সংগোপনে’ পর্ব-১৪

0
1867

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_১৪
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

মিস বাসু, উইল ইউ ম্যারি মি?

কথাটা শুনে কুহেলি এতটাই স্তম্ভিত হয়ে পড়ল যে মনে হয় নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেল। হাতটা এখনও সেভাবেই শুন্যেই রয়েছে, মুখটা ঈষৎ হা হয়ে আছে। কুহেলির নিজের কানকে বিশ্বাস হল না, বিশ্বাস করার মত কথাও নয়, ওঙ্কার গ্রুপসের কর্ণধার, দ্য আলেখ শর্মা ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে!! তাও আবার এভাবে!! কুহেলির মনে হল ও নির্ঘাৎ ভুল শুনেছে, এটা হতেই পারে না। কিন্তু আলেখের দিকে তাকিয়ে দেখল সে একভাবে কুহেলির দিকে তাকিয়ে আছে, মুখটা অসম্ভব রকম থমথমে হয়ে আছে। কুহেলি বেশিক্ষণ সেদিকে তাকাতে পারল না, চোখটা নামিয়ে নিল। চামচটা প্লেটে রেখে একগ্লাস জল ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল, একটা অদ্ভুত রকমের অস্বস্তি হচ্ছে যেন। আলেখ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

আই নো, আপনি খুব অবাক হয়েছেন। আর সেটাই স্বাভাবিক, বাট আই অ্যাম সিরিয়াস। আমি সিরিয়াসলি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, উইল ইউ ম্যারি মি?

কুহেলি বিহ্বল দৃষ্টিতে আলেখের দিকে চেয়ে রইল, আলেখ যে এই মুহূর্তে কত টা সিরিয়াস সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কুহেলির কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না, গোটা ব্যাপারটা এতটাই অবিশ্বাস্য যে কুহেলি নিজে কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারছে না। আলেখ কুহেলির মনের অবস্থাটা বুঝে বলল,

জানি, আপনার মনে এখন হাজারটা প্রশ্নের ঝড় উঠছে, আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দেব। আপনার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে আমি হঠাৎ করে বিয়ের মত একটা সিরিয়াস ব্যাপারে এভাবে কীকরে কথা বলতে পারি? এরকম আচমকা আমি বিয়ে করতে চাইছি কেন? আর আপনাকেই কেন? মিস বাসু, আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি, কেন হঠাৎ আমাকে এরকম একটা ডিসিশন নিতে হচ্ছে।

কুহেলি নির্বাক শ্রোতা হয়ে তাকিয়ে আছে আলেখের দিকে, আলেখ বলতে শুরু করল।

ড্যাড আমার বিয়ে দিতে চায়, এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারনটা খুবই কমন, সব বাবা মায়েরাই এই কারনটা দিয়ে থাকেন। ড্যাডের বক্তব্য, আমার বিয়ের বয়স হয়েছে, এখন আমার একটা বিয়ে করা প্রয়োজন, অ্যান্ড মোস্ট ইম্পর্টেন্টলি ড্যাডের ইচ্ছে ওর বয়স হচ্ছে, এখন বাকি লাইফটা ড্যাড ছেলে পুত্রবধূ আর নাতি নাতনিদের নিয়ে কাটাতে চায়। ড্যাড আগেও একথা বহুবার বলেছে কিন্তু আমি প্রত্যেকবারই না করে দিয়েছি, বাট এবার আর ড্যাড কিছুতেই শুনছে না। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনও লাভ হয়নি, ড্যাড নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। এমনকি আমাকে এও বলেছে যে এবার যদি আমি বিয়ে না করি তাহলে ড্যাড পার্মানেন্টলি পাঞ্জাবে সেটল হয়ে যাবে, আমার সঙ্গে কোনরকম সম্পর্ক রাখবে না।

এতোটা বলে আলেখ থামল, কুহেলি স্পষ্ট বুঝতে পারছে আলেখের মনটা একদমই ভালো নেই, আর এরকম একটা পরিস্থিতি তে পড়লে সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু যেটা বুঝতে পারছে না সেটা হল এরমধ্যে ও কোথা থেকে আসছে? আলেখ ওর বাবার চাপে পড়ে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে ঠিক আছে কিন্তু তাইবলে আলেখ ওকে কেন প্রপোজ করল! দ্য আলেখ শর্মার জন্য নিশ্চয়ই মেয়ের অভাব হবে না। কুহেলি নিজের এই প্রশ্নের উত্তর আলেখের পরবর্তী কথাতেই পেয়ে গেল।

বুঝতেই পারছেন, আমার কাছে এখন বিয়ে করা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই। ছোট থাকতে মাকে হারিয়েছি, সেই কষ্ট আজও ভুলতে পারি নি, এখন ড্যাড যদি নিজেকে আমার কাছ নিয়ে সরিয়ে নেয়…. নো, আই কান্ট অ্যাফর্ড দ্যাট। বাট আমি এইমুহুর্তে বিয়ে করতে চাই না, ওঙ্কার গ্রুপসকে ইন্ডিয়ার নম্বর ওয়ান পজিশনে নিয়ে যাওয়াই এখন আমার মূল লক্ষ্য। আমার কাছে সত্যিই এখন এই বিয়ে বা সংসারের জন্য কোনও টাইম নেই, কিন্তু ড্যাড আমার কোনও কথা শুনতে চাইছে না। তাই এখন আমার কাছে এই একটাই রাস্তা খোলা আছে, বিয়ে। ড্যাড আমাকে এই উইকটা টাইম দিয়েছে, এরমধ্যেই আমাকে ফাইনাল ডিসিশন নিতে হবে, আমি যদি একবার হ্যা বলি ড্যাড আমার জন্য মেয়েদের লাইন তৈরি করে দেবে, কিন্তু আমি ওই পারফেক্ট ব্রাইড মেটেরিয়াল টাইপের মেয়েদের বিয়ে করতে চাইছি না। আমি এমন কাউকে খুঁজছি, যে আমার লক্ষ্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, যার সঙ্গে একটা বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও আমি কোনও বন্ধনের মধ্যে থাকব না। আমাদের একে অন্যের প্রতি কোনও চাহিদা থাকবে না, কোনও প্রত্যাশা থাকবে না। কিন্তু এরকম কোনও মেয়ে কি আছে!

