মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৪৪

মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৪৪
#আনিশা_সাবিহা

–“আমার কেন লজ্জা লাগবে? আপনি যদি অন্য কারো সামনে আমাকে কাজিন হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন আমি কেন আপনাকে ভাইয়া ডাকতে পারি না? আপনি কাজিন হলে সেই হিসেবে আপনি আমার ভাইয়ায় ডাকা উচিত তাই না?”

চোখমুখ জড়িয়ে এবার মনের মধ্যে থাকা সব রাগের সঙ্গে কথাগুলো বলে দিলাম আমি। তবুও যেন রাগ কমছে না। ইচ্ছে তো করছে আয়াশের জামার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলতে, ‘আমি তোর কোন জন্মের বোন রে? বোনই যদি হই তাহলে ব্ল্যাকমেইল করিয়ে জোর করে তিববার কবুল বলিয়ে নিয়েছিলি কেন? এখন আমি কাজিন হয়ে গেলাম?’

এসব ভাবতে ভাবতে রাগে ঘামতে শুরু করলাম। আর অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম আয়াশের দিকে। ধীরে ধীরে আয়াশের চোখমুখ স্বাভাবিক হয়ে এলো। উনার চেহারায় লাল ভাবটা গায়েব হতে লাগল। মুখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত ধরনের হাসি। একটু ঝুঁকে আমার সমান হয়ে আমার সামনে বরাবর বসে ভ্রু উঁচিয়ে বাঁকা হেঁসে বলেন,

–“আমার তো তোমায় কাজিন হিসেবে পরিচয় দেওয়ার দুটো কারণ আছে। প্রথমটা হচ্ছে তোমার আর আমার এই সম্পর্ক যেন সঠিক সময়ের আগে বাইরে ছড়িয়ে না পড়ে আর তোমায় হ্যারাজ না হতে হয় সেজন্য। আর আমি মৃধাকে বিশ্বাস করি না। মেয়েটা যে হারে কথা বলে যেন পেটের ভেতর থেকে সব কথা উগলে দিতে এক সেকেন্ডও লাগবে না। আর দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে…”

বলেই থামলেন উনি। আমি রাগে কটমট করে বললাম,
–“কি এমন কারণ?”

এবার উনি আমার আরো কাছে এসে আমার মুখে নিজের তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে নিজের হাসি প্রসারিত করে বলেন,
–“দ্যাটস সিক্রেট নিশাপাখি। এর জন্যও সঠিক সময় দরকার। এখন এটা বলছি না। বাট ওয়েট এ মিনিট! আর ইউ জেলাস?”

সব রাগ ঝড়ে গিয়ে চোখজোড়াতে নিজের হিংসা নামক জিনিসটা লুকানোর চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগে গেলাম। চোখ নামিয়ে নিয়ে হাতের আঙ্গুল মুখে দিতে নেব তৎক্ষনাৎ আমার হাত ধরে ফেলেন উনি। আমার বদঅভ্যেস হচ্ছে চিন্তায় পড়ে গেলে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে থাকা। সেটাই করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু হলো না। আয়াশ মাথা নাড়িয়ে বললেন,

–“নো নিশাপাখি। দাঁত দিয়ে নখ কাটবে আর তোমার মাথায় অন্য বাহানা কিলবিল করবে আমি জানি। সেটা আর হচ্ছে না। আই ওয়ান্ট টু নো আর ইউ জেলাস?”

