রিস্টার্ট পার্ট-৫

0
5444

#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_৫

নাদিয়া বাস স্ট্যান্ড এর ছাউনিতে বসে কোথায় যাবে চিন্তা করছে। ইন্টারনেট ব্রাউজ করে দেখল সিলেট যাওয়া ভালো হবে। কিন্তু এখন তো প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নেক্সট বাসটা রাত বারোটায়। এতক্ষণ ও কোথায় থাকবে? এমনিতেই মানুষ যেভাবে দেখছ। কাল সকালে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আজ রাতটা কোথায় থাকা যায়? হোটেলেই যাবে? এর মধ্যেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। জানিনা কেন, নাদিয়া জাহিদকেই কল করল। জাহিদ আসবে বলেছে। কিন্তু আজ ও জাহিদের বাসায় শুধুই একজন অতিথি। তাই ও জাহিদ আসার আগে ওর বাসায় যাবে না। একটা রিকশা নিয়ে জাহিদের বাসার কাছে একটা জায়গায় গেল। যা ভেজার ভিজে গেছে। জাহিদ ওর কাছে ছাতা নিয়ে এলো। ওরা গাড়িতে করে এই একটু পথের জন্য অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল। দাড়োয়ান ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। মেম সাহেবের তবে রাগ ভেঙেছে।

ভেতরে ঢোকার পর জাহিদ তোয়ালে নিয়ে এলো। নাদিয়া চুল মুছতে মুছতে বলল,

– আমার জরুরী কথা আছে আপনার সাথে।
– পরে বলবেন, আগে কাপড় বদলে নিন।
– না, এখনই শুনুন। আমি এখানে একেবারের জন্য আসিনি। আমি অতিথি হয়ে এসেছি। কাল সকালেই চলে যাব।
– জ্বী!

জাহিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। যেন ওর মনে হচ্ছিল ও একেবারের জন্য এসেছে। যদিও ও জানে এমনটা সম্ভব না।

– জ্বী। আজকের রাতটা শুধু।
– কোথায় যাচ্ছেন?
– সিলেট।
– ও।

জাহিদের খুব জানার ইচ্ছে ছিল কেন যাচ্ছে ও সিলেট। কিন্তু ও অধিকারহীনতায় ভুগছে। উচিত হবে কিনা জানে না। ও আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে চলে আসছে। নাদিয়ার খুব রাগ হচ্ছে। ওর তো জিজ্ঞেস করা উচিত ও কেন যাচ্ছে। ও এক বার ও জিজ্ঞেস করল না। তারপর জাহিদ কোনো সাত পাঁচ না ভেবে নাদিয়ার দিকে ফিরে বলল,

– কেন যাচ্ছেন সিলেট? আপনি কিছু মনে না করলে জানতে পারি?
– ঘুরতে, মানে অনেকদিন থাকব। কমপক্ষে আমাদের ডিভোর্স পর্যন্ত।
– এতদিন!
– জ্বী। আসলে আমার বাড়ির পরিবেশ টা কেমন টক্সিক হয়ে গেছে। এরচেয়ে ভালো একটু প্রকৃতি দেখব। শুধু সিলেট না। আরো অনেক জায়গায় যাব। বাংলাদেশ টা ঘুরে দেখব। আপনার কোনো সমস্যা নেই তো?
– না, নেই। কেন থাকবে?
– আমি তাহলে আজ গেস্টরুমে থাকবো। আপনি আমাদের মানে আপনার ঘরে থাকুন।

