ভালোবাসি আমি যে তোমায় ২পর্ব:৩৮

0
1414

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sohani_Simu

৩২.

বিকেল হতে হতে সকালের সেই ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ ঘোলাটে ধূসর বর্ণের রুপ নিয়েছে।দুপুরের পর থেকে এক ফোঁটাও বৃষ্টি নেই।ভ্যাপসা গরমে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।অন্ত ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বোতল টেবিলে রেখে মন খারাপ করে কমলা খালার দিকে তাকিয়ে থাকলো।মন খারাপের প্রধান কারন সবাই তাকে ভুল বুঝেছে।কাল রাতে কি হয়েছিল অন্ত সব গল্প কমলার কাছে শুনেছে।সাথে সাথে নির্ভীককে ফোনও দিয়েছে এটা বলার জন্য যে সে অতগুলো মেডিসিন খায়নি কিন্তু নির্ভীক কল রিসিভ করেনি।কমলা মেঝেতে বসে বেশি পাওয়ারের চশমা চোখে দিয়ে নকশী কাথা সেলায় করছে।অন্তর মন খারাপ দেখে বলল,

‘একা একা ভাল নানা লাগলে তোমার শেফালী কি করতেছে দেখে আসো যাও।’

অন্ত কিচেনের দিকে উঁকি দিল।এখান থেকে কিছু দেখা যাচ্ছে না কিন্তু ভেতর থেকে টুুং টাং আওয়াজ আসছে।অন্ত উঠে শেফালির কাছে গেল।শেফালি ময়দা মাখছে।অন্ত শেফালির পাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,

‘তুমি রান্নাও করবা?’

শেফালি দাঁত বের করে হাসলো।ময়দার ডো বানাতে বানাতে বলল,

‘হ আজ পয়লা দিন তো তাই সব কাম করতে ভাল লাগতেছে।তোমার বর কইছে আমার কাম হইলো তোমার সাথে থাকা।’

অন্ত ভ্রু কুচকে বলল,

‘আমার সাথে থাকা মানে?’

‘মানে হইলো তোমার সব কাম কইরা দেওয়া।এই ধর তোমার আর তোমার বরের কাপড় ধুয়া,তোমার ঘর গোছানো,মেঝে মুছা, তোমার যদি রান্না করতে মন চায় আমি করে দিব তুমি শুধু দূরে বইসা দেখবা।এই ধর এখন করব আর তুমি বইসা থাকবা।আমি রান্না কইরা দিমু তুমি শুধু বরকে খাওয়াইবা।এক কথায় আমি তোমার হাতা।তোমার সব কাম আমার।’

শেফালির কথা গুলো অন্তর পছন্দ হল না।ওই বাসায় থাকতে ওয়াশিং মেশিনে নিজের কাপড় নিজেই ধুত।এখানেও ধুবে।অন্ত দেখেছে জারিফের কাপড় কুহেলী ধুয়ে দেয় তাই অন্তও নির্ভীকের কাপড় ধুবে।আর নির্ভীকের জন্য রান্না করতে হলে অন্ত নিজে করবে।কাজের মেয়ের হাতের রান্না নির্ভীককে খাওয়াবে আর নির্ভীক সেই রান্না খেয়ে প্রশংসা করবে অন্ত সেটা কিছুতেই সহ্য করবেনা।অন্ত মুচকি হেসে বলল,

‘তোমাকে এত কিছু করতে হবেনা।কাপড় ধুতে জানি আমি কিন্তু রান্না কিছু জানিনা।তুমি শুধু আমাকে শিখিয়ে দিবা আমিই সব করবো।দেখি সর আমি রুটি বানাবো।’

শেফালি ময়দার বাটি আরেক হাতে ধরে বলল,

‘না না তোমার কিছু করতে হইবোনা।তুমি সব কাম করলে আমার চাকরি থাকবো নাকি?তাছাড়া তোমার বর কইছে তোমারে যেন একটা কামেও হাত দিতে না দিই।’

অন্ত শেফালির কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘কখন বলেছে?’

