শুকতারা পর্ব-৩৪

0
836

#শুকতারা (পর্ব-৩৪)
#হালিমা রহমান

” মায়ের দোয়া ফার্নিচার “— বাজারের সবচেয়ে বড় দোকান।ঘরের সব আসবাবপত্র এখানে পাওয়া যায়।জিনিসগুলো যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনি টেকসই। মতির চায়ের দোকানের বিপরীতেই দোকানটা। দু-হাত দূরে দাঁড়ালেও কাঠের গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দেয়। কাঠ ঘষার শব্দ,রঙের গন্ধে মুখরিত চারপাশ।তিন-চারটে কর্মচারী আপন কাজে ব্যস্ত। কাস্টমারের দিকে চোখ ফেরানোর সময় নেই তাদের।নির্জীব কাঠের জিনিসগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন মমিন শেখ ও রতন পাটোয়ারী।হাত বুলিয়ে হরেক রকম ডিজাইন ছুঁয়ে দিচ্ছেন। চোখে চোখে কথা হচ্ছে দুজনের মাঝে।কোন আসবাবটা সুন্দর, কোনটা নেওয়া উচিত–তা ঠিক করছেন ইশারায়।দুইজোড়া শৌখিন চোখ,দুটো ঠোঁটের কোনে সন্তুষ্টির হাসি।না,কষ্টের টাকা দিয়ে এখান থেকে জিনিস কিনলে ঠকতে হবে না।

দোকানের মালিক রঞ্জু হাওলাদার কাছে এসে দাঁড়ালেন।শেষ চৈত্রের তীব্র গরমে ঘাম ঝরছে সারা শরীরে।কাস্টমারের দিকে চেয়ে বিনীত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন, ” ভাই পছন্দ হইছে? রেডিমেট থেকাই নিবেন?”

এক সেকেন্ডে নিজের মত ইশারায় জানিয়ে দিলেন মমিন শেখ।রতন পাটোয়ারী বন্ধুর মন বুঝে বললেন,” না ভাই,রেডিমেট না।আমরা অর্ডার দিমু।আপনে ঐ অনুযায়ী বানাইবেন।”

” তাইলে সপ্তাহ দেড়েক দেরি হইব ভাই।এমনেই পুরানো অর্ডারগুলা হাতে আছে।তা শেষ কইরা আপনাগোটা দিতে হইব।”

” সমস্যা নাই। আমগো ওতো তাড়া নাই।আপনে সময় নিয়া বানায়েন।”

” তাইলে আজকে এডভান্স দিয়া যায়েন।”

এতোক্ষণে মুখ খুললেন মমিন শেখ।পাশের জিনিসগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে শান্ত গলায় বললেন, ” আপনে টাকা নিয়া চিন্তা কইরেন না। এইবারেরটা পছন্দ হইলে পরে আরো জিনিস নিমু আপনের থেকা। একটু আদর দিয়া বানায়েন ভাই,বেয়াই বাড়ি যাইব এগুলা।মান-ইজ্জতের ব্যাপার আছে।”

” এই বাজারে আরো অনেক দোকান আছে।খোঁজ নিয়া দেখেন,কেউ এই রঞ্জু হাওলাদারের মতো বানাইতে পারে না।কাস্টমারের চেয়ে আমার চিন্তা বেশি।নাহয় শূন্য থেকা শুরু কইরা এতো তাড়াতাড়ি উপরে উঠতে পারতাম? ডিজাইন দেখায়া দিয়া যান ভাই।দেড়-দুই সপ্তাহ পরেই পায়া যাইবেন সব।”

দোকানের এক কোনে পড়ে থাকা সোফাটার উপর অনেক্ষন যাবৎ নজর ঘুরছিলো মমিন শেখের। ফুল-লতা,পাতায় জড়ানো খুব হিজিবিজি ডিজাইন। তবুও ওটাই মনে ধরলো।কাজী বাড়িতে পাঠানোর জন্য ঐ দামী সোফাটাই উপযুক্ত।

দু-তিনটি জিনিসের নকশা ঠিক করে দিয়ে,অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে মমিন শেখ যখন দোকানের বাইরে পা রাখলেন,তখন ঘড়িতে বেলা সাড়ে এগারোটা।তাতানো সূর্যের নিচে চোখ মেলা দায়।রোদে পুড়ে যায় চামড়া।ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলের আগায় কপালের ঘাম মুছে, বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে দিলেন। উৎফুল্ল গলায় প্রস্তাব করলেন, ” চল চা খাই।”

