শঙ্খচিল পর্ব-৩

0
3059

#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya

পর্বঃ০৩

মানহা তৃপ্তি সহকারে চা শেষ করে ব্যাগ থেকে বিশ টাকার নোট বের করে টেবিলে রাখতে যাবে ঠিক তখনি ওয়াহাব বললো,
” আপনাকে টাকা দিতে হবে না। আমি দিচ্ছি। ”

মানহা ভ্রু কুচকিয়ে বললো, ” আমার চায়ের বিল আমি দেবো আপনি কেন দিবেন। ”

ওয়াহাব মানহার কথায় লজ্জা পেলো। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বললো, ” এখানে আসার জন্য বলেছি তো আমি-ই। বিল টা দেওয়া কি আমার দ্বায়িত্বে পড়ে না?”

মানহা বললো ” হ্যাঁ। আপনার বিল আপনি দিন। আমার বিল আমি দিবো। ”

ওয়াহাব টাশকি খেয়ে তাকিয়ে রইলো, মেয়েটা কে সে যতোটা লাজুক স্বভাবের ভেবেছিলো ততোটা লাজুক ও না। ওয়াহাব তার বিল রেখে কেন্টিন থেকে বেড়িয়ে এলো, সাথে মানহা ও।
ওটি রুমের বাইরে একটা ব্রেঞ্চিতে মানহা বসলো। ওয়াহাব কিছু না বললে, তার কেবিনের দিকে চলে গেলো।
মানহার দাদীকে বেডে দেওয়া হলো রাত বারোটার পর। মানহা দাদীর পাশে বসে আছে দাদী ঘুমাচ্ছে৷ দাদীর নিষ্পাপ চেহারা দেখে মানহার বুক থেকে পাথর সরে গেলো। ক্লান্তিতে মানহার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে, রাজ্যের ঘুম যেনো তার চোখে বাসা বেধেছে।

ওয়াহাব ল্যাপটপে কিছু একটা করছে, কি করছে বুঝা গেলো না। ঘটিতে একটার এলার্ম বাজতেই হাতে থেটিস্কোপ নিয়ে ওয়ার্ডে গেলো রাউন্ডে। ওয়ার্ডের দরজা খুলতেই ওয়াহাব মানহার দাদীকে দেখতে পেলো, পাশেই একটা মেয়ে চুল এলো মেলো করে বসে আছে, মেয়েটা যে মানহা বুঝতে ওয়াহাবের অসুবিধা হলো না৷ ক্লান্তিতে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, আচ্ছা ঘুমালে অদ্ভুত মেয়েটাকে দেখতে কেমন লাগে? ওয়াহাবের খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।

” স্যার পেশেন্টরা তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সের কথা শুনে ওয়াহাবের ধ্যান ভাংলো, ওয়াহাব প্রতি উত্তরে বললো, ” রোগীদের রিপোর্ট তৈরি করেছেন? ”

” জ্বি স্যার। ”

” গুড। কাউকে জাগাতে হবে না। ” বলেই ওয়াহাব রিপোর্ট দেখতে শুরু করলো। ওয়াহাব মানহার দাদীর কাছে গেলো, হাতের পার্লস চেক করলো। হঠাৎ মানহার দিকে চোখ যেতেই ওয়াহাব ক্ষানিক তাকিয়ে রইলো, খালি বেডের থেকে একটা বালিশ এনে মানহার মাথার নিচে গুঁজে দিলো। রিপোর্ট চেক করা হলে, ওয়াহাব অন্য ওয়ার্ডের দিকে পা বাড়ালো।

——————————————————

ফ্লোরে গ্লাস ভাংগার টুকরো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তানহা গুটি শুটি মেরে এক কোনায় বসে আছে। ভয়ে সে নড়তে পর্যন্ত পারছেনা। এই খুনি লোকটা তানহার পিছনে লেগেছে, সেটা তানিহা ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে৷ তানিহার নিজের চেয়ে পরিবারের জন্য ভয় হচ্ছে আরো বেশি, খুনিটা তাদের বাসা চিনে ফেলেছে, যে কোন সময় যদি ক্ষতি করে বসে?
ভয়ে চিন্তায় তানিহা মাথা চেপে বসে রইলো৷ বিদ্যুৎ চলে এসেছে বাইরের রাস্তা থেকে আলো আসছে তানহা জানালার কাছে একটু উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করলো লোকটা আছে কি না।
লোকটা কে না দেখতে পেয়ে তানিহা দম ছাড়লো।

ভোরের আলো মাথার কাছের জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে। ৭২ বছর বয়সী শেহতাজ বেগম পিট পিট করে চোখ খুললেন, চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে ভাবলেন এবারও তিনি বেঁচে গেছেন, আল্লাহ পাক তাকে বেঁচে থাকার দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছেন। গত কাল কি যে হলো, মানহার কথা না শুনেই সে একা একা বাথরুমে চলে গেলো, আর তার ভাগ্যের দোষে ব্যালেন্স হারিয়ে পিছল খেয়ে পড়লেন। শেহতাজ বেগম টের পেলেন তার বাম হাত কেউ ধরে রেখেছে, হাতের দিকে তাকাতেই তিনি দেখতে পেলেন তার নাতনি তার হাত জরিয়ে বসে বসে ঘুমোচ্ছে। সারা রাত মেয়েটা এভাবেই বসেছিলো৷ শেহতা বেগম ডান হাত দিয়ে, মানহার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। নড়তে গিয়ে আচমকা শব্দ করলেন, মানহা দাদীর শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে বসলো৷

দাদীর দিকে এক নজর তাকিয়ে বললো, ” দাদী তুমি কখন উঠেছো? এখন শরীর কেমন লাগছে?”