এতোটা বলে আলেখ আবার থামল, সোজা কুহেলির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

এই প্রশ্নটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে একটাই নাম এসেছিল, আপনার। ইউ আর জাস্ট পারফেক্ট ফর মি, এতদিন একসঙ্গে কাজ করার পর এটা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছি যে আপনার কাছেও কাজটা সবার আগে, নিজের স্বপ্ন গুলো পূরণ করার জন্য আপনি নিজের কাজের প্রতি কতটা ডেডিকেটেড সেটা অফিসের সবাই জানে। কাজ আপনার নেশা, জাস্ট লাইক মি, অ্যান্ড দ্যাটস হোয়াই আমি আপনাকে এই প্রস্তাব টা করছি। এই সম্পর্ক টা যদি হয় তাহলে আমাদের দুজনেরই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পৌঁছানো টা আরও সহজ হয়ে যাবে, আমরা একে অপরকে হেল্প করতে পারব। আমার মতে ইউ আর বেস্ট ফর মি, এখন অফকোর্স আপনার মতামত টা সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আমি পুরোটাই আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভেবেছি, আপনার চিন্তাধারা আলাদা হতেই পারে। আপনার নিজের ম্যারেড লাইফ নিয়ে কিছু স্বপ্ন থাকতে পারে, কিছু প্ল্যানস থাকতে পারে। আমি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমার সিদ্ধান্ত আপনার ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না, সে অধিকার বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। আমি শুধু আপনাকে একবার ভেবে দেখতে বলছি, হাসবেন্ড হিসেবে আমি কেমন হতে পারি সেটা আমারও জানা নেই, কিন্তু এতদিন একসঙ্গে কাজ করার পর এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে আমি মানুষ হিসেবে হয়তো খারাপ নই। মিস বাসু আপনি বুঝতে পারছেন তো আমি কি বলছি?

বুঝতে কুহেলি সবটাই পারছে, আর নিজের সঙ্গে একটা অদ্ভুত সাযুজ্যও খুঁজে পাচ্ছে। কি অদ্ভুত মিল! আলেখও বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে, আর ওর পরিস্থিতি টাও অনেকটাই এক। শুধু কারনটা আলাদা, আলেখ ওর লক্ষ্যের পথে কোনও বাধা চায় না আর কুহেলি নিজের জীবনে আর প্রেম নামক শব্দটার অস্তিত্বই চায় না, তাই বিয়ে করার কোনও প্রশ্নই ছিল না, শৈলজা দেবীর কথায় বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয়েছে। কুহেলিকে চুপ করে থাকতে দেখে আলেখ বলল,

মিস বাসু, আমি আপনাকে ফোর্স করছি না, আর এক্ষুনি উত্তরও দিতে বলছি না, টেক ইওর টাইম। কিন্তু খুব বেশি সময় আমার কাছে নেই, হোপ ইউ ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড।

কুহেলি এবারও কিছু বলল না, আসলে বলার মত কিছু খুঁজে পেল না। আলেখের গম্ভীর ভাবটা এখন অনেকটাই কম, কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকল, প্লেটের নুডলস ঠান্ডা জল হয়ে গেছে, কুহেলি ওগুলো নিয়েই নাড়াচাড়া করে চলেছে। আলেখ একটু ইতস্তত করে আবার বলল,

মিস বাসু একটা প্রশ্ন করতে পারি?

কুহেলি ওর দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। আলেখ একটু থেমে প্রশ্ন করল,

ডু ইউ.. ডু ইউ লাইক এনিওয়ান?

আলেখ এমন একটা প্রশ্ন করবে সেটা কুহেলি আশা করেনি, অবশ্য আজকের আলেখের বলা কোন কথাটাই বা ও আশা করেছিল। কুহেলি উত্তর দিচ্ছে না দেখে আলেখ বলল,

যদি আপনার লাইফে অলরেডি কেউ থেকে থাকে তাহলে তো এই সব কথার এমনিতেই কোনও মানে থাকবে না। আমারই ভুল, আগে আপনাকে জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত ছিল। আসলে এই ধরনের আলোচনা আগে কখনও করতে হয়নি, তাই ঠিক কোথা থেকে শুরু করা উচিৎ বুঝতে পারিনি। আই অ্যাম রিয়েলি সরি ফর দ্যাট।

কুহেলি এতক্ষণে মুখ খুলল,

ইটস ওকে, সরি বলার প্রয়োজন নেই, আমার লাইফে তেমন কেউ নেই।

কথাটা শুনে যেন আলেখের মুখে একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল।

তাহলে আমি রিকোয়েস্ট করব আমার কথাটা একবার ভেবে দেখবেন। জানি এটা খুবই অদ্ভুত একটা প্রস্তাব, সব মেয়েদেরই তাদের ম্যারেড লাইফ তার ফিউচার হাসবেন্ড নিয়ে একটা স্বপ্ন থাকে, আর আমি যা বলছি সেটা সেই স্বপ্নগুলোর থেকে একেবারেই আলাদা। বাট আই থিঙ্ক আপনি বাকি সব মেয়েদের থেকে আলাদা, আমার কেন জানি না মনে হয় আমার মতই আপনার কাছেও একটা রোম্যান্টিক হ্যাপি ম্যারেড লাইফের থেকে নিজের ড্রিম টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর ঠিক সেই কারণেই সাহস করে আপনাকে এই প্রস্তাব টা করেছি, এখন বাকিটা আপনার ওপর, আপনি যা ডিসিশন নেবেন আমি মেনে নেব। বাট খুব বেশি সময় আমি আপনাকে দিতে পারব না, জানি এটা ঠিক নয়, এরকম একটা লাইফটাইমের জন্য ডিসিশন নিতে গেলে সময়ের দরকার হয় বাট আমার কোনও উপায় নেই, সময় আমার কাছে নেই। হোপ ইউ ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড।

কুহেলি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে আলেখ বলল,

তাহলে আপনি আমার প্রস্তাব টা ভেবে দেখবেন তো?

