#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৩৪
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
খুব সকালে ঘুমটা ভেঙে গেল কুহেলির, আল্যার্ম বাজার বেশ আগেই। ঘুমের রেশটা একটু কাটতেই কুহেলি বুঝতে পারল নিজের অবস্থানটা। আলেখের বুকের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে যেন একটু লজ্জা পেল, পুব আকাশের রক্তিম ছটা যেন সযত্নে লালের পরশ ছুঁইয়ে দিল ওর তপ্ত হয়ে আসা গাল দুটোয়। আলেখ দুহাতে জড়িয়ে রেখেছে ওকে, ঘুমন্ত মুখটায় যেন একটা মিষ্টি হাসি লেগে আছে। কালকের সব মুহূর্ত গুলো যেন ছবির মত ভেসে উঠতে লাগল কুহেলির চোখের সামনে। আলতো এক টুকরো হাসি যেন অজান্তেই খেলে গেল ওর পাতলা ঠোঁট দুটোয়। খুব সন্তর্পনে আলেখের গালে ওর ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে হালকা স্বরে বলল,
গুড মর্নিং।
ঘুমন্ত আলেখের কাছে প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশা না করে কুহেলি একটু ধীরে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। আলেখের বাহুদ্বয়ের বেষ্টনীর বৃত্ত থেকে নিজেকে মুক্ত করার কোনও পথ খুঁজে পেল না। বেশি নড়াচড়াও করতে পারছে না, আলেখের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। কিছুক্ষণ নানা প্রকারে অল্প বিস্তর চেষ্টা চরিত্র করে এক সময় হাল ছেড়ে দিল। আলেখের ঘুমন্ত মুখটার দিকে আরও একবার তাকিয়ে একটু হেসে কুহেলি বলল,
ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাকে আরও বেশি ভালোলাগে।
কুহেলিকে একরকম চমকে দিয়ে আলেখ বলে উঠল,
তাই বুঝি?
কুহেলি কিছুক্ষণ হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল আলেখের ঘুমন্ত মুখের দিকে। না না, ঘুমন্ত কোথায়!! এইতো কথা বলল, তার মানে….. ইশ, কি বাজে মানুষ!! কুহেলি এবার আর কোনও সন্তর্পনতার লক্ষণ না দেখিয়ে এক প্রকার জোর করেই সরে আসতে চাইল কিন্তু এবারেও তার প্রচেষ্টা ব্যর্থই হল। আলেখের দৃঢ় বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে তো পারলই না, উপরন্তু বাঁধনটা আরও একটু দৃঢ় হল। আলেখ ওর সবুজ চোখের তারায় একরাশ দুষ্টুমি নিয়ে বলল,
এত তাড়া কিসের? আরেকটু আদর করো না, বেশ লাগছিল।
কুহেলি কোথায় মুখ লুকোবে বুঝে উঠতে পারল না, মানুষটা এত ইয়ে কেন!! কুহেলি আলেখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবার সেই ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে লাগল। কিন্তু আলেখের হাতের বাধন এতটুকুও শিথিল হল না। শেষে কুহেলি ক্লান্ত হয়ে ওর ব্যর্থ প্রয়াসে ইতি টানতেই আলেখ বলল,
হয়েছে? না আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করবে?
কুহেলি কিছু বলল না, কি বলবে! ওর সব ভাষা তো এই মানুষটা বেমালুম গায়েব করে দিয়েছে। আলেখ একটু হেসে বলল,
তোমার আদর পাওয়ার জন্য কি এখন আবার নিদ্রাদেবীর আরাধনায় বসতে হবে? আমার অবশ্য আপত্তি নেই, বউয়ের এমন মিষ্টি আদরের জন্য এটুকু তো করাই যায়। ঘুমালে যদি এমন উপহার পাওয়া যায়, তাহলে আমি যখন তখন ঘুমিয়ে পড়তে পারি।
বলে আলেখ ওর চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করতে লাগল। কুহেলি একটু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল,
তুমি মোটেও তখন ঘুমাচ্ছিলে না।
আলেখ চোখ দুটো মেলে দুষ্টুমি ভরা চাহনিতে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,
তাই নাকি! কে বলল? আমি তো ঘুমিয়েই ছিলাম।
মোটেই না, তুমি জেগেই ছিলে।
উহু, আমি ঘুমিয়েছিলাম।
না, তুমি জেগেই ছিলে।
তাই! কীকরে বুঝলে আমি জেগেছিলাম?
জেগে না থাকলে তুমি কীকরে বুঝলে আমি তোমাকে…..
কুহেলির হঠাৎ যেন খেয়াল হল ও কি বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সময়ে নিজেকে সামলে নিল। তবে যা বলে ফেলেছে সেটুকুই যথেষ্ট ওকে বিব্রত করার জন্য। আলেখের চোখ দুটোয় দুষ্টুমির মাত্রা টা যেন আরও একটু বাড়ল। দুষ্টু একটা হাসি ঠোঁটের কোণে এনে বলল,
তুমি আমাকে কি? বল, থামলে কেন? বল তুমি আমাকে কি করেছিলে?
কুহেলি বুঝল এই ব্যক্তির সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা তার কর্ম নয়। তাই যেন কিছু জানেইনা এমন একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে কিছু না বলে চুপ করে রইল। কিন্তু আলেখ কি আর সহজে হাল ছাড়ার পাত্র! একটু মুচকি হেসে বলল,
সেকি! এর মধ্যেই ভুলে গেলে নাকি! আচ্ছা বেশ, আমিই না হয় মনে করিয়ে দিচ্ছি।
বলে আলেখ ধীরে ধীরে ওর মুখটা এগিয়ে আনতে লাগল কুহেলির দিকে। কুহেলি এমন কিছু একেবারেই আশা করেনি, কিন্তু সেও কম যায় না, দুষ্টু বুদ্ধি তারও এমন কিছু কম নয়। অল্প হেসে আলেখের পেটে একটা মোক্ষম চিমটি কেটে বসল। ব্যাস, আর কি! বাকিটা তেমনই হল যেমনটা হওয়া উচিৎ। কুহেলির এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য আলেখ মোটেই প্রস্তুত ছিল না, একটা ‘আউচ’ শব্দের সঙ্গে ওর হাতের বাঁধনটা সামান্য শিথিল হতেই কুহেলি এক লাফে বিছানা থেকে নেমে আলেখকে একটু জিভ ভেঙিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। আলেখ একটু মৃদু হেসে উঠে ওর জগিং সেট টা বের করতে লাগল। কুহেলি অভ্যাস মত একেবারে স্নান সেরে বেরিয়ে দেখল আলেখ ল্যাপটপে কিছু একটা করছে।
সাত সকালে ল্যাপটপ নিয়ে কি করছ?
