সংগোপনে’ পর্ব-১৫

0
1706

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_১৫
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

গাড়িতে চুপচাপ বসে ছিল কুহেলি, মনে মনে কথাগুলো একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। আলেখ অনেকক্ষণ হল ড্রাইভ করছে, মিনিট কুড়ির বেশি হতে চলল। কুহেলি এতক্ষণ বাইরের দিকে তাকায়নি, এবার বাইরের দিকে চোখ যেতেই বুঝতে পারল ওরা লোকালয় ছাড়িয়ে চলে এসেছে, আশে পাশে ঘর বাড়ি দোকান পাট কিচ্ছু নেই, দুপাশের সবুজের বুক চিরে কালো পিচের রাস্তা চলে গেছে অনেকদূরে। সেই মসৃণ রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে আলেখের কালো এক্স ইউ ভি টা। আস্তে আস্তে বিকেল হচ্ছে, আকাশে অল্প বিস্তর মেঘ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু বর্ষা কালের মেঘের কোনও ভরসা নেই কখন যে হঠাৎ কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। অবশ্য সেটা নিয়ে আপাতত কুহেলির কোনও মাথা ব্যথা নেই, আরও মিনিট পনের পর আলেখ একটা জায়গায় গাড়ি থামাল। দুজনে গাড়ি থেকে নেমে দাড়াল, কুহেলি এখানে আগে কখনও আসেনি, জায়গাটা বেশ সুন্দর। ছোট্ট একটা ঝিল দেখা যাচ্ছে, আর ঝিলের একটা পাশে বেশ বড় একটা গাছ। গাছটার নিচে একটা পুরনো কাঠের বেঞ্চ, ঠিক যেমনটা পুরনো সিনেমা গুলোতে দেখা যায়, সেরকম। আজকাল আর এরকম বেঞ্চ তেমন একটা দেখা যায় না। আলেখ কুহেলিকে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই বেঞ্চটার দিকে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে সংস্কারের বেশ অভাব। আলেখ নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে বেঞ্চটা একটু পরিষ্কার করে নিজে বসে কুহেলির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

বসুন মিস বাসু, ভয় নেই পুরনো হলেও এখনো বেশ মজবুত, ভাঙবে না।

আলেখের হাসিটা দেখে আজ কেন যেন কুহেলির নার্ভাসনেস টা আরও বেড়ে গেল। একটু হেসে একটা পাশে বসল, ঝিলের দিক থেকে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া আসছে, গাছের ছায়ায় বসে হাওয়াটা খুব আরামদায়ক মনে হচ্ছে। আলেখ বলল,

হোটেল থেকে বেরিয়ে আবার কোনও হোটেল বা রেস্টুরেন্টে যেতে ইচ্ছে করল না, তাই এখানে নিয়ে এলাম আপনাকে। এই জায়গাটা আমার প্রিয় জায়গা গুলোর মধ্যে একটা, যখন খুব একা থাকতে ইচ্ছে করে এখানে চলে আসি।

জায়গাটা সত্যি খুব সুন্দর, কুহেলিরও বেশ ভালোলেগেছে জায়গাটা। প্রকৃতির একটা নিজস্ব মনমুগ্ধকর ক্ষমতা আছে, যার স্নিগ্ধ পরশে মনটা এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই নিগ্ধ স্পর্শের সংস্পর্শে এসেও কুহেলির মনটা শান্ত হল না, কিছুতেই বুঝতে পারছে না কিভাবে কথাটা শুরু করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুহেলিকে কিছু করতেই হল না, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আলেখ নিজেই বলল,

সো, মিস বাসু, আপনার ডিসিশন নেওয়া হয়ে গেছে, রাইট? আর সেই বিষয়েই আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

কুহেলি মনে মনে হাপ ছেড়ে বাঁচল, ওকে নিজে থেকে কথা শুরু করতে হল না। মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে হ্যা জানাল। আলেখ বলল,

সো, ক.. কি ডিসিশন নিলেন?

কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আলেখের গলাটা যেন একটু কেপে গেল। কুহেলি আলেখের দিকে তাকাল, ওর মুখটা যেন একটু ম্লান মনে হল। চোখ দুটো আলেখের দিক থেকে সরিয়ে একটু সময় থেমে কুহেলি বলতে শুরু করল,

ডিসিশন আমি নিয়ে নিয়েছি, আর সবদিক ভেবে তবেই নিয়েছি। সেদিন আপনি ঠিকই বলেছিলেন, একটা হ্যাপি রোমান্টিক ম্যারেড লাইফের থেকে আমার কাছে আমার ড্রিম গুলো সত্যিই অনেক বেশি দামী। ছোট থেকেই যে লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলাম তার পথে কোনরকম বাধা আমি আসতে দিই নি। স্কুলে হোক বা কলেজে বহু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি কোনদিনও রোমান্টিক রিলেশনশিপের দিকে পা বাড়াই নি। আমার মনে হয়েছিল একটা এক্সট্রা সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে সময় নস্ট করার থেকে নিজের লক্ষ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর ঠিক এই কারণে আমার লাইফের যে পারফেক্ট ছবিটা মনের মধ্যে তৈরি করছিলাম তাতে বিয়ের কোনও উল্লেখ ছিল না। বিয়ে করার ইচ্ছে আমার কোনোদিনই ছিল না, শুধু……

এতোটা বলে কুহেলি থামল, কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। আলেখ চুপ করে তাকিয়ে আছে কুহেলির দিকে, মুখের হাসিটা আর নেই। কুহেলি এবার আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,

কিন্তু এখন খুব অদ্ভুত ভাবে আপনার মত আমার কাছেও বিয়ে করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

আলেখের চোখে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ফুটে উঠল, কুহেলি সেটা লক্ষ্য করে বলল,

অদ্ভুত কোইনসিডেন্ট বলতে পারেন, এবার ছুটিতে বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম আমার ঠাম্মু.. আই মিন আমার গ্র্যান্ড মাদারের শরীরটা খুব দুর্বল। ডক্টর বলেছেন একটা হার্ট অ্যাটাকের পর ওনার হার্ট আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর তাছাড়াও আরো কিছু সমস্যা রয়েছে। কোনও রকম উত্তেজনা ওনার শরীরের পক্ষে ঠিক নয়। ঠাম্মু আমায় খুব ভালোবাসে, আমার বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমিই ঠাম্মুর সব, নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে আমার জন্য।

বলতে বলতে কুহেলির গলা ধরে এল, আলেখ কুহেলির বাবার ব্যাপারে কিছুই জানত না। এটা শুনে যেন চমকে উঠল, কুহেলির চোখের কোণে জল দেখে আস্তে করে বলল,

ইটস ওকে মিস বাসু, আপনার কষ্ট হলে এই প্রসঙ্গ টা বাদ দিতে পারেন।

কুহেলি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

না, স্যার। অ্যাম ফাইন, আমাকে বলতে দিন।

আলেখ আর কিছু বলল না, কুহেলি আবার বলতে শুরু করল,

ঠাম্মু আমার একটা সুখী সংসার দেখতে চায়, আর পাঁচটা মেয়ের মত একটা সুন্দর গোছানো সংসার। ঠাম্মুর জন্য আমি সব করতে পারি, আর এইজন্যই আমি বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। কিন্তু বিয়ে আমি করতে চাই না, আপনার মত আমিও কোনও সম্পর্কে নিজেকে জড়াতে চাই না। আর সেইজন্যই আপনার প্রস্তাব টা আমার কাছে সঠিক মনে হয়েছে, এই মুহূর্তে আমার জন্য এটা একদম পারফেক্ট।

আলেখ এটা শুনে চমকে উঠল, ব্যস্ত হয়ে বলল,

তার মানে আপনি আমার প্রপোজাল টা অ্যাকসেপ্ট করছেন?