কুহেলি এবারও কিছু না বলে মাথা নেড়েই সম্মতি জানাল। আলেখের এতক্ষণে নুডলসের দিকে নজর গেল, ঠান্ডা হয়ে কেমন নেতিয়ে গেছে।

যাহ, কথায় কথায় এগুলোর কথা মনেই ছিল না, একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে, মিস বাসু একটু ওয়েট করুন আমি এগুলো চেঞ্জ করে দিতে বলছি।

আলেখ হাত উচু করে একটা ছেলেকে ডাকতে গেলে কুহেলি বাধা দিল।

থাক স্যার, আমার আসলে খিদেও নেই।

আলেখ বুঝল কুহেলি একটু অস্বস্তি বোধ করছে, এরকম একটা আলোচনার পরে এটা স্বাভাবিক। আলেখ হাত তুলে ছেলেটাকে ডেকে খাবারগুলো প্যাক করে দিতে বলল, খাবার অপচয় করা ওর একেবারেই পছন্দ নয়। ছেলেটি প্লেট দুটো নিয়ে চলে গেল, বেশ কিছুক্ষণ কারোর মুখেই কোনও কথা নেই, হঠাৎ করেই পরিবেশ টা কেমন একটা অদ্ভুত হয়ে গেছে। ছেলেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবারগুলো প্যাক করে এনে দিয়ে গেল, আলেখ একটা প্যাকেট কুহেলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

আপনার জন্য অর্ডার করা ফুড আপনাকেই নিতে হবে। আর তাছাড়া দু প্লেট নুডলস খাওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।

কুহেলি চোখ দুটো নামিয়ে রেখেছিল, আলেখের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে দেখল সেই গম্ভীর ভাবটা এখন আর নেই, বরং ওর সেই পরিচিত হাসিটা আবার ফিরে এসেছে। হয়তো মনের মধ্যে জমা কথাগুলো বলে এখন অনেকটা হালকা হয়েছে, কিন্তু কুহেলি সহজ হতে পারছে না। তবে আলেখকে আবার হাসতে দেখে বেশ ভালোলাগল। প্যাকেট দুটো নিয়ে ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল, গাড়িতে গোটা রাস্তাটা কুহেলি চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল, আলেখও আর কিছু বলেনি। কুহেলির অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে আলেখ গাড়ি থামিয়ে নেমে দাড়াল, কুহেলিও নেমে এসে আলেখের সামনে দাড়াল, আলেখ হেসে বলল,

এত প্রেসার নেওয়ার কিছু হয়নি মিস বাসু, টেক ইট ইজি। ঠান্ডা মাথায় গোটা ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন, মনে রাখবেন, দেয়ার ইজ নো প্রেসার। আমি একটা প্রস্তাব দিয়েছি, এবার আপনি সেটা অ্যাকসেপ্ট করবেন না রিজেক্ট করবেন সেটা সম্পূর্ণ আপনার ডিসিশন। ওকে, এবার আপনি যান, ব্রেনটাকে একটু রেস্ট দিন, গুড নাইট।

আলেখ গাড়িতে উঠে আরও একবার গুডনাইট উইশ করে চলে গেল। কুহেলি ধীরে ধীরে নিজের ফ্ল্যাটে এল, কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। অভ্যেসমত ফ্রেশ হয়ে পোশাক পাল্টে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কি অদ্ভুত আজকের দিনটা! প্রথমে নিশীথ তারপরে আলেখ। নিশীথের কথাটা তাও আগে থেকে জানত তাই তেমন অবাক আর হয় না আজকাল কিন্তু আজ আলেখ যা করল সেটা কুহেলি কোনোদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেনি, সবটাই কেমন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। নাহ, কিছুতেই মনটাকে স্থির করে ভাবতে পারছে না, অনেক চেষ্টা করল মনটাকে একটু শান্ত করার, ভাবনা গুলোকে একটু পরপর সাজানোর কিন্তু কিছুতেই পারল না। যতবার একটু ঠান্ডা মাথায় সবটা পরপর গুছিয়ে নিতে চাইছে ততবার সব চিন্তাগুলো ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। শেষে হাল ছেড়ে দিল কুহেলি, এখন যতই চেষ্টা করুক কোনও লাভ হবে না। উঠে গিয়ে নুডলস টা গরম করে খেয়ে নিল, খুব একটা ভালোলাগছিল না খেতে আসলে এই ধরনের খাবার গুলো একবার ঠান্ডা হয়ে গেলে ফিরে যতই গরম করা হোক না কেন কেমন একটা বিস্বাদ মনে হয়। কিন্তু কুহেলি পুরোটাই খেয়ে নিল, সামান্য কারণে খাবার অপচয় করা একদম পছন্দ নয়, খাওয়া সেরে সোজা বেডরুমে এসে শুয়ে পড়ল। চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল, আজ আর কিছু ভাবতে চায় না, একদিনের হিসাবে অনেক বেশি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেছে আজকে। মস্তিষ্ক টাকে সত্যি একটু আরাম করতে দেওয়া উচিৎ, কিন্তু চাইলেই কি আর হয়! ঘুরে ফিরে বারবার আলেখের কথা গুলোই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, চিন্তার জালে এমন ভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল যে এটাও খেয়াল করল না যে এতদিনের নিয়ম ভেঙে আজ নিশীথ আগরওয়ালের কাছ থেকে কোনও মেসেজ আসেনি। সকালে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল, কারনটা বলা বাহুল্য, অ্যালার্ম তার নির্ধারিত সময়ে বেজে স্নুজ মোডে চলে গেলেও কুহেলি টের পায়নি, দশ মিনিট পর আবার অ্যালার্ম বাজলে ঘুমটা ভাঙল। মোবাইলে টাইম দেখেই তড়াক করে উঠে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকল, দেরী করে পৌঁছানো টা কুহেলির অপছন্দের তালিকায় সবার উপরে। সেই স্কুলের সময় থেকে আজ পর্যন্ত একদিনও লেট হয়নি, কুহেলির মতে যার কাছে সময়ের গুরুত্ব নেই জীবনের কাছে তার গুরুত্ব নেই। উঠতে সামান্য দেরী হলেও অফিসে পৌঁছাতে কিন্তু একটুও দেরী হল না, আর এসেই কাজ নিয়ে বসে গেল। কি অদ্ভুত মেয়ে! কাজের কথা এলেই যেন বাকি সবকিছু একমুহূর্তে ভুলে যায়! এখন যেমন, যেভাবে কাজের মধ্যে ডুবে রয়েছে তাতে ওকে দেখে মনেই হচ্ছে না, কালকে ওর জীবনে এত কিছু ঘটেছে, এমনকি সেইসব চিন্তার কারণে যে মাঝরাত পর্যন্ত ঘুমই আসেনি সেটাও যেন বেমালুম ভুলে গেছে! লাঞ্চ ব্রেকের পর আলেখ একটা মিটিং ডাকল, মিটিংরুমে সবাই ওয়েট করছিল একটু পরেই আলেখ রুমে প্রবেশ করল। আলেখকে দেখে যেন কুহেলির কালকের সব কথাগুলো হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল, এতক্ষণ সত্যিই মনে ছিল না। আলেখ আবার নিজের পুরনো ছন্দে ফিরে গেছে, সেই পরিচিত হাসিটা ঠোঁটের কোণে লেগে রয়েছে, কুহেলির দিকে তাকিয়ে একটু যেন অন্যমনস্ক হল কিন্তু সেটা নিতান্তই সাময়িক। কুহেলিরও প্রথমে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলেও সেটা মুহূর্তে মন থেকে ঝেড়ে ফেলল, কাজের ক্ষেত্রে ওরা দুজনেই অসম্ভব প্রফেশনাল। ব্যক্তিগত জীবন আর কর্ম জীবন কীকরে আলাদা রাখতে হয় সেটা দুজনেই খুব ভালো করে জানে। নিশীথ আগরওয়ালের প্রস্তাব করা নতুন প্রজেক্ট নিয়ে এই মিটিং টা, সবার সাথে আলোচনা করে ঠিক হল আগামী শুক্রবার দুই কোম্পানি মিলে একটা বিস্তারিত বিশদ মিটিং হবে, বাকি কথাও সেদিনই আলোচনা করা হবে। মিটিং শেষ হলে আলেখ সকলকে রুম থেকে চলে যেতে বলল শুধু কুহেলি ছাড়া, এটা শুনে প্রথমটায় কুহেলির বুকটা কেমন ধ্বক করে উঠল, যদি কালকের কথা বলে তাহলে! কিন্তু আলেখকে ও যতটা চেনে তাতে অফিসে বসে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ওর পছন্দ নয়। ওর চিন্তাকে ঠিক প্রমাণ করে আলেখ কাজের কথাই বলতে শুরু করল, কুহেলিও আশ্বস্ত হল।

