শেষ বিকেলের আদর❤️পর্ব : ২৭

0
3734

#শেষ বিকেলের আদর❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
পর্ব : ২৭

🌼
থাইগ্লাসের ফাঁক গেলে আসা রোদের তীর্যক আলো চোখে মুখে পড়তেই চোখ মুখ কুচকে এলো রোশনির।পরিচিত গন্ধ নাকে যেতেই ঘুমটা হালকা হয়ে এলো। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে।ঘুমটা ভেঙে আসতেই কালকের কথা মনে পড়লো তার।সাথে সাথেই চোখ খুলে তাকালো।চোখ খুলতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো অধিরের বুকে।ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।যদি কালকের ঘটা ঘটনাটা কোনো ভাবে স্বপ্ন হতো।চোখ মেললেই সব কিছু আগের মতো হয়ে যেত।একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে সে ভুলে যেতে পারতো।তাহলে বেশ হতো। প্রার্থনা করতো আল্লাহর কাছে যেন দ্বিতীয় বার সে এমন স্বপ্ন না দেখে।কিন্তু রোশনি জানে এটা স্বপ্ন নয় এটা বাস্তব।কঠিন বাস্তব।তার নিয়তি।রোশনি উঠতে নিলে দেখে অধির দু’হাতে তার কোমর জড়িয়ে রেখেছে।রোশনির চোখ মুখ শক্ত হলো।অধিরের হাত দুটো নিজের কোমর থেকে ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিতেই ঘুম ভেঙে গেলো অধিরের।চোখ পিটপিট করে তাকাতেই চোখের সামনে রোশনির রাগান্বিত মুখটা স্পষ্ট হলো।কিছুক্ষন এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে হাই তুললো অধির।ঘাড়ে হাত দিয়ে মুখ কুচকালো।সারা রাত দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থেকে তার ঘাড় ব্যথা করছে।রাতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেই পারে নি।অধিরের থেকে ছাড়া পেতেই উঠে দাড়ালো রোশনি।অধিরের দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বললো,

-আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না একদম।তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।একটা কথা মাথায় রাখবেন সবকিছু আপনার ইচ্ছে মত হবে না।আমার কাছে আসার চেষ্টা করলে খুন করে ফেলবো আপনাকে।

অধির হাসলো।উঠে দাড়াতে দাড়াতে ঘাড়ে হাত বুলালো।বললো,

-সকাল সকাল তোমার সাথে ঝগড়া করার মুড নেই সুইটহার্ট। ক্লান্ত লাগছে ভিষন। আই নিড সাম এনার্জি।তার পরে না হয় ঝগড়া করবো।

অধির ওয়াশরুমের দরজার সামনে যেতেই পেছন থেকে বলে উঠলো রোশনি,

-আপনার কথামত বিয়েটা তো করে নিয়েছি।এবার তো নকুলকে ছেড়ে দিন।কোথায় আছে ও? আমি ওকে দেখতে চাই।

অধির ঘুরে দাড়ালো।বললো,

-আয়াশ ঠিক আছে রোশনি।এতো চিন্তার কিছু নেই।আজই দেখতে পাবে ওকে।রিল্যাক্স।

অধির ওয়াশরুমে ঢুকতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোশনি।এখন আর কান্না পাচ্ছে না তার।কষ্টটা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন মানুষ কাঁদে না।চুপ হয়ে যায়।কষ্টটা বুকে আটকে থাকলেও চোখ থেকে পানি ঝরছে না আর।হাঁপিয়ে উঠেছে এক দিনেই।মাত্র একদিনের ব্যবধানে তার গোটা জিবনটাই অন্য দিকে মোড় নিয়েছে।

অধির যখন ওয়াশরুম থেকে বের হলো দেখলো রোশনি বিছানায় মুখ নিচু করে বসে আছে।অধির শান্ত চোখে তাকালো।রোশনিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গেলো ওর দিকে।বললো,

-গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।চাইলে শাওয়ার নিতে পারো।ভেতরে তোমার পোশাক রাখা আছে।শাওয়ার নিলে ফ্রেশ লাগবে।

রোশনি মাথা নিচু করেই প্রশ্ন করলো।বললো,

-তারমানে এসব আপনার আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিলো? আপনি আগে থেকেই জানতেন আমাকে নিয়ে আপনি এখানে আসবেন।আমাকে বাধ্য করবেন বিয়ে করতে।তাই আগে থেকেই আমার জন্যে ড্রেস রেখে দিয়েছেন?

-তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।

রোশনি ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাড়াতেই দম আটকে আসতে লাগলো।নিজের চেহারা নিজের কাছেই ভিষন অসহায় মনে হতে লাগলো।শাওয়ার ছেড়ে বসে পড়লো মেঝেতে।হাটুর ভাজে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙে পড়লো।শাওয়ারের পানির সাথে চোখের পানি মিশে এক হতে লাগলো।শরিরে পানির ছোঁয়া পড়তেই শরির ভেঙে আসতে শুরু করলো।ভিষন দূর্বলতায় ছেঁয়ে গেলো গোটা শরির ।এভাবে কতোক্ষন পানির নিচে বসে ছিলো জানা নেই রোশনির।ওয়াশরুমের দরজায় আঘাত পড়তেই মেঝে ছেড়ে উঠে দাড়ালো সে।অধিরের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।রোশনি পাশ থেকে টাওয়াল নিতে গিয়ে দেখলো তার জন্যে পোশাক রাখা।সাদা কূর্তি আর জিন্স। রোশনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রেসগুলো হাতে নিলো।

অধির দরজায় ধাক্কা দিতে দিতেই বলতে লাগলো,

-রোশনি? আর কতোক্ষন শাওয়ার নেবে?পানির নিচে বেশিক্ষণ থাকলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।জ্বর চলে আসবে রে বাবা।তাড়াতাড়ি বের হও।অনেকক্ষণ ধরে ডাকছি তোমায়।সাড়া তো দাও।দেখো এবার যদি তুমি বের না হও আমি কিন্তু দরজা ভেঙে ফেলবো।বের হও নারে বাবা।আমি তিন পর্যন্ত গুনবো তবুও যদি বের না হও আমি সত্যিই দরজা ভেঙে ফেলবো।এক,দুই,তিন।রোশনি? তুমি কি বের হবে না কি আমি দরজা ভাঙবো?

অধিরের কথার মাঝেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো রোশনি।ভেজা চুল,,চোখে মুখে পানির ফোঁটা। এই মুহূর্তে ভিষন স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে রোশনিকে।রোশনির ভেজা ঠোঁট জোড়ার দিকে নজর পড়তেই নিষিদ্ধ কিছু ইচ্ছে উঁকি দিতে লাগলো মনে।অধির চোখ নামিয়ে নিলো।অন্য দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজেকে সামলে নিলো।খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-এতোক্ষন কি করছিলে ভেতরে? এক ঘন্টা লাগে শাওয়ার নিতে?যদি জ্বর আসে তো তোমার খবর আছে।

অধিরের কথায় প্রগাঢ় অধিকারবোধ দেখতে পেলো রোশনি।এতো কিসের অধিকার দেখাচ্ছে লোকটা?এক দিনেই এতো অধিকারবোধ?বউ বলেই কি এতো অধিকারবোধ? রোশনি কিছু বললো না।ভেজা টাওয়াল হাতে বেলকোনিতে চলে গেলো।বেলকোনিতে ভেজা টাওয়েল নেড়ে দিয়ে পেছনে ফিরতেই কিছুর সাথে পায়ে বারি লাগলো।সাথে সাথেই মৃদু আওয়াজ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে।পায়ের দিকে তাকাতেই দেখলো পা থেকে সামান্য রক্ত বের হচ্ছে।রোশনি নিচে তাকাতেই দেখলো ক্যাকটাস গাছের সাথে পা লেগে এমন হয়েছে।রোশনি ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলো পুরো বারান্দা জুড়ে ক্যাকটাস গাছে ভর্তি।ছোট ছোট টবে ক্যাকটাস লাগানো।কয়েকটা গাছে ফুলও এসেছে।সাদা আর গোলাপি দু রঙের ফুল। পায়ের দিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে রোশনি রুমে চলে এলো।রুমে আসতেই দেখলো টি-টেবিলের উপর খাবার রাখা।আর সোফায় বসে আছে অধির।রোশনিকে রুমে আসতে দেখে কাছে ডাকলো অধির।

-এখানে এসো।খাবার রান্না করেছি খেয়ে নিবে এখন।এখানে বেশ কিছু দিন আসা হয় না।তাই বাজারও তেমন কিছু ছিলো না।ফ্রীজে শুধু চিকেন ছিলো আর গরুর কলিজা।ব্যস সেগুলোই রাস্না করেছি।চলবে তো তোমার? নাকি আমি বাইরে থেকে অর্ডার করবো?

