সংগোপনে’ পর্ব-১

0
5593

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_১
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

রাত একটা দশ, ল্যাপটপের স্ক্রীনে মুখ গুজে বসে আছে কুহেলি। না, কোনো মুভি বা নেটফ্লিকস সিরিজে ডুবে নেই সে, একটা প্রজেক্ট নিয়ে বসেছে। কালকেই অফিসে সাবমিট করতে হবে, অফিস থেকে ফিরতেও আজ লেট হয়েছে, আসলে আগামীকাল এই প্রজেক্ট টা নিয়ে একটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং রয়েছে, আর এই প্রজেক্ট টার দায়িত্ত্ব পুরোটাই কুহেলির ওপর, তাই কাজের চাপটাও সব থেকে বেশি ওর উপরেই এসে পড়েছে। তাতে অবশ্য কোনো আক্ষেপ নেই ওর, কাজটা ওর ভালোবাসার জায়গা, তাই হাজার পরিশ্রমেও ক্লান্তি আসে না। অফিসে ওর কলিগরা তো ওকে রীতিমত ওয়ার্কোহলিক বলে খেপায়। কুহেলির কাছে ওর কাজটা সত্যিই একটা নেশার মত, খাটি বাংলায় বলতে গেলে এক্কেবারে কাজ পাগল। তাই তো, অফিসে অতিরিক্ত সময় অবধি কাজ করে এসেও বাড়ি ফিরেই কোনরকমে ডিনার টুকু সেরেই আবার বসে পড়েছে ল্যাপটপ নিয়ে। এদিকে ঘড়ির কাটা যে নিজের মনে চলতে চলতে একটার ঘর পেরিয়ে গেছে, সেদিকে ওর কোনও হুশই নেই। অবশেষে, যখন প্রজেক্ট টা সম্পূর্ণ হল তখন পৌনে দুটো বাজে। ল্যাপটপ টা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল কুহেলি। কালকে আটটার মধ্যে অফিস পৌঁছতে হবে, কাজ করতে করতে এতটা লেট হয়ে গেছে টের পায়নি, চট করে একবার ওয়াশরুম থেকে ঘুরে এসে লাইটটা অফ্ করে সবে শুয়ে চোখটা বন্ধ করেছে অমনি পাশে রাখা মুঠোফোনটা টুং টাং শব্দে আওয়াজ করে উঠল। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে নিজের মনেই বলে উঠল,

উফ্, এত রাতে আবার কে?