মিস বাসু প্রিভিয়াস প্রজেক্টটা আপনি যেভাবে হ্যান্ডেল করেছেন তাতে এই প্রজেক্টটাও নিঃসন্দেহে আপনারই প্রাপ্য। আর সেটা আমাদের কোম্পানির জন্যও বেস্ট ডিসিশন হবে।

কুহেলি হেসে থ্যাঙ্কস জানাল। আলেখ আবার বলতে শুরু করল,

বাট আমি এখনই এটা অ্যানাউন্স করতে চাইছি না, ফ্রাইডের মিটিং টা আগে হোক, তারপর আমি সবাইকে এটা জানাব। আপনাকে আগে থেকে জানাচ্ছি কারণ আপনি যাতে সেইভাবে ফ্রাইডের মিটিংয়ের জন্য নিজেকে রেডি করতে পারেন, ঠিক আগের বারের মত।

ডোন্ট ওয়ারি স্যার।

কথা শেষে দুজনে আবার যার যার কাজে ফিরে গেল, একবারের জন্যেও কেউ ভুলেও কালকের কথা মুখেও আনল না। এইভাবেই ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে আরও দুটো দিন কেটে গেল, অফিস আর বাড়ি সব মিলিয়ে কুহেলি মোটামুটি এখন কাজের সাগরে ডুবে রয়েছে। ঠিক আগের বারের মতই এই নতুন প্রজেক্ট টার ওপরেও একটা পারফেক্ট প্রেজেন্টেশন তৈরি করে মিটিং অ্যাটেন্ড করবে। আর কাজের মধ্যে একবার ডুবে গেলে কুহেলির যে আর অন্য কোনদিকে হুশ থাকে না সেটা তো বলাই বাহুল্য। এবারও ঠিক তাই হল, কাজের মধ্যে এতটাই ডুবে গেছে যে আলেখের প্রস্তাবের কথাটাও বেমালুম ভুলে গেছে। এমনকি সেদিনের পর থেকে যে নিশীথ আর মেসেজ করছে না সেটাও খেয়াল করেনি। আজকেও সারাটা দিন অফিসে কম্পিউটার স্ক্রীনে মুখ ডুবিয়েই কেটে গেল, কালকে মিটিং তাই প্রেজেন্টেশন টা আজকেই শেষ করতে হবে। অবশেষে যখন প্রেজেন্টেশন টা শেষ করে উঠল তখন সাতটা বাজে, ব্যাগ টা গুছিয়ে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল। বিল্ডিং থেকে বেরোতে গিয়েই থেমে যেতে হল, সামনে আলেখ নিজের কালো এক্স ইউ ভি টায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে, কুহেলিকে দেখে সোজা হয়ে দাড়াল। কুহেলি ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ওর দিকে, আলেখ গাড়ির দরজাটা খুলে দিল, কুহেলি কোনও রকম কথা না বলে চুপচাপ উঠে পড়ল, বুঝতে পারছে আলেখ ওর সাথে কথা বলতে চায়। কি বিষয়ে যে কথা বলতে চায় সেটাও কুহেলি বুঝতে পারল। আলেখ গাড়ি স্টার্ট করে কুহেলির ফ্ল্যাটের রাস্তা ধরল, প্রথম কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না, খানিকক্ষণ পরে আলেখ বলল,

আপনার প্রেজেন্টেশন রেডি?

কুহেলি জানে আলেখ এখন মোটেও প্রেজেন্টেশন নিয়ে কথা বলতে চায় না, তাও বলল,

হ্যা স্যার, আজকেই কমপ্লিট করলাম।

গুড।

এরপর আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আলেখ বলল,

মিস বাসু, আপ…আপনি কিছু ভেবেছেন?

