ভরসার_দুহাত পর্ব_২

0
579

#ভরসার_দুহাত
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২

বাসায় পৌঁছে উমায়ের সোফার উপর ব্যাগ রেখে পাশে বসলো। কিছুক্ষণ পর বাবা আসলেন। উনি দ্রুত হেটে রান্নাঘরে চলে গেলেন। উমায়ের সোফায় হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। হঠাৎ কপালে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো। স্পর্শটা পেয়ে মুচকি হেসে চোখ খুলল। তার সামনে তার আম্মু দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় হিজাব হাতে তাসবীহ্। উমায়ের এর সকল ক্লান্ত দূর হয়ে গেল মাকে দেখে। মা উমায়ের এর পাশে বসে বললেন-
“কী ব্যাপার, আজ তুমি তারাতাড়ি এসে পড়লে যে?”
“১টা ক্লাস হয়নি। ম্যাম আসেনি আজ ভার্সিটিতে।”
তখনই বাবা আসলেন। উমায়ের এর মা নুসাইফা বেগম স্বামীকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললেন-
“আপনি রান্নাঘরে কেন গিয়েছিলেন?”
“কেন আমার রান্নাঘরে যাওয়া মানা?”
সোফায় বসতে বসতে ফিরোজ আনোয়ার জবাব দিলেন। নুসাইফা বেগম রাগে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলেন। সবসময় উত্তরের বদলে আর একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারেন ফিরোজ আনোয়ার। আপাতত উনি রাগকে দমানোই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন। দাঁড়িয়ে উমায়ের এর উদ্দেশ্যে বললেন-
“তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নও। রান্না হতে দেরি হবে। আমি ডিম ভেজে দিচ্ছি টোস্ট দিয়ে খেয়ে নাও।”
“আমার ক্ষুধা নেই আম্মু।”
নুসাইফা বেগম কিছু বলার আগেই ফিরোজ আনোয়ার বললেন-
“ফ্রিজে আইসক্রিম রেখেছি মেয়েকে এনে দাও৷ আর আমার রাজপুত্ররা কোথায়?”
“ওরা ক্রিকেট খেলছে গিয়েছে মাঠে। এসে পরবে হয়তো।”
“কেন ছেলেদের বাহিরে যেতে দাও বলো তো। কিছুদিন আগেও উজ্জ্বল পায়ে ব্যাথা পেয়ে এসেছে।”
“এখন ছেলেটা বানরের মতো লাফালাফি করলে আমার দোষ? উসমানের কাছে মোবাইল দিয়েছি আপনি কল দিয়ে বলুন আসতে।”
কথা শেষ করেই নুসাইফা বেগম নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন। উমায়ের উঠে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে মুচকি হাসলো। পুরো ঘর মা গুছিয়ে ফেলেছেন। উমায়ের প্রতিদিন সকালে ভার্সিটির জন্য তৈরী হতে গিয়ে ঘরের ১২ টা বাজিয়ে ফেলে। আর মা প্রতিদিন সুন্দর করে সব গুছিয়ে রাখেন। খাটের উপর ব্যাগ রেখে ড্রয়ার থেকে জামা বের করে বাথরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখে মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখে রুম্মান কল দিয়েছে। খাটে বসে রিসিভ করে কানে ধরলো-
“হ্যাঁ বল।”
“দোস্ত বাসায় পৌঁছে গিয়েছি আমি।”
“এত দেরি হলো কেন?”
“আরে অনেক আগেই পৌঁছে ছিলাম কিন্তু কল দেয়ার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো।”
“ওহ, লাঞ্চ করে নে। আর এক্সামের পড়া পড়তে ভুলিস না আমাদের সিট প্রতিবারের মতো এইবারো আলাদা হবে।”
“জল্লাদ শিক্ষক সব, আচ্ছা মজাদার কথা শুন।”
“বল”
“তোর মজনুকে দেখেছি।”
উমায়ের থমকে গেল। রাগ হচ্ছে না তার এখন। কিন্তু রুম্মান সামনে থাকলে ঠিক একটা চড় পরতো তার গালে। উমায়ের এর জবাব না পেয়ে রুম্মান আবার বলল-
“কি হলো? শুনিস নি নাকি না শোনার এক্টিং করছিস?”