ডো বেশি নরম হওয়ায় শেফালি আর একটু শুকনো ময়দা নিতে নিতে বলল,
‘সকালে বাইরে যাওয়ার সময়।’

অন্ত কৌতূহলি হয়ে বলল,
‘আর কি বলেছে?’

‘সবসময় তোমার খেয়াল রাখতে কইছে।’

অন্ত মুচকি হেসে সিংকে হাত ধুয়ে জোর করে শেফালির মাখা ময়দা গুলো সাইডে রেখে আরেকটা বাটিতে ময়দা মাখতে লাগলো।শেফালি অন্তর সাথে না পেরে হাত ধুয়ে অন্তর পাশে দাঁড়িয়ে অন্তকে শেখাতে লাগলো।রুটি আর সবজি বানিয়ে গরমে অন্ত একদম হাঁপিয়ে উঠেছে।হাত ধুয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে ঘরে গিয়েই দেখে নির্ভীক টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপের দিকে ঝুকে মাউসে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।অন্য হাতে ফোন কানে ধরে আছে।অন্ত মনে মনে বলল এতক্ষণে আসার সময় হয়েছে।অন্ত হাসি মুখ করে নির্ভীকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।নির্ভীক ভ্রু কুচকে অন্তর দিকে একনজর তাকিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিন নামিয়ে বেলকুনিতে গেল।অন্ত টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেই নির্ভীকের কথা শুনছে।নির্ভীক রেগে বলছে,

‘ শৈবালকেও নিয়ে আসবি।সিআইডির ফরেনসিকে নিয়ে গিয়ে তোদের ফ্রিঙ্গারপ্রিন্ট চেক করব।আ’ম সিউর তোরাই আমার ল্যাপটপে হাত দিয়েছিস।তোদের সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।এত গুলো ফাইল ডিলিট করে দিলি?এখনও সময় আছে সত্যি কথা বলে দে টোয়া।ওকে।’

কাল রাতে নির্ভীক যখন অন্তর সাথে হসপিটালে ছিল টোয়া তখন হসপিটাল থেকে ফিরে এসে নির্ভীকের ল্যাপটপ থেকে সব ইমপর্টেন্ট ফাইল ডিলিট করে দিয়েছে।যাতে সেগুলো আবার তৈরী করতে দু-তিনদিন রাত-দিন এক করে নির্ভীক ল্যাপটপ নিয়ে পরে থাকে।নির্ভীক এখন টোয়াকে সন্দেহ করছে কারন তার ল্যাপটপে হাত দেওয়ার মতো এ বাসায় কেউ নেই,শুধু টোয়া আর শৈবাল ছিল।ছোটবেলা থেকেই টোয়া আর শৈবাল বাসায় আসলে নির্ভীক সব দরকারি জিনিসপত্র আলমিরাতে তুলে লক করে রাখে কারন নির্ভীকের জিনিসপত্রের প্রতি ওদের ঝোক বেশি।বিয়ের আগেই নির্ভীক তার সব ডিভাইস লক করে রেখেছে।এই পুরাতন ল্যাপটপে তেমন কিছু ছিলনা।শুধু ক্লাসের জন্য কিছু প্রজেক্ট বানিয়ে রেখেছিল যাতে তার স্মার্টনেস দেখে স্যাররা খুশি হন কিন্তু নির্ভীক আজ সেগুলো ক্লাসে উপস্থাপন করতে পারেনি।আদিম যুগের টিচারদের মতো মোটা মোটা বই হাতে নিয়ে ক্লাস করাতে হয়েছে।সেজন্য মাথা একদম গরম হয়ে আছে।

টাই ঢিলে করে নির্ভীক বেলকুনি থেকে বের হয়ে আসলো।অন্তকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকালো।কিছু না বলে অন্তকে পাশ কাটিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই খুলে শার্টের বাটন খুলতে খুলতে আয়নাতে অন্তকে দেখতে লাগলো।অন্ত শুকনো মুখ করে ধীরে ধীরে হেঁটে নির্ভীকের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘কালরাতে আমি…’

অন্তকে পুরোটা বলতে না দিয়ে নির্ভীক বলল,

‘সরি বলতে হবেনা।তোমার সরি তোমার কাছেই রাখো।’

অন্ত ভ্রু কুচকে বলল,

‘সরি বলিনি, আমি বলছি কাল রাতে মেডিসিন গুলো খাইনি আমি।’

নির্ভীক পেছনে ঘুরে অন্তর দিকে তাকালো।চোখে মুখে সন্দেহ নিয়ে বলল,
‘তাহলে অসুস্থ হলে কেন আর অতগুলো মেডিসিন কি করেছো?’

