শঙ্খচিল পর্বঃ-৪১

0
1399

#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya

পর্ব-৪১

রাত একটা বাজে, চারিদিক থেকে শোঁ শোঁ বাতাস বইছে। জানালার পর্দা গুলোর, ফাঁকে ফাঁকে ঠান্ডা আবহাওয়া রুমে প্রবেশ করছে। অনেক ক্ষন আগেই সবাই রিসিপশন থেকে বাড়ি ফিরেছে, সবার সাথে বসে গল্প করতে করতে অনেক টাই দেরি হয়ে হয়ে গেছে, ক্লান্ত ভংগিমায় মানহা আয়নার সামনে বসে আছে৷ ধীরে ধীরে গায়ের গয়না গুলো খুলছে। ক্লান্তিতে মানহার চোখ দুটো বুজে আসছে তবুও সে নিজেকে গয়না এবং ভাড়ী পোশাকের আস্তরণ থেকে মুক্ত হতে চাইছে।
মানহা অনেক্ষন যাবৎ গলার হার খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না, মানহা বিরক্ত হয়ে বসে রইলো।

হঠাৎ কারো স্পর্শে মানহা চমকে উঠলো, ওয়াহাবে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া তার উষ্ম গায়ে লাগতেই মানহা, মৃদু কেঁপে উঠলো। মানহার কান্ডে ওয়াহাব স্মিথ হাসলো, মানহার চুল গুলো সরিয়ে মানহার গলা থেকে নেকলেসের হুক খুলে দিলো।
মানহা আয়নায় ওয়াবের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে, ওয়াহাব মানহার কাধের সব গুলো চুল সরিয়ে দিলো। মানহা মৃদুস্বরে বললো,
” কি করছেন? ”

ওয়াহাব মানহার দিকে তাকিয়ে বললো, ” কিছু না। দেখছি। ”

মানহা আয়না থেকে চোখ সরিয়ে ওয়াহাবের দিকে ঘুরে বললো, ” কি দেখছেন? ”

” আপনার গলার ডান পাশের তিল টা খুব সুন্দর। ”

মানহার চমকে গিয়ে বললো, ” কিহ৷ ”

ওয়াহাব মানহার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপুনি মেরে বললো, ” হুম৷”

মানহা রেগে বললো,” লুইচ্চা লোক একটা, চোখ এমন কেনো? ”

ওয়াহাব মুচকি হেসে বললো, ” কেমন? ”

” মেয়ে মানুষের দিকে চোখ কেনো হু?”

ওয়াহাব এক হাত দিয়ে মানহার কোমর জরিয়ে ধরে বললো, ” পর নারীর দিকে তাকাইনি তো, বিয়ে করা বউয়ের দিকে তাকিয়েছি। ”

মানহা বিড় বিড় করে বললো, উহ! পর নারীর দিকে তাকালে চোখ কাটা চামুচ দিয়ে উপড়ে ফেলবো। হুহ!
ওয়াহাব মুচকি হেসে বললো, ” কি বললেন?”

” কিছু না। আমাকে ছাড়ুন আমি মেক-আপ ধুবো।”

” ধোয়াই উঁচিত আপনার মেক আপ চেহারায় লেপ্টে গেছে, চোখ দেখে তো কাঞ্চনা রিটার্ন মুভির ভুতের মতো লাগছে। ”

মানহা রাগে ফুসে উঠলো ” কিহ! তাই না? দেখাচ্ছি মজা। ” বলেই মানহা ওয়াহাবের সাদা টিশার্টে ঠোঁট, গাল, কপাল মুছতে শুরু করলো, ওয়াহাব হেসেই চলেছে মানহা ক্লান্ত হয়ে ওয়াহাবের বুকে মাথা রাখলো। অতঃপর বললো,
” আমাকে কাঞ্চনা মুভির ভুত ফলার, রিভেঞ্জ নিলাম।” বলেই মানহা ওয়াহাবের দিকে তাকালো।

ওয়াহাব মানহা কে আগের মতোই জরিয়ে ধরে আছে, কথায় কথায় মানহা খেয়াল ও করে নি, ওয়াহাব মুচকি হেসে বললো,
” টিশার্টে মেক-আপ লেগেছে, অসুবিধা নেই, কিন্তু তার বদলে আপনাকে তো বাহু ডোরে পেয়েছি। ”

মানহা এতোক্ষণে খেয়াল করলো ওয়াহাব তাকে জড়িয়ে ধরে আছে, এবং সে নিজেও ওয়াহাবের বাহু ডোরে আবদ্ধ হয়ে, ওয়াহাবের সাথে মিশে আছে।
মানহা ভ্রু কুচকিয়ে বললো, ” ছাড়ুন বলছি। ”

” আমি ধরলাম কখন আপনি তো আমার বুকে চেহারা ঘষে মেক আপ উঠালেন। ”

” উফফ আমি আমাকে ছাড়তে বলেছি৷ হাত সরান। ”

