মন_গহীনের_গল্প পর্ব ৩৯ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব ৩৯
রূবাইবা_মেহউইশ
💞
হৈচৈ পূর্ণ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ছোট ছোট শিশুরাই বেশি মাতিয়ে তুলেছে সুইমিংপুলের পাশের লনটা। আলোয় আলোয় পরিপূর্ণ অংশটুকুতে নির্জন ছাড়া বাকি প্রত্যেকটা শিশুই এতিম এখানে। আর এই এতিমদের খাওয়ানোর ইচ্ছেটা রেহনুমার। সে চায় জন্মদিন উপলক্ষে যদি কিছু করতেই হয় তবে এতিম কিছু ছেলেপেলেকে খুশি করুক। হতে পারে সেটা একবেলা ভালোমন্দ খাইয়ে অথবা শীত আসছে কিছু ভালো শীতের কাপড় অথবা এতিমখানায় বাচ্চাদের স্বার্থে কোন উন্নতিমূলক কাজ করতে। রিশাদের ভালো লেগেছিলো রেহনুমার ইচ্ছের কথা শুনে সে মেহউইশের ইচ্ছে জানতে চেয়েছিলো। সেও একই জবাব দিয়েছে তাই আজকের আয়োজন শুধুমাত্র তাদেরই জন্য করা। রাইমা একটিমাত্র বোনকে ছেড়ে করতে ভালো লাগবে না তাই রাইমাকে বলেছে আসতে। এই সুযোগ মেহউইশের মা’কেও বলা যায় মেয়ের বাড়ি আসতে তাই তাদেরকেও দাওয়াত করা। আর রাইমার আবদারে তার বন্ধুরাও আমন্ত্রিত হয়েছে। এই আয়োজনে বাদ পড়েনি নির্জনের জন্মদাত্রী নীলিমাও। নীলিমাকে দাওয়াত করার আগে মেহউইশের অনুমতি নেওয়াটাও ভুল হয়নি রিশাদের। আর এখানেই ভুল হয়েছে রিশাদের চিরকুট লেখায়। মেহউইশ শাড়ির প্যাকেট খোলার আগ পর্যন্তও খুব খুশি ছিলো এই অনুষ্ঠান নিয়ে। চিরকুটের লেখাটা পড়েই তার মন খারাপ হলো, বুক জুড়ে হাহাকারের সৃষ্টি হলো।