অন্ত মুখ কাচুমাচু করে বলল,

‘ফেলে দিয়েছিলাম।আর অসুস্থ হইনি তো।ঘুম পাচ্ছিল তাই ঘুমিয়েছি,উঠে দেখি হসপিটালে।’

নির্ভীক ভ্রু কুচকে বলল,
‘সত্যি বলছো?’

অন্ত মাথা নাড়ালো।নির্ভীক চিন্তিত হয়ে অন্তর গালে কপালে হাত দিয়ে বলল,

‘মেডিসিন খাওনি তাহলে কি খেয়েছিলে?কেন খেয়েছিলে?’

অন্ত মিনমিন করে বলল,
‘কিছু খাইনি।’

নির্ভীক দুই হাতে অন্তর দুই গাল ধরে বলল,

‘আমার দিকে তাকিয়ে বল।ওই সবগুলো মেডিসিন খেয়েছিলে তুমি?’

অন্ত নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘না ফেলে দিয়েছি।’

নির্ভীক ভ্রু কুচকে বলল,
‘কখন ফেলেছো?কোথায় ফেলেছো?’

অন্ত গাল থেকে নির্ভীকের এক হাত সরিয়ে দিয়ে পেছনে তাকিয়ে ঝুড়ির দিকে ইশারা করে বলল,

‘ওখানে।’

ঝুড়ি একদম পরিষ্কার তাই নির্ভীক অন্তর কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করলেও কিছু একটা ভেবে উল্টো দিকে ঘুরে শার্ট খুলতে খুলতে বলল,
‘এখনও ঘুম পাচ্ছে?’

অন্ত ঝুড়ির কাছে যেয়ে বলল,

‘কিন্তু আমি সত্যি এখানে ফেলেছিলাম।শেফালি মনে হয় পরিষ্কার করেছে।’

নির্ভীক ভ্রু কুচকে বলল,

‘ওকে বাদ দাও।’

‘আমি শেফালিকে ডেকে নিয়ে আসছি’

বলেই অন্ত দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।নির্ভীক শার্ট খুলে অন্তর পেছন পেছন যেতে যেতে বলল,

‘নো,ওয়েট,নো নিড টু গো।’

অন্ত চলে গিয়েছে।নির্ভীক ছোট্ট শ্বাস ফেলে ফ্রেশ হতে ঢুকলো।কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখে অন্ত ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।নির্ভীক কিছু না বলে মাথা মুছতে মুছতে অন্তকে পাশ কাটিয়ে সোফাতে গিয়ে বসলো।অন্তর মুখ মলিন হল।খুব ভাল করে বুঝতে পারছে নির্ভীক তাকে ইগনোর করছে।অন্ত নির্ভীকের কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতে থাকা সবগুলো মেডিসিন দেখালো।নির্ভীক মেডিসিন গুলো দেখে ভেজা টাওয়াল সোফার উপর রাখলো।অন্তর হাত চেপে ধরে ওকে নিয়ে বেলকুনিতে এসে বলল,

‘ফেলে দাও ওগুলো।’

অন্ত মুখ মলিন করে বলল,

‘বিশ্বাস হচ্ছেনা আপনার?’

নির্ভীক অন্তর হাত গ্রীলের বাইরে নিয়ে মেডিসিন গুলো ফেলে দিল।অন্তকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে আবার কোলে নিয়ে ছাদে আসলো।সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।চারপাশে আবছা অন্ধকার।মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে।নির্ভীক অন্তকে ইটের রেলিংয়ের উপর বসিয়ে দিল।এক হাতে অন্তর কোমর জড়িয়ে ধরলো আর অন্যহাত অন্তর গালে রেখে নরম কন্ঠে বলল,

‘করেছি বিশ্বাস।এখন তুমি বল,কি হয়েছিল কাল?শরীর খারাপ লাগছিল কখন থেকে?’

