শঙ্খচিল পর্ব-১৮

0
1859

#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya

পর্বঃ-১৮

সিলিং ফ্যানের কৃত্রিম বাতাসে বইয়ের পাতা গুলো উলট পালট হয়ে যাচ্ছে, শিহাব বিরক্ত হয়ে বইয়ের পাতা ঠিক করলো। শিহাবের কবিতা লেখা শেষ হতেই, খাতা টা মানহার দিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য তাকালো, মানহার চোখ বেয়ে টপ করে পানি গাল বেয়ে গরিয়ে পড়লো। শিহাব অবাক হয়ে বললো,
” মিস তুমি কান্না করছো কেনো?”

মানহা হন্তদন্ত হয়ে চোখ দুটো মুছে বললো, ” কই না তো। তোমার লেখা শেষ? ”

” কিছুক্ষণ আগেই শেষ। তুমি দেখো নি? কেনো কান্না করছিলে মিস?”

মানহা মুখ টা প্রসারিত করে নকল হাসি দিয়ে বললো, ” কাঁদছিলাম না বাবু। ঠান্ডা লেগেছে তো তাই। ”

শিহাব মানহার দিকে তাকিয়ে রইলো, এইটুকু পিচ্চি মানহার কথা বিশ্বাস করলো বলে মনে হলো না। মানহা শিহাবের মনোযোগ সরানোর জন্য বললো, ” খাতাটা দাও শিহাব৷ ”

শিহাব খাতাটা মানহার কাছে দিলো, মানহা মনোযোগ দিয়ে শিহাবের লেখা পড়ছে,
” মিস মিস…”

” হুঁ। ” বলেই মানহা শিহাবের দিকে তাকালো।

” একটু হিসু করতে যাই?”

” একটু যেতে হবে না। পুরোটাই যাও৷ ” শিহাব হেসে দিলো। মানহা ও।

ভর বিকেলে ওয়াহাব বাসায় থাকে না। মায়ের করা আদেশ মা বাবা যে ক দিন ঢাকায় থাকবে তাকেও হাসপাতাল থেকে ছুটি নিতে হবে। তাই তিন দিন ধরে হাস্পাতালে না গিয়ে, বাসায় বোরিং সময় কাটাচ্ছে। আর পাত্রী দেখে বেড়াচ্ছে, ওয়াহাবের মতে পৃথিবীতে সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ হলো মেয়ে দেখা। এক গাদা মেক-আপ করে সং সেজে কোন মেয়ে সামনে বসে থাকে, ইচ্ছস না থাকা শর্তেও কথা বলতে হয়৷
ওয়াহাব কফি শেষ করে মগ রাখার জন্য রুম থেকে বের হতেই শিহাব কে দেখতে পেলো৷ পেন্টের জিপ আটকাতে না পেরে বাথরুমের বইরে উশখুশ করছে।
শিহাবের অবস্থা দেখে ওয়াহাব ফিক করে হেসে দিলো, শিহাব ছল ছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” মামু তুমি হাসছো। ”

” তাড়াহুড়ো করছো কেনো? কুল। ”

“মামু আমার ব্যাথা লাগছে, তুমি বুঝতে পারছো না। ”

” থামো থামো আমি হ্যাল্প করছি। ” বলেই ওয়াহাব প্যান্টের চেইন ঠিক করে আটকে দিলো। শিহাব হাফ ছেড়ে বললো,

” থ্যাংক ইউ মামু। না হলে আমিও মিসের মতো কেঁদে দিতাম। ”

ওয়াহাব চমকে গিয়ে বললো, ” তোমার মিস কাঁদে?”

