মন_গহীনের_গল্প পর্ব -৪১ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব -৪১
রূবাইবা_মেহউইশ
💞
বিকেলের নরম আলোয় গা ধুয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে শঙ্খচিলের দল। কোথায় যাচ্ছে তারা, কোথায় তাদের ঘর মেহউইশের খুব জানতে ইচ্ছে হলো! রিশাদের কাছে জেনে নিবে এক্ষুনি আগে সে ঘরে আসুক। বেলকোনির সব ক’টা পর্দা সরানো,কাঁচ খোলা । ঝড়ের বেগে সমুদ্রের হাওয়া পশ্চিম থেকে ঠেলে বাঁক নিয়েছে, আর সেই বাঁকেই মেহউইশদের এই বেলকোনিটাতে ঝপাট মেরে জায়গা নিচ্ছে সানন্দে । মেহউইশের সর্বাঙ্গ মরা রোদের আলো আলতো করে মাখিয়ে দিচ্ছে সুযোগ পেয়ে। সন্ধ্যে নাগাদ ফিরবে আজ মেহউইশেরা তাদের পাহাড়ি বাড়িতে। অনেক বলেও মিহাদ,মাইমুনা কাউকেই সঙ্গে নিতে পারছে না তারা। ব্যবসাটা নতুন এখনই এমন বন্ধ ফেলে রাখলে গ্রাহক পাবে কি করে, মিহাদের পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে এই সেই আরো কত যুক্তি দেখিয়ে তবেই রাজী করেছে সবাইকে । মেহউইশ সকালে মজা করেই বলেছিলো যেতে হয় যাও আটকাবো না। সে কি জানতো তার মা আজ সত্যিই চলে যাবে! এতগুলো দিন পর মা’কে তার আনন্দের সীমা ছিলো না। এখন আবার সেই আনন্দ মিলে যাচ্ছে দিনের দ্যুতি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই। রিশাদ গেছে প্রাইভেট গাড়ির জন্য লোক পাঠাতে স্ট্যান্ডে। মাইমুনা বাসেই যেতে চেয়েছিলো । রিশাদ কিছু বলবে তার আগেই রেহনুমা বলল, ‘ অত কথা বলবেন না। দুদিন তো মেয়ের কাছে থাকলেন না এখন আবার যাওয়ার ব্যবস্থা নিয়েও আপনার কথা শুনতে চাই না। রিশাদ যা কাউকে পাঠা গাড়ির ব্যবস্থা করতে।’ মাইমুনা খুশি হয়েছে রেহনুমা আর রিশাদের আচরণে। বদলেছে রিশাদ সবটাই আর এই বদল তার মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গল বয়ে আনুক এমনটাই আল্লাহর কাছে তার চাওয়া। মেহউইশ মায়ের সাথে অভিমান করেই নিজের ঘরের বেলকোনিতে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। তখনই চোখে পড়ল অদূর সাগরের উপর ভাসতে থাকা শঙ্খচিলের ঝাক। মন খারাপের পর্দা সরে একটুখানি মন ভালো করা এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই ভাবুক মেহউইশ টের পেল তার পেছনে কেউ একজন চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা সময় একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে গলা খাঁকাড়ি দিলো তানভীর।অপরিচিত কন্ঠের খাঁকড়ি নিজের ঘরে শুনতে পেয়ে চকিতে ফিরে তাকালো মেহউইশ৷ ঘরে রিশাদ নেই,নেই ফুপু,রাইমা, মা কিংবা মিহাদ। তানভীর একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দেখেই ভড়কে গেছে সে, প্রচণ্ড রেগেও গেছে।

-তুমি এ ঘরে কি করছে তানভীর? বিনা অনুমতিতে প্রবেশই কেন করেছো? এ কেমন অসভ্যতা!

-‘ প্রথমেই বলছি আমি দুঃখিত এভাবে ঘরে প্রবেশ করার জন্য । এভাবে আসা ভালো ম্যানার্সে পড়ে না আমি জানি কিন্তু সময় কম বলেই এভাবে এসেছি। রিশাদ ভাইয়ার মুখে শুনলাম আপনারা চলে যাচ্ছেন কোথাও৷ তাই কৌতূহল মেটানোর তাড়ায়,,,,

– ‘অনুমতি ছাড়াই কোন মেয়ের ঘরে ঢুকে যাবে তাই না তানভীর!’ তানভীরকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল মেহউইশ ।

-‘ সত্যিই দুঃখিত মেহউইশ আপু৷ কিন্তু আপনি ইভান ভাইয়াকে কেন ছেড়ে দিলেন?’

