#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sohani_Simu
১৩.
হসপিটালে ঢুকতেই ফিনাইলের কটু গন্ধে এক হাতে নাক চেপে ধরলো অন্ত।নির্ভীকের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখলো একটু দূরেই দুটো লোক ফিনাইল দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করছে।কিছুটা দূরে একটা ছোট ছেলে দুই পায়ে ফ্রাকচারের ব্যান্ডেজ নিয়ে হুইল চেয়ারে বসে থেকে কান্না করছে।তার ঠিক পাশেই পুরোনো আর বেশ নোংরা সোফায় বসে একটা বয়স্ক লোক কন্টিনিউয়াসলি কেশে যাচ্ছে।অন্তর এসব দেখে গা ঘিন ঘিন করছে।মনে মনে ইয়াক ছি করতে করতে নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
‘আমরা হসপিটালে কেন এসেছি নির্ভীক?’
নির্ভীক অন্তকে নিয়ে লিফটে ঢুকে বলল,
‘ডক্টর তোমাকে চেকআপ করবে সেজন্য।’
অন্ত নির্ভীকের হাত ছেড়ে দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘কেন চেক আপ করবে আমি তো ভাল হয়ে গিয়েছি।মাথাব্যথা করছেনা।আমি ডক্টরের কাছে যাবো না।’
নির্ভীক অন্তর এক হাত ধরে নরম কন্ঠে অন্তকে বুঝিয়ে বলল,
‘ব্যথা না করলেও ট্রিটমেন্ট নিতে হবে।তুমি তো কিছু মনে রাখতে পারছোনা।ডক্টর মেডিসিন দিলে ওগুলো খেতে হবে তাহলেই তুমি ভাল হয়ে যাবে।’
অন্ত বিরক্ত হয়ে বলল,
‘হাত ছাড়ো,এখানে ভয় করছেনা।তখন রাস্তায় ভয় করছিল।’
নির্ভীক অন্তর হাত আরও শক্ত করে ধরে মুচকি হেসে বলল,
‘কিন্তু আমার এখনও খুব ভয় করছে।ধরে থাকো আমাকে ওকে?নাহলে কিন্তু আমি ভয়ে কান্না করে দিব।’
অন্ত ভীত চোখে তাকিয়ে বলল,
‘তুমিও ভয় পাচ্ছো?আমিও তো ভয় পাচ্ছি।চলো বাসায় চলে যাই।’
লিফট থামতেই নির্ভীক অন্তকে নিয়ে ডক্টর বোরহানের চেম্বারে ঢুকলো।ডক্টর বোরহান উদ্দীন রাযীনের টিচার তাই রাযীন আগেই অন্তর কথা ডক্টরের সাথে আলোচনা করে নিয়েছে।নির্ভীকের মা সকাল সকাল এসে অন্তর ব্যাপারে ডক্টরের সাথে আলোচনা করেছেন।অন্তর সাথে আলাপ শেষেই ডক্টর অন্তকে একটা নার্সের সাথে পাশের কেবিনে পাঠিয়ে দিলেন।অন্তর মেডিকেল হিস্ট্রি ঘাটাঘাটি শেষে নির্ভীককে কেবিনের বাহিরে রেখে ডক্টর অন্তর কাছে গেলেন।কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে অন্তর কান্নার আওয়াজ পেয়েই নির্ভীক হন্ত দন্ত হয়ে কেবিনটাতে ঢুকে গেল।অন্ত বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে হেঁচকি তুলে কাঁদছে কারন নার্স আবার ওর হাতে সুচ ফুটিয়ে দিয়েছে।ডক্টর স্যালাইনের ভেতরে দুটো ইন্জেকশনও পুশ করে দিয়েছেন।সাদা কালার স্যালাইন কেমন সোনালি কালার হয়ে গিয়েছে।নির্ভীক অন্তকে কাঁদতে দেখেই কেবিন থেকে বেড়িয়ে এসে দেয়ালে সজোরে ঘুঁষি দিল।চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।আরাফের উপর তীব্র রাগ হচ্ছে।আরাফের জন্যই তো অন্তর আজকে এই অবস্থা।কাঁধে কারও হাতের স্পর্শ পেয়েই পেছনে তাকিয়ে দেখে তার মা।মাকে দেখেই অসহায় মুখ করে বলল,
‘কবে সুস্থ হবে ও?’