নাদিয়া ওর চুল শুকাতে শুকাতে ভেতরে গেল। ভাবছে কেনই বা জিজ্ঞেস করল ওর সমস্যা হবে কিনা। ওর তো সুবিধা এটা আগেরই কথা। জাহিদ ওর যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে রইল। ওকে পেছন থেকে দেখল। ওর ভেতরটায় কেমন শূন্য শূন্য হয়ে গেছে। খাবার অর্ডার করে শাওয়ার নিতে গেল জাহিদ। শাওয়ার শেষে খাবার রিসিভ করল। টেবিলে নাদিয়া ও আছে। নাদিয়া ও গোসল করে এসেছে। ওর দু চারটা হাঁচি শুনে জাহিদ ওকে ঔষধ খেতে বলল। কিন্তু ও খেল না। ওর কাছে এইটা বেশি কিছু না। এরপর ওরা একসাথে খাবার খেল। পুরোটা সময় ও নাদিয়ার দিকে তাকায়নি। কারণ বারবার ওর কলিজা ছিড়ে যাচ্ছিল। এটাই ওদের একসাথে শেষ ডিনার। ভালোই হয়েছে, নাদিয়া ওখানেই খুশি হবে। এখানে কোনো সুখ নেই। এরপর নাদিয়া ঘুমাতে গেল। ওর সকালে বাস। জাহিদ জেগে আছে। এই হয়তো ওদের একসাথে শেষ রাত। বসার ঘরে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল জাহিদ। রাত তিনটার দিকে ওর হঠাৎ ঘুম ভাঙল। নাদিয়া পানি খেতে এসেছিল। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল অনেক ক্লান্ত ও। ওর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। পানির জগটাও ধরতে পারছে না। জাহিদ দৌঁড়ে গিয়ে ওকে ধরে বসাল। ওর শরীরটা অস্বাভাবিক গরম। ওর কপালে হাত দিয়ে দেখল ওর অনেক জ্বর।

– কেমন লাগছে? আপনার তো অনেক জ্বর!
– আমার, আমার খুব ঠান্ডা লাগছে।

জাহিদ দেখল নাদিয়ার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। ও জাহিদ কে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে। জাহিদ সাথে সাথে ওকে কোলে করে ওদের ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিল। এরপর কাঁথা চাপিয়ে ওর জন্য জলপট্টির ব্যবস্থা করল। নাদিয়ার জ্বর ধীরে ধীরে বাড়ছে। বৃষ্টিতে ভেজার জন্যই এমনটা হয়েছে। জ্বরের ঘোরে নাদিয়া আবোল তাবোল বলতে লাগল। বিভিন্ন জনের নাম নিয়ে বিভিন্ন কথা। যেমন,

” বাবা!”
“মা!”
“রাহু!”
“অর্ষা!”
“প্রিয়ম!!!”

এই নামটি শোনার পর জাহিদ একটু থেমে গেল। না, ও এই নামটা বলেনি। জাহিদ ভুল শুনেছে। এমনিতেও সব অস্পষ্ট। ওর জ্বর তো কমছেই না। ওর মাথায় পানি ঢালতে হবে। জাহিদ বালতি ভরে পানি আনল। বালিশের ওপর প্লাস্টিক বিছিয়ে নাদিয়ার মাথা রাখল। আজ নাদিয়াকে বহন করতে করতে ওর ব্যায়াম হয়ে গেছে। আস্তে করে ওর চুল বিছিয়ে দিয়ে ওর মাথায় হাত রাখল জাহিদ। এরপর আস্তে আস্তে পানি ঢালছে। ভোর চারটা। আজান হবে একটু পর। ওর নামাজ পড়ার কথা। নাদিয়ার মাথা মুছে তারপর যেতে হবে। আরেকটু পানি ঢালতে হবে। নাদিয়া এখনো উল্টো পাল্টা বলছে।

