শেষ বিকেলের আদর❤️পর্ব : ২৮

0
3708

#শেষ বিকেলের আদর❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
পর্ব : ২৮

🌼
ঘড়ির কাটা তখন সাতটার ঘরে।মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা অলস ভঙ্গিতে ঘুরছে।বাইরে বৃষ্টির প্রকোপ এখন কিছুটা কম।ঘর জুড়ে নিস্তব্ধ নিরবতা।থমথমে নিরবতা কাটিয়ে নড়ে চড়ে আরাম করে বসলেন মিসেস আনোয়ারা চৌধুরি।দূর্বল হাতে চোখের চশমাটা নাকের ডগা থেকে ঠেলে দিয়ে সোজা চোখে তাকালেন অধিরের দিকে।গুরুগম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,

-এসব কেমন রসিকতা অধির? গত একদিন ধরে তুমি বাড়ি ফেরো নি।আর এখন যখন ফিরলে তখন একেবারে বিয়ে করে ফিরলে? তুমি কি দিদামের কথা ভুলে গেছো নাকি তার সাথে তুমি এংগেজ্ড এটা ভুলে গেছো? এমন বাচ্চাদের মত কাজ করার মানে কি? তুমি নিজেই দিদামকে পছন্দ করেছিলে বিয়ে করার জন্যে।তাহলে ওকে ছেড়ে রোশনিকে কেন?আমি কিছু জানতে চাইছি অধির।চুপ করে থেকো না।

দাদিকে উত্তেজিত হতে দেখে মুখ খুললো অধির।বললো,

-রিলাক্স দাদি।সব বলছি তোমায়।রোশনির সাথে বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেছে।তাই তোমাকে জানাতে পারি নি।আমি হঠাৎ করেই ওর সাথে জড়িয়ে গেছি।রোশনিতে হঠাৎ করেই আটকে গেছি।লন্ডন যাবার পর থেকে ক্রমাগত শুধু ওর কথায় মনে পড়েছে।ওর সাথে কথা না বললে, ওকে না দেখলে অস্থির লাগত।উন্মাদ মনে হতো নিজেকে।আমি জানিনা ওর প্রতি আমি কবে দূর্বল হয়ে পড়েছি।উঠতে বসতে শুধু ওর কথায় মনে হতো।চেষ্টা করিনি তা নয়।চেষ্টা করেছিলাম ওর থেকে দূরে থাকতে।কিন্তু পারি নি। দিদামের প্রতি চেয়েও কোনো ফিলিংস তৈরি করতে পারি নি আমি।কারো মুগ্ধতায় একবার আটকে গেলে আর অন্য কাউকে ভাল লাগে না।আমি রোশনির মুগ্ধতায় আটকে গেছিলাম।।যখন বুঝতে পারলাম রোশনিকে ছাড়া আমার চলবে না তখন বিয়ে করে নিলাম।তোমাদের জানানোর সুযোগ হয়ে ওঠে নি।সবকিছু এতো দ্রুত হয়ে গেলো যে। সরি দাদি।আমার তোমাকে জানানো উচিত ছিলো।

তখনই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো সাহিল আর আদি।সাহিল এগিয়ে এসে বললো,

-তুই যখন বললি তুই আমার ভাবি নিয়ে ফিরবি আমি ভেবেছিলাম দিদামের কথা বলছিস।বিশ্বাস কর আমি মোটেও এটা আশা করি নি।

আদি এক গাল হেসে অধিরকে জড়িয়ে ধরলো।টুপ করে অধিরের গালে চুমু দিয়ে বলে উঠলো,

-ভাইয়া ইউ আর দা বেস্ট।আজ আমি ভিষন খুশি।ওই ইউনিভার্স চুড়েলের থেকে অবশেষে তোমার মুক্তি হলো।রোশনি আপুকে আমার ভিষন পছন্দ। আই মিন টু ছে ভাবি হিসেবে।খুশিতে তো আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।উফফ দিদামের মুখটা দেখতে যা লাগছে না।

অধির ভ্রু কুচকে বললো,

-রোশনি কোথায়?