নির্জনকে দ্বিতীয় দফায় তৈরি করছে মেহউইশ । সন্ধ্যায় একবার নতুন পোশাক পরিয়ে ঘুরিয়ে আনা হয়েছে নিচ থেকে। এখন আবার রিশাদ নতুন যা এনেছে তাই পরানো হলো। সাদা শার্ট, কালো ডেনিম প্যান্ট আর শার্টের উপরে কালো রঙের কোট। কোটের কলার দেখে বোঝা গেল নির্জনের মায়ের শাড়ির অংশ বিশেষভাবে লাগানো আছে এতে। যাকে বলা যায় ম্যাচিং ম্যাচিং। সবগুলো ব্যাগ হস্তান্তরিত করার পরও তিনটে ব্যাগ বাড়তি রইলো। একটি নির্জনের ছিলো যা সে পরে আছে অন্যটি শাড়ি নির্জনের মায়ের তৃতীয়টি খুলতেই বুঝলো এটা রিশাদের নিজের জন্য । বাপ, ছেলে একইরকম পোশাক পড়বে সেই সাথে তার মায়ের পোশাকও মিলবে তাদের সাথে। বুক ফেটে কান্না এলো। নির্জনকে তৈরি করে রাইমার কাছে দিয়েই সে দ্রুত পায়ে বাথরুমে ঢুকলো। ডানা ভাঙা পাখির মত ছটফট করতে করতে পানির ট্যাপ চালু করলো। যতটুকু সম্ভব চিৎকার করে কান্না করলো৷ নয়টা মাস একেবারেই কম সময় নয়। বিয়ের বন্ধনটাও ঠুনকো নয় ; জোর করে হলেও বিয়েটা হয়েছে ধর্মীয় এবং আইনগত দুভাবেই৷ নয়মাসের এতগুলো দিনরাত্রি ওই বাচ্চা ছেলেটাকে বুকে আগলে কেটেছে তার। মা না হোক মায়ের চেয়ে কমও করেনি। যে মেয়ে কখনও বাচ্চা কোলেই নেয়নি সেই মেয়ে একটা তিন মাসের বাচ্চাকে কোলে তুলেছে, খাবার খাইয়েছে,ঘুম পাড়িয়েছে, মলমূত্র পরিষ্কার করেছে নিজ হাতে সেই মেয়েটা আজকে মায়ের জায়গা পেলো না! কান্না থামছে না মেহউইশের। অসহ্যবোধ করা সম্পর্কটা আজ তাকে কাতর করে ছাড়লো। অপাপবিদ্ধ সেই ছোট্ট মুখখানি চোখের পাতায় ভেসে উঠলো তার। ওই মুখের মায়ায় পড়ে গেছে অনেক আগেই। আর সেই মায়া থেকেই তার যত্ন নেওয়া,আদর করা কখন যে অধিকারের ভাবনাটাও মাথায় ঢুকেছে কে জানে! রিশাদ যখন অনুমতি চাইলো নির্জনের জন্মদিনে নীলিমা একটিবার তাকে দেখতে চায় সে কি দিবে! তখনও মনে হয়েছিলো রিশাদের পর নির্জনের উপর একমাত্র অধিকার তারই আছে। তার ভাবনা ভুল যতোই নীলিমা অন্য কারো অর্ধাঙ্গী হোক মা তো সে নির্জনের আজীবনই থাকবে।

মেবিশ!

বাথরুমের দরজায় নক করলো রিশাদ। ডাকলো বার কয়েক মেহউইশের নাম ধরে। মেহউইশ জবাব দিলো না ইচ্ছে করেই । কেন দিবে সে জবাব , রিশাদের ফরমায়েশ শুনতে! তার কি এত দায় পড়েছে? শুনবে না আর কারো কথাই এখন থেকে; চলে যাবে দূরে। অভিমানে বুকের ভেতর চাপা কষ্টের উদ্রেক হলো। রিশাদ ডেকেও জবাব না পেয়ে রুমেই নিজের কাপড় বদলে নিলো। রাইমা ফোন করলো নিচে যেতে কেক কাটার পর্ব শুরু করতে৷ নীলিমাও এসেছে অনেকক্ষণ হলো।

– ‘সবাই প্রস্তুত কেক কাটার জন্য আমি নিচে যাচ্ছি। তোমার হলে গেলে এসে জলদি।’

সুইমিংপুলের নীল পানিতে ভাসছে অসংখ্য ফুলেল প্রদীপ।প্রদীপগুলো নকল যাকে বলা হয় আর্টিফিশিয়াল ঠিক ওরকম। পানিতে থেকেও নিভে যাওয়ার ভয় নেই আবার এতে তেল, সলতেরও দরকার নেই। ভেতরে হয়তো ব্যাটারি জাতীয় কিছু আছে আর প্রদীপগুলোর আকৃতি দেখতে ফুলের মত। হঠাৎ দেখলে মনে হয় লাল,কমলা,কাঁঠালি রঙের জারবেরা ছড়িয়ে আছে পানিতে। তাতে আগুনের ছায়াটাও নেই। জলন্ত প্রদীপগুলোর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে মেহউইশ। তার সামনেই বড় টেবিলটাতে সাজানো বড় সাইজের কেক । রিশাদের কোলে নির্জন তার একপাশে মেহউইশ অন্যপাশে রেহনুমা তার সাথে রাইমা। নীলিমা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে । সে এসেই নির্জনকে নিয়ে অনেকটা সময় আলাদা কাটিয়েছে তবে সেই সময়টাও রিশাদের বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময় ছিলো। তারপর আর এক সেকেন্ডের জন্যও নির্জনকে ছুঁতে দেওয়া হয়নি।

-মেবিশ, নির্জনের হাত ধরো।

-হু!