আলেখ ল্যাপটপ থেকে চোখ না তুলেই বলল,
একটা মেল চেক করছি।
এখনই করতে হবে?
হুম, আসলে কালকেই অঙ্কিত বলেছিল অফিসে বাট টাইম পাইনি, আর বাড়ি ফেরার তাড়ায় পরে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন হঠাৎ মনে পড়ল তাই ভাবলাম আবার ভুলে যাওয়ার আগে চেক করে নিই।
তাই বলে সকালে উঠেই কাজ নিয়ে বসবে? আগে ফ্রেশ হয়ে এস তারপর কাজ করো।
আলেখ চোখ তুলে অবাক হয়ে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,
এটা তুমি বললে! যে কিনা নিজে কাজ ছাড়া আর কিছু বোঝে না, এমনকি খেতে পর্যন্ত ভুলে যায় সে এই কথা বলছে!
কুহেলি চুলটা আঁচড়ে সিঁদুর পরে উঠে এসে বলল,
হ্যা বলছি, আমি যখন কাজ করি তখন বাকি সব ভুলে যাই ঠিকই তবে এখন আর খেতে ভুলি না, আর তোমার মত সাত সকালে উঠেই কাজ নিয়ে বসি না।
আলেখ একটা দুষ্টু হাসির আভাস এনে বলল,
হুম, তুমি তো এখন সাত সকালে উঠে অন্য কিছু করো।
কুহেলি আবার লজ্জায় লাল হয়ে গেল, এই মানুষটা মনে হচ্ছে ওকে স্থায়ী রূপে লাজুকলতা বানিয়েই ছাড়বে। কুহেলি আর কথা না বাড়িয়ে বিছানাটা ঠিক করতে শুরু করল। বালিশ গুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতেই হঠাৎ খেয়াল হল ওর প্রিয় কোলবালিশটা নেই! নেই মানে নেই, কোথাও নেই, একেবারে উধাও! কুহেলি ভারী অবাক হল, স্পষ্ট মনে আছে কালকে রাতেও কোলবালিশটা এখানেই ছিল অথচ এখন আর নেই! কি অদ্ভুত ব্যাপার! কুহেলি প্রায় গোটা ঘর খুঁজে ফেলল, কিন্তু কোলবালিশের চিহ্নও খুঁজে পেল না। আলেখ ল্যাপটপের স্ক্রীন থেকে একবার চোখ তুলে বলল,
কি খুঁজছ?
আমার কোলবালিশটা।
আলেখ আবার ল্যাপটপে মনোনিবেশ করে নির্বিকার চিত্তে বলল,
ওটা পাবে না।
কুহেলি খোঁজা বন্ধ করে বেশ অবাক হয়ে বলল,
মানে! পাব না কেন?
কারণ ওটা আমি সরিয়ে রেখেছি।
কুহেলির মুখটা যেন হা হয়ে গেল, মানে টা কি! আলেখ ওর কোলবালিশ সরিয়ে রেখেছে! কিন্তু কেন?
তুমি সরিয়ে রেখেছ?
হুম।
কেন?
আলেখ ওর ল্যাপটপ টা বন্ধ করে একটা পাশে রেখে সোজা কুহেলির কাছে এসে দুহাতে ওর কোমরটা জড়িয়ে একদম কাছে এনে বলল,
কারণ কোলবালিশটা কে বড্ড হিংসা হচ্ছিল। মাঝরাতে উঠে দেখলাম এমন ভাবে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছ, খুব রাগ হল তাই সরিয়ে দিলাম।
কুহেলি কিছু বলার মত খুঁজেই পেল না, কোলবালিশ কে হিংসা! ভাবা যায়! কেউ এমন কথা কস্মিনকালেও শুনেছে কিনা সন্দেহ। কুহেলি হাসবে না কাঁদবে না কি করবে ভেবে পেল না। ওর অমন হতভম্ব মুখটা দেখে আলেখ একটু হেসে বলল,
কিহল মিসেস শর্মা? অমন হা করে কি দেখছ?
ভাবছি তুমি শেষে একটা কোলবালিশ কে হিংসা করছ?
হুম করছি তো, আর কেন করব না বলতো? আমাদের মাঝখানে ওই কোলবালিশ কেন থাকবে?
কুহেলি হেসে বলল,
কারণ কোলবালিশ ছাড়া আমার ভালো করে ঘুম হয় না।
আলেখ কুহেলিকে আরও একটু কাছে টেনে বলল,
কেন? কালকে ঘুম হয়নি? আর এত সুন্দর জলজ্যান্ত তোমার একান্ত ব্যক্তিগত কোলবালিশ থাকতে তুমি ওই নির্জীব তুলোর বালিশটাকে জড়িয়ে ঘুমাবে কেন শুনি?
