যে শ্রাবণে এলে তুমি শেষ পর্ব

0
3298

#যে_শ্রাবণে_এলে_তুমি💕💕
#পর্ব_42 (শেষ পর্ব)
#লেখনিতে_মৌসুমী

অন্ধকার ঘরের মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে তাসিফ।নিকোটিনের ধোঁয়ায় ভরে আছে সারাঘর।অদ্ভুত এক বাজে গন্ধে ভোরে আছে চারদিক।খাওয়া নেই,দাওয়া নেই ,আগের চেয়ে অনেকটাই শুকিয়ে গেছে ছেলেটা।চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।কারো সাথে ঠিক করে কথাও বলে না।নিজের মত করেই চলে।ছেলের এই অবস্থা দেখে মাজেদা বেগমের অবস্থাও কাহিল,ছেলের এই অবস্থা কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারছেননা।বাপহারা ছেলে তাসিফ,বাপের আদর ভালোবাসা খুব কম ই পেয়েছে সে কারণ অনেক আগেই তাসিফের বাবা এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন।তবে রেখে গেছেন অনেক সম্পদ।কোন কিছুর ই কমতি নেই তাদের।ছেলেটাকে নিয়ে এই অশান্তি তার আর ভালো লাগছেনা।তাসিফের বিয়ের কথাও চিন্তা করছেন কিন্তু বিয়ে কি করবে তাসিফ অন্য মেয়েকে?এই ভাবনায় তিনি আরো অস্থির হয়ে যাচ্ছেন।তনিমা চলে গেছে শ্বশুরবাড়ি,বাড়িটা এক সপ্তাহ ধরে কেমন গুমোট মেরে আছে।মাজেদা বেগম আর তিন্নি তাসিফের দরজার কাছেই বেশিরভাগ সময় বসে থাকে।ভয়ে তাদের মনটা সব সময় অস্থির হয়ে থাকে যদি কোন অঘটন ঘটায় তাসিফ।হায়রে ভালোবাসা।এই ভালোবাসার জন্য কেউ হাসছে,কেউ কাঁদছে ,কেউবা আবার পাগল হয়ে যাচ্ছে।সব এই ভালোবাসার জন্য ই।কবে যে সব ঠিক হবে সেটার ই অপেক্ষা এখন।
কাঁদো কাঁদো গলায় মাজেদা বেগম ডাকছেন তাসিফকে,
-আব্বা দরজা খুলো আব্বা।আমাদের সাথে কথা বলো,পেটে কিছু দানা পানি দাও সব ঠিক হয়ে যাবে।বের হৌ বাপ।
তাসিফের কোন সারাশব্দ নেই,সে নিশ্চুপ।সারাদিনে ইচ্ছে হলে খায় না হলে ঘরেই পড়ে থাকে সারাক্ষণ।মাজেদা বেগম আবার বললেন,
-এই বয়সে আমাকে এত কষ্ট দিসনা বাপ,আমি আর নিতে পারছিনা।তোর এই চুপ থাকা আমি মেনে নিতে পারছিনা।নিরা তোকে কোনদিন ভালোবাসেনি ,বাসলে সে তোর জন্য ই অপেক্ষায় থাকতো বিয়ে করে নিতো না।তোকে বুঝতে হবে আর তুই ও তো কখনো তাকে বলেছিলি না তোর মনের কথা তাহলে নিরা বুঝবে কি করে তোর মনের কথা বল,যা হয়ার তা হয়ে গেছে,তুই স্বাভাবিক হয়ে যা বাপ।আমি আর পারছিনা বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন মাজেদা বেগম।
