সংগোপনে’ পর্ব-৩৫

0
1311

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৩৫
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

আজ পঞ্চমী, কুহেলি অফিস থেকে ফিরে ব্যাগ গোছানো তে মন দিয়েছে। মুখে যতই যাই বলুক না কেন, মনে মনে দারুন খুশি। পুজো বলে কথা, আর পুজোটা কলকাতায় কাটানোর থেকে বেশি আনন্দের আর কিছু হতেই পারে না। তাও আবার নিজের বাড়ির পুজো, নিজের সব আপনজনদের সঙ্গে। উফফ কি ভালো যে লাগছে ওর, আলেখ সত্যি সবটা এই কদিনে বেশ ভালই ম্যানেজ করে নিয়েছে। কুহেলি আগে আলেখের লাগেজটা গুছিয়ে এবার নিজেরটা নিয়ে বসেছে, খুব বেশি কিছু নেওয়ার প্রয়োজন হবে না কারণ ওখানে সবই আছে। গোছগাছ শেষ করে এবার সবে ফোনটা হাতে নিয়েছে বাড়িতে ফোন করবে বলে তখনই স্ক্রীনে ভেসে উঠল রাত্রির নাম। কুহেলির সঙ্গে মাঝে মাঝেই কথা হয় রাত্রির, তবে দুজনেই যা ব্যস্ত, তাও সেই ব্যস্ততার ফাঁকেই দুজন ঠিক যোগাযোগ রেখে চলেছে। আলেখ তো আবার এটা নিয়েও হিংসে করতে শুরু করেছে, ওর বাল্যবন্ধু এখন ওকে তেমন পাত্তা না দিয়ে কুহেলির সঙ্গেই আড্ডা দেয়। কুহেলি হাসি মুখে ফোনটা রিসিভ করে বলল,

হাই রাত্রি, কেমন আছ?

এই তো, জাস্ট শ্যুট সেরে ফিরলাম।

ওহ, তাহলে তো খুব টায়ার্ড নিশ্চয়ই।

একদম না, বরং আমি ভীষন একসাইটেড।

তাই? কেন, এমন কি হল?

রাত্রি একটু থেমে একদম বাচ্চাদের মত উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,

আমি ইন্ডিয়া আসছি।

কুহেলি খুব খুশি হল এটা শুনে।

ওয়াও, এটা তো সত্যিই দারুন নিউজ। কবে আসছ?

কালকে।

কালকে?

হুম। উফফ, আই কান্ট ওয়েট।

কুহেলি একটু থেমে বলল,

বাট রাত্রি…. আমরা তো থাকছি না।

রাত্রি একটু দমে গিয়ে বলল,

মানে, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

কোলকাতা, আমার মামাবাড়িতে এবার বড় করে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে, সেখানেই যাচ্ছি।

রাত্রি একটু মন মরা হয়ে বলল,

ওহ।

কুহেলির খুব খারাপ লাগল, হঠাৎ ওর মনে হল রাত্রিকে নিয়ে গেলে কেমন হয়!

আচ্ছা রাত্রি তুমিও চল না আমাদের সঙ্গে, দেখো তোমার খুব ভালোলাগবে।

কলকাতার দুর্গাপূজার অনেক নাম শুনেছি, দেখতে পেলে তো ভালই হত কিন্তু হবে না।

কেন?

আমি এবার কাজের সূত্রেই ইন্ডিয়া আসছি। শ্যুট আছে।

এখানে?

হুম, তোমাদের সেই নিশীথ আগরওয়াল। ওনারই প্রজেক্ট।

ওহ, এটা নিউ প্রজেক্ট?

উম, ঠিক নিউ না, লাস্ট প্রজেক্ট দি ইন্ডিয়ান ব্রাইড টা খুব সাকসেফুল হয়েছে। ওটাকেই এবার আরও ডিটেলে, আরও লার্জ মার্জিনে করা হবে মানে ইন্ডিয়ার প্রতিটা কালচার ওয়াইজ আলাদা আলাদা ব্রাইডাল ফ্যাশন শ্যুট আর কি। তার জন্য ইন্ডিয়ার থেকে বেস্ট লোকেশন আর কি হতে পারে?

রাইট। কিন্তু একদিনও কি সময় হবে না?