কুহেলি আলেখের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা টা উপর নীচ করে সম্মতি জানাল। আলেখের মুখে সেই হাসিটা ফিরে এল, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে কুহেলির একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,

থ্যাঙ্ক ইউ মিস বাসু, আপনি জানেন না আপনি আমার কত বড় একটা চিন্তা দূর করে দিলেন, থ্যাঙ্কস এ লট।

আলেখ এরকম হঠাৎ করে ওর হাত ধরে নেবে কুহেলি আশা করেনি, একটু চমকে উঠে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। আলেখের এতক্ষণ খেয়াল হয়নি ও কি করছে, এবার বুঝতে পেরে বলল,

সরি মিস বাসু, আসলে আমি এতটাই টেনশনে ছিলাম এটা নিয়ে। আপনি যদি রাজি না হতেন তাহলে কি করব সেটা ভেবেই…. সরি।

ইটস ওকে স্যার।

আলেখকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও কতটা ভারমুক্ত অনুভব করছে, কিন্তু কুহেলি এখনও শান্ত হতে পারছে না। ওর এখনও সব কথা যে বলা হয়নি, ঠিক কিভাবে বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না, আর শোনার পরে আলেখ কিভাবে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে সেটাও জানা নেই। কিন্তু বলতে তো হবেই, একটা সম্পর্ক শুরু করার আগে সবকিছু পরিষ্কার করে নেওয়া উচিৎ। আলেখ একটু চুপ করে থাকার পরে বলল,

আমি জানতাম না, আপনার পরিস্থিতি টাও অনেকটা আমার মতই। আমাদের দুজনেরই বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণটাও এক, আমরা দুজনেই আগে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। আমি ড্যাডের কথা ভেবে বাধ্য হচ্ছি আর আপনি আপনার গ্র্যান্ড মাদারের কথা ভেবে।

কুহেলি কিছুক্ষণ নিচের তাকিয়ে থেকে বলল,

আমার বিয়ে করতে না চাওয়ার আরও একটা কারণ আছে।

কথাটা শুনে আলেখের হাসিটা একটু কমে এল, কুহেলি একদম স্থির হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সেইদিকে তাকিয়েই বলতে শুরু করল,

শুরু থেকেই আমি বিয়ে নিয়ে কোনও চিন্তাই করিনি, শুধু নিজের লক্ষ্যের কথাই ভেবেছি। কিন্তু পরে..

কুহেলি থামল, ওর হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে সেই সঙ্গে আলেখেরও হৃদযন্ত্রের গতি বেড়ে উঠেছে। কুহেলি চোখ দুটো বন্ধ করে একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল,

আমি… আমি একজনকে ভালোবেসেছিলাম।

কথাটা শুনে আলেখের মুখের কমে আসা হাসিটা একেবারেই মিলিয়ে গেল। একভাবে তাকিয়ে রইল কুহেলির দিকে, কুহেলি বলে চলল।

জীবনে কোনদিনও কাউকে ভালবাসব ভাবিনি, যেমনটা বললাম আপনাকে আমার লাইফে এই সম্পর্ক গুলোর জন্য কোনও জায়গা ছিল না কিন্তু ঠিক কিভাবে যে আমার মনে ওর জন্য ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল আমি জানিনা। কিন্তু…..

আলেখ নির্বাক শ্রোতা হয়ে বসে আছে, কুহেলির দিক থেকে এক মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি সরায়নি। কুহেলি একে একে দেবার্ঘ্যর সঙ্গে ওর পরিচয় থেকে শুরু করে, ওদের বন্ধুত্ত্ব, তারপর ভালোবাসা আর সব শেষে ওদের অপূর্ণ পরিণতির কথা আলেখকে খুলে বলল। আলেখ সবটা শুনল, কুহেলি এতক্ষণ আলেখের দিকে তাকায়নি, এবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

আমার মনে হয়েছে আমার সম্পর্কে আপনার সবটা জানা উচিৎ। একটা সম্পর্ক শুরু করার আগে সবটা পরিষ্কার করে জেনে নেওয়া উচিত, এখন সবটা জানার পর আপনি যা ডিসিশন নেবেন আমি মেনে নেব।

কুহেলির এতক্ষণে নিজেকে একটু হালকা মনে হচ্ছে। আলেখ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

আপনি এখনও দেবার্ঘ্যকে ভালোবাসেন?