“শুনেছি, তুই আমাকে এটা বলার জন্য কল দিয়েছিস?”
“হ্যাঁ, দিন দিন তোর মজনু হ্যান্ডাম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে আজ তোর মজনুকে একটা মেয়ের হাত ধরে হাঁটতে দেখেছি।”
“তো?”
“তো? তোর কষ্ট হচ্ছে না।”
উমায়ের বিরক্ত হয়ে বলল-
“ও একটা মেয়ের হাত ধরুক বা ১০ টা তাতে আমার কি? এসব বলার জন্য যদি তুই আমাকে আবার কল দিস তোর খবর আছে বলে দিলাম। কল রাখ এখন।”
বলেই উমায়ের কল কেটে দিলো। রুম্মান হা হয়ে ২ বার চোখের পলক ফেলল। উমায়ের তাকে কল রাখতে বলে নিজেই রেখে দিলো। মেয়েটা আসলেই পাগল।
উমায়ের মোবাইল রেখে দাঁড়িয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় গেল। মন খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ করে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ছাড়লো।

অন্যদিকে…..
বুরাক ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে অনেক মানুষ এখন সে যার সাথে দেখা করতে এসেছে তাকে কিভাবে চিনবে বুঝতে পারছে না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে রাশিদ খানকে কল করলো। রিং বাজছে কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। বুরাক মোবাইল আবার পকেটে রেখে দিলো। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ পেছন থেকে কারো ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ আসলো।
“তুমি যার সাথে দেখা করতে এসেছো আমিই সেই। পেছনে ফিরতে হবে না এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে৷ তুমি পেছনে ফিরতেই দেখতে পারবে কালো রং গাড়ি রয়েছে। গিয়ে পেছনের দরজা খুলে একটা লাগেজ দেখতে পাবে। রাশিদ খানের আমানত সেটার ভেতর। আমি এখান থেকে সরে যেতেই পেছনে ফিরো এর আগে না।”
বুরাক কিছু বলার আগেই পেছনে থাকা মানুষটা চলে গেল। বুরাক তাকে দেখতে পারলো না। বুরাক ডান বাম দেখে পেছনে ফিরলো। কালো রং এর গাড়ি দেখা যাচ্ছে। ধীরপায়ে সেখানে হেটে গিয়ে পেছনের দরজা খুলল। লাগেজ রাখা, লাগেজ নিয়ে দরজা বন্ধ করে হাঁটা ধরলো দ্রুত। বুরাক বাড়ি পৌঁছে দেখে রাশিদ খান সোফায় বসে টিভি দেখছে। বুরাক লম্বা নিশ্বাস ফেলল। টিভির ভেতরে হয়তো ঢুকে পড়েছিল তাই কল টন শুনে নি। বুরাক গিয়ে টেবিলের উপর লাগেজ রাখলো। রাশিদ খান ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যাগ দেখে দ্রুত সোজা হয়ে বসে হাসিমুখে বলল-
“এত তারাতাড়ি নিয়ে আসলে? বসো বসো তোমার জন্য নাস্তা আনতে বলছি।”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি লাগেজ খুলে দেখুন সব ঠিক আছে কিনা।”
“হ্যাঁ দেখে নিব তুমি যাও এখন।”
বুরাক হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে বলল-
“লাগেজ খুলুন।”
“বুরাক, আমাকে অর্ডার দিও না। আমার এই বিষয়টা ভালো লাগে না তুমি জানো।”
“বস আমাকে বলেছেন আপনার উপর নজর রাখতে। তো এটা আমার কর্তব্য। আপনি কি আনিয়েছেন আমার দেখতেই হবে।”
“বেশী বাড়াবাড়ি করছো।”
“অতীতে কি হয়েছিল ভুলে যাবেন না ছোটো বস।”
রাশিদ খান চুপ হয়ে গেল। রাগে তার গা জ্বলছে। এই ছাড়া আর কোন উপায় নেই। লাগেজ খুলে বুরাককে দেখালো। বুরাক ভ্রু কুঁচকে বলল-
“স্লো পয়জন, আমি কি জানতে পারি আপনি কেন এটা আনিয়েছেন?”