“বাবা, আ’ম স্যরি!”
“জাহিদ, আপনি পাষাণ!”
নাদিয়ার মুখে এতক্ষণে নিজের নাম শুনতে পেয়ে হালকা হাসি ফুটল জাহিদের মুখে। নাদিয়ার চুলে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে পানি দিচ্ছে জাহিদ। ওর কপালটা একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। জাহিদ ওর ভেজা ঠান্ডা হাত দিয়ে নাদিয়ার গাল স্পর্শ করে। অজান্তেই পানির মগটা বালতিতেই রেখে দেয়। এরপর নাদিয়ার কপালের কাছে এসে ওকে দেখতে থাকে। ওনারা স্বামী স্ত্রী, তবুও ওনাকে কখনো এত কাছ থেকে দেখেননি উনি। হঠাৎ করে নাদিয়া ওর চোখ খুলে ফেলে। জাহিদ তারপর ও ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ কেন যেন ভয় লাগছে না। ওর দিকে আধখোলা চোখে নাদিয়া বলে,

” প্রিয়ম! তুই এসেছিস? আমাকে নিয়ে যাবি তোর কাছে? আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল না। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তুই ছাড়া কেউ আমার আপন না। আমাকে নিয়ে যাবি প্রিয়ম! আমার এখানে কিছুই ভালো লাগছে না।”

জাহিদ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। নাদিয়া আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ওর কথা গুলো একদম স্পষ্ট না হলেও বুঝতে পারছিল জাহিদ। ও প্রিয়মকেই ডাকছে। ও আজ ও ভুলতে পারেনি প্রিয়মকে। প্রিয়ম ওর জীবনে ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা ও প্রিয়মের জন্য ছিল। প্রিয়ম আর প্রিয়মের অরনী, দুজনেই ভাগ্যবান। আবার দুর্ভাগাও বটে। জাহিদ যেন অন্য কোনো এক দুনিয়ায় ছিল, ফজরের আজান ওর কানে ঢুকতেই এই দুনিয়াতে ফিরে আসে সে। ও আস্তে আস্তে নাদিয়ার চুল মুছে সব ঠিক করে নামাজ পড়তে যায়।

সকাল আটটার দিকে জাহিদ ওর অফিসে ফোন করে জানিয়ে দেয় আজকে আসতে পারবে না। ফ্যামিলি প্রবলেম। নাদিয়া এখনো ঘুম। ওর সিলেটের বাস কবে চলে গেছে। জাহিদের হালকা আনন্দ হচ্ছে। কারণ ও আজ সিলেট যাচ্ছে না। তবে সত্যি এটাই, সিলেটের গাড়ি একটা না। ও চাইলেই সিলেট যেতে পারবে।

বিকেলের দিকে হালকা সুস্থ হয়ে নাদিয়া বুঝতে পারে ওর সিলেটের বাস এতক্ষণে চলে গেছে। ওকে উঠতে দেখে জাহিদ ওর ঘরে আসে।

– আপনি এখন কেমন আছেন?
– মোটামুটি। এখন কী বিকাল?
– জ্বী। আপনি কী এখন কিছু খাবেন?
– না। ভালো লাগছে না।
– একটু ডাবের পানি খান।
– বমি আসছে।
– অল্প একটু। আপনি অনেক দুর্বল।

এদিকে ওর ফোন ও বন্ধ। আফরা একের পর এক ট্রাই করেই যাচ্ছে। ওর কোনো খোঁজ নেই। ওকে সত্যি বের করে দিয়েছে এরপর ও কোথায় গেল? নাদিয়ার বাবা মায়ের প্রেসার ও হাই হয়ে গেছে। ও যে জাহিদের বাসায় ই গেছে তাও তো ওনারা জানেন না। জাহিদ ও ফোন ধরছে না, নাদিয়ার ফোন ও বন্ধ। আফরা পরদিন সকালে স্কুলে গিয়ে দেখল নাদিয়া আজ ও আসেনি। ও করিডোরে এসে কনফারেনসে হাফসা খালামণি আর রাহুকে আনলো।
– খালামণি, ও আজ ও আসেনি।
– কী বলছ! কেন আসেনি? রাহু, এবার পুলিশে খবর দে।