জানি না, আমি শুধু এটুকু জানি হয়তো আর কোনদিনও কাউকে ভালোবাসতে পারব না। আর এই কারণেই আমি বিয়ে করতে চাই না, একজন মানুষ যে কিছু আশা নিয়ে আমাকে নিজের স্ত্রীয়ের মর্যাদা দেবে আর আমি তার প্রাপ্য অধিকার টুকুও তাকে দিতে পারব না। এটা আমি করতে চাই নি, বাধ্য হয়ে ঠাম্মুর খুশির জন্য বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু নিজের মনকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলাম না। এরকম একটা মুহূর্তে আপনার প্রস্তাব আমার সব সমস্যার সমাধান নিয়ে এল। কিন্তু আমি আপনার কাছে কিছু লুকোতে চাই না, নিজের সুবিধার জন্য আপনার পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাই না। আমি নিজের সম্পর্কে সবটা বললাম, এখন আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন আমি মেনে নেব।

আলেখ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটু হেসে বলল,

ইউ নো মিস বাসু, আমি শিওর হয়ে গেলাম, আপনাকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে পছন্দ করে আমি কোনও ভুল করিনি।

কুহেলি এরকম উত্তর আশা করেনি, ও ভেবেছিল আলেখ হয়তো সবটা জেনে আর এগোতে চাইবে না। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে আলেখ বলল,

মিস বাসু, পাস্ট ইজ পাস্ট। আগে আপনি কি করেছেন সেটা আমার কাছে কোনও গুরুত্ব রাখে না, আপনি বর্তমানে কি চান সেটাই আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট। ভালোবাসা কোনও অপরাধ নয়, আপনি একজনকে ভালোবেসেছিলেন কিন্তু সেটা কোনও কারণ বশত পূর্ণ হয়নি। এটা তো হতেই পারে, আর রইল আপনার মনের কথা, মিস বাসু আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনার ওপর আমি কখনও স্বামীর অধিকার দাবী করব না। কাউকে ভালোবাসলে তাকে বললেই যে ভুলে যাওয়া যায় না এটা আমি বুঝি, ডোন্ট ওয়ারি।

কুহেলি অবাক হয়ে আলেখের দিকে তাকিয়ে রইল, মানুষটাকে যত দেখছে ততই মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ছে। আলেখ বলল,

আমি আবার আজকে আপনাকে জিজ্ঞেস করছি মিস বাসু, উইল ইউ ম্যারি মি?

কুহেলি দেখল আলেখ হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, কুহেলিও একটু হেসে বলল,

ইয়েস। কিন্তু স্যার আমার আরও একটা কথা বলার আছে।

আলেখ ভ্রূ দুটো উপরে তুলে বলল,

কি?

আমাদের কমিউনিটি তো আলাদা, তাই আমি ঠিক জানি না এটা শোনার পর ঠাম্মু কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে। আসলে উনি পুরনো দিনের মানুষ তো, তাই… কিন্তু উনি নিজে আমাকে বলেছিলেন আমি যাকে পছন্দ করব তাকেই উনি মেনে নেবেন কিন্তু তাও আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারছি না। আমার মা বা আমার মামাবাড়ির কাউকে নিয়ে সমস্যা হবে না, শুধু ঠাম্মুর কথা টাই…. আচ্ছা আপনার বাড়িতে এটা নিয়ে সমস্যা হবে না?

আলেখ হেসে উত্তর দিল,

একেবারেই না, আমাদের ফ্যামিলিতে মানে রিলেটিভস দের মধ্যে অনেকেরই এইরকম বিয়ে হয়েছে। আমার এক তায়া জী মানে আমার বাবার একজন বড় ভাই, উনি তো গুজরাটি মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। আমাদের ফ্যামিলিতে এটা কোনও সমস্যাই নয়, অ্যান্ড যতটা আমি আপনার কাছে শুনলাম আপনার গ্র্যান্ড মাদারও আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না। হ্যা, হতে পারে শুরুতে হয়তো একটু আপত্তি করবেন কিন্তু উনি আপনাকে যতটা ভালোবাসেন তাতে উনি ঠিক মেনে নেবেন।