ফোনটা চোখের সামনে আনতেই দেখতে পেল, লক স্ক্রীনের ওপর ভেসে উঠেছে ফেসবুকের নোটিফিকেশন, “ইউ হ্যাভ এ নিউ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট”। কখন যেন ডেটা কানেকশন টা অন করে আর অফ করা হয়নি, এরকম অবশ্য মাঝেমাঝেই হয় ওর, কাজের মধ্যে ডুবে গেলে অনেক সময় ও খেতেও ভুলে যায়। এই মুহূর্তে কুহেলির আর নোটিফিকেশন টা ওপেন করতে ইচ্ছে করল না, এমনিতেই অনেক লেট হয়ে গেছে, আবার সকাল সকাল উঠতে হবে, কয়েক ঘন্টার সলিড ঘুমটা একান্তই প্রয়োজন। ডেটা কানেকশনটা অফ্ করে, নোটিফিকেশন টা রাইট সোয়াইপ করে স্ক্রীন থেকে সরিয়ে দিল, তারপর ফোনটা পাশে রেখে দিয়ে চোখ বন্ধ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। মনের ক্লান্তি না আসলেও শরীরের ক্লান্তি তো আসেই, ওকে বরং একটু ঘুমোতে দেওয়া যাক, ততক্ষণ আসুন কুহেলির সঙ্গে আপনাদের আলাপটা করিয়ে দিই। স্বর্গীয় অরিন্দম বসু এবং শ্রীমতী চৈতালী বসুর একমাত্র মেয়ে কুহেলি বসু, মায়ের আদরের কুহু। শুধু মায়ের বললাম, কারণ বাবার সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য কুহেলির হয়নি, ছোট থেকে মা আর ঠাম্মুই ওর সব। কুহেলি যখন অনেক ছোট, সবাইকে দেখত বাবার হাত ধরে স্কুলে আসতে, ওর ছোট্ট মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত। সবাই কত আবদার করত তাদের বাবার কাছে, কিন্তু ছোট্ট কুহেলির কাছে বাবার স্মৃতি টুকুও ছিল না, ছিল শুধু কতগুলো নিষ্প্রাণ ছবি। ওর যখন মাত্র তিন বছর বয়স তখন ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেননি অরিন্দম বাবু। ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী, ওর ঠাম্মু শৈলজা দেবী ওকে বলেছিলেন ওর বাবা নাকি শহীদ হয়েছিলেন। সেদিনের ছোট্ট কুহু শহীদ শব্দটার মানে বোঝেনি, শুধু এইটুকুই বুঝেছিল ওর বন্ধুদের মত ওর বাবা ওর কাছে নেই। চৈতালী দেবী কলকাতা শহরের অন্যতম নাম করা গাইনোকলজিস্ট দের মধ্যে একজন, তাই অরিন্দম বাবুর অবর্তমানে ওদের সংসারে আর্থিক অভাবের ছায়া পড়েনি ঠিকই, কিন্তু কুহেলির ভবিষ্যতের জন্যই ধীরে ধীরে চৈতালী দেবী আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অরিন্দম বাবু চলে যাওয়ার পর কুহেলি তার বেচে থাকার একমাত্র সম্বল, কিন্তু সেই কুহেলিকেই ঠিক মত সময় দিতে পারতেন না। বেশিরভাগ দিনই বাড়ি ফিরে দেখতেন তার কুহু ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুমন্ত মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চোখটা ভিজে আসত, এই সময়টা শৈলজা দেবী তার মমতার আঁচল দিয়ে চৈতালী দেবীর কষ্ট কিছুটা কম করার চেষ্টা করতেন। মাঝে মাঝে কুহেলির খুব রাগ হত, বাবাকে তো মনেই পড়ে না, আর মাকেও ঠিক মত কাছে পেত না। কিন্তু এই রাগটা সময়ের সাথে সাথে দুর হয়ে গিয়েছিল, একটু বড় হওয়ার পর যখন শহীদ কথাটার অর্থ বুঝতে পেরেছিল, তখন আর রাগ হত না, মানুষটার প্রতি একটা শ্রদ্ধা জন্মেছিল, গর্ব হত খুব, আর ওর ভবিষ্যতের জন্য চৈতালী দেবীর আত্মত্যাগ ওর মনে সৃষ্টি করেছিল অফুরন্ত সন্মান আর ভালোবাসার। কুহেলির জীবনের শ্রেষ্ঠ দুজন নারী ওর মা আর ঠাম্মু, এরা দুজনেই সারাজীবন নিজের খুশির আগে ওর খুশির কথা ভেবে এসেছেন। তাই কুহেলি একটু বড় হলেই ঠিক করে নিয়েছিল, ওর মা আর ঠাম্মুর বাকি জীবন টা খুশিতে ভরিয়ে দেবে, আর তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন ছিল আত্মনির্ভর হওয়ার। সেই তখন থেকেই ওর