মন_পাড়ায় পর্ব_২৬

মন_পাড়ায়
পর্ব_২৬
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

“আমার মনে হয় কি জানিস এই মেয়ে সৈকত থেকে বেশি আমাকে ভালোবাসে। তিনমাস হয়ে গেল তারপরও ওর আমার প্রতি ভালোবাসা কমে না। মাঝেমধ্যে মন চায় ওর চুলগুলোর মধ্যে আগুন লাগায় দেই। তারপর এত সুন্দর চুল দেখে মায়া লাগে। এমন পেত্নীদের এত সুন্দর চুল কেন?”

অঞ্জলি শব্দ করে হাসতে শুরু করল ঝিনুকের কথা বলার ভঙ্গিতে সাবেকও বহু কষ্টে নিজের হাসি থামাল। সে নিজের খাওয়ায় ব্যস্ত। অবশেষে অর্ণব বরাবরই বিরক্ত। এমন না যে সে ঝিনুককে অপছন্দ করে। কিন্তু তার পছন্দ করার নাটকের পরও ঝিনুক কিছুই বুঝতে পারে না। এত বোকা মেয়েও হয় নাকি? আর আজকাল সে কোনো মতেই সৈকতের সাথে কথা বলে না। এইভাবে সৈকতকে কষ্ট দিবে কীভাবে সে? বিরক্ত লাগে তার প্রচুর। আজকাল সব কিছুতেই তার বিরক্ত লাগে।

অঞ্জলি চায়ে এক চুমুক দিয়ে ঝিনুককে ইশারা করে বলল, “এসেছে তোর জানেমান।”

ঝিনুক পিছনে তাকিয়ে দেখে জ্যোতি তার তিনটা বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে একজনের নামও সে জানে না তাই সে নিজ থেকে নাম দিয়েছে পেত্নী ২, পেত্নী ৩ ও পেত্নী ৪। আর জ্যোতি শুধু পেত্নী। একেকজন অসম্ভব সুন্দর হলেও তার সাথে তাদের ব্যবহার এমনই মনে হয় ঝিনুকের। ঝিনুক টেবিলে মাথা রেখে কপালে হাত দিয়ে বলল, “পেত্নীর নাম নিলাম আর পেত্নী হাজির। মাঝেমধ্যে আমার পেত্নীদের জন্য আফসোস হয় তাদেরকে এই চারটার সাথে তুলনা করছি বলে।”

পিছন থেকে ঝিনুক শুনল জ্যোতি বলছে, “তুই কী যে বলছিস! এই ভার্সিটিতে আমার সাথে প্রতিযোগিতা করে কেউ নাচে জিতবে? অসম্ভব। আজ পর্যন্ত জ্যোতির কাছ থেকে কেউ জিততে পারে নি। আমি বেস্ট।”

ঝিনুক কথাটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এই মেয়ে ঘুরে ফিরে আমার কাছেই আসবে দেখে নিস।”

জ্যোতি আবারও বলল, “আমি গত চার বছর ধরে সব অনুষ্ঠানে নৃত্য প্রদর্শন করি। আজ পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে কেউ সাহস করেছে নিজের নাম লেখানোর? ওহ ঝিনুক…..”

ঝিনুক চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “যা বলেছিলাম।”

ঝিনুক বসে থাকা অবস্থাতেই পিছনে ফিরে তাকালো। জ্যোতি তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সে বলল, “শুনেছি তুমি নাকি নাচ করতে?”

“আপনার মতো ভালো পারি না। শুধু ফ্রেন্ডের বিয়েতে ও স্কুল-কলেজের কিছু অনুষ্ঠানে নাচ প্রদর্শন করেছি।” মনে মনে আবারও বলল, “পেত্নীর বাচ্চা পেত্নী আমি তোকে বলছি আমি নাচ পারি? হুদাই লাগতে আসোছ কেন?”

জ্যোতি তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “রিয়ালি? আমি আরও ভেবেছিলাম এইবার কেউ হয়তো আমার বিরুদ্ধে নাম দিবে তোমাদের নবীন বরণে। কিন্তু এখন তো দেখি……আচ্ছা যাই হোক এখন আর কী করার! বাই দ্যা ওয়ে আমি সৈকতকে নিয়ে আলাদা এক ট্রিপে যেতাম। ইউ নো ও আর আমি শুধু। তুমি তো ওকে আগের থেকে চেনো। বলোতো কোথায় গেলে ভালো হবে। যেহেতু শুধু আমরা দুইজন। রোমেন্টিক কোথাও বলো তো।”

ঝিনুক নিজের রাগ শান্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করল। নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, “জাহান্নামে যান দুইজনের জন্য একদম পার্ফেক্ট জায়গা।”