আমারও তাই ধারনা কিন্তু যতক্ষণ না কথা বলছি ততক্ষণ আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছি না।

ঠিক আছে আপনি বাড়িতে কথা বলে নেবেন, কিন্তু আমি বলব এই বিষয়ে আপনি ফোনে কথা না বলে সামনা সামনি কথা বলবেন।

হ্যা, কিন্তু এখন বাড়ি কীকরে যাব? এই কদিন আগেই তো ঘুরে এলাম, এখন আবার ছুটি নেওয়া টা.. আর তাছাড়া নতুন প্রজেক্টটাও শুরু হচ্ছে।

মিস বাসু, কাজ ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু এই ম্যাটার টাও তো দেখতে হবে। আমি আজকে ড্যাড কে আমার ডিসিশন জানিয়ে দেব, ড্যাড অবভিয়াসলি আপনার সাথে দেখা করতে চাইবে, যদি আপনার প্রবলেম না থাকে তাহলে কালকে আমি আপনার সঙ্গে ড্যাডের পরিচয় করাতে চাই।

কুহেলি আচমকা এমন একটা প্রস্তাবে চমকে উঠল।

হ্যা!! না মানে.. স্যারের সামনে আমি কীকরে…

রিল্যাক্স মিস বাসু, একদিন তো পরিচয় করতেই হবে।

হ্যা, কিন্তু…

মিস বাসু, আপনার ভয়ের কিছু নেই, আমি তো থাকব।

কুহেলি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। আলেখ আবার বলল,

মিস বাসু, আমি একটা কথা বলতে চাই।

বলুন।

আমরা বিয়েটা কেন করছি সেটা নিয়ে আপনার আর আমার দুজনের বাড়িতেই প্রশ্ন উঠবে। আমিও বিয়ে করতে চাইছিলাম না, আর আপনিও তাই। সেক্ষেত্রে হঠাৎ করে আমরা কেন বিয়ে করছি এটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাড়িতে তো আসল কারনটা বলা সম্ভব নয়, তাই আমাদের অন্য কিছু ভাবতে হবে। একই রিজন আপনি আর আমি দুজনেই নিজেদের ফ্যামিলিকে দেব।

হুম, কিন্তু কি?

সেটাই তো ভাবছি, যেখানে আমরা বিয়েই করতে চাইছিলাম না সেখানে এটাও বলা যাবে না যে উই লাভ ইচ আদার, এটা মোটেই বিশ্বাস যোগ্য হবে না।

রাইট, বিশেষ করে আমার বাড়িতে তো কিছুতেই এটা বিশ্বাস করবে না।

হুম, আমারও।

আলেখ একটু ভেবে বলল,

আচ্ছা, এরকম বললে কেমন হয়। আমি সত্যিই বিয়ে করতে চাইছিলাম না, ড্যাডের কথায় রাজী হতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু এমন কাউকে বিয়ে করতে চাইছিলাম যাকে আমি অলরেডি চিনি আর যে আমার বিজনেসে হেল্প করতে পারবে। ইউ আর জাস্ট পারফেক্ট ফর দ্যাট।

কুহেলি একটু ভেবে বলল,

হুম, এটা বলা যেতে পারে, কিন্তু আপনাকে বিজনেসে হেল্প করতে পারে এরকম তো অনেক মেয়ে আছে, কত বড় বড় বিজনেস ওম্যান রয়েছে। তাদের বিয়ে করলে তো বরং আপনার আরও বেশি সুবিধা হত।

নো মিস বাসু, ওঙ্কার গ্রুপসের জন্য অন্য কারো থেকে আপনি বেটার। আপনি ওঙ্কার গ্রুপসের সবটাই খুব ভালো করে জানেন, ইউ আর অলরেডি এ পার্ট অফ দ্য কোম্পানি। ইভেন লাস্ট প্রজেক্টের সাকসেস অনেকটাই আপনার জন্য, ড্যাডও সেটা জানে।

বাট, আই অ্যাম স্টিল জাস্ট অ্যান এম্প্লই।

ওটা কোনও প্রবলেম নয়, ড্যাড এটা নিয়ে কোনো আপত্তি করবে না। আপনি বলুন এই রিজন টা আপনার ফ্যামিলিকে কনভিন্স করবে কিনা?