” চল,গলা ভিজাইতে হইব।”

দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানের বাইরের বেঞ্চিতে আসন গেড়ে বসলেন দুজনে।খরখরা আকাশের তেজীয়ান সূর্যের নিচে ও নিজেদের গোলগাল মাথার উপরে মতির দোকানের সস্তা পলিথিনের ছাউনি দেওয়া। ছাতার মতো কাজ করছে এটা।রোদের প্রখরতা থেকে মাথাকে বাঁচায়।খানিক আরাম পেয়ে খুশি হলেন মমিন শেখ। খুশি গলায় রতন পাটোয়ারীকে বললেন, ” একটা ঝামেলা গেল বুঝলি।তুই এডভান্সের টাকাটা না দিলে সত্যিই ঝামেলায় পড়তে হইতো। বাপের উপকার করছোছ।আমি এই মাসের শেষেই পরিশোধ কইরা দিমুনি।”– মমিন শেখের কন্ঠে স্বস্তি,উপচে পড়া কৃতজ্ঞতা, ভবিষ্যতের আশ্বাস। রতন পাটোয়ারী হাসলেন।

” দিছ তুই সময় কইরা।সূচি তো আমারই মাইয়া।ওর লেগা এইটুকু করতেই পারি আমি।কিন্তু কাজটা তোর ভুল হইছে মমিন।বেয়াই বাড়িতে যা দেওয়ার তা বিয়ার পরপরেই দিলে ভালো হইতো।এতোদিন পরে দেওয়াটা ঠিক হয় নাই। বিয়ার উপহার মানুষ এতোদিন পরে দেয়? তোর তো আর কম নাই।”

” আরে আমি ভাবছিলাম সূচিরে গয়না বানায়া দিমু।বৈশাখের হালখাতার ধাক্কাটা গেলে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হইব।হালখাতার ঝামেলাটা গেলেই ভাবছিলাম গলার হার আর কানের দুল বানাইতে দিমু। এহন মাইয়ার যখন ফার্নিচারের শখ তখন গয়না থাক।এটাই এখন দেই। তাছাড়া,বেয়াইনেরও মনে হয় ফার্নিচারের শখ।”

” ক্যামনে বুঝলি? মুখ ফুইট্টা কইছে?”

” না সরাসরি বলে নাই কিন্তু ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝাইছে। আমার চুলগুলি কি বাতাসে পাকছে? হের কথার ধরন দেইক্ষাই বুঝছি। কিন্তু বেয়াইন যদি এমনে না কইত তাইলে আমি আরো পরে এগুলি বানাইতে দিতাম।সারের-বীজের দোকানে টাকা পাইব কিছু।হালখাতায় ঐগুলি পরিশোধ কইরা তারপর এগুলি বানাইতে দিতাম।আমার তাইলে সুবিধা হইতো।তোর থেকা ধার করা লাগতো না।কিন্তু মুখের উপরে যখন বইলা ফালাইছে তখন তো আর দেরি করা যায় না।তাছাড়া জামাইও দেখলাম কিছু কয় নাই।চুপ কইরাই আছিলো।সূচি মনে হয় অনেক ঘ্যানঘ্যান করে।”

মতি দু-কাপ চা এগিয়ে দিলো। রতন পাটোয়ারী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কথার রেশ টেনে বললেন, ” পোলাপাইনে শখ করবই।এরা কি আর বাপ-মায়ের হাতের অবস্থা জানে? তুই এতোদিন দেছ নাই এটা তোরই দোষ। আরে, মাইয়া বিয়া দেওনের আগ থেকা টাকা-পয়সা জমা করতে হয়। পরের বাড়িতে মাইয়া দেওয়া কি এতোই সহজ? তুই পুরা পাঁচটা দিয়া সাজায়া দিবি, তারপরেই না মাইয়ার মাথা উঁচা হইব।সামাজিকতা বলতেও একটা শব্দ আছে। কোনো চাওয়া-পাওয়া না থাক, বাপ হিসাবে তোর একটা কর্তব্য আছে না? পাঁচটা জিনিস দিলেই দেখবি শ্বশুরবাড়িতে মাইয়ার আদর বাড়ব।আমি তো এখনি ঠিক কইরা রাখছি।রত্নার বিয়ার সময় ফার্নিচার দিমু।আমি কিছু দিমু আর রত্নার মামারে কিছু দিতে বলুম।দিলে আমার মাইয়ারই থাকব।আরেকজনের বাড়িতে কিছুতেই খালি হাতে মাইয়ারে পাঠামু না। মাইয়া যদি আশেপাশের মানুষগোরে গর্ব কইরা বাপের বাড়ির জিনিস না দেখাইতে পারে,তাইলে ক্যামনে হয়? তোর তো আছে, তোর এতো দেরি করা ঠিক হয় নাই।”

