যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-৮

0
827

#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব৮

চোখ মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে টিচার্স রুমে বসে রুমি। মরিয়ম আপা ইচ্ছে করেই আলাদা বসেছেন, সবসময় একসাথে থেকে সবার চোখে পড়তে চান না, অযথাই দলাদলির লেবাস পেতে হবে। রৌশন আপা না হয় মিতু যে কেউ বলে বসবে, “রুমি আর মরিয়ম আপা তো একদল!” একই সাথে কাজ করা সহকর্মীরা আবার আলাদা আলাদা দল কেন হয় বোঝে না মরিয়ম, এসব তার ভালোও লাগে না। তবে কর্মক্ষেত্রে অদৃশ্য গ্রুপিং আছে, খোঁচাখুঁচিও আছে, আর অফিস পলিটিক্স তো মামুলি ব্যাপার।

রুমি এখনো অফিসিয়ালি নতুন ডিপার্টমেন্টে কাজ শুরু করেনি। মাস শেষ হতে আরও চারদিন বাকি আছে, এই কয়দিনে সবকাজ গুছিয়ে, আগামী মাস থেকে নতুন ডিপার্টমেন্টে কাজ শুরু করবে। মরিয়ম আপার সাথে কথা বলে হালকা লাগে রুমির। দীর্ঘদিনের জমানো কষ্টগুলো কান্নার সাথে ধুয়ে গিয়েছে। মাঝেমাঝে একটা কাঁধ আসলে খুব দরকার হয়, যে কাঁধে মাথা রেখে চোখের পানি ফেলা যায়। একটা সময় একজন নিরব শ্রোতা খুব প্রয়োজন হয়, যে শুধু কথাগুলো শুনবে, কোন পরামর্শ দেবে না, ভুল খুঁজবে না, কথার মাঝে নিজের গল্প নিয়ে বসে যাবে না, শুধু কথাগুলো শুনবে। দুই ভিন্ন বয়সী নারী মরিয়ম আর রুমির নিজেদের এই না বলা কথার সাথীই যেন। একে অপরের কাউকে বলতে না পারা কথাগুলো তারা ভাগ করে নেয় সহজেই।রুমি চেয়ার টেনে বসতেই রৌশন আপা এগিয়ে আসেন,

“রুমি নতুন ডিপার্টমেন্টে যাচ্ছ শুনলাম?”

“জ্বি আপা, ইনশাআল্লাহ।”

“ভালো ভালো। তোমাকে দেখে আসলে শেখার আছে অনেককিছু।”

“কী আপা?”

“এই তো তুমি কারও কথা গায়ে নাও না। ভারী শক্ত মন তোমার। আমরা অনেকেই পারি না, একটু কিছু হলে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যাই।”

“সেটা কী রকম আপা? আমি তো আলাদা কেউ না, খারাপ কথায় কষ্ট আমিও পাই।”

“তা তো পাবেই। কিন্তু না বলছিলাম যে, এই তো কে কী বললো সেগুলো পাত্তা দাও না। নিজের মতো চলো।”

“আপা, কখন থেকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলছেন। পরিষ্কার করে বলেন প্লিজ। কে আবার কী বলে? যা আমি পাত্তা দেই না?”

“না মানে এমনি বললাম। ঐ যে মিতু আছে না, কিসব বললো তোমাকে আর হাসান জামিলকে নিয়ে।”

রুমির মুখের ভেতর তিতা লাগে, একজন সিনিয়র মানুষ কিভাবে এমন অযথা মিথ্যা কথা বলতে পারেন! মিতু মেয়েটা ঠুস ঠাস কথা বলে ঠিক, একটু ঝগড়াটেও, কিন্তু কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টের হাসান জামিলকে নিয়ে মিতু নয়, রৌশন আপা নিজেই রুমিকে জড়িয়ে উল্টো পাল্টা কথা বলেছিলেন, আর রুমি নিজের কানেই তা শুনেছে। না শুনলে হয়তো রুমি মিতুকেই ভুল বুঝতো।

“আপা, শুধু হাসান জামিল ভাইকে নিয়েই বলেছে? হায়দার স্যারকে নিয়ে বলেনি? বলেনি আমি অযথা হায়দার স্যারের আশেপাশে ঘুরঘুর করি? আপা শোনেন, আমি সব শুনেছি ওয়াসরুমে কী বলেছেন আমার নামে। আমার কথা বাদ দেন, আমি তো না হয় বাজে মেয়ে। কিন্তু নিজের হ্যাসবেন্ডকে জড়িয়ে এসব কথা বলে আপনি ওনার সম্মানও রাখছেন না।”

হায়দার আলী স্যার, রৌশন আপার স্বামী, ওরাল এনাটমি ডিপার্টমেন্টের হেড। স্যারের কথা শুনে রৌশন আপার মুখটা হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে যায়। কঠিন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে যান তিনি।