আমার এই তো ছাব্বিশ তারিখ থেকে শ্যুট শুরু। আমি ভাবলাম আগেই চলে যাই, একটু টাইম স্পেন্ড করতে পারব তোমাদের সাথে।

কুহেলি হেসে বলল,

ছাব্বিশ তারিখ থেকে শ্যুট শুরু তো?

হ্যা।

ব্যাস, নো প্রবলেম। তুমি এক কাজ করো, এখন যদিও একটু মুশকিল কিন্তু দেখো কালকের কোনও কলকাতার ফ্লাইটের টিকিট পাও কিনা।

কিন্তু…

আরে এতে এত কিন্তু কিন্তু করছ কেন? আজ সবে কুড়ি তারিখ। কাল থেকে শুরু হবে দুর্গোৎসব আর শেষ হবে পচিশ তারিখে বিজয়া দশমীর দিন। তুমি নিশ্চিন্তে পুরো পুজোটা এঞ্জয় করতে পারবে।

রাত্রি দুর্গাপূজার ব্যাপারে কিছুই জানে না, শুধু নামটাই শুনেছে। তাই কবে কখন কিভাবে হয় কতদিন ধরে হয়, এসবই তার অজানা। সেটাই স্বাভাবিকও, তাই ভাবছিল ওর শ্যুটের সময়েই হয়তো। এখন এটা শুনে যেন লাফিয়ে উঠল, আর কিছু না জানলেও এটা সবাই জানে আমাদের মানে ভারতীয়দের যেকোনো উৎসব মানেই প্রাণখোলা আনন্দের ঠিকানা। আর রাত্রি আনন্দ উপভোগের একটা সুযোগও হাতছাড়া করে না। দারুন উত্তেজিত হয়ে বলল,

দ্যাটজ গ্রেট, আমি এক্ষুনি টিকিটের ব্যবস্থা করছি। তোমরা কটায় পৌঁছাবে?

আমরা সকালেই পৌঁছে যাব এই সাড়ে দশটা এগারোটার মধ্যে।

ওকে, দেখি আমি কটার ফ্লাইট পাই।

হুম, তবে এইসময় কলকাতার টিকিট পাওয়া খুব মুশকিল।

আরে আমার নাম রাত্রি অহুজা, একটা টিকিট কেন, চাইলে এক ডজন টিকিট এক্ষুনি হাজির হয়ে যাবে।

তা অবশ্য ঠিক।

কুহেলি আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে দিল। মনটা আরো বেশি খুশিতে ভরে উঠল। রাত্রি আসলে পুজোটা আরও বেশি জমবে তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই ওর। আলেখ এতক্ষণ পাশের ঘরে একটা ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করছিল, এখন ঘরে এসে দেখল কুহেলি গুনগুন করে গান গাইছে। কুহেলি খুব খুশি হলেই গান গায়, আলেখ মুচকি হেসে বলল,

কি ব্যাপার কোলকাতায় যাওয়ার এত আনন্দ? প্রথমে তো যেতেই চাইছিলে না।

হুম, আনন্দ তো হচ্ছেই তবে শুধু কলকাতায় যাওয়ার নয়।

তাহলে?

কুহেলি রাত্রির আগমন সংবাদটা আলেখকে দিতেই সে দারুন খুশি হয়ে বলল,

বাহ্, এত দারুন ব্যাপার। আচ্ছা তুমি দেখছি আমার বেস্টফ্রেন্ড টাকেও আমার থেকে বেশি নিজের দিকে করে নিয়েছ। আমাকে কিছু না জানিয়ে আজকাল সব তোমাকেই জানায়।

বেশ করেছি, এত হিংসুটে কেন তুমি?

আলেখ একটু এগিয়ে এসে কুহেলির কোমর জড়িয়ে নিজের বুকের কাছে টেনে এনে বলল,

আসল কথাটা বলি তাহলে, হিংসা টা আমার রিতুকে নিয়ে নয় তোমাকে নিয়ে।

কুহেলি একটু অবাক হয়ে বলল,

আমাকে নিয়ে?

হুম, এত সবার সঙ্গে মিশে গেলে আমার জন্য তো আর সময়ই থাকবে না তোমার কাছে। যেমন ধর রিতুর সঙ্গে যদি তোমার বন্ধুত্ত্ব টা না হত তাহলে তোমরা এক সাথে সময় কাটানোর কথা ভাবতেই না। সেই সময়টুকু তাহলে আমি পেতাম, তাই না?