” আমার আছে ঠিক আছে কিন্তু আমি আবার জমিদারও না।তাছাড়া, মাথায় ছিল না এগুলা। আমি মরলে জায়গা-জমি যা আছে তা তো সূচি আর ওর জামাইয়েরই থাকব।ভাবছিলাম আস্তে-ধীরে গয়না বানায়া দিমু।এখন আর সূচিরে গয়না দিমু না।পারলে ভবিষ্যতে নাতি-নাতনীরে দিমু।”

বন্ধুর দিকে চোখা চোখে চেয়ে রইলেন রতন পাটোয়ারী। একটু থেমে,একটু ধীরে-সুস্থে,ঠান্ডা গলায় বললেন, ” ভূমির নামে কিছু দেওয়া উচিত তোর।সব জমি সূচির নামে দেওয়া ঠিক হয় নাই।দুইজনেরই হক আছে।হক মারা ভালো না।আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হইব।”

” কীসের মাইয়া? আমার একটাই মাইয়া।সূচি ছাড়া আর কেউ নাই।যে আমার ঘর ছাড়ছে, সে আমার কাছে তখনই মইরা গেছে। আমি এতো ভালো মানুষ না। শয়তানের বাচ্চার নামও নিবি না আমার সামনে।”

” মমিন,অনেকদিন আগের কেচ্ছা এগুলা। ছয়টা বছর গেছে মাঝে দিয়া। তাছাড়া জামাই তো খুব একটা খারাপ না।মাইয়াটা এখন অসুস্থ।সেদিন দেখলাম কই জানি নিয়া যায় জামাই।তোর এখন রাগ-গোস্বা মেঘনায় ভাসায়া দেওয়া উচিত।এই অবস্থার মানুষ।নিশ্চয়ই বাপের ঘরে আসতে মন চায়। আল্লাহ না করুক, যদি ভালো-মন্দ কিছু হয়? যদি..

” মইরা যাক।আমার সামনে আর নাম নিবি না।ওর কোনো দায়-দায়িত্ব আমার নাই।”— রতন পাটোয়ারীকে মাঝপথে থামিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন মমিন শেখ। তেষ্টায় অথবা রাগে,এক চুমুকে আধা কাপ গরম চা শেষ করলেন।

রতন পাটোয়ারী ক্ষুব্ধ,বিরক্ত। কাপের তলানিতে জমে থাকা চা’টুকু দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বন্ধুর মতো সমান তেজে গর্জন করলেন।

” মইরা গেলেই বুঝবি। তোর মতো পাষাণ আমি দুনিয়াতে আরেকটা দেখি নাই। পাথরের মাঝেও ফুল ফুটানো সম্ভব কিন্তু তোর মতো পাষাণের বুকে দয়া-মায়া জন্মানো সম্ভব না।গোলগাল মাইয়াটা, কত খারাপ লাগে এহন দেখতে। নিজের চোখে দেখলে বুঝতি।”

” আমার দেখাও লাগব না,বুঝাও লাগব না।ওরে দেখার আগে যেন আমি কানা হইয়া যাই।রত্নায় যদি এরকম ভরা সমাজের মাঝে তোর মুখে চুন-কালি মাখায়া আরেকজনের হাত ধইরা পলাইতো,তাইলে দেখতাম এতো গুণের কথা কই থাকে।বাইরে থেকা এরকম দরদী সাজা অনেক সহজ।ঐ হারামজাদীর লেগা আরেক ব্যাটায় আমার আর সাহিদার চরিত্র ধইরা টান দিছে।বিয়া ভাঙছে দেইখা পাত্রের মামা মারতে পর্যন্ত আইছে।আমি ভুইলা যামু? সবকিছু এতো সহজ!”