জীবনের লক্ষ্য ও ঠিক করে নিয়েছিল, পড়াশুনোতে দুর্দান্ত না হলেও বেশ ভালোই ছিল। একে একে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক দুটোতেই বেশ ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করল, তারপর কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে ব্যাঙ্গালোর ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ। এই ব্যাঙ্গালোরে পড়ার ব্যাপারে অবশ্য চৈতালী দেবী ভিষন আপত্তি করেছিলেন, আসলে তার আদরের কুহুকে চোখের আড়াল করতে চাইছিলেন না, কিন্তু পরে ঠিক রাজি হয়ে যান। কলেজ ক্যাম্পাসিংয়ে এই জব টা হয়ে যায়, ব্যাঙ্গালোরেই। চৈতালী দেবী প্রথম প্রথম একটু আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত আর বাধা দেননি। একবছর হল এই চাকরিটায় জয়েন করেছে কুহেলি, এরমধ্যেই কাজের জন্য বেশ প্রশংসিত হয়েছে। কুহেলির ইচ্ছে আরেকটু সেটল হয়ে চৈতালী দেবী আর শৈলজা দেবীকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে, সারা জীবন তো শুধু কষ্টই করে গেলেন। কুহেলি ছোট থেকেই খুব দায়িত্বশীল, স্টুডেন্ট লাইফে ছিল পড়া পাগল আর এখন কাজ পাগল। কিন্তু তাইবলে কুহেলিকে বেরসিক গোমড়ামুখো সিরিয়াস টাইপের মেয়ে ভেবে ভুল করবেন না যেন, ওর মত প্রাণ খুলে আনন্দ করতে খুব কম মানুষই পারে, স্কুল কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া থেকে শুরু করে সিনেমা দেখা কোনোটাই বাদ যেত না, কিন্তু সবটাই পড়াশোনা ঠিক রেখে। এখন যদিও কাজের চাপটা অনেক বেশি, তাই বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে খুব একটা সময় কাটাতে পারে না, কিন্তু মাঝে মধ্যেই সময় পেলেই ছোটখাট আড্ডা গুলোয় যোগ দিয়ে আসে। এই তো, গত রবিবার ওর বান্ধবী ঈশার জন্মদিন ছিল, চুটিয়ে মজা করে এসেছে। শুধু প্রেমের দরজাটা বন্ধ করে রেখেছে, সেই কৈশোর থেকেই, ওর ধারণা এই সব প্রেম ভালোবাসা শুধুমাত্র সময়ের অপচয়। ভবিষ্যত গড়ার সময় অযথা একটা অতিরিক্ত সম্পর্কে জড়িয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কোনও মানে হয় না। নিজের পারফেক্ট লাইফের যে ছবিটা কুহেলি একে রেখেছে তাতে প্রেম ভালোবাসার জন্য আপাতত দুর দূরান্ত পর্যন্ত কোনও জায়গা নেই। দেখা যাক কি হয়, তবে সে তো পরের কথা, সময়ের সাথে সাথে সেটা তো দেখাই যাবে। এই হল কুহেলি বসু। এই দেখুন আপনাদের সাথে কথা বলতে বলতে তো সকাল হয়ে গেল, চলুন দেখি কুহেলি কি করছে। ঠিক ছটায় অ্যালার্মের প্রথম আওয়াজের সঙ্গেই কুহেলির ঘুম ভেঙে গেল, রুটিন মাফিক ঘুম থেকে উঠেই আগে স্নান সেরে নিল। এটা ওর অনেকদিনের অভ্যেস, ঘুম থেকে উঠে ওর প্রথম কাজ স্নান করা। স্নান সেরে বেরোতে বেরোতেই গীতা এসে পড়ল। গীতা এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা, গীতা থাকায়, রান্না বান্না করা, বাসন মাজা, ঘর দোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এইসব দিকে কুহেলির ফিরেও তাকাতে হয় না। স্বামী আর একটা ছেলে নিয়ে কুহেলির অ্যাপার্টমেন্ট এর কাছেই একটা কলোনিতে থাকে গীতা। ভারী মিশুকে আর বিশ্বস্ত, কুহেলি তো ওকে ফ্ল্যাটের একটা চাবি দিয়ে রেখেছে। গীতা ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিলে ও খেয়ে অফিসে চলে যায় আর তারপরে গীতা বাকি সব কাজ সেরে অন্য কাজে যায়। আজকেও গীতা এসেই আগে কিচেনে ঢুকে চটপট দুটো ডিমটোস্ট বানিয়ে এনে কুহেলিকে দিল। কুহেলি খেতে খেতে বলল,