আমার জন্য এটা খুব একটা প্রবলেমের ব্যাপার নয়। আমার বাড়িতে সবাই জানে আমার স্বপ্ন টা কি আর সেটা আমার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এরকম সিচুয়েশনে আপনাকে বিয়ে করাটা যে আমার কাছে বেস্ট অপশন সেটা আর আলাদা করে বলে দিতে হবে না। আমাকে তো কাউকে না কাউকে বিয়ে করতেই হত, সেখানে আপনি যে রিজন টা বলছেন তার জন্য নিজে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন, সুতরাং আমার আপত্তি করার কোনও কারণ নেই।

হুম, গ্রেট। তাহলে তো এটা নিয়ে আর সমস্যা থাকল না।

হুম।

তাহলে কালকে কিন্তু আপনি আমার আর ড্যাডের সঙ্গে ডিনার করছেন।

হুম।

কথায় কথায় কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চলেছে দুজনের কারোরই খেয়াল হয়নি। হঠাৎ বেশ কিছু পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনে দুজনেই আকাশের দিকে তাকাল। ফিকে হয়ে আসা দিনের আলোয় পাখিরা যে যার ঘরে ফিরছে, ওরা যে গাছটার নিচে বসে আছে সেখানেও দেখা গেল অনেক পাখির বাস। আলেখ বলল,

আমাদেরও এবার ফেরা উচিৎ।

হ্যা, সন্ধ্যে হয়ে আসছে।

দুজনে উঠে গাড়ির দিকে এগোল। সন্ধ্যের সময় রাস্তাটা আরও ফাঁকা, অনেকক্ষন পরে হয়তো দু একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে। আলেখ ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ বলল,

মিস বাসু, তখন আপনি বললেন আপনার ফাদার…. মানে কিভাবে? যদি আপনার প্রবলেম থাকে দেন ইটস ওকে, বলতে হবে না। আমি এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।

কুহেলি সামান্য হেসে বলল,

কোনও অসুবিধা নেই, এমনিতেও আপনাকে তো সবই বলেছি। ইভেন যেটা আমার ফ্যামিলির কেউ জানে না সেটাও বলেছি। সেখানে এটা না বলার তো কোনও কারণই নেই। আমার বাবা একজন আর্মি অফিসার ছিলেন, লেফট্যানেন্ট অরিন্দম বসু। আমার যখন তিন বছর বয়স তখন কার্গিল যুদ্ধে বাবা শহীদ হন।

ও। স্যাড বলব না, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার থেকে বড় গৌরব আর হয় না।

হুম, আমি ভিষন গর্ববোধ করি বাবাকে নিয়ে, শুধু একটাই আফসোস, আমার স্মৃতিতে বাবার এতটুকু ছায়াও নেই।

কুহেলির মনটা হঠাৎ করেই খুব খারাপ হয়ে গেল। আলেখ সেটা লক্ষ্য করে বলল,

মন খারাপ করবেন না, মিস বাসু। আই অ্যাম শিওর, উনি যেখানেই থাকুন আপনাকে কষ্ট পেতে দেখলে উনিও কষ্ট পাবেন।

কুহেলি নিজের চোখের কোণে আসা জলটুকু মুছে নিয়ে বাইরের দিকে তাকাল, দুপুরে যেটুকু মেঘ ছিল সেটুকুও নেই। আকাশ একদম পরিষ্কার, অজস্র নক্ষত্র ফুটে রয়েছে সেখানে। তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে পুরনো সিনেমার সেই কমন ডায়লগ টা মনে পড়ে গেল, মানুষ মারা গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়। কুহেলি এইসব ছেলে ভুলানো কথা বিশ্বাস করে না, জানে এগুলো শুধুই বাচ্চাদের মন রাখা কথা। কিন্তু তাও কেন যেন আজ বারবার ওই লক্ষ্য কোটি তারার ভিড়ে নিজের বাবার মুখটা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল। আলেখ ড্রাইভ করতে করতে কুহেলির দিকে দেখছিল, স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওর মনটা খারাপ হয়ে রয়েছে। আলেখ কুহেলির মনটা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য বলল,

মিস বাসু আপনি লক্ষ্য করেছেন আমাদের মধ্যে অনেককিছু কমন আছে।

আলেখের কথায় কুহেলি যেন আচমকা ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবের মাটিতে এসে পড়ল।

হ্যা?