নির্ভীকের মা শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।সকালে এসেই ডক্টরের সাথে কথা বলেছিলাম ওকে এখানে এডমিট করাতে হবেনা।এখন খুব ভাল করে ওর একটু যত্ন নিতে হবে।শরীরে কোনো ঘাটতি থাকা যাবেনা।জাপান থেকে সাতটা ইন্জেকশন নিয়ে আসা হবে।পনেরো দিন পর একটা ইন্জেকশন করা হবে তার পনেরো দিন পর আরেকটা তারপর থেকে বাকি পাঁচটা দশদিন পর পর।’
নির্ভীক মলিন মুখ করে বলল,
‘এভাবে সুস্থ হবে?’
-‘হুম পুরো সুস্থ হয়ে যাবে।জমাট রক্ত তরল হয়ে যাবে।স্মৃতিগত সমস্যা যা থাকবে সেগুলো মেডিসিনেই সেরে যাবে।’
নির্ভীক পাশের চেয়ারে বসে বলল,
‘ততদিন আমি এসব সহ্য করতে পারবোনা।আমি এখনই স্বাভাবিক অন্তকে চাই,এখনই।’
নির্ভীকের মা নির্ভীকের পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন,
‘তোকে পরিস্থিতি মেনে নিতে হবে।সামনের দিনগুলোর জন্য আরও শক্ত হতে হবে।অন্ত ঠিক হয়ে যাবে।আজকের অন্ত আর দশদিন পরের অন্তর মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকবে দেখিস।যতদিন যাবে ও তত সুস্থ হবে।’
নির্ভীক দুই হাতে মাথা ধরে মাথা নিচু করলো।সঙ্গে সঙ্গে টুপ করে দুচোখ থেকে দুফোটা অশ্রু মেঝেতে গিয়ে পরলো।নির্ভীকের মা মন খারাপ করে কেবিনে ঢুকলেন।অন্ত উনাকে দেখেই কান্না করতে করতে বলল,
‘অ্যান্টি তুমি এখানে কি করে আসলে?ডক্টর আমাকে আবার সুচ ফুটিয়ে দিয়েছে।নির্ভীক কেন নিয়ে আসলো এখানে?নির্ভীক একটুও ভাল নয়।’
নির্ভীকের মা অন্তর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘কিছু খাচ্ছিসনা দেখেই তো ডক্টর তোকে স্যালাইন দিলেন।এখন থেকে ঠিক করে খেলে আর স্যালাইন করবে না।’
অন্ত চোখ মুছে বলল,
‘এখানে থাকবোনা আমি।’
-‘স্যালাইন শেষ হলেই বাসায় নিয়ে যাবো।এখন চুপ করে বসে থাক।আমরা ডক্টরের সাথে কথা বলে আসি ঠিক আছে?সিস্টার, স্যালাইনটা সামান্য বাড়িয়ে দিন।’
ডক্টর আর নির্ভীকের মা কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলেন।নার্সও স্যালাইনের গতি সামান্য বাড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেন।নার্স যেতেই অন্ত স্যালাইনের গতি পুরো বাড়িয়ে দিল যাতে তাড়াতাড়ি শেষ হয়।প্রায় পনেরো মিনিট পর ডক্টরের সাথে কথা বলে নির্ভীক আর ওর মা অন্তর কাছে আসলো।অন্ত জড়সড় হয়ে চোখবন্ধ করে শুয়ে আছে।নির্ভীক একহাত বেডে রেখে অন্যহাত অন্তর গালে দিতেই চমকে গেল।অন্তর কপালে হাত দিয়ে ভীত কন্ঠে বলল,
‘আম্মু ওর তো জ্বর!’
নির্ভীকের মা চিন্তিত হয়ে অন্তর হাতে হাত দিয়ে বললেন,
‘সেকি!জ্বর আসলো কেন!’