সচ মে গীতা দি, তুম নহি হোতি তো মেরা ক্যায়া হোতা।

গীতা হেসে বলে,

ম্যায় নহি হোতি তো কোই অর হোতা।

কুহেলি জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,

একদম না, তোমার জায়গা কেউ নিতে পারবে না, কোই নহি।

গীতা আর কিছু না বলে হেসে আবার রান্নাঘরে চলে যায়, ওর এখনও অনেক কাজ বাকি। কুহেলি মাঝে মাঝেই গীতার সঙ্গে বাংলায় কথা বলে, একবছর ধরে কুহেলির কাছে কাজ করতে করতে গীতা এখন বাংলা বলতে না পারলেও বুঝতে পারে। কুহেলি চট করে ওর ব্রেকফাস্ট শেষ করে রেডি হয়ে নিল, অফিসে ড্রেস নিয়ে বেশ কড়াকড়ি, ফরমাল ছাড়া একদম আল্যাও নয়। আজকে কুহেলি একটা ডীপ সী গ্রীন কালারের ফর্ম্যাল প্যান্ট আর হোয়াইট শার্ট পরল। লম্বা চুলটা একটা পনি করে ছেড়ে দিল, কুহেলির সাজতে বেশ ভালই লাগে কিন্তু অফিসে বেশি সেজে গুজে যেতে ওর মোটেও ভালোলাগে না। ঠোঁটে হালকা করে ন্যুড লিপগ্লস লাগিয়ে চোখে সরু করে আইলাইনার লাগিয়ে নিল, তারপর পারফিউমের ছোয়া মেখে যখন সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে ব্যাগটা কাধে নিয়ে বেরোল তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে সাতটা ছুয়েছে। জয়েন করার কয়েকদিনের মধ্যেই দেখেশুনে এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিল কুহেলি, অফিসের একদম কাছে না হলেও ওই কাছাকাছিই বলা চলে, ক্যাবে মিনিট পনেরো লাগে। অফিসে আটটার আগেই পৌঁছে গেল, ওদের বস মিস্টার শর্মা এখনও এসে পৌঁছাননি, কুহেলি নিজের ডেস্কে ওর ব্যাগটা রেখে জরুরী ফাইল আর ল্যাপটপ টা নিয়ে মিটিং রুমে গিয়ে একবার প্রজেক্টর টা চেক করে নিল। মিটিং টা সাড়ে আটটায় শুরু হবে, তাই হাতে এখনও যথেষ্ট টাইম রয়েছে, কুহেলি সবকিছু ডবল চেক করে যখন মিটিং রুম থেকে বেরোচ্ছে তখন ওদের বস মিস্টার শর্মা অফিসে ঢুকছেন। কুহেলিকে দেখে একটা হাসি বিনিময় করে নিজের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলেন, কুহেলিও গুডমর্নিং উইশ করে নিজের ডেস্কে ফিরে এল। অফিসের বাকিরাও এসে গেছে, কুহেলির পাশের ডেস্কে রুহি বসে, মেয়েটা নতুন সবে দুমাস হল জয়েন করেছে, এখনও অতটা সড়গড় হয়নি, কিন্তু খুব ট্যালেন্টেড। কুহেলির সাথে রুহির খুব ভাল একটা বন্ডিং তৈরী হয়ে গেছে, কুহেলি ওর সিটে বসতেই রুহি হেসে ওকে গুডমর্নিং উইশ করে বলল,

গুডমর্নিং কুহেলি দি, সো, নার্ভাস লাগছে?

এখানে একটা কথা বলি, অফিসের সমস্ত কথাই কিন্তু হিন্দিতে হচ্ছে, কিন্তু আমরা সেটা বাঙলাতেই পড়ব। হ্যা তো রুহির প্রশ্ন শুনে কুহেলি একটা ছোট্ট স্মাইল করে বলল,

উম, লিটল বিট।

হুম, বাট আমি জানি, ইউ উইল রক ইট।

লেটস সি।

ওদের কথার মাঝখানেই মিস্টার শর্মার পি.এ অঙ্কিত এসে কুহেলিকে জানাল তাকে স্যার এক্ষুনি একবার মিটিংয়ের ফাইলটা নিয়ে ওনার কেবিনে যেতে বলেছেন। কুহেলি ফাইলটা নিয়ে স্যারের কেবিনের সামনে গিয়ে দরজাটা অল্প খুলে বলল,

মে আই কাম ইন স্যার?