রাহু ওর হাসপাতালের ছাঁদে,
– কী বলব? ওকে তো বের করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ উল্টো আমাদের হয়রানি করবে।
– কিন্তু রাহু ভাই, অরনীর কোনো খোঁজ না পাওয়ার থেকে তো ভালো। যুবতী মেয়ে। কত বাজে লোক রাস্তায়। আমার ওকে এভাবে না করে দেওয়া উচিত হয় নি। (কাঁদো কাঁদো গলায়)
– আফরা, আপনি কাঁদবেন না।

খালামণি রেগে গিয়ে বলল,
– ছিচকাঁদুনে! ওর সংসার যে ভেঙে যেত! আমরা মনে হয় ইচ্ছে করে বের করে দিয়েছি।
– ইচ্ছে করেই দিয়েছেন। আপনারা আরেকটু খোঁজ নিতে পারতেন। ও প্রায় রোজ রাতেই কাঁদে। বলে না, তবুও ওর চোখ ফুলে থাকে।
– জাহিদ কী ওকে মারে নাকি! ও ভদ্র ছেলে। এত ভাগ্য করে পেয়েছে। নইলে সারাজীবন আইবুড়ো থাকতো। কতজন তো মার খেয়েও সংসার বাঁচায়। ও তো তাও চুপচাপ।
– মারলেই শুধু দোষ? ও তো একটা রোবট! এরকম একটা রোবট স্বামী অবশ্যই অরনী চায়নি।
– এত প্রেমিক পুরুষ কোত্থেকে পাব আফরা! নিজে প্রেম করেছ, পালিয়ে গিয়েছ, বান্ধবী কে একটা ধরে এনে দিতে পার নি!
– অরনী কী এমন নাকি! ও প্রেম ভালোবাসা এত পছন্দ করে না।
– তাহলে আবার জাহিদে কেন সমস্যা? জাহিদ ও তো তোমাদের মতো রোমান্টিক না। আচ্ছা করে বল তো কী চায় তোমার অরনী?

রাহু ওদের থামিয়ে দিল,
– আপনারা থামুন! আমি জাহিদ ভাইকে আরেকটা কল দিচ্ছি, আর না পেলে ওনার বাসায় যাব। ওখানেও না পেলে থানায় যাব। আপনারা চিন্তা করবেন না।

ফোনটা রেখে রাহু জাহিদকে আরেকটা কল দেয়। জাহিদ ওর কল পেয়ে ভাবছে এটা কার নাম্বার। কাল থেকে পনের বার কল করেছে। অচেনা তাই রিসিভ করেনি। ওর ফোন হারানোর পর কারো নাম্বার ই সেভ নেই।

– হ্যালো, কে?
– আমি রাহিয়ান, মানে রাহু। এতক্ষণে ধরলেন তবে।
– জ্বী! আপনি ছিলেন!
– হ্যাঁ। আসলে কী করে যে বলব, নাদিয়া কোথায়?
– হ্যাঁ!
– মানে, ও বাসায় নেই।
– ও বাসায় নেই!
– আসলে বাবা মা ওকে বের করে দিয়েছে। আর ওর সব বন্ধুদের বারণ করেছে জায়গা না দিতে। এখন ও কোথায় আমরা জানি না। আমরা আইডিয়া করছি ও কিছু না পেয়ে আপনার বাসায় ই যাবে। ও কী আপনার কাছে গেছে? মানে ও আর কোথাও নেই। আপনিও ফোন ধরছেন না, ওর ও ফোন বন্ধ।
– উনি আমার বাসায়।
– আলহামদুলিল্লাহ!