অন্ত চোখ খুলে দূর্বল গলায় বলল,
‘স্যালাইন খুলে দাও হাত ব্যথা করছে।’
নির্ভীকের মা স্যালাইনের দিকে তাকিয়েই ভ্রু কুচকে বললেন,
‘এটা এত বাড়িয়ে দিয়েছে কেন?এই জন্যই জ্বর এসেছে।নার্সরা আজকাল একদম দায়িত্বহীন হয়ে যাচ্ছে।আমি সামান্য বাড়াতে বলেছি উনি পুরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
নির্ভীকের মা নার্সটাকে বকছে দেখে অন্তর অপরাধ বোধ হচ্ছে তাই সে মুখ কাচুমাচু করে বলল,
‘আমি বাড়িয়ে দিয়েছি ওই নার্সটার কোন দোষ নেই।এখানে থাকবোনা।’
নির্ভীক অন্তর গাল ধরে নরম কন্ঠে বলল,
‘তুমি বাড়িয়ে দিয়েছো?কেন এমন করেছো এখন দেখ জ্বর চলে আসলো।এমন দুষ্টুমি করলে কিন্তু বাসায় নিয়ে যাবো না,এখানেই রেখে যাবো তোমাকে।’
নির্ভীকের কথা শুনে অন্ত কান্না শুরু করে দিল।অবশেষে জ্বর থাকা অবস্থাতেই অন্তকে বাসায় নিয়ে আসতে হলো।বাসায় এসে কিছুক্ষণ পরই অন্ত ঘুমিয়ে গেল।নির্ভীক নিজের রুমে এসে বই খাতা সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল।নির্ভীক বাসা থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।একদম ফাইনাল এক্সাম শেষ করে অন্তর সামনে এসে দাঁড়াবে।ততদিনে অন্ত ওকে ভুলে যাবে।নির্ভীক চায় অন্ত তাকে ভুলে যাক।
—
কিছুদিন আগেই পত্রশূন্য ছিল গাছপালা।রুক্ষ মরুময় ছিল চারপাশ।শীতের নিষ্ঠুরতায় সব কেমন চুপচাপ ছিল।আজকাল সবকিছু জীবন্ত সবুজে ছেয়ে গেছে।সযত্নে লালিত নিপার ফুলগাছগুলো বেড়ে উঠেছে দ্রুত।গাছে গাছে রংবেরংয়ের ফুলের সমাহার।নিপা ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গভীর চোখে একটা লাল টুকটুকে গোলাপের দিকে তাকিয়ে আছে।নীল রঙের জামদানি শাড়ি পরেছে সে,হাত ভর্তি নীল কাচের চুড়ি, ডাগর চোখে মোটা করে কাজল দিয়েছে আর পাতলা ঠোঁটে লাল লিপস্টিক।চুলগুলো খোপা করে রেখেছে।এতটুকুতেই ভয়ানক সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।হালকা পাতলা গড়নের উজ্জল শ্যামা দেখতে শান্তশিষ্ট এই মেয়েটির চোখে মুখে উপচে পরা মায়া।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গাছ থেকে গোলাপটা তুলেই নিচে চলে আসলো।গোলাপটা হ্যান্ড ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে মায়ের সাথে বেড়িয়ে গেল আরাফদের বাসার উদ্দেশ্যে।আরাফের বাবা নিপার চাচা হয়।নিপার বাবা মারা গিয়েছে বছর ছয় হলো।মাকে নিয়ে বাবার এই ছোট একতলা বাড়িতে নিপা একাই থাকে।নিপার বড় একটা ভাই আছে সে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে আলাদা বাসায় গিয়ে উঠেছে।নিপার মা প্রাইমারি স্কুলের টিচার।টিচিং করে মা-মেয়েতে ভালভাবেই দিন যায় তাদের।তাছাড়াও নিপা এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে,পড়াশুনার পাশাপাশি দুয়েকটা টিউশনিও করাই।নিপার বাবা সরকারী চাকরি করতেন।উনার জমানো টাকা যা ছিল তার সবটায় উনার চিকিৎসার পেছনে খরচা হয়ে যায়।পেনশনের টাকা গুলো দুভাগ করে একভাগ নিপার জন্য রেখে দিয়েছে তার মা আর অন্য ভাগ ছেলেকে দিয়েছে।ছেলের সাথে উনার সম্পর্ক ভাল না।নিপার মা ছেলের জন্য খুবই আফসোস করেন।উনি চান ছেলে মায়ের কাছে ফিরে আসুক কিন্তু ছেলের বউ এর এক কথা শাশুড়ি আর ননদের সাথে সে কিছুতেই একসাথে থাকবেনা।বড় লোক বাবার অত্যাধুনিক মেয়ে সে,এসব মিডিলক্লাস লোকদের একদমই পছন্দ করেনা।