মাজেদা বেগমের কাঁন্না তাসিফের সহ্য হচ্ছেনা সেও কাঁদছে নিরবে,সে স্বাভাবিক হতে চাচ্ছে কিন্তু পারছেনা,ফারদিনের সাথেই নিরা বিয়ে হয়েছে এটাতে আরো কষ্ট পাচ্ছে সে কারণ নিরা ফারদিনকেই ভালোবাসতো তাকে না,সে ভূল ভাবতো নিরাকে নিয়ে,মনে করতো নিরাও তাকে ফালোবাসে,ফারদিনকে না,তাইতো সেদিন সে ফারদিন নিরার থেকে দূরে সরিয়ে ছিলো,সে যদি জানতো নিরা তাকে না নিরা ভালোবাসে ফারদিনকেই তাহলে সে কখনোও ফারদিনকে ওসব বলতে যেতোনা,সাবধান ও করতোনা।তার খুব কষ্ট হচ্ছে।বুকের মধ্যে চিনচিন করছে।কেনো যে ভালোবাসতে গেছিলো নিরাকে।নিরাকেও ভূলতে পারছেনা এদিকে সে তার মা-বোনের কাঁন্নাও সহ্য করতে পারছেনা।হাতের সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে উঠে এসে দরজা খুললো তাসিফ,তার মা এখুনো কাঁদছে,সে পাশে বসলো।মাজেদা বেগম জড়িয়ে ধরলো ছেলেকে,কাঁদতে। কাঁদতেই বললো,সব ঠিক হয়ে যাবে,তোর কোন কষ্ট থাকবেনা।আমি তোর বিয়ে দিবো, সব ঠিক হয়ে যাবে।
-মা আমি এখন বিয়ে করবোনা,আগে নিজেকে একটু সামলাতে চাই।যখন মনে হবে নিজেকে সামলাতে পেরেছি তখন ই বিয়ের কথা ভেবে দেখবো।মা চলো কাল আমরা দূরে কোথাও বেড়াতে যাই।বাড়ির মধ্যে ভালোলাগছেনা।
-তাই হবে বাপ,তাই হবে,আমরা কালকেই কোথাও বেড়াতে যাবো,এই তিন্নি যা সব গোছাতে শুরু কর।


নিরার সংসার এখন জমে গেছে।নাইমারা চলে গেছে কিছুদিন আগে।এখন বাড়িতে ওরাই আছে।ফারদিন তো বাড়িতে থাকলে তার দুষ্টু ভালোবাসার অত্যাচারে নিরাকে জ্বালাতেই থাকে।নিরাও সেগুলো আনন্দের সাথে উপভোগ করে।সাথে নিরা এখন নিহার কাছে রান্নাও শিখছে,হাতে হাতে অনেক কাজ ও করে।আগের মত আর আলসেমি করে বসে থাকেনা।নিহাও এখন অনেক সময় পায়।তুলতুলকে সময় দেয়,আগে একা কাজ করার জন্য তা পারতোনা।ফজিলা বেগম তো খুব খুশি দুই ছেলের বৌকে নিয়ে।কারণ অন্য পরিবারে অনেক অশান্তি থাকে সেই বিষয়টি তাদের মধ্যে নেই।তারা ভালো আছে।তাসিফ যে দেশে এসেছে এ কথা নিরা বা কেউ ই জানেনা।তাসিফের ভেঙে পড়া নিয়েও কেউ অবগত নয়।কাউকে জানতেও দেয়নি মাজেদা বেগম।
কয়েকদিন ধরে ফারদিন নিরার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে তার ও তুলতুলের মত কাউকে চাই।নতুন সদস্য এই বাড়িতে আনতে চাই,এই নিয়ে নিরাকে পাগল করে দিচ্ছে।নিরা এ বিষয়ে কোন কথায় বলেনি,তার লজ্জা করে।ভিষণ লজ্জা করে।সে কখনোই মুখ ফুটে বলতে পারেনা যে সেও মা হতে চাই।তার কোল আলো করেও সন্তান আসুক।কারণ তার লজ্জা করে।তবে সে অপেক্ষায় আছে ফারদিনের সন্তানের মা হবার জন্য।
-কি ভাবছো জান?