রোশনি কিছু বললো না।আগের মতোই দাড়িয়ে রইলো।অধির প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে বললো,

-এতো সকালে ভাত খাওয়া উচিত নয়।তবে তোমার জন্যে ঠিক আছে।তোমার আরো একটু মোটা হওয়া উচিত।যদিও আমি সকালে ভাত খাই না। তবে তোমার সাথে আজ খেতে ইচ্ছে করছে।তাড়াতাড়ি চলে এসো।আমার ভিষন খিদে পেয়েছে।রাতে তো একাই খাবার খেয়ে নিলে।আমি খেয়েছি কিনা জানতেও চাইলে না।সবই কপাল বুঝলে?

অধিরের কথায় চোখ তুলে তাকালো রোশনি।এমন ভাবে কথা বলছে যেন সব কিছু কত নরমাল।খারাপ কিছু যেন হয়ই নি।আর বাকি পাঁচটা স্বামি স্ত্রীর মত তাদের সম্পর্কটাও স্বাভাবিক।রোশনিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অধির বললো,

-আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে কি পেট ভরবে সুইটহার্ট? তোমার বর পালিয়ে যাচ্ছে না।এখন খেয়ে নাও পরে যতো ইচ্ছে দেখো।

বলেই দুষ্টু হাসলো অধির।এমন হাসিতে গা জ্বলে গেলো রোশনির। বললো,

-আপনার মনে হচ্ছে না আপনি বেশি বেশি করছেন?আমাদের সম্পর্কটা বাকি পাঁচটা স্বামি স্ত্রীর মত না।আমি এই বিয়েটা মানি না।আর নাই আপনাকে স্বামি হিসেবে মানি।তাহলে এমন বিহেবের মানে কি?

অধির উত্তর দিলো না।প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,

-খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেয়ে নাও।

রোশনিও আর কিছু বললো না।খিদে পেয়েছে তার।চুপ চাপ সোফায় বসে ভাতের প্লেট তুলে নিলো হাতে।অধিরের দিকে না তাকিয়েই খেতে শুরু করলো।অধিরও নিজের প্লেট তুলে নিয়ে খাবারে মনোযোগী হলো।খাওয়া শেষ হতেই অধির নোংরা প্লেটগুলো কিচেনে নিয়ে গেলো।এই বাড়িতে সে মাঝে মাঝে এসে সময় কাটায়।এখানে কোনো কাজের লোকও নেই।অধির নিজেই প্লেট গ্লাসগুলো পরিষ্কার করে রুমে চলে এলো।রোশনি বিছানায় বসে কিছু একটা ভাবছে।আর অধির সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছে।হঠাৎই পাশে পড়ে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো।অধির ল্যাপটপ রেখে ফোন রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে সাহিলের চিন্তিত গলা ভেসে এলো।

-কোথায় আছিস তুই? কাল থেকে কন্টিনিউয়াসলি ফোন করে যাচ্ছি আর তোর ফোন সুইচড অফ আসছে।কোনো খবরই নেই তোর।একটা বার ফোন করে তো বলবি তুই কোথায় আছিস? আমাদের জন্যে তোর টেনশন না হলেও তোর জন্যে আমাদের টেনশন হয়।সেটা কেন মাথায় ঢোকে না তোর?

-রিল্যাক্স সাহিল।আই এম ওকে।আমি ফার্ম হাউজে আছি।

-সেটা ফোন করে বললে কি ক্ষতি হয়ে যেত? বাই দা ওয়ে মিষ্টার মিত্র কালকের মিটিংটা দুদিন পিছিয়ে দিয়েছেন।আজ আসতে পারবেন না।এদিকে আমাদের প্রেজেন্টেশনের কাজ সব কমপ্লিট।এখন এমন করার কোনো মানে হয়?

-ওনাকে ফোন করে জানিয়ে দে ওদের সাথে আমরা প্রজেক্টটা করছি না।ইট’স ডান।

-কিন্তু?