কুহেলি একটু হেসে বলল,

তুমি আর তোমার অদ্ভুত সব যুক্তি, সরো দেখি অনেক কাজ আছে।

আলেখ কুহেলিকে ছেড়ে সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসল আর কুহেলি প্রথমে বাড়িতে ফোন করে কথা বলল তারপর নভতেজ বাবুর সঙ্গে কথা বলল। ওনার ফিরতে দেরী আছে, পুরনো বন্ধুকে পেয়ে বেশ লম্বা ছুটি কাটাচ্ছেন। সবার সঙ্গে কথা বলে কুহেলি সোফায় আলেখের পাশে এসে বসল, বেশ কিছুক্ষণ ধরে একটা কথা মাথায় ঘুরছে। আলেখকে কিভাবে বলবে সেটাই ভাবছে, কারণ কথাটা শুনে আলেখের প্রতিক্রিয়া ঠিক কেমন হতে পারে সেটা আন্দাজ করা তেমন কঠিন না হলেও….. যাক গে, অত ভাবার থেকে সোজা বলে দেওয়াই ভালো।

বলছি একটা কথা বলার ছিল।

আলেখ ল্যাপটপের দিক থেকে চোখ না তুলেই বলল,

হুম, বলো।

বলছি…. বলছিলাম…. আমি বলছি….

কুহেলিকে এত ইতস্তত করতে দেখে আলেখ ল্যাপটপ টা বন্ধ করে বলল,

কি হল? এত হেজিটেট করছ কেন?

না মানে.. আমি ভাবছিলাম মিস্টার আগরওয়ালকে পুজোয় ইনভাইট করব।

কথাটা শুনে আলেখের হাসি টুকু মিলিয়ে গেল, মুখটা যেন অন্ধকার হয়ে এল। একটু ভারী গলায় বলল,

হঠাৎ ওনাকে বলার কি দরকার?

না আসলে উনি একবার আমাকে বলেছিলেন ওনার কলকাতার পুজো দেখার খুব ইচ্ছে কিন্তু এখনও হয়ে ওঠে নি। তাই আমি ভাবলাম….

ওর কথাটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আলেখ বলল,

তাই তুমি ভাবলে ওনাকেও আমাদের সাথে নিয়ে যাবে?

আলেখের গলায় অভিমানের সুর ঝরে পড়ল। কুহেলির খুব হাসি পেল, কিন্তু এখন হাসা যাবে না, না হলে আলেখ আরও রেগে যাবে থুড়ি, অভিমান হবে।

আহা, আমি কি বললাম আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব? আমি তো শুধু ওনাকে ইনভাইট করব। আর উনিও তো ব্যস্ত মানুষ, আমি বললেই যে উনি আসবেন এমন তো কোনও কথা নেই। এলেও হয়তো একদিনের জন্য আসবেন আবার হয়তো এলেনই না।

তাহলে শুধু শুধু বলার কি প্রয়োজন?

এটা কেমন কথা? আরে বাবা আগে ইনভাইট না করলে বুঝব কীকরে উনি আসবেন কিনা!

আলেখ কিছু না বলে বাচ্চাদের মত মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। কুহেলি অল্প হেসে বলল,

কি হল? ওরকম মুখ ফুলিয়ে বসলে কেন?

তুমি জানো কুহেলি, আমি ওনাকে ঠিক পছন্দ করি না। ওনাকে বলাটা কি খুব জরুরী?

এটা কেমন ছেলেমানুষী কথা বলতো? তুমি এরকম কেন করছ? মিস্টার আগরওয়াল আমার বন্ধু, আর বন্ধু হিসেবে আমি আমার বাড়ির পুজোতে ওনাকে ইনভাইট করতেই পারি।

ছেলেমানুষী হলে তাই, কিন্তু আমার সত্যিই ওনাকে ভালোলাগে না। কেন অত আমি বলতে পারব না, বাট ভালোলাগে না। তুমি তোমার বন্ধুকে ইনভাইট করতে চাও করো, সেখানে আমার আর কিছু বলার নেই।

কুহেলি হেসে আলেখের গাল দুটো টিপে দিয়ে বলল,

মাঝেমধ্যে এমন একটু আধটু রাগ করো বুঝলে তো, খুব কিউট লাগে।

আলেখও হেসে ফেলল।

যাও, তোমার বন্ধুটিকে ইনভাইট করো। ব্যস্ত থাকলেই ভালো।

তুমি না সত্যি।

কুহেলি হেসে ফোনটা নিয়ে নিশীথের নম্বরটা ডায়াল করার কিছুক্ষণের মধ্যেই অপরপ্রান্ত থেকে নিশীথের আওয়াজ পাওয়া গেল।

গুড ইভনিং কুহেলি, আজ হঠাৎ আমার কথা মনে পড়ল?