এরপরে আর কথা থাকে? ছয় বছর আগের সেই অপয়া বেলার কথা মনে পড়ে গেল রতন পাটোয়ারীর।সেদিন ভূমি পালিয়ে গিয়ে দুর্নাম-কলঙ্কের বোঝা তুলে দিয়েছিল বাবা-মায়ের মাথার উপর।সুখে থাকার তাগিদে নিজের পছন্দের মানুষের হাত ধরে পালিয়ে গেল ঠিকই।ছোট থেকে আদরে বড় করার প্রতিদান হিসেবে বাবা-মায়ের হাতে দিয়ে গেল জবাবদিহিতার ঝুলি,কৈফিয়ত, অপমান আর লজ্জা।ভূমি যখন নতুন জীবন বরন করতে তিন কবুল বলেছে,গ্রামের কয়েকশো জ্বিভ তখন মমিন শেখের দিকে ফিরে ছিঃ, ছিঃ করেছে।ভাঙা বিয়ের পাত্রের চাচা গায়ের দিকে তেড়ে এসে অপমান করেছে।আঙুল নাচিয়ে প্রশ্ন করেছে, “মানুষ করতে না পারলে মেয়ে জন্ম দিছেন ক্যান?আবার এই দুশ্চরিত্র মেয়েরেই আমাদের সংসারে দিতে চাইছেন? আপনাদের চরিত্রও কত সুন্দর তা আমাদের বুঝা শেষ।”
কথাগুলো এরকমই ছিল।কিন্তু এর আগে-পিছে জড়ানো ছিল হাজারটা গ্রাম্য গালি আর শ’দেড়েক প্রশ্ন। রক্ত পানি করে তিলতিল করে যারা গড়ে তুললো তাদের কপালে এই ছিল?আদরের বিনিময়ে যে সন্তান লজ্জা ও অপমান ছুঁড়ে দেয়,তাকে ক্ষমা করা এতোই সহজ? সত্যি তো, সবই কি ভুলে যাওয়া যায়? ভুল-ঠিকের পাল্লায় মমিন শেখ অথবা ভূমিকে মাপতে পারেন না রতন পাটোয়ারী। একবার মনে হয় ভূমির দোষ।বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিলে কী এমন হতো? কিন্তু গোলগাল ভারী শরীরের বন্ধু কন্যার ছবি চোখে ভাসলে আর এই প্রশ্নটা টিকে না।মনের পিতৃ সত্তাটা রায় দেয়,না মমিনেরই দোষ।সে তো জানতো ইশতিয়াকের কথা।অন্য জায়গায় বিয়েটা ঠিক করাই ভুল হয়েছে।তাছাড়া,এতো বছর তো গেল।এবার মেয়েটাকে ক্ষমা করাই যায়।কত বড় বিপদ সামনে।মেয়েটা যদি না বাঁচে? মমিন শেখের মাথায় এসব আসে না? সে এতোই পাষাণ?
________________________
সকাল সকাল কেবল বাইরে পা দিয়েছে সূচি,কোথা থেকে উড়ে এলো রনি। গায়ে কালচে-সাদা রঙের স্কুল শার্ট,নীল রঙা প্যান্ট। কাঁধে মলিন স্কুল ব্যাগ।ছেলেটা হয়তো স্কুলে যাবে।একটু অবাক হলো সূচি।স্কুলে রনি কখনোই ক্লাস করতে যায় না,যায় বেড়াতে। মাসে বড়জোর দুই-তিনদিন তাকে স্কুলের বারান্দায় দেখা যায়।বাকি দিনগুলো তার অবসর। ভাবখানা এই,দুই-তিনদিন স্কুলে পা দিয়েই সে স্যারদেরকে ধন্য করছে। প্রত্যেকদিন স্কুলে যাওয়া লাগে না।এতে সময় নষ্ট হয় কেবল।দু-একদিন দর্শন দিলেই হয়।
সূচি অলস পা সামনে বাড়ানোর আগেই রনি দু-হাত মেলে গতি রোধ করলো তার।আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,” খেলবা?”

” কী?”

” বৌচি।”

” তুই না স্কুলে যাচ্ছিস?”

” তুমি খেলবা নাকি ঐটা কও।”

” তুই স্কুল থেকে আয় তারপর খেলব।”

স্বস্তির হাসি ফুটলো রনির মুখে।কাঁধ থেকে পাতলা ব্যাগটা খুলে সূচিদের বারান্দায় ছুঁড়ে দিলো।গোড়ালির উপরে প্যান্ট তুলতে তুলতে বললো,” তাইলে চলো এখনি খেলি।”

” তুই না স্কুলে যাচ্ছিস?”

” ধুর আজকে আর যামু না?”

” কেন?”

” আজকে অনেক গরম সূচি আপা।রাস্তা দিয়া হাঁটার সময় আমি সিদ্ধ হইয়া যামু।”

” দৌড়াদৌড়ি করে খেললে তোর গরম লাগবে না?”

