শঙ্খচিল পর্ব-১৭

0
1864

#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya

পর্ব-১৭

” কার জন্য পাত্রী দেখতে গিয়েছিলেন? ”

ওয়াহাব শার্টের কলার টা ঠিক করে বললো, ” আমার জন্য। ”

মানহা মুখ ফসকে বলে ফেললো, ” কিহহহ৷ ”

ওয়াহাব মানহার এক্সপ্রেশন দেখে থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলো। মানহা দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে রইলো। মনে মনে ওয়াহাব হাসলো, তবে প্রকাশ করলো না।
কথা বলার শব্দ পেয়ে শেহতাজ বেগম বাসায়ার রুমে উঁকি দিলেন। ওয়াহাবে কে দেখে বেশ অবাক হলেন। বসার রুমে যেতেই ওয়াহাব দাদীকে সালাম দিলো। মানহার ধ্যান ভাংলো দাদীর কথায়, দাদী ডাঃ ওয়াহাব কে দেখে ক্ষানিকটা অবাক হয়ে বললো,
” ডাক্তার সাহেব আপনি এখানে?”

ওয়াহাব স্মিথ হেসে বললো,” মিস মানহা আমার ভাগনের টিচার। এই দিক দিয়েই আসছিলাম, তাই… ”

দাদী বললেন ” ও আচ্ছা। ”

” দাদী আপনি আমাকে শুধু ওয়াহাব এবং তুমি করে বলবেন প্লিজ। ”

দাদী হেসে বললো, ” আচ্ছা বললো। ” বলেই মানহার দিকে তাকিয়ে বললো, ” তুই মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ”

মানহা আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। শেহতাজ বেগম বললেন, ” ওয়াহাবের জন্য কিছু নাস্তা নিয়ে আয়। ”

মানহা মাথা দুলিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো। চুলায় পানি বসিয়ে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে রইলো, ওয়াহাব মেয়ে দেখতে এসেছে তাতে তার নিজের এতো খারাপ লাগছে কেনো কেনো? চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসছে, আশ্চর্য! মানহার চুপ করে ঘাপটি মেরে এক কোনায় বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে এই পাজি ডাক্তার টাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। তার এই উলটো পালটা ইচ্ছা করছে কেনো? সে কি ওয়াহাব কে ভালোবেসে ফেলেছে…

” তোমার বিয়ে হয়েছে? ” ওয়াহাব একবার শেহতাজ বেগমের দিকে তাকালেন। স্মিথ হেসে বললো,
” জ্বি না। ”

” মেয়ে দেখতে এসেছিলে নাকি শুনলাম?”

” জ্বি না। সত্যি বলতে আমার ভাগ্নে শিহাব শুনেছে মানহা অসুস্থ তাই এসেছি৷ ”

শেহতাজ বেগম অবাক হয়ে বললেন,” তাহলে মেয়ে দেখার ব্যপারটা মিথ্যা?”

” জ্বি৷ ”

শেহতাজ বেগম চুপ করে রইলেন। একবার রান্না ঘরের দিকে আড় দৃষ্টিতে তাকালেন। মানহা এখনো রান্না ঘরে, চা তৈরি করতে তো এতো সময় লাগে না এই মেয়েটা এতো টাইম নিচ্ছে কেনো?
শেহতাজ বেগম উঠে রান্না ঘরের দিকে গেলেন। গ্যাসের চুলায় গরম পানি শুকিয়ে গেছে সে দিকে মানহার কোন খেয়াল নেই।
সে এক ধ্যানে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে গড় গড়িয়ে পানি পড়ছে। শেহতাজ বেগম এসব কিছু পর্যবেক্ষণ করে হঠাৎ কাঁশি দিয়ে উঠলেন।
মানহা হঠাৎ দাদীর কাঁশির শব্দ পেয়ে তাড়াহুড়ো করে গরম চায়ের পাতিলায় হাত লেগে গেলো। মানহা মৃদু চিতকার দিয়ে উঠলো।

দাদী মানহার হাত ধরে বললেন, ” কি যে করিস। এতো তাড়ার কি আছে। ”