গুড ইভনিং। আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।

হুম, বুঝেছি বলুন।

আগামীকাল থেকে দুর্গাপূজা শুরু হচ্ছে আর এই বছর আমার মামাবাড়িতে প্রথমবার বড় করে পুজোর আয়োজন করা হয়েছে।

ওয়াও গ্রেট। আমার আর কোলকাতার পুজো দেখার সুযোগটাই হয়ে উঠছে না।

সেইজন্যই তো ফোন করলাম।

মানে?

মানে, আমি আর আলেখ কালকে কোলকাতা যাচ্ছি পুজো উপলক্ষে। তাই আমি মানে আমরা চাইছিলাম যদি আপনিও আসতে পারেন।

কিছুক্ষণ নিশীথের কোনও সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না, কুহেলি দু একবার হ্যালো বলার পরে আবার নিশীথের কথা শোনা গেল।

হ্যা? ওহ, সরি কুহেলি। আসলে আমি ভাবছিলাম আমি ঠিক শুনলাম কিনা। না মানে, আপনি আপনার ফ্যামিলি ইভেন্টে আমাকে ইনভাইট করছেন।

হুম, কেন আপনার কি কোনও প্রবলেম আছে? না যদি অসুবিধা থাকে তাহলে…..

কথাটা শেষ হল না তার আগেই নিশীথ বলল,

অসুবিধা নেই, শুধু একটু অবাক হয়েছিলাম। তবে কুহেলি কালকে যাওয়াটা পসিবল হবে না, আসলে একটা মিটিং আগে থেকেই ফিক্স করা আছে আর সেটা কোনোমতেই পোস্টপন্ড করা যাবে না।

হুম, আমিও সেটাই ভাবছিলাম। আপনি এমনিতেই এত ব্যস্ত থাকেন, আর আমি এত লেটে হঠাৎ জানালাম।

কুহেলির কথায় আলেখ বুঝল নিশীথ যেতে পারবে না, মনে মনে খুব খুশি হল। সবটা জানার পরেও কেন যে নিশীথ কে দেখলেই রাগ হয় কে জানে! একটু কুহেলির কাছে সরে এসে দুহাতে ওকে জড়িয়ে কাধে মাথা রাখল আলেখ। কুহেলি তখনও নিশীথের সঙ্গে কথা বলছে,

আপনাকে যদি আগে বলতাম হয়তো আসতে পারতেন।

কুহেলি আমি কিন্তু বলেছি কালকে পসিবল নয়, এটা কিন্তু বলিনি যে আমি যেতে পারব না। আই মিন দুর্গা পূজা তো আর একদিনের উৎসব নয়।

অফকোর্স নট। পুরো পাঁচটা দিনের মহোৎসব।

ইয়েস, আই নো দ্যাট। আমি কালকে যেতে পারব না বাট পরশু যেতে পারব। তবে হয়তো একদিনের বেশি থাকতে পারব না।

কুহেলি আনন্দিত হয়ে বলল,

পরশু মানে অষ্টমী, আপনি একদম বেস্ট দিনে আসছেন। আপনার হয়তো মনে আছে আমি আপনাকে বলেছিলাম সময়ের খুব অভাব হলে অষ্টমীর দিন যেতে। পুজোর সবটুকু আনন্দ ওই একদিনেই পাওয়া হয়ে যায়।

হুম, কীকরে ভুলব? মনে আছে।

হঠাৎ করেই আলেখ কুহেলিকে ছেড়ে দিয়ে আবার সরে বসল। কুহেলি একবার সেদিকে তাকিয়ে বুঝল বাবুর আবার অভিমান হয়েছে। কুহেলি নিশীথের সঙ্গে আরও একটু কথা বলে মানে কোথায় কিভাবে যাবে সেসব বুঝিয়ে দিয়ে ফোনটা রেখে আলেখের দিকে একটু সরে এসে বলল,

আবার কি হল?