-নিচে।

অধির দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে এলো।নিচে নিশ্চয় ওকে সবাই কথা শুনাচ্ছে।অধির দ্রুত নিচে নামতেই কানে এলো ওর মায়ের কথা।

-এই মেয়ে কোন সাহসে আমার ছেলেকে বিয়ে করেছো? তোমার কোনো যোগ্যতা আছে চৌধুরি বাড়ির বউ হওয়ার? এ বাড়ির ছেলের বিয়ের অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে এসে নিজেই বিয়ে করে নিলে? আমার ছেলেকে কি দিয়ে ফাঁসালে শুনি?

পাশ থেকে তেড়ে এলো দিদাম।রোশনির সামনে দাড়িয়ে বলে উঠলো,

-বুঝতে পারছো না আন্টি।এই রুপের জ্বালে ফাঁসিয়েছে অামার অধিরকে।তাছাড়া আর কি অাছে এই মেয়ের কাছে।দুপয়সার মেয়ে।সব সময় লক্ষ্য করেছি এই দুপয়সার মেয়ে আমার অধিরের পেছনে ঘুরঘুর করছে।।এসব মেয়েদের কাজই এসব করে বেড়ানো।রুপ দেখিয়ে বড় লোকের ছেলেকে ফাঁসিয়ে তার টাকা পয়সা হাতিয়ে নেওয়া ধান্দা। ।বাবা মা তোমাকে এসবই শিখিয়েছে না? তোমাকে দেখলেই বোঝা যায় তোমার বাবা মা কেমন।

রোশনি এবার মুখ তুলে তাকালো।এতোক্ষন অনেক কথা সে সহ্য করেছে।আর না।বিয়েটা সে নিজের ইচ্ছেই করে নি। জোর করা হয়েছে তাকে।তাহলে এতো কথা তাকে কেন শুনতে হবে? এতোক্ষন চুপ থাকলেও এখন আর থাকবে না।এখানে তার বাবা মাকে পর্যন্ত অপমান করছে এই মেয়ে।রোশনি রাগি চোখে তাকালো।চোখ মুখ শক্ত করে বললো,

-খবরদার আমার বাবা মাকে নিয়ে কিছু বলেছো তো? এতোক্ষন আমাকে নিয়ে বলেছো আমি কিচ্ছু বলি নি।আমার বাবা মাকে নিয়ে একটা বাজে কথা বলবে তো জিব টেনে ছিড়ে দেবো।

রোশনির কথায় খানিক ভড়কে গেলো দিদাম।মিসেস ঝুমা চৌধুরি তেড়ে এলেন রোশনির দিকে।বললেন,

-এই মেয়ে তোমার সাহস কি করে হয় দিদামের সাথে এভাবে কথা বলার? তুমি জানো ও কে? এ বাড়ির হবু বউ।চাইলে তোমাকে আমি এখুনি বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি।মুখে লাগাম দাও বুঝেছো? নয়তো আমি কি করতে পারি ভাবতেও পারবে না।

রোশনি কিছু বলবে তার আগেই ছুটে এলো অধির।চোয়াল শক্ত করে বললো,

-স্টপ মম।তুমিও বোধহয় একটা কথা ভুলে যাচ্ছো।দিদাম এ বাড়ির হবু বউ ছিলো।এখন রোশনি এ বাড়ির বউ।তাই তুমি চাইলেও ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারো না।আই এম সাইলেন্ট বিকজ আই হেইট ড্রামা।কিন্তু তোমাদের জন্যে আমার মুখ খুলতেই হলো।

-তুই আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছিস অধির?তোর মাকে এই মেয়েটা অপমান করলো আর তুই ওর পক্ষ নিয়েই কথা বলছিস? এতোটা বদলে যাবি আমি ভাবতেও পারি নি?

