মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্বঃ১৫

0
1277

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ পনেরো

শুভ্র রাঙা মেঘ ভেসে যাচ্ছে আকাশ পথে। তাদের নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই। যখন যেখানে ঠাঁই মেলে তখন সেখানেই থেকে যায়। তিস্তা’র জীবনে আজকে একটা নতুন ভোর,নতুন সকাল আর নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার দিন।

গতকাল রাতে দাদী বারবার বলেছে তার নাকি সতীত্ব কেড়ে নিয়েছে, তাকে আটকে রাখা জানোয়ার গুলো। সে শত চেষ্টা করেও দাদীকে বুঝাতে পারে নি যে, তার সাথে খারাপ কিছুই হয় নি৷ দাদী ভেবেছে,সে হয়তো খারাপ জিনিসটা বুঝে না তাই তার সাথে যে খারাপ হয়েছে তা বুঝতে পারছে না।

কত রকমের নোংরা প্রশ্ন করেছে দাদী। তিস্তা শেষমেশ কেঁদে দিয়েছে ক্লান্ত হয়ে। তার সাথে কোনো নোংরামি হয়নি,অথচ দাদী মানতেই চাইছে না!

তনয়া বেগম তখন বুজেছিলো মেয়ের মনোভাব। শাশুড়ীকে তখন সে’ই এসব প্রশ্ন করতে বারণ করে। ছুটন্ত তিস্তা সামন্য মূর্ছে যায়। কী হচ্ছে তার সাথে! এসবের সাথে কোনো কালেই সে পরিচিত না। বাড়ির মানুষই তাকে বিশ্বাস করছে না। বাহিরের মানুষের সাথে কীভাবে লড়বে সে!

সকাল হতে না হতেই তিস্তা উঠে হাতমুখ ধুয়ে, স্নান করে নেয়। রোজকার মতন বাড়ির উঠানে এসে চুল শুকােচ্ছিলো। তনয়া বেগম তখন বাড়ির উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। সকাল সকাল মেয়েকে স্নান করতে দেখে অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘তুমি এত সকালে স্নান করলে যে!’

তিস্তা চুল মুছায় মনোনিবেশ করে বললো,
-‘এই রবিবার থেকে তো আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু,আম্মা। পড়াশোনাও তো করতে হবে। তাই,বকুলগো বাড়িতে যাবো,কোনো পড়া দাগিয়ে দিছে না কিনা সেটা দেখে আসবো।’

তনয়া বেগমের হাতে থাকা ঝাড়ুটা পড়ে গেলো। মেয়েটা যদি এখন বাহিরে যায়, গ্রামবাসীর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে! ওর দাদী’ই তো মানতে চাইছে না মেয়েটার মুখের কথা, গ্রামবাসী মানবে?

মানুষ বরাবরই অদ্ভুত প্রাণী। অন্য কারো খারাপটা শুনতে তারা মনে মনে পৈচাশিক আনন্দ পায়। ভালোটা যেনো মানতেই পারে না। খারাপটা শুনে আফসোস করার মতন মজার কাজ হাতছাড়া করতে চায় না তারা।

তনয়া বেগম মেয়েকে “না” করার আগেই মেয়ে ছুট লাগালো বকুলদের বাড়ি। তনয়া বেগমের ভয় হচ্ছে,মেয়েটা এখনও দুরন্তপনা করছে। কিন্তু হয়তো আর বেশিক্ষণ পারবে না এই দুরন্তপনা দেখাতে।

___

‘বকুল,ও বকুল, কোথায় তুই? একটু বাহিরে আয় তো।’

এমন চার-পাঁচ বার ডাকার পরও বকুল নামের মেয়েটি বাহিরে এলো না। আশ্চর্য! বকুল তো এক ডাকেই সদা হাজির থাকতো, তবে আজ কোনো আসছে না? এত জোড়ে ডাকার পরও ওরা ডাক শুনছে না কেনো?

তিস্তা বিরক্ত হলো। সেই কতক্ষণ যাবত ডেকে যাচ্ছে মেয়েটাকে, কিন্তু মেয়েটার কোনো খোঁজখবরই নেই?