অন্ত মলিন মুখ করে বলল,
‘শরীর খারাপ লাগেনি।ঘুমিয়ে ছিলাম উঠে দেখি হসপিটালে।খালা বলল মেডিসিনের পাতা খালি দেখায় সবাই ভেবেছে আমি সবগুলো মেডিসিন এক সাথে খেয়েছি।কিন্তু আমি শুধু চারটে মেডিসিনই খেয়েছি যেমনটা প্রতিদিন খাই।’

নির্ভীক মনোযোগ দিয়ে অন্তর কথা শুনলো।চিন্তিত হয়ে বলল,

‘কিন্তু ডক্টর বলেছে তুমি মেডিসিন খেয়েছো।আচ্ছা তুমি কি ঘুমের মেডিসিন খেয়েছো একটাও?’

অন্ত নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘না।আমার কাছে তো ঘুমের মেডিসিন নেই।কাল রাতে বাসায় এসে পানি আর ওই চারটে মেডিসিন ছাড়া কিছু খাইনি।’

নির্ভীকের মনে হলো টোয়া পানি দিয়েছিল।টোয়ার উপর নির্ভীকের সন্দেহ হচ্ছে কিন্তু কোন প্রমাণ না থাকায় কিছু বলা ঠিক হবেনা।নির্ভীকের অবচেতন মন বলছে কিছু একটা হচ্ছে অন্তকে ঘিরে।মনে মনে বলছে আরাফ ভাইয়া চুপ আছে কেন?বিয়ে হয়ে গেল কোন ঝামেলা করলো না।এমনকি ফোনও করছেনা।নির্ভীক অন্তকে নিচে নামিয়ে দিল।অন্তকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘কখনও আমাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তাও করবা না।সব সময় নিজের যত্ন নিবা।একটা কথা মাথায় রাখবা তোমার কিছু হলে আমি বাঁচতে পারবোনা,শেষ হয়ে যাব।’

অন্ত নির্ভীকের বুকে মুখ গুজে দুই হাতে নির্ভীককে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘এসব বলবেননা প্লিজ।’

নির্ভীক অন্তর মাথায় চুমু দিয়ে মুচকি হেসে বলল,

‘ ওকে বলব না কিন্তু যেই প্রবলেমই হোক জানাবা আমাকে।আমাকে নাহলে অন্য কাউকে কিন্তু জানাবা।তুমি তো এখন সুস্থ।আর একবার শুধু ইন্জেকশন করবে তারপর স্ক্যান করে দেখবে আর ক্লট নেই তখন আর মেডিসিন খেতে হবেনা। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করতে হবে।এত বেশি শুকিয়ে গিয়েছো।তোমার হেল্থ নিয়ে খুব টেনশনে আছি।মাত্র থার্টি এইট কেজি তুমি আর আমার কত জানো?সিক্সটি ফোর।রাতে যে আমার উপর উঠে ঘুমাও,আমি যদি ভুল করে তোমার উপর উঠি নিতে পারবা আমাকে?’

অন্ত লাজুক হাসলো।মুখে হাসি রেখেই বলল,

‘মিথ্যে কথা।আমার শুয়ে থাকা ভাল।তাছাড়াও আমি হসপিটালে ছিলাম।’

নির্ভীক অন্তকে ছেড়ে দিয়ে অন্তর নাক টেনে বলল,

‘আমিও তোমার সাথে হসপিটালেই ছিলাম বউ।একই বেডে একই বালিশে।দুদিনে টু থাউজ্যান্ড কিস করেছি আর একটা করি?’

