মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৪১ও ৪২

মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৪১ও ৪২
#আনিশা_সাবিহা

উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন আয়াশ। পায়ে ব্যথা পেলেন সেই সঙ্গে হাতে থাকা স্যালাইনের সিরিজে টান পড়াতে রেগে কটমট করে স্যালাইনের সিরিজের দিকে তাকালেন উনি। বুঝতে পারছি উনি স্যালাইন নামক জিনিসটির প্রতি খুবই বিরক্ত! তিতিবিরক্ত রূপে বললেন,
–“বার বার মানা করা সত্ত্বেও এই ডিজগাস্টিং জিনিসটা লাগিয়ে দিল। আই হেট দিস!”

বলেই সিরিজের ওপর হাত রাখলেন উনি। আমার বুঝতে বিন্দুমাত্র দেরি হলো না যে উনি কি অঘটন ঘটাতে চলেছেন। আমি কিছু বলার আগেই আমার পাশে আমায় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রুদ্র জোরে চিল্লিয়ে বললেন,
–“নো আয়াশ। ডোন্ট ডু দিস। পাগল হয়েছিস নাকি? কি করছিস? ওটা ওভাবে কেউ খোলে না।”

–“তো তুই খুলে দে। আমার অসহ্যকর লাগছে বলে দিলাম। এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি এভাবেই খুলে ফেলব।”

–“না খুলবি না। স্যালাইন তো শেষের দিকে একটু সহ্য কর।”

দাঁত কিড়মিড় করে নিজের হাতের দিকে তাকালেন উনি। তারপর আমার দিকে তাকালেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি উনার চোখের ভাষা। উনি চাইছেন আমি যেন উনার কাছে যাই। উনার চোখের ভাষা বুঝে এক পা বাড়ালাম আমি। দ্বিতীয়বার পা রাখতেই রুদ্র আমার দুটো বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলেন,
–“আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমায়।”

আমার বাহু ধরে আস্তে করে আমায় আয়াশের কাছে নিয়ে এলেন উনি। আমি ছোট্ট করে বললাম,
–“থ্যাংক ইউ।”

প্রতিত্তোরে রুদ্র কিছুই বললেন না। বরং আয়াশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললেন,
–“তোর বউ তোর কাছে ফিরিয়ে দিলাম। তাও খুব সাবধানে। এর বদলে আমি কি পাচ্ছি?”

আয়াশ আমার হাত টেনে ধরলেন। হেঁচকা টানে নিজের পাশে বসিয়ে দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে আমার বাহুর ওপর যেখানে রুদ্রের হাত ছিল সেখানে হাত রাখলেন হয়ত এটা বোঝানোর জন্য যে রুদ্রের আমায় ছোঁয়া উনি পছন্দ করছেন না। রুদ্র তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে হালকা কাশলেন। অতঃপর আয়াশ বললেন,

–“তুই ফিরিয়ে না দিলেও ওকে আসতে হতো। ও না চাইলেও ওকে আসতে হতো। আসতেই হতো। ওকে আমি নিজের নামে করে নিয়েছি বহু আগে। আর এর বদলে তুই আমার হাতে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় খেতে পারিস।”

–“দ্যাটস নট ফেয়ার আয়াশ! তুই একই রকম রয়ে গেলি। উপকার করলাম এতো বড় তাও এর বদলে মার খেতে হবে? তাহলে তো এর থেকে ভালো ছিল আনিশাকে সিন্দুকে বন্ধি করে রেখে আসা।”

রুদ্রের কন্ঠে নূন্যতমও রসিকতার ছাপ পেলাম না। অথচ উনি রসিকতা করার চেষ্টা করছেন। যেন উনি মজার মাঝে আছেন সেটা বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমি চোখ সরিয়ে আয়াশের দিকে তাকালাম। এই মানুষটা যাকে কিছুক্ষণ না দেখলে সবটা ফাঁকা লাগে। তার এই সুন্দর চেহারা যেটা না দেখলে ভেতরটা খালি লাগে। যাকে না দেখলে মনটা হাহাকার করে তাকে অনেকক্ষণ পর দেখছি তাও এই অবস্থার। কপালে মোটা ব্যান্ডেজ! নিশ্চয় প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছেন? কাল রাতে তো দেখেছিলাম কপাল থেকে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। ভাবতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। রক্তের কথা মনে করতেই ভয়ে আয়াশের এক হাত খামচে ধরলাম।

আমার দিকে খানিকটা চমকে তাকালেন আয়াশ। উনি রুদ্রের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত ছিলেন। এমন কর্মকান্ডে কিছুটা হকচকিয়ে তাকালেন। উনি তখনই আমার হাত ধরে উঠে বসতে বসতে বললেন,
–” আর ইউ ওকে? ঠিক আছো তুমি?”