ওয়াহাব শীশ বাজিয়ে বললো, ” পাড়লে নিজেকে ছাড়ান। আর নাহলে এভাবেই লেপ্টে থাকুন। ”

মানহা শত মুচড়া মুচড়ি করেও ওয়াহাবের বাহু ডোর থেকে বের হতে পারলো না। ওয়াহাব আগের মতোই তাকে আবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে, ওয়াহাব মানহার কান্ড দেখে মনে মনে হাসছে। মানহা ক্লান্ত হয়ে বললো,
” আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, ঘুম পাচ্ছে প্লিজ ছারুন না। ”

” ওকে বাট নেক্সট টাইম কিন্তু ছাড়বো না। ”

” আচ্ছা। ” ওয়াহাব মানহা কে ছেড়ে দিলো। মানহা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মানহা লেহেঙ্গার সেইফটি পিন খুলতে খুলতে বললো,

” একটু বাইরে যান৷ আমি চেঞ্জ করবো। ”

ওয়াহাব পকেটে হাত ঢুকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো, মানহা ওয়াহাবের পিছু পিছু গিয়ে, টাস করে দরজা আটকে দিলো। ওয়াহাব থত মত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আজকেও মেয়েটা তাকে কাঁয়দা করে বের করে দিলো।
মানহা দরজার ওপাশ থেকে বললো, ” কেমন লাগলো ডাক্তার বাবু? ” বলেই হো হো করে হেসে দিলো।

ওয়াহাব কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না, বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। মানহা খিল খিল করে হেসে বললো,
” আপনি সেয়ানা হলে আমি ষোলো আনা, নাম আমার মানহা। বুঝেছেন ? ভেবে চিন্তে আমার সাথে লাগতে আসবেন।”

ওপাশ থেকে ওয়াহাব বললো, ” মনে রাখবেন মিস মানহা, এক মাঘে শীত যায় না। আমারো একদিন দিন আসবে। ”

” সেই দিনের আসায় আপনি থাকুন। আমি গেলাম ঘুমাতে।” বলেই মানহা দরজার কাছ থেকে সরে গেলো। ওয়াহাব ভ্যাবলা কান্তের মতোই দাড়িয়ে রইলো।

—————————————————

বাইরে থেকে বাতাস তানিয়ার ঘরে প্রবেশ করছে। তানিয়া জানালার গ্রীল ধরে বাইরে বাতাস অনুভব করছে৷ চোখ বুজতেই রাতে ঘটে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার চোখের সামনে নার বার ভেসে বেড়াচ্ছে।
গাড়িতে তানিয়ার ঘুম ভাংতেই তানিয়া নিজেকে শাহেদের কাধে মাথা রাখা অবস্থায় পায়, শুধু তাই নয়, শাহেদ তার হাত পর্যন্ত ধরে রেখেছিলো। কোন কিছু না জেনেই তানিয়া শাহেদ কে এতো কথা শুনিয়ে দিয়েছে।

ঘুমন্ত অবস্থায় গাড়ির ঝাকুনি খেয়ে মানহা পড়ে যেতেও পারতো ব্যাথাও হয়তো পেতো, শাহেদ যা করেছে তাকে এক্সিডেন্ট থেকে সেইভ করা জন্যই করেছে আর সে কিনা এতো গুলো মানুষের সামনে তাকে এতো কথা শুনিয়েছে,এক প্রকার ইনসাল্ট করেছে ভাবতেই তানিয়ার ভীষণ গিলটি ফিল হচ্ছে।

শিহাব অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে, তানিয়া শিহাবের মাথায় হাত বুলিয়ে। চাঁদর গায়ে জরিয়ে নিলো, বৈশাখ মাসের মতো গরমেও তার শরীর ভীষণ উষ্ম লাগছে। তানিয়া পা টিপে টপে শিহাবের রুমে প্রবেশ করলো, শাহেদের থাকার ব্যাবস্থা শিহাবের রুমেই করা হয়েছে। তানিয়া দেখতে পেলো, শাহেদ হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। শিহাবের ছোট খাটে, শাহেদের পা দুটো বেরিয়ে গেছে। তানিয়া শাহেদের পাশে বসলো। ঘুমন্ত শাহেদের দিকে তাকিয়ে বললো,

” আই এম সো সরি শাহেদ। রাগের বসে তোমাকে কথা গুলো বলে ফেলেছিলাম। ” তানিয়া শাহেদের মাথায় হাত রাখলো, শাহেদ হঠাৎ তানিয়ার হাত মুঠোয় করে বিড় বিড় করে বললো,
” আজকেও তুমি সপ্নে এসেছো? একটু ভালো করে কেনো কথা বলো না, বলো তো? তোমাকে যে..”