অন্ত বিস্ফোরিত চোখে নির্ভীকের দিকে তাকালো।বিয়ের পর দুটো রাত কেঁটে গিয়েছে কিন্তু অন্ত জানেনা রাতে কি হয়েছে।মনে মনে ভাবছে নির্ভীক কি আমার ঘুমোনোর সুযোগ নিয়ে….।না না এমন কিছু হয়নি।অন্তর ভাবনার মাঝেই নির্ভীক অন্তর গালে চুমু দিল।এক হাতে অন্তর কোমড় জড়িয়ে ধরে চিলেকোঠার ঘরের দেয়ালের কাছে আসলো।অন্তকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে অন্তর গলায় মুখ ডুবিয়ে বলল,

‘ডোন্ট ওরি,শুধু কিস করেছি আর কিছু নয়।’

বলার পরই নির্ভীক অন্তর গলা থেকে মুখ তুলে অন্তর দিকে তাকালো।অন্তর দুপাশে দেয়ালে হাত রেখে মুচকি হেসে বলল,
‘বাই দ্যা ওয়ে আর কিছুর মানে বুঝতে পারছো?’

অন্ত ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে।নির্ভীক এত কাছে আসায় তার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে।লজ্জায় এখান থেকে দৌঁড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।নির্ভীকের কথা বুঝলেও অন্ত মাথা নাড়িয়ে না বলল। নির্ভীক অন্তর পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।বুকে হাত গুজে অন্তর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতেই অন্ত দৌঁড়।নির্ভীক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘হেঁটে যাও।পরে গেলে কিন্তু মাইর দিব।’

অন্ত শুনেও না শোনার ভান করে দৌঁড়ে চলে গেল।নির্ভীক আবার দেয়ালে হেলান দিয়ে অন্তর চিন্তা করতে লাগলো।মনে মনে বলল দুই রাত এমন অস্বাভাবিক ঘুমের কারন কি হতে পারে?

সন্ধ্যায় আরাফ ছাদে দাঁড়িয়ে স্মোক করছে।হঠাৎ পাশের ছাদে চোখ যেতেই দুজনকে দেখতে পেল।আবছা অন্ধকারে সবকিছু দেখা গেলেও স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে না।অর্থাৎ মানুষ দেখা গেলেও মানুষের মুখ চেনা যায় না।এমন অন্ধকারকে মুখ অন্ধকার বলা যেতে পারে।মুখ দেখতে না পেলেও আরাফ বুঝতে পারলো পাশের ছাদের দুটো মানুষ নির্ভীক আর অন্ত।আরাফ একটু পিছিয়ে আসলো।পানির ট্যাংকির সাথে হেলান দিয়ে হাঁটু ভাজ করে একপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো।পুরোটা সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তাদের দিকে।মনে মনে বলল ভালোবাসা মানে পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা।আমি তোমাকে কাছে টেনেছি কিন্তু তুমি টানতে পারোনি।তুমি নির্ভীককে কাছে টেনেছো।ভালোবেসেছো ওকে।আকুলভাবে কামনা করেছি কিন্তু পাইনি তোমাকে।আরাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ছাদ থেকে নিজের ঘরে ঢুকে দেখলো নিপা মেঝেতে বিছানা করছে।আরাফ ভ্রু কুচকে বলল,

‘কি ব্যাপার এখনই বিছানা করছিস কেন?’

নিপা এতক্ষণ আরাফকে খেয়াল করেনি।হুট করে আরাফের কন্ঠ পেয়ে কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো।মলিন মুখ করে আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘বিছানা করিনি।গোছাচ্ছি এগুলো।নিচের রুম খালি আছে ওখানে থাকবো।’

আরাফ ভ্রু কুচকে সোফাতে গিয়ে বসলো।পকেট থেকে ফোন বের করে বলল,

‘নিচে কেউ থাকেনা।তোর ওখানে একা একা থাকতে হবে না।এখানে ভাল না লাগলে ইচ্ছের কাছে থাক।’

নিপা খুশি হল।মনে মনে বলল তারমানে এখানে থাকার পারমিশন আছে।নিপা বিছানা গুছিয়ে একপাশে রেখে দিল।গুটি গুটি পায়ে আরাফের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে হাতের নখ খুটলে বলল,

‘আপনাকে একটা কথা বলার আছে।’

আরাফ ফোনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
‘বল।’

নিপা আমতা আমতা করে বলল,

‘অন্তর তো বিয়ে হয়ে গেল।’

আরাফ রাগী চোখে নিপার দিকে তাকালো।।নিপা একটা শুকনো ঢোক গিলল।অনেক কথায় হুড়মুড় করে বুকের মধ্যে ভিড় করে আসে কিন্তু সাহসের অভাবে কিছু বলা হয়ে উঠে না।আরাফ চোখ নামাতেই নিপা বলল,

‘আপনি কি এখনও ওর জন্য বসে থাকবেন?’