-কেনো কিন্তু না।অধির চৌধুরি কারো অপেক্ষায় বসে থাকে না।ডিল ক্যানসেল।

সাহিল দীর্ঘশ্বাস ফেললো।অধিরকে আর কোনো ভাবেই মানানো যাবে না।ভাইটা তার ভিষনই ঘাড়ত্যাড়া।

-সেসব তো ঠিক আছে।কিন্তু তুই ফিরবি কখন?

-দুপুরের পরেই ফিরবো।সাথে তোর ভাবিকে নিয়ে।

সাহিল যেন বুঝতে পারলো না ঠিক।বললো,

-ভাবি মানে? দিদামের কথা বলছিস? তুই আর দিদাম কি এক সাথেই আছিস?

-বাড়ি ফিরে কথা বলছি।বাই।

সাহিলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কাটলো অধির।ফোন কাটতেই রোশনি অধিরের দিকে তাকালো।ফোন স্পিকারে থাকায় সাহিল আর অধিরের সব কথায় সে শুনেছে।

-আপনি যে জিবন নিয়ে বেঁচে আছেন এটাকে কি জিবন বলে? না এটাকে বেঁচে থাকা বলে?লোকটার মিটিং দুদিন পেছানোতে আপনি কিছু না জেনেই প্রজেক্ট ক্যানসেল করে দিলেন।একটা বার তার কারনটা জানার চেষ্টা করলেন না।এমনও তো হতে পারে এটা করার পেছনে তার বড় কোনো কারন রয়েছে।বা কোনো সমস্যা।একটা কথা কি জানেন?ইউ ওয়ার্ক হার্ড।ইউ মেইক মানি।ইউ ডু ইট ফর ইওরসেল্ফ।দ্যাটস নট লাইফ।ইউ গো আউট।ইউ সিক ফর পিপুল হু নিড ইউর হেল্প ইউ মেক দেয়ার লাইফ বেটার।ইউ বিকাম দ্যাট স্পঞ্জ, হুইচ ক্যান এবজর্ব অল দা নেগেটিভিটি।এন্ড ইউ বিকাম দ্যাট পারসন হু ক্যান এমিট, বিউটিফুল পজিটিভ ভাইবস।এন্ড হোয়েন ইউ রিয়ালাইজ দ্যাট ইউ হেভ চেঞ্জড সামওয়ানস লাইফ. এন্ড বিকজ অফ ইউ দিস পারসন ডিডেন্ট গিভ আপ।দ্যাট ইজ দা ডে হোয়েন ইউ লিভ।তবে আপনি এসব বুঝবেন না।সেই ক্ষমতা আপনার নেই।হার্টলেস মানুষদের এসব বোঝার ক্ষমতা থাকে না।দয়া মায়া বলতে তো কোনো বস্তু আপনার ভেতরে নেই।তাই আপনাকে এসব কথা বলাও বেকার।

রোশনির কথায় হাসলো অধির।চোখ থেকে মোটা ফ্রেমের চশমাটা নামিয়ে টি-টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসলো।ডান হাতে সুন্দর দাড়িগুলো ঘষতে ঘষতে বলে উঠলো,

-আসলে কি বলো তো? আমার প্রত্যেকটা কাজই তোমার কাছে খারাপ বলে মনে হয়।হয়তো আমার কাজগুলো তোমার মনের মত হয় না তাই তোমার পছন্দ না।নয়তো আমাকে তোমার পছন্দ নয় তাই আমার কাজগুলোকে তোমার পছন্দ হয় না।তবে যেটাই হোক দুটো একই ব্যাপার।আমরা অনেকেই টিভিতে ডিসকভারি চ্যানেল দেখি।যেখানে একটা সিংহ একটা হরিনের পিছে তাড়া করে। এটা দেখতেই দুনিয়ার সব মানুষ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে ওই হরিনটা যেন কোনো না কোনো ভাবে বেঁচে যায়।হরিন বেঁচে যেতেই খুশিতে হাত তালি দিতে থাকে।টিভি বন্ধ করে দেয়।এরপর সেই মানুষই মুরগি কেটে বিরিয়ানি রান্না করে তৃপ্তি ভরে খায়।আসলে ওরা ওই হরিন বা মুরগির উপর দয়া টয়া করে না ওরা ব্যস ওই সিংহকে ঘৃনা করে।কেন জানো? কারন তারা তো আর সিংহের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না নাহ?তাই এসব বিনয়ের মুখোশ পড়ে মিথ্যে দয়ার ভাষন দিতে থাকে।এন্ড আনফরচুনেন্টলি আমি ওসব মানুষের কাতারে পড়ি না।আমি সিংহ।কারো প্রতি মিথ্যে দয়া আমি দেখায় না।এতে আমি কার কাছে কেমন হলাম তাতে আমার কিছু যায় আসে না।কে আমাকে হার্টলেস ভাবলো তাতেও আমার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।একটা কথা মাথায় রেখো।বেশি সোজা হয়ে লাভ নেই।জঙ্গলে সোজা গাছ কেটে ফেলা হয় আর ব্যাঁকা ট্যারা গাছ গুলোই কিন্তু মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকে।লোকটা ভালো ছিল এই কথাটা শোনার জন্যে যেখানে মরতে হয় সেখানে আমাকে কে কি ভাবলো বা বললো তাতে আমার যায় আসে না।আমি টাকা নই যে সবার পছন্দের বস্তু হবো।