মিস্টার শর্মা দরজার দিকে তাকিয়ে কূহেলিকে দেখে হেসে বললেন,

ওহ, মিস বাসু কাম ইন।

কুহেলি দরজাটা বন্ধ করে টেবিলের সামনে এসে দাড়ালে মিস্টার শর্মা বললেন,

হ্যাভ আ সিট।

কুহেলি বসে ফাইলটা টেবিলের উপর রাখল। এই মিস্টার শর্মার পুরো নাম আলেখ নভতেজ শর্মা, এই ওঙ্কার গ্রুপস এর ওনার নভতেজ শর্মার একমাত্র ছেলে, বর্তমানে ওঙ্কার গ্রুপসের সি ই ও। চার বছর আগে লন্ডন থেকে এমবিএ কমপ্লিট করে দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই নভতেজ শর্মা কোম্পানির দায়িত্ব আলেখের হাতে তুলে দেন, নিজে মাঝেমধ্যে আসেন। নভতেজ শর্মা পুরোদস্তুর পাঞ্জাবি, বহু বছর আগে ওনার ঠাকুরদা কোনকারণে উত্তর ভারত ছেড়ে এই দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন। একা হাতে এত বড় বিজনেস গড়ে তুলেছিলেন, সেই থেকে এই পাঞ্জাবি পরিবারটি এই ব্যাঙ্গালোরেই থেকে গেছে, আর বংশ পরম্পরায় ওঙ্কার গ্রুপসকে উচ্চতার শিখরে নিয়ে গেছে। আলেখও এই ধারা বজায় রেখেছে, কোম্পানির রাশ নিজের হাতে নেওয়ার পর উন্নতির গতি যেন দ্রুততর হয়েছে, আলেখের লক্ষ্য এই ইন্ডাস্ট্রিতে ওঙ্কার গ্রুপসের নাম থাকবে সবার উপরে। আলেখ যেমন ভালো বিজনেস ম্যান তেমন ভাল বস, অফিসের প্রত্যেকে ওকে ভিষন ভালোবাসে সন্মান করে। যদিও মেয়েরা একটু বেশিই ভালোবাসে, আর ওদের দোষ দিই বা কীকরে! এরকম ঈর্ষণীয় উচ্চতার অধিকারী, নিয়মিত জিম করা সুঠাম দেহ, দারুন রূপ, আর তারউপরে যদি ঠোঁটে সর্বক্ষণ একটা হাসি লেগে থাকে তাহলে কোন মেয়ে ঘায়েল না হয়ে পারবে! তবে আমাদের কুহেলির কথা আলাদা, ওই যে বললাম না, প্রেম ভালোবাসা থেকে শতহস্ত দূরে। এহেন রাজপুত্র প্রকারের আলেখ কে দেখেও ওর মনে কোনরকম অনুভুতির সৃষ্টি হয়নি। ওর সিনিয়ার কলিগ বিদিশা তো ওকে একদিন বলেই ফেলেছিল,

কুহেলি, আই থিঙ্ক তোর কোনও প্রবলেম আছে, আই মিন দ্যা হট আলেখ শর্মাকে দেখেও তুই ফিদা হলি না!! হাউ ইজ দিস পসিবল!!

কুহেলি সেদিন খুব হেসেছিল, মানুষের মনে কত রকম চিন্তা ভাবনা আসে। এই দেখুন, কথা বলতে পেলে না, আমার আর হুশ থাকে না, কোথা থেকে কোথায় চলে গেছি। আসল কথায় ফিরি, আলেখ শর্মার পরিচয় তো হল, এবার চলুন দেখি ওরা কি করছে। আলেখ কিছুক্ষণ প্রজেক্টটা নিয়ে কুহেলির সাথে আলোচনা করার পর নিজের রিস্ট ওয়াচে টাইম দেখে বলল,

ওকে, মিস বাসু, ইটস অলমোস্ট টাইম। মিস্টার আগরওয়াল যেকোনো মুহূর্তে এসে পড়বেন, আপনি সবাইকে নিয়ে মিটিং রুমে ওয়েট করুন, আমি মিস্টার আগরওয়াল এলে ওনাকে নিয়ে আসছি।