আরাফ সোফায় ফোন রাখলো।চুপ করে বসে আছে।অথচ কত কথায় বলা যায়।মাঝে মাঝে নিপার জন্য আরাফের অনুশোচনা হয়।বাবা-মার প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে নিপার প্রতি কি অন্যায় করেনি?পরক্ষণেই ভাবে নিপা সব জেনে শুনে ভুল করেছে।এতে আমার কিছু করার নেই।আরাফ এক হাতে দুচোখ কচলে ফোন হাতে নিয়ে বলল,

‘অনন্ত কাল আমি ওর জন্য অপেক্ষা করব।সবসময় ওর পথ চেয়ে বসে থাকবো।কখনও,কোনদিনও আর কাউকে ভালোবাসতে পারবোনা।এমনটা নয় যে ওকে ছাড়া আর কাউকে পাবোনা,আমি অন্তকে ছাড়া আর কাউকে পেতে চাইনা।’

আরাফ কথা শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।নিপা ভয়ে ভয়ে বলল,

‘আপনি জানেন?সব ভালোবাসায় অসম্পূর্ণ হয় যতক্ষণ না তার সাটিসফিকেশন হয়।সাটিসফিকেশন সবাই পায় না।সারাজীবন পাগলের মতো ভালোবাসলেও পাওয়া যায়না।আপনি যেমনটা চান আমিও তেমনটা চাই।এমনটাতো হতেই পারে আমরা সারাজীবন একসাথে থাকবো,সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে থাকবো।ভালোবাসা নাইবা থাকলো,বন্ধুত্ব থাকবে।ভালোবাসার চেয়ে বন্ধুত্ব বড় হতে পারেনা?ভালোবাসার চেয়ে বন্ধুত্ব বড়।বন্ধুত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে আপনি সেদিন অন্তর বিয়ে ভাঙতে পারেননি আমি জানি।’

আরাফ মাথা নিচু করে রাগী কন্ঠে বলল,

‘গেট লস্ট।’

আরাফ রেগে গিয়েছে।নিপা যা বলল আরাফ এসব কখনও ভাবেনি।তার ভাবনা সরল।সে অন্তকে ভালোবাসে আর সারাজীবন বাসবে।ভাল থাকা,ভাল রাখা,বন্ধুত্ব,পাশে থাকা এসব নিয়ে সে আর ভাবতে চায়না।নিপা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।কোমল স্নিগ্ধ মুখ জুড়ে বিষাদের ছায়া।আরাফের সাথে তার যেটুকু সম্পর্ক আছে তা এক তরফা।আরাফ কোনদিন তাকে ভালোবাসবেনা।নিপার চোখ ভিজে আসলো।আস্তে আস্তে হেঁটে ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতেই আরাফ ঘরের দরজা সজোরে লাগিয়ে দিল।সব আলো নিভিয়ে দিয়ে বেলকুনিতে গিয়ে মেঝেতে বসলো।

ছাদে অন্তকে নির্ভীকের খুব কাছে দেখে সহ্য হচ্ছে না।।ভাগ্য সহায় থাকলে নির্ভীকের জায়গায় সে থাকতো।অন্তর পাতলা গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট!আরাফ শুকনো ঢোক গিলল।অনৈতিক কিছু করার বাসনা আরাফকে অস্থির করে তুলছে।বিষ কিংবা ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যাকারী ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকাদের আগে করুণা করতো আরাফ।মনে মনে ভাবতো এ কেমন ছেলেমানুষি!এখন নিজের অবস্থা বিবেচনা করে ভাবছে ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকাদের আত্মহত্যা করার অধিকার কাছে।পরক্ষণেই আরাফের বুক চিড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পরে।