রোদ্র তপ্ত আকাশে হঠাৎই মেঘ জমেছে।নিকষ কালো মেঘে ঢেকে গেছে আকাশের নিজস্ব রঙ।কিছুক্ষন আগেও যেখানে তুলো তুলো মেঘ ভাসছিল সেখানে এখন কালো মেঘের রাজত্ব।শহরের অলিগলি আবছা অন্ধকারে ছেঁয়ে গেছে মুহূর্তেই।অধির টেবিলের উপর থেকে গাড়ির চাবিটা হাতে তুলে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রোশনিকে ডাকতে লাগলো।

-সুইটহার্ট তাড়াতাড়ি এসো।দেরি করলে ঝড়ের মুখে পড়তে হতে পারে।উই আর অলরেডি লেট বাবা।হারি আপ।

রোশনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানার উপর থেকে ওড়না তুলে নিলো।ওড়নাটা গলায় ঝুলিয়ে অধিরের সামনে দাড়াতেই টাইম দেখলো অধির।বললো,

-আকাশে কি ভিষন মেঘ করেছে দেখেছো? এখান থেকে বাড়ি পৌছাতে পাক্কা দুই ঘন্টার মত লাগবে।মাঝ রাস্তায় ঝড় শুরু হলে কি বিপদে পড়তে হবে বুঝতে পারছো? আজ না গেলে হয় না? কাল খুব ভোরেই না হয় বেরিয়ে পড়বো।

রোশনি চুলগুলো ঠিক করে বললো,

-আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে মিষ্টার চৌধুরি।

অধির দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এই মেয়ে তার মতোই জেদি।আজকে যখন যাবে বলেছে তখন যেয়েই ছাড়বে।ওরা বাড়ির ভেতর থেকে যখন বেরোলো তখন মেঘের মৃদু মন্দ গর্জন শুরু হয়ে গেছে।অধির দরজায় তালা লাগিয়ে আকাশের দিকে তাকালো।কিছুক্ষনের মাঝেই বৃষ্টি শুরু হবে।যদি ঝড় ওঠে তাহলে কিভাবে কি করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে।ফার্ম হাউজটা শহর থেকে অনেকটাই দূরে।মাঝরাস্তায় ঝড় শুরু হলে কি করবে তখন? ওই অবস্থায় গাড়ি চালানোটাও ঠিক হবে না।নিজের জন্যে চিন্তা না হলেও রোশনির জন্যে চিন্তা হচ্ছে তার।মেয়েটার জেদের কাছে হার মেনেই তাকে এই পরিবেশে বের হতে হচ্ছে।বাড়ির চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে পেছনে ফিরতেই দেখলো রোশনি বিষ্ময় নিয়ে চারপাশটা দেখছে।অধির সানগ্লাসটা টি-শার্টের গলায় ঝুলিয়ে এগিয়ে গেলো রোশনির দিকে।মাথাটা একটু ঝুকিয়ে রোশনির কানের কাছে এসে গলার স্বর নিচু করে বললো,

