সংগোপনে’ পর্ব-৪০

0
1405

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৪০
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————

পুব আকাশের লালচে আভা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা আকাশ জুড়ে। ইতিমধ্যেই ভোরের বাতাস যেন শীতের আগমন বার্তা নিয়ে আসতে শুরু করেছে, বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে ভোরের দিকটায়। প্রতিদিনের মত আজও কুহেলির ঘুম আগে ভাঙল, ওদের বর্তমান রোজনামচার কোনও পরিবর্তন না ঘটিয়েই আজও নিজেকে আলেখের বুকের মাঝেই আবিষ্কার করল। কুহেলি অল্প একটু হেসে সন্তর্পনে উঠে এল, আজ থেকে আবার অফিস যেতে হবে, পুরনো দিনচর্যায় ফিরতে হবে। কুহেলি বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে গিয়েও থেমে গেল। হঠাৎ ওর কালকের কথা মনে পড়ল, আলেখের নতুন দাবী টার কথা মনে পড়তেই ওর গোলাপী ঠোঁট দুটোয় একটা লাজুক হাসির ছোয়া লাগল। পিছন ঘুরে একবার আলেখের ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকাল। ঘুমন্ত অবস্থাতেও কাউকে এত সুন্দর কীকরে লাগতে পারে! কুহেলি খুব সাবধানে আস্তে করে আলেখের পাশে বসে অল্প একটু হেসে ওর কোমল ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিল আলেখের ঠোঁটে। আলেখ এখনও নিশ্চিন্তে ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করছে