বলছি আমাদের মধ্যে বেশ কিছু জিনিষ কমন আছে। যেমন আমরা দুজনেই নিজের কাজটাকে নিজের লাইফ মনে করি, আমাদের দুজনের কাছেই আমাদের ফ্যামিলি খুব গুরুত্বপূর্ণ, নিজেদের প্রিয় মানুষটার জন্য আমরা দুজনেই সব করতে পারি।

কুহেলি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

হুম, তা ঠিক।

আলেখ একটু থেমে বলল,

আরও একটা জিনিষ কমন আছে আমাদের মধ্যে।

কি?

আমাদের দুজনের জীবনেই একটা বড় শূন্যস্থান আছে। আমার মায়ের অভাবটা আমি আজও অনুভব করি আর আমি জানি আপনিও আপনার বাবার অভাবটা সবসময় অনুভব করেন। আমার থেকে আপনার কষ্টটা হয়তো আরও বেশি, আমার কাছে তাও আমার মায়ের সঙ্গে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোর স্মৃতি আছ, আপনার কাছে তো সেটাও নেই।

কুহেলি কিছু বলল না, মাথাটা নামিয়ে নিল। আলেখ হঠাৎ একটু ইতস্তত করে ওর বা হাতটা কুহেলির কোলের ওপরে রাখা একটা হাতের উপরে রেখে বলল,

জানি কারও অভাব কেউ পূরণ করতে পারে না, আমি নিজে সেটা অনুভব করেছি। কিন্তু তাই বলে মন খারাপ করে কি লাভ? সেই মানুষটার জন্যই আমাদের উচিৎ আরও বেশি করে খুশি থাকার চেষ্টা করা। আমি তো সবসময় সেই চেষ্টাই করি, আমার মা আমার কষ্ট সহ্য করতে পারত না, আপনার বাবাও নিশ্চয়ই আপনাকে কষ্টে দেখে খুশি হতেন না। কোনও বাবা মাই তাদের সন্তানের কষ্ট দেখতে পারেন না, তাই আমাদের কিন্তু এটা একটা দায়িত্ব, নিজেদের খুশির মাধ্যমে ওদের খুশি রাখা, আমরা খুশি থাকলে ওরাও খুশি হবেন।

আলেখের কথাগুলো খুব অদ্ভুত ভাবে কুহেলির মনটা শান্ত করে দিল, ওর হাতের ছোয়ায় যেন একটা প্রচ্ছন্ন আশ্বাস অনুভব করল কুহেলি। কিছুক্ষণ পর আলেখ ওর হাতটা সরিয়ে নিল, লোকালয়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে কিছুক্ষণ হল, তাই রাস্তার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না আলেখ। কিন্তু মাঝে মাঝেই আড় চোখে দেখে নিচ্ছে কুহেলিকে, এখন অনেকটা শান্ত মনে হচ্ছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কুহেলির অ্যাপার্টমেন্ট এসে গেল, কুহেলির সঙ্গে আলেখও গাড়ি থেকে নেমে দাড়াল। আলেখ বলল,

মিস বাসু আমি আজকে গিয়ে ড্যাড কে আগে আমার ডিসিশন টা জানাব। ড্যাডের সাথে কথা বলে কি হয় আমি আপনাকে জানিয়ে দেব, টেনশনের কিছু নেই আমি জানি ড্যাড খুশি মনেই এটা মেনে নেবেন। তাও আমি আপনাকে জানিয়ে দেব, আর হ্যা, কালকের ডিনার টা কিন্তু ফাইনাল, টাইমটা পরে জানিয়ে দেব। কালকের ডিনার টার পর আপনার বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা আলোচনা করা যাবে।