-সুইটহার্ট তোমার জায়গাটা ভালো লাগলে আমরা থেকে যেতে পারি।

অধিরের কথায় চমকে দূরে সরে দাড়ালো রোশনি।সামনের চুলগুলোকে কানের পাশে গুজে বললো,

-তেমন কোনো ব্যাপার না।এতো গাছ চারপাশে। দেখতে ভালো লাগছে।মনে হচ্ছে ছোট খাটো একটা সুন্দর জঙ্গলের মধ্যে এই বাড়িটা।এই টাইপ বাড়ি আমি তূর্কি নাটকে একবার দেখেছিলাম।এটাও অনেকটা ওই রকম তাই দেখছিলাম।

-তোমার ভালো লেগেছে জায়গাটা? ঠিক আছে মাঝে মধ্যেই তোমাকে এখানে নিয়ে আসবো।এবার চলো নয়তো ঝড় উঠলে সত্যিই বিপদে পড়বো।

কথাটা বলে অধির পা বাড়ালেও রোশনি আগের মতোই আশে পাশে দেখতে লাগলো।অধির বুঝলো জায়গাটা রোশনির ভালো লেগেছে।ভালো লাগার মতোই জায়গা এটা।চারপাশে অনেক অনেক গাছ।বাড়ির চারপাশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।বাড়িতে ঢোকার গেটটাও খুব বেশি বড় নয়।ছোট খাটো লোহার গেটটার পর থেকেই দুপাশে প্রাচীরের মত উচু দেয়াল।তাতে লতাটাইপ গাছের পাতায় ঢাকা।সবুজের মাঝে ছোট্ট একটা দুতলা বাড়ি।বাড়ির চারপাশে অনেক গুলো নারকেল গাছ লাগানো।বাইরে থেকে বোঝায় যায় না এই গাছপালার মধ্যে এমন সুন্দর একটা বাড়িও আছে।অধির মুচকি হেসে রোশনির দিকে এগিয়ে এলো।বললো,

-সুইটহার্ট? এই জায়গা আর তোমার বর কেউই হারিয়ে যাচ্ছে না।পরে আবারো দেখতে পাবে।এখন চলো।

অধির রোশনির হাত ধরে সামনের দিকে হাটতে লাগলো।রোশনি অধিরের মুঠো থেকে নিজের হাত বের করার জন্যে মোচড়ামুচড়ি করতেই আরো শক্ত করে চেপে ধরলো অধির।ছোট গেটটাতেও তালা ঝুলিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো দুজন।গাড়ি চলতে শুরু করলো চৌধুরি ম্যানশনের উদ্দেশ্যে।রোশনি জানালার বাইরে মুখ বের করে শ্বাস নিলো।ততোক্ষণে বাইরে বাতাস শুরু হয়ে গেছে।রোশনিকে জানালার বাইরে মুখ বের করতে দেখে রোশনির হাত ধরে টান দিলো অধির।রোশনি ভ্রু কুচকে তাকাতেই অধির গাড়ির জানালা লক করে দিলো।রোশনি হাত ঝামটা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলো অধিরের থেকে।রোশনি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো গাড়ির কাঁচ উঠানো।বিরক্ত চোখে অধিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

-জানালা কেন লক করলেন?

অধির ড্রাইভ করতে করতেই জবাব দিলো।বললো,

-কি করবো বলো? গাড়িতে একটা ছোট বাচ্চা যে আছে।জানালা দিয়ে যেভাবে মুখ বের করছে কখন কি বিপদ ঘটে যায় তার ঠিক নেই।বাচ্চাটা তো আর সেটা বুঝছে না।

-বেশি বাজে না বকে লক খুলুন।আমার আটকা জায়গায় নিশ্বাস নিতে প্রবলেম হয়।তাড়াতাড়ি খুলুন বলছি।

-রোশনি জিদ করো না।বাইরে দেখো ঝড় শুরু হয়ে গেছে অলরেডি।কি পরিমানে ধুলো উড়ছে। নাকে মুখে ধুলো গেলে তোমারই প্রবলেম হবে।

-আমার জন্যে এতো ভাবতে হবে না আপনাকে।আপনি শুধু লকটা খুলে দিন। আটকা জায়গায় দম বন্ধ লাগে আমার।