-‘দিস ইজ নান অফ ইউর বিজনেস তানভীর৷ ‘

-‘ ডোন্ট বি রুড মেহউইশ আপু, আই জাস্ট সে দ্যাট,,,’

-‘ মেবিশ, তুমি কি তৈরি?’ দরজার সামনে এসেই রিশাদ ডাকলো। মিহাদ আর মাইমুনার সাথেই তারাও রওয়ানা দিবে নিজের গন্তব্যে ভেবেই এসেছিলো মেহউইশকে ডাকতে। রিশাদের রাগ বরাবরই চট করে আসে তানভীরকে দেখেও রাগের উদ্রেক হচ্ছিলো৷ কিন্তু সেই রাগে বর্ষণ হলো মেহউইশের মুখ দেখে। চোখ দুটো ছোট ছোট, নাকের পাটা ফুলে আছে সেই সাথে তার কপাল কুঁচকে যে রেখার উৎপত্তি তা বিরক্তির নয় রাগেরই আভাস। কষ্ট হলেও নিজের রাগকে আয়ত্তে আনা অনেকটাই শিখেছে রিশাদ। এখন তাই শিখে যাওয়াটাকে কাজে লাগিয়েই রাগ সংবরণ করেছে৷ নইলে তানভীরের এভাবে মেহউইশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জনমের মত শেষ করে দিতো।

-‘ আমি তৈরি দু মিনিটেই আসছি ওর প্রশ্নের জবাব দিয়ে।’ কঠিন চাহনি তানভীরের দিকে তাক করে রেখেই মেহউইশ বলল রিশাদকে। রিশাদ একবার এগিয়ে আসতে গিয়েও আবার ভাবলো না আগানোটাই উচিত। তারা দুজন যে দুজনকে চেনে এ ব্যপারে রিশাদের কোন সন্দেহই নেই বরং সে আজকে জেনেই গেছে পরিচয়ের যোগসূত্র কোথায়। ‘ইভান’ হলো তাদের পরিচয়ের শিকড়। রিশাদ নেমে গেছে দোতলা থেকে নিচ তলায়। সম্পর্কের গোড়া মজবুত করতে যতোটা করা লাগে ঠিক ততোটাই সে করবে বাকিটা জীবন। সবাই তো আর নীলিমা নয় যে, পুরনো প্রেমিকের কাছে ফিরে যেতে সুযোগ সন্ধানী হবে। তানভীর তো ইভানের আপন ভাই নয় তবুও আত্মীয়।ইভান কি কখনো কিছু করবে তানভীর -রাইমার জীবনে! গাড়ির কাছে যেতে যেতে এলোমেলো কত ভাবনাই তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করলো৷ কিছুটা বোনের ভবিষ্যত নিয়ে আর কিছুটা মেহউইশের মনের অবস্থা পরিবর্তনের ভয়ে।