” আমি তানিয়া শাহেদ৷”

শাহেদ চোখ মেলে তাকালো, ফিক করে হেসে বললো, ” আজ কাল দেখি সপ্নের ভেতরও তোমাকে দেখি। আজকে মনে হয় পেগ বেশি হয়ে গেছে। ”

তানিয়া ভ্রু কুচকিয়ে বললো, ” তুমি মদ খেয়েছো?”

শাহেদ ঢুলতে ঢুলতে বললো, ” একটু খেয়েছি৷ এই একটু? ”

” ডিজগাস্টিং। এই জন্যই পুরুষ মানুষে কে সুযোগ দিতে নেই। লাইফ টাকে জাস্ট হেল করে দিলো”

শাহেদ হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে বললো, ” তুমি বিরক্ত হচ্ছো কেনো, আমাকে কেনো ভালোবাসো না। একটু ভালো বাসলে কি হয়? ”
বলেই তানিয়ার কোলে শুয়ে পড়লো৷ তানিয়া চেয়েও নড়তে পারলো না। শাহাদ তার হাতটা চেপে তার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। তানিয়া জোরে শ্বাস ফেলে ঘুমন্ত শাহেদের দিকে তাকিয়ে রইলো, তানিয়ার গাল বেয়ে নোনা পানি গুলো শাহেদের কপালে টুপ টুপ করে পড়লো।

মানহা বিছানার এপাশ ওপাশ করছে, নতুন জায়গায় এলেই তার চোখের ঘুম কর্পুরের ন্যায় হাওয়া হয়া হয়ে যায়।
গত রাতের মতোই, ওয়াহাব কি করছে তা ভীষণ জানতে ইচ্ছা করছে মানহার।
ড্রিম লাইটের আধো আলোয় মানহা ওয়াহাবের ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো, হঠাৎ রাজ্যের ঘুম তার চোখে প্রবেশ করলো।

সকাল আটটা বাজে, ওয়াহাব অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে তার রুমের বাইরে পায়চারি করছে, ভাগ্যিস গত কাল ইলহামের রুম টা ফাঁকা ছিলো তাই ওয়াহাব ইলহামের রুমে আরামসে ঘুমোতে পেরেছে, যদিও সিগারেটের গন্ধ তার বিরক্ত লাগছিলো, তবে নাই মামা থেকে কানা মামা ভালো, এই ভেবে ওয়াহাব ঘুমিয়ে পড়েছিলো৷

ওয়াহাব ব্যায়াম করার চেষ্টা করছে যাতে কেউ কিছু না বুঝতে পারে৷
মানহা কখন ঘুম থেকে উঠে, তা ভাবতেই ইলহাম দুঃশ্চিতায় পড়ে গেলো। আজকে থেকে তার হাস্পালের ডিউটি শুরু।
ওয়াহাব সাত- পাঁচ না ভেবে দরজায় মৃদু কড়া নাড়ালো, হঠাৎ দরজা খুলে গেলো।

আকাশীরঙের শাড়ি পড়ে, ভেজা চুল গুলো মানহা তোয়ালে দিয়ে মুছছে, চেহারায় এখনো ফোটা ফোটা পানি লেপ্টে আছে, মানহা শাড়িটা একটু ঠিক করে বললো,
” আপনি?”

” হ্যাঁ । আমাকে হাস্পাতালে যেতে হবে তাই রেডি হতে এসেছি। ”

“ও আচ্ছা। আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। ” বলেই মানহা চলে গেলো।

কুসুম বেগম রান্না ঘরে সবজি কাটছেন, সহকারী মহিলা চুলোয় বসানো কড়াইয়ে খুনতি নাড়ছেন। মানহা শ্বাশুড়ি মাকে সালাম দিয়ে বললো,
” আমি হ্যাল্প করবো মা?”

” তুমি রুটি বেলতে পারো?”

মানহা মাথা দুলিয়ে বললো, ” হ্যাঁ পারি। ”

” তাহলে তুমি রুটি বেলো দেখি গোল হয় কি না। ”
মানহা এক পাশে দাঁড়িয়ে রুটি বেলতে শুরু করলো। খানিক সময় পর পর কুসুম বেগম আড় দৃষ্টিতে রুটি বানানো দেখছে।

সবাই নাস্তার টেবিলে বসে আছে, তানিয়া শিহাবের টিফিন পেক করছে। শাহেদ সোফায় বসে শ্বশুর বাবার সাথে গল্প করছে। এবং আড় দৃষ্টিতে তানিয়াকে দেখছে..
ওয়াহাব টেবিলে এসে বসতেই মানহা প্লেটে নাস্তা দেওয়া শুরু করলো, কুসুম বেগম বসতে বসতে বললেন,
” তোর বিয়ের জন্যই ঢাকায় আসা, তোর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ। তাই ভাবছি আজকে কালকের মধ্যেই খুলনায় ফিরে যাবো। ”

ওয়াহাব নাস্তা মুখে দিয়ে বললো,….


চলবে
কেমন হয়েছে জানাবেন সবাই ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here