কুহেলি শুধু মাথা নাড়ল। এখানে তার তেমন কিছুই বলার নেই। হঠাৎ করে এতকিছু ঘটছে ওর জীবনে, মাঝে মধ্যে সন্দেহ হচ্ছে এগুলো আদৌ ঘটছে তো, নাকি স্বপ্ন দেখছে! আলেখ বলল,

তাহলে আমি এখন আসছি, গুড নাইট।

গুড নাইট।

আলেখ চলে যাওয়ার পর কুহেলি ফ্ল্যাটে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসল। এত গুলো কথাবলার পরেও ওর বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আলেখ ওকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছে আর ও এই একটু আগে সেই প্রস্তাবে নিজের সম্মতি জানিয়ে এসেছে। সব কিছু ঠিক হলে অদূর ভবিষ্যতে ও বিয়ে করতে চলেছে তাও আবার আলেখ শর্মা কে! সত্যিই জীবন খুবই অপ্রত্যাশিত, কখন কি হয় কিছুই বলা যায় না। চুপচাপ বসে গত কয়েকমাসে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কথা ভাবছিল। ভাবনার জগতে এতটাই মগ্ন হয়েছিল, কোথা থেকে যে দুটো ঘণ্টা কেটে গেছে বুঝতেই পারেনি। এখনও হয়তো টের পেত না, কিন্তু পাশে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠতেই ভাবনার জাল গুলো নিমেষে ছিড়ে গেল। স্ক্রীনে আলেখের নাম ফুটে উঠেছে, বুকটা কেমন যেন ধড়ফর করে উঠল। কাপা হাতে ফোনটা রিসিভ করল,

হ্যালো।

ডিস্টার্ব করলাম না তো?

না, না, বলুন।

আমি এই কিছুক্ষণ আগে ড্যাডের সঙ্গে কথা বলে এলাম। অ্যাস এক্সপেকটেড, ড্যাডের এই সম্পর্কে কোনও আপত্তি নেই, ইনফ্যাক্ট আমি ফাইনালি বিয়েতে রাজি হয়েছি, এতেই ড্যাড ভিষন খুশি। আর আমি যা বলেছিলাম, আপনার কথা শোনা মাত্রই ড্যাড আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। সো কালকের ডিনারটা একদম ফাইনাল, রাত আটটায় আমাদের বাড়িতে, আমি নিজে আপনাকে নিয়ে আসব।

ওকে।

ওকে মিস বাসু, এখন আর বেশি কথা বলব না, আপনি রেস্ট করুন। গুড নাইট।

গুড নাইট।

ফোনটা রেখে কুহেলির মনে হল ওর মধ্যে সেই নার্ভাসনেস টা আবার ফিরে এসেছে। আজ অবধিও যে ওর বস ছিল, কালকেই তার সঙ্গে তার বাড়িতে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে, ভবিষ্যৎ পুত্রবধূ হিসেবে!! নাহ, কুহেলি আর বেশি ভাবল না। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন এরপরেও যা হওয়ার সেটাই হবে, শুধু শুধু এত ভেবে লাভ নেই। ঘড়িতে সময় বলছে রাত দশটা, এত তাড়াতাড়ি সচরাচর ও ডিনার করে না, কিন্তু আজ আর ভালোলাগছে না। ফ্রিজ থেকে খাবারগুলো বের করে গরম করে, ডিনার সেরে শুয়ে পড়ল। কালকের দিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, মস্তিষ্কটাকে একটু আরাম করতে দেওয়া উচিৎ।

ক্রমশ____________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগল আজকের পর্ব? আশা করি আপনাদের ভালোলাগছে। ভালোলাগলে আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আপনাদের কমেন্টের অপেক্ষায় থাকব। পরের পর্বে আপনাদের সাথে পরিচয় করাব আলেখের বাবা মিস্টার নভতেজ শর্মার সঙ্গে। কি মনে হয়, কেমন হবে কুহেলি আর মিস্টার নভতেজ শর্মার প্রথম আলাপ? কুহেলির পরিবারের প্রতিক্রিয়াও বা কেমন হবে? আপনাদের মতামত জানাবেন কিন্তু। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here