মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৩৭
রূবাইবা_মেহউইশ
💞
ঘুমে ভাসা উন্মাদ বাতাস জেদে পড়েই যেন এলোমেলো করছে মেহউইশের চুল, শালের ভেতর লুকিয়ে থাকা ওড়নার কোণ আর তার ভেতরের চুপটি মেরে থাকা অনুভূতিকে। ছন্দপতন হয়ে গেছে রিশাদের বিষন্ন একাকীত্বে ভরপুর অনুভূতিরও। কি এক জাদুকরী মোহমায়া এই বালুচরে ফণা তোলা সাপের বিষের মত ছড়িয়ে পড়ছে শিরায় শিরায়, প্রতিটি রক্ত কণিকায়। আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে ধরছে নিজেকে কারো সান্নিধ্যে নিঃস্ব করতে। পায়ের গতি শ্লথ হয়েছে দুজনেরই সেই সাথে রাতও মোহনায় ঠেকেছে। রাত আর ভোরের মিলনমেলায় এসে হাওয়া উত্তেজিত করে তুলছে দুটি বিপরীতমুখী মানুষের ভেতর ছটফট করা আত্মাকে৷ প্রাণহীন এই তীরে প্রাণের স্পন্দন ঘোলাটে রাতকে আরও ঘোলা করে দিচ্ছে। মানুষের নিশ্চুপতা সমুদ্রের গর্জনকেও হার মানিয়েছিলো সেই নিঃশব্দতায় ইতি টেনে মেহউইশ কথা বলল।
-‘ অনেক তো হাঁটা হলো, একটু কি কোথাও বসা যায়?’ কথাটা বলেই তাকালো ঘাড় বাঁকিয়ে রিশাদের মুখের দিকে। আবছা অন্ধকার চোখ সয়ে গেছে আরও আগেই। এখন যেন স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে তার মুখাবয়ব।
-‘এখানে বসবে?’ বলেই চারপাশে তাকালো রিশাদ। বসার মত জায়গা খুঁজে একটু সামনেই চোখে পড়লো কলমিলতায় ভরা বালুচর৷
-ওদিকে চলো তবে ।
-নাহ।
ভ্রু জোড়া কুঁচকে জানতে চাইলো, ‘কেন?’
-‘ ওই লতায় ভর্তি বালুতে এই অন্ধকারে বসে সাপের কামড় খাবো নাকি!’ বাচ্চাসুলভ আচরণ পরিলক্ষিত হলো মেহউইশের এ কথায়। রিশাদের বুঝি একটু হাসিও পেল। ঠোঁট টেনে নিঃশব্দে একটু হেসে বলল, ‘ঠিক আছে তবে এখানেই বসি! কাঁকড়ার গর্তের ওপর আবার বসে পড়ো না যেন, নইলে কাঁকড়া আবার আদর করে কামড়ে ধরবে। ‘ হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো রিশাদ। তার কথার ধরন যে একটু বাঁকা ছিলো আবার নেগেটিভও তা বুঝতে পেরে লজ্জা পেল । যাচ্ছেতাই লোক তো! রিশাদ বসে পড়েছে বালুর ওপর যেখানে দাঁড়িয়েছিলো সেখানেই । মেহউইশ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই তা দেখে রিশাদ আচমকা মেহউইশের বা হাতটা টেনে তাকেও বসিয়ে দিলো নিজের পাশে। অপ্রত্যাশিত এই টেনে বসানোতে মেহউইশ ভীষণ অবাক হলো এবং অবাকের রেশ কাটতেই ভালো লাগার হাওয়া লাগলো। কিছু সময় আবারও কাটলো নীরবে। এবার নীরবতার রাশ টেনে রিশাদ কথা শুরু করলো। তার দৃষ্টি সামনে ভাটার টানে পিছিয়ে সরে যাওয়া পানির দিকে৷ চোখ জোড়া উজ্জ্বল আর জলে চিকচিক করছে।
– ‘মেবিশ তুমি কি জানো, মা হারা মানুষগুলো খুব অসহায় হয়।’ নিঃশব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো মেহউইশ৷ পাশে বসা মানুষটার এই একটা বাক্য তীরের মত বিঁধলো তার বুকে৷ রিশাদ কি কাঁদছে!