কুহেলি আবারও লজ্জা পেল, কি মুশকিল! এখনও তো ঠিক মত দিন শুরুই হল না আর ইতিমধ্যে এই মানুষটা ওকে লজ্জাবতী লতায় পরিণত করে ফেলেছে। কুহেলির ঠোঁটের লাজুক হাসিটা আলেখের দুষ্টুমি করার ইচ্ছেটাকে যেন আরও একটু বাড়িয়ে দিল। কুহেলির কানের কাছে মুখটা নামিয়ে এনে খুব নীচু স্বরে বলল,
লজ্জা পেলে তোমাকে আরও বেশি সুন্দর লাগে।
কুহেলির লাল হয়ে আসা গাল দুটো আরও একটু লাল হল, আলেখ সেই রক্তিম কপোলে ওর তপ্ত অধরের আলতো পরশ বুলিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। কুহেলি কিছুক্ষণ সেভাবেই দাড়িয়ে থাকল, এত সুন্দর সকাল আগে বোধহয় কখনও আসেনি। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আজ আবার মেলা বসেছে, বিহান আর রাজীব তো আছেই সঙ্গে রাত্রিও। সবাই গল্পে মেতে উঠল, অধিকাংশ কথাই গতকালের পার্টির। যতবার গতকালের কথা উঠছে ততবার যেন কুহেলির চোখ দুটো আপনা থেকেই আলেখের দিকে চলে যাচ্ছে। রঙিন অনুভূতি গুলো যেন নতুন নতুন রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে ওদের হৃদয় দুটো। তবে অন্য একজনের মুখের সব রঙ উড়ে গিয়ে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বেচারি রাত্রির মুখখানা এক্কেবারে শুকিয়ে গেছে যেন, ওরকম উচ্ছ্বল ঝর্নার মত মেয়েটা কেমন যেন শান্ত দীঘির মত হয়ে গেছে। অন্য দিন হলে রাত্রির বকবকের চোটে অন্যরা কথা বলার সুযোগই পেত না, আর আজ যেন মুখে কথাই নেই, কোনরকমে দুচারটে উত্তর দিচ্ছে। আলেখ হঠাৎ খেতে খেতে বলল,
রিতু, কিরে! তুই এত চুপচাপ কেন? কি হয়েছে?
আলেখের বলার পর যেন অন্যদেরও খেয়াল হল, কুহেলিও এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি। সত্যিই রাত্রি আজ বড্ড চুপচাপ, মুখটা দেখে মনে হচ্ছে কোনোকিছু নিয়ে ভিষন মনখারাপ। রাত্রি ওর স্যান্ডুইচে আলগোছে একটা কামড় বসিয়ে বলল,
কিছু না, এমনি।
বললেই হল? বল কি হয়েছে।
আরে সত্যি কিছু হয়নি।
আলেখ ওর বাল্যবন্ধু কে খুব ভালো করেই চেনে, কিছু তো একটা হয়েছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও কুহেলির ইশারায় থেমে গেল। আসলে কুহেলি ভাবছিল হয়তো এমন কিছু হতে পারে যেটা ও সবার সামনে বলতে চাইছে না। আলেখ আর কিছু না বলে চুপচাপ খেতে লাগল, ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গেলে নভতেজ বাবু বাদে সবাই বেরিয়ে পড়ল। আলেখ কুহেলি অফিসের উদ্দেশ্যে, বিহান আর রাজীব এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে আর রাত্রি ওর বাংলোর উদ্দেশ্যে। কুহেলি আলেখকে একটু অপেক্ষা করতে বলে রাত্রির দিকে এগিয়ে গিয়ে হাসি মুখে বলল,
রাত্রি, তোমার সঙ্গে তো এখনও আমার সেভাবে টাইম স্পেন্ড করাই হল না। আজ সন্ধ্যেয় কি করছ?
রাত্রি অল্প হেসে বলল,
কিছু না, ফ্রী আছি।
গ্রেট, তাহলে আজকে চলো একটু শপিং করে আসি। ওনলি তুমি আর আমি আর কেউ না।
শপিংয়ের বিশেষ প্রয়োজন ছিল না, সদ্য এত শপিং করা হয়েছে তবে কুহেলি এই কয়েকদিনেই বুঝেছে রাত্রি যাকে বলে শপাহলিক। শপিংয়ে সে কিছুতেই না করবে না, আর হলোও তাই শপিংয়ের নাম শুনেই রাত্রির ফ্যাকাশে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
অফকোর্স, কোথায় কখন মিট করবে বলো।
সাড়ে পাঁচটায় স্কাইটাচ মল।
ডান।
রাত্রি চলে যেতেই কুহেলি এসে গাড়িতে উঠে বসল। আলেখ একটু কৌতূহলী হয়ে বলল,
কি বলছিলে?
কুহেলি অল্প হেসে বলল,
বলব কেন?
বাবা! আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের সঙ্গে কি কথা বললে সেটা আমাকেই বলবে না?
না, বলব না। সব কথা তোমাকে বলতে হবে নাকি?
কুহেলির গলায় মজার সুর, আলেখ একটু হেসে বলল,
সিরিয়াসলি বলো না, কি কথা বললে? রিতু অমন মুড অফ করে আছে কেন? আর তুমি তখন আমাকে থামিয়ে দিলে কেন?
ওরে বাবা এত প্রশ্ন এক সাথে করলে তো মুশকিল। দাড়াও এক এক করে উত্তর দিচ্ছি। তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হল আমরা শপিংয়ে যাওয়ার প্ল্যান করলাম, ওনলি আমরা তুমি কিন্তু নট আল্যাউড।
কেন?
আরে আগে আমাকে সব উত্তর গুলো দিতে দাও মাঝখানে কথা বলো না। তোমার সেকেন্ড প্রশ্নের উত্তর টা জানি না তবে জানার জন্যই শপিংয়ে যাচ্ছি। আর তোমার লাস্ট প্রশ্নের উত্তর টা কি তোমায় সত্যিই দিতে হবে?
মানে?
মানে তুমি এতোটা ম্যাচিয়োর্ড হওয়ার পরেও বুঝতে পারছ না! রাত্রি হয়তো সবার সামনে বলতে চাইছিল না।
আলেখ একবার সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে বলল,
হুম, হতে পারে। তবে আমার মনে হয় না তেমন কোনও রিজন আছে। ওকে আমি খুব ভালো করে চিনি, ওর মুড অফ্ হওয়ার জন্য বিশেষ কোনো কারণ লাগে না। প্রথমে মনে হয় বিরাট কিছু শেষে দেখা যায় নিতান্তই সামান্য কোনও ব্যাপার।
তাও হতে পারে, যাই হোক না কেন একসাথে শপিংয়ে তো যাচ্ছি ঠিক জানতে পারব। আর তাছাড়াও আমার সত্যিই ওর সাথে একটু ভালো করে মেশাই হল না এখনও।
আলেখ একটু একপেশে হাসি হেসে বলল,
কীকরে মিশবে বলো! সহ্যই তো করতে পারছিলে না বেচারীকে!