তিস্তা আরেকবার ডাকার জন্য প্রস্তুতি নিতেই ঘর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো বকুলের মা। তিস্তাকে দেখে তিনি যেনো সাত আসমান থেকে পড়লো। অবাক নয়নে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
-‘এই, এই মেয়ে,তুই এ শরীর নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিস কেনো? যা, যা তাড়াতাড়ি বাড়ি। গ্রামের ছেলেমানুষ বা অন্য কেউ দেখলে কী হবে! ছিহ্! যা বাড়ি যা।’

বকুলের মায়ের কথায় অবাক হলো তিস্তা। তাকে দেখলে কী এমন হবে, ভেবে পাচ্ছে না সে। বিষ্মিত কণ্ঠেই তিস্তা বললো,
-‘জেঠিমা,কী হবে আমায় দেখলে? এভাবে বলছো কেনো?’

বকুলের মা আরেকটু এগিয়ে এলেন তিস্তার দিকে। গলা ছেড়ে ভীষণ নাক মুখ কুঁচকে বললেন,
-‘কিরে,তোর কী লজ্জা শরম নেই? আবার জিজ্ঞেস করছিস কী হবে তোকে দেখলে! তোর বাড়ির মানুষের কী আক্কেল জ্ঞান নেই? তুই নাহয় কিছু বুজিস না, তারা তো বুঝে। কীভাবে একা ছাড়লো তোকে?’

তিস্তা যেনো অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। বকুলের মায়ের কথার ধরণের সাথে কাল রাতের দাদীর কথার ধরণের মিল পাচ্ছে সে। তবে কী বকুলের মাও ভাবছে, তার সতীত্ব নেই?

তিস্তার অবুঝ মাথায় বকুলের মায়ের অহেতুক আচরণের কারণটা বোধগম্য হলো। সে ব্যাতিব্যস্ত কণ্ঠে বকুলের মায়ের ভুল ধারণাটা ভাঙাতে বললো,
-‘না না জেঠিমা, তুমি বোধহয় ভুল ভাবছো। আমার সাথে ওরা কিছু করে নি। কোনো নোংরামি করে নি, বিশ্বাস করো।’

তিস্তার এহেন কথায় বকুলের মায়ের মনোভাব আরও গাঢ়ো হলো। মেয়েটা কী এখানে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে এলো? ধূর,এ মেয়ের সাথে কথা বলতেও রুচিতে বাঁধছে। না, না, বকুলকে ওর সাথে মিশতে দেওয়া যাবে না।

ভদ্র মহিলা তিস্তার থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘরে যেতে যেতে বললো,
-‘তোর সাথে কী হয়েছে না হয়েছে তা আমার ভালো করেই জানা। একদম বকুলের ধারে কাছে ঘেষবি না। ভ্রমরী তারপর আরেকটা মেয়ে, কী জেনো নাম খানা? ওদের তুলে নিয়ে মেরেই ফেললো, আর তুই বলছিস তোকে কিছু করেনি। আমরা কী এতই অবুঝ? যা দেখি,তোর বাড়ি যা। তোর সাথে মিশলে আমার মেয়েটার আর ভালো সম্বন্ধ পাবো না। আর কয়েকদিনের মাঝেই বিয়ে দিয়ে দিবো ওরে। বিয়ের সময় হয়ে গেলে মেয়েছেলে ঘরে রাখাও এখন যন্ত্রণা। পরে পাপ হয়ে যাবে। যা,বাড়ি যা। আমার মেয়ের সাথে আর কোনোদিনও দেখা করবি না। যা।’

তিস্তা হতবাক! চেনা মানুষের,চেনা ব্যবহার, আজ যেনো বড্ড অচেনা। তার মুখের কথা কেউ বিশ্বাসই করছে না? দোষ না করেও আজ সে কেনো কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে! কিসের শাস্তি পাওয়া শুরু হলো তবে!

তিস্তার বুকে চাঁপা ব্যাথা অনুভব হয়। এই জেঠিমা’ই তো কত আদর করে মাঝে মাঝে তাকে খাইয়ে দিয়েছিলো! এই জেঠিমা’ই তো কত আদর করে গাছের কাচা আম মাখিয়ে দিয়ে ছিলো! তবে আজ তার বিরাট পরিবর্তন কেনো?

তবে কী সেই আধাঁর ঘরের পাঁচদিন, তিস্তার পুরো জীবনটাকে আধাঁর করে দিবে!