কুহেলি জানত আলেখ এই বিষয়েই কথা বলতে চাইছিল, দোষ টা কিছুটা ওরও। আলেখ সেদিনই বলেছিল ওর হাতে খুব বেশি সময় নেই, ও যাই সিদ্ধান্ত নিক না কেন সেটা জানিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু এই দুটো দিন কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে ভাবার সুযোগই পায়নি। কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,

আসলে.. মানে… না…

মিস বাসু আমি জানি আমার এভাবে আপনাকে জিজ্ঞেস করা টা ঠিক নয়, এরকম এটা বিষয়ে ডিসিশন নেওয়ার জন্য একটু সময় প্রয়োজন। কিন্তু আমার কিছু করার নেই, এই সানডের মধ্যে ড্যাড কে আমার ডিসিশন জানাতেই হবে।

কুহেলির সত্যিই খুব খারাপ লাগছে, আলেখ তো ওকে এটা সেদিনই বলেছিল। মাথা টা নিচু করে বলল,

সরি স্যার, আ..

এটা শুনে আলেখ হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দিল, কুহেলির কথাটাও সম্পূর্ণ হলো না। এভাবে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দেওয়ায় কুহেলিও চমকে উঠল, পাশে তাকিয়ে দেখল আলেখ ওর দিকে কেমন একটা হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আলেখের এইরকম আচরণের কারনটা কুহেলি বুঝতে পারল না, অবাক হয়ে আলেখের দিকে তাকিয়ে থাকল, অদ্ভুত একটা হতাশা যেন ছেয়ে আছে মুখটায়। আলেখ কিছুক্ষণ সেইভাবেই তাকিয়ে থেকে বলল,

ইটস ওকে মিস বাসু, আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড।

কুহেলি অবাক হয়ে ভাবল ও তো এখনও কিছু বলেইনি, তাহলে কি বুঝে গেল! আলেখ দুহাতে স্টিয়ারিং টা ধরে মাথাটা নীচু করে নিল, সেভাবেই বলল,

আমিই বোধহয় একটু বেশিই আশা করে ফেলেছিলাম। হঠাৎ করে এরকম একটা প্রস্তাবে আপনি কেনই বা রাজি হবেন?

কুহেলি এবার বুঝতে পারল, ওর সরি বলাতে আলেখ মনে করেছে ও আলেখের প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করছে। কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

স্যার আপনি ভুল ভাবছেন। আমি সেটা বলছিলাম না, আমি তো বলছিলাম যে আমি এখনও কিছু ডিসাইড করে উঠতে পারিনি, সরিটাও সেইজন্যই বলছিলাম।

কুহেলির কথা শুনে আলেখ চমকে ওর দিকে তাকাল, মুখটায় একটু আগের সেই হতাশ ভাবটা আর নেই, বরং একটু যেন উজ্জ্বল মনে হল। কুহেলি আবার বলল,

অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি। আমি সত্যিই এখনও কিছু ঠিক করতে পারিনি।

ইটস ওকে মিস বাসু, আপনার সরি বলার কোনও প্রয়োজন নেই।

কুহেলি আলেখের দিক থেকে চোখ টা নামিয়ে নিল, আলেখ আবার ড্রাইভ করতে শুরু করল। আবার বেশ কিছুক্ষণের নিরবতা, কুহেলির অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে আলেখ গাড়িটা থামিয়ে কুহেলির দিকে তাকাল। কুহেলি দরজাটা খুলে নামতে গেলে আলেখ বলল,

মিস বাসু, প্লিজ থিঙ্ক অব্যাউট ইট।

আলেখের গলায় অনুনয়ের সুর। কুহেলি কিছু বলল না, শুধু মাথাটা একবার ওপর নিচ করে সম্মতি জানিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাড়াল, আলেখ একটু হেসে গুডনাইট উইশ করে চলে গেল। কুহেলি নিজের ফ্ল্যাটে এসে আগে সোফায় বসল, সাধারণত ও এটা করেনা, অফিস থেকে ফিরেই ওর প্রথম কাজ ফ্রেশ হওয়া। কিন্তু আজ সেটা না করেই সোফায় বসে পড়ল, সেদিনের আলেখের বলা কথাগুলো আবার মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছে। এই দুটো দিন কাজের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে গেছে কিন্তু এবার একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। আলেখ তো বলেছে ওর ওপর কোনও প্রেসার নেই, ওর যা সিদ্ধান্ত হবে আলেখ মেনে নেবে। কিন্তু তাও কুহেলি কেন যেন একটা প্রেসার অনুভব করছে, হয়তো আলেখ ওর বস সেই কারণে। হঠাৎ কুহেলি সোফা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বলল,

নাহ, এভাবে ভেবে কোনও লাভ নেই, ফ্রেশ হয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ, কুহেলি উঠে গিয়ে সোজা স্নান করে নিল। এমনিতেও আজ বড্ড গরম, সারাটা দিন আকাশ মেঘলা, গুমোট আবহাওয়ায় আরও গরম বেড়েছে। স্নান সেরে কুহেলি বিছানায় উঠে একটা বালিশ কোলে নিয়ে হেলান দিয়ে বসল। মাথাটা অনেকটা হালকা লাগছে এখন, এবার হয়তো ঠিকঠাক চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিতে পারবে। সিদ্ধান্ত যে এবার একটা নিতেই হবে সেটা তো ঠিক, আর সেক্ষেত্রে দেরী করারও কোনও মানে হয় না। বসে বসে আলেখের বলা কথা গুলো ভাবতে লাগল, কুহেলির এখনও ঠিক বিশ্বাস হয় না আলেখ ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তাও আবার এরকম অদ্ভুত একটা প্রস্তাব! কুহেলির মধ্যের দ্বিতীয় সত্তাটা যেন আবার জেগে উঠল, মনের মধ্যে আবার একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হল।