আলেখ কথাগুলো কুহেলিকে রাগানোর জন্য বললেও কুহেলি একটুও না রেগে বলল,
হুম, ঠিক যেমন তুমি মিস্টার আগরওয়ালকে সহ্য করতে পারোনা।
কুহেলি এমন উত্তর দেবে আলেখ ভাবতে পারেনি, কোথায় কুহেলিকে একটু রাগাতে গেল এখন উল্টে নিজেরই রাগ হচ্ছে। আলেখ নিজেও জানে না ওর নিশীথের নাম শুনলেই এত কেন রাগ হয়! কই দেবার্ঘ্যর সঙ্গে আলাপ করেও তো এতোটা রাগ হয়নি! বরং সেটা হলেও না হয় একটা কথা ছিল, কুহেলি একটা সময় ভালোবাসতো দেবার্ঘ্যকে। কিন্তু নিশীথ কে তো কুহেলি বন্ধুর বেশি কিছু ভাবেইনি কোনদিনও। তাহলে ওর এত রাগের কারনটা কি? উত্তর আলেখেরও অজানা। যাই হোক, সারাটা দিন কাজের মধ্যে দিয়েই পেরিয়ে গেল, ঠিক পাঁচটায় কুহেলি নিজের কাজ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আলেখের একটু সময় লাগবে, ওর কিছু কাজ বাকি আছে এখনও। কুহেলির স্কাইটাচে পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না, সাড়ে পাঁচটার কিছু আগেই এসে পড়ল। রাত্রিও একটু আগেই এসেছে, কুহেলিকে দেখেই এগিয়ে এল।
তুমিও আগেই এসে পড়েছ?
হুম, জ্যাম ছিল না তাই সময় টা কমই লাগল। তুমিও তো আগেই এসেছ।
ইয়েস, বিকজ আই লাভ শপিং।
আবার সেই প্রানবন্ত রাত্রিকে দেখতে পাচ্ছে কুহেলি, সকালের মনখারাপ ভাবটার ছিটেফোটাও নেই। রাত্রি ভিষন উত্তেজিত হয়ে বলল,
কুহেলি আমি আগে এথনিক সেকশনে যাব। সেদিন এথনিক সেকশনের দিকে যাওয়াই হয়নি।
বেশ, তাই চল।
দুজনে বেশ জমিয়ে শপিং করল। কুহেলি তেমন কিছু কিনবে না ভেবেছিল কিন্তু যতই হোক এমন সম্ভার দেখলে আর সঙ্গে যদি রাত্রির মত সঙ্গী থাকে তাহলে ওসব পূর্বপরিকল্পিত চিন্তা ভাবনাগুলো কোথায় যে হারিয়ে যায় তার আর খোজ পাওয়া যায় না। নয় নয় করেও কুহেলি প্রায় অনেক কিছুই কিনে ফেলল, আর রাত্রির কথা নাহয় নাই বা বললাম। শপিং শেষে দুজনে গেল ফুডকোর্টে, ইচ্ছে ছিল কোনও রেস্তোরায় যাবে তবে এই বহুল পরিমাণ ব্যাগের সম্ভার নিয়ে সে চিন্তা বাদ দিতে হল। দুজনে মুখোমুখি বসে আগে কিছুক্ষণ দম নিয়ে নিল, এতক্ষণ শপিং করে আর এত ব্যাগ বয়ে দুজনেই ক্লান্ত। ওয়েটার ওদের অর্ডার নিয়ে চলে যাওয়ার পর কুহেলি এটা সেটা বলার পর বলল,
আচ্ছা রাত্রি একটা কথা বলবে?
হুম, বলো না।
তুমি সকালে অমন মুড অফ করেছিলে কেন? দেখে মনে হচ্ছিল যেন যেন কোনও চিন্তায় আছ।
রাত্রির মুখটা আবার কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে এল। কুহেলি সেটা লক্ষ্য করে বলল,
তুমি যদি বলতে না চাও তাহলে বলো না, ইটস ফাইন। তখন আলেখ তোমাকে আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল আমিই বারন করলাম। হয়তো তুমি সবার সামনে বলতে চাও না।
রাত্রি ব্যস্ত হয়ে বলল,
আরে না না, তেমন কিছু না, কাজের ক্ষেত্রেই একটু প্রবলেম হয়েছে আর কি। আসলে আমি ভাবছিলাম কী বলব? কারণ যে সিচুয়েশন টা ক্রিয়েট হয়েছে তাতে কিছুটা দোষ আমারও আছে। অ্যাকচুয়ালি পুরো দোষটাই আমার, আর আলু আবার ভিষন পারফেক্ট এসব বিষয়ে, তুমি তো জানোই। কাজের ক্ষেত্রে কোনরকম গাফিলতি ওর পছন্দ নয়, শুনলে হয়তো উল্টে আমাকেই বকতে শুরু করে দিত তাই আর কিছু বলিনি।
বুঝলাম, তো প্রবলেম টা কি সিরিয়াস?
নাহ, সিরিয়াস নয় তবে যেহেতু আমার নিজেরই দোষ তাই ভালোলাগছে না।
তোমার যদি প্রবলেম না থাকে তাহলে বলতে পারো।
আরে প্রবলেম কেন থাকবে! কি বলছ তুমি?
রাত্রি একটু থামল, কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
আচ্ছা তুমি নিশীথ আগরওয়ালকে চেন?
রাত্রির মুখে নিশীথের নাম শুনে কুহেলি একটু অবাক হল।
তুমি কীকরে চেন ওনাকে?
বলনা, চেন?
হুম, চিনি।
কীকরে? মানে কিভাবে?
কেন বলতো?
কালকে পার্টিতে দেখলাম, তাই ভাবলাম তোমাদের পরিচিত।
হ্যা, পরিচিত। ওনাদের কোম্পানির সঙ্গে আমাদের একটা জয়েনট ভেঞ্চার চলছে। এর আগেও এই দুটো কোম্পানি একসাথে কাজ করেছে। সেইসুত্রেই আলাপ, আর সেখান থেকেই বলতে পারো ওনার সাথে আমার বন্ধুত্ত্ব।
নিশীথ আগরওয়াল তোমার বন্ধু?
হুম। আচ্ছা এবার বলতো তুমি ওনাকে কীকরে চিনলে?