আমি উত্তর দিতে পারলাম না। উনি আমার এতো কাছে থাকায় সবকিছু গুলিয়ে ফেললাম। চোখে চোখ অবধি রাখতে পারছি না আমি। আয়াশের চোখের গভীরতা আমি দেখেছি। এতোটা গভীরতাই ডুবে যাব আমি। সব গুলিয়ে ফেলব। উনি আমার উত্তর না পেয়ে বললেন,

–“তাছাড়া জেলাসি হলেও বা কি? তোমায় কাজিন বললেও বা কি? আমি ভুলিনি আমার কাছে খুব কম সময় আছে। সীমিত সময় রয়েছে। এক বছর প্রায় কেটেই গেছে। মনে হচ্ছে এবার চ্যালেঞ্জে হেরে যাবে আয়াশ রায়হান। জিততে পারবে না তার প্রেয়সীর মন।”

এবার আয়াশের চোখের দিকে তাকাতে বাধ্য হলাম আমি। উনার প্রতিটা শব্দ আমার হৃদয়ে আঘাত আনলো। সত্যিই তো এক বছর কেটে গেছে। ভেতর থেকে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। আয়াশ একটু সরে বসলেন। অতঃপর বললেন,

–“আর হাতে মাত্র পনেরোটা দিন। তারপর তোমার বার্থডে। একবছরে যা পারিনি পনেরো দিনে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তুমি তো একদিন আমার কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছিলে। তাই আমি ডিসাইট করেছি তোমার জন্মদিনে সব থেকে বড় উপহার হিসেবে তোমায় মুক্ত করে দেওয়া যাক? খোলা পাখির ন্যায় উড়তে পারবে তুমি। আয়াশ আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। আর ইউ হ্যাপি?”

সব দুঃখ এসে একসঙ্গে ভীড় লাগিয়ে দিল। মনটা ভার হয়ে এলো। কান্না পেয়ে গেল আমার। উনি তো বলেছিলেন আমার কাজকর্ম উনাকে বুঝিয়ে দেবে আমার মনে উনার জন্য কি অনুভূতি। তবে কেন উনি বুঝছেন না? তাহলে কি উনি বুঝবেন না? এসব ভেবে কান্না বেরিয়ে আসতে লাগল। আয়াশের থেকে কান্না লুকাতে আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। চোখের কার্ণিশে পানি জমে গেল।

–“তবে কি জানো? আমার একটা আফসোস। যেই একটা বছর তুমি আমার কাছে থাকলে সেই একটা বছর আমি তোমায় সেফ করতে পারলাম না। তোমার অনেক বড় অসম্মান হয়ে গেল তাও হয়ত আমারই জন্য। বাট আই প্রমিস ওদের বেঁচে থাকা কঠিন করে দায়িত্ব আমার।”

আয়াশের এসব কথায় রাগে আরো বেশি কান্না পেয়ে গেল আমার। উনি নাকি খুব বোঝেন আমাকে। এখন বলতে ইচ্ছে করছে, ‘কচু বোঝেন আমায়।’

–“কি হলো? চুপ করে গেলে যে? ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছো কেন? রক্তের ব্যাগ রয়েছে না ওদিকে? আমার দিকে তাকাও।”

বলেই আমার থুঁতনি একহাত দিয়ে ধরে নিজের দিকে ফেরালেন উনি। চোখজোড়া তখন অশ্রুসিক্ত ছিল। আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড পলকহীন নজরে দেখে হাত দিয়ে চোখ বুলিয়ে বললেন,
–“এই অশ্রু কিসের? দুঃখ নাকি আনন্দ?”

–“আপনাকে জানতে হবে না ওসব। আমায় আমার মতো ছেড়ে দিন।”

বলে নিজেকে ধাতস্থ করে উনার হাত সরিয়ে একটু সরে বসলাম। যদিও বেডে খুব বেশি একটা জায়গা নেই তবুও। আয়াশ আবারও আগ বাড়িয়ে বললেন,
–“ডিভোর্স স্পেশালিষ্ট লইয়ারের কাছে এপ্লিকেশন পাঠাব?”

চিৎকার করতে গিয়েও পারলাম না যেন। এতো হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা কেন হচ্ছে? আমিই তো চেয়েছিলাম মুক্তি তবে? আমি এবার পানি ভরাট চোখে আয়াশের দিকে তাকিয়ে রোবটের মতো বললাম,

–“আপনি তো এতো তাড়াতাড়ি নিজের চ্যালেঞ্জ হেরে যাওয়ার মানুষ নন। তবে এই চ্যালেঞ্জের বেলায় কেন এমন করছেন? কেন ছাড়ছেন এতো তাড়াতাড়ি?”