‘বলছি কি হাত ধরো নির্জনের। কেক কাটবে।’

-‘মিসেস নীলিমাকে ডাক’,,,,,

মেহউইশ কথাটা শেষ করার সাহস পেলো না। সে বলতে গিয়েই দেখলো রিশাদের চোখ বড় বড় হয়ে আছে। তার দৃশ্যজোড়া কঠিন আর চোয়াল শক্ত হয়ে আসায় চুপ হয়ে গেল মেহউইশ। ভয়ে ভয়ে হাত রাখলো রিশাদের হাতে। দুজনের হাতের মাঝে নির্জনের ছোট্ট হাতখানা বন্দী পড়লো। তিনটি হাতের বন্ধন দূর থেকেই চোখে জ্বলে উঠলো নীলিমার। চিকচিকে হলো তার চোখের কোণ৷ হারিয়েছে কি তা যেন সে আজ বুঝতে পারলো।

কেক কাটার আগেই বাচ্চাদের প্রত্যেককে খাবার খাওয়ানো হয়েছিলো। তখনি রিশাদ প্রত্যেকের পোশাকের ব্যাগও তাদের হাতে দিয়েছে। কেক খেয়ে বাচ্চারা চলে যাবে তাই রিশাদ নিজ দ্বায়িত্বে তাদের পৌঁছে দিতে যেতে চাইলো। নির্জন তার কোলে থাকায় মেহউইশের কাছে এগিয়ে গেল। অন্যমনস্ক মেহউইশের তখনও খেয়াল নেই কোন কিছুর। চুপ এক কোণে চেয়ার টেনে বসেছিলো সে৷ নির্জনকে মেহউইশের কোলে বসিয়ে দিয়ে আস্তে বলল, ‘ সোনা বাবা আমার তোমার মায়ের কাছে থাকো বাবা এক্ষুনি ফিরে আসবো।’ চকিতে তাকালো মেহউইশ । রিশাদের চোখে ইশারা সেইসাথে আশ্বাস । নির্জন তার কোলে বা বা বলে কান্না করছে, রিশাদের হাত খামচে ধরেছে সে। মেহউইশের কানে এখনও বাজছে, ‘তোমার মায়ের কাছে থাকো।’