রাত্রি এবার ওকে বাকি ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল, শুনে কুহেলি বলল,
এটা করা সত্যিই তোমার উচিৎ হয়নি।
আই নো, বাট তার জন্য এভাবে আমাকে আল্টিমেটাম দিয়ে দিল?
নিশীথের তরফ থেকে রাত্রির কাছে একটা মেল এসেছে যার বক্তব্য হল আগামী দুদিনের মধ্যে যদি রাত্রি শ্যুট শুরু না করে তাহলে কনট্র্যাক্ট বাতিল করে দেওয়া হবে। আর সেটা রাত্রির পক্ষে মোটেই লাভ জনক নয়, কারণ হিসেব অনুযায়ী রাত্রি কনট্র্যাক্টের উলঙ্ঘন করেছে তাই ক্লজ অনুযায়ী ওকে মোটা অঙ্কের মাশুল গুনতে হবে। নিশীথ যে এতটা করবে রাত্রি ভাবেনি, আর তাছাড়া কীকরে জানবে যে এখানে এসে বেছে বেছে সেই নিশীথ আগরওয়ালের সঙ্গেই দেখা হবে! তাও আবার অমন ভাবে। কুহেলি বলল,
মিস্টার আগরওয়াল যে ঠিক কতটা পারফেকশনিস্ট আর নিজের কাজের প্রতি কতটা ডেডিকেটেড সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি নিজে দেখেছি ওনার ঠিকমত সোজা হয়ে বসার পর্যন্ত ক্ষমতা ছিল না কিন্তু তাও উনি মিটিং ক্যানসেল করেননি। তুমি এটা একদম ঠিক করনি রাত্রি, আই অ্যাম শিওর আলেখও শুনলে একই কথা বলবে।
সেটা আমিও জানি, আর আমি তো বলছি দোষটা আমারই। কিন্তু কি করতাম বলতো! এত কাজ করতে করতে হাপিয়ে উঠেছিলাম, তার মধ্যে তোমাদের বিয়ে রিসেপশন কোনোটাই অ্যাটেন্ড করতে পারিনি। আর পারছিলাম না, একটা ব্রেকের খুব দরকার ছিল।
সবটাই বুঝতে পারছি কিন্তু তাও… সে যাই হোক, ওসব নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমি তাহলে কবে ফিরছ?
রাত্রি একটু হতাশ হয়ে বলল,
কালকের ফ্লাইটেই ফিরতে হবে। পরশু যখন শ্যুট স্টার্ট করতেই হবে তখন এছাড়া তো আর উপায় নেই। অ্যামি মানে আমার পি এ, ওকে জানিয়ে দিয়েছি আজ রাতের মধ্যেই টিকিট মেল করে দেবে আমাকে।
হুম, মন খারাপ করো না, নেক্সট বার হাতে বেশি করে সময় নিয়ে আসবে। অবশ্যই নিজের কাজের কোনরকম ক্ষতি না করে।
রাত্রি একটু হাসল,
তুমি সত্যিই আলুর জন্য একদম পারফেক্ট লাইফ পার্টনার। এক্কেবারে এক, মনে হচ্ছে যেন আলুর সঙ্গেই কথা বলছি।
দুজনেই হেসে উঠল একথায়। পেট পুজো সেরে ওরা ওদের নতুন কেনা দ্রব্যাদির পাহাড় নিয়ে কোনরকমে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাল। অবশ্য মাঝপথে রাত্রি বেচারি অতগুলো ব্যাগ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল দেখে একজন সিকিউরিটি গার্ডের সাহায্য নিতেই হল। যাই হোক গাড়ির ব্যাক সিটটায় আর তিল ধারণের জায়গা নেই। ভাগ্যিস আলেখের গাড়িটা নিয়ে এসেছিল কুহেলি, আলেখের কথামতই অবশ্যই। রাত্রিকে ওর বাংলোর সামনে নামিয়ে দিয়ে কুহেলি ওঙ্কার ভিলায় প্রবেশ করল। দুইহাতে মোটামুটি গোটা পনেরো ছোট বড় প্যাকেট নিয়ে যখন নিজের ঘরে পৌঁছাল তখন আবার হাপিয়ে গেছে। আলেখ বেশ কিছুক্ষণ হল ফিরে এসেছে, অভ্যাস মত সোফায় বসে ল্যাপটপে মুখ গুজে কাজ করছিল। কুহেলি ঘরে ঢুকতেই চোখদুটো বড় বড় করে বলল,
একি! গোটা শপিং মলটাই তুলে নিয়ে এলে নাকি?
কুহেলি উত্তর না দিয়ে ধপ করে আগে সোফার একটা পাশে বসে বলল,
দাড়াও আগে একটু বসতে দাও।
আলেখ এক গ্লাস জল কুহেলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
শপিং করে এমন বিধ্বস্ত?
কুহেলি কিছুটা জল খেয়ে বলল,
হুম।
আলেখ অন্য কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কুহেলি বলল,
আগে আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর তোমার বাকি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।
কুহেলি যে বাইরে থেকে এসে ফ্রেশ না হয়ে একদন্ডও শান্তিতে বসতে পারে না এটা আলেখ এতদিনে জেনে গেছে। কুহেলি এক সেট ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল আর আলেখ সেন্টার টেবিলের উপর রাখা স্তুপাকৃত প্যাকেটগুলোর দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে আবার কাজে মন দিল। কুহেলি ফ্রেশ হয়ে বেরোতে আলেখ ল্যাপটপ টা সরিয়ে রেখে বলল,
হুম, এবার বল।
কুহেলি ওর ভিজে চুলগুলো মুছে সোফায় বসে সবকিছু খুলে বলল। আলেখ সব শোনার পরে বলল,
কি অদ্ভুত মেয়ে! এখনও ছেলেমানুষী গেল না। মিস্টার আগরওয়াল যে ডাইরেক্ট কনট্র্যাক্ট ক্যানসেল না করে ওকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন এটাই তো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
হুম, রাত্রি কালকেই ফিরে যাচ্ছে।
কটার ফ্লাইটে যাচ্ছে?
একটা উনিশ।
হুম, অফিস টাইম। সি অফ্ করতে যেতে পারলে হত।
তুমি চলে যেও, আমি তো থাকব অফিসে।
দুজনেরই যাওয়া উচিৎ।
সে তো ঠিকই, কিন্তু দুজন কীকরে যাব বল? তার থেকে তুমিই যাও।
হুম।
আলেখ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বলে উঠল,
আচ্ছা তুমি আমাকে রিতুর সঙ্গে একা ছেড়ে দিচ্ছ! তোমার রাগ হবে না?