এত কি ভাবছ?
ভাবছি কোনটা সত্যি আর কোনটা স্বপ্ন।
কোনোটাই স্বপ্ন নয়, পুরোটাই বাস্তব।
কিন্তু হঠাৎ আমার লাইফে এত আন এক্সপেকটেড ঘটনা কেন ঘটছে?
এখন কি এটা ভাবার সময়?
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
এতে না বোঝার মত কি আছে? ঠাম্মুর খুশির জন্য একবার যখন বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছ, তখন তো আর পিছিয়ে আসতে পার না।
না, আমি পিছিয়ে আসছি না।
তাহলে? তোমার সামনে তো ঠিক সময়ে দুটো রাস্তা আপনা থেকেই খুলে গেছে, নিশীথ আগরওয়াল আর আলেখ শর্মা।
নিশীথ আগরওয়ালের কথা কেন আসছে?
কেন আসবে না? সে তো তোমাকে ভালোবাসে, সারাটা জীবন তোমার সঙ্গে কাটাতে চায়।
সেখানেই আমার আপত্তি, একজন আমাকে এতোটা ভালোবাসবে আর পরিবর্তে আমি তাকে কিছুই দিতে পারব না, এটা আমি পারব না।
কিন্তু নিশীথ তো তোমার কাছ থেকে কোনও কিছুর আশা রাখে না, শুধু তোমাকে পাশে চায়।
সেটা হয়না, একটা মানুষকে ভালোবাসলে মনে একটা আশা থেকেই যায়, একদিন হয়তো সেই মানুষটা তার ভালোবাসার উত্তর দেবে। আমি সেই উত্তর কোনদিনও দিতে পারব না।
তাহলে আলেখের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও। আলেখ তো, এমন একটা সম্পর্কই চাইছে যেখানে একটা বন্ধন থেকেও থাকবে না। যে সম্পর্কে সংসারের বাঁধন থাকবে না, কোনও আশা প্রত্যাশার চাহিদা থাকবে না।
ঠিক, আমি তো এটাই চাইছিলাম, এমন একটা সম্পর্ক যেখানে আমায় কাউকে ঠকানোর অপরাধ বোধ বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে না। অন্য মানুষটার যদি সম্পর্কটার থেকে কোনও আশা প্রত্যাশা, কোনও চাহিদাই না থাকে তাহলে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও আমি মুক্তই থাকব, নিজের স্বপ্ন গুলোকে পূরণ করার জন্য এগোতে পারব।

কুহেলি যেন হঠাৎই ভিষন উত্তেজিত হয়ে পড়ল, সোজা হয়ে উঠে বসল, যেন বহু বছর ধরে সঠিক পথের সন্ধানে ঘুরতে থাকা ক্লান্ত পথিক হঠাৎ করেই সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে গেছে। এবার আর চিন্তা গুলো মনের মধ্যে মৌন হয়ে রইল না, শব্দের আকারে তারা নিজের অস্তিত্বের জানান দিল।

আমি আগে কেন বুঝতে পারিনি! আলেখ শর্মার প্রস্তাব টা একদম সঠিক সময়ে আমার সব সমস্যার সমাধান নিয়ে এসেছে। এর থেকে ভালো তো আর কিছু হতেই পারে না, দিস ইজ দ্য বেস্ট অপশন ফর মি। এই সম্পর্কটা হলে ঠাম্মুও খুশি হবে, ঠাম্মু আর মাকে দেওয়া কথাও পূরণ হবে অ্যান্ড মোস্ট ইম্পর্টেন্টলি বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরেও আমাকে সো কলড স্বামী স্ত্রী এর সম্পর্কেও জড়াতে হবে না। দিস ইজ জাস্ট সো পারফেক্ট ফর মি, আমি কীকরে আগে এটা বুঝতে পারিনি! নো, এখানে আর কিছু ভাবার কোনও অবকাশই নেই, আমি কালকেই স্যারকে আমার ডিসিশন জানিয়ে দেব।

কিন্তু পরক্ষণেই মুখটা কালো হয়ে গেল, মনের মধ্যে একটা নতুন চিন্তার উদয় হল। এভাবে বাড়িতে কিছু না জানিয়ে এতবড় একটা ডিসিশন নেওয়া টা কি ঠিক হবে? আলেখ শর্মাকে পাত্র হিসেবে যে কেউ একবাক্যে পছন্দ করবে, কিন্তু ওদের কমিউনিটি আলাদা। চৈতালী দেবী আপত্তি করবেন না কুহেলি জানে, কিন্তু শৈলজা দেবী কি রাজি হবেন? যতই হোক উনি পুরনো দিনের মানুষ, ওদিকে কুহেলির দাদু স্বরূপ বাবুর কথাও ভাবতে হবে। যদিও কুহেলি যতটা ওনাকে চেনে তাতে মনে হয় না উনি আপত্তি করবেন, রাশভারী মানুষ হলেও যথেষ্ট আধুনিক মনষ্ক, চিন্তা শুধু শৈলজা দেবীকে নিয়ে, যদি উনি রাজি না হন। এইসব ভাবতে ভাবতে আবার অন্য একটা কথা মাথায় এল, আলেখের পরিবারেও তো একই সমস্যা হতে পারে, যদিও আজকাল এসব আর কোনও বাধার সৃষ্টি করে না কিন্তু তবুও কিছু পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিদের চিন্তা এখনও ততটা আধুনিক নয়। আলেখ কি তাহলে আগেই বাড়িতে কথা বলেছে! সেটাও বা কীকরে হয়! কুহেলির সঙ্গে চূড়ান্ত কথা না বলে বাড়িতে কীকরে জানাবে? তাহলে? হঠাৎ কোলের বালিশটা পাশে ছুড়ে দিয়ে মুখে একটা বিরক্তির ভাব নিয়ে ব্যালকনিতে চলে এল। এত ভাবতে কারই বা ভালোলাগে? জীবনের সব থেকে বড় সমস্যাটার এত সুন্দর একটা সমাধান পেয়েও খুশি হতে পারছে না, হাজার টা প্রশ্ন বোধক চিহ্ন চারিদিক থেকে ঘিরে ধরছে। আকাশটা এখনও মেঘলা করেই রয়েছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, একটা সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। কুহেলির সাধের গোলাপ গাছ দুটোয় বেশ কয়েকটা ফুল ফুটেছে, তারাই নিজেদের সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছে হাওয়ায়। মিষ্টি মন ভালো করা গন্ধটা যেন ধীরে ধীরে কুহেলির মনের অস্থিরতা টা কমিয়ে দিল। রেলিঙে ভর করে আকাশের দিকে তাকিয়ে কুহেলি ভাবল,

একটা সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এতকিছু ভাবলে চলবে না। আগে আমাকে স্যারের সাথে কথা বলতে হবে, ফ্যামিলির সম্পর্কে কথা বলা প্রয়োজন। তারপর নাহয় বাড়িতে কথা বলা যাবে, তাছাড়া আমার ধারণা তো ভুলও হতে পারে। ঠাম্মু তো আমাকে বলেছে আমি যাকে পছন্দ করব তাকেই মেনে নেবে, আমার পছন্দের ওপর ভরসা আছে। নাহ, একবার যখন ডিসিশন নিয়েছি তখন আর অন্য কথা ভেবে লাভ নেই, কালকে আগে স্যারের সাথে কথা বলতে হবে, আমার ফ্যামিলির সম্পর্কে সবটা জানাতে হবে, আর তাছাড়াও…. আরো একটা বিষয় আছে যেটা ওনার আগে থেকেই জেনে রাখা দরকার।