“তোমাকে সব কিছু বলা আমি ঠিক মনে করছি না। যাও এখান থেকে। ভাইজানকে আমি সামলে নিব।”
“ইলেকশন সামনে আসছে আর আপনি এসব কুকর্ম করার চেষ্টায় আছেন?”
“বুরাক শাহরিয়ার শাহ বেশী কথা বলো না। তুমি কি ভুলে যাচ্ছো তুমি কে? তুমি সামান্য একজন কাজের লোক আমাদের। যাকে আমার ভাই মাথায় তুলে রেখেছে।”
বুরাক ধীরপায়ে হেটে গিয়ে রাশিদ খানের বরাবর দাঁড়াল। বুরাকের রাগী দৃষ্টিটা দেখে রাশিদ খান ভয় না পেয়ে পারলো না। এই ছেলের উপর ভরসা নেই। নিখুঁত ভাবে মার্ডার করে ফেলে কেও টেরও পায় না। আশে পাশে কেও নেই এখন যদি বুরাক তাকে মেরে ফেলে চলে যায় কেও টেরও পাবে না কি হয়েছিলো। আর তার বড়ো ভাই অন্ধ বিশ্বাস করে বুরাকের উপর। সে তো সন্দেহ করার কথা ভাববেও না। বুরাক শান্ত গলায় বলল-
“লেকশন যত পর্যন্ত শেষ না হবে স্লো পয়জন নিজের যত্নে রাখুন। আমি যদি কোন জায়গা থেকে খবর পাই খাবারে ভেজাল মেশানোর কারণে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে আপনাকে সর্বপ্রথম ধরবো।”
এইটুকু বলে বুরাক পেছনে ফিরে হাঁটা ধরলো। রাশিদ খান রাগী কন্ঠে বলল-
“তুমি আমাকে হুমকি দিচ্ছো?”
বুরাক দাঁড়িয়ে পরলো। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল-
“উহু, লাস্ট ওয়ার্নিং।”

রাতেরবেলা…..
হলরুমে মানুষ ভর্তি উমায়ের যেতে পারছে না কারণ বাবা না বলেছে বের হতে। এই বাসায় কারো ঘরে টিভি নেই হলরুমে একটা টিভি রাখা শুধু। উমায়ের এর প্রিয় রিয়েলিটি শো শুরু হয়ে গিয়েছে। রাগে উমায়ের এর কান্না আসছে। যবে থেকে বাবা ইলেকশনে নাম দিয়েছে তবে থেকে তার জীবন উলট পালট হয়ে গিয়েছে। এলাকার অনেকে এখন থেকেই তার বাবাকে চেয়ারম্যান বানিয়ে বসে আছে। আর সাহায্যের জন্য উনার কাছেই আসে। যাক এটা ভালো কথা। উমায়ের এর বেশ গর্ব অনুভব হয় এই নিয়ে৷ কিন্তু এসবের কারণে তার পরিবার আর আগের মতো নেই। সবসময় মনে এক ভয় থাকে। এই বুঝি কারো ক্ষতি হয়ে গেল। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ আসলো। উমায়ের ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে উসমান আর উজ্জ্বল এসেছে। উসমান আর উজ্জ্বল উমায়ের এর ছোটো ভাই। দুজন জমজ, দেখতে একদম এক। উসমান শুধু উজ্জ্বল থেকে একটু লম্বা আর চিকন। উমায়ের মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। দুজন দ্রুত পায়ে হেটে এসে উমায়ের এর পাশে বসলো। উজ্জ্বল নিচু স্বরে বলল-
“আপি, জানো কি হচ্ছে নিচে?”
