যে শ্রাবণে এলে তুমি পর্ব:৪০

0
1849

#যে_শ্রাবণে_এলে_তুমি💕💕
#পর্ব_40
#লেখনিতে_মৌসুমী

বন্ধ ঘরের মধ্যে বসে আছে দুই নরনারী ঘর অন্ধকার করে।কেউ কোন কথা বলছেনা।মাথার উপরে শা শা করে ফ্যান চলছে।ফ্যানের বাতাসের সাথে সাথে দুই নরনারীর নিশ্বাসগুলো এক হয়ে মিশে যাচ্ছে।শুধু মিশে যেতে পারছেনা তারা দুজনেই একে অপরের সাথে।নিরাকে কোলে করে নিয়ে এসে খাটের ওপর বসিয়ে ফারদিন নিজেও বসে আছে ।দরজা,জানালা বন্ধ ,লাইটটাও নিভিয়ে দিয়েছে ।এদিকে নিরার মনের মধ্যে ভালোবাসার ঝড় বইছে,ভালোবাসার মানুষটিকে একটু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে,বন্ধ রুমে এমন একটা পরিবেশে—ছিঃ কি সব ভাবছি বলে লজ্জায় আরো আরষ্ঠ হয়ে বসলো নিরা,বসে থাকতে থাকতে নিরার মনে পড়লো ফারদিন তাকে তুলে এনে এভাবে ঘরে বন্দি করলো কেনো?কথাও বলছেনা । ফারদিন দুই পা ভাজ করে সন্ন্যাসীদের মত হয়ে বসে আছে।মনে মনে তার অভিমানের মস্ত বড় এক পাহাড়।অনেকবার ,অনেকবার নিরাকে নিজের করার চেষ্টা করেছে,ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে চেয়েছে।আদরের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি,প্রতিবার ই নিরার কাছ থেকে আঘাত নিয়ে ফিরে এসেছে।তাই সে আর যেচে পড়ে যাবেনা নিরার কাছে।তাইতো ঘরটা অন্ধকার করে রেখেছে যেনো নিরার মুখটা দেখা না যাই,নিরার মুখটা যদি এখন এক ঝলক দেখে তাহলেই তার সর্বনাশ,নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারবেনা,কারণ সে তো মানুষ,রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ,সেতো আর সন্ন্যাসী নয়।নিরার এখন খুব বিরক্ত লাগছে,একেতো আচমকা তুলে নিয়ে এসেছে ,তারপর এখন আবার ঢং ধরে চুপচাপ বসে আছে।কথাও বলছেনা আবার একটু কিছু…ধুর ভাল্লাগেনা।নিরা এবার নড়াচড়া করতে শুরু করলো যাতে ফারদিন কিছু একটা বলে কিন্তু না কিছুই বলছেনা।এখুনো চুপচাপ বসে আছে ব্যাটা ফারদিন।নিরাই কথা বললো আগে,
-এখানে আনলেন কেনো হঠাৎ?
-ভাইয়ার জন্য।
-মানে?
-ভাইয়া ভাবির সাথে রান্নাঘরে রোমান্স করবে তাই।
-কিহ বলেই নিরা অন্ধকারেই হেবলির মত তাকালো ফারদিন যেখানে বসে আছে সেদিকে।মনে মনে বললো,হায়রে কপাল,এক ভাই বৌকে কাছে পাওয়ার জন্য রান্নাঘর পর্যন্ত বাদ রাখছেনা আর আরেক ভাই ভাইকে রোমান্স করার সুযোগ দিয়ে এসে বৌকে নিয়ে অন্ধকার রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে।আচ্ছা এর কি মনে রোমান্স জাগছেনা।আগে যখন চাইতামনা তখন টানাটানি করতো আর এখন চাইছি তো এখন আর হাতটাও ধরছেনা,ধুর,,ধুর ভাল্লাগেনা।
-আমি বাইরে যাচ্ছি।
-নাহ,এখানেই থাকো।
-এখানে থেকে কি করবো?
মুখে না বলে ফারদিন মনে মনে বললো,
-আমাকে আদর করো।
-ওই ,কথা বলছেন না কেনো?