রাহু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। কিন্তু জাহিদ ভাবতে লাগলো নাদিয়ার কথা। ওনাকে তবে বের করে দিয়েছে। কত কষ্ট পেয়ে উনি আমার কাছে আসলেন। এত চাপ সৃষ্টির কী দরকার ছিল?
– আপনি এ খবর আগে দেননি কেন?
– আমি তো জানি না ওনাকে বের করে দিয়েছেন। আমি ভেবেছি উনি জানিয়েই এসেছেন।
– তাহলে সব ঠিকঠাক আপনাদের মাঝে। এইবার তো বাড়ি আসলেন আর গেলেন। আগামী শুক্রবার আসুন নাদিয়া কে নিয়ে, জামাই আদর বাকি এখনো।

জাহিদ ভাবছে বলবে কি বলবে না। ওর গলা আটকে আসছে। তবুও বলল,
– আর হয়তো আসা হবে না।
– মানে?
– মানে, উনি চলে যাবেন।
– কী?
– আসলে, চলে যেতেন। ওনার এখন জ্বর। বৃষ্টিতে ভিজেছেন তাই। যেদিন সন্ধ্যায় এসেছিলেন, সেদিনই বলেছিলেন।
– কোথায় ?
– উনি সিলেট যাবেন। শুধু রাতটা থাকবেন। সকালে চলে যাবেন। এরপর রাতেই ভীষণ জ্বর আসল।
– এখন কেমন আছে?
– মোটামুটি।
– ও বৃষ্টিতে ভিজলে গরম পানিতে গোসল করতে হয়। নইলে জ্বর হয়। ও কী ঠান্ডা পানি দিয়ে করেছিল?
– বোধহয়। আমাদের একটাই গ্রীজার। উনি ওটা তে যাননি।
– এখন আপনি কোথায়?
– অফিসে।
– সঙ্গে কে ওর?
– রাহেলা খালা।
– তো সিলেট কেন যাবে?
– ঘুরতে।
– কয়দিন থাকবে?
– ডিভোর্স পর্যন্ত। পুরো বাংলাদেশ ঘুরে দেখবেন। ডিভোর্স ফাইনালাইজ হলেই ঢাকা আসবেন।
– এটা কেমন কথা! দেখুন, আপনি ওকে যেতে দেবেন না। আটকে রাখুন। প্লিজ!
– আমি বলেছি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত থাকতে।
– এরপর? এরপর চলে যাবে! আপনি কী চান ও চলে যাক!
– না!
– আমার মনে হচ্ছে আপনি চান ও চলে যাক। আপনার নিশ্চয়ই কোনো গোপন প্রেমিকা আছে।
– আশ্চর্য! এসব মিথ্যে কথা!
– ও যদি চলে যায় আমি শিওর থাকব আপনার অন্য কোনো সম্পর্ক আছে। এটা আপনার নিজেকে প্রমাণ করার পালা।

রাহু ফোনটা কেটে দিল। ও এখন সবাইকে হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে এই খবরটা দেবে। আর জরুরি মিটিং ও ডাকবে আজ লাঞ্চ টাইমে। এদিকে জাহিদ ভাবছে এই ভাইবোন গুলো এত উইয়ার্ড কেন? এই মিষ্টি করে কথা বলে আর এই রেগে যায়।

এদিকে জাহিদ রাহেলা খালা কে আগে থেকেই ডেকে এনেছে। ও তাড়াতাড়িই চলে আসবে। রাহেলা খালা ঘর ঝাড়ু দিতে দিতে বলল,
– তো খালা, চইলা আসছেন।
– হুম।
– বিয়ার পর আমনে এক লগে এতদিন ই বাপের বাড়ি আছিলেন।
– হুম।
– আমি ভাবসিলাম আমনে পোয়াতি।
– কী!!!
– বাচ্চা হইব আরকি।
– বুঝতে পেরেছি।

নাদিয়া একটু বিব্রত। ওনার কাছ থেকে আর কী বা আশা করা যায়।
– আমি মামারে জিগাইসি, কোনো সুখবর কিনা।
– হাহাহাহাহাহাহ! উনি কী বললেন?
– আমনের নাম্বার চাইল। ওনার ফোন নাকি হারাইয়া গেসে। নাম্বার সেভ নাই কারো।

এক মুহূর্তে নাদিয়ার হাসি গায়েব হয়ে গেল। এখন ওর চোখে স্থির রাগের ছাপ। তো সত্যিই ওনার কাছে ওর নাম্বার নেই। আবার এই ফোন হারানোর বাহানা। মিথ্যুক!