আলেখ তেমনই মুখটা অন্ধকার করেই বলল,

তুমি পুজোর এত ডিটেলস কবে দিলে ওনাকে? আমাকে তো কখনও বলোনি।

আলেখের গলায় আবার বাজছে অভিমানের সুর। কুহেলি খুব উপভোগ করে এই ব্যাপারটা। আলেখের আরেকটু কাছে সরে বসে বলল,

সে অনেক আগে, তখন তোমার সাথে কাজের বাইরে কোনও কথাই হত না।

আলেখ ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,

আর তখন থেকেই তোমার ওনার সাথে এত কথা হত?

আরে না, উনিই চেষ্টা করতেন কথা বলার নানা ভাবে। তেমনই একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন।

আলেখ ছোট্ট করে একটা হুম বলে আবার ল্যাপটপ টা টেনে নিল। কুহেলি এবার একটু হেসে একদম আলেখের কাছে সরে এসে আদুরে গলায় বলল,

আবার রাগ হল বুঝি?

আলেখ কিছু না বলে যেমন কাজ করছিল তেমন কাজ করতে লাগল। কুহেলি এবার আলেখের একটা হাত জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,

তুমি এত রাগ করতে পার জানতাম না তো!

কেন? আমি রাগ করতে পারি না বুঝি? নাকি আমার রাগ করা বারণ?

কুহেলি এবার আলেখের কাধে ওর চিবুক টা রেখে আদুরে সুরে বলল,

নিশ্চয়ই পার, আমি তো বললাম মাঝে মাঝে একটু রাগ করতে। সত্যি, রাগলে খুব কিউট লাগে তোমাকে।

আলেখ ল্যাপটপ টা কোল থেকে নামিয়ে রেখে বলল,

তুমি তো অদ্ভুত মেয়ে! দেখছ আমি রাগ করে আছি কোথায় আমার রাগ ভাঙাবে তা না করে তুমি উল্টে মজা নিচ্ছ?

তাই? তোমার রাগ ভাঙাতে হবে বুঝি! তা কি করলে তোমার রাগ ভাঙবে শুনি।

আলেখ কুহেলির দিকে ফিরে ওর কিছুটা অবিন্যস্ত চুলগুলোকে কানের পিছনে সরিয়ে দিয়ে বলল,

বেশি কিছু না, ভালোবেসে একটু আদর করে দিলেই হবে।

কুহেলি আবার লজ্জায় লাল হয়ে গেল, এই একটা জায়গায় কুহেলি একদম জব্দ। আর কিছু বলার ভাষাই খুঁজে পায় না। আর আলেখও সুযোগ পেলেই এই মোক্ষম অস্ত্রটা প্রয়োগ করার অবকাশ হারায় না।

তোমার শুধু ওই এক কথা, যাও তো।

কুহেলি এটা বলেই উঠে চলে আসতে যাচ্ছিল কিন্তু আলেখ কুহেলির একটা হাত ধরে টেনে ওকে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দুহাতের মাঝে বেঁধে নিল।

কোথায় পালাচ্ছ শুনি! আমার রাগ না ভাঙিয়ে পালালেই হল?

সমগ্র দুনিয়ার লজ্জা যেন কুহেলির বাকশক্তি রোধ করে ফেলল, কোনও কথাই যেন বেরোতে চাইছে না। কুহেলি নিজেকে ছাড়ানোর একটু ব্যর্থ প্রয়াস করল, আসলে আলেখের এই বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার খুব একটা ইচ্ছে হয়তো ওরও নেই। আলেখ ওর নাকে আলতো করে নিজের নাকটা স্পর্শ করে বলল,

তুমি তো মনে হচ্ছে আমার রাগ ভাঙাবে না, কি আর করা যাবে! আমি নিজেই না হয় নিজের রাগ ভাঙিয়ে নিলাম।