ফারদিনের আচমকা কথায় চমকে তাকালো নিরা।ফারদিন এসে নিরার পাশে বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
-এই কি এমনে ভাবছিলে যে লজ্জায় তোমার মুখ এমন হয়ে আছে,মনে হচ্ছে লাল টমেটো।তুমি জানোনা এমন করে থাকলে তোমাকে আমার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে?বলো কি ভাবছো?
-ক..কই,কি..কিছুনা।
-এইতো ,এবার তোতলাচ্ছো,ওহ হো বুঝেছি আমার কথা ভাবছিলে তাইতো?তা কি ভাবছিলো গো?
-মোটেই না।আমি কেনো আপনার কথা ভাববো?
-এই দেখো তুমি এখুনো লজ্জা পাচ্ছো,এখুনো এতো লজ্জা পেলে চলে বলো,আমি তো লজ্জা ভাঙানোর সব ই করে ফেলেছি,আর কদিন পর আমার বাচ্চা তোমার পেটে থাকবে,পেট ফুলে ইয়া বড় হয়ে যাবে তারপর ও লজ্জা পাচ্ছো।
-আমি লজ্জা পাচ্ছিনা,আপনি যান।
-কোথায় যাবো?সারাদিন পর এখন আসছি আর তুমি যেতে বলছো?তুমি ভালো বৌ না।
কোথায় এখন আমাকে আদর করবে তা না।
-সবসময় খালি আদরের কথা মুখে আর কোন কথা নাই?
-না নাই,এসো তো কাছে।
-না,এখন আমি ঘুমাবো।
-কিসের ঘুম,ঘুমের গুষ্টি কিলায়।
-এত টানাটানি করলে আমি কবে ছিরেই যাবো মনে হয়,হাতগুলো আগে ছিড়বে।
-ছিড়বে ছিড়ুক,আমি সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিবো।বিরক্ত করো না,আর কোন কথা না,এখন আমি আমার বৌকে দেখবো,সারাদিন দেখিনি।
-আচ্ছা দেখেন,আমি ঘুমায়।
-না না হবে না।আজ রাতেই আমি বাপ হয়ার ব্যবস্থা করবো।
-করেন,আমি ততক্ষণ ঘুমাই।এই কামড় দিচ্ছেন কেনো?লাগনা বুঝি।
-আচ্ছা আদর করে দিচ্ছি ,
-লাগবেনা আদর।
-আমার তো লাগবে বলে নিরার চোখের দিকে কামনা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ফারদিন।নিরাও তার চোখদুটো ফেরাতে পারছেনা।ফারদিন বললো,তুমি আমার ডায়েরি পড়েছো তাই না।ফারদিনের আচমকা এই কথাতে নিরা হকচকিয়ে গেলো।
ফারদিন বললো,যেদিন তুমি আমার ডাকে সাড়া দিলে,সেদিন ই আমার সন্দেহ হয়েছিলো যে, তুমি ডায়েরিটা পড়েছো আর তাইতো আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছো,আমিই সেই যাকে তুমি সত্যিই ভালোবাসো তাইতো?
-হু,কিন্তু আপনি বলেছিলেননা কেনো বলেনতো যে আপনিই সেই?জানেন আমি কত কষ্ট পেয়েছিলাম।আর তাইতো আপনাকে মেনে নিচ্ছিলাম না।যদি জানতাম আপনিই সেই তাহলে,,
-তাহলে কি,সাথে সাথেই আমার ইজ্জত হরণ করতে?
-যাহ দুষ্টু।
-সত্য কথা বললে আমিই দুষ্টু।তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে তাসিফকে তুমি ভালোবাসনা?
-বাসিতো,ভাইয়ের মত।
-বুঝেছি।তবে তাসিফ ও তোমাকে খুব ভালোবাসা,আমি ওর চোখে তোমার জন্য অনেক ভালোবাসা দেখেছিলাম।
-হয়তো,তবে আমি আপনাকেই ভালোবাসি বলেই লজ্জায় মুখ লুকালো নিরা ফারদিনের বুকে।
-নিরা?