কুহেলি “ওকে স্যার” বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। তারপর এই প্রজেক্টে যতজন মেম্বার রয়েছে তাদেরকে নিয়ে মিটিং রুমে এসে সবকিছু রেডি করে মিস্টার আগরওয়ালের জন্য ওয়েট করতে লাগল। ঠিক সাড়ে আটটায় আলেখ মিস্টার আগরওয়াল কে সঙ্গে নিয়ে মিটিং রুমে এল, সাথে আলেখের পিএ অঙ্কিত আর মিস্টার আগরওয়ালের পিএ কুনাল। ফর্মাল আলাপচারিতার পরে আলেখ কুহেলিকে প্রেজেন্টেশন শুরু করতে বললে, কুহেলি ওর ল্যাপটপ অন করে শুরু করে ওর প্রেজেন্টেশন। কুহেলির খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই, মাত্র এক বছরের চাকরি জীবন তার, এরমধ্যেই এতবড় একটা প্রজেক্ট ওকে লিড করতে দেওয়ায় অনেকেই আপত্তি তুলেছিল, কিন্তু আলেখ নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি। আর ওর সিদ্ধান্ত কে সঠিক প্রমাণ করে কুহেলি অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে প্রেজেন্টেশন সম্পূর্ণ করল। মিস্টার আগরওয়াল প্রবীণ মানুষ, ওনার বহু বছরের অভিজ্ঞতা, প্রেজেন্টেশন শেষ হওয়ার পর মিস্টার আগরওয়াল উঠে দাড়িয়ে বললেন,

ইয়াং লেডি, হোয়াটস ইয়োর নেম এগেইন?

কুহেলি মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল,

কুহেলি বাসু স্যার।

কুহেলি, নাইস নেম। আই মাস্ট সে ইউ আর এ ভেরি ট্যালেন্টেড গার্ল। অনেস্টলি স্পিকিং, আমি যখন শুনেছিলাম একজন লেস এক্সপিরিয়েন্সড এম্পলয়ী এত বড় একটা প্রজেক্ট লিড করছে, আমি খুব বেশি কিছু আশা করিনি আজকের মিটিং থেকে। বাট আই ওয়াস রঙ, আমি এটা ভুলে গিয়েছিলাম যে কোম্পানির সি ই ও এত অল্প বয়সে এত উন্নতি করতে পারে সেই কোম্পানির এম্পলয়ীও ট্যালেন্টেড হবে। ইউ হ্যাভ ডান এ গ্রেট জব মিস বাসু।

বলে মিস্টার আগরওয়াল কুহেলির দিকে একটা হাত এগিয়ে দিলেন করমর্দনের জন্য, কুহেলি ওনার সাথে করমর্দন করে আলেখের দিকে তাকাল, ওর মুখে সেই সবসময় লেগে থাকা হাসিটাই বিরাজ করছে। মিস্টার আগরওয়াল আলেখের সাথে হাত মিলিয়ে বললেন,

সো, মিস্টার শর্মা, ডিল ইজ অন। আই হোপ ইট উইল বি নাইস টু ওয়ার্ক টুগেদার।

আলেখ হেসে উত্তর দিল,

শিওর মিস্টার আগরওয়াল।

এরপর অফিসিয়ালি সই সবুদ করে দুই কোম্পানির চুক্তি বদ্ধ হল, গোটা মিটিং রুমটা করতালিতে ভরে উঠল। সব ফর্মালিটি শেষ হয়ে গেলে আলেখ নিজে মিস্টার আগরওয়াল কে এগিয়ে দিয়ে এল, নিজের কেবিনে যাওয়ার সময় আরেকবার মিটিং রুমে উকি দিয়ে কুহেলিকে বলে গেল,

মিস বাসু, কাম টু মাই কেবিন ফর এ মোমেন্ট।

কুহেলি ল্যাপটপ আর ফাইল গুলো গুছিয়ে ওর ডেস্কে রেখে আলেখের কেবিনে গেল। আলেখ ওকে বসতে বলে হেসে বলল,