” আজকে কেঁদেছিলো৷ আসার পর৷ ”

” তাই নাকি? কেনো? ”

” জানিনা মামু। ”

” আচ্ছা। তুমি পড়তে যাও। ”
শিহাব মাথা দুলিয়ে নিজের রুমে চলে এলো, ওয়াহাব শিহাবের রুমের ভেতরে উঁকি মেরে এক নজর তাকালো, মানহা মনোযোগ দিয়ে শিহাবের খাতা দেখছে। গাল দুটো ফুলে আছে চোখের পাপড়ি ও ক্ষানিকটা ভেজা। শিহাব ঠিক বলেছে, মানহা কেঁদেছিলো কিন্তু কেনো? ওয়াহাবের খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
হঠাৎ তিন দিন আগের কথা ওয়াহাবের মনে পড়ে গেলো। মানহার কথা গুলো সূচের মতো ওয়াহাবের গাঁয়ে বিধলো। ওয়াহাব একটু হলেও এখন বুঝতে পারছে মানহার কান্নার কারন।
শিহাব কে আরো বেশ কিছুক্ষণ পড়িয়ে মানহা রুম থেকে বের হতে যাবে ঠিক তখনি ওয়াহাব মানহা কে পিছু ডাক দিলো। মানহা এক নজর তাকিয়ে আবারও নিজে কাজে মন দিলো।

যে লোকটা আর দু – চার দিন পরে অন্য মেয়ের সাথে ঘর বাঁধবে তার সাথে নিজেকে কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য জড়াতে চায় না সে। দ্রুত মানহা বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। খুব কষ্টে মানহা শিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো চোখ দুটো বার বার ঘোলাটে হয়ে আসছে,
❝ কি অদ্ভুত, সৃষ্টি কর্তা তার সাথেই দেখা করিয়ে দেয় যে কিনা, একান্ত ব্যাক্তিগত ভাবে কখনো নিজের হয় না৷❞ — রুহি জাহান মায়া।

মানহা হাটতে হাটতে ধানমন্ডি দুইয়ে এসে দাঁড়ালো, শরির হঠাৎ করেই যেনো ভীষণ দূর্বল লাগছে। লেকের সামনে দুটো ব্রেঞ্চ পাতা, মানহা ক্লান্ত শরিরে সে খানেই বসে রইলো৷
ক্ষানিক ক্ষন আগে ওয়াহাব ঠায় দাঁড়িয়ে মানহার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিলো। মানহার এমন ব্যাবহারে সে একটু চমকালে-ও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ভাবে মানিয়ে নিয়েছে৷
তার পাত্রী দেখার ব্যাপার টা জানার পর থেকে মানহার অদ্ভুত আচার ওয়াহাব লক্ষ্য করছে।
তার ওপর শিহাব কে পড়ানোর সময় ও মানহার কান্না। সব কিছু ধীরে ধীরে ওয়াহাবের কাছে পরিষ্কার হয়ে আসছে।
ওয়াহাবের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ওয়াহাব জানালার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে নিলো….

————————————————

” আপু আমি বিয়ে করতে চাই! ”

শিহাবের ব্যাগ গুছাতে গুছাতে হঠাৎ তানিয়া হঠাৎ থমকে গেলো। ওয়াহাবের দিকে তাকিয়ে বললো, ” যাক এতো দিনে তোর একটু সুমতি হয়েছে৷”

” কিন্তু আমি একটা মেয়ে কে পছন্দ করি, আই গেস সে-ও আমাকে পছন্দ করে…”

ওয়াহাবের বড় বোন তানিয়া অবাক হয়ে বললো, ” কে সে?”

” মানহা! ”

” মানহা? ” দ্বিতীয় বারের মতো তানহা অবাক হয়ে বললো।

” হুঁ!”

” তুই মানহা কে চিনিস?”

” হ্যাঁ। মানহা কে প্রথম দেখেছিলাম, ইমারজেন্সির বাইরে, ওর দাদী ব্যাথা পেয়েছিলো, আমি ওনার অর্থপেডিক্সের সার্জারী করেছিলাম…..”

ওয়াহাব তার বড় বোন তানিয়া কে সব কিছু বলতেই তানিয়া মুখ টিপে হেসে বললো, ” আমার খসরুস ভাই যে কারো প্রেমে পড়তে পারে, আই কান্ট বিলিভ ইট। ”
ওয়াহাব লজ্জা মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ তানিয়া বললো, ” একটা সমস্যা আছে৷ ”

ওয়াহাব অবাক হয়ে বললো, ” কি সমস্যা?”

” বাবা – মা ভালোবেসে বিয়ে করাটাকে সমর্থন করে না, আমার বিয়ের কথা ভুলে গেলি?”