“না, জানতে চাই না মুখ বন্ধ রাখ।”
উসমান বলল-
“আরে আপি শুনে তো দেখো, তুমি খুব হাসবে শুনলে।”
“আচ্ছা বল, এমনিতেও মন খারাপ। একটু হাসতে পারলে ভালো লাগবে।”
“নিচে একজন ভদ্রলোক এসেছে।”
“একজন? আমি তো ১০ জনেরও বেশী মানুষ দেখলাম।”
“আরে আপি পুরো কথা তো শুনো, সেই ১০ জনের মধ্যেই একজন। দেখতে জলহস্তির মতো। শুনলাম উনি নাকি ইলেকশনে দাঁড়াতে চান। তাই আব্বুকে হুমকি দিতে এসেছে।”
উমায়ের চমকে বলল-
“বলিস কি? আব্বু-আম্মু ঠিক আছে তো। আব্বুর কোন ক্ষতি করে নি তো?”
উজ্জ্বল বিরক্ত হয়ে বলল-
“আহা আপি, নিচে আমাদের বডিগার্ডরা আছে তো। তুমি টেনশন না নিয়ে শুনো চুপচাপ।”
“আচ্ছা বল”
উসমান আবার বলা শুরু করলো-
“হুমকির কথা শুনে আব্বু হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। সেই মানুষটা রেগে আগুন হয়ে বলে আব্বু যদি নাম তুলে না নেয় তাহলে আমাদের সবার ক্ষতি করবে সে। আমাদের বডিগার্ডরা তার কলার ধরে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো লাঠি চার্জ করেছে। শুধু তাই না একজন তো ভিডিও করেছে তার হুমকির।”
উসমান আর উজ্জ্বল হাসতে হাসতে খাটে শুয়ে পরলো। উমায়ের থতমত খেয়ে বসে আছে। এতে সে হাসির কিছু খুঁজে পেল না। উল্টো তার ভয় করছে। উসমান আর উজ্জ্বল ছোটো, তাই এসব বিষয় তাদের কাছে কিছু না। কিন্তু উমায়ের তো সব বুঝে। তার ভয় আরো বেড়ে গেল এই ঘটনা শোনার পর। তার মন বলছে এই ইলেকশনের ঋণ তাকে আজীবন শোধ করতে হবে।

ভোট শুরু হবে আগামীকাল থেকে। আজ পুরো এলাকায় পোস্টার লাগানোর কাজ সম্পূর্ণ হলো। বুরাক নিজের হাতে সব করেছে। শুধু তাই না বাসায় বাসায় গিয়ে টাকা দিয়ে এসেছে যাতে খালিদ খানকে সবাই ভোট করে। খালিদ খান যেভাবেই হোক জিততে চায়। যদি খালিদ খান না জিতে এলাকায় আগুন লাগিয়ে দিবে। এই ২ মাসে ১০ কোটিরও বেশী খরচ করেছে এলাকার মানুষদের পেছনে। এইটার শোধ তো সে তুলবেই। বুরাক পকেটে হাত দিয়ে চারপাশে চোখ বুলালো। খালিদ খানকে সে বেশ সম্মান করে। তার বসের ছবি চারপাশে দেখে তার বেশ আনন্দ হচ্ছে আজ। হঠাৎ তার মোবাইলের টন বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে খালিদ খান কল দিয়েছে। তারাতাড়ি রিসিভ করলো-
“ইয়েস বস।”
“কোথায় তুই?”
“পোস্টার লাগাতে এসেছিলাম। কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে এখন বাসায় ফিরছি।”
“আচ্ছা, একটা সাহায্য লাগবে।”
“হ্যাঁ বলুন”
“আমি তোর বিকাশে কিছু টাকা পাঠাচ্ছি। টাকাগুলো তুলে আসার সময় বৃদ্ধা আশ্রমে দিয়ে আসিস। আর হ্যাঁ ভোট করার কথা বলতে ভুলিস না।”
“জি বস হয়ে যাবে।”
“তুই না থাকলে আমার কি হতো রে বুরাক?”