-হুম
-আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি।
-জানিতো।
-প্রথম দিনের মত ই।জানো তুমি আমাকে সেই যে পাগল করলে সেই রোগ আমার আজ ও সারলোনা,সারাজিবনেও সাড়বেনা।তুমি হচ্ছো আমার নেশা।
ফারদিনে বুকে চুমু খেলো নিরা।ফারদিনো নিরার মুখটা তুলে সারামুখে চুমুতে চুমুতে ভড়িয়ে দিলো তারপর দুজনে ভেসে গেলো দুজনের ভালোবাসায়।

ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো ফারদিনের।ঘুম ঘুম চোখেই নিরার মুখটা তুলে চুমু এঁকে দিলো নিরার কপালে তারপর কোলে করে নিয়ে গেলো বাথরুমে।পানির চোখে মুখে সারা শরীরে পড়তেই নিরার ঘুম ভেঙে গেলো,ঘুম ভেঙে দেখলো সে ওয়াশরুমে ফারদিনের কলে,তাকে নিয়ে ফারদিন ভিজছে আর দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
-এসব কি,নিজে ভিজবেন ভালো কথা আমাকে নিয়ে কেনো?
-তো শাওয়ার কি আপনি নিবেননা ম্যাডাম,আজান হয়ে গেছে,নামাজ পড়তে হবে যে।
-আমাকে আগে ডাকতেন,আমি একা একা গোসল করতাম।
-উহু,আমার সাথেই গোসল করতে হবে তোমাকে।
-ধুর ভাল্লাগেনা,সব জায়গায় আমার ইজ্জতের দফারফা হয়ে যাচ্ছে।
-হে হে,,,
-হাসবেন না।সব দেখে ফেললো আমার।
-আমিই তো দেখবো ,দেখবো কি দেখেছিইতো,সব কিছু।
-মারবো,চুপ করেন।
-আচ্ছা।
এভাবেই দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসায় নিরা আর ফারদিনের সুখের সংসার আলোকিত হতে থাকলো।পরিবারের সবাই একসাথে মিলেমিশে জিবন অতিবাহিত করতে থাকলো।তাদের দেখে পাড়াপ্রতিবেশিরাও গর্ব করে এটাই হলো একটি পরিবার,সুখী পরিবার।জামান সাহেব তো ফজিলা বেগমকে বলেন,
– দেখেছো ফজিলা আমার মত ই আমার দুই ছেলেও কেমন বৌ পাগলা হয়েছে।
ফজিলা বেগম শুধু ঠোঁট টিপে হাসে।মনে মনে গর্বে ভরে থাকে তার মন তার পরিবার নিয়ে।
দুই বছর পর,শ্রাবণের শেষ সপ্তাহে বৃষ্টিমুখর বিকেলে বসে আছে ফারদিন আর নিরা ,নিরার কোলে তাদের সন্তান ,তাদের আদরের মেয়ে আয়রা।টুক টুক করে নিরা আর ফারদিনের দিকে তাকাচ্ছে আয়রা।ঠোঁটে হাসি নিয়ে বসে আছে।ফারদিন নিরা আর আয়রাকে জড়িয়ে বসে থেকে বৃষ্টি দেখছে আর প্রথম যেদিন নিরাকে দেখেছিলো সেই দিনটা আওড়াচ্ছে মনে মনে।

আপনাদের সকলের ভালোবাসা আর উৎসাহে গল্পটা শেষ করেই ফেললাম।জানি তেমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারিনি গল্পটা তবুও আমনারা আমার পাশে থেকেছেন।গল্পটাকে ভালোবেসেছেন এজন্য আমার তরফ থেকে আপনাদের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা।সবাই ভালো থাকবেন আর আমার জন্য দোয়া করবেন।তবে আমি নতুন আরেকটি গল্প নিয়ে আবার আসবো আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে ইন শা আল্লাহ।নতুন গল্পটা আজ কালের মধ্যেই দিতে পারি।ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here