কথা গুলো বলেই কান্না শুরু করলেন উনি।অধির মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আমি সবটা শুনেছি মম।রোশনি তোমাকে অপমান করে নি।ইনফ্যাক্ট ও কাউকেই অপমান করে নি।ও শুধু দিদামকে সাবধান করেছে।আর কি বললে রোশনিকে? লাগাম দিতে তাইতো? লাগাম ঘোড়াকে দেওয়া হয় মম।কখনো শুনেছো সিংহকে লাগাম দিতে? আমার বউ সিংহী মম।আর একটা কথা।আমি পাল্টে যায় নি।তোমার ছেলে যেমন ছিলো তেমনই অাছে।তোমার ছেলে শুধু নিজের বউকে প্রটেক্ট করছে।এটাকে পাল্টে যাওয়া বলে না মম।

অধির রোশনির হাত ধরে চলে যেতে গিয়েও থেমে গেলো।চোয়াল শক্ত করে দিদামের দিকে তাকিয়ে বললো,

-ফারদার আমার বউকে নিয়ে খারাপ কথা বলার সাহস কেউ যেন না করে।আর একটা টু শব্দও যেন আমার কান পর্যন্ত না পৌছায় এই মুহূর্তে।

অধির আর দাড়ালো না।রোশনির হাত ধরে নিজেদের রুমে চলে গেলো। কোনায় দাড়িয়ে অধিরের সব কথায় শুনেছে মিসেস আনোয়ারা, সাহিল,আদি আর নাতাশা।রোশনির প্রতি অধিরের ভালোবাসা দেখে মিসেস আনোয়ারা চৌধুরি ভিষন খুশি।অবশেষে তার নাতিটা সঠিক মানুষের সন্ধান পেয়েছে।

-এই নিয়ে আর কতো ড্রামা চলবে কে জানে? বড় মা এতো তাড়াতাড়ি সবকিছু মানবে না।

সাহিলের কথার প্রেক্ষিতে মিসেস আনোয়ারা বললেন,

-মানবে কি মানবে না সেটা তো সময়ই বলবে।

আদি এতোক্ষন হাসি হাসি মুখে সবটা ইনজয় করলেও এবার মুখ গোমড়া করে দাড়ালো।দাদির দিকে চোখ মুখ কুচকে বললো,

-তোমরা সব সময় এই কথাটা কেন বলো বলোতো? সময় বলে দেবে।সময় বলে দেবে।সময় কিভাবে বলবে? কাকে বলবে? এই ঘড়ি বলবে? মুখ আছে ওর?

আদির কথায় হাসলেন মিসেস আনোয়ারা।আদির মাথায় চাটা মেরে বললেন,

-সময়ের মুখ না থাকলেও সে বলতে পারে।সময়ই সবকিছু বলে দেয়।বুঝিয়ে দেয়।কিন্তু তোর তো মাথা থেকেও ব্রেইন নেই হনুমান।

আদি ঠোট ফুলিয়ে তাকালো।কি সুন্দর লজিক দেখালো সে অথচ তাকে পাত্তাই দিলো না কেউ।উল্টে তাকে হনুমান বলে চলে গেলো।নাতাশা আর দাদি চলে যেতেই সাহিল ভ্রু কুচকে বললো,

-আদি…? আমার যা লাগছে তোরও কি তাই লাগছে?

-হুম।অনেক জোরে লেগেছে।

সাহিল ভ্রু কুচকে তাকালো।বললো,

-মানে? কি লেগেছে তোর?

আদি নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলো,

-কেনো হিশু।ভিষন হিশু লেগেছে।

আদির কথায় ওর মাথায় গাট্টা মারলো সাহিল।বললো,

-আমি তোকে এটা জিজ্ঞাসা করেছি ফাজিল?

-তো আমি কি করে জানবো তোর মনে কি চলছে এই মুহূর্তে?

সাহিল এবার সিরিয়াস হয়ে দাড়ালো।বললো,

-কিছুতো গন্ডগোল আছে।অধির কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ বিয়ে করে ফেললো।কিছু তো একটা ঘাপলা নিশ্চয় আছে।সেটাই খুজে বের করতে হবে আমাদের।বুঝেছিস?