” আরে না।দুই ঘন্টা খেলার পরে একঘন্টা পুকুরে থাকমু।গরম-টরম সব শেষ।আরে চলো না।”

” সূচি, আয় ডাইল ভর্তা দিয়া দুই লোকমা ভাত খায়া যা।তাড়াতাড়ি আয়।”

ঘরের ভিতর থেকে সাহিদা বেগমের কন্ঠ ভেসে আসলো।রনি হতাশ চোখে চেয়ে রইলো সূচির দিকে।দৃষ্টিতে এক আকাশ বিরক্তি,হতাশা,ভাত না খাওয়ার অনুরোধ। সূচি হাসলো।গলা বাড়িয়ে বললো, ” এখন খাব না,আম্মা। একটু আগেই তো খেয়েছি।তুমি খাও।”

” এক লোকমা খা।”

” না,রেখে দাও। পরে খাব।”

” তাইলে একটা আপেল খা। নাইলে একটা কমলা খা।তোর বাপে কতকিছু আনছে,কিছু একটা খা।এই তো শরীর।আমি ভয়েই বাঁচি না,কখন বাতাসে উইড়া যাছ।কিছু একটা খা।সূচি, দৌড় দিবি না।দাঁড়া সূচি,সূচিইইইই……

রুগ্ন মেয়ের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা।কিন্তু দস্যি মেয়ে কথাই শোনে না।এবাড়িতে এসেছে দুটো দিন হয়েছে সবে।ড্যাংড্যাং করে নাচতে নাচতেই বেলা শেষ।খাবার তো বাহুল্য। অগাধ স্বাধীনতার মাঝে খাবারের কথা তার মনেই থাকে না।
সাহিদা বেগমের কথা বোধহয় সূচির কানেও ঢুকলো না।রনির সাথে তাল মিলিয়ে এক দৌড়ে চলে এলো মনির ঘরের পিছনের পুকুরপাড়ে। এখানে গাছ-গাছালি বেশি।রোদ কম লাগে।মনির ঘরের বিপরীতেই জয়াদের ঘর।দরজায় দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো রনি, ” লিলি,খেললে বাইরে আয়।তাড়াতাড়ি আসবি।”

” এই এইখানে খেলবি ভালো কথা।দেইক্ষা-শুইন্না খেলিছ,বটির উপরে আইসা পড়িছ না আবার।”– পুকুরের সামনে বসে মাছ কুটছে মনি।সূচি-রনিকে সতর্ক করে দিলো আগেই।

” কি রে সূচি,শাড়ি কই? চুড়ি কই? দেখলে মনেই হয় না তুই বিবাহিত।”

ওড়নাটাকে গায়ের উপর বিছিয়ে সুন্দর করে বেঁধে নিলো সূচি।চম্পা ভাবির কথার বিপরীতে চুলে হাত খোঁপা করে বললো, ” বিবাহিত মনেই হয় না? তারমানে আরেকবার বিয়ে করতে পারব? বয়সটাও তো বেশি হয়নি এখনো।তাহলে ছেলে দেখো,আরেকবার বিয়ে করি।”

” ছেমড়ির শখ কত! ফয়সালের সামনে বলিছ এগুলা,জবাই দিব তোরে।”

” হুহ,আমি সূচি।এতো সহজ আমাকে কিছু করা? চৌদ্দপুরুষের নাম ভুলিয়ে দেব একদম।তাছাড়া তার চিন্তাও আমার আছে।আমি একটা বিয়ে করে, ওনাকেও একটা বিয়ে করিয়ে দেব।শোধবোধ, সব নতুন নতুন।”

” এগুলি কইতে হয় না, ছাগল।আল্লাহ কখন কার কথা কবুল করে তা বলা যায় না।”– লিলির পিছু পিছু জয়াও বেরিয়েছে।সূচির মজা করে বলা কথাটা তার পছন্দ হয়নি মোটেও।মানুষ মজা করে এগুলো বলে না-কি? তাই বিজ্ঞের মতো শুধরে দিলো।

” আরে আমি তো এমনিও বললাম।”

” আর বলিছ না।দুষ্টামি কইরা মানুষ এগুলা বলে না।বাদ দে এখন।চালতা ভর্তা খাবি? বানামু?”

” এতো সকাল সকাল?”