“বার বার এক কথা আমার পছন্দ না। রাখছি এখন আপনি বিশ্রাম নিন।”
বলেই বুরাক কল কেটে দিলো। খালিদ খান কান থেকে মোবাইল সরিয়ে হাসলেন।

বুরাক বৃদ্ধা আশ্রমের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। এখানে কাওকেই দেখা যাচ্ছে না কিন্তু ভেতর থেকে হৈহল্লার শব্দ আসছে। বুরাক হেটে ভেতরে গেল। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে কারো জন্মদিন। সে সেখানেই বসে রইলো। এখানে অনেক বৃদ্ধ মানুষ রয়েছে। বুরাকের মায়া হলো। এইখানে অনেকেই সন্তানের অবহেলায় এসে ঠাই নিয়েছে। আবার অনেকেরই পৃথিবীতে কেও নেই। হঠাৎ বুরাক পেছন থেকে কারো কন্ঠ শুনতে পেল।
“কাকে চাই?”
বুরাক পেছনে ফিরলো। ২০/২১ বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুরাক এক নজর আবার সবার দিকে দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি আশ্রমের মালিকের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
“জি বলুন”
বুরাক কিছুটা অবাক হলো। এই মেয়ে কি এই আশ্রমের মালিক? বুরাককে বেশ ভাবনায় ফেলল মেয়েটা। বুরাকের অবাক চেহারা দেখে মেয়েটা হেসে বলল-
“অবাক হতে হবে না। আশ্রম আমার বাবার। উনার মৃত্যুর পর আমিই দেখাশোনা করি।”
বুরাক মেয়েটাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল-
“এত কম বয়সে আপনি এই আশ্রম একা দেখাশোনা করেন?”
“না আমার মামা এবং আম্মু সাথে আছে। আমি আপনার কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন।”
“আমি আসলে কিছু টাকা ডোনেট করতে এসেছিলাম।”
“আপনাকে ধন্যবাদ, আমার সাথে আসুন।”
বুরাক মেয়েটার পেছন পেছন গেল। একটা হলরুম, যেখানে অনেকগুলো হুইলচেয়ার রাখা। মাঝখানে বসার জন্য টেবিল রয়েছে। মেয়েটা বুরাককে বসতে বলে ভেতরে চলে গেল। বুরাক বসে মেয়েটার অপেক্ষায় রইলো। কিছুক্ষণ পর৷ মেয়েটা আসলো। হাতে কলম এবং খাতা নিয়ে। বুরাকের বরাবর বসে নাম, ফোন নাম্বার সব নিলো। বুরাক টাকা এগিয়ে দিতেই মেয়েটা বলল-
“আপনি কেন চান খালিদ খান জিতুক জানতে পারি?”
“আমি উনার জন্য কাজ করি।”
“তাই বলে এমন জঘন্য একজন মানুষকে জেতাতে চান?”
বুরাক ভ্রু কুঁচকালো। মেয়েটা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুরাককে চুপ থাকতে দেখে বলল-
“আমি সব জানি তার সম্পর্কে। তাই অবাক হতে হবে না। আপনি তার জন্য কি ধরণের কাজ করেন সেটাও জানি। থাকগে, এই টাকা হালাল হোক বা হারাম আপাতত এটা নিয়ে ভাবছি না। এই আশ্রমের অবস্থা বেশ খারাপ। আমার প্রত্যেক বাবা মায়ের খাবারের কমতি আমি হতে দিতে পারবো না। তাই টাকাটা আমার রাখতে হচ্ছে।”
বুরাক জবাব দিলো না। জীবনে প্রথমবার সে লজ্জিত হলো। মেয়েটা এই বয়সে বেশ ভারী ভারী কথা বলেছে।
“আমার এক বাবার আজ ৭২তম জন্মদিন কেক খেয়ে যাবেন প্লিজ।”
কথাটা বলেই মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। বুরাক আমতা আমতা করে বলল-
“আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?”