–“হু! রক্তের কথা মনে পড়ে গেছিল।”
আয়াশ চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। পেটের দিকে তাকালেন। বুঝতে পারলাম উনার পেটে ব্যথা লাগছে। আমি উনার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
–“আপনি বার বার উঠে বসছেন কেন? অযথা উঠে লাফ দিয়ে বসার কি দরকার? আপনি সুপারম্যান না!”

আয়াশ বালিশে আধশোয়া হয়ে পড়লেন। তারপর রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–“তোর ওপর আমি চরম রেগে আছি রুদ্র! লাইক সিরিয়াসলি? তুই দেশে ফিরেছিস হসপিটালে নিজের প্র্যাকটিস শুরু করেছিস অথচ আমাকে জানাস নি। কয়েকদিন পর দেখা যাচ্ছে বিয়েসাদী করে ফেলবি আর আমাকে জানাবিও না। হুট করে বউ নিয়ে হাজির হয়ে বলবি, আয়াশ এই দেখ এটা আমার বউ।”

আমি আয়াশের এরূপ কথায় ফিক করে হেঁসে দিলাম। উনাকে এভাবে কথা বলতে দেখে বিস্মিতও হলাম বটে। কারণ আয়াশকে অন্য কারো সামনে এভাবে মন খুলে কথা বলতে কখনো দেখিনি। এই প্রথম দেখছি রুদ্রের সঙ্গে মন খুলে মজা করে কথা বলছেন। তাই উনার দিকে বিস্ময়ের নজরে তাকিয়ে আছি। রুদ্র ফিচেল গলায় বললেন,
–“তুই কি করলি? কম বেইমানি তো করিসনি। হুট করে বিয়ে করে ফেললি। একবারও জানাসনি। একদিন ফোন দিলাম জন্য জানতে পেরেছি তুই ম্যারিড! এখনো এই বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছি না। এখন আমিও যদি একই কাজ করি তাহলে শোধবোধ হয়ে যাবে।”

–“আমার কথা আলাদা। এইযে সামনে যেই মেয়েটাকে দেখছিস সেই মেয়েটা বিয়ে করা তো দূর। পুলিশ ডেকে এনেছিল। আমাকে ধরিয়ে দেবে বলে। কত সাংঘাতিক মেয়ে জানিস? দুই আঙ্গুলের মেয়ে মাথায় জিলাপির প্যাঁচ। বিয়ে না করাই ভালো ছিল। আসলে মেয়েদের মাথায় এমন এমন প্যাঁচ চলে যা আমাদের মতো সহজসরল ছেলেদের বোঝার মতো ক্ষমতা নেই।”

আয়াশের এমন কথার জন্য চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি উনার দিকে। এসব কি কথা বলছেন উনি? চোখ রাঙাচ্ছি বার বার। আয়াশ এবার ভয় পাওয়ার ভং ধরে রুদ্রকে ইশারা করে বললেন,
–“দেখ দেখ, কিভাবে তাকাচ্ছে? খেয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে।”

রুদ্র হেঁসে দিলেন। বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–“বিয়ে করেছিস তোকেই তো সামলাতে হবে না? তোরা কথা বল। আমি কাবাবে হাড্ডি হতে চাই না।”

বলেই কোনোরূপ কথা না শুনে রুদ্র হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমার নজর সেদিকে নেই। আয়াশের দিকে নজর আমার। ধীরে ধীরে আমার চোখজোড়া পানিতে টলটল করতে লাগল। অস্পষ্ট হয়ে এলো আয়াশের চেহারা। সেই অস্পষ্ট দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম উনি আমার হাতজোড়া ধরছেন। হাত ধরে ধীরে ধীরে নিজের হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলেন উনি। উনার আলতো ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলাম আমি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আমার চোখজোড়ায় আলতো হাত রেখে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নিলেন পানি।

–“কাঁদছো কেন? নীলাদ্র তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে না? সেজন্য এখনো অবধি কষ্ট পাচ্ছো কাঁদছো?”