লজ্জা গুলো যেন বাকশক্তির সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখ দুটোতেও নিজের আধিপত্য বিস্তার করল। কুহেলির এই লজ্জা মাখা রূপটা আলেখের ভিষন প্রিয়। একটা আলতো হাসি ছড়িয়ে গেল ওর ঠোঁট জুড়ে, আলেখ ধীরে ধীরে স্পর্শ করল কুহেলির ঈষৎ কম্পমান ঠোঁট দুটো। আলেখের উষ্ণ ঠোঁটের ভাজে যেন মিশে যেতে লাগল কুহেলির পেলব ওষ্ঠাধর। গভীর আবেশে কুহেলির কোমল হাত দুটো আলেখের কণ্ঠদেশ জুড়ে গঠন করল এক অবিছেদ্য বৃত্তের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গভীর থেকে গভীরতর হল ওদের প্রেমাবেশে পূর্ণ ওষ্ঠযুগলের আলাপ। আজ মহাষষ্ঠী, কলকাতার বুকে পা দিয়েই যেন পুজোর আমেজটা সারা শরীর মন জুড়ে অনুভব করতে পারল কুহেলি। এখন সকাল থেকেই কলকাতার অলিতে গলিতে অহোরাত্র চলছে খুশির আমেজের ব্যস্ততা। সেই ব্যস্ততার ঢেউ পেরিয়ে শ্যামবাজারের মঞ্জরীতে পৌঁছতে কিঞ্চিৎ সময় লাগল। ক্যাব থেকে নামতেই টের পেল গোটা বাড়িটা একেবারে গম গম করছে। সবাই এসে পড়েছে, পুজোর কাজও শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। বাড়ির পিছন দিকে অনেকটা খোলা জায়গা আছে সেখানেই বিরাটাকৃতির এক সুদৃশ্য মণ্ডপ বাধা হয়েছে। হাওয়ায় ভাসছে ধূপ ধুনো আর ফুলের মিষ্টি একটা সুবাস। বহু পরিচিত সেই মন্ত্রচ্চারোণের ধ্বনি যেন গোটা বাড়িময় গুঞ্জরিত হচ্ছে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও চৈতালী দেবী ঠিক ওদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। আরে বাবা জামাই মানুষ বলে কথা, তার আদর যত্নে কমতি থাকলে চলে! ওদের ভিতরে নিয়ে যেতেই ওরা একে একে চৈতালী দেবী সহ উপস্থিত বাকি গুরুজনদের প্রণাম করল। শৈলজা দেবী তো যারপরনাই আনন্দিত, দুজনকে বুকে জড়িয়ে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। চৈতালী দেবী কুহেলিকে বললেন,

কুহু, যা মা আলেখকে নিয়ে তোর ঘরে চলে যা। আগে ফ্রেশ হয়ে নে, আমি একটুপরেই তোদের জলখাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। আলেখ বুঝতেই পারছ পুজোর কাজে ব্যাস্ত আছি। তুমি একটু বিশ্রাম করো আমি পরে তোমার সাথে কথা বলছি।

আপনার ব্যস্ত হতে হবে না মা।

কুহেলি আলেখকে নিয়ে এই বাড়িতে ওর নির্দিষ্ট ঘরটায় চলে এল। লাগেজ গুলো সরিয়ে রেখে কুহেলি বলল,

তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি তারপর যাচ্ছি। ততক্ষণে আমি লাগেজ গুলো গুছিয়ে ফেলি।

আলেখ ওর একসেট ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল আর কুহেলি লাগেজ খুলে ওদের জামা কাপড় গুলো আলমারিতে গুছিয়ে রাখতে লাগল। সবার জন্য আনা গিফট গুলোও এক পাশে আলাদা করে রাখল। আলেখ বেরোতেই কুহেলি একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। কিন্তু স্নান করে পড়ল মহা সমস্যায়, ওয়াশরুমে দাড়িয়ে শাড়ি পরতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। কুহেলি বেচারি ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে দাড়িয়ে রইল, কি সমস্যা! অন্য কিছু নিয়েও আসেনি যে পরে বাইরে বেরোবে। দরজাটা সামান্য একটু খুলে উকি দিয়ে দেখল আলেখ খাটে বসে ফোনে কিছু একটা করছে। ভারী মুশকিল! এখন ওর সামনে এভাবে বেরোবেও বা কীকরে? কুহেলি একটু আস্তে করে ডেকে বলল,

আলেখ।

হুম।

বলছি একটু বাইরে যাও না।

আলেখ চোখ না তুলেই কথা বলছিল এখন কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

কেন? হঠাৎ বাইরে যাব কেন?