মেয়েটা বুরাকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল-
“আকলিমা”
বুরাকের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। বুরাক সবার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে কেক খেয়ে বেড়িয়ে পরলো আশ্রম থেকে।

উমায়ের ভার্সিটির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। আজ পুরো ৮ দিন সে আসছে না। যখন ছেলেটা তার পিছু করতো উমায়ের এর বেশ রাগ হতো। আর এখন যেহেতু ছেলেটা আসে না তার মন খারাপ হচ্ছে।রুম্মান একা একা বকবক করতে করতে এসে দেখে উমায়ের দাঁড়িয়ে আছে। উমায়ের এর সামনে গিয়ে দেখে মেয়েটা কোথায় যেন হারিয়ে আছে। রুম্মান উমায়ের এর মাথায় আলতো করে থাপ্পড় মেরে বলল-
“কিরে কোথায় তুই?”
উমায়ের মাথা ডলতে ডলতে বলল-
“তুই ভালো হবি কবে? কতবার বলেছি তুই আসলে আমাকে নাম ধরে ডাক।”
“তোকে টাচ ন করলে আমার ভালো লাগে না।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ আমি জানতাম তোর মধ্যে গাবলা আছে। দূর হো এখনই।”
“কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস ছি।”
“তো আর কি করবো?”
“তোর সাথে কথা বলাই বেকার। এখন বল কার চিন্তায় হারিয়ে ছিলি?”
“কই কারো না।”
“লুকাতে হবে না। এখনই বল।”
উমায়ের জবাব দিলো না। মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেলল। রুম্মান মুখ বাঁকা করে বলল-
“আমি জানতাম তুই তোর মজনুর জন্য লেলা হয়ে গিয়েছিস।”
“ইয়ার প্লিজ তুই এসব কথা বলিস না। আমার মনে তার জন্য কিছুই নেই। এখন চল বাসায় যাওয়া যাক।”
“আচ্ছা চল আমি জানি তুই ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই বলবি যে তুই মজনুর জন্য লেলা হয়ে গিয়েছিস।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ হয়েছে এবার হাট।”
উমায়ের আর রুম্মান হাঁটা ধরলো। দুজন একসাথে হলে পুরো দুনিয়া ভুলে যায়। হাসিঠাট্টা তাদের মুখে থাকবেই থাকবে। রুম্মানের বাসা সামনে তাই তারা পৌঁছে গেল। রুম্মানকে বাসার সামনে দিয়ে উমায়ের হাঁটা ধরলো। বাসায় গিয়ে সে লম্বা ঘুম দিবে ভেবেছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তার। যাওয়ার পথে হঠাৎ রাস্তার কিনারায় একটা ছেলে বাচ্চাকে দেখলো। বাচ্চাটা দাঁড়িয়ে কান্না করছে। উমায়ের দ্রুত তার সামনে হেটে গেল। বাচ্চাটার বয়স ৭/৮ বছর হবে। উমায়ের বাচ্চাটার কাঁধে হাত রাখতেই বাচ্চাটা ঘাড় তুলে তাকালো। উমায়ের হাঁটু ভেঙে বসে বলল-
“কি হয়েছে বাবু তুমি কাঁদছো কেন?”
“আম্মু চলে গেছে আপু।”
“কোথায় চলে গেছে?”
“ওখানে”
বাচ্চাটা আঙুল দেখিয়ে সামনের দিকে দেখালো। কিন্তু উমায়ের কিছু বুঝতে পারছে না। সে কিছুক্ষণ ভেবে ডিসাইড করলো বাচ্চাটাকে পুলিশ স্টেশন নিয়ে যাবে।
“চলো আমরা পুলিশের কাছে যাই।”
“না আমি আম্মু যাব।”
“কিন্তু আমি তো আপনার বাসা চিনি না। কিভাবে নিয়ে যাব আপনাকে?”