পুকুরের কাছে বসেছিল চম্পা।ফোঁড়ন কেটে বললো, ” নবাবজাদী, সাড়ে এগারোটা বাজে।তোর ঘুম ভাঙছে আজকে দেরি কইরা।জয়া ভাবি, তুমি বানাও তো। কম কইরা বানায়ো,আমি কিন্তু খামু না।কিছু খাইলেই পেট গোলায়।”

” বুঝছো সূচি আপা,চম্পা ভাবি খায় না বেশি কিন্তু তার হাতের ফাঁক দিয়ে কিছুই নেওয়া যায় না।চালতা খাইব ঠিকই।কিন্তু খাইতে খাইতে কইব, বেশি খাইতে পারি না।খালি বমি আসে।আজব কিছিমের মানুষ।খাইতে খাইতে সব খায় আবার গলাও শুকায়। চল তো খেলি।বৌচি খেলমু না।তিনজনে বৌচি খেলা যায় না।চলো ছোঁয়াছুঁয়ি খেলি।দশ,বিশ,তিরিশ………… নব্বই,একশ।লিলি-বিলি তুই চোর। সূচি আপা দৌড়াও।”

লিলি ছোট মানুষ।নিজের চেয়ে অনেক বড় মানুষ দুটোর সাথে দৌড়ে পারে না।জান-প্রাণ দিয়ে পিছু পিছু ঘুরেও একজনের নাগাল পায় না।তবুও প্রতিবার খেলার সময় কী করে যেন ছোট্ট মেয়েটাই চোর হয়। পিছু পিছু দৌড়ানোর কাজটা ওর কাঁধের উপরেই পড়ে।সব দোষ এই ফাজিল রনির।সবসময় চালাকি করে।উল্টা-পাল্টা বাটাবাটি করে লিলির মাথায় একশ ফেলে। বজ্জাত একটা ছেলে।মনে মনে আরো পঞ্চাশটা গালি দিয়ে সূচির পিছনেই ছুটলো লিলি।ওই বজ্জাত ছেলেকে ধরার সাধ্য ওর নেই।তারচেয়ে সূচি ফুপুকেই ধরা যাক।

আগের মতো আর দৌড়াতে পারে না সূচি।শাড়ির বদলে বিয়ের আগের থ্রিপিস পরেছে,তবুও কাজ হয় না।একটু দৌড় দিলেই হাঁপিয়ে যায়।হাঁটু ভেঙে আসে। তাছাড়া শরীরটাও কেমন ভারী ভারী লাগে।তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যায়।এ বাড়িতে আসার পর খেলাধুলা যতটুকুও করছে,তা পারছে কেবল মনের জোরে।পায়ের জোর আগের মতো নেই।দৌড়ের মাঝেই একবার পিছু ফিরে দেখলো সূচি।লিলি হাত তিনেক দূরে।আর কিছুক্ষনের মাঝেই ছুঁয়ে ফেলবে।পা না থামিয়ে দূর থেকেই হুঙ্কার ছাড়লো সূচি।

” লিলি,শুধু আমার পিছেই পড়ে আছিস কেন? রনির পিছেও দৌড়া।”

” আমি রনি মামাকে ধরতে পারি না।”

” তাহলে আমিও খেলব না। শুধু আমাকেই হয়রান করছিস।ফাজিল মেয়ে,যা খেলা বন্ধ।”

লিলিও থামলো না,সূচিও থামলো না।খেলা বন্ধ বলার পরেও খেলা থামলো না।লিলির হাত থেকে বাঁচার জন্য এলোমেলো পায়ে ছুটলো সূচি।পুকুর পাড় থেকে নিজেদের ঘরের পিছনে,জয়াদের দোরের সামনে দিয়ে,শিমুল তুলার গাছের পিছনে।লিলি সেই পিছনেই পড়ে আছে।রনি দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।লিলির হাত থেকে বাঁচার জন্যে এবার সদর দরজার দিকে ছুট দিলো সূচি।কাঁচা রাস্তা ধরে একদৌড়।মিনিট দুয়েকের মাঝে প্রায় পৌঁছে গেল বাড়ির সামনের সেই বুড়ো খেজুর গাছের সামনে।

” সূচি আপা সাবধান।সামনে গর্ত,ইট আছে,পড়বা কিন্তু।সূচি আপা, ইশ আস্তে..