আরাফদের বাসায় এসে সবার সাথে কথা বলে চুপচাপ মায়ের পাশে বসে আছে নিপা।এতবড় বাড়িতে তার চোখ শুধু একজনকেই খুঁজে যাচ্ছে।বার বার সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে।আরাফের মা বিষয়টা বুঝতে পেরে নিপাকে ইচ্ছেমতির সাথে উপরে আরাফের সাথে দেখা করতে পাঠিয়ে দিল।ইচ্ছেমতি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে মুচকি হেসে বলল,
‘শোনো আমাকে তুমি ট্রিট দিবা ওকে?’
নিপা শান্ত কন্ঠে বলল,
‘কেন রে?তোকে কেন ট্রিট দিব?তুই আমার কোন কাজটা করেছিস।জীবনেও কোনদিন হেল্প করিসনি।’
ইচ্ছেমতি ভাব নিয়ে বলল,
‘আমি যা করেছিনা তুমি কল্পনাও করতে পারবানা।কালকে বাবাকে তোমাদের বিয়ের কথা বলেছি সেসব কথা বলতেই তো বড় আম্মু তোমাকে নিয়ে এসেছে।জানো আম্মু তোমাকে আজ একটা নেকলেস গিফট করবে।’
ইচ্ছেমতির কথা শুনে নিপা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে।সে আগের থেকেই অনুমান করেছিল চাচা তাদের বিয়ের কথা বলার জন্যই ডেকেছে আর চাচি তো অবশ্যই শাড়ি পরে আসতে বলেছে।নিপা কিছু না বলে চুপ করে থাকলো।উপরে এসে কিছুতেই সে আরাফের রুমে যাওয়ার সাহস পেলনা।এই ছেলেটাকে সে বড্ড লজ্জা পায়।যেদিন থেকে শুনেছে আরাফের সাথে ওর বিয়ে হবে সেদিন থেকে আরাফকে অনেক লজ্জা পায়।তা প্রায় পাঁচবছর হবে।এর মধ্যে হাতে গুনা কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে।যা কথা বলার আরাফই বলেছে নিপা শুধু হু হা করে কল কেটে দিয়েছে।উপরে এসে নিপা কিছুতেই আরাফের রুমে যাবেনা কিন্তু ইচ্ছেমতি জোর করে নিপাকে নিয়ে আরাফের রুমে গেল।আরাফ সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে।ইচ্ছেমতি যেয়ে আরাফের সামনে দাঁড়াতেই।আরাফ ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই বলল,
‘অন্তর সাথে কথা বলেছিস?’
ইচ্ছেমতি অন্তর ব্যাপারে কোন কথা বলতে চায় না তাই সে কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘বড় আম্মু আর নিপা আপু এসেছে।এই নিপা আপু ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?এখানে আসো।’
নিপা আরাফকে দেখেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেছে।তার খুব লজ্জা লাগছে,বুকের মধ্যে ধক ধক করছে।
আরাফ ভ্রু কুচকে দরজার দিকে তাকালো।নিপাকে দেখেই ভ্রু স্বাভাবিক করে মুচকি হেসে বলল,
‘কিরে তুই নিপা নাকি?অনেকদিন পর দেখা।’
নিপা আরাফের দিকে এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল,
‘কেমন আছেন আরাফ ভাইয়া?’