কুহেলি নির্বিকার চিত্তে উত্তর দিল,
না।
কেন?
কেন মানে কি? আমার রাগ হওয়াটা উচিৎ বুঝি?
না, কিন্তু এইতো দুদিন আগেও মন খারাপ করে রাগ করে বসেছিলে।
সেটা তো দুদিন আগের কথা, এখনের কথা আলাদা।
আলেখের চোখ দুটোয় দুষ্টুমি গুলো খেলে বেড়াচ্ছে। ঠোঁটের হাসিতেও দুষ্টুমির ছোয়া এনে বলল,
কেন? এখন আলাদা কেন?
কুহেলি আলেখের এই ইচ্ছাকৃত উত্যক্ত করার কৌশল গুলো বেশ ভালই বোঝে। অল্প হেসে উত্তর দিল,
বুঝতে পারছো না কেন আলাদা?
আলেখ কুহেলির দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বলল,
উহু, পারছিনা। আমি একটু কম বুঝি, তুমি একটু ভালোবেসে বুঝিয়ে দিলে হয়তো বুঝতে পারব।
কুহেলি নিজের কানের পাশটায় আলেখের উষ্ণ নিশ্বাসের স্পর্শে কেমন যেন কেঁপে উঠল। কুহেলি বুঝতে পারছে ওর শরীরটা ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু না, এমন হুটহাট অবশ হয়ে এলেই হল নাকি! যখন তখন এভাবে কুহেলির কাছে এসে ওকে আচ্ছন্ন করে ফেললেই হল বুঝি! কুহেলি চোখ দুটো বন্ধ করে বলল,
কম বুঝলে কমই বোঝো, আমার অনেক কাজ আছে।
কুহেলি চট করে উঠে সব প্যাকেট গুলো নিয়ে বসল। আলেখ ওকে দেখে হেসে ফেলল, এখনও মুখটা লাল হয়ে আছে বেচারির। পরের দিন আলেখ আর কুহেলি দুজনেই রাত্রিকে সি অফ করতে এল। যদিও কুহেলির আসার কথা ছিল না তাও একটু ম্যানেজ করে চলেই এসেছে। আসলে এই অল্প সময়েই মেয়ে টাকে খুব ভালোলেগেছে কুহেলির। এখন ভাবলে নিজেরই রাগ হয়, শুধু শুধু কত গুলো অনর্থক চিন্তায় পড়ে প্রথম দিকে তেমন ভালো করে মিশতেই পারল না। এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখল রাত্রি ওর লাগেজ নিয়ে ওদের অপেক্ষাতেই দাড়িয়ে আছে। আলেখ আগেই জানিয়ে দিয়েছিল ওরা আসছে। রাত্রি হাসি মুখে বলল,
আলু এবার কিন্তু তোর টার্ন, কুহেলিকে নিয়ে লন্ডন আসিস কিন্তু সময় করে।
অফকোর্স, তবে এবার তুই একটু এই ছেলেমানুষী গুলো কমা।
তুই থাম, কুহেলি আলুকে কোনও বিশ্বাস নেই তুমি কিন্তু আসবে।
নিশ্চয়ই যাব। তুমিও আবার যখন ইচ্ছে হবে তখনই চলে এস তবে এইবারের মত করে নয় কিন্তু।
রাত্রি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
কাকে ছেড়ে কাকে বললাম! দুজনেই তো এক ধাঁচে গড়া।
ওদের কথার মাঝেই ফ্লাইট বোর্ড করার ফাইনাল অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেল। রাত্রি ওদের দুজনকে একটা উষ্ণ আলিঙ্গন করে এগিয়ে গেল নির্দিষ্ট দিকে আর কুহেলি আর আলেখও ফিরে গেল অফিসে। দেখতে দেখতে দুটো মাস কোথা থেকে যেন পেরিয়ে গেল। বেশ ভালোই কাটছিল দিনগুলো, কর্মব্যস্ততার মধ্যেও ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল আলেখ আর কুহেলির প্রেম। সুযোগ পেলেই আলেখের খুনসুটি আর কুহেলির লাজুকলতায় পরিণত হওয়াটা যেন ওদের রোজনামচার একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাড়িয়েছে। আজ রবিবার, ছুটির দিন, কিন্তু কুহেলির আজও খুব সকালেই ঘুমটা ভেঙে গেল। প্রতিদিন সকালেই নিজেকে আলেখের আলিঙ্গন মুক্ত করতে বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করতে হয় কুহেলিকে। ইদানীং কুহেলির আর আল্যার্মের প্রয়োজন হয় না, এমনিই ভোর বেলায় ঘুমটা ভেঙে যায়, আলেখ ওঠার আগেই। আর প্রতিদিনই খুব সন্তর্পনে আলেখের ঘুম না ভাঙিয়ে নিজেকে মুক্ত করাটা বেশ কঠিন কাজ, তবে কুহেলি সেটা রপ্ত করে নিয়েছে। প্রথম প্রথম কুহেলির খুব লজ্জা লাগত, প্রত্যেক রাতেই নিজের জায়গায় ঘুমালেও, সকালে চোখ মেলে নিজেকে আলেখের বুকের মাঝেই আবিষ্কার করত। কিন্তু এখন আর লজ্জা করে না, আলেখের বক্ষলগ্না হয়ে ঘুম থেকে ওঠাটাই যেন একটা মিষ্টি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কুহেলি প্রথম কয়েকদিন ওর সাধের কোলবালিশটা খোজার অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু আলেখ যে সেটাকে কোথায় রেখেছে কে জানে! গোটা বাড়ি খুঁজেও পায়নি, শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। তবে কোলবালিশের অন্তর্ধানের জন্য বিশেষ শোক নেই ওর মনে, ওই নিষ্প্রাণ তুলোর বালিশটার থেকে এই ভালোবাসায় পূর্ণ নিরাপদ আশ্রয় টা অনেক বেশি উষ্ণ। কুহেলি আজও খুব সাবধানে উঠে স্নান সেরে সোজা টেরিসে উঠে এল। সাজানো ফুলের বাগান দেখলেই মনটা আনন্দে ভরে যায়। ওর