আমি মাথা নাড়ালাম। আয়াশ চোখজোড়া সরু করে বললেন,
–“তাহলে কাঁদছো কেন নিশাপাখি?”

গলা ধরে এলো আমার। তবুও বলল,
–“আপনার জন্য।”

–“আমি…? আমি কি করেছি? কোনো ভুল হয়েছে আমার দ্বারা? কি ভুল হয়েছে বলো।”

–“মস্ত বড় ভুল করেছেন আপনি। বাজে লোক আপনি। কাল রাতে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছিলেন না। আমি তো ভেবেছিলাম… ”

বলেই থেমে গেলাম। বাকিটুকু বলার সাহস আমার হয়নি। আয়াশ মুচকি হাসলেন তাতে। আমার বড্ড রাগ হলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে চোখ রাঙালাম।
–“আপনি হাসছেন? বজ্জাত লোক!”

–“হাসছি কারণ আছে। এতোকিছুর পরেও এটা ভেবে আমার খুশি লাগছে যে তুমি আমার জন্য কাঁদো। তুমি আমার জন্য চিন্তা করো। আমাকে হারানোর ভয় পাও।”

পেছন থেকে এবার আমায় জড়িয়ে ধরলেন আয়াশ। ফিসফিস করে বললেন কথাগুলো। এক স্নিগ্ধ অনুভূতি ছুঁয়ে গেল আমায়। তবুও যেন স্বীকার করতে মন চাইলো না বলে জবাবে নিরবতা পালন করলাম। আয়াশ এবার এক ভয়ানক প্রশ্ন করে বসলেন। বেশ শান্ত গলায় বললেন,
–“ভালোবাসো এই বাজে লোককে?”

শ্বাস আঁটকে গেল আমার। মূহুর্তেই ঘামতে শুরু করলাম। ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে। সত্যিটা বের হতে চাইছে না। আমি হালকা উনার দিকে ঘুরে উনার বুকে মাথা রেখে চোখ বুঁজে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
–“আ…আমার মাথা ঘুরছে। শরীর খারাপ লাগছে।”

আয়াশ কি বুঝলেন জানি না। আমিও বা আয়াশকে কতটা বোকা বানাতে সক্ষম হলাম তাও জানি না। মনে হলো উনি বোকা বনে গেছেন আমার অভিনয়ে। আয়াশ আমার থুঁতনি ধরে নিজের মুখের দিকে তুলে বাঁকা হেঁসে বললেন,
–“ব্যাড এক্টিং! ডিজগাস্টিং মেলোড্রামার দিক থেকে তুমি বড্ড কাঁচা নিশাপাখি।”

মুখটা আমার তখনই বেলুনের মতো চুপসে গেল। এবার উচ্চস্বরে হেঁসে দিলেন আমার এই মুখ দেখে। তারপরেই চোখমুখ জড়িয়ে ফেললেন ব্যথায়। আমি আবারও উনার কাজে উনার পেটে আলতো করে হাত রাখলাম। ঠোঁট উল্টে বললাম,।

–“কোথায় লেগেছে আপনার? এভাবে হাসার কি খুব দরকার ছিল?”

–“এখন হাসাও অপরাধ?”

–“অপরাধ কি? কয়েকদিন আপনার ধীরে হাসতে হবে। এভাবে হাসলে ব্যথা লাগবে তো।”

হুট করেই আমার উল্টে রাখা ঠোঁটে আলতো চুমু খেয়ে বসলেন উনি। আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম। উনার মাথায় কখন কি চলে সেটা কি বুঝতে পারব না? আয়াশ এক গাল হেঁসে বললেন,
–“সরি বাচ্চা বউ! এমনভাবে ঠোঁট উল্টে ছিল যেন ঠোঁটজোড়াও ডাকছিল। কিস দিয়ে যেতে বলছিল।”

আমার চোখজোড়া সরু হয়ে এলো। কি বলে এই লোক? উনার দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে দেখতে উনি ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
–“সত্যি বলছিল। তোমার লিপস বলছিল, ‘কিস মি। কিস মি। কিস মি!’ তাই মানা করতে পারিনি।”

উনার কথায় বিষম খেলাম আমি। এমন উদ্ভট কথা কেউ বলে? আমি ঝাঁঝালো কন্ঠে বললাম,
–“ঠোঁটজোড়া আপনার মতো লজ্জাহীন নাকি?”