পরদিন অফিসে পা দিয়েই কুহেলি বুঝতে পারল সবাই আজকের মিটিং নিয়ে খুব ব্যস্ত। কুহেলির মধ্যে একটা অদ্ভুত নার্ভাসনেস কাজ করছে, না মিটিংয়ের জন্য নয়। কারনটা মনে হয় আলাদা করে বলে দিতে হবে না, আর এটাও আলাদা করে বলার কিছু নেই যে কুহেলি নিজের কাজ নিয়ে কতটা সিরিয়াস। মুহুর্তের মধ্যে সব নার্ভাসনেস ঝেড়ে ফেলে নিজের প্রেজেন্টেশনের টা ফাইলটা আরও একবার দেখে নিল। ঠিক সময়মত নিশীথ আগরওয়াল আর ওনার কিছু এম্পলয়ী এলেন, মিটিংটাও ঠিক সময় মতই শুরু হল। নিশীথ কুহেলিকে দেখে একটা হাসি ছুড়ে দিল, না, এখন আর এই হাসি টা কুহেলির কাছে রহস্যময় মনে হয় না। কুহেলিও উত্তরে একটা হাসি ঠোঁটের কোনায় ফুটিয়ে তুলল, আলেখ মিটিং স্টার্ট করার নির্দেশ দিলে কুহেলি ওর প্রেজেন্টেশন শুরু করল। আগের বারের মতই এবারেও প্রেজেন্টেশন শেষ হওয়ার পরে প্রত্যেকের মুখে একটা বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল। শুধু আলেখ আর নিশীথের মুখে এতটুকুও বিস্ময়ের ভাব নেই, বরং দুজনের মুখেই একটা হালকা হাসির রেখা দেখা গেল। নিশীথ সোজা উঠে দাড়িয়ে বলল,

আমি ঠিক এরকম একটা কিছুই আশা করেছিলাম। আই অ্যাম নট অ্যাট অল সারপ্রাইজড, বরং আজ যদি এই প্রেজেন্টেশনটা না পেতাম তাহলে অবাক হতাম।

কুহেলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। নিশীথ এবার আলেখকে বলল,

মিস্টার শর্মা, আলাদা করে আর বলার মত কিছু নেই। আমাদের তরফ থেকে দ্য ডীল ইজ অন।

আলেখ হেসে নিশীথের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

ইটস আ প্লেজার মিস্টার আগরওয়াল। আই হোপ এই প্রজেক্টটা প্রিভিয়াস প্রজেক্টের থেকেও বেশি সাকসেসফুল হবে।

নিশীথ আলেখের এগিয়ে দেওয়া হাতটা ধরে বলল,

অফকোর্স।

এরপরে টুকটাক আরও কিছু আলোচনা হল। শেষে অফিসিয়ালি ডীল সাইন করার দিন ফাইনাল হওয়ার পর মিটিং যখন শেষ হল তখন ইতিমধ্যে লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে। নতুন ডিল ফাইনাল হওয়ার খুশিতে নিশীথ অফিসের প্রত্যেককে লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করল, আলেখ আপত্তি করলেও নিশীথ শুনল না। কিছুটা দূরেই একটা ফাইভ স্টার হোটেলে ওদের লাঞ্চের আয়োজন হল। অফিসের সবাই খুব খুশি, কুহেলিও খুশি, ওর প্রেজেন্টেশন সবার এতোটা ভালোলেগেছে খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু থেকে থেকেই চোখ দুটো আলেখের দিকে চলে যাচ্ছে, আজকের মত কাজ শেষ তাই মনে এখন শুধু একটাই কথা ঘুরছে, আলেখকে কিভাবে কথাগুলো বলবে। যতই হোক আলেখ ওর বস, আর এরকম একটা বিষয়ে নিজে থেকে কথা বলা খুবই অস্বস্তি কর। কিন্তু কথা তো বলতে হবেই, ভেবেছিল অফিসের পর সবাই চলে গেলে আলেখের সাথে কথা বলবে, কিন্তু এখন তো সেই উপায়টাও নেই। অফিস আজকের মত ডিসমিস, সবাই লাঞ্চ সেরে এখান থেকেই যার যার গন্তব্যে চলে যাবে। এখন উপায়? রুহি অনেকক্ষণ ওর পাশে বসে ফোনে কোনও একজনের সঙ্গে চ্যাটিং করেই চলেছে, এটা খুব বাজে লাগে কুহেলির। সবার মাঝখানে বসে ফোনে ব্যস্ত থাকাটা ওর মতে একদমই ভালো দেখায় না। একটু বিরক্ত হয়ে রুহিকে ফোনটা রাখতে বলতে গিয়েও থেমে গেল, হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। অ্যালেখকে মেসেজ করে দিলে কেমন হয়? কিন্তু এর আগে কখনও আলেখকে মেসেজ করেনি, প্রয়োজনও পড়েনি। কিন্তু এখন তো পরিস্থিতি আলাদা, কথা বলাটা প্রয়োজন, একটু ইতস্তত করে মেসেজটা পাঠিয়েই দিল কুহেলি।

“বিশেষ কটা কথা বলার আছে, আজকে সম্ভব হবে কি?”

মেসেজ টা সেন্ড করে একবার আলেখের দিকে তাকাল, একভাবে নিশীথের সঙ্গে কিছু একটা আলোচনা করছে। আদৌ মেসেজটা দেখবে কিনা কে জানে? মেসেজের কথা ভাবতে ভাবতে সামনে নিশীথ কে দেখে কুহেলির হঠাৎ মনে হল,

তাই তো, বেশ কয়েকদিন হল মিস্টার আগরওয়াল আমাকে কোনও মেসেজ সেন্ড করেননি! এরকম তো আগে কখনও হয়নি, স্ট্রেঞ্জ!