বলে নিজেই বোকা বনে গেলাম এবার। আয়াশ আমার হাত ধরে আমার কাটা স্থান গুলোতে ঠোঁট বুলাতে বুলাতে বললেন,
–“তুমি কি চাও আমি তোমায় ধরে রাখি?”

আমি হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে নিলাম রাগে বা অভিমানে। হয়তবা অভিমানেই। আমার আকাশটাকে আজ আয়াশ অভিমানে, অভিমানে ভরিয়ে দিয়েছেন। সেখানে শুধু অভিমানের মেঘ ভাসছে। সেই মেঘ দ্বারা বর্ষণ হতে পারে যেকোনো মূহুর্তে। আমার এমন কর্মকান্ডে আমার চুলের নিচ দিয়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে অন্যহাতটা কোমড়ে রেখে টেনে নিলেন নিজের একেবারে কাছে। চেপে ধরলেন নিজের সঙ্গে কোমলভাবে যাতে অন্যহাতে ব্যাথা না পাই। আবার প্রশ্নবিদ্ধ করলেন উনি।
–“কি হলো? এসব প্রশ্ন করলে চুপ হয়ে যাও কেন? উত্তর দাও!”

–“জানি না আমি। ছাড়ুন তো। আয়াশ ভাইয়া ছাড়ুন আমাকে।”

অকপট রাগ নিয়েই বললাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে দুইহাত দিয়ে উনার এই বাঁধন ছেড়ে বের হতে চাইলাম। আয়াশ শান্ত সুরে একটু ধমক দিয়ে বললেন,
–“হাতে লাগবে তোমার। ভুলে যেও না স্যালাইনের মতোই সিরিজ ফুটিয়ে রাখা আছে তোমার হাতে। হাত নড়াবে না। আর বার বার ভাইয়া বলেছো তো তোমার খবর আছে।”

–“নিজের বেলায় ষোল আনা আর আমার বেলায় এক আনাও না! কাজিন বলেছেন ভালো কথা। এখন আমাকে মনের সুখে ভাইয়া ডাকতে দিন, আয়াশ ভাইয়া।”

আয়াশ ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লেন। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি হাত বাড়িয়ে নিতে গেলেই উনি ঢকঢক করে পানি খেয়ে ফেললেন। আমি উনার কাজে ভ্যাবাচেকা খেয়ে সরু দৃষ্টিতে তাকালাম। রাগে ফুঁসে উঠে বললাম,
–“আপনি…আপনি একটা বাজে আর অসভ্য লোক।”

–“আই নো দ্যাট। দিনে না হলেও ২০ বার কথাটা শুনতে হয় আমার।”

নির্বিকার সুরে বললেন আয়াশ। আমার গালে হাত ছুঁইয়ে স্মিত হাসি দিয়ে বললেন,
–“পানি খাবে?”

আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ালাম। তারপরেই উনি বললেন,
–“উমম… পানি খেতে পারবে। বাট সেটা আমার মুখ থেকে খেতে হবে। এটা তোমার পানিশমেন্ট।”

উনার কথায় চোখজোড়া কপালে উঠে গেল আমার। অটোমেটিক বিষম খেয়ে কাশি উঠে গেল আবারও। আয়াশ এবার তাড়াহুড়ো করে পানি গ্লাসে ঢেলে আমার মুখের সামনে ধরলেন। আমি পানি খেয়ে নিলাম। তারপরেই পৈশাচিক হাসি দিতেই আয়াশের কপালের ভাঁজ পড়ল। আমি কিছুটা ভাব নিয়ে বললাম,
–“পানি খেয়ে নিয়েছি। এখন দিন পানিশমেন্ট।”