–“তার থেকেও বেশি লজ্জাহীন নাহলে এভাবে উল্টে থাকত? ঠোঁটজোড়া জানে না? এভাবে থাকলে নিজেকে সামলাতে পারি না?”

বলেই একহাতে কোমড় পেঁচিয়ে ধরেন আয়াশ। নিজের সঙ্গে আমায় চেপে ধরেন উনি। টাল সামলাতে আমি উনার বুকে হাত রাখি। তারপর দূরে ঠেলে দিতে দিতে বলি,
–“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং আয়াশ? এটা হসপিটাল।”

–“হসপিটালে স্পেশাল কিছু করা যাবে না এই কথা কোথায় লিখা আছে? লিখা থাকলেও মানতাম না। ডোন্ট ডিস্টার্ব। আদারওয়াইজ, স্যালাইনের সিরিজ খুলে ফেলব। অন্যহাতেও ধরব তোমায়। পালিয়ে যাই, পালিয়ে যাই করতে পারবে না। ”

আমি কিছু বলার সুযোগই দিলেন না আয়াশ। ঠোঁটে আবারও পেলাম উনার ঠোঁটের অদ্ভুত মোহময় ছোঁয়া! নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে আমার। মত্ত হয়ে পড়েছেন উনি আমার প্রতি! উনার এই উন্মাদনা আমার মনে প্রেমের ঝড় সৃষ্টি করছে উনি কি সেটা জানেন?

আচমকা লজ্জাজনক ও এমন ব্যক্তিগত দুজনের সময় কাটানো দেখে তড়িৎগতিতে দরজা থেকে সরে আসে রুদ্র। ওর পুরো শরীর ঘেমে একাকার। সেগুলো শুকিয়েও যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কিন্তু তার মনের এক গভীর ক্ষত এখনো তরতাজা। সেই ক্ষত তারই বেস্টফ্রেন্ডের বউয়ের দেওয়া। আনিশা নামক মেয়েটির দেওয়া। সেই মেয়েটি নিজের অজান্তে রুদ্রের মনে ক্ষত সৃষ্টি করে ফেলেছে।

চোখ বুঁজে ফেলে রুদ্র। তার বুকে কেউ তীব্রভাবে আক্রমণ করে ক্ষত-বিক্ষত করছে। এতোক্ষণ রুদ্র কেবিনের দরজার মধ্যের কাঁচ দিয়ে আনিশাকে গভীরভাবে দেখে যাচ্ছিল। আয়াশের দেওয়া আনিশাকে প্রতিটা ছোঁয়া রুদ্র পর্যবেক্ষণ করেছে। যা রুদ্রকে আহত করে ফেলেছে। এই দৃশ্য সহ্য করার মতো ছিল না। এর চেয়ে বড় যন্ত্রণার যেন আর কিছু নেই।

–“ভুলটা আমারই ছিল। আমিই বোকা রয়ে গেলাম। না জেনে, না বুঝে এই মায়াবিনীর মায়ার ভয়ানক জালে জড়িয়ে পড়লাম। সেই জাল কি কেটে বের হতে পারব কখনো?”

রুদ্র আরো দূরে সরে আসে। তার চোখজোড়া চাইছে না আর সেই দৃশ্য দেখতে যেটা দেখলে তার হৃদয় পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। নিজের ওপরই অসম্ভব রাগ হলো তার। হাত দুটো এদিক-ওদিক ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
–“আমি এতটুকু সময়ে সামান্য একটা মেয়ের প্রতি এতোটা ঝুঁকে পড়তে কি করে পারি? ওর সাথে দেখা হয়েছে ২৪ ঘন্টাও হয়নি আর আমি কিনা ওর সম্মন্ধে কিছু না জেনেই…”

