মেঘবৃত্ত পর্ব_৩২

#মেঘবৃত্ত
পর্ব_৩২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বৃত্তের চাকরিটা হয়ে যায়। বৃত্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ায় মোটামুটি ভালো বেতনের চাকরি পায় সে। সেদিন রাতের কথা,
রাতের খাবারের পর্ব শেষ করে মেঘা মাত্রই ঘরে এলো। বৃত্ত তখন সোফায় বসে ল্যাপটপে ফাইল ঘাটছিলো। মেঘা বৃত্তকে একপলক দেখে বাথরুমে চলে গেল। ঘরে মেঘার উপস্থিতি লক্ষ্য করতেই বৃত্ত ল্যাপটপ বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখে দিলো। আজ মেঘার সাথে একটা বিহিত করতেই হবে। এভাবে তো দিন যাবে না! কথা বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমস্যার ফলাফল না। মেঘার কিসে সমস্যা সেটা আগে জানতে হবে। আজ মেঘাকে কোনোরূপ ছাড় দেওয়া হবে না, বৃত্ত যেনো নিজের পণে অটল।

একটু পর মেঘা বাথরুম ছেড়ে বের হলো। দরজার সামনে বৃত্তকে ঠায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে মেঘা এক দফা বিস্মিত হলো। বৃত্ত মেঘার চাওনির পরোয়া না করে ভ্রু কুচকে বললো,
— তোর সাথে আমার কথা আছে, ইমার্জেন্সী।
মেঘা বুঝতে পারলো, বৃত্তের ইমার্জেন্সী কথাটা কি হতে পারে! মেঘা চুপচাপ বৃত্তকে পাশ কাটিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। চুলে চিরুনি লাগিয়ে বললো,
— বল, কি বলবি।

বৃত্ত এগিয়ে এলো মেঘার দিকে। আয়নায় মেঘার প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে তীক্ষ্ম সুরে প্রশ্ন করলো,
— তোর সমস্যা কি? কথা বলছিস না কেনো আমার সাথে?

মেঘা ভাবলেশহীন হয়ে চুল আঁচড়াতে মন দিয়ে বললো,
— কই কথা বলছি না। যা জিজ্ঞেস করছিস, উত্তর তো দিচ্ছি। আর কি কথা বলবো?
— সিরিয়াসলি মেঘ? আমার রাগ উঠাস না। আমি জানি তুই ইচ্ছে করেই আমার সাথে কথা বন্ধ করেছিস। আমি কিছু জিগ্গেস করলো শুধু উত্তর দেওয়া, এগুলো নরমাল কথার মধ্যে পড়ে না। আমি জানতে চাইছি, তুই আগের মত নরমাল হচ্ছিস না কেনো? দেখ মেঘ, সমস্যা কি সেটা না বললে তো এর সলিউশন বের হবে না। আমাকে বল, তোর কি প্রবলেম? তুই কেনো আগের মত হচ্ছিস না?

বৃত্তের চেঁচিয়ে বলা কথাটা শুনে মেঘার হাত থেমে গেলো। কতক্ষণ চেয়ে রইলো বৃত্তের প্রতিবিম্বের পানে। বৃত্ত বেশ রাগ হয়ে আছে। এখন উল্টাপাল্টা কথা বললে বৃত্তের রাগ তার সীমা পেরিয়ে যাবে। আর তার সীমাহীন রাগ সম্পর্কে মেঘা বেশ সচেতন! মেঘা হাসলো হঠাৎ। চিরুনি টেবিলের উপর রেখে বৃত্তের দিকে ফিরলো সে। মুচকি হেসে বললো,
— আমার মধ্যে তো কখনোই কিছু ছিলো না বৃত্ত। আমার মধ্যে কি আছে? না রূপ, না গুন, না অন্য। শুধুমাত্র একটা অহং ছিলো। আজ আমার সেই অহংটাও ধারালো আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমি তো নিজেকে সামলাচ্ছি শুধু, দ্যাটস ইট!

বৃত্ত অবাক হলো। কুঁচকানো ভ্রু সোজা করে বললো,
— অহং, কিসের অহং?