তিস্তার হাঁটার শক্তি যেনো লোপ পায়। বকুল,বকুলও কী তবে আর তিস্তার সাথে খেলবে না?

যেই উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটে এসেছিলো তিস্তা,সে উচ্ছ্বাস হঠাৎ করেই বিষন্নতায় রূপ লাভ করলো। মিইয়ে গেলো তার ফুটন্ত চঞ্চলতা। ধীর পায়ে সে বকুলদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। এখন তার লজ্জা লাগছে, ভীষণ লজ্জা৷ সে কী নোংরা মুখ সবাইকে ঢেং ঢেং করে দেখাতে বেরিয়েছে! রাস্তার সবাই তবে তার দিকে তাকিয়ে আছে কেনো?

সবার অদ্ভুত চোখের দৃষ্টি দেখে মিইয়ে যায়, তিস্তা। চোখ মুখ খিঁচে ছুট লাগায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। সবাই কেমন বদলে গেলো, পাঁচ দিনের বিবর্তনে! তাকে দেখে সবাই কানাকানি করে কী যেনো বলে। সে কী এতটাই নোংরা হয়ে গেলো?

পাহাড় সমান অবিশ্বাস্য কাহিনী কুড়িয়ে বাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে তিস্তা। এখন সত্যিই মনে হচ্ছে,তার বাহিরে বের হওয়াটাই ভুল ছিলো।

___

বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই থমকে যায় তিস্তা। এতদিন পর তাদের বাড়িতে কাকে দেখছে সে! তার আপা এসেছে!

কত দিন পর আপা এলো। আপাকে দেখে তিস্তার মন খারাপের আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলো। পথ থেকে যে বিষাদ কুড়িয়ে এনেছিলো তা জেনো পথেই হারালো। বাহিরে মানুষ যা-ই বলুক, তার বাড়ির মানুষ তো তাকেই বিশ্বাস করে, ভালোবাসে।

এক আকাশ আনন্দ নিয়ে যখন তিস্তা তার আপার দিকে পা বাড়ায়,তখন ভেসে আসে আপার কিছু তিক্ত কথা। আপা ঘৃণিত মাখা কণ্ঠে বলছে,
-‘দেখেছো তো,আম্মা,তোমার এত অবুঝ মেয়ের শেষমেশ কী হলো! ও ই হয়তো কিছু ইশারা করেছে,তাই ওরে তুলে নিয়ে গেছে। কই,আমরা যে এত বড় হোলাম,আমাদের সাথে তো কেউ কিছু করলো না। তোমার মেয়ের বেলায় সব ব্যাটাছেলে খারাপ! সেদিন আমার স্বামীর উপরও কেমন আঙ্গুল তুলছিলা। এবার দেখো কে খারাপ।’

নিজের বড় মেয়ের এমন লাগামহীন কথায় ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় তনয়া বেগম। হুংকার ছেড়ে বলে,
-‘কে খারাপ তা ভালো করেই বুঝা যাচ্ছে। তুই এমন হবি জানলে, জন্মের পরই তোকে মেরে ফেলতাম। যাকে ছোটবেলা থেকে বড় করলি, মানুষ করলি,তাকে এসব বলতে লজ্জা করে না তোর? এ শিক্ষা পেলি? স্বামীর জন্য অন্ধই হয়ে গেছিস।’

আম্মার চেয়েও আপা দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বললো,
-‘আমি অন্ধ হয়েছি না তোমরা? ঐ মেয়েকে এখনো কীভাবে বাঁচিয়ে রাখছো মানুষের কথা থেকে? নোংরা মেয়ে তোমার। একদম ঠিক হয়েছে ওর সাথে।’

তিস্তা যেনো ভাষা হারিয়ে ফেললো এসব শুনে। তারই আপন বোন,তাকে এসব বলছে! এসবও শোনার ছিলো? এতক্ষণ পথের মানুষের কথায় সে মূর্ছে গিয়েছিলো, আর এখন ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। সে নোংরা মেয়ে! দুলাভাই ভালো,আর সে নোংরা! আপা কীভাবে বললো এসব?

তবে,আজ মেয়ে বলেই কী এত ঝঞ্জাট? মেয়ে হয়ে জন্মানোটা কী ছিলো অভিশাপ!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here