বলেই শুয়ে পড়লাম আমি চাদর মুড়ি দিয়ে। কারণটা হলো আয়াশের ওপর এসব ব্যাপারে আমার ভরসা নেই। উনি যখন-তখন এমনসব কাজ করে ফেলতে পারেন যে তখন লজ্জার সঙ্গে মিশে যেতে মন চাইবে। কিন্তু নিজের পৈশাচিক হাসি টিকল না বেশিক্ষণ। আয়াশ নিজেও চাদরের মধ্যে ঢুকে আমার ওপর বেশ খানিকটা ঝুঁকে পড়লেন। সাদা চাদর আর দিনের আলো থাকার কারণে উনাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। হাসিটা মোটেও সুবিধার নয় উনার। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হেসে বললেন,

–“আমার প্রথম পানিশমেন্ট অমান্য করে অনেক বড় অন্যায় করে ফেললে। গেট রেডি ফর স্পেশাল পানিশমেন্ট।”

–“আ…আমার ভালো লাগছে না আয়াশ। ঘুম পাচ্ছে। মাথা ঘুরছে। দেখি সরুন একটু ঘু…ঘুমাবো।”

–“আমি তোমায় একবার বলেছি মাই বিউটিফুল ওয়াইফ যে এসব মেলোড্রামা তুমি করতে পারো না।”

চোখ বন্ধ করে ফেললাম। নাহ, লোকটাকে কোনোভাবেই মানানো যায় না। আফটার অল ইনি একজন লইয়ার। তাকে যুক্তি, তর্ক আর নাটকে হারানো বড্ড মুশকিল। চোখ খুলতেই চমকে উঠলাম আমি। আমার নাকের সঙ্গে নিজের নাক ঘষে দিলেন আয়াশ। ফিসফিসিয়ে বললেন,

–“আমার হাতে এখনো ১৫ দিন আছে। তুমি বলেছিলে না এতো সহজে চ্যালেঞ্জ না হারতে তো চলো হারবো না এতো সহজে। ইটস টাইম টু ডু সামথিং স্পেশাল! চলো, এই হসপিটালে কিছু মনে রাখার মতো মোমেন্ট ক্রিয়েট করা যাক।”

আমি আর কিছু বলার মতোই সুযোগ পেলাম না। আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। খোঁচা খোঁচা দাড়ির ঘষা লাগল আমার গালে। আমার ঘাড়ে নিজের ঠোঁটজোড়ার স্পর্শ দিয়ে চলেছেন একের পর এক। নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে আমার।

হঠাৎ করেই দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম আমি। আয়াশকে ঠেলতে শুরু করলাম এবার। না জানি কে এসেছে! চোখমুখ খিঁচে বললাম,
–“আয়াশ? কেউ এসেছে! সরে যান।”

আমার কথা যেন উনার কানেই গেল না। আমার বাম গালের তিলে অনবরত চুমু একে দিয়ে যাচ্ছেন উনি। ছাড়বার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। উপায়ন্তর না পেয়ে উনার বুকে হাত রেখে সজোরে চিমটি মেরে দিতেই নড়েচড়ে উঠে সরে গেলেন। চাদর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
–“রুদ্র তুই? আসার আর টাইম পেলি না ইয়ার! একটুখানি তো রোমান্স করতে দিতে পারতি!”

এক আকাশ সমান লজ্জা ঘিরে ধরল আমায়। তার মানে রুদ্র এসেছেন। এখন কি হবে? আমি তো মুখ দেখাতেই পারব না। মনে মনে আয়াশকে শত বকা দিয়ে চাদর থেকে চোখ বের করে হালকা উঁকি দিতেই একটা নার্স আর রুদ্রকে দেখতে পেলাম। রুদ্র মুচকি হেঁসে বললেন,

–“গেট লাগিয়েও তো দিতে পারিস ইয়ার। ওপেনলি এসব করলে হসপিটালের পুরো পাবলিক চলে আসবে ফ্রিতে রোমান্টিক সিনেমা দেখতে।”