হঠাৎ ওয়াহাবের নয় বছর আগে কথা মনে পড়ে গেলো, তখন ওয়াহাব সবে মাত্র নবম শ্রেনীতে উঠেছে, আর তানিয়া আপু অনার্সে দ্বিতীয় বছরের ছাত্রী, ভার্সিটির এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে তানিয়ার বন্ধুত্ব হয়, অতঃপর প্রেম। শাহেদ ( তানিয়ার স্বামী) অনার্স শেষে, ছোট চাকুরী জুটিয়ে তানিয়াকে বিয়ের করার প্রস্তাব দেয়, তানিয়া ও বিয়ের সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষন করে নি৷
বাড়িতে সবাইকে জানাতেই ওয়াহাবের বাবা মা না কোচ করে দেন৷ তাদের একটাই ধারণা প্রেম ভালবাসার বিয়ে খুব বেশি দিন টেকে না, অথচ তারা চেয়েছিলো একটা অচেনা অজানা ছেলের হাতে মেয়ে টাকে তুলে দিতে।
তানিয়া প্রতিবাদ করে, ঠিক -ই তবে বাবা মায়ের মতের কাছে তার মত হেরে যায়। তানিয়া শাহেদের হাত ধরে ঘর ছারে।

তানিয়া এবং শাহেদের ছোট্ট সংসার ভালোই চলছিলো, বিয়ের বছর দুই পরে তানিয়ার কোল জুরে ফুট ফুটে শিহাবের জন্ম হয়৷ সব কিছু ঠিক ঠাক চলছিলো। শাহেদের চাকরি-ও দিন দিন পদোন্নতি হচ্ছিলো।
শিহাবের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন চাকরির সুবাদে শাহেদ বিদেশে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এক সময় শাহেদ অস্ট্রেলিয়া পারি জমায়। সময়ের সাথে সাথে শাহেদের কর্ম ব্যাস্ততা বাড়ে সাথে সাথে তানিয়ার সাথে দূরত্ব-ও।
সম্পর্ক জিনিস টা বড়-ই অদ্ভুত দূরত্বের সাথে সাথে সম্পর্কে জম ধরা শুরু হয়ে যায়, মিইয়ে যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুন্দর ভালোবাসা গুলি। সুন্দর অতীতের স্মৃতি গুলো।

এক বুক অভিমান নিয়ে তানিয়া মনে মনে ছেলেকে একাই মানুষ করার সংকল্প নেয়। ছেলেকে মানুষ করার পাশা পাশি চাকরি খুঁজতে থাকে এক সময় পেয়েও যায়।
শাহেদ বিদেশ যাবার চার বছর কেটে যাবার পর-ও তানিয়া ছেলে কে বাবার কমতি অনুভব করতে দেয় নি৷ তবে শিহাবের শিশু মন, তো চায় বাবার ভালোবাসা৷ বাচ্চা ছেলেটা রোজ অপেক্ষা করে তার বাবার সাথে কথা বলার জন্য…
দিন শেষে ছেলের মুখের দিকে তাকালে মনে পরে যায় তানিয়ার নয় বছর আগের কথা, হয়তো বাবা মায়ের ইচ্ছে তে বিয়ে করলে আজ বাবা মায়ের সাপোর্ট ও থাকতো। জীবনে কঠিন সময় টা পার করতে হতো না…

” আপা তাহলে এবার উপায়? ”

হঠাৎ তানিয়ার ধ্যান ভাংতেই সে ওয়াহাবের দিকে তাকালো। ক্ষানিক টা ভেবে জরানো কন্ঠে বললো,
” সে দিন মা, মানহা কে দেখেছিলো, তাই ব্যাপার টা ক্ষানিকটা জটিল হয়ে গেছে।”

তানিয়া ওয়াহাবের কাধে হাত রেখে বললো, ” তুই চিন্তা করিস না ভাই। একটা উপায় তো বের করতেই হবে ভাই। যাতে বাবা মাও রাজি হয়…”



চলবে
কেমন হয়েছে জানাবেন সবাই 🌹

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here