বলেই সে উঠে চলে গেল। বাহিরের দিকে যাওয়ার সময় ক্যান্টিনের দরজায় কারো বুকে ধাক্কা খেলো। পিছিয়ে যেতেই লোকটা তার কোমরে হাত দিয়ে দিলো। ঝিনুকের চোখ দুটো ছানাবড়া। সে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো লোকটার খবর করার জন্য। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে লোকটা সৈকত। এক চোখ টিপ মারলো সৈকত। ঝিনুক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। পাশে ইকবাল ও নীরাকে দেখে সে একটু লজ্জাও পেল বটে। কিন্তু পরের মুহূর্তে নিজেকে সামলে সৈকতের হাতের উপর হাত রেখে তা সরাতে চেষ্টা করে বলল, “জায়গা ও মানুষ দেখে শুনে কাজ করা যায় না? আমি তোমার প্রিয় গার্লফ্রেন্ড জ্যোতি না।”

“আমি জানি ম্যাম আপনি আমার বউ ঝিনুক।”

“আমি বলেছি আমাকে ছুঁবে না।”

“তোমাকে না ছুঁলে কাকে ছুঁতে যাব জানেমান?”

“পিছনেই তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে। ওর সাথে যেয়ে এমন ঘষাঘষি করো যাও।”

জ্যোতির কথা শুনতেও ও হাত সরিয়ে নিলো। এত নিলজ্জ ছেলে আমি সারাজীবনে দেখি নি। আমার সামনে জ্যোতিকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে, জ্যোতি তার হাত ধরে হাঁটবে, ঘষাঘষি করবে সে কিছুই বলবে না। উল্টো তার যত্ন নিবে আবার তারও কাছে আসবে। এখন আর এইসব ভালো লাগে না ঝিনুকের। বিরক্ত লাগে বেশ। সে ভেবে নিয়েছে, তার প্রভা আপি ও অর্ক দুলাভাইয়ের সম্পর্ক আরেকটু গভীর হলেই চলে যাবে সে এইখান থেকে। তার আর সহ্য হয় না তার। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যকারো সাথে দেখার মতো কষ্ট আর হতে পারে না। তার দম বন্ধ হয়ে আসে মাঝেমধ্যে।

ঝিনুক সৈকতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

.

.

অর্ক সাইকিয়াস্ট্রিট দীপ্তি চক্রবর্তীর সামনে বসে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, “ম্যাম আপনাকে দেখানোর পর ওর ভয়টা কমেছে। কিন্ত তবুও মাঝেমধ্যে সমস্যা হয়।”

“একদিনে তো আর অসুখ ঠিক হয়ে না মিঃ অর্ক। সময় লাগে। উনি যদি মাঝখানে ট্রিটমেন্ট না ছাড়তো তাহলে হয়তো অবস্থা আরও ভালো হতো। আপনি উনাকে আমার দেওয়া ঔষধ দিবেন প্রতিদিন। ভগবানের কৃপায় আরও ভালো হয়ে যাবে।”

“একটা জিনিস জিজ্ঞেস করার ছিলো ম্যাম। এমন অবস্থায় কী কেউ ভুলে কোনো অপরাধ করতে পারে?”

দীপ্তি চক্রবর্তী একটু সময় নিয়ে বলল, “দেখুন মিঃ অর্ক আমি ওর আচরণ দেখে ঔষধ দিতে পারি কিন্তু পেসেন্টের মাথায় কি চলে তা জানা সম্ভব না আমার পক্ষে। মানসিক রোগ অনেক রকমের হয়। আমি আপনাকে দুই এক উদাহরণ দেই। অনেক সময় রোগীরা মানসিক সমস্যায় থাকলে এমন কিছু চরিত্র তৈরি করি যার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে নেই। অনেক সময় পেসেন্টরা নিজে তা বুঝতে পারে না আবার অনেক সময় জানে যে এটা শুধু তার মাথার খেলা। এমন চরিত্রের অস্তিত্বই নেই। আরেক ধরন হচ্ছে তারা নিজের চিন্তাকে অবসেশন বানিয়ে নেয়। আবারও এমন কিছু মানসিক রোগীও আছে যারা অত্যন্ত চালাক হয়। সাধারণ মানুষ থেকেও বেশি। আবার কিছু পেসেন্ট আছে যারা বিশেষ কোনো ঘটনা তাদের মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলে। তারা ওই কাজটি করে কিন্তু তাদের তা মনে থাকে না অথবা কোনো এক ঘটনা আসলে হয় নি কিন্তু সে তা নিজে তৈরি করে নেয় সে ঘটনা। নিজের মস্তিষ্কে এইটা বসিয়ে নেয় সে তারা যা করছে সব ঠিক এবং ভুলগুলোকে মুছে ফেলে। কিন্তু অনেকের সাধারণ সমস্যা থাকে। যেমন অতিরিক্ত চিন্তা বা ভয়। প্রভাকে আমি যতটুকু চিকিৎসা করছি আপাতত আমি শুধু ওর ভয়টাই ধরতে পেরেছি। কারণ এইটাই ও আমায় বলছে। ওর মতে ওর উপর অনেক নির্যাতন হয়েছে।”

“এইটা কী ওর নিজের তৈরি করা ভাবনা হতে পারে?”