ঘড়িতে রাত ন’টা বাজতেই টোয়া নির্ভীকদের বাসায় আসলো।নির্ভীক তখন অন্তর বানানো রুটি আর সবজি খাচ্ছে।রুটির সাইজ দেখে নির্ভীক মুখ টিপে হাসলেও টোয়াকে দেখেই রেগে গেল।শেফালি টিভি দেখছে তাই অন্ত টোয়াকে দেখে কিচেনে আরও রুটি নিতে গেল।টোয়া এসে নির্ভীকের পাশে অন্তর চেয়ারে বসে অন্তর প্লেট সরিয়ে নিজের প্লেট টেনে নিল।অন্ত ফিরে এসে দেখে তার জায়গায় টোয়া বসে আছে।নির্ভীক প্লেট ঠেলে উঠে টোয়াকে বলল,

‘খাওয়া শেষ হলে আমাকে নক দিবি।’

তারপর অন্তর হাত থেকে রুটির বাটি নিয়ে শব্দ করে টেবিলে রেখে অন্তর এক হাত ধরে বলল,

‘কাম উইথ মি।’

টোয়া প্রায় একঘন্টা সময় নিয়ে ডিনার করলো।কচ্ছপের গতিতে নির্ভীকের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিতেই নির্ভীক ভেতরে যেতে বলল।নির্ভীক টেবিল চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল।টোয়া নির্ভীকের পাশে দাঁড়িয়ে মুখ কাচুমাচু করে বলল,

‘আসলে আমি হাত দিয়েছিলাম ল্যাপটপে।’

নির্ভীক চেয়ার ছেড়ে উঠে ঠাস করে টোয়ার গালে থাপ্পড় দিয়ে বলল,

‘একদম ঠিক করিসনি।’

টোয়া গালে হাত দিয়ে কান্না করতে করতে বলল,
‘আমি ওগুলো ডিলিট করতে চাইনি,হাত লেগে হয়ে গেছে।তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু ভয়ে বলতে পারিনি।’

নির্ভীক ল্যাপটপ,একটা পেনড্রাইভ আর মোটা একটা বই টোয়ার হাতে দিয়ে বলল,

‘যেগুলো ডিলিট করেছিস সেগুলো আজকে রাতের মধ্যেই তৈরী করে দিব।বইয়ে টপিক মার্ক করা আছে আর পেনড্রাইভে এক্সামপল আছে।যা কাজ শুরু করে দে।’

টোয়া মিনমিন করে বলল,

‘আমি এসব কিছু বুঝিনা।’

নির্ভীক রেগে বলল,

‘যেতে বলেছি তোকে।’

টোয়া এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চলে গেল।নির্ভীকের রাগকে জমের মতো ভয় পায় কিন্তু মাথায় শয়তানি বুদ্ধি থাকায় এর বেশির ভাগ শয়তানি কাজকর্ম কেউ ধরতে পারেনা।নির্ভীক আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সোফায় অন্তর পাশে বসে অন্তর হাত ধরে বলল,

‘পুরো রাজশাহী নিয়ে আমার দুটো শত্রু,টোয়া আর শৈবাল।এরা দুজন হিংসে করে ওগুলো ডিলিট করেছে যাতে সবার সামনে আমাকে অপমানিত হতে হয় কিন্তু ওরা কিছু করতেই পারেনা।ওই ফাইল গুলোর সব কপি আছে তো আমার কাছে।’

অন্ত এতক্ষণ সোফায় বসে অবাক হয়ে সব দেখছিল।নির্ভীকের কথা শুনে অবাক হয়ে বলল,
‘তাহলে টোয়া আপুকে আবার ওগুলো তৈরী করতে বললেন কেন?’

নির্ভীক মুচকি হেসে,

‘এই ধরো আমার মনের শান্তির জন্য।ক্লাসে একটু অশান্তিতে ছিলাম তাই একটু শান্তির আয়োজন করলাম।’

অন্ত ভ্রু কুচকে বলল,
‘আপনি এখন টিচার?’

নির্ভীক অন্তকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘না আমি এখন হাজবেন্ড।’

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here