কংগ্রাচুলেশন মিস বাসু, ইউ হ্যাভ ডান এ গ্রেট জব।

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

মিস বাসু, এবার কিন্তু আমাদের কাজ আরও বেড়ে গেল, আমাদের কিন্তু হান্ড্রেড পারসেন্ট এরও বেশি এফর্ট দিতে হবে, দেয়ার ইজ নো রুম ফর এনি মিসটেক।

আই নো স্যার, আমরা সবাই আমাদের বেস্ট কাজ করব, আপনি চিন্তা করবেন না।

আলেখ হেসে বলল,

গুড, কালকে সানডে, পরশু থেকে এই প্রজেক্টের কাজ শুরু হবে। সো, আজকে আর লেট অবধি কাজ করার প্রয়োজন নেই, অফিস আওয়ার শেষ হলে বাড়ি চলে যাবেন।

কুহেলি একটু অবাক হয়ে গেল, ও যে কাল অনেক লেট অবধি অফিসে ছিল সেটা আলেখের জানার কথা নয়, কারণ লাঞ্চ ব্রেকের আগেই আলেখ একটা মিটিং অ্যাটেন্ড করতে বাইরে চলে গিয়েছিল, আর অফিসে ফেরেনি। কুহেলির অবাক ভাবটা লক্ষ্য করে আলেখের হাসিটা আরও একটু প্রশস্ত হল।

মিস বাসু, আপনি ভুলে যাচ্ছেন দিস ইজ মাই অফিস, এখানে কখন কি হয় সব আমি জানি।

কুহেলি কিছু না বলে শুধু একটু হাসল, আলেখ বলল,

ওকে দেন, গো অ্যাহেড উইথ ইওর ওয়ার্ক, অ্যান্ড রিমেম্বার টু লিভ অন টাইম।

কুহেলি উঠে দাড়িয়ে হেসে “ইয়েস স্যার” বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। ওর ডেস্কে ফিরে আসতেই রুহি সহ ওর বাকি কলিগরাও তাকে অভিনন্দিত করে গেল, কুহেলিরও খুব ভালোলাগছে। জীবনের প্রথম স্বাধীন প্রজেক্ট, আর এতটা সফল। কাজের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে গেল বাকি সময়টা, অফিস আওয়ার শেষ হলে কুহেলি রওনা হল ওর ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। মনটা আজ বেজায় খুশি লাগছে, ফ্ল্যাটে ফিরেই আগে ফ্রেশ হয়ে বাড়িতে ফোন করল কুহেলি, দুবার রিং হতেই যন্ত্রটার ওপাশ থেকে চৈতালী দেবীর আওয়াজ ভেসে এল।

কুহু, কেমন আছিস? পুরো দুদিন পর ফোন করলি, আমিও ফোন করতে পারছিলাম না, ব্যস্ত থাকলে তো তুই আবার ফোন করলে রাগ করিস।

মা, অমনি শুরু করে দিলে, আগে বল কেমন আছ?

ভাল আছি, তুই কেমন আছিস? ঠিক ঠাক করে খাওয়া দাওয়া করছিস তো?

হ্যা মা, সব ঠিক আছে, আমি ভাল আছি আর ঠিক ঠাক করে খাচ্ছিও। তুমি বাড়ি ফিরেছ?

না রে, এই তো আরেকটু পরে ফিরব।

মা, এবার তো একটু নিজের খেয়াল রাখো, এত বেশি ডিউটি করো না।

আচ্ছা ঠিক আছে, বাদ দে এসব, তোর আজকে একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ছিল না? কেমন হল?

মিটিংয়ের কথায় কুহেলির মনটা আবার খুশি হয়ে গেল, এক নাগাড়ে আজকের সব কিছু বর্ণনা করে গেল। শুনে চৈতালী দেবী খুব খুশি হলেন, ওনার ছোট্ট কুহু আজ কত বড় হয়ে গেছে। কুহেলি আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর শৈলজা দেবীর কথা জিজ্ঞেস করল।

মা, ঠাম্মু কেমন আছে? কত বার বলেছি একটা ফোন নিতে, একটু কথা বলতে পারি না।

আর বলিস না, ভাল আছে। আমিও তো কতবার বলেছি কিন্তু মা তো শুনতেই চায় না।

দাড়াও এবার বাড়ি যাই, দেখছি।

ভাল কথা মনে করেছিস, সামনের মাসে আসছিস তো?