বলেই থামল রুদ্র। ঠোঁটের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল সে। নিজেকেই যেন তার সহ্য হচ্ছে না। একটা সময় হাত সরিয়ে জোরে জোরে বেশ কয়েকবার শ্বাস নিল সে। বড় বড় শ্বাস নিলে নাকি অস্থিরতা কাটে। আসলেই কাটে। রুদ্র আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে পড়ল। করিডোরের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত দেখে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে। আয়াশের ডক্টরের সঙ্গে কথা বলবে সে। ওর রিকভারির কত দিন লাগবে সেসব কিছু ডিটেইলস জানা দরকার তার। আয়াশ নামক ছেলেটাকে সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। এভাবেই ঘুরেফিরে বেড়াতে সে বিন্দুমাত্র দেরি করবে না।

আমি পায় নামিয়ে বেডে বসে আছি। বালিশে ঠেস লাগিয়ে আধশোয়া হয়ে আমার হাতখানি ধরে রয়েছেন আয়াশ। তার মনের নেই বিন্দুমাত্র অস্বস্তি! কিন্তু আমি অস্বস্তি আর লজ্জাতে মরে যেতে ইচ্ছে করছি। বার বার হাত টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলেও আয়াশ নির্বিকার।

সামনে অর্ক ভাইয়া বসে আছে। মামা ও মামি রাস্তায়। আমাদের দেখতে আসছেন। অর্ক ভাইয়া মিটমিটিয়ে হাসছে। তা দেখে আমি মুখ তুলেও তাকাতে পারছি না। অর্ক ভাইয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,

–“এখনো কিন্তু সেভাবে কেউই জানে না তুমি আর আনিশা বিবাহিত ধর্মীয়মতে। আর হসপিটাল পাবলিক প্লেস। যদিও তোমাদের রোমান্সে বাঁধা দিতে পারি না তবুও বলছি। তুমি তো আনিশাকে মিডিয়ার সামনে বা মিডিয়া যেমন প্রশ্ন করে সেসবে আনিশাকে ইনভলভ করতে চাও না। সো বি কেয়ারফুল। বাইরের কেউ বিষয়টা না জানলে ভালো হয়। ইভেন হসপিটালের রেজিষ্ট্রেশন খাতাটা আমার পূরণ করা তোমার কাজিন হিসেবে পূরণ করেছি আয়াশ। আই থিংক তুমিও চাও না আনিশা হ্যারাজ হক। এর আগেও কিন্তু একবার মিডিয়া ওকে নানান প্রশ্ন করেছিল। বিষয়টার খেয়াল রেখো।”

–“হুমম ঠিকই বলেছো। কিন্তু কেবিনে তো কেউ নেই। অ্যান্ড ইউ নো দ্যাট যে আমি বউ ছাড়া থাকতে পারি না। তোমার বোন জাদু করে আমায় বউ পাগল বানিয়ে রেখেছে।”

চোখজোড়া ছোট হয়ে এলো আমার। পানিভরা চোখ থেকে পানি গায়েব হয়ে গেল। লোকটার কথায় এমন যে দুঃখের বদলে রাগ লাগবে। আমি কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। এখন কিছু বললে আবারও ঠোঁটকাটা স্বভাবের লোকটা উল্টাপাল্টা কিছু বলে বসলে নিজেকে আবারও হয়ত সুইসাইড করতে হবে লজ্জায়। লজ্জার সমুদ্রে ডুবিয়ে মারতে চাইছেন উনি!

আমার ব্যান্ডেজ করা হাত সযত্নে নিয়ে হাতের ওপর হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন আয়াশ। এবার উনি থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
–“কি হয়েছিল তোমার সাথে? তোমার এই সুন্দর হাত দুটোর এই অবস্থা কে করেছে?”

গতকাল রাতের কথা মনে পড়ল আমার। কি ভয়াবহ ছিল সেসব মূহুর্ত। গায়ে এখনো অবধি কাটা দিচ্ছে আমার। কিভাবে আমি একজনকে আঘাত করেছিলাম তাও ছুরি দিয়ে। আবার নিজেকেও আঘাত করেছি। আর আমাকে বিক্রি করার কথা মাথায় আসতেই আমি এবার নিজ থেকে আয়াশের হাত চেপে ধরলাম। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না নিবারণ করার চেষ্টায় থাকলাম। আয়াশ আমার মাথায় হাত রাখলেন। তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বললেন,
–“নীলাদ্র?”

