ব্রোকেন হার্ট পর্ব-৭

0
982

#ব্রোকেন_হার্ট
লেখাঃ মান্নাত মিম

|৭|
“হাত ছাড়।”

ব্যক্তিগুলো সম্ভবত কথাটা শুনতে পায়নি। কারণ এখনো আমার হাত ধরে টানাহেঁচড়া করছে তারা। তবুও ছেড়ে দেওয়ার শব্দগুলো পুনরাবৃত্তি হয়।

“আমি কি বলছি তোরা শুনতেও পাসনি, না কি? হাত ছাড়া মেয়েটার।”

শক্ত-পোক্ত, গাম্ভীর্যের গড়া কণ্ঠস্বর আমার কাছে নতুন লাগছে। না কি মানুষটাকে চেনা হয়নি? সময়ই বা পেলাম কোথায় তাকে জানার? অল্প কয়েক পলকের দেখা মুখ, মাহাত্ম্য বোধ নিয়ে মনমানসিকতার এন্ডারসনকে বোঝা হয়ে উঠেনি এখনো আমার।

কাজ শেষে কতক্ষণ সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব ভেবে একপ্রকার রিস্ক নিয়েই বাইরে পা রাখি। বাড়ি ফেরা প্রয়োজন। পিছু ঘুরে একবার পরখ করে দেখেও ছিলাম, কেউ পিছু নিয়েছে না কি। কিন্তু নাহ, কাউকে দেখা যায়নি। তবে ওইযে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে ছিলাম, অথচ সামনেই যম দাঁড়ানো। ভয়ে দু-পা পিছিয়ে গেলাম। বারে থাকা তিনজন’ই সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে তাদের সাথে যেতে বলে। মুখের কথা না কি বললেই যাব। আমি-ও তাদের পথ ছাড়ার জোরদার দাবি করি। কিন্তু মেয়ে মানুষ বিধায় তাদের সাথে পারি না। তারা-ও জোর করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখনই এন্ডারসন এসে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে তাদের। বয়স্ক লোকটি আমার হাত ধরে রেখেই বললেন,

“উহুম, কোন ছাড়াছাড়ি নেই। এটা আজকে আমাদের আহার। তুমি কে ভাই মাঝে এসে বাগড়া দিচ্ছো?”

“ওয়েল, ওয়েল। আমি যেই হই না কেন, তোদের যমদূত আজকের জন্য।”

বলেই এন্ডারসন এক হাতে ঘুষি দিলো যে কি না আমার হাত ধরে রেখেছিল এতক্ষণ যাবৎ। ফলে আমার হাত ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ল লোকটা। ছেলে দু’টো এবার এন্ডারসনের ওপর হামলা করতে এলো হাতে চাকু নিয়ে। এমন সময় পিছন থেকে পুলিশ অফিসার এসে হাত ধরে ফেলেন। নিচে পড়ে থাকা লোকটাকেও আটক করে। আমি হতবাক হয়ে সবার মাঝে চোখ ঘুরিয়ে কেবল দেখা ছাড়া আরকিছুই করতে পারছিলাম না। কখন এন্ডারসন পুলিশে কল করল, আর আমার পিছনেই বা কীভাবে এলো? তার তো ক্লাবে থাকার কথা।

“থ্যাংকস অফিসার।”

পুলিশ অফিসারের সাথে হাত মিলিয়ে কথা বলে আমার কাছে এগিয়ে এলো এন্ডারসন। মৃদু হাসি দিলো। গালে টোল না পড়লেও হালকা গর্ত হলো। দেখতে অমায়িক লাগল। একইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বলল,

“কী হলো তাকিয়ে আছো যে?”

“ম…মানে আপনি কখন… কী?”

“তোমাকে বার কাউন্টারে দেখেছিলাম। তোমার প্রতি লোকগুলোর হয়রানিও খেয়াল করেছিলাম। তারপরেই রিনকে পাঠিয়েছিলাম বিষয়টা দেখে আমাকে জানানোর জন্য। সে এসে আমাকে খুলে বলে। ভেতরে ঝামেলা করতে চাইনি। বাইরে তোমাকে যে আটকাবে বুঝতে পেরেই পুলিশ করল করে রেখেছিলাম। আর তোমার পিছনে এসে… বুঝেছ আশা করি। বায় দ্য ওয়ে, তোমার কোথাও লাগেনি তো?”

এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলল। এতকিছু ঘটিয়ে ফেলল লোকটা! বিস্ময়ে আমি বিমূর্তি প্রায়। মনের মধ্যে হাজারো প্রজাপতির আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। বন্ধ করে রাখা দোর ফের খুলে গেল এন্ডারসনের একটু ছোঁয়ায়। জ্ঞান হারাতেও পারি যেকোনো সময়। দমিয়ে রাখা ভালোবাসার যেন পুনর্জাগরণ হলো। অন্ধকারের মাঝেও উজ্জ্বলতার আলো সৃষ্ট হলো যেন। মিটিমিটি তারা খসে আমাদের চারপাশে জ্বলজ্বল করতে লাগল মনে হয়। কিন্তু সব থমকে গেল এন্ডারসনের এককথায়।

“আচ্ছা, ক্যাব বুক করে দিয়েছি বাড়ি চলে যেও। ক্যাপ্রিনা আমার অপেক্ষা করছে।”

বাড়ি থেকে অনেকটা দূরের পথ করেই ক্লাবে কাজ করতে আসা। সেই কারণেই ক্যাব বুক করে দিয়েছে এন্ডারসন। অবশ্য আমি সাইকেল দিয়েই আসি তবে সে তো তা জানে না। আমার চোখ হঠাৎই অশ্রুর ফোঁটা অনুভব করলাম। লাগবে না সাহায্য আমি একাই চলে যেতে পারব। সেজন্য এন্ডারসনেড কথা উপেক্ষা করে পার্কিং লট থেকে নিজের সাইকেল নিতে গেলাম। তখন এন্ডারসন এসে হাত ধরে বলল,

“একা যাওয়া সেফ নয়। অপেক্ষা করো একটু।”

ওহ্! তাহলে এই ব্যাপার। আমার সেফ দিয়ে তার কী?

“প্রতিদিনই আসা-যাওয়া করব এখানে। আমার কর্মস্থল এটা। তখন কী সেফ থাকব?”

একদম এন্ডারসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম। প্রশ্নটা সঠিক ছিল বিধায় কোন প্রত্যুত্তর করতে পারল না এন্ডারসন। আমি তার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে সাইকেলে চড়ে বসলাম। একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অসহায়, বিষণ্ণ করা মুখ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে। হয়তো আমার এমন আচরণ তার বোধগম্য হচ্ছে না। চিন্তা করছে প্রথম দেখা শান্তশিষ্ট, মিষ্টি হাস্য আমি’র সাথে এই বিরূপধারী, গাম্ভীর্যের মোড়া আমি’র অমিল। সেই চিন্তার রেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিতে আমি তখন বলে উঠলাম,

“আপনি কখনো আমার সামনে আসবেন না। কক্ষনোই না।”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এন্ডারসনকে ফেলে আমি চলে যেতে লাগলাম নিজের পথে।
_______

ভালোবেসেছিলাম, হয়তো বা এখনো বাসি। অন্তরালের অনুভূতিতে আবছায়া হয়ে থাকবে সে, স্বপ্নে আসবে যাবে কিন্তু সম্মুখে সে না কখনো তা জানবে। ভালোবাসার অনুভূতি এমন তিক্ত, রিক্ত, বিষাক্ত হলে কখনোই ওমন সুন্দর, মহৎপ্রাণ মানুষটাকে ভালোবেসে মরতাম না আমি। কিন্তু বেসে ফেলেছি যে। এখন শুধু দহনে পুড়ে জ্বলিত হই।

উজ্জীবিত আলোর প্রভাব মুখের ওপর পড়তেই চক্ষুযুগল মেলে তাকাই। এমন না যে আমি ঘুমে মশগুল ছিলাম। সারারাত নির্ঘুম চোখ আমার রক্তাভ ধারণকৃত। একে তো লোকগুলোর জোরজবরদস্তির বিষাদময় স্মৃতি উপরন্তু এন্ডারসনের সাথে করা আমার মন্দ আচরণ ভেতরে ভেতরে মূর্ছায় দিচ্ছিল। যার ফলস্বরূপ সারারাতের এই নির্ঘুমতা।