“পারে। কিন্তু ভাবনা হলেও ওর জন্য এইটাই সত্যি। এবং ওর এই সমস্যা থাকলেও কোনো বিশেষ কারণে হয়েছে কারণ ছোট থেকে ওর এমন কোনো সমস্যা ছিলো না। যা হয়েছে ওর প্রথম বিয়ের পর হয়েছে।”

“ধন্যবাদ ম্যাম। আমি তাহলে আগামী রবিবার ওকে নিয়ে আসবো। আজ উঠি।”

অর্ক রুম থেকে বের হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল কেবিনের বাহিরে। সে বুঝতে পারছে না ঠিক কী হচ্ছে তার জীবনের সাথে। একদিকে বিনয় ও নূহা। তার জীবনের অনেক বড় অংশ তারা দুইজন। সাথে তাদের পরিবার। অন্যদিকে প্রভা, যার প্রতি না চেয়েও মায়া বেড়েই যাচ্ছে তার মনে। এর উপর এই অসুখের কথা শুনে আরও মায়া লাগে মেয়েটার উপর। নিশ্চয়ই কোনো বড় ঘটনা ঘটেছে তার জীবনে, নাহয় এত খারাপ অবস্থা হতো না তার। আর যদি নিজ অজান্তেই বিনয় ও নূহার সাথে কিছু করে তখন?

কিছুই বুঝতে পারছে না অর্ক। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেল।

বাসায় যাওয়ার পর প্রভাকে খুব চিন্তিত দেখায়। অর্ককে একগ্লাস পানি দিয়েই সে চলে যায় বারান্দায়। অর্ক বারান্দায় যেয়ে দেখে প্রভা চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাহিরে। অর্ক জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোনো কারণে চিন্তিত?”

প্রভা তাকালো অর্কের দিকে। মাথা নাড়িয়ে না বলল। অর্ক বলল, “তুমি না বললে আমি বুঝব কি করে?”

প্রভা আশেপাশে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। সে চাইতো না কথাগুলো অর্ককে বলতে। কিন্তু আজকাল কেন যেন সে অর্ক থেকে কিছু লুকাতে পারে না। আজব লাগে তার নিজের কাছে। সে না চেয়েও বলে দেয় সবটা অর্ককে। আজও তাই করল। বলল, “আপনার বাবা আজ ডেকেছিল।”

“কী বলল?”

প্রভা মাথা নিচে নামিয়ে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বলল, “হানিমুনে পাঠানোর জন্য। আগামী সাপ্তাহেই নাকি পাঠাবে।আমি মানা করেছি কিন্তু বেশি কিছু বললেও সন্দেহ করবে। আপনি কথা বলে দেখবেন একটু?”

“তুমি এইজন্য এত চিন্তিত?” প্রভা মুখ তুলে দেখে অর্ক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাকে রাগান্বিত দেখাচ্ছে বটে। কারণটা ধরতে পারলো না প্রভা। এতে তারও কি চিন্তিত হওয়ার কথা না? নাকি সেই বেশি ভাবছে? প্রভা বিষয়টা পাল্টানোর জন্য আবারও বলল, “পরিশ ভাইয়া বাংলাদেশে আসছে।”

অর্ক নিজের হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল, “তাহলে এইখানে এত চিন্তিত হবার কি আছে? তোমার ভাই আসছে তোমার খুশি হওয়ার কথা।”

প্রভা আমতা-আমতা করে বলল, “পরিশ ভাইয়া ঝিনুকের বিয়ের কথা জানলে কী করবে তা নিয়ে আমি চিন্তিত। ভাইয়া জানে না ঝিনুকের বিয়ে হয়েছে।”

“বেশি চিন্তা কর না। এইখানে চিন্তা করার কিছু নেই।”

“ভাইয়া ঝিনুককে পছন্দ করে ছোট থেকেই। বিয়ে করতে চাইত।” অর্ক কথাটা শুনেই চমকে উঠলো। প্রভার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত সুরে বলল, “কী বলছ এইসব? উনি ঝিনুকের অনেক বড় আর। তুমি ওর আপন বোনের মতো তাহলে পরিশও তো…… আমার ভেবেই ঘিনঘিন লাগছে।”

“পরিশ ভাইয়া একপ্রকার জেদ ধরে ছিলো ঝিনুককে নিয়ে তাই বাবা তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয় আর ঝিনুককে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে, নাহয় আমার ইচ্ছা ছিলো না ওকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার। আল্লাহ জানে ভাইয়া আসলে কী তুফান উঠবে? ঝিনুকের কথা উঠলে ভাইয়া সব কিছু ভুলে যায়। আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে।”

চলবে……

[কিছু সমস্যার কারণে দিতে দেরি হয়েছে। ইনশাআল্লাহ আবার কোনো সমস্যা না এলে আগামীকালও গল্প দেওয়ার চেষ্টা করব।]

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here