–“ও খুব খারাপ আয়াশ। আমি আন্দাজও করতে পারিনি। ওর এমন মুখের পেছনে একটা নোংরা মানসিকতা লুকিয়ে থাকবে। কাল ও আমার সাথে যা করেছে সেটার কারণে লজ্জায় মাটিতে মিশে গেছি আমি। আমি বুঝতেও পারিনি ছেলেটা এমন। একদিন কিনা ওর হাত ধরে আমি পালাতে চেয়েছিলাম। ভাবলে নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা বাড়ছে আমার।”

শব্দ করে কেঁদে দিয়ে কথাগুলো বললাম আমি। মাথা নিচু করে কেঁদে চলেছি। বার বার মনে হচ্ছে নীলাদ্র যদি আবার আসে আর আমায় পাচার করার জন্য দিয়ে যায়? ভাবতেই কান্নার বেগ দ্বিগুন বাড়ল। অর্ক ভাইয়া মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছিল। এসব শুনে সে আর ঠিক থাকল না। একটু এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বলল,

–“যা হবার হয়ে গিয়েছে। তবে এটা বলা যায় নীলাদ্র নামক বাস্টার্ড ছেলেটা এসব করে কোথাও পালাতে পারবে না। যেই ছেলে মেয়েদের সম্মান করতে পারে না। সেই ছেলে মানুষের কাতারে পড়ে না। কি হয়েছে তোর সাথে? আমাদের বল। আর কাঁদছিস কেন? তুই তো এখন একেবারে নিরাপদে আছিস।”

আমি কিছু বলার আগেই আমার মাথায় হাত রেখে বুলিয়ে দেন আয়াশ। কৌশলে সরিয়ে দেন অর্ক ভাইয়ার হাত। সেটা ভাইয়া না বুঝতে পারলেও আমার বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয় না। কারণ উনার এমন আচরণে আমি অভ্যস্ত। আমি হতভম্ব এটা ভেবে যে একটা মানুষ কতটা পজেসিভ হলে নিজের অসুস্থতার মাঝেও এসব মনে রাখা যায়?

আমার গাল ধরে আলতো ঘুরিয়ে নিলেন আয়াশ। আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
–“হেই গার্ল! লুক এট মি। আমি জানতে চাই এসব কে করেছে? কেন করেছে? কাল রাতে কি ঘটেছিল তোমার সাথে? আমি জানতে চাই। আমার দুর্বলতার সুযোগ যারা নিয়েছে তাদের সঙ্গে আমি এমন কিছু করতে চাই যাতে ওরা তড়পাতে থাকে। তোমার সঙ্গে যেই বিশ্রী কান্ড ঘটিয়েছে তার থেকে অধিকতর বিশ্রী কান্ড ঘটাতে চাই আমি। দরকার হলে খুন করব I swear!”

আমার কান্নার বেগ ধীরে ধীরে কমে এলো। আয়াশ একটু থেমে আমার দুটো হাত ধরে বলল,
–“এসব বাজেভাবে আঘাত কে করেছে? ওই বাস্টার্ড নীলাদ্র?”

আমি মাথা নাড়ালাম। তাতে হালকা ভ্রু কুঁচকান আয়াশ। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
–“এটা আমি নিজে করেছি। ও…ওরা আমার কাছে আসছিল আর আমি বুঝেই উঠতে পারছিলাম না কি করব। বার বার বলেছি কাছে এলে নিজেকেই মেরে দেব। ওরা শোনেনি। ভুলবশত ওদের ভয়ে আচমকাই এসব করে বসি।”

–“কাদের কথা বলছো তুমি? নীলাদ্র ছাড়া আরো কেউ আছে?”

আমি আবারও মাথা দুলিয়ে বললাম,
–“র…রক্তিম বাহাদুর!”