রিশাদ কি তাকেই নির্জনের মা বলে সম্মোধন করেছে! রিশাদের চোখের ভাষা তো তাই বোঝালো। তবে সেই চিরকুটে নির্জনের মা কি তাকেই বলেছে? শাড়িটি কি তারই জন্য ছিলো! নীলিমা তো গাউনের মত ড্রেস পরে এসেছে। মেহউইশের মাথা ঘুরে গেল। এত বড় ভুল সে কি করে করলো? সকল আনন্দ নিজের ভুল ধারনার জন্য খারাপ হয়ে গেল।ফোলা ফোলা চোখ, আর গুমোট থাকা মুখের আবহাওয়া বদলে গিয়ে লজ্জায় লালচে হলো মেহউইশের গাল। কোলের উপর থাকা নির্জনকে সীমাহীন আনন্দে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ছুঁলো। এত বোকামি সে কি করে করলো! আজকে ভোরটা তার সবচেয়ে আনন্দময় আর সন্ধ্যাটা গেল বোকামিময়৷ কি যে করিস না মেবিশ তুই! অস্পষ্ট স্বরে স্বগোতক্তি করলো আবার অবাকও হলো। সে কি রিশাদের সুরে নিজেকে ডাকলো! নিচে আর এক মুহূর্তও নয়। রিশাদ চলে গেছে এতিম বাচ্চাদের নিয়ে। ফিরতে তার দেরিই হবে । রাইমারা এখনও হৈ চৈ করছে নিজেদের মত সেই সাথে কেক মাখামাখিও৷ নীলিমা এখনও বসেছিলো কাছেই কোথাও উঠে এসে মেহউইশের কাছে নির্জনকে চাইলো। ইচ্ছে না হলেও দিয়ে দিলো নীলিমার কোলে। ছেলেটা কেঁদে উঠলো ভাঙা স্বরে মা মা করে ডাকলোও মেহউইশকে। কিন্তু নীলিমা জোর করেই তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে শান্ত করার বৃথা চেষ্টায় লেগে গেল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টদায়ক হবে তাই মেহউইশ চলে গেল অনুষ্ঠানের জায়গা ছেড়ে। নিজের ঘরে গিয়ে শাড়ির ব্যাগটা হাতে নিতেই মনে হলো ভুল করেছে। রিশাদ নিশ্চয়ই নিচে তাকে পুরনো ড্রেসটাতে দেখে অবাক হয়েছিলো। রাগও কি হয়েছিলো তার! বলতে তো পারতো নতুন শাড়িটা কেন পরলে না? তাতেই নিশ্চয়ই মেহউইশের ভুল ভাঙতো৷ বড্ড বদখত স্বভাব লোকটার। চাইলেই শুধরে যেতে পারে, শুধরে দিতে পারে। কিন্তু নাহ, সে তো রিশাদ রায়হান খান, মিঃ যা তা। তার ভাবসাবই আলাদা, হুহ। নির্জনটা কি এখনও কাঁদছে! রাইমাকে ফোন করে জেনে নিলো মেহউইশ। নির্জনের কান্না থেমেছে এখন সে রেহনুমার কাছে আছে। ফোনটা রাখতে গিয়ে সময় দেখলো রাত এগারোটা বেজে গেছে। নিস্তব্ধতার বিন্দু মাত্র সুযোগ নেই আজ হোটেলটাতে। দোতলার রেস্টুরেন্ট কি তিন তলার কাপল স্যুট অথবা চার তলার সিঙ্গেল রুম সবগুলোতেই পর্যটকের ভীড়৷ গিজগিজ করছে আজকে সমুদ্রের তীরও। আজকে কি কোন বিশেষ দিন? নাকি বাংলাদেশের সব মানুষ আজকেই এসেছে কক্সবাজারে! শাড়িটাকে এলোমেলো করে আবার গায়ে জড়িয়ে নিতেই মন ভরে গেল। আয়নায় নিজেকে দেখে মনে হলো এই কালো রঙটা আজকে তাকে দ্বিগুণ সুন্দরী করে তুলছে৷ আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না বরং শাড়িটা গায়ে দিতেই ইচ্ছে হচ্ছে ভীষণ।

ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁই ছুই; রিশাদ এসে নক করলো। নির্জন ঘুমিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে কমলা রঙের। দরজা খুলতেই রিশাদের মুখটা হা হয়ে রইলো। অল্প আলোতেই মেহউইশের ঠোঁটের গাঢ় লাল রঙ স্পষ্ট চোখে পড়ছে। সন্ধ্যাতেও তার ঠোঁটে এত গাঢ় রঙ ছিলো না। পরনে তার চকমকে কোন পোশাক ছিলো না।

-বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?

মেহউইশ এর কথায় সম্বিত ফিরলো যেন রিশাদের। সে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়েই সোজা বাথরুমে প্রবেশ করলো। মেহউইশও পেছন পেছন বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকলো, ‘শুনুন।’

রিশাদের মন বলল আজ সে চমৎকার কোন কথা অথবা দারুণ কোন উপহার পেতে চলেছে মেহউইশের কাছ থেকে। প্রথম ডাকেই সে জবাব দিলো না। মেহউইশ পুনরায় আগের মতোই ডাকলো, শুনুন।’

‘হ্যাঁ বলো’ অনেকটা নিজের গাম্ভীর্য অবদল রেখেই সে জবাব দিলো।

‘ সকালে তো চা ব্রাশ না করেই খেলেন এখন সময় হলে ব্রাশ করে তবেই আসুন।’

-কিহ!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here