আদি মাথা দুলিয়ে হ্যা বললো।সাহিল ওর মাথায় আরো একটা গাট্টা মেরে ওকে নিয়ে চলে গেল।
রোশনিকে নিয়ে রুমে আসতেই রোশনি হাত ছাড়িয়ে নিলো অধিরের থেকে।ভ্রু কুচকে বললো,

-আপনার কোনো প্রয়োজন নেই আমাকে প্রটেক্ট করার।আমি নিজেই নিজেকে প্রটেক্ট করতে পারি।বেশি স্বামি গিরি দেখাতে হবে না।

অধির তাকালো রোশনির দিকে।বললো,

-আমি জানি তুমি শেরনি। নিজেই নিজের প্রটেক্ট করতে পারো।আর আমি স্বামি গিরি দেখাচ্ছি না।শুধু তোমাকে রক্ষা করেছি।স্বামি হিসেবে আমারো দায়িত্ব আছে তোমাকে প্রটেক্ট করা।সো আমার যেটা করা উচিত মনে হয়েছে সেটাই করেছি।বাই দা ওয়ে। আয়াশকে কাল সকালে দেখতে পাবে।এই বৃষ্টির মধ্যে ওকে আনতে চাচ্ছি না আমি।আজকের রাতটা ওয়েট করো। ও যেখানেই আছে ভালো আছে।

রাত তখন এগারোটা বাজে।অধির বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।রোশনিকে খাটের পাশে ঠাঁই দাড়িয়ে থাকতে দেখে অধির ভ্রু কুচকে তাকালো।বললো,

-এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? শুয়ে পড়ো।

-আপনি বিছানায় বসে আছেন। আমি কিভাবে শোবো?

অধির ভ্রু কুচকে তাকালো। বললো,

-মানে? এতো বড় বিছানায়ও তোমার হবে না?

-সেটা কখন বললাম?আপনি বিছানায় বসে আছেন তো আমি কিভাবে শোবো? আপনি বিছানা থেকে সরুন।

-সরুন মানে? বিছানা ছেড়ে কোথায় যাবো আমি?দেখো রোশনি,,,তুমি যদি বাংলা সিরিয়ালের মত এখন বলো যে তুমি আমার সাথে এক বিছানায় থাকতে পারবে না।তাহলে আগে থেকেই বলে দিচ্ছি আমি এসব শুনতে ইচ্ছুক নই।আর আমি ওই ট্রিপিক্যাল হাসবেন্ডদের মত বিছানা ছেড়ে সোফায় গিয়েও শুতে পারবো না।বউ তুমি আমার।তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।সেটাও এক বিছানায়।আর এটা নিয়ে যদি বেশি বাড়াবাড়ি করো তবে শুধু এক বিছানাতেই না এক বালিশে শোয়ানোর ব্যবস্থা করবো বলে দিলাম।তুমি ভালো করেই জানো আমি যা বলি তাই করি।সো কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়ো।আমি আমার বউ ছাড়া ঘুমাতে পারবো না।

রোশনি বিরক্ত চোখে তাকালো।বললো,

-আপনি ভিষনই অসভ্য একটা মানুষ।আই হেইট ইউ।

-জানি আমি।নতুন কিছু বলো।

-ঘৃনা করি আপনাকে।ঘৃনা করি আপনার নামকে।আপনার ক্যারেক্টারকে।আপনার চেহারাকে।

অধির চোখ থেকে চশমা খুলে সাইড টেবিলে রাখলো।ল্যাপটপটা বন্ধ করতে করতে বললো,

-তুমি কি আমার সাথে এক বালিশে শুঁতে চাচ্ছো সুইটহার্ট? তোমায় বলেছিলাম চুপচাপ শুয়ে পড়তে।

-আপনি আমার উপর জোর করতে পারেন না।পারেন না আমাকে এভাবে হিউমিলিয়েট করতে।

-সুইটহার্ট আমি তোমায় হিউমিলিয়েট করছি না।বউ তুমি আমার।তোমার উপর সম্পূর্ন অধিকার আছে আমার।তোমার সাথে এক বিছানায় এক বালিশে শোয়ারও অধিকার আছে আমার।সেটাই মনে করিয়ে দিচ্ছি। যাইহোক আমার এখন ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না।তুমি ওইপাশে শুয়ে পড়ো।আর আমি এদিকটাই শুঁচ্ছি।ট্রাস্ট মি আমি তোমার দিকে যাবো না।

রোশনিও কিছু বললো না আর।চুপচাপ শুয়ে পড়লো পাশ ফিরে।কে জানে জয় কেমন আছে।তাকে নিশ্চয় ফোনে না পেয়ে চিন্তা করছে।আর পিয়া? ওই বা কি করছে কে জানে।রোশনির চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।অধিরকে খুন করার বিশ্রী ইচ্ছেটাকে সাইডে রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here