‘ তানভীর, আমি এখন একজনের বিবাহিতা স্ত্রী । ইভান এখন শুধুই অতীত আমার জীবনে। যেভাবেই হোক আমরা আলাদা হয়েছি এবং দুজনেই নতুন দুজন মানুষের জীবনের অংশ এখন । তুমি যাকে ভালোবাসো আমি তারই ভাইয়ের বউ। তুমি আমার অতীত নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নিজেদের সম্পর্কের সুষ্ঠুতা নষ্ট করো না৷ ঝগড়া বা অন্যকোন কারণ ছাড়াই আমরা আলাদা হয়েছি কিন্তু আমরা অন্য আর দশজন প্রেমিক প্রেমিকার মত বিয়ের সম্পর্ক ভেঙে পালাবো না৷ ভাগ্যের হাতে না চাইতেও কিছু জিনিস ছেড়ে দিতেই হয় এছাড়া করার কিছু নেই। বিয়েটাও তেমনই একটা অংশ আমাদের জীবনে যা উপরওয়ালা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। যাইহোক, তুমি আমার চেয়ে ছোট না হলেও আমি তোমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখতাম ইভানের কারণে। আজও তোমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই ভাবছি রিশাদ সাহেবের ছোট বোনের হবু বর হিসেবে।’ শেষ বাক্যটা বলার সময় মেহউইশ মুচকি হাসলো৷ তানভীর বেশ উত্তেজনা বোধ করলো, ‘রাইমার হবু বর!’ তারমানে কি প্রিয় মানুষটিকে পাওয়া সহজ হলো তার জন্য ? সকালে রাইমার ভাইয়ের কথাবার্তাতেও পজেটিভ সাইন ছিলো তাদের সম্পর্কের প্রতি । এখন আরও সহজ লাগছে মেহউইশ আপুর কথায়। তানভীরের মুখে, চোখে আনন্দের ঝিলিক ছিলো যা মেহউইশের চোখে ধরা পড়েছে৷ ভালো লাগে তার যে যাকে চায় তাকে পেতে দেখলে। একটা সময় নিজেরও তো সাধ ছিলো প্রিয় মানুষটার সাথে সারাজীবন থাকার। রিশাদকে সে ভালোবাসে না, হয়তো কখনও বাসতেও পারবে না কিন্তু রিশাদের জীবনের বিষাক্ত অতীত আর অভ্যাসে বাঁধা পড়ে সারাজীবন একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা সে নিজ মনে করে নিয়েছে। দায় নয় বরং দ্বায়িত্ব হিসেবেই পালন করবে সম্পর্কটাকে।

‘ আমাদের দেরি হচ্ছে তানভীর চললাম৷ ভালো থেকো আর সৎ থেকো মেয়েটার প্রতি। কেন জানি ভরসা হয় তোমার ওপর তুমি কখনো কষ্ট দেবে না রাইমাকে। তবুও অনুরোধ রইলো ভাই সম্পর্কটাকে সৎভাবে এগিয়ে নিয়ে যেও। রাইমা সত্যিই খুব ভালো মেয়ে।’

-‘দোয়া করবেন যেন আমরা উপসংহারেও একসাথে, একই বন্ধনে জুড়ে থাকতে পারি৷’ কথা শেষ করে তানভীরই আগে বের হলো ঘর থেকে তারপরই মেহউইশ বেলকোনির পর্দা,কাঁচ সব লাগিয়ে ঘর লক করেই বের হলো৷ নির্জন আগে থেকেই বাইরে ছিলো। সে নিচতলায় গুটি গুটি পায়ে ছুটোছুটি করছিলো সেই সাথে তার আধখানি বুলিতে মাতিয়ে দিচ্ছিলো সবাইকে। মেহউইশ নিচে আসতেই মাইমুনা ডাকলো তাকে। মন খারাপ হলো মা, মেয়ে দুজনেরই তবুও নিয়মের পথে বাঁধ তৈরি সম্ভব নয় বলেই আলাদা হয়ে দু পথে রওয়ানা দিলো৷ মিহাদ আর মাইমুনা ঢাকার পথে আর মেহউইশরা চট্টগ্রামেই তাদের সেই পাহাড়ের বুকে। পাহাড়ি জনপদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা মেহউইশের নজরে পাহাড়ি হাটবাজার। কত রকম আদিবাসী একসাথে হয় তখন। আজও হাট বসেছে আর নিজেদেরই বাড়ির কাছাকাছিই এক বাজার। মেহউইশ জেদ করলো সে ওই বাজারে ঘুরবে। আজ সাথে নির্জন আর ফুপিও আছে তাই জেদ আরও জোড়ালো হলো তার। সন্ধ্যে ঘন হয়ে রাত নামছে ধরণীতে এ সময় পাহাড়ি পথে চলতে বড্ড ভয় রিশাদের যখন তার সাথে নির্জন থাকে। কিন্তু মেহউইশকে বোঝানো হলো না তার ভয়টা। বাধ্য হয়েই গাড়ি থামাতে হয়েছে তার। বাজার বসেছে দুপুরের পরই কিন্তু সন্ধ্যের পর তা জমেছে খুব। খাদ্যসামগ্রী থেকে কাপড়, বাঁশ,মাচার তৈরি জিনিস, নারীদের প্রসাধনী , ছাগল,হাঁস মুরগি কিছুই বাদ নেই এতে। শীত আসি আসও করছে হালকা হিম গায়ে থেকে থেকে কাঁপুনি দিচ্ছে। শীতের আগমনী এই হাওয়া মনের কোণ জমে থাকা বিষন্নতাকে জমিয়ে দেয় আশ্লেষে। রিশাদ গাড়ি থেকে নামার আগে তার ওয়ালেট চেক করলো। খুঁচরো কিছু পয়সা আছে কিনা তার জানা নেই। এখন বাজারে ঢোকা মানে ফুপি কিছু বেতের তৈরি জিনিস কিনবে, মেহউইশ নিশ্চয়ই একটা কাজল আর একটা ছোট্ট খেলনা কিনবে৷ প্রতিবার তারা তাই করে আর বিপদে ফেলে রিশাদকে। তারা এমনসব জিনিস কেনে যার দাম পাঁচশো’ও হয় না৷ আর রিশাদের পকেটে বরাবরই টাকা বলতে কয়েকটা পাচশো টাকার নোট অথবা তার কার্ডগুলোই থাকে। আগেরবার মেহউইশ ইঙ্গিতে তাকে অপমান করেছিলো। সেই অপমানের ঝাল সে মিটিয়েছিলো তার বোকাসোকা ম্যানেজারের উপর। কিন্তু আজও যদি অপমানিত হতে হয় সে ঝাল মেটানোর জন্য তো আজ ম্যানেজারও নেই।