-‘আমার মা মারা গেছেন আমার বোনের জন্মের সময়৷ আমার ঠিকঠাক মনে নেই মায়ের সাথে কাটানো সময় গুলো। বোনের জন্মের সময় হয়ে এসেছিলো আর সেসময়ই একটা দূর্ঘটনা ঘটলো। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়েই অসাবধনতায় পড়ে গেল মা। বোনটা নাকি মায়ের গর্ভেই মারা গিয়েছিলো এবং প্রচুর ব্লিডিংয়ের কারণে মাও বাঁচতে পারেনি। বাবা তখন বিদেশে ছিলেন বাড়িতে ফুপি ছাড়া কেউ ছিলো না। কাজের লোকের সাহায্য নিয়ে ফুপি মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যান । কিন্তু সময় হয়তো আল্লাহ্ ততটুকুই রেখেছিলেন তাই রক্ত দিয়ে, দেশের বেস্ট ডক্টরদের দেখিয়েও লাভ হয়নি৷ চলে গেছে আমায় ছেড়ে মা,বোন দুজনই। আমার জীবনের হাত বদলের শুরু সেই থেকে। কখনও ফুপি,কখনও খালা মানে রাইমার মা, কখনও কাজের লোক কাছে বড় হতে থাকলাম। তারপর যখন বয়স হলো বোঝার মত, পড়াশোনায় যখন হাই স্কুলে তখন থেকে বন্ধু বান্ধব হলো প্রচুর পরিমাণে। বাবার বিয়ে,ফুপির বিধবা হওয়া আর এসবে বাড়ির পরিস্থিতি এতোটাই বাজে হয়েছিলো যে আমি বোঝার বয়সে এসে আর কাউকেই কাছে পাইনি৷ বন্ধু বান্ধবের সঙ্গ আর বাবার টাকায় আমার জীবন চলতে লাগলো। বছরে দুটো দিনও ঠিকঠাক বাবার সাথে কাটানো হতো না আমার। ততদিনে আবার রাইমারও জন্ম হয়ে গেল। বাবা আমারই চোখের সামনে রাইমাকে সময় দিতে সব কাজ ফেলেই তার জন্মদিনে ছুটে আসতেন দেশে। প্রথম প্রথম হিংসে হলো ছোট বোনটির প্রতি তারপর একসময় বুঝতে পারলাম রাইমাও দুঃখী। ঠিক আমারই মতন৷’ থেমে গেল রিশাদ এতটুকু বলতেই কিন্তু মেহউইশ এখনও অপলক দেখছে তাকে। সে শুনতে চায় আরও কিছু, অনেক কিছু, এমনকি সবটাই৷ মেহউইশের এভাবে তাকিয়ে থাকা বুঝতে পেরেই রিশাদ বলল, ‘ সামনে তাকাও মেবিশ। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে বলতে পারবো না কিছুই।’ টনক নড়লো মেহউইশের সে সত্যিই মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকালো।
-‘ রাইমা বাবার আদর দুই কি তিন দিন পেত বছরে৷ ওই যে তার জন্মদিনের সময় বাবা আসতো সেইটুকুই তার প্রাপ্তি বাকিটা সময় সে আমার মতোই জীবন কাটাতো৷ তার কারণ, খালা কখনও তাকে আদর করে কাছে ডাকতো না, একবেলা নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিতো না। সে যখন জোর করে তার মায়ের হাতে খাওয়ার বায়না করতো তখন খালা তাকে দূর দূর করতেন। আমার চোখ এড়াতো না এগুলো৷ কষ্ট লাগতো তখন তার জন্য আর সুযোগ পেলে আমি নিজে তাকে ডেকে নিয়ে খাইয়ে দিতাম। সুযোগ পেলে তার মাথায় ঝুঁটি বেঁধে দিতাম আবার আমার কোন কথা না শুনলে প্রচুর মাির দিতাম। আর লক্ষ্য করতাম আমি তাকে অনেক মারলেও