আমি আর মুখ দেখাবার অবস্থায় রইলাম না। চুপটি করে ঘাপটি মেরে চাদরে লুকিয়ে থাকলাম। রুদ্র আবারও বললেন,
–“তোর কিছু মেডিসিনস নিতে হবে সেজন্যই এসেছি। নয়ত কাবাব মে হাড্ডি হনেকা মেরা কই শখ নেহি থা।”

আয়াশকে মেডিসিন দিয়েই বেরিয়ে গেলেন রুদ্র আর নার্স। আমি সঙ্গে সঙ্গে চাদর থেকে বেরিয়ে আয়াশের বাহুতে আঘাত করে তেজী কন্ঠে বললাম,
–“আপনি খুব খারাপ। সবসময় আমায় লজ্জায় ফেলেন।”
আয়াশ এসবে হু হা করে হাসতে শুরু করলেন।

রাত ঘনিয়ে এসেছে। আশেপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কেবিনে পিনপতন নীরবতা। আমার চোখে ঘুম নেই। বার বার উশখুশ করছি। আয়াশ চোখ বুঁজে রয়েছেন। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমায় নিজের সঙ্গে জাপ্টে ধরে ঘুমিয়ে যাচ্ছেন উনি আমার ঘুম হারাম করে। বিকেলে মা-বাবা, তুষার ও মামা-মামী এসেছিল দেখা করতে। দেখা করে সকলে চলে গেছেন। অর্ক ভাইয়াও আজ গেছেন। রয়ে গেছেন রুদ্র! একবারও বাড়ি যাওয়ার নাম করেননি উনি। হয়ত নিজের বেস্টফ্রেন্ডের জন্য। আজকাল এমন বন্ধুত্ব খুব কম দেখা যায়।

ঘুম না আসার কারণ দুপুরে বলা আয়াশের কথাগুলো! ডিভোর্সের কথা বার বার কানে বাজছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। ছটফটিয়ে আয়াশের দিকে তাকালাম আমি। দরজার কাঁচের অংশ থেকে সামান্য আলো কেবিনে ঢুকেছে। সেই আলোতে আয়াশের অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। আমি উনাকে বলতে চাই নিজের অনুভূতির কথা। চিৎকার করে বলতে চাই, ‘হ্যাঁ আমি ভালোবাসি এই বাজে লোকটাকেই। উনাকেই আমার চাই!’
কিন্তু বলতে পারি না। কারণ এমন কথা কখনো কাউকে বলিনি। এমনকি কখনো নীলাদ্রকেও বলিনি।

আমি মুক্ত হতে চাই না উনার বাহুডোর থেকে। একটু উবু হয়ে আয়াশের দিকে তাকালাম আমি। এলোমেলো চুলে হাত আলতো করে ছুঁইয়ে দিলাম। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক লাগছে। লোকটাকে দেখলে কেন জানি না ঘোর লাগে দুটো চোখে। নিজের অজান্তে ধীরে ধীরে নিজের ঠোঁটজোড়া আয়াশের কপালে ছুঁইয়ে দিলাম। সরে আসতে নিলে আমার হাত ধরে আচমকাই নিজের বুকে ফেলেন আয়াশ। চোখ মেলিয়ে বলেন,
–“লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের স্বামীকে চুমু খাওয়া কোনো দরকার নেই। সামনাসামনি চুমু খেলেও সে কিছুই মাইন্ড করবে না।”

–“মা…মানে?”

–“মানেটা তো তুমিই ভালো জানো। কিন্তু তুমি কি কাঁদছো? তোমার চোখের পানি আমার গালে পড়েছে। কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? কষ্ট পেয়েছো?”

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম। উনি তড়িঘড়ি করে বললেন,
–“কি কষ্ট? আমায় বলো?”

–“আপনার সেই রক্তাক্ত অবস্থার কথা মনে পড়ছে। কি করে হলো এমন?”