-কি বলবো?
-একটা ছড়া বলেন।
-কিহ,পাগল নাকি,আমাকে তোমার ছোট শিশু মনে হচ্ছে নাকি?
-তাছাড়া আর কি,বড় হলে তো এখন এই বন্ধ রুমে,অন্ধকারের মধ্যে,,,,
-অন্ধকারের মধ্যে কি?ফারদিনের মনে একটু আশার আলো দেখা দিলো,বৌকে কাছে পাবার।
-অন্ধকারের মধ্যে,,,,,
-বলো?
-অন্ধকারের মধ্যে কি করতেন জানিনা।
-ওহ,ফারদিনের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো,শালা বিয়ে করলাম ,বৌ আছে সব আছে তবুও সেই সন্ন্যাসী জিবন,ধুররর।
-কি বিরবির করছেন আপনি?
-কিছুনা।আচ্ছা থাকেন আমি গেলাম।দিনের বেলা এরকম দরজা লাগিয়ে ঘরে বসে থাকা ঠিক না।বাড়িতে আপনার ফুপুরাও আছে,তাড়া কি ভাববে ছিঃ।
খাট থেকে নামতে গিয়ে সামনে ফারদিনের সাথে ধাক্কা লাগলো,ফারদিন খাটের ধারেই বসে আছে।ধাক্কা লেগে ফারদিনের গাঁয়ের ওপরেই হুমড়ি খেয়ে পড়লো নিরা।সাথে সাথে ফারদিনের মনের মধ্যে দিয়ে এক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো,সে দুই হাতে নিরাকে আকড়ে নিলো নিজের বাহুতে।নিরার ঠোঁটটা গিয়ে ঠেকেছে ফারদিনের ঠোঁটের কাছে,দুজনেই অজানা পৃথিবীতে হারিয়ে যাচ্ছে,যাচ্ছে এমন সময় দরজায় ঠক,, ঠক,,মনে মনে ফারদিন বললো,
-যাহ শালা,এখন এই মুহূর্তে আবার কে,সকালে একবার সুযোগ পেয়েও পেলামনা,এখন আর একটু আর একটু হলেই ছক্কা মেরে দিতাম তার আগেই কে এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে।নিরা চোখ বন্ধ করে আছে।তার কানে এখুনো দরজার ঠকঠকানি যাইনি সে গভীর আবেশের অপেক্ষায় আছে ভালোবাসার মানুষটার ছোঁয়ার,গভীরতম ভালোবাসার।কিন্তু কি হলো ফারদিন তাকে দূরে সরিয়ে দিলো কেনো?চোখ খুলে দেখলো রুমে আলো জ্বলছে,সেই আলোয় হেঁটে হেঁটে ফারদিন দরজার কাছে যাচ্ছে।ধুর বাল আর খেলবোই না বলে নিরা রাগে উঠে দাঁড়ালো।দরজা খুলে দেখলো তুলতুল দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে,ফারদিনকে দেখতেই দুই হাত বাড়িয়ে দিলো তুলতুল কোলে উঠার জন্য।ফারদিনো আর দেরি না করে তুলতুলকে কোলে নিয়ে রুমে আসলো সাথে সাথে নিরা ঝড়ের বেগে রুম ত্যাগ করলো,সেই ঝড়ে ফারদিনের ভিতরটা লন্ডভন্ড হয়ে গেলো,সে দেখলো নিরা রেগে রুম থেকে বের হয়ে গেলো,তুলতুলের সাথে পর্যন্ত কথা বললোনা।ফারদিনের মনে মনে অবশ্য আনন্দ হচ্ছে।সে বুঝতে পেরেছে নিরা তাকে মেনে নিচ্ছে,হ্যাঁ হ্যাঁ মেনে নিচ্ছে নাহলে এমন রাগ দেখিয়ে রুম থেকে যেতো না।ইয়াহু,ফারদিন তুই জিতে গেছিস,তোর সন্ন্যাসী জিবন এবার শেষ হবে,আজ রাতেই হবে বুঝতে পারছিস,নিজের মনেই ফারদিন নিজে বকবক করছে আর মিটিমিটি হাসছে।কোলে বসে তুলতুল সেই হাসি দেখছে সাথে সেও হাসছে।




এক তরফা ভালোবাসার কোন মূল্য আছেকি ভাইয়া?তিন্নির দিকে অবাক হয়ে তাকালো তাসিফ তারপর বললো,
-মানে?