আয়াশের দৃষ্টিতে বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হলো। আমি যেন অবিশ্বাস্য কোনো কথা বলে ফেলেছি। কন্ঠে এক পাহাড় সমান বিস্ময় ঢেলে বললেন,
–“হোয়াট? ওই রক্তিম? এতোদূর এগিয়েছে? এতোদূর হাত বাড়িয়েছে? এতো প্লানিং করেছে? কিন্তু ওর তো আরো কয়েকবছর জেলে থাকার কথা। মাত্র একবছরে বেরিয়ে এলো? নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করা খুব ভালো করে জানে। কিন্তু আমি আয়াশ! আয়াশ রায়হান। যার কথা শুনলে এখনো ক্রিমিনাল লইয়ার ভেবে লোকজনে ভয়ে কাঁপে। তার দুর্বলতায় আঘাত করে জীবনের সবথেকে বড় ক্ষতিটা করে ফেলেছে।”

আমি ধীরে ধীরে সবটা আয়াশকে জানালাম। আমার কতটা সম্মানহানির চেষ্টা করা হয়েছে এসব মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলাম আমি। অর্ক ভাইয়া আর আয়াশ মনোযোগের সহিত শুনছিলেন। যদিও আন্দাজ করতে পারছি আয়াশ এসব শোনার পর কেমন রিয়েক্ট করবেন!

কিন্তু এতো ভয়ানক রিয়েক্ট করবে তা জানতাম না। আচমকা বিকট শব্দে আমার পিলে চমকে উঠল। হৃদপিণ্ড ধরাস ধরাস করতে লাগল। অর্ক ভাইয়াও চমকে তাকালেন। আমি পিছু ঘুরে দেখি স্যালাইন যার সঙ্গে টানানো ছিল সেটাই একেবারে জানালা বরাবর ছুঁড়ে মেরেছেন। যার কারণে জানালার কাঁচ ভেঙে দফারফা হয়ে গেছে। স্যালাইনের সিরিজ তো সেই সঙ্গে খুলেই গেছে।

আমি বুঝছি না স্যালাইনের সঙ্গে উনার কি শত্রুতা? এর আগেও নাকি একবার সিরিজ খুলে ফেলেছিলেন। আয়াশের হাত দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগল এতো বিশ্রী ভাবে সিরিজ খুলে যাওয়ায়। তাতে আমার গলা শুকিয়ে এলো কাঁপতে কাঁপতে চোখ বুঁজে ফেললাম আমি। অস্পষ্ট সুরে বললাম,
–“র…রক্ত!”

হালকা চোখ খুলতেই দেখলাম আয়াশ ধড়ফড়িয়ে উঠছেন। মুখশ্রী লাল বর্ণের হয়ে উঠেছে উনার। রাগে উনার ঠোঁটজোড়াও কাঁপছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন উনি। পায়ের ব্যথায় পড়ে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে নিলেন। বিড়বিড় করে ঘাড় কাঁত করে কিছু বললেন। আমি কিছুই বলতে পারছি না। রক্ত দেখে মস্তিষ্ক অলরেডি শূন্য হয়ে পড়েছে। অর্ক ভাইয়া পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠলেন,

–“কি পাগলামি করছো আয়াশ? এমন করো না। শান্ত হও। রাগটা আমারও হচ্ছে। কিন্তু এভাবে উত্তেজিত হলে কি চলবে?”

আয়াশ কথাগুলো কানেই নিলেন না। আমিও কিছু বলতে পারছি না। এমনিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত নেই আমার শরীরে। যার কারণে খুব সহজে দুর্বল হয়ে পড়লাম। কিছু বলার আগেই রাগে হিসহিসিয়ে কোনোরকমে দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে গেলেন উনি। রুদ্রও কেবিনেই আসছিলেন। আয়াশকে এমন ভাবে বের হতে দেখে উনিও হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। আয়াশ পড়ে যেতে নিয়েছিলেন তাও ধরে ফেলে বললেন,

–“কি করছিস টা কি তুই আয়াশ? এদিকে আয়। বসবি চল। হাঁটতে পারবি না তুই!”

রুদ্রের কথারও তোয়াক্কা করলেন না উনি। রুদ্রকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রুদ্রও গেলেন উনার পিছু পিছু। আমি শুধু মাথায় হাত চেপে ধরে দেখছি। কি হয়ে গেল এসব?

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তাই বাস্তবতার ভিত্তি খুঁজবেন না। আর আয়াশের সঙ্গে ঠিক কি হয়েছিল তা পরবর্তী পর্বে বলা হবে। আজকের পর্বটা বেশ অগোছালো হয়েছে। ছোটও হয়েছে। বাইরে থেকে এসে তাড়াহুড়ো করে লিখেছি। আশা করি সমস্যাটা বুঝবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here