আয়াশ আমার মাথা নিজের বুকের সঙ্গে ঠেকিয়ে বললেন,
–“বেশ লম্বা কাহিনী!”

–“এই হসপিটালে কি করে এলেন? তাও বাড়ি থেকে এতদূর?”

আয়াশ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,
–“আমি দুটো কেস পেয়েছিলাম। কিন্তু তার মধ্যে একটা নিতে হয়েছিল আমায়। যেই কেস পুরোটাই সাজানো ছিল হয়ত রক্তিম বাহাদু্রের লোক দিয়ে। যেই কেসটা নিয়েছিলাম সেই ভিকটিম আমায় ফোন করে জানাই একটা বড়সড় প্রমাণ দেওয়ার আছে তার। সে আমায় ডাকে। আমি বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবে নিই কারণ এমন আগে অনেকবার হয়েছে। প্রমাণ নিতে আমি তার বাড়ি আসি। কজ কেসটা খুব কম্পলিকেটেড ছিল। তখনই যা ঘটার ঘটে। সরাসরি আমার মাথার আঘাত করা হয়। আর আমি সেখানেই সেন্স হারিয়ে ফেলি। যখন আমার সেন্স ফিরে আসে তখন নিজেকে বাঁধা অবস্থায় দেখি। আর সামনে নীলাদ্র বসে ছিল। আমার সঙ্গে ওর তর্ক। বলেছিল ও আমায় যে, আমি যদি তোমায় ওর হাতে তুলে দিই তাহলে ও আমায় ছেড়ে দেবে। আমি এটা নিয়ে অনেক তর্ক বির্তক করায় এক পর্যায়ে আমায় মারতে থাকে নীলাদ্র। একসময় ছুরি বসিয়ে দেয় দুইবার। রিভলবার দিয়ে শ্যুট করতে যাচ্ছিল কিন্তু একজন এসে তাকে বলে আমায় যেন পুরোপুরি প্রাণে না মেরে ফেলা হয়। ততক্ষণে আমার চোখ বুঁজেই আসছিল। আর পায়ে গুলি করে দেওয়ার পর কিছুই মনে নেই আবার। জ্ঞান ফিরতে নিজেকে হসপিটালেই দেখি।”

কথাগুলো শুনতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে দিই আমি। আয়াশকে আবেশে জড়িয়ে ধরি। উনাকে হারানোর ভয় আঁকড়ে ধরে আমাকে। কেঁদে কেঁদে থেমে থেমে বলি,
–“কতটা নৃশংস সে। আপনাকে এভাবে মারল! আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম যে আপনাকে হারিয়ে ফেলব।”

–“এতো ভয় পাও আমায় হারানোর?”

কান্না বন্ধ হয়ে যায় আমার। ছলছল নয়নে তাকাই উনার দিকে। আয়াশ মাতাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেটা অস্পষ্ট হলেও বোঝা যাচ্ছে। আমার গাল স্পর্শ করে ঠোঁট দিয়ে সমস্ত চোখের পানি মুছে বলেন,
–“ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমি তোমায় বলেছি আমি মারা যাবার আগে তোমায় খুন হতে হবে। কারণ তোমায় অন্য কারোর সাথে সহ্য করতে হবে এটা ভাবতেও পারব না আমি। মরেও শান্তি পাবো না। ইউ নো না? আই এম এ বিগ…. ”

উনাকে থামিয়ে আমি বলি,
–“সেলফিশ!”

আয়াশ নিঃশব্দে হেঁসে আমার কপাল উনার কপালের সঙ্গে ঠেকিয়ে বলেন,
–“সব কিছুর ঊর্ধ্বে আমি তোমায় ভালোবাসি। এই #মনের_অন্দরমহলে শুধু একজনেরই রাজত্ব! সে হলো আনিশা সাবিহা।”

চলবে…

[বি.দ্র. গল্পের অন্তিম ঘনিয়ে আসছে। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে সঙ্গে তুলনা করবেন না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here