মানহা অস্ফুট গলায় বললো, ” ভুলে লেগে গেছে দাদী। ”

বসার রুমে একা ওয়াহাব বসে আছে শিহাব ভিডিও গেইম খেলতে ব্যাস্ত। ওয়াহাব সারা ঘর একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো। রান্না ঘর থেকে শব্দ আসছে, মানহা হাত ধরে বেরিয়ে এলো, হাতটার অনেক অংশ লাল হয়ে গেছে।
মানহা ওয়াহাব কে দেখে কান্না মুছার ব্যার্থ চেষ্টা করলো। নাহ তার চোখের পানি থামছেই না৷ বাধ-হীন শ্রোতের মতো পড়েই চলেছে। শেহতাজ বেগম বলল্বন, ” তাড়া হুড়ো করতে গিয়ে মেয়েটা হাত পুরিয়ে ফেললো। ”
ওয়াহাব মানহার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো, ” বার্ন মলম।বা স্প্রে থাকলে দ্রুত নিয়ে আসুন। প্রাথমিক চিকিৎসা করলে ঠিক হয়ে যাবে। ”
শেহতাজ বেগম দ্রুত মলম আনতে গেলেন ভেতরের রুমে।
ওয়াহাব মানহার উদ্দ্যেশ্যে বললো,
” খুব জ্বালা করছে? ”

মানহা অশ্রু শিক্ত নয়নে বললো, ” হাতের থেকে মনে জ্বালা করছে বেশি।”

ওহায়াব থত মত খেয়ে তাকিয়ে রইলো। যেনো তাকে মানহা ইনডাইরেক্টলি কিছু বলতে চাইছে। শেহতাজ বেগম ওয়াহাবের হার মলম টা ধরিয়ে দিলেন ওয়াহাব দ্রুত মলম টা মানহার হাতে আলতো করে লাগিয়ে দিলো, মানহা স্তব্ধতা দেখে ওয়াহাব বললো,
” জ্বালা করছে? ”

মানহা ফিস ফিস করে বললো,
” হু। হাতের জ্বালাতো কমালেন। মানের জ্বালাকি কমাতে পারবেন? ”

ওয়াহাব দ্বিতীয় দফায় থতমত খেয়ে তাকয়ে রইলো। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না সে। মলম লাগানো শেষ করে বললো,
” দাদী আজ আসি। ”

” তোমাকে চা খাওয়ানো ও হলো না।”

ওয়াহাব ভদ্রতার হাসি হেসে বললো, ” অন্য একদিন না হয়…..” বলেই উঠে দাঁড়ালো। মানহার দিকে তাকিয়ে বললো , ” সাবধানে থাকবেন মিস মানহা। ” মানহা তাকিয়ে রইলো কোন উত্তর দিলো না।

শিহাব বললো, ” মিস তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও। ”
মানহা ফিনিক হাসলো শিহাবের কথা শুনে। ওয়াহাব বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

—————————————————

মানহার জ্বর সারতে তিন দিন সময় লাগলো, হাত টা বেশ ক্ষানিক পুরে যাওয়ার কারনে মানহার জ্বর ছারলো দেরিতে৷ তিন দিন ওয়াহাব মানহার কোন খোঁজ নেয় নি, মানহা যে এক্সপেক্ট করেছিলো এমন টাও না।
তিন দিন মানহা নিজেকে সময় দিয়েছে, নিজের সাথে মনের যুদ্ধে লড়াই করেছে, মনের যুদ্ধে জিতেছে নাকি হেরেচল গেছে তার নিজেরই অজানা।

বিকাল চার টা বাজে, মানহা হাত ঘড়িটা পড়ে, সাইড ব্যাগ হাতে নিলো। বসার রুম পার হতেই হঠাৎ শেহতাজ বেগম বললেন, ” কোথায় যাচ্ছিস?”

” ধানমন্ডি যাচ্ছি দাদী।”

” ওই যে ওয়াহাব বলে ছেলেটার বাসায়?”