– বাপের বাড়িতে অনেকে অনেক যত্নআত্তি হইসে না?
– হুম।
নাদিয়া মনে মনে ভাবছে কীসের যত্ন। বের করে দেওয়ার।

– একমাত্র মাইয়া না আমনে?
– জ্বী।
– ভাইবোন আর নাই?
– দুই ভাই।
– আমিও একমাত্র মাইয়া আছিলাম। বাপের চক্ষের মণি। বিয়া দিসিল, খালি কাম করতাম শ্বশুর বাড়িত। বাপের বাড়ি যাইতে দিত না। চারটা পোলা মাইয়া হইলো। হেরপরে পোলার বাপে একদিন বিয়া করল।
– তারপর?
– নতুন বউয়ের লগে ডং আমি দেখতে পারি নাই। পোলা মাইয়া লইয়া বাপের বাড়ি আসি।
– পরে?
– বাপের বাড়ি তো আর বাপের বাড়ি নাই। অহন ভাইগো বাড়ি। বাপই হেগো আশ্রয়ে। কিছুদিন যাইতেই খেদায়া দিসে।
– মানে?
– বাইর কইরা দিসে। পোলা মাইয়াসহ। অনেক কথা হুনাইসে। তরে বিয়া দিসি, স্বামীর ঘর করবি। স্বামী মাইরা ফেলাইলেও করবি। মাটি তর স্বামীর বাড়ি হইব। মাইয়া মানুষ, লাল শাড়ি পইড়া স্বামীর বাড়ি গেসস, কাফন পরা বাইর হবি।

নাদিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর নিজের কথা মনে পড়ছে। একই জিনিসটা তো ওর সাথে ও হয়েছে। নিম্নবিত্ত বা উচ্চবিত্ত, সবখানেই মেয়েদের এক অবস্থা। বাবার ঝুপড়ি থাক বা দালান, ওটা বিয়ের পর আর নিজের বাড়ি থাকে না।

– আপনাগো তো ভালা। বাপ মা শিক্ষিত বড়লোক। স্বামী কিছু কইতেই পারে না। স্বামী বাইর কইরা দিলেও যাওয়ার একখান জায়গা আছে। নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন।
– আপনি এরপর কী করলেন?
– ঢাকা আসছি। দুই বাড়ির কাম নিসি। আস্তে আস্তে আরো কয়েক বাড়ি। পোলা গোরে পড়াইসি, মাইয়া বিয়া দিসি। আমার পোলারা এখন ভালা চাকরি করে। কয়, মা তুমি আর বাড়ি বাড়ি কাম কইরো না।
– তাও আপনি কাজ করেন?
– ক্যান করুম না? যতক্ষণ আমি কাম করমু ততক্ষণ আমার দাম। এরপর তো আমি বোঝা। আমার মাইয়ারা বাপের বাড়ি বেড়াইব না? আমি চাই না আমার মাইয়ারা যখন নিঃশ্বাস ফেলাইতে আইবো, ভাই ভাবি গো ঝাড়ি খাক। শান্তি মতো থাকুক। যতদিন আমি বাইচা আছি ততদিনে অন্তত।
– এখন কয় বাসা আছেন?
– যা দিয়া শুরু করসি। দুইডা। যেখানে সম্মান দেয়, কাজের চাপ একটু কম, হেগুলা করি।

কথা বলতে বলতেই অনেক বেলা হয়ে গেল। লাঞ্চ শেষে জাহিদ চলে আসলো অফিস থেকে। রাহেলা খালা জাহিদ কে পানি দিয়ে বললেন,

– মাইনসে অসুখ হইলে বাপের বাড়ি যায়। খালা দেখি বাপের বাড়ি থেইকা আইসা অসুখে পড়সে।