আরাফ নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে বলল,
‘খুব ভাল আছি।বসবি নাকি?বস তোরা।’
ইচ্ছেমতি কাবাব মে হাড্ডি হতে চায় না তাই নিপাকে একা রেখে রুম থেকে চলে গেল।নিপা একা একা কি করবে বুঝতে পারছে না।আরাফ ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই বলল,
‘নিশান ভাইয়ার কি খবর? কথা বলেনা কেন আমার সাথে?’
নিপা মন খারাপ করে বিছানার এক কোনায় বসলো ধরা গলায় বলল,
‘ভাইয়া ছমাস থেকে আমাদের সাথে কথা বলেনা,ভাবিকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে।’
আরাফ নিপার দিকে তাকালো।মনে মনে বলল মেয়েটা কি অদ্ভুত,সামান্য কথায় কান্না চলে এসেছে।মন খারাপ করা স্বাভাবিক তাই বলে এমন সামান্য কথায় কান্না করতে হবে!মেয়ে মানুষ মানেই কথায় কথায় কান্না করা।তার জানপাখিও তো একটু কিছু বললেই নাক মুখ ফুলিয়ে কান্না করে দেই।অন্তর কান্না মাখা মুখের কথা মনে হতেই আরাফ মুচকি হাসলো।এদিকে আরাফের কাছে যেটা সামান্য মনে হচ্ছে নিপার কাছে সেটা একদমই সামান্য নয়।নিপার পরিবার ভেঙ্গে গিয়েছে।যারা পরিবারকে ভালোবাসে তারা জানে পরিবার ভাঙ্গা কত কষ্টের।আরাফ ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘যাক গে বাদ দে ওসব কথা।তোর কথা বল।’
নিপা চোখের কোনায় জমা পানি অতি সাবধানে মুছে ফেলে বলল,
‘আমার কথা কি বলবো।আম্মুকে নিয়ে খুব ভাল আছি।’
আরাফ কিছু বলল না।নিপা আড় চোখে বার বার আরাফের দিকে তাকাচ্ছে।মনে মনে বলছে এত ফর্সা সুদর্শন ছেলে তার মতো কালো মেয়েকে বিয়ে করবে কখনও!আরাফের পাশে আমাকে কোনো কোণ থেকেই মানাবেনা।আরাফ লম্বা চওড়া সুঠাম দেহি ছেলে আর আমি রোগা পটকা দেখতে মাঝারি উচ্চতার মেয়ে।সবচেয়ে বড় কথা উনি যা ফর্সা উনার পাশে আমি একটা পেত্নী।আমাদের যদি বিয়ে হয় তাহলে সোসাইটির অ্যান্টিদের জ্বালায় ঘর থেকে বের হতে পারবোনা।সবাই চাচিকে বাড়ি বয়ে এসে অপমান করে যাবে।এসব ভেবেই নিপার মন খারাপ হয়ে গেল।হঠাৎ আরাফের কল আসায় আরাফ ফোন নিয়ে বেলকুনিতে যেতে যেতে নিপাকে বলল,
‘তুই থাক আমি কথা বলে আসছি।’
আরাফ চলে যেতেই নিপা ব্যাগ থেকে গোলাপটা বের করলো।সোফার সামনে টেবিলে একটা প্যাড আর কলম দেখে তাতে লিখলো,
‘আমার নতুন গাছের প্রথম ফোঁটা ফুল।আপনার জন্যই এনেছি।সামনাসামনি দিতে লজ্জা করছিল তাই এভাবে দিলাম।মানুষকে ভালোবেসে যেমন ভুলে যেতে নেই তেমনই ফুলকে ভালোবেসে ছুড়ে ফেলতে নেই।আশাকরি আপনি এটা আগের বারের মতো জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলবেন না।’