তার মা কখনও আমাকে কিছু বলতো না। তবে আমার লালন পালন নিয়ে অনেক কটুকথা বলতেন বাবাকে। ফোন করলেই আমার কিংবা রাইমার নাম নিয়ে কালসাপের বাচ্চা বলে গালি দিতেন৷ তখনও আমার অজানা ছিলো বাবার প্রতি খালার ক্ষোভের কারণ তাই আমিও অপছন্দ করতাম খালাকে৷ আর একমাত্র ফুপি সেও প্রায় আঠারো বছর বিদেশে ছিলেন৷ বাড়িতে আপন কেউ ছিলো না আমার, রাইমার। আমি যখন এস এস সি পরীক্ষা দেবো তখন বাবা দেশে এলেন। থাকলেন কয়েকমাস কিন্তু বাবার সাথে খালার কোন বনিবনা হলো না। বাবা আবার চলে গেলেন বিদেশে সেখানেই ব্যবসায় মজে গেলেন। তখন আবার খালা প্রেগন্যান্ট। রিহানের জন্ম হলো। মালা দাদাী আমাদের বৃদ্ধা কাজের লোক তিনি বললেন এবার সংসারে পরিবর্তন হবেই। সব ঠিক হবে কিন্তু না হলো না কিছুই। সময় গেল আপন স্রোতে কিন্তু পরিবর্তন শব্দটা আমাদের জীবনে অপরিচিতই রয়ে গেল।’
পূব আকাশ রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। ফজরের আযান হচ্ছে রিশাদের হোটেলের পাশের মসজিদটাতে৷ আযান শুনেই হয়তো রিশাদ কথা বন্ধ করলো মেহউইশও ওড়না টেনে এলেমেলো চুলগুলোকে আড়াল করে ঘোমটা টানলো। এত ভোরে হোটেলে সবাই গভীর ঘুমে আছে নিশ্চয়ই। হোটেলে ফিরলেও বসইরে বসে থাকতে হবে আর হোটেলের চেয়ে এখানে বসাটাই ভালো লাগছে মেহউইশের। সেই সাথে এই গম্ভীর, একরোখা, বদমেজাজী লোকটার মনের গহীনে লুকানো কথাগুলো শুনতেও ইচ্ছে করছে খুব। দুজনের বসার মাঝে কিছুটা জায়গা ফাঁকা ছিলো। অন্যদিকে মুখ করেই মেহউইশ সেই ফাঁকা জায়গাটুকুর দূরত্ব ঘুচিয়ে গা ঘেঁষে বসলো। রিশাদ অন্যমনস্ক সে হয়তো বুঝতেই পারলো না এই ঘুচানো দূরত্বটুকু। তবে উষ্ণতা একটু গায়ে লাগলো তার।
-আপনার খালা তো আপনাকে ভালোবাসে। আপনি কি তা জানেন?
-‘ হুম, জেনেছি অনেক পরে৷ তোমাকে বাড়িতে আনার ঠিক দুদিনের মাথায় আমার জানা হলো সৎ মা নামক খালাটা আমাকে খুব ভালোবাসে৷ সেই সাথে আমার ছেলেটাকেও।’ রিশাদ শেষের কথাগুলো বলার সময় মেহউইশের দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘আমার ছেলেটাকেও’ আমার! কথাটা কানে বাজলো খুব মেহউইশের । ঠিক নয় মাস আগে মেহউইশকে জোর করে আনা হয়েছিলো রিশাদের জীবনে। শুধু মাত্র নির্জনের মা হতেই তো তার এ জবরদস্তির জীবনে থেকে যাওয়া তবুও শুনতে হলো নির্জন শুধু রিশাদের ছেলে। কেন? আমাদের ছেলে কি বলা যেত না! আবেগী হয়ে উঠলো মেহউইশ । চোখ ছলছল,কান্নার একটা ঢোক গলায় আটকে রইলো৷
-‘হোটেলে ফিরবে?’
-‘ এখন হোটেলে গিয়ে কি করবো?’
-হুম, করার কিছুই নেই। হয় গ্রাউন্ড ফ্লোর অথবা লনে বসে থাকতে হবে। তবে কি এখানেই বসে থাকবে?
-থাকি।
-আচ্ছা। কিছু খাবে?
-নাহ
-আশ্চর্যজনক তাই না!
-কি?