মেঘা আলতো হাসলো। বললো,
— তুই কি জানিস বৃত্ত! তুই নিজেকে যতটা চালাক মনে করিস, আসলে তুই ততটা চালাক না। আমি তো বলবো, তুই আস্ত এক ডাফার। তুই সবার বাইরেরটাই দেখিস, ভেতরের দিকে তোর নজর শুধুই ঝাপসা।

মেঘার ওমন ভারী ভারী শব্দ বৃত্তের মস্তিষ্কে ঢুকলো না। সে তখনো ভ্রু কুঁচকে মেঘার দিকে চেয়ে।
মেঘা আর কথা বললো না। চুপচাপ ঔষধ খেয়ে বিছানায় গা এলালো। বৃত্ত তখনো দাঁড়িয়ে। মেঘার একেকটা কথা তাকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। এই মেঘ চাইছেটা কি?
_________________________________
আজ নেহার বিয়ে। বন্ধুমহলের সবাই দলবেধে সেই বিয়েতে এসেছে। বৃত্তও বাদ যায়নি। তবে, বাদ গেছে মেঘা স্বয়ং। বৃত্তের শতবার বলার পরও মেঘা বিয়েতে আসেনি। বৃত্ত ভেতরে ভেতরে সেজন্যে খানিক নাখোশ হয়ে আছে। মেঘার এমন হেয়ালিপনা তার ঠিক সহ্য হচ্ছে না। বৃত্তের শুধু মনে হচ্ছে, কোনো একটা ম্যাজিক হোক, তার মেঘ সেই ম্যাজিকের ছোঁয়ায় আগের ন্যায় হয়ে উঠুক। হাসুক, জ্বালাক, কান্নায় তার বুক ভাসা়ক। কিন্তু আফসোস, বাস্তবে ম্যাজিকের অস্তিত্ব কোথায়?

ভার্সিটির সবাই একপাশে বসে আছে। বিশটা চেয়ার বিশিষ্ট টেবিলে আপাতত এই বন্ধুমহলের দখলে। সবাই একসাথে কথা বলছে, হাসছে, মাঝেমধ্যে গানও গেয়ে উঠছে। সর্বোপরি পরিবেশটা বেশ জমে উঠেছে। তবে, বৃত্তের মন পড়ে আছে ‘তার মেঘে’। এত এত বন্ধুদের মধ্যে বৃত্তের মনটা শুধু তার মেঘকেই খুঁজছে। বিয়ের বাড়ীর এত শোরগোল সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে আছে তার মেঘের কণ্ঠ বিনা। বৃত্ত অন্যমনস্ক হয়ে সবার কথার সাথে তাল মেলাচ্ছে। সিদ্ধার্থ পাশ থেকে বৃত্তের এমন উদাসীনতা দেখে ভ্রু কুঁচকালো। সরু চোখে বৃত্তের মূলত কি হয়েছে সেটাই বুঝার চেষ্টা করছে সে। হঠাৎ সিদ্ধার্থ উঠে দাঁড়ালো। সবার উদ্দেশ্যে বললো,
— গাইস, আমি সবার জন্যে ড্রিংকস নিয়ে আসছি। এই বৃত্ত চল আমার সাথে।

সিদ্ধার্থের কথা শুনে বৃত্ত মাথা উচুঁ করে তার দিকে তাকালো। সিদ্ধার্থ চোখের ইশারায় বৃত্তকে তার সাথে যেতে বললো। বৃত্তও আর অমত করলো না। এমনিতেও, এখানে বসে থাকতে তার ভালো লাগছিলো না।