মানহা একটু চুপ করে বললো, ” হ্যাঁ দাদী। ”

” ঠিক আছে। সাবধানে যেও৷ ”

” আচ্ছা। ” বলেই মানহা জুতো পড়ে বেরিয়ে এলো। জ্বলন্ত বিকেল, চৈত্র মাসের রোদ্দুরে চারিদিক খাঁ খাঁ করছে। রাস্তার এক পাশে মানহা দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায়। ওয়াহাবের কথা গুলো মানহার কানে বাজছে, সবকিছু যেনো তার চোখের সামনে ভাস্যমান হয়ে আছে,

” ধানমণ্ডি, পান্থপথ… আপা কই যাইবেন। ”

হঠাৎ বসের কন্ট্রাক্টরের ডাকে মানহার ধ্যান ফিরলো। মানহা এক নজর তাকিয়ে বললো,,
” ধানমন্ডি বারোতে যাবো৷ ” মানহা বাসে উঠে পড়লো।
পথচারীরা নিজেদের গন্তব্য ব্যাস্ত ঠিক তখনি বাসের গতিতে সব কিছু পেছনে মিলিয়ে যাচ্ছে। মানহা সে দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, বাতাসে চোখ দুটো বুজে আসছে, মানহা শুকনো ঢোক গিলে বসে রইলো। রাজ্যের ঘুম যেনো চোখে আড়ষ্ট হয়ে আসছে, বিরক্তিতে চুল গুলো ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

গাড়ি থেমে গেছে লোক সমাগমের শব্দে মানহার চোখ মেলে তাকালো৷ বাইরে বিলবোর্ডে এক বার তাকিয়ে দেখলো ধানমন্ডি চৌদ্দতে গাড়ি থেমেছে, অথচ তার গন্তব্য ধানমন্ডি বারোতে৷ মানহা ঠিক এই ভয় টাই পাচ্ছিলো৷ বাসে সচারাচর মানহার ঘুম পায় না, ভোতা মাথা যন্ত্রণার কারনেই হয়তো ঘুম পেয়ে গেছিলো তার। মানহা বাস থেকে নেমে হাটা শুরু করলো। রাস্তায় সারি সারি গাড়ি জ্যাম আটকে আছে, মানহা ফুটপাত ধরে এগিয়ে চলে গেলো। মিনিট পঁনেরো হাটার পর মানহা ‘ কুসুমতি’ ভিলায় পৌছালো।

কলিং বেল বাজাতেই শিহাবের মা তানিয়া এসে দরজা খুলে দিলো। তানিয়া হালকা হেসে বললো, ” শরীর এখন কেমন আছে? ”

মানহা মাথা এলিয়ে বললো, ” ভালো। একটু মাথা ব্যাথা আছে।”

” তুমি শিহাবের রুমে যাও আমি, আদা দিয়ে কড়া রং চা বানিয়ে পাঠাচ্ছি৷ ”

মনহা না করতে পারলো না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। মানহা এগুতেই সোফায় একজন মাঝ বয়সি মহিলা কে দেখতে পেলো। ফর্সা, সাস্থবান গম্ভীর চেহারার ভদ্র মহিলা বসে ভসে তসবি পড়ছেন। তানিয়া পেছন থেকে বললো,
” মানহা উনি আমার মা। তিন-চার দিন আগে খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছেন। ”

মানহা দ্বিতীয় বার তাকিয়ে, সালাম দিলো। ভদ্র মহিলা মানহার দিকে তাকিয়ে, গম্ভীর কন্ঠে সালামের উত্তর দিয়ে আবারো তাসবি পড়ায় মনোযোগ দিলেন।

” আমার ভাইয়ের জন্য পাত্রী ঠিক করতেই বাবা মা ঢাকায় এসেছেন। ”

মানহা তানিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তাহলে সত্যি ওয়াহাব এবার বিয়ে করবে, ভাবতেই আগের মতো দলা পাকানো, কষ্ট গুলো জমাট হতে শুরু করলো…


চলবে
কেমন হয়েছে জানাবেন সবাই 🌹

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here