‘শালা এই কপালটাই খারাপ নইলে কি আর বোকাসোকা ম্যানেজারটার প্রেম হয় তিশমার মতো মেয়ের সাথে। ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেল আমার সকল সুখের চাবি ম্যানেজারকে।আগেই বোঝা উচিত ছিলো তিশমা এমন ঘন ঘন কক্সবাজারে আসা আর আমার বলদা ম্যানেজারকে হাংকি পাংকি ডাকার কারণ ,,,! ‘ স্বগোতক্তির মতোই বলল রিশাদ সিটে বসে থেকেই। তার এই বেখেয়ালি ভাবনা চলার মাঝেই রেহনুমা আর মেহউইশ বেরিয়ে পড়েছিলো গাড়ি থেকে। রিশাদও এবার বেরিয়ে গিয়ে খুঁজতে লাগলো ভীড়ে। অন্ধকারে বড় বড় কুপি আর চার্জার লাইটের আলোতে চেনা মুখের খোঁজ মিলছে না। এত দ্রুত কোথায় মিলিয়ে গেল তারা! যেদিকে চোখ যায় চাকমা,মারমা,মুরুং। এত লোকের ভীড়ে তার বাঙালি বউ আর ফুপুটাকে চোখে পড়ছে না। মিনিট দশেক ঘুরতে ঘুরতে পাগল প্রায় রিশাদের চোখ থমকে গেল সামনেই এক কুপির সামনে। হলদে আলোয় ফর্সা মুখটা কাঠবর্ণ হয়ে আছে৷ ঘন পাপড়ির চোখ ঘন কালো মেঘের মতন। ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক বিজলির মত চমকিত করছে যেন ভুবনমোহিনী গোলাপর গুচ্ছ কেউ তুলে ধরেছে চোখের সামনে। সঙ্গাহীন হয়ে থমকে আছে মেহউইশের অমন আলোয় জ্বলজ্বল মুখটা দেখে৷ এ মুখের প্রেমে সে বহুবার নিজেকে হারাতে চায়। নতুন করে মন বুঝি তার আবারও নিজেকে রক্তাক্ত করতে চায় প্রেম নামক কাঁটায় ঘেরা রক্ত গোলাপে!

মাটির একটা ছোট পুতুল হাতে নিয়ে খুব মন দিয়ে দেখছিলো মেহউইশ। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলো রিশাদ দেখছে তাকে, নিষ্পলক সে চাহনি।

চলবে

(গুলিয়ে যাচ্ছে সব 😑। কি লিখছি কি করছি জানি না৷ দুঃখিত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here