সেই গোলাপ গাছ দুটো, তারাও দিব্যি আছে, এখনও কি সুন্দর হলদে আর লাল গোলাপের বাহারে সেজে আছে। কুহেলি ওয়াটারিং ক্যান টা নিয়ে গাছগুলোয় জল দিতে লাগল, এটা ওর রবিবারের সকালের প্রথম কাজ বলা যেতে পারে। কুহেলি গাছে জল দিতে দিতেই আপনমনে গুনগুন করে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ধরল। রবীন্দ্রসঙ্গীত ওর ভিষন প্রিয়, তাই মনটা যখনই খুশি থাকে আপনা থেকেই কোনও না কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর গুনগুন করতে থাকে। আজ আবার আবহাওয়া টাও দারুন, শরৎকালের সকাল গুলো বোধহয় সবারই খুব ভালোলাগে। না সেই প্যাচপ্যাচে গরম, না যখন তখন আকাশের মুখ ভার করে অবিরাম বারি বর্ষণ আর না কনকনে শীত। নীল আকাশের গায়ে সাদা সাদা মেঘ গুলো ছেড়া ছেড়া তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে। হাওয়ায় যেন একটা অন্যরকম খুশির আমেজ, আর হবে না কেন! শরৎ কালের হাওয়ায় অন্যরকম আমেজ তো থাকবেই, একটা অন্যরকম গন্ধ, পুজো পুজো গন্ধ। বাঙালির কাছে শরৎকাল মানেই তো পুজো, যদিও ব্যাঙ্গালোরে তেমন পুজোর আমেজ নেই। হাতে গুনে কয়েকটা পুজো হয় মাত্র, কিন্তু বাঙালী মনের আঙিনায় পুজোর রেশ ছড়াতে স্থান প্রভেদে তেমন একটা প্রভাব পড়ে না। কুহেলির মনেও তাই এই স্থানের প্রভেদ টা এতটুকু প্রভাব ফেলতে পারল না। গুনগুন করে সুর ধরেছে,
‘শরতে আজ কোন অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে’
কুহেলি এতটাই বিভোর হয়ে পড়েছিল যে আলেখ কখন ওর পিছনে এসে দাড়িয়েছে টেরই পায়নি। আলেখ মুগ্ধ হয়ে ওর গান শুনছিল, কোনদিনও তালিম না নিলেও কুহেলির গলায় সুর আছে। আলেখ এখন কিছু কিছু বাংলা শব্দ বুঝলেও তার সাহায্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মর্মোদ্ধার সম্ভব নয়। তবে সঙ্গীত এমন একটা মাধ্যম যার অন্তর্নিহিত অনুভূতিগুলো অনুভব করার জন্য ভাষার প্রয়োজন হয় না। সুরের মূর্ছনা তার নিজস্ব ছন্দে মানব হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে দেয় সূক্ষ্ম অনুভূতির তরঙ্গ গুলো। গানটা শেষ হতেই আলেখ কুহেলিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
আজ খুব খুশি মনে হচ্ছে।
কুহেলি হাতের ক্যান টা রেখে আলেখের হাতদুটোর উপর নিজের হাত দুটো রেখে বলল,
হুম।
আলেখ ওর গালটা কুহেলির নরম গালে ঠেকিয়ে একটু আদুরে গলায় বলল,
তুমি রবিবারেও এত তাড়াতাড়ি উঠে পড় কেন বলতো?
কুহেলি হেসে বলল,
ছাড়ো, এবার নীচে যেতে হবে তো।
উহু, এভাবেই থাকি না কিছুক্ষন।
ছাড়ো, কাজ আছে তো।
ছুটির দিনে কি কাজ?
অনেক কাজ আছে, প্লিজ ছাড়ো।
কুহেলি এত মিষ্টি করে বলল যে আলেখ অনিচ্ছা সত্ত্বেও কুহেলিকে ছেড়ে দিল। আজ সারাদিন কুহেলি নিজের ইচ্ছেমত রান্না করবে, কিছুদিন হল এই শখটা শুরু হয়েছে। রবিবারের সকালের ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে রাতের ডিনার পুরোটাই নিজে হাতে করে। আজও কিচেনে ঢুকেই ব্রেকফাস্টের তোড়জোড় শুরু করে দিল, আলেখও ফ্রেশ হয়ে জগিংয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওহ, বলা হয়নি তো, নভতেজ বাবু কিছুদিন হল লন্ডন গেছেন। ওনার এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে নাকি বহুদিন পর হঠাৎ আলাপ হয়েছে তারই ডাকে কিছুদিনের জন্য ছুটি কাটাতে যাওয়া আর কি। কুহেলি ব্রেকফাস্ট সেরে আবার লাঞ্চের প্রস্তুতি শুরু করল, আলেখ বেচারা মাঝেমধ্যেই কিচেনে এসে ঘুরে যাচ্ছে নানা অছিলায়। কিন্তু ঠিক সুবিধা হল না, বৃন্দা ছাড়াও আরও অনেকেই রয়েছে যে। আলেখের করুন মুখটা দেখে কুহেলির ভারী হাসি পাচ্ছিল, আর সেটা দেখেই যেন আলেখ একটু রাগ করেই ঘরে চলে গেল। আচ্ছা বলুন তো, ছুটির দিনেও যদি বউকে একটু মনের মত করে কাছে না পায়, এর চেয়ে বড় দুঃখ আর আছে! তবে সেই রাগ বলুন আর অভিমান বলুন লাঞ্চের পদ দেখেই সব উধাও হয়ে গেল। লাঞ্চ সেরে দুজনেই রুমে ফিরল, কুহেলি একটু ক্লান্ত, সবে একটু বিছানায় দেহটা এলিয়েছে ঠিক এমন সময় কুহেলির ফোনটা যান্ত্রিক শব্দে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে লাগল। কুহেলি উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল চৈতালী দেবী ফোন করছেন, মুখে একটা হাসি এমনিই খেলে গেল।
হ্যালো মা, বলো কেমন আছ?