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একভাবে নিশীথের দিকে তাকিয়ে ছিল কুহেলি, বোধহয় এই হঠাৎ মেসেজের অনাগমনের কারনটা বোঝার চেষ্টা করছিল। আচমকা নিশীথ ওর দিকে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে চোখ দুটো নামিয়ে নিল। এইরকম একটা নির্বোধের মত কাজ করার জন্য নিজেকেই দুষতে লাগল।

ইশ, মিস্টার আগরওয়াল কি ভাবছেন কে জানে? হোয়াট দ্য…

কুহেলি ওয়াশরুমে যাওয়ার বাহানায় ওখান থেকে প্রায় পালিয়ে এল। ওয়াশরুমে ঢুকে হাফ ছেড়ে বাঁচল, এমন সময় ফোনে যান্ত্রিক শব্দে একটা মেসেজ এল, স্ক্রীনে ফুটে উঠেছে আলেখের নাম। আলেখ মেসেজের রিপ্লাই করেছে, মেসেজটা ওপেন করল কুহেলি।

“শিওর, আমি পর্কিংয়ে ওয়েট করব।“

মেসেজটা পড়ে কুহেলি একটু চোখে মুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই চমকে উঠল। সামনে নিশীথ আগরওয়াল দাড়িয়ে, ঠোঁটে সেই হাসি। কুহেলির মনে হল মাটিতে মিশে যেতে পারলে ভাল হত, কেন যে তাকাতে গিয়েছিল কে জানে? আরে ভাবতে গেলে কি অন্যদিকে না তাকিয়ে ভাবা যায় না? নিশীথের ওর প্রতি অনুভূতির কথা জানা সত্বেও এরকম কীকরে করতে পারে সে! এখন যদি নিশীথ এই ব্যাপারটার অন্য কোনো মানে ধরে নেয় তখন কি হবে? নিশীথ কুহেলিকে দেখে বলল,

সো মিস বাসু, ডিড ইউ মিস মি?

কুহেলি একটু থতমত খেয়ে বলল,

সরি?

নিশীথ একটু হেসে বলল,

সেইদিনের পর থেকে আমি কিন্তু একবারও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি, নট ইভেন এ মেসেজ। আমি কিন্তু আমার কথা রাখার পুরো চেষ্টা করছি, বাট আপনি কিন্তু আপনার কথা রাখছেন না।

কুহেলি এবারও একটু চমকে গেল।

মানে!

মানে সেদিন তো আমাকে ফ্রেন্ড হিসেবে অ্যাকসেপ্ট করলেন, কিন্তু বন্ধু হিসেবে একবারও তো খোজ নেননি।

কুহেলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, ঠিক কি বলবে বুঝতে পারল না। তবে নিশীথ যে ওর একটু আগের তাকিয়ে থাকার বিষয় টা নিয়ে কথা বলছে না, এতেই অনেকটা শান্তি পেয়েছে। হয়ত খেয়ালই করেনি, কুহেলিই একটু বেশি ভাবছিল। একটু ইতস্তত করে বলল,

না.. মানে আসলে.. কদিন কাজের খুব চাপ ছিল।

এছাড়া আর কিছু বলার মত খুঁজে পেল না কুহেলি। নিশীথ হেসে বলল,

জানি, আপনি কাজ ছাড়া কিছুই বোঝেন না, অ্যান্ড দ্যাটস গুড। সো মিস বাসু আজকের মত তো অফিস শেষ, আমি কি আপনাকে ড্রপ করতে পারি।

কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

নো, নো, ইটস ফাইন। আমি আসলে বাড়ি যাব না এখন, একটু সময় পেয়েছি তো, তাই একটা ফ্রেন্ডের বাড়ি যাব।

কুহেলি মিথ্যে কথা বলতে একদম ভালোবাসে না, কিন্তু এই মুহূর্তে মিথ্যের আশ্রয় না নিয়ে উপায় নেই। নিশীথ বলল,

নো প্রবলেম, আমি সেখানেই আপনাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।

না, না তার কোনও কোনও প্রয়োজন হবে না, মানে ওর বাড়ি এই কাছেই, আমি হেঁটেই চলে যাব। থ্যাঙ্কস ফর ইওর কনসার্ন।

বলে কুহেলি আর এক মুহূর্তও না দাড়িয়ে ওখান থেকে এসে নিজের জায়গায় বসে পড়ল। নিশীথও এসে নিজের জায়গায় বসল, কুহেলি ভুল করেও বাকি সময় টা অন্য কোনও দিকে তাকায়নি। লাঞ্চ শেষ হলে সবাই বিদায় নিয়ে যে যার মত বেরিয়ে পড়ল, আলেখ আর নিশীথ একসঙ্গেই পার্কিং এর দিকে এগোল। কুহেলি ইচ্ছে করেই একটু ধীরে ধীরে এগোতে লাগল, কিছুক্ষণ পরে নিশীথের গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই কুহেলি পা বাড়াল পার্কিং এরিয়ার দিকে। অফিসের বাকিরা আগেই চলে গেছে, আলেখ নিজের গাড়িতে বসে কুহেলির জন্য অপেক্ষা করছিল, ওকে আসতে দেখে দরজাটা খুলে দিল। কুহেলি চুপচাপ উঠে বসতেই আলেখ গাড়ি ঘুরিয়ে বেরিয়ে পড়ল, কোথায় যাচ্ছে কুহেলি জানে না। এখন সেটা জানার বিশেষ ইচ্ছেও নেই, সকালের সেই নার্ভাসনেস টা আবার অনুভব করছে। কুহেলি এখনও জানে না কিভাবে কথাগুলো বলবে, কিন্তু এটুকু জানে যেভাবেই হোক বলতে তাকে হবেই। এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা।

ক্রমশ_______________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগল আজকের পর্ব টা? জানাবেন কিন্তু। আলেখের কথাও শুনলেন, কুহেলি কি সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে সেটাও শুনলেন। আচ্ছা কি মনে হয় বলুন তো? ওরা দুজন যেটাকে নিজেদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত মনে করছে আদৌ সেটা সঠিক নাকি সময়ের সাথে ভুল প্রমাণিত হবে ওদের ধারণা? এভাবে কি আদৌ কোনও সম্পর্ক শুরু করা যায়? আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না। ভালো লাগুক মন্দ লাগুক আমাকে জানাবেন। অপেক্ষা করব আপনাদের কমেন্টের। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here