আসলে.. আমি… আমি ওয়াশরুমে শাড়ি টা পরতে পারছি না। অসুবিধা হচ্ছে, তুমি প্লিজ একটু বাইরে যাও না।

আলেখ একটু হাসল, কুহেলি মুখটা এমন কাচুমাচু করে কথাগুলো বলল যে না হেসে পারা যায় না। আর আলেখ তো এমন সুযোগের অপেক্ষাতেই থাকে। আলেখ খাটে হেলান দিয়ে আরও একটু আরাম করে বসে বলল,

কিন্তু কুহেলি ভেবে দেখ এখন যদি হঠাৎ করে আমি বাইরে যাই সবাই কি ভাববে? আর আমি কি উত্তর দেব বলতো?

কথাটা একেবারে মন্দ বলেনি সে, এটা ভাববার বিষয় বৈকি। কুহেলি বেচারি মুখটা এমন কালো করে রইল যে আলেখের মায়া হল।

আচ্ছা শোনো, আমি না হয় চোখটা বন্ধ করে রইলাম। তোমার হলে বোলো।

আলেখ কুহেলির উত্তরের অপেক্ষা না করে চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। কুহেলি কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শাড়িটা পরে নিয়ে বলল,

আমার হয়ে গেছে, তুমি চোখ খুলতে পার।

আলেখ চোখ দুটো খুলল বটে তবে ওর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের চলাচল কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। কুহেলি একটা কাচা হলুদ রঙের লালপেড়ে শাড়ি পরেছে সঙ্গে লাল ব্লাউজ। ভিজে চুল গুলো থেকে এখনও টুপ টুপ করে জল ঝরে পড়ছে। বিন্দু বিন্দু জলকণা ভোরের শিশিরের মত লেগে আছে কুহেলির পিঠের উন্মুক্ত অংশে। ভিজে চুলগুলো কাধের একপাশ দিয়ে সযত্নে রাখা আছে সামনের দিকে। বিয়ের কিছুদিন পরেই কুহেলি শাখা পলা জোড়া খুলে রেখেছিল, আসলে অত ব্যস্ততার মধ্যে ওর সামলাতে অসুবিধা হত। আজ আবার হাত দুটো সেজে উঠেছে লাল সাদা শাখা পলার সাজে। কপালে একটা ছোট্ট লাল টিপ আর সিথিতে লাল সিদুরের ছোয়া। শুদ্ধ বাঙালি নববধূর সাজে সজ্জিত কুহেলির এই রূপের আগুনে যেন আলেখের হৃদয় প্রেমাগ্নিতে দগ্ধ হতে লাগল। কখন যেন নিজের অজান্তেই উঠে এসে দাড়িয়েছে কুহেলির ঠিক পিছনে। আয়নায় ফুটে ওঠা আলেখের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে কুহেলির শরীর জুড়েও খেলে গেল অদ্ভুত এক শিহরণ। ঈষৎ সবুজ ওই চোখের তারায় একরাশ মুগ্ধতার পাশাপাশি ভিড় করেছে আরও কিছু। একটা অন্তহীন তৃষ্ণার আকুলতা যেন বারবার ছাপিয়ে যাচ্ছে মুগ্ধতার রেশ কে। কিসের তৃষ্ণা! দুর্দমনীয় সেই প্রেমাগ্নি নিবারণের আকুল তৃষ্ণা। আলেখ আলতো হাতে স্পর্শ করল কুহেলির দুই কাধ, ধীরে ধীরে আলেখের তৃষ্ণার্ত ঠোট ছুয়ে গেল কুহেলির উন্মুক্ত পিঠ, শিউরে উঠল কুহেলি। কুহেলির ভিজে চুলগুলোর মাতাল করা সেই ঘ্রাণ আবার আঘাত হানল আলেখের মন জুড়ে। আলেখ ধীরে ধীরে কুহেলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল, কুহেলির পলক জোড়া ততক্ষণে আবারও লজ্জার ভারে বুজে এসেছে। আলেখ ধীর গতিতে সেই অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের টানে এগিয়ে যেতে লাগল কুহেলির কোমল ওষ্ঠাধরের দিকে। দুটো তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের দূরত্ব যখন প্রায় মিলিয়ে এসেছে তখন অনাহুত বাধার মত ভেসে এল একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর।

ক্রমশ_________________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগল আজকের পর্বটা জানাবেন কিন্তু। আর হ্যা, এই বেয়াক্কেলের মত এমন সময় ওদের কে বিরক্ত করল বলুন তো? আজ তবে আসি, দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here