-আস্ত এক হোটেলের মালিক শেষরাতে বালুচরে এসে ঠাঁই নিয়েছে। ঘুমানোর মত জায়গা নেই তার আর তার স্ত্রীর৷
‘কে বলেছে নেই? তার না থাকলেও তার স্ত্রীর তো আছে৷ এই যে আপনার লম্বা চওড়া কাঁধটা এটাকে একটু নামিয়ে নিলেই তো হয়। আপনার স্ত্রী এই কাঁধে মাথা রেখে স্নিগ্ধ ভোরের আলোমাখায় হাওয়ায় দারুণ একটা ঘুম দিতে পারবে৷’ মনে মনে কথাটা ভেবেই লজ্জায় লাল হলো মেহউইশ। যতোই সে মনে মনে এসব ভাবুক না কেন মুখে বলার সাহস একটুও নেই৷ লালচে ভোরের লালিমাসিক্ত গাল দুটোকে দেখে কোমল ভোরটাকে উফভোগ করা থেকে বঞ্চিত হলো রিশাদ শুধুমাত্র দৃষ্টি সামনে থাকায়।
-‘ঘুম ঘুম লাগলে একটু চোখ বুঁজে বসতে পারো কাঁধে মাথা রেখে।’
এই এক ভোরেই এত পাওয়া কি করে সহ্য করবে মেহউইশ! মনে মনে যা সে ভাবছে তাই পেয়ে যাচ্ছে। ইশ, এখনই মাথাটা রাখবে কাঁধে! নাকি একটু ভাব দেখিয়ে নেবে? লোকটা আবার ছ্যাচড়া ভেবে বসবে নাতো! সেকি ছ্যাঁচড়া নাকি, গত নয় মাসে কত কিই তো করলো লোকটার ইচ্ছেতে এখন একটু না হয় সেও নিলো নিজের ইচ্ছে পূরণ করে৷ আর আজই কেন এমন ইচ্ছে হলো?
-নাহ, কাঁধে ব্যথা পাবেন।
-‘মাথা রাখো সমস্যা নেই৷ এখন চাইলেও হোটেলে ফিরে ঘুমানোর জায়গা পাবে না।’
কথা বাড়ালো না মেহউইশ। আরো একটু ঘেঁষে মাথাটা রিশাদের কাঁধে রাখলো। মেহউইশের কাঁধ নাগাল পেতে একটু কষ্ট হচ্ছে ভেবে পা ছড়িয়ে হাত পেছনে বালুতে ফেলে বসলো৷ মেহউইশের চোখে সত্যিই ঘুম ছিলো । শিরশিরে হাওয়ায় ঘুমটা আরো জেঁকে বসেছিলো চোখের পাতায়। সুযোগ পেয়ে ঘুমটা খুব গভীর হয়ে নেমে এলো চোখে৷ রিশাদ তাকিয়ে রইলো যতদূর দৃষ্টি যায়। অসীম সাগরে থেকে থেকে জাহাজ , ভেসে বেড়ানো নাম না জানা কিছু পাখির আনাগোনা। পর্যটকরাও বেরিয়ে পড়েছে ভোরবিলাসে। অনেকেই চলতে চলতে ফিরে চাইছে তাদের দিকে৷ অনেকটা সময় কেটে গেছে এভাবেই দুজনের৷ মেহউইশ ঘুমে আচ্ছন্ন রিশাদের কাঁধে । শরীরের উত্তপ্ততা রিশাদকে নাকাল করছে। ঘাড় ফিরিয়ে ঘুমন্ত মেহউইশের দিকে চেয়ে নিজেকে সাবধান করছে৷ অনুভূতির পোকারা কিলবিল করে কামড়ে ধরছে মনকে একটু পরশ নিতে ঘুমন্ত অধরের। ভয়ংকর যাতনায় নিজেকে সামলানো দায় হলো তার৷ ভাবনাদের ঠেলে দূরে সরানোর চরম চেষ্টা বিফলে গেল৷ ডান হাতে ঘুমন্ত মেহউইশের কাঁধ জড়িয়ে নিলো রিশাদ। আলতো করে বা হাতে মেহউইশের চিবুক ধরে মুখটাকে উঁচু করলো। এত গভীর ঘুম কি করে ঘুমায় মেয়েটা! কয়েক মুহূর্তে নিষ্পলক চেয়ে নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো সে। নিজের দু’ঠোঁটের ভাঁজে মেহউইশের অধর চেপে চুমু খেল৷ খুব ধীরে, চুপিসারে খাওয়া চুমুটাতে স্বাক্ষী হতেই বুঝি জেগে উঠলো মেহউইশ তাকিয়ে রইলো তার আঁখিযুগল৷ কল্পনা না সত্যি! ভালোলাগা নাকি মোহ!
চলবে
(আরও তিন পর্ব আগে কথা ছিলো মেহউইশ-রিশাদময় পর্ব দেবো। কাহিনির পরিস্থিতির ওপর ডিপেন্ড করেই তখন সম্ভব হয়নি। আশা করি আজকে সবাই খুশি হয়েছেন। সাধ্যমত ভালো করার চেষ্টা করেছি। কতোটা পেরেছি তা আপনারাও কমেন্টে জানিয়ে দিলে খুশি হবো। )