অধির জানালা খুললো না।গাড়িতে এসি অন করে দিলো।রোশনির এবার কিছুটা ভালো লাগতে লাগলো।প্রায় ঘন্টা খানিক যেতে না যেতেই ঝড়ের গতি তীব্র হলো।অধির এই ভয়টাই পাচ্ছিলো।এই অবস্থায় ড্রাইভ করাটা ভিষন রিস্কি। অধির গাড়িটাকে এক সাইড করে দাড় করালো।আশে পাশে কোনো বাড়ি ঘর এমনকি মানুষের পর্যন্ত কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।অধির একহাত স্টেয়ারিং এ রেখে বললো,

-এতোক্ষন ধরে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম।এই অবস্থায় গাড়ি চালানো সম্ভব নয়।আর গাড়িতে এভাবে থাকাটাও সেইভ নয়।

অদিরের মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো।কপালে দু তিনটে ভাজ দেখা গেলো।হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো পাঁচটার বেশি বাজে।রোশনিও কাচুমাচু হয়ে বসে আছে।এখন বুঝতে পারছে জিদ দেখিয়ে এভাবে আসাটা তাদের ঠিক হয় নি।অধির কতবার মানা করলো।আজকের রাতটা থেকে গেলেই ভালো হতো।হঠাৎই প্রচন্ড জোরে বাজ পড়ায় রোশনি বাম হাতটা তুলে অধিরের ডানহাতটা খামচে ধরলো।রোশনির নখগুলো সাথে সাথেই দেবে গেলো অধিরের হাতে।হালকা আওয়াজ করে রোশনির দিকে তাকাতেই দেখলো রোশনি চোখ মুখ খিঁচে বসে আছে।অধির হাত সরালো না।হাতের দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসলো।একহাতে সিটবেল্ট খুলে ঝুকে গেলো রোশনির দিকে।রোশনির সিটবেল্টও খুলে দিলো।অধিরকে এতো কাছে আসতে দেখে চোখ খুলে তাকালো রোশনি।অধিরের খামচে ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো।সাথে সাথে হাত সরিয়ে অসহায় চোখে তাকালো।

-সরি।আমি ইচ্ছে করে করি নি।

অধির কিছু বললো না।টিস্যু দিয়ে হাতের উল্টোপিঠের রক্তটুকু মুছে সোজা হয়ে বসলো।রোশনি বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

-খুব জোরে ঝড় হচ্ছে।আমার ভয় করছে ভিষন।আশে পাশে তো কোনো বাড়িঘরও চোখে পড়ছে না।

অধির রোশনির দিকে তাকিয়ে দেখলো রোশনি প্যানিক হয়ে পড়ছে।

-রিলাক্স সুইটহার্ট। এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? আমি আছি তো তোমার কাছে।

-আপনি বুঝতে পারছেন না।আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।প্লিজ কিছু করুন।

-আমার কাছে একটা উপায় আছে।কিন্তু মনে হয়না তোমার সেটা ভাল লাগবে।আমাকেই খারাপ আর অসভ্য বলবে।তার থেকে এভাবেই বসে থাকো।তোমার জেদের জন্যেই তো আসতে হয়েছে।

-প্লিজ যা করার করুন।আমি কিছু বললো না।আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।

অধির শব্দহীন হাসলো।হাত বারিয়ে রোশনিকে ওর সিট থেকে তুলে এনে নিজের কোলের উপর বসালো।রোশনির মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো,

-এবার লম্বা শ্বাস নাও সুইটহার্ট। শুধু আমার হার্টবিট শুনতে থাকো।আশে পাশে কান দিয়ো না।শুধু আমার হার্টবিট শুনো।এখানে ম্যাজিক আছে।তোমার আর কষ্ট হবে না।

রোশনি তাই করলো।লম্বা শ্বাস টেনে শান্ত করলো নিজেকে।কান পেতে শুনতে লাগলো অধিরের হার্টের ঢিপঢিপ শব্দ।রোশনির এক হাত অধিরের পিঠে আর এক হাত বুকের কাছে টি-শার্ট খামচে ধরে আছে।অধির নিঃশব্দে হাসলো।ধন্যবাদ দিলো মেঘকে।তার জন্যেই তো তার তিলোককন্যাকে এতোটা কাছে পেলো সে।অধির চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো।মনে মনে বললো বাইরের এই ঝড় যেন আরো অনেক অনেক সময় ধরে হয়।সে যেন আরো অনেকটা সময় পায় তার তিলোককন্যাকে এভাবে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখার।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here