সিদ্ধার্থ আর বৃত্ত বসে আছে একটা লেকের পাশে। এখনটায় বেশ নীরব, বিয়ের বাড়ীর শোরগোল এখান অব্দি আসে না। বৃত্তের তাই এখানে খুব শান্তি লাগছে। বৃত্ত লেকের দিকে চেয়ে হুট করেই বলে উঠলো,
— জানিস, মেঘের লেকের পানি খুব পছন্দ। কেনো যে বিয়েতে আসলো না? হুদাই এত সুন্দর পরিবেশটা মিস করলি। এলে দেখতি, কি যে খুশি হত।
কথাটা বলতে বলতে বৃত্তের আবারও মন খারাপ হলো। বুকটা ক্রমশ ভারে পিষ্ট হয়ে যেতে লাগলো। সিদ্ধার্থ পাশ থেকে ভ্রু কুচকে বৃত্তের দিকে চেয়ে আছে। মেঘার জন্যে বৃত্তের এরূপ ছটফট করা সিদ্ধার্থকে ভাবিয়ে তুলছে। সিদ্ধার্থ শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— মেঘাকে খুব মিস করছিস, না?
বৃত্ত উত্তর দিলো না, হাসলো শুধু। হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে বললো সে,
— জানিস, এই মেঘটা না কেমন যেনো হয়ে গেছে। আমি এক মেঘকে মোটেও চিন্তে পারছি না। মনে হচ্ছে, এ আমার সেই মেঘ নয়, যাকে আমি এতটা বছর ধরে চিনি। এ মেঘ তো কোনো অন্য!

বৃত্তের কথায় কোথায় যেনো এক প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি সিদ্ধার্থ। বারবার মনে হচ্ছে, মেঘবৃত্তের এই সম্পর্ক শুধুমাত্র বন্ধুত্ত্ব নয়, বরং তার থেকেও বেশি কিছু। হঠাৎই সিদ্ধার্থের মাথায় এক বুদ্ধি এলো। সে একটু নড়েচড়ে বসলো মাটিতে। হঠাৎ করেই বললো,
— আচ্ছা, বৃত্ত তোকে আমি কিছু প্রশ্ন করবো। তার ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারলে তুই হবি উইনার। আর না দিতে পারলে ইউ উইল বি অ্যা লুজার। ঠিকাছে?

কোথাকার কথা কোথায় টেনে আনছে এই সিদ্ধার্থ। বৃত্ত এবার বড়ই বিরক্ত হলো। তবে তার বোরিংনেস কাটানোর জন্যে শর্তে রাজি হয়ে গেলো। সিদ্ধার্থ প্রশ্ন করলো,
— বল তো, মেঘার কি পছন্দ? পাহাড় নাকি সমুদ্র?
বৃত্ত কোনো কিছু ভাবার আগেই বলে ফেললো,
— সমুদ্র!
— মেঘার আইস্ক্রিম পছন্দ নাকি ফুচকা?
— আইস্ক্রিম। ওর ফুচকা দেখলেই গা গুলায়।
— মেঘার একটা বদ অভ্যাসের নাম বল।
— দাঁত দিয়ে নখ কাটা। এর জন্যে অনেকবার মারও খেয়েছে আন্টির কাছে।
— বৃষ্টি নাকি শীত পছন্দ ওর?
— বৃষ্টি। জানিস, সেদিনও বৃষ্টিতে ভিজেছে ও। বৃষ্টিতে ভিজলে ও একদম বাচ্চা হয়ে যায়।

সিদ্ধার্থ এবার থামলো। যা বোঝার সে বুঝে গেছে। বৃত্ত খুব হাসলো। গর্ব করে বললো,
— দেখলি,এই বৃত্ত পারে না এমন কিছুই এই দুনিয়াতে নেই। সো, আই অ্যাম দ্য উইনার।

সিদ্ধার্থ এসব কথা পরোয়া করলো না। বরং খুব শান্তসুরে জিজ্ঞেস করলো,
— তুই কি মেঘাকে ভালোবাসিস, বৃত্ত?

#চলবে
নোট ১- যাদের কাছে পোস্টটা পৌঁছাবে রিয়েক্ট করার অনুরোধ। পেজের রিচ অনেক কমে গেছে। পেজের রিচ বাড়াতে আপনাদের এই ছোট্ট রিয়েক্টই সহায়ক। আশা করি, আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন। ভালোবাসা।

লেখিকার পাঠকমহল,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/100063985747587/posts/270155225127334/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here