-মানে এক তরফা ভালোবাসার কোন মূল্য নেই।তুই নিরাকে ভূলে যা।
-কি বলছিস যা তা,আমি কেনো নিরাকে ভূলে যাবো?এ কথা বলছিস কেনো হঠাৎ করে?দেখ মেজাজ আমার নষ্ট করিস না।
-মেজাজ নষ্টের এখানে কিছু নেই,তুই এখন নিরাদের বাড়ি যাবিনা আর কোনদিন নিরার নাম ও তোর মুখে উচ্চারণ করবিনা।
-তিন্নি এক চড় দিবো বলে দিচ্ছি,আর একবার এ ধরণের কথা বললে,আমার সামনে থেকে যা,আমি এখন যাবো নিরার সাথে দেখা করতে।
-না ভাইয়া তুই যাবিনা।
-তোর কথার আমি কিছুই বুঝছিনা তিন্নি,তুই এরকমভাবে এসব কথা এখন বলছিস কেনো?
-তোর ভালোর জন্য,কারণ নিরা এখন তার বাড়ি নেই,
-মানে?কোথায় গেছে?
তিন্নির চোখ দুটো টলমল করছে,কি করে বলবে তার ভাইকে নিরার বিয়ের কথা,কতটা ভালোবাসে তার ভাই নিরাকে সেটা তারা বাড়ির সবাই জানে।তাসিফের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মাজেদা বেগম,তনিমা মাজেদা বেগমের সাথে দাঁড়িয়ে আছে।তাসিফ নিরব দৃষ্টিতে তিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-বল,কোথায় গেছে নিরা?
-ভাইয়া,আসলে,তোকে কিভাবে যে বলি কথাটা বুঝতে পারছিনা।
তাসিফের এবার মনের মধ্যে কি হতে লাগতো,মনটা অস্থির হয়ে গেলো নিরার কথা জানার জন্য,অস্থিরতা নিয়েই তিন্নিকে বললো,
-কি এমন কথা যে বলতে তোর এত সময় লাগছে,তাড়াতাড়ি বল কি হয়েছে?তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু ঘটেছে।
-ভাইয়া বল তুই কষ্ট পাবিনা,কোন ঝামেলা করবিনা বল?বলেই তিন্নি কাঁদতে শুরু করলো,
এবার তাসিফ অধৈর্য হয়ে গেলো,তার এতোক্ষণের চেপে রাখা রাগটা পা থেকে মাথার তালুতে উঠে গেলো।চিৎকার করে তিন্নিকে বললো,
-তুই বলবি?কি হয়েছে?
-ভাইয়া আসলে নিরার বিয়ে হয়ে গেছে।
ভাইয়া আসলে নিরার বিয়ে হয়ে গেছে,ভাইয়া আসলে নিরার বিয়ে হয়ে গেছে ,কথাটা তাসিফের মস্তিস্কে বার বার ঘুরতে শুরু করলো,মনে মনে বলছে,এ মুহূর্তে যে কথাটা সে শুনলো তা কি ঠিক শুনলো সে?নাকি ভূল?কাঁপাকাঁপা সড়ে আবার তিন্নিকে বললো,
-কি বললি আবার বল?
-নিরার বিয়ে হয়ে গেছে ভাইয়া।
তাসিফ কথাটা শুনে এবার মেঝেতে বসে পড়লো ,তারপর বিরবির করে বললো,
-নাহ ,বার বার ভূল শুনবো কেনো?ভূল শুনিনি,যা শুনছি ঠিক শুনছি।দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মাজেদা বেগম দু’চোখের অস্রু ঝড়াচ্ছেন।তনিমা মাজেদা বেগমকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে আর সেও কাঁদছে।তাসিফ ঠান্ডা গলায় বললো,
-নিরার বিয়ে হয়ে গেছে আমাকে তোরা জানাসনি কেনো আগে?