” এতো দ্বায়িত্ববান নাতনি যার থকে সে কি ভাবে খারাপ থাকে বল তো? ”

মানহা মুখটা কাচুমাচু করে বললো, ” তাহলে গতকাল আমাকে অথবা রহিমা খালা ( কাজে সাহায্য কর্মী) কে না বলে কেনো ওয়াশ রুমে একা একা যেতে গেলে বলো তো? জানো কত ভয় পেয়েছিলাম! ”

শেহতাজ বেগম নাতনির থুতনি ধরে আদর করে বললেন, ” বোকা মেয়ে বেঁচে আছি তো আমি। জানিস এক বার জানের ফারাক গেলে মানুষ অনেক বছর বাঁচে। আমার কেনো জানি মনে হয় আমি অনেক বছর বাঁচব। ”

মানহা ফিনিক হাসলো৷ কিছু বললো না। হাতের কাছের বালিশ দেখে খানিকটা চমকালো। রাতে তো সে দাদীর হাত ধরে বসে ছিলো, বালিশ কি ভাবে এলো। মনে মনে এই প্রশ্ন বার বার ঘুর পাক খাচ্ছে, পরক্ষনেই ভাবলো হয়তো বা নার্স তার মাথার নিচে বালিশ গুজে দিয়েছে।

হঠাৎ ফোন কলে মানহার ধ্যান ভাংলো, তানহা ফোন দিয়েছে। সারা রাত মেয়েটা একা কিভাবে কাটিয়েছে আল্লাহ মালুম। তানহা একটু ভীতু স্বভাবের রাতে আবার ভয় পায় নি তো? মানহা দ্রুত কল টা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তানহা বললো,” আপু দাদী এখন কেমন আছে?”

” ভালো। এতো শব্দ কিসের?”

” আমি হাস্পাতালের রিসিপশনে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি কতো নম্বর রুমে আছো? ”

” চার তলায় ২০৯ নম্বর ওয়ার্ড।”

” আচ্ছা। আমি আসছি।” বলেই ফোনটা কেটে দিলো তানহা। মিনিট দশেক পর হঠাৎ এক জন বোরখা পরিহিত মহিলা মানিহার সামনে আসলো। চোখের কার্নিশে ব্যাতিত আপাদমস্তক বোরখা দিয়ে ঢাকা৷ মানহা একবার দাদীর দিকে তাকালো, দাদীও তার দিকে জিজ্ঞাস্যু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মানহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না? ”

তানহা কোঁকিয়ে বললো, ” আপু আমি তানহা। ”

মানহা চোখ ছানাবড়া করে বললো, এভাবে আপাদমস্তক ঢেকে রেখেছিস কেনো?”

” গতকাল কি হয়েছে জানো..” বলতে গিয়েও থেমে গেলো তানহা। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো এটা সঠিক সময় নয়, আপু কে বলার। খুব ভেবে চিন্তে নিজেকে লুকিয়ে রাখার বুদ্ধি পেয়েছে সে, যেহেতু তার নিজের বোনই তাকে চিনে নি, সেহেতু ওই খুনি লোকটাও তাকে চিনবে না। সকাল বেলাই রহিমা খালাকে দিয়ে বোরখা, নিকাব, হাত মোজা, পা মোজা আনিয়েছে সে।
মনে মনে নিজেকে বাহবা দিচ্ছে তানহা। এবার ওই খুনি লোকটা তার টিকিটা পর্যন্ত ছুতে পারবে না।

” কি হয়েছে, থেমে গেলি যে?”

” কিছু না আপু। আমাদের কলেজের সামনে কয়েকটা বজ্জাত ছেলে জুটেছে৷ খুব জ্বালাতন করে ওদের থেকে নিজেকে লুকানোর জন্যই কিছুদিন বোরখা পড়বো। ”

” কত দিন নিজেকে লুকিয়ে রাখবি ওই বস্তির ছেলেদের জন্য? বোরখা পড়লেই কি ভেবেছিস ছেড়ে দিবে? প্রিন্সিপালের কাছে কেনো কামপ্লেইন করিস না? ”

তানহা ভাবলো, আসলেই তো এদেশে কি বোরখা পড়া,মেয়েদের ইভটিজিং হয় না? আচ্ছা মেয়ে রা কোথায় নিরাপদ? তানহা শ্বাস ফেলে বললো,
” সবাই একজোট হয়ে হয়ে কমপ্লেইন করবো। এখন এসব বাদ দাও তো, হাতে মুখে পানি ছিটা দাও নাস্তা বানিয়ে এনেছি।”

দাদী ক্ষানিকটা অবাক হয়ে বললো, ” তুই বানিয়েছিস?”

” নাহ৷ রহিমা খালা বানিয়েছে, আমি হেল্প করেছি। ”

তানিহা হাস্পাতাল থেকে কলেজের উদ্দেশ্য রওনা দিলো, কলেজ গেইটে নামতেই দেখতে পেলো এক দল বখাটে ছেলে বাইকে হেলান দিয়ে মেয়েদের উত্যাক্ত করছে। তখন সে কথাটা ভুল বলে নি, তার খুব জানতে ইচ্ছা করে, মেয়েরা সত্যি কারের কোথায় নিরাপদ…



চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here