জাহিদ কিছু বলে না। সৌজন্য রক্ষার্থে মুচকি হাসলো। কিন্তু নাদিয়ার দিকে চোখ পড়তেই দেখল ওর মুড খারাপ। ও রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে। নিশ্চয়ই সিলেট না যেতে পেরে মন খারাপ। নাদিয়া রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন কনটেইনারের সাথে রাখা একটা বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছে। বাক্সের সাথে প্যাকেট ও আছে। ওর মাথায় শুধু এগুলো বাঁজছে।
” কলিকাতা হারবাল ” ” পুরুষের শক্তি বর্ধক ” “এক ফাইলই যথেষ্ট ” “পুরুষের যৌ…”

নাদিয়া হাত দিয়ে কান বন্ধ করে ফেলল। এরপর প্যাকেট টা খুলে দেখল। সেখান থেকে বের হলো বিভিন্ন রকমের ক*ডম। ও এতদিন বাসায় ছিল না। তাই জাহিদ এইসব ফালতু জিনিস কিনে এনেছে। ওর মাথায় চলছে কী? আর এই ক*ডম গুলো! ও যাওয়ার পরপর ই এ সব জিনিস। তারমানে বাসায় আরো মেয়ে আসে। আর ও! ছি ছি! জাহিদ যেমনই হোক, দুশ্চরিত্র হবে তা ভাবে নি। কোনো গার্লফ্রেন্ড ও হতে পারে। কিন্তু বললেই তো পারে। এত সাধু কেন সাজে? জাহিদ রান্নাঘরে এসে পানি খাচ্ছে। পানি তো আগেই খেয়েছে, কিন্তু নাদিয়ার কী হয়েছে তাই দেখতে এসেছে। অত্যন্ত বিরক্তির সাথে নাদিয়া ওর ফ্রিজের রেডিও অন করে দিয়ে খাবার টেবিলে বসলো। জাহিদ ভয়ে ভয়ে সামনের দিকে হাঁটছে। রাহেলা খালা এতক্ষণে চলে গেছেন। রেডিও তে গান বাঁজছে। জাহিদ ফ্রেশ হতে গিয়েছে।

“Just gonna stand there and watch me burn?
Well, that’s alright, because I like the way it hurts
Just gonna stand there and hear me cry?
Well, that’s alright, because I love the way you lie
I love the way you lie.”

গান শেষ হতে হতে জাহিদ ফিরে এসেছে। নাদিয়া এখনো বসে আছে একই জায়গায়। রেডিও আরজে কথা বলছে,

” কেন আমরা কোনো অচেনা মানুষকে বিশ্বাস করি? কেন তাদের চেনা হয়ে উঠি? কেন তারা মিথ্যা বলে? কেনই বা তারা আমাদের বিশ্বাস ভেঙে দেয়। দিন শেষে আমরা কী পাই? বিশ্বাসঘাতকতা? এই বিশ্বাসঘাতকতা থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি। সেই শিক্ষা কোথায় কাজে লাগে? সবসময় আমরা বোকার মতো বিশ্বাসই করে যাই। আজকের শো আমি সেই কাপুরুষ বিশ্বাসঘাতকদের উৎসর্গ করছি না। আজ আমি উৎসর্গ করছি সে সকল মানুষদের যারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন। আপনারা দাঁড়ান, উঠুন, প্রশ্ন করুন, কেন? জবাবদিহি তাদের করা উচিত। আজ পুরোটা সময় আমি আরজে ঐশী , বলব আপনাদের কথা গানে গানে।”

নাদিয়া উঠে দাঁড়ালো। রেডিওর ভলিউম নামিয়ে রান্না ঘর থেকে সেই জিনিস গুলো আনলো। জাহিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এগুলো তো ফেলে দিয়েছিলাম। আর এই প্যাকেট টা কোত্থেকে আসলো?