“ইমি, ইমি! জলদি ওঠো। নাস্তা রেখেছি।”

বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে একেবারে ভার্সিটির উদ্দেশে পরিপাটি হয়ে নিচে নামলাম। দেখি টমাস নেই শুধু মাম্মা বসে। বোধহয় আমার সাথে লোন কথা বলার আছে। নাহয় আমার জন্য এভাবে অপেক্ষা করতেন না। নাস্তদর টেবিলে বসে নাস্তা শুরু করে আঁড়চোখে মাম্মার হাবভাব দেখে আগ বাড়িয়েই জিজ্ঞাসা করলাম,

“কিছু বলতে?”

“হুম, কাজের কী খবর? যাচ্ছো, আসছ তাই হালচাল জিজ্ঞেস করছি।”

“ভালো।”

আমি বেশিকিছু বললাম না। আর না গতকাল রাতের কথা জানালাম। এমনিতেই কিছুদিন হলো সুস্থ হয়েছেন একটু-আধটু। এখনই টেনশন দেওয়ার কোনো মানে হয় না।

“আসলে ঋণের টাকা দেওয়ার সময় হয়ে আসছে। আবার ঘরের কাঁচাবাজার নেই। তাই আগেভাগে বেতনটা…”

এবার বুঝলাম আসল কথা। ঘরে আসলেই কিছুই নেই। আমাদের জমানো যা ছিল মাম্মার ওষুধপত্র কিনতে খরচ হয়ে গেছে, তাও ভালো হসপিটালের বিল দিতে হয়নি। ক্রিশ্চান দিয়ে সাহায্য না করলে অথৈ জলে ডুবে মরতাম।

“আচ্ছা আমি দেখছি।”

বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। সাইকেল নেওয়ার ইচ্ছা নেই। আজ ক্লাস করব না ভাবছি৷ মাম্মাকে ‘আচ্ছা, দেখি’ বলে আশ্বস্ত বাণী শুনিয়েও কোনো লাভ নেই। কাজের তিনদিনের মাঝে কে-ই বা বেতন আগে আগে দিবে? যত্তসব আজগুবি চাহিদা! একবার ভাবলাম, ক্রিশ্চানের কাছে চাইব না কি, পরে আবার দিয়ে দিব এই আশ্বাসে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, ছেলেটা কম করেনি আমার জন্য, আমাদের জন্য। সে-ও তো একজন ছাত্র মানুষ। তার বাসা থেকে পরিমিত পরিমাণে হাতখরচা তাকে দেওয়া হয়। সেখান থেকে আমি… না থাক। এটাও বাদ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নির্জন স্থানে সবুজের সমারোহে গাছপালা ঘেরা বালুচরে দর্শনীয় স্থানে এলাম। রেইনট্রি, পাইন এসবের মাঝে নারকেল গাছ-ই এখানে বেশিরভাগ জায়গা করে নিয়েছে। সেই গাছের ছায়াতলে বসে আছি। কান্না পাচ্ছে, তবুও শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। হয়তো বাতাসের তোড়ে চোখের জল শুকিয়ে আছে। বাতাসের শোঁশোঁ, বাজপাখির শব্দ ছাড়া। সামনেই সমুদ্র তবে অন্যপাশে পর্যটকের ভিড়। মানুষজন একদমই নেই। সেই নিশ্চুপ, নির্জন স্থানের বুক চিড়ে একজন মানুষের আগমন ঘটল। যা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। আশা করিনি। ভাবছি দিনদুপুর স্বপ্নের ঘোরে উলটাপালটা দেখছি না তো? কিন্তু নাহ, সত্যিই দেখছি যখন সমুখে এসে এমন একটা প্রশ্ন করে বসলো তখন ভুলটুল দেখার কথাই আসে না।

চলবে…

যারা পড়েন তারা প্লিজ সকলেই রেসপন্স করবেন 💝

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here