চিরকুট সহ ফুলটা আরাফের ল্যাপটপের কিবোর্ডের উপর রাখতেই নিপা ল্যাপটপে অন্তর একটা হাস্যজ্জ্বল ছবি দেখতে পেল।আরাফের ল্যাপটপে অন্তর ছবি দেখে কিছুটা মন খারাপ হলেও পরমুহূর্তে মুচকি হাসলো কারন অন্ত এমনই মিষ্টি মেয়ে যার উপর রাগ,অভিমান,মন খারাপ এসব কিছুই প্রভাব ফেলেনা।আরাফকে ঘরে ঢুকতে দেখেই নিপা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ‘আমি আসছি’ বলে দ্রুত রুম থেকে চলে গেল।আরাফ ল্যাপটপের সামনে বসতেই লাল গোলাপ দেখে চমকে গেল।এমনই লাল গোলাপ অন্তর খুব পছন্দ।আরাফ গোলাপটা হাতে তুলে নিয়ে মুচকি হেসে অন্তর ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘জানপাখি আই লাভ ইউ।’
চিরকুট টা পড়ে আরাফ মনে করতে পারলোনা সে কবে নিপার দেওয়া ফুল ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।অবশ্য আজকে ছুড়ে ফেলতো শুধুমাত্র অন্তর পছন্দের ফুল বলে টেবিলের উপর রেখে দিল।অন্তর ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমি তোমাকে কখনও ভুলে যাবোনা।তোমাকে ছাড়া বাঁচতেও পারবোনা,খুব শীঘ্রই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।আমি কিছুতেই ওই বিয়ে মানিনা।’
এদিকে আরাফের ঘর থেকে বেড়িয়েই নিপা নিজের উপর রাগ করলো।সে কি করে এমন বিশ্রী একটা চিরকুট লিখতে পারলো!আরাফই বা কি ভাবছে।ফুলটা উনাকে এভাবে না দিয়ে ইচ্ছেমতির হাত দিয়ে দেওয়ায় ভাল ছিল।ফুল দেওয়ারই বা কি দরকার ছিল!আমি বার বার কেন এমন পাগলদের মতো কাজ করি?হুয়াই গড হুয়াই?আরাফ নিশ্চয় আমাকে পাগলি বলছে।নিপা মুখ ফুলিয়ে নিচে চলে গেল।
——
অফিসের কেবিনে বসে নিজের পার্সনাল এসিস্টেন্ট আতিকের সাথে কথা বলছে জারিফ।আতিক চেয়ারে বসে একটা সংসারে যাবতীয় যত জিনিসপত্র লাগে সব নোট করছে।জারিফ আতিককে বলছে কোন ফার্নিচার কি রঙের হবে।হঠাৎ জারিফের ফোন আসতেই দ্রুত কল রিসিভ করলো।নির্ভীক ফোন করেছে।
-‘হুম চাঁদ বল।ছোটপাখি কি করছে?’
‘বাসায় ঘুমোচ্ছে।কবে আসছো তোমরা?প্লিজ তাড়াতাড়ি আসো।’
-‘এনিথিং রং?'(চিন্তিত হয়ে)
‘আরে না ডোন্ট ওরি।তুমি কবে আসছো সেটা বলো।’
-‘আরে ভাই বিয়েটাতো করতে দিবি নাকি?স্যাটারডে যাবো,হবে?’
‘না হবে না,ফ্রাইডে আসো।সকাল সকাল বিয়ে করে বেড়িয়ে পরবা আর ইচ্ছেমতিকে তোমাদের সাথে নিয়ে আসবা।’
-‘হুম যাবো।বাসা সাজাতে হবে।আতিককে পাঠিয়ে দিব কাল আর আমরা স্যাটারডে যাবো।’
‘আচ্ছা আসো।’
কল কেটে জারিফ চিন্তায় পরে গেল।নির্ভীককে তো বলল যাবে কিন্ত আরাফ ওর সাথে যেতে চাইবে।জারিফ ওখানে গেলে আরাফকে কিছুতেই আটকানো যাবেনা কিন্তু জারিফের ওখানে যেতেই হবে।জারিফ ডেস্কে দুই হাতের কনুই রেখে মাথা ধরলো।আতিক চিন্তিত হয়ে বলল,
‘স্যার আমি কি পরে আসবো?আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে,আপনি একটু রেস্ট নিন।’
জারিফ আতিককে যেতে বলল।আতিক যেতেই জারিফ চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।এখন ভর সন্ধ্যা।অন্যান্য দিন বিকেলের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যায় কিন্তু আজ তার কোন কাজেই মন লাগছেনা।
চলবে…………..