রনির সাবধান বানী ঠিক কাজে দিলো না।চোখে-মুখে অন্ধকার দেখলো সূচি।ডান পা’টা গর্তের ভিতর পড়েছে বেকায়দায়।উল্টে গেল পায়ের পাতা।নিচ থেকে সূচির ডান পা’টা জোরে মোচড় দিলো কে যেন।
” মাগো ” বলে চিৎকার করে নিচে পড়ার আগেই শক্ত হাতে আগলে নিলো কেউ।হাঁটু ভেঙে পড়তে দিলো না সূচিকে।বলিষ্ঠ হাত দুটো একটানে সূচির হাত দুটো টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। প্রায় জোরেই চিৎকার করে বললো, ” তুমি ছোট? পড়লে এখন কেমন হতো? কোমড়টা থাকতো আর?”

__________________________________

” আহ, আস্তে।এতো জোরে কেউ টান দেয়? রগগুলো ফেটে যাচ্ছে আমার।লাগবে না আপনার সেবা,দেখি সরুন এখান থেকে।”

এক পা নড়লো না ফয়সাল।কেবল বিরক্ত চোখে একবার দেখলো বউকে।আগের মতো পায়ের পাতা টেনেটুনে দেখে বললো, ” এতো কথা যে কেন বলো তুমি। আমি না আসলে এই আওয়াজ কই থাকতো? ফাজিল মেয়ে,ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে আসছে। রত্না,আমাকে আরেকটু বরফের ব্যবস্থা করে দাও তো।”

” এই তো দেই দুলাভাই।”

ঘরের বাইরে ছুটতে হলো না রত্নাকে। সাহিদা বেগম দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছেন।হাতে বরফ ঠান্ডা মাছের পলিথিন।বাড়তি বরফ নেই ফ্রিজে।এই মাছের পলিথিনই এখন ভরসা।

” রত্না,এইটা দাও জামাইরে।ফয়সাল,তুমি বসো আরাম কইরা।ফাজিলে কষ্ট করুক।বারবার মানা করছি আমি। আমার একটা কথাও শোনে না।রনি,লিলির মতো ওয় মনে হয় পোলাপাইন।বেদ্দপ।”

নতুন জামাইয়ের জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করতে দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে ছুটলেন সাহিদা বেগম।দশ মিনিট আগে ফয়সাল এসেছে।সাথে রত্নাও আছে।এই দুপুরের আগে এদের আগমনের কারণ জানা নেই।তবে ফয়সালকে দেখে খুশিই হয়েছেন তিনি।মেয়েকে না দেখে জামাই বোধহয় থাকতেই পারছে না।

” কি রে রত্না,তোর ভাইয়াকে কোন জায়গা থেকে ধরে আনলি?”— চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো সূচি।পায়ের কাছে ঠান্ডা পলিথিন চেপে রাখা।ফয়সালও ততোক্ষণে খাটের কোনে যেয়ে বসেছে।সেবা-যত্নের মাঝে দুদিন আগের অভিমানের মেঘ কোথায় কেটে গেছে,তার খবর কেউ রাখলো না।

” খামারে গেছিলাম একটা ভিডিও করতে।তখনই দেখা।তোর কথা জিগাইতাছিলো তাই ধইরা নিয়াসছি।”

” ভালো করিসনি।কত ব্যস্ত মানুষ তোর দুলাভাই।ফোন করার সময় হয় না একটু।এর মাঝে তুই টেনে এনেছিস এ অবধি।ভালো কাজ হয়নি।”

কটাক্ষ নাকি বিদ্রুপ? ঠিক ধরতে পারল না ফয়সাল।তবে খোঁচাটা ঠিক ধরতে পারলো।এই দুদিন ফোন না দেওয়ায় খুব সুন্দর করে খোঁচা দিয়ে ফেললো। সে নিজেও চোখা চোখে চেয়ে রইলো।দৃষ্টিতে অভিযোগ, ” তুমিও তো ফোন দেওনি।”

” জানোছ সূচি কী হইছে?”

” না।”

” রাতুল দেশে আসছে।বৈশাখে ভোলা আসব।তখন আব্বার কাছে প্রস্তাব নিয়া আসব।ওনার আব্বা-আম্মার সাথে আমারে কথা বলায়া দিছে।ভিডিও কলে কথা বলছি।আমারে মনে হয় তাদের পছন্দ হইছে,কয়েকদিন পরপরেই ফোন দেয়।”

রত্নার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক।উপচে পড়া আনন্দে ফর্সা মুখ আরো জ্বলজ্বল করছে।সূচির বেশ লাগলো।হাসিমুখে বললো, বাহ! দারুন খবর।ট্রিট দে।”