বাচ্চাটা মুখ লটকালো। উমায়ের এর মায়া হচ্ছে বেশ। সে ভাবছে তারও দু’টো ভাই আছে কোনদিন যদি তাদের সাথে এমন হতো তখন? উমায়ের মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে বলল-
“ঠিক আছে আমরা এখন আপনার বাসায় যাব।”
বাচ্চাটা তারাতাড়ি চোখ মুছে হাসলো। উমায়ের এর মন ভালো হয়ে গেল তার হাসি দেখে। হঠাৎ উমায়ের খেয়াল করলো বাচ্চাটার শার্টের পকেটে একটা কাগজ একটু বেরিয়ে আছে। উমায়ের কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে ছোটো চিরকুট। চিরকুটটা খুলে দেখে কিছু লিখা আছে।
“আসসালামু আলাইকুম, আমি এই বাচ্চাটার মা। ওর নাম ফারহান। আমি মানসিক অসুস্থতায় ভুগছি। অনেক সময় রাস্তায় বের হলে ভুলে যাই সব কিছু। আমার ছেলেকে একা রেখে কোথায় চলে যাই নিজেও জানি না। আপনি যেই হোন দয়া করে আমার ছেলেকে নিচে থাকা এড্রেসে দিয়ে আসুন। এটা আমাদের বাড়ির ঠিকানা। বাসায় তার দাদা দাদী রয়েছে। আমি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আমার ছেলের কাছে ফিরে যাব। আমার বাচ্চাটার সাহায্য করুন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
উমায়ের চিঠিটা পড়ে ফারহানের দিকে তাকাল। বাচ্চাটা এদিক সেদিক দেখছে। উমায়ের এর মায়া বেড়ে গেল। তার মা হয় তো আবার ভুলে গিয়েছে ছেলেকে। উমায়ের বাচ্চাটার হাত ধরে চিরকুটে থাকা এড্রেসের উদ্দেশ্যে হাটা ধরলো। ভার্সিটি থেকে অনেকটাই দূর। উমায়ের অবাক না হয়ে পারলো না। এত দূর কেন এসেছিল ফারহানের মা সে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর তারা এড্রেসে পৌঁছে গেল। ফারহান উমায়ের এর হাত ছাড়িয়ে দৌড়ের বাড়ির ভেতর ঢুকে পরলো। উমায়েরও দ্রুত তার পেছনে গেল। ভেতরের দরজা খোলা। উমায়ের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়েই ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। ফারহান হঠাৎ কোথায় গেল সে বুঝতে পারছে না। উমায়ের ভাবলো ভেতরে যাওয়া দরকার। তার দাদা দাদীর সাথে কথা বলতে হবে। উমায়ের ভেতরে গেল। বেশ গোছানো ড্রইংরুম। চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিলো তখনই চারপাশের লাইট চলে গেল। উমায়ের ভয় পেয়ে গেল হঠাৎ অন্ধকার ছেয়ে যাওয়ায়। পেছন থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ আসলো। উমায়ের পেছনে ফিরলো। চারপাশে একদম অন্ধকার ছেয়ে আছে।দু’তিন বার ফারহানের নাম ধরে ডাকলো কিন্তু কেও জবাব দিচ্ছে না। হঠাৎ একটা লাইট জ্বলে উঠলো। উমায়ের দ্রুত পেছনে ফিরলো। ভেতরের ঘর থেকে দুজন লোক বেরিয়ে আসলো। দুজনকে দেখে উমায়ের ঢোক গিলল। দুজনের চেহারায় পৈশাচিক ভাব ভেসে বেড়াচ্ছে। উমায়ের পিছিয়ে গেল। হঠাৎ পেছনে কারোর সাথে ধাক্কা লাগলো। উমায়ের দ্রুত পেছনে ফিরলো। মানুষটাকে সে চিনলো না। উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে লোকটা দাঁত বের করে হেসে বলল-
“হ্যালো বেবি গার্ল।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here