– ক্যান আই আস্ক ইউ সামথিং?
– না, মানে হা!!!
– এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? বেশি কিছু না, শুধু জিজ্ঞেস করবো এগুলো কেন?
– এগুলো আমার ভা,

জাহিদ ভাবছে ওকে কী বলবে এগুলো ওর ভাইয়ারা দিয়েছে। আর এই প্যাকেটটা তো ও খুলেই নি। এটা কখন দিলো? কী একটা লজ্জার বিষয়।

– সৎ সাহস থাকলে আমার সাথে সবকিছু শেয়ার করতে পারেন। আশা করি কাপুরুষের মতো মিথ্যে বলবেন না।
– আসলে, ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।
– ও আচ্ছা! ঠিক বোঝাবুঝি করুন।
– আ, আ, আসলে সেদিন আমাদের কথা,
– মেয়েটা কে?
– মেয়েটা! কোন মেয়ে?
– জাহিদ, আমি আপনাকে অনেক ভালো মনে করতাম। সত্যি। যদি কোনো গার্লফ্রেন্ড থেকে থাকে বলতে পারেন। এভাবে, এসব, কেন?
– গার্লফ্রেন্ড? গার্লফ্রেন্ড কেন? বারবার গার্লফ্রেন্ড!
– ডোন্ট টেল মি দ্যাটস আ কলগার্ল!!! আপনি! ছিইইই!!!! আমি ভাবতেও পারি না! আমি ছিলাম না, তাই বলে কলগার্ল!
– আশ্চর্য রকমের ফালতু ভাবনা তো আপনার! আপনার কী আমাকে থার্ড ক্লাস সে*ক্স অ্যাডিক্ট মনে হয়?

নাদিয়া ঐ বাক্স আর প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখায়।
– এসব কী? এই ক*ডম না হয় ভালো জিনিস, এইটা? এইটা কী? কলিকাতা হারবাল! এসব বিজ্ঞাপন আমি বাস স্টেশনে, ওভারব্রিজে দেখি। এসব বিজ্ঞাপন রাত বারোটার পর চলে। এগুলো নিশ্চয় আপনার না। এটাই তো বলবেন। আর এগুলো আমার অবর্তমানে এই বাসায় ছিলো। নিশ্চয়ই এগুলো আপনি আমার জন্য আনেননি। আমি ছাড়া অন্য কেউ আছে। আমি যাওয়ার পরই এগুলো এনেছেন, মানে আমি যাওয়ার পর কেউ এসেছে।
– না! কেউ আসেনি। এগুলো আমি আনিনি।
– আর কতো লজ্জা দেবেন আমাকে? বাই দ্য ওয়ে, এমনিতেই তো সব শেষ। চলে যাব, আর ভেজাল করে কী। আপনি আপনার রাস্তায়, আমি আমার রাস্তায়। যার সাথে ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা থাকুন! একা বাসা, একা লোক, কেউ কিছু বলবে না।

নাদিয়া আবার বসে পড়ল। রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিল।

” না জানি কোন অপরাধে,
দিলা এমন জীবন
আমারে পুড়াইতে তোমার,
এতো আয়োজন
আমারে ডুবাইতে তোমার,
এতো আয়োজন।”

” বিশ্বাসঘাতক মিথ্যেবাদী লোকেরা আমাদের পোড়ায়, মাঝ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয় ডুবে যাওয়ার জন্য। আমাদের কোনো অপরাধ থাকে না। তারা বিশ্বাস না ভেঙে স্বাভাবিক ভাবেও তো বলতে পারত। হয়তো পথ থেকে সরে যেতেন, কিন্তু তখন যে তারা মন ভাঙার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন। আরজে ঐশী তাদের ধিক্কার জানায়, জাহন্নামেও জা…”

জাহিদ রেডিওটা বন্ধ করে দিল। এই আরজে ঐশী কী ফালতু কথা বলে। সিচুয়েশন তো দেখা উচিত। শুধু বলেই যাচ্ছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here