” দিমুনি তোর ভাইয়া আসুক।ফয়সাল ভাই আপনে কিন্তু আবার আমার আব্বারে বইল্লা দিয়েন না। আব্বা কিছুই জানে না।”

হতভম্ব মুখে বসেছিল ফয়সাল।কথার আগামাথা না জানলেও বুঝতে পেরেছে।তাই ছোট্ট করে নাথা নাড়লো।

” আমি যাই,দেখি কাকিরে সাহায্য করি।থাক তুই।”

বান্ধবীর দিকে চেয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে,ঠোঁটের ভঙ্গিতে অজান্তেই একটি পুরুষ হৃদয় কাঁপিয়ে ঘর ছাড়লো সুন্দরী রত্না।পদচারণা হিল্লোল তুললো একটি মুগ্ধ হৃদয়ে।ফয়সালের মাঝে মাঝে মনে হয় এই মেয়েটা মানুষ না হয়ে ঘাসফড়িং হলে ভালো হতো।ঘাসফড়িংয়ের মতোই নাচে আর নাচে।আজকেও খামারে গিয়েছিলো রত্না।টিকটক ভিডিও করতে প্রায়ই যায়।না চাইতেও তার দিকেই বারবার নজর আঁটকে যাচ্ছিলো। কি সুন্দর মুখ ভঙ্গি করে! মেয়েটা ঘাসফড়িং হলেই বেশ হতো।শরীরে একটা রঙিন সুতো প্যাঁচিয়ে বুকপকেটে আঁটকে রাখা যেতো।বড় ভাবি ব্যাতীত দুনিয়ার সকল সুন্দরীদের দেখলে হরহামেশাই বুকে শিহরণ জাগে তার।নিজের বিয়ের কথা মনে পড়লেই শিরশিরে ব্যাথাটা বাড়ে।মনের শিরশিরানি ভাব কমাতেই এগিয়ে গিয়েছিলো খোশগল্প করতে।কথায় কথায় সূচির কথা উঠলো।ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটা টেনে আনলো এবাড়ি। অনুরোধ তো নয় যেন চুম্বক।মিষ্টি স্বরের অনুরোধ ফেলতে পারলো না ফয়সাল।বউকে উপলক্ষ করে সুন্দরীকে সঙ্গ দিতেই এ বাড়িতে আসা।

” রত্নার রিলেশন আছে?”

” হ্যাঁ, বহুদিনের।”

” ছেলে কী করে?”

” সৌদি থাকে।”

” প্রবাসী?”.

” হুম।”

” এই বিদেশিগুলোর কাজ নেই? বিয়ের সময় বিয়ে করবে সুন্দরী বউ তারপর তাকে দেশে রেখে ছুটবে আবার অন্যদেশে। তোরা যখন আলাদাই থাকবি তখন এতো সুন্দরী বউ বিয়ে করার কী দরকার? আর আমি দেখেছি,এই বিদেশিগুলোর কপালেই আল্লাহর দুনিয়ার সব সুন্দরীগুলো জুটবে।আমাদের আফজাল ভাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ।এতো সুন্দর একটা বউ রেখে বিদেশে পড়ে আছে।দেশে থাকলেই চলে কিন্তু।আল্লাহ একটা সুন্দর ভাগ্য দিয়েছে তা নিয়ে দেশেই থাক। তা, ন। যত্তসব।”

” আপনার খুব আফসোস হয়?”— সূচির তীক্ষ্ম কন্ঠ।সুচালো দৃষ্টিতে মেপে নিচ্ছে অপরজনকে।

কঠিন দৃষ্টির সামনে থই পায় না ফয়সাল।মনের দুর্বলতা প্রকাশ পেল নাকি? ধরা পড়া ইঁদুরের মতো বউয়ের দিকে চাইলো।না,মনের ভাব প্রকাশ করতে যেয়ে পরিস্থিতি ঘেটে দিয়েছে একদম।বউয়ের মনে সন্দেহ জাগানো যাবে না।এমনিতেই ওদের সংসারে অশান্তির শেষ নেই।দুরাবস্থায় সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্রটার কথাই মাথায় এলো তার।সেকেন্ডের মাঝে নিজেকে ধাতস্ত করে, খাট থেকে উঠে এসে বউকে আলগোছে জড়িয়ে ধরলো।মাথায় আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো, ” মিস করেছি অনেক।আর থাকা লাগবে না।বাড়ি চলো তো।ফাঁকা ঘরে আমার কেমন খালি খালি লাগে।আমার কথা মনে পড়ে না তোমার? ভালোবাসি।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here