#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব৭
“রুমি কী হয়েছে? কাল খুশি মনে বাসায় গেলে, আজ দেখি আবার মন ভার হয়ে আছে। কেউ কিছু বলেছে? তুমি এইসব বাইরের মানুষের কথায় একদম কান দিও না তো।”
“না আপু, বাইরের মানুষের কথায় আর কষ্ট পাই না, কষ্ট যা পাই এখন নিজের মানুষদের আচরণে।”
“বাসায় কিছু হয়েছে?”
“তেমন কিছু না আপু। আসলে কাল বাসায় যাওয়ার পথে কাচ্চি ওয়ালা থেকে কাচ্চিবিরিয়ানি নিয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম বাসায় মিষ্টি তেমন কেউ খায় না, কাচ্চিই খাওয়াই, আমারও পছন্দ। খেতে বসলে সবাইকে কলেজের খবরটা বলবো।”
“তারপর?”
“আর কী আপু, বাসায় সেই রোজকার থমথমে পরিবেশ। কেউ জানার আগ্রহও করে নাই কেন আনলাম। আব্বা তো আগেই খেয়ে নেয়। আম্মা খাবে না, কেন খাবে না, সেটারও কোন কারণ নেই। এমনি একটা চাপা জিদ আর রাগ সবসময় আমার উপর। আমার ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটা আম্মা আজও মেনে নিতে পারেননি। আমি ঐ সংসারে পরকীয়ার বলি হয়ে মারা গেলেও বোধহয় আম্মা আব্বা এতটা কষ্ট পেত না, যতটা আমার সংসার ভাঙায় পেয়েছে।”
“না না ছিঃ রুমি, এভাবে বলছ কেন! ওনারা কী তোমায় এখনো কম ভালোবাসেন বলো? আসলে যা হয়, চিন্তা থেকে হয়তো ওনারা অভিমান দেখান।”
“অভিমান একটা জিনিস আপু, আর অপমান আলাদা জিনিস। এক বিয়ে হওয়ার পর যেন আমার বাবার বাড়ি, আর আমার বাড়ি নেই। এখানে মেহমান হিসেবে আমি মাথার মনি ছিলাম, আবার মেয়ে হয়ে ফিরে আসায় কেমন গলার কাঁটা হয়ে গিয়েছি।”
মরিয়ম সহসা কী উত্তর দেবে বোঝে না। রুমির জন্য খারাপ লাগে। মানসিক ভাবে খুব খারাপ অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বলে হয়তো এমন লাগছে ওর।
রুমি কথ বলে হালকা হতে চায়, নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলা সহজ নয়, বললে দশজনের নয়জনই উল্টো কথা শোনাবে। বাবা মাও যে ভুল হতে পারেন, এইটা যেমন এখনো আমরা স্বীকার করতে রাজি না, তেমনি সহজে কেউ নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে বলতেও চায় না। পরিবারে তার অবস্থান দুর্বল, ভালেবাসা পায় না, এটা জানাতে সবাই কুণ্ঠা বোধ করে। তাই পরিবারের সম্পর্কগুলোর মাঝের ভালোবাসাটাই শুধু সামনে আসে, অভিমানটা খুব কম।
“আপু আপনি হয়তো ভাবছেন কী বলছি আমি। কিন্তু আপনি নিজে এই অবহেলা, তাচ্ছিল্য অনুভব না করলে বুঝবেন না। দৃশ্যত কোন অপরাধ করা ছাড়াই আমি অপরাধী, এমনটাই আমার মনে হয়। বাড়িতে যখন বাবা মায়ের কাছেই মেয়ে মূল্যায়ন পায় না, তখন বাকি সদস্যরা কেন দেবে বলেন? জানেন আপু আমার নেওয়া কাচ্চি আমার ভাই বোনও খায়নি। যদি জিজ্ঞেস করেন কেন খায়নি, তবে বলবো কোন কারণ নেই। শুধুমাত্র আমাকে তাচ্ছিল্য দেখানোই উদ্দেশ্য। দুই বেলা সেই বিরিয়ানি আমি একা বিষের মতো গিলেছি। কারণ নষ্ট হলে এই নিয়ে আরেকদফা কথা শুনব। বাকিটা আজ বক্সে করে নিয়ে এসেছি।”
“শুনো তোমার আম্মা আব্বা বয়স্ক মানুষ। ওনারা ভারী খাবার না খাওয়াই ভালো। রশ্মিকে দেখতে ছেলেপক্ষ আসবে, তাই হয়তো ও ডায়েটের চেষ্টা করছে। আর তোমার ভাইয়ের চাকরি হচ্ছে না, মানসিক চাপে আছে, তার হয়তো মন মর্জি ভালো যাচ্ছে না। এভাবে ভেবে দেখ রুমি। সবকিছু নিজের উপর নিও না প্লিজ। আর ভালো হয়েছে নিয়ে এসেছ, আমি খাব। আমাকে তো খাওয়ালে না।”
“সত্যি খাবেন আপু? খুব খুশি হব।
আপু আপনার সাথে কথা বলে মন হালকা লাগে। তবে এই কথাগুলো আর কাউকে বলবেন না প্লিজ। নিজের পরিবার নিয়ে বিরূপ কথা বলতে কেমন বিব্রত লাগে।”
“নাহ্ বোকা। এই চিনলা আপু কে?”
“চিনেছি বলেই শেয়ার করি আপু। আপু জানোই তো, বেতন পাই মাত্র পঁচিশ হাজার। মাসের শুরুতেই পনেরো হাজার আম্মার হাতে দিয়ে দেই। বাকি দশ হাজারে নিজের আর মেয়ের সব খরচ চালাই। তিতলির বাবার, মেয়ের জন্য মাসে মাসে পাঠানো পাঁচ হাজার টাকা ডিপিএস করা আছে । আর আমার একাউন্টে আছে লাখ দেড়েক টাকা। তিতলির স্কুলে ভর্তি সহ বিপদ আপদের জন্য এই টাকা রাখা। আমি নিজে যত কষ্টই করি না কেন, বাসা থেকে এক টাকাও না নেওয়ার চেষ্টা করি। আব্বা যে অবসরে গিয়েছেন, এই খেয়াল আমার আছে। অথচ বাসার যাবতীয় সমস্যার বয়ানে আম্মা আমাকে টেনে আনে। কাল অন্তত দশবার টাকা পয়সার টানাটানির কথা তুলে হইচই করলেন বাসায়। কয়টা টাকা খরচ করে দুই প্যাকেট কাচ্চি নিয়ে বিশাল অপরাধ করেছি আমি। অথচ এটা আমি সম্পূর্ণ আমার হাতখরচ থেকে কিনেছি। একই ভাবে কোন জামা কাপড় কিনলে রাগ, বাসায় ফিরতে একটু দেরি হলে রাগ, বিকেলে ঘুমালে রাগ। আপু আমি বোধহয় আপনাকে বুঝাতে পারছি না, ঠিক নিজের বাসায় আমি কতটা একা আর কোণঠাসা অনুভব করি। আমার বোনটা সংসারের একটা কাজ না করলেও সমস্যা নেই, কারণ ও এখনো কুমারী মেয়ে। আমার ভাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গ্লাসে পানিটা ঢেলে না খেলেও অপরাধ নেই। কিন্তু কোনদিন আমি যদি ক্লান্তিতে রাতে আম্মার ঘুমানোর আগে ঘুমিয়ে যাই, তাহলে সকালে আর আম্মার চেহারার দিকে তাকানো যায় না। মুখ ভার করে থাকেন, সাথে কথার খোঁচা চলে, তিনি নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেন, এসব চলতেই থাকে। আমিও মাঝেমাঝে না পেরে উত্তর দেই, তখন একটা ঝগড়া লেগে যায়। এইসব কিছু মিলে আমার মাঝে মাঝে ভীষণ হতাশ লাগে আপু।”
রুমিকে কী বলা উচিত, সহসা মরিয়ম তা খুঁজে পায় না। শুধু রুমির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আপার স্নেহের কাছে গলে গিয়ে রুমির জমানো কষ্টগুলো কান্না হয়ে ঝরে। মরিয়ম বাঁধা দেয় না, মাঝেমাঝে মানুষকে কাঁদতে দেওয়া উচিত, এতে মন হালকা হয়।
ক্লাসের ফাঁকে একাকী কথা বলতে হলে মরিয়ম আপা আর রুমি প্রায় ছাদে চলে আসেন। এখন এখানে কেউ নেই, কাঁদলেও তাই পরে রুমিকে বিব্রত হতে হবে না।
“নানু বিয়ানি খাব।”
“বিরিয়ানি নেই নানু ভাই। ভাত দেব তোমাকে”
জলি বেগমের মনটা খারাপ। মেয়েটার সাথে প্রতিবার কঠিন আচরণ করার পর নিজেরই কষ্ট লাগে। প্রত্যেকবার ভাবেন আর এমন করবেন না, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ একটা চাপা ক্ষোভ সব এলোমেলো করে দেয়। সামনে রশ্মিকে দেখতে মেহমান আসবে। স্বামী রিটায়ার্ড হয়েছেন, ছোট মেয়েটাকে হাতে টাকা থাকতে থাকতে বিয়ে দেওয়া দরকার। রুমি তো ভালো ছাত্রী ছিল, তখন স্বামীরও চাকরিও ছিল, সব মিলিয়ে ভালো পেশার ছেলে পেতে সমস্যা হয়নি। ঘর বর সব দেখেই তো মেয়েটার বিয়ে দিলেন, এরপর ছেলের চরিত্র খারাপ হবে তা কে জানতো। তবে পুরুষ মানুষের এমন টুকটাক দোষ থাকে, সব ধরলে সংসার হয় না।
রুমি তো জানে না, ওর বাবা কী ধোয়া তুলসীপাতা ছিল নাকি, অফিসের রিসেপশনিস্টের সাথে কতবার হাতে নাতে ধরেছেন তিনি। কিন্তু সেসব কথা বাইরে যেতে দেননি। বুকে চেপে ধরে সেই স্বামী নিয়েই বিয়ের চৌত্রিশ বছর তিনি কাটিয়ে ফেলেছেন! অথচ আজকালকার মেয়েরা এত অধৈর্য, কোথায় রুমি স্বামীর সব দোষ লুকিয়ে স্বামীকে আঁচলে বাধার চেষ্টা করবে, তা না করে সমাজ জানালো, বিয়ে ভাঙলো। চাকরি বাকরি যাই করুক, মেয়ে সংসার করবে না, এই জিনিস তিনি আজও মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। সমাজের কাছে এই এক ঘটনায় কত ছোটো হয়েছেন। মেয়েটার উপর তাই ওনার চাপা রাগ। বড় মেয়ে ডিভোর্সি, ছোটোমেয়ের বিয়েতে এই নিয়ে কোন ঝামেলা হয় কিনা, সেই চিন্তায় ওনার ঘুম নেই, আর সেখানে মেয়ের কোন হেলদোল নেই, মনের আনন্দে বাসায় বিরিয়ানি নিয়ে আসে! ইচ্ছে করেই তাই খাননি। মেয়ে কষ্ট পেলে পাক, তখন তাই ভেবেছেন। কিন্তু আজ রাগ পড়ে যেতে মন খারাপ লাগছে, এতটা রূঢ় আচরণ না করলেও হতো। মেয়েটা এমনি টাকা নষ্ট করে না, কোন ভালো খবর হয়তো ছিল, তাই বলার চেষ্টা করেছে। নাতনিকে ভাত মেখে খাওয়াতে খাওয়াতে বড়ো মেয়ের জন্য মনটা কেমন কেমন করে ওঠে, কতদিন মেয়েটার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেন না, শুধু রাগ আর রাগ। আজ বাসায় আসলে হাসিমুখে কথা বলবেন।
(চলবে)