আমি ফোন করলাম বলে এখন জিজ্ঞেস করছিস, না হলে তো ভুলেই গেছিস।
মা, কি যে বলো না!
ঠিকই তো বলছি।
মাআআআআ।
চৈতালী দেবী হেসে বললেন,
আচ্ছা ঠিক আছে, বল কেমন আছিস? আলেখ কেমন আছে আর নভতেজ বাবু?
সবাই ভালো আছে মা, তোমরা কেমন আছ? ঠাম্মুর শরীর কেমন আছে?
আমরাও ভালো আছি। আচ্ছা শোন আজকে তোকে একটা অন্য কথা বলার জন্য ফোন করলাম।
কি?
চৈতালী দেবী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগে হঠাৎ আলেখ কুহেলির কোলে মাথা রেখে ওর কোমরটা জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। আচমকা এমন একটা কাণ্ডে কুহেলি চমকে উঠে বলল,
একি! কি করছ?
প্রশ্নটা আলেখকে করলেও উত্তর টা এলো ফোনের অপর প্রান্ত থেকে, তাও উত্তর নয়, পাল্টা প্রশ্ন।
কি করছি মানে! এইতো….
কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,
না না, তোমাকে বলছি না মা। তুমি বলো কি বলছিলে।
আলেখ সেইভাবেই কুহেলির কোমর জড়িয়েই শুয়ে রইল। ঠোঁটে খেলছে একটা দুষ্টু হাসি, জানে এখন যাই করুক কিছু বলতে পারবে না কুহেলি। কুহেলি একবার চোখের ইশারায় ওকে ছাড়তে বললেও আলেখ নির্বিকার চিত্তে তা উপেক্ষা করে যেমন ছিল তেমনই রইল উপরন্তু ওর হাতের বাঁধন টা আরও একটু দৃঢ় করল। কুহেলি আর কোনও উপায় না পেয়ে সেইভাবেই কথা বলতে লাগল। চৈতালী দেবী বললেন,
শোন কুহু, তোর দাদুর এবার ইচ্ছে হয়েছে বাড়িতে বড় করে দুর্গা পূজা করবে।
কুহেলি বেশ উৎসাহিত হয়ে বলল,
তাই নাকি! এত দারুন ব্যাপার।
হুম, আত্মীয় স্বজন মোটামুটি সবাই আসছে, তোরাও আসবি কিন্তু। বাবা কিন্তু অনেক করে বলেছেন।
কুহেলির মুখটা একটু কালো হয়ে এল।
যেতে পারলে তো ভালই হত, কিন্তু….
চৈতালী দেবী ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই বললেন,
আমি কোনও কিন্তু শুনতে চাই না কুহু। তোদের আসতেই হবে।
মা, আমিও যেতেই চাই কিন্তু তুমিও একটু বোঝার চেষ্টা করো পুজোর আর মাত্র একটা সপ্তাহ বাকি। এখন হুট করে এভাবে বললেই কি যাওয়া যায়? অফিসে কাজের ভিষন চাপ, ড্যাডও নেই যে সামলে নিতে পারবে।
কেন? উনি কোথাও গেছেন?
হুম, লন্ডনে ওনার বন্ধুর কাছে গেছে।
আচ্ছা, তবে আমি কোনও কথা শুনছি না। তোদের আসতেই হবে এটাই শেষ কথা। বিয়ের পর তোদের প্রথম পুজো, আর বাড়িতেও এইবার প্রথম এত বড় করে পুজোর আয়োজন করা হচ্ছে। তোরা না এলে হয়! তুই নিজেই বল?
জানি মা, কিন্তু….
আলেখ এতক্ষণ চুপচাপ কুহেলির কোলে মাথা রেখে সব শুনছিল। এখন হঠাৎ উঠে বসে কুহেলির কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে বলল,
মা, আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা দুজনেই আসব।
কুহেলি অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আলেখ ওকে থামিয়ে দিয়ে চৈতালী দেবীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। চৈতালী দেবী ভিষন খুশি হলেন,
কেমন আছো আলেখ?
ভালো আছি মা। কবে যেতে হবে বলুন।
আমি জানতাম তুমিই বুঝবে, কুহুটা অপদার্থ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। তোমাদের ব্যস্ততা আছে জানি তাই বেশি আগে আসতে বলব না, ষষ্ঠীর দিন চলে এসো।
আলেখ হেসে বলল,
নিশ্চয়ই মা।
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর আলেখ ফোনটা রেখে আবার কুহেলির কোলে শুয়ে পড়ল। কুহেলি তখনও বেশ অবাক হয়েই আছে, অফিসে কি পরিমান কাজের চাপ সেটা জানা সত্ত্বেও আলেখ কীকরে যাওয়ার কথা বলল?
তুমি মাকে যাবে তো বলে দিলে, কীকরে যাবে?
কেন? ফ্লাইটে।
ধুর ইয়ার্কি ছাড়, এত কাজ ফেলে আমরা কীকরে যাব বলতো।
সেসব আমি দেখে নেব, তোমায় ভাবতে হবে না।
মানে টা কি! কিভাবে দেখে নেবে?
বললাম তো, ওসব চিন্তা ছাড়। এখন কোলকাতা যাওয়ার প্রস্তুতি নাও, কলকাতার পুজোর অনেক নাম শুনেছি এখনও দেখার সুযোগ হল না। এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? আর তাছাড়া, বিয়ের পর আর শ্বশুর বাড়ি যাওয়াই হল না আমার, ঠিক করে এখনও একটু জামাই আদর উপভোগ করতে পারলাম না।
মনে মনে কুহেলিও যথেষ্ট খুশি হয়েছে, পুজোয় কলকাতায় যাওয়ার থেকে বড়ো আনন্দের কথা আর কিছু হতেই পারে না। তবে অফিসের কথা ভেবে আর একবার মৃদু একটু আপত্তি করতে গিয়ে আবার বাধা পেল।
কিন্তু…..
কোনও কিন্তু নয়, আমরা যাচ্ছি এটাই ফাইনাল, আর কোনও কথা হবে না এটা নিয়ে। শোনো না, আমার না ঘুম পাচ্ছে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো।
ক্রমশ__________
© স্বত্ব সংরক্ষিত
যাই হোক, কেমন লাগল আজকের পর্ব জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। অপেক্ষা করব। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।