তিন্নি কান্নামিশ্রিত কন্ঠেই বললো,
-ভয়ে।আমরা ভেবে রেখেছিলাম তুই বাড়ি আসলেই তোকে জানাবো,তুই আসার পর থেকে অনেক চেষ্টা করেছি বলার কিন্তু পারছিলাম না।কিন্তু এখন না বললে তুই নিরাদের বাড়ি চলে যেতি তখন আরো সমস্যা হয়ে যেতো তাই এখনি জানাতে বাধ্য হলাম।
দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে নোনাজল গুলো তাসিফের ফর্সা গাল বেড়িয়ে পড়ছে।নাকের ডগাটা লাল টকটকে হয়ে গেছে।দুই কান লাল হয়ে আছে।মাজেদা বেগম আস্তে আস্তে হেঁটে এসে ছেলের পাশে বসলেন।দুই হাত দিয়ে তাসিফের মুখটা তুলে কপালে একটা চুমু দিলেন।তাসিফ মাজেদা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো তারপর মেয়েদের মত হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো,কাঁদছে মাজেদা বেগম ও,তনিমা আর তিন্নিও কেঁদে চলেছে অনবরত।
ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে না ফেলে কি যে কষ্ট তা একমাত্র যে পাইনি সেই জানে।এর থেকে কষ্ট কি দুনিয়ায় আর কিছু আছে?
কাঁদতে কাঁদতেই তাসিফ বললো,
-আম্মা ,ও আম্মা এখন আমি কি করবো,কি করে থাকবো আমি নিরাকে ছাড়া।আমিতো সেই কবে থেকে স্বপ্ন দেখে আসছি নিরাকে আমার জিবনসঙ্গি করার,এখন কি হবে আম্মা।আমি বাঁচবোনা আম্মা,
-না বাপ,এমন কথা বলিস না,আমি আছিনা? আমি সব ঠিক করে দিবো,তুই ওই কথা আর মুখে আনবিনা।আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো নারে বাপ।তুই আমার কলিজারে বাপ।তোর জন্য আমি লাল টকটকে বৌ নিয়ে আসবো,নিরাকে তুই ভূলে যা।
-না আম্মা না,আমি ভূলতে পারবোনা নিরাকে,ওকে আমি খুব ভালোবাসা আম্মা।
-আমি জানিতো বাপ,তাও তুই ভূলার চেষ্টা কর।সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন দেখিস।
-আম্মা ও আম্মা আমি কিভাবে থাকবো আম্মা।আমি নিরাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবো আম্মা?
-আমরা আছিনা?আমাদের জন্য তুই বাঁচবি।
চারটা মানুষ নিরবে কেঁদে যাচ্ছে অনবরত।ছেলে মানুষরা সহজে কাঁদে না বা কাঁদলেও সেটা কারো সামনে প্রকাশ করেনা তবে আঘাত যখন বুকের মাঝখানে লাগে তখন সেই ব্যাথাটা আর লুকাতে পারেনা,তখন মানুষ কি ভাববে আর কি ভাববেনা তা পরখ করে দেখেনা।তাসিফ নিরাকে মন থেকে এতোটাই ভালোবেসেছে যে নিরার বিয়ের খবরটা তার বুকে হঠাৎ করে খুব জোরেই অ্যাটাক করেছে যার যন্ত্রণায় সে এখন ছটফট করছে,নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে,নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছেনা।মেয়েরাই যে শুধু ভালোবাসতে জানে তা কিন্তু না পুরুষরাও ভালোবাসতে জানে,তাসিফ ও নিরাকে ভালোবেসে অনেক কিন্তু সেটা সে কখনোই নিরার কাছে প্রকাশ করেনি।সে চেয়েছিলো একদম বিয়ে করেই নিজের মনের ভালোবাসা দিয়ে ভড়িয়ে দিবে নিরাকে,কিন্তু তা আর হলো না।আসলে ভালোবাসার মানুষকে সবাই পায় না।আর এক তরফা ভালোবাসাটা খুব বোকামির ই একটা কাজ।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here