না, ঠিক বলতে পারছি না। আসলে এই প্রজেক্টটা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট, আর স্যার আমার উপর খুব ভরসা করেই দায়িত্বটা দিয়েছেন।

তা বললে কীকরে হবে কুহু? তোর একমাত্র মামার বিয়ে, তুই না আসলে কীকরে হবে? আর চিরু তোকে কত ভালোবাসে বল তো, তুই না আসলে কিন্তু খুব কষ্ট পাবে।

মা, আমি জানি। বাট… ওকে আমি ট্রাই করছি।

ট্রাই না, আসতেই হবে।

মা, কথা দিতে পারছি না, আমি ট্রাই করব।

কিন্তু….

মাআআআআ।

চৈতালী দেবী হতাশ হয়ে আর কথা বাড়ালেন না। উনিও জানেন কুহেলির কাছে ওর কাজের গুরুত্ব কতটা। আরও কিছুক্ষণ অন্যান্য বিষয়ে কথা বলার পর ফোনটা রেখে কুহেলি ঘরের কাজে হাত লাগাল। ঘর ঝাড়ু মোছা গীতা করলেও বাকি অনেক কাজ থাকে, সবার আগে তো সারা সপ্তাহের জামা কাপড় গুলো ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে রাখল। তারপর সব ফার্নিচার গুলো মুছল, বারান্দায় শখ করে দুটো গোলাপ গাছ লাগিয়েছে সেগুলোয় জল দিল। এইরকম টুকটাক কাজ করতে করতেই রাত হয়ে গেল, একটু ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গিয়ে দেখল গীতা আজকে ডাল আর ডিমের কারি রান্না করেছে, খাওয়া নিয়ে সেরকম কোনও বাছ বিচার নেই ওর, তাই গীতাকে সম্পূর্ন স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে, গীতা নিজের মত করেই রান্না করে। খাবার টা গরম করে প্লেট টা হাতে নিয়ে লিভিং রুমে এসে টিভি টা অন করল, টিভি শো গুলোর প্রতি ওর কোনোদিনই আকর্ষণ নেই, মাঝে মধ্যে বরং মুভি দেখতে ভালোবাসে। চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে একটা পছন্দ সই সিনেমা পেয়ে গেল, সেটা দেখতে দেখতেই ডিনারটা সেরে নিল। খাওয়া হয়ে গেলে প্লেট টা কিচেনে রেখে হাত ধুয়ে এসে আবার সোফায় বসল, কাল সানডে তাই অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। সিনেমা টা দেখে শুতে যাবে ঠিক করল, খুব একটা অবসর হয় না সিনেমা দেখার। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে চোখ দুটো ভারী হয়ে এল, অনেক চেষ্টা করেও চোখ খুলে রাখতে পারল না, আসলে সারাদিনে খাটনি তো কম হয়নি, যতই হোক প্রজেক্টটা নিয়ে একটা মানসিক চাপ তো ছিলই। তারমধ্যে গতকাল রাতে খুব অল্প সময়ের জন্য ঘুমিয়েছে, বাধ্য হয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে বেডরুমে এসে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল, নরম বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই ঘুমটা যেন বেশ জাকিয়ে নেমে এল কুহেলি দু চোখ জুড়ে।

ক্রমশ……

© স্বত্ব সংরক্ষিত

শুরু করলাম নতুন ধারাবাহিক “সংগোপনে”। আমার আগের ধারাবাহিক “মন জানে” কে আপনারা যেভাবে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করেছেন আশা করব এই ধারাবাহিক টাকেও ততটাই ভালোবাসা দেবেন। মেঘের মতই আপন করে নেবেন কুহেলি কেও। কেমন লাগল আমাকে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকব। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব আগামী পর্ব নিয়ে। ততদিন পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here