একই কলেজে শিক্ষকতা করলেও, সবার চোখেই স্পষ্ট ধরা পড়ে যে হায়দার স্যার যেমন রৌশন আপাকে বিন্দুমাত্র পছন্দ করেন না, তেমনি রৌশন আপাও স্যারকে সামান্যতম বিশ্বাস করেন না। চাকরির চেয়ে স্যারের দিকে নজর রাখাই যেন আপার প্রধান কাজ, সিনিয়র মানুষ বলে ম্যানেজমেন্টও কিছু বলে না। তবে মাঝেমাঝে আপার কাজ কারবার হাস্যকর পর্যায়ে চলে যায়। কোন মেয়ে কলিগ স্যারের সাথে হেসে কথা বললে সর্বনাশ! মহিলা কোন পিয়ন, আয়া স্যারের রুমে চা নাস্তা নিয়ে যেতে পারে না। সবদিকে আপার সদা সতর্ক দৃষ্টি। আর আপার এই অতিরিক্ত সন্দেহ বাতিক মনোভাব স্যারের আপাকে দিন দিন অপছন্দের মানুষ করার অন্যতম কারণ। স্যারের আগে কোন নারী ঘটিত ঘটনা আছে কিনা রুমি জানা নেই, তবে কলেজে কখনো এমন কিছু চোখে পড়েনি, অথবা আপার সতর্ক চোখ এড়িয়ে স্যার কিছু করার সাহস এখন পান না।

একজন মধ্যবয়সী, দুই সন্তানের মা যে এমন অবসেসিভ হতে পারে, এটা রৌশন আপাকে না দেখলে বোঝাই যেত না। কর্মক্ষেত্রে নিজের সম্মান বাঁচাতে অনেক কিছুই হায়দার স্যার হজম করে যান, তবে মাঝেমাঝে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কয়েকমাস আগে ওরাল এনাটমি ডিপার্টমেন্টের এক মহিলা লেকচারার চাকরি ছাড়ে বলতে গেলে আপার সাথে সমস্যা হয়ে, সেসময় হায়দার স্যার এত রাগ করেছিলেন যে আলাদা থাকা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তিনদিনের ভেতর আপা সুইসাইড করার চেষ্টা করেন। একগাদা ঘুমের ঔষধ খান, তাও আবার কলেজে এসে স্যারের রুমে। এমন নাটকীয় অবস্থা সৃষ্টি হয় সেদিন। এরপর আবার ওনাদের একসাথে থাকা শুরু হয়েছে, স্যার আর আপার দুই ছেলেমেয়ে বাবাকে শাসিয়েছে মায়ের কিছু হলে ওরা মামলা করবে বাবার নামে। স্ত্রী হিসেবে স্যারের সাথে যত অশান্তিই হোক,মা হিসেবে ছেলেমেয়ের কাছে আপা অনন্য, সন্তানেরা তাই মাকেই সাপোর্ট করেছে।

একটা অযথা সন্দেহবাতিক মন যে সংসারকে কেমন বিষিয়ে তুলতে পারে, এই একটা সম্পর্ক দেখলে তার অনেকটুকু ধারণা পাওয়া যায়। তারপরও তাদের সংসার টিকে আছে, বা বলা যায় আপা টিকিয়ে রেখেছেন। ‘হয় মরবেন, না হয় সংসার করবেন, তারপরও ডিভোর্স দেবেন না’, এই কথা রৌশন আপা প্রায় বলেন। এদিক দিয়ে রৌশন আপাকেও কম দৃঢ় মনে হয় না। রুমি তো এভাবে কখনো ভাবেনি, আর তার জন্য বাসায় কত কী শুনতে হয়েছে, আম্মা আব্বা সহ সবাই বলেছেন এত অধৈর্য হলে হবে না, অন্য নারীর আঁচল থেকে স্বামীকে ছিনিয়ে আনতে না পারলে আর কিসের স্ত্রী!!

সবাই ভাবে রুমি শক্ত মনের। কিন্তু রুমির মনটা আসলে শক্ত না, বরং দুর্বল। তাই ভালোবাসার মানুষের এই প্রতারণা সে সইতে পারেনি, কোন ছিনিয়ে আনা আনির ভেতর যাওয়ার শক্তি বা ইচ্ছে কোনটাই ওর ছিল না। আপা যেমন সারাক্ষণ হায়দার স্যারের পেছনে আছে, রুমি ছিল তার উল্টো। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছে হিমেলকে। অতিরিক্ত সন্দেহবাতিক মন যদি ভয়াবহ হয়, তবে অন্ধবিশ্বাসও কম ভয়াবহ না। হিমেলের ছাত্রী জেনি প্রেগন্যান্ট হয়ে গিয়েছিল, অথচ রুমি টেরও পায়নি। সংসার বাচ্চা, পোস্ট গ্রাজুয়েশনের পড়া, এাব কিছুর ভেতর ওর একবারও মনে হয়নি হিমেলের দিকে নজর দেওয়া দরকার। হিমেলও হয়তো সব চেপে যেতে পারতো, যদি না এবোরেশন করাতে গিয়ে জেনি মরোমরো না হয়ে যেত। এশিয়া মেডিকেল কলেজের মেডিকেল অফিসার কাম লেকচারার হিমেল। জেনি সেই কলেজেরই সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো তখন। কলেজ ছুটির পর, একজন সিনিয়ার স্টাফ নার্সের সাহায্য নিয়ে কলেজের ওটি রুমে গোপনে এমআর করানোর চেষ্টা করে হিমেল। ভয়ে আতংকে বাচ্চা নষ্ট করতে জেনিও রাজি ছিল। কিন্তু প্রায় চারমাস বয়সী ভ্রূণ এমআর করা সহজ ছিল না, কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না, শকে চলে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল জেনির। না চাইলেও ইমার্জেন্সি সাপোর্টে নিতে বাধ্য হয় নার্স। হিমেল রাজি ছিল না, কিন্তু জেনি মারা যেতে পারে ভয় পেয়ে নার্স নিজেই উদ্যোগ নেয়। জেনি বেঁচে গিয়েছিল, তবে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে জরায়ু ফেলে দিয়েছিল ডাক্তার। বেঁচে থাকলেও আর কোনদিন মা হতে পারবে না জেনি। এরপর কলেজ ছেড়ে চলে যায় জেনি, কোথায় আছে কে জানে। চাকরি চলে গিয়েছে সেই সিনিয়র স্টাফ নার্সের। আর কিছুই হয়নি কার!!! হিমেলের।

এমনকি রুমিকেও সবাই পরামর্শ দিয়েছে যে স্বামীকে শোধরাবার, শুধরে সংসার করার। যেন এত বড়ো ঘটনার কারণ একটা বাচ্চা ছেলের মামুলি একটা ভুল, যাতে একটা মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেল, এত কেলেঙ্কারি হলো। রুমি যেন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, যে ব্যর্থ স্বামীকে শোধরাতে।

প্রায় নাটক সিনেমায় দেখায় যে ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্ত, চরিত্রহীন প্লে বয়, সংসার বিমুখ উচ্ছনে যাওয়া স্বাামীকে স্ত্রী ভালো করে ফেলে। সমাজে ব্যাপক হিট হয় এইসব কাহিনি। আরে এই না হলো স্ত্রী!!! অথচ বিয়ে কোন পুনর্বাসন কেন্দ্র নয়, কারো বিগড়ে যাওয়া সন্তানকে ঠিক করার কাজ তার স্ত্রীর নয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের বিপথে যাওয়ার দায় তার একান্ত নিজের, তাকে গড়ে তুলতে গিয়ে নিজে নিঃশেষ হওয়ার গল্পগুলো মহত করে দেখানো আর কত দিন চলবে জানে না রুমি।

“রৌশন আপার সাথে লাগা ঠিক হয়নি। আপা তিলকে তাল করতে উস্তাদ রুমি। কী সিনক্রিয়েট করবে ঠিক নেই।”

“মরিয়ম আপু, কী করবো ঐ সময় রাগ উঠে গিয়েছিল। থাক বাদ দেন যা হবে দেখা যাবে। আমি ক্লাসে গেলাম, টিউটোরিয়াল আছে আমার।”

“আচ্ছা, পরে কথা হবে।”

মরিয়ম ক্লাস টেস্টের খাতা গুলো দেখতে মন দেয়। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না আজ দুইদিন। কেমন বমিবমি ভাব, মাথাটা ভার হয়ে আছে। মরিয়ম মনে মনে যা সন্দেহ করছে, মুখে তা আনতে ভয় পায়। শাশুড়ি অভিমান ভুলে আবার বাড়িতে ফিরে এসেছে ঠিক, তবে একটা দূরত্ব নিয়ে চলছে। নতুন নাতি নাতনির মুখ না দেখা পর্যন্ত ওনার শান্তি নেই। তবে মরিয়মের শরীরের পরিবর্তন ওনারও নজর এড়ায়নি। আজ সকালে মরিয়ম যখন বমি করছিল, তখন ছেলে শাহেদের সাথে তিনিও উদ্বেগ দেখান। মরিয়মের যে অতিরিক্ত পরিশ্রম যাচ্ছে সেটা শাশুড়িও স্বীকার করেন। রুমনের পেছনে খাটাখাটুনির পর সংসারের কাজ, চাকরি সব সামলানো সহজ নয়। মরিয়মকে আজ অফিসে আসলেও নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু সামনে ছুটি আরও বেশি দরকার হবে ভেবে মরিয়ম অনেকটা জোর করেই আসে। নিজে নিশ্চিত হওয়ার আগে এখনো স্বামী বা শাশুড়ি কাউকেই কিছু বলেনি। রুমিকে বলবে ভেবেছিল, কিন্তু রুমি নিজেই এত চাপে আছে আজ, দেখে আর নতুন করে নিজের দুশ্চিন্তার কথা বলতে গেল না। আসলেই মরিয়ম বুঝতে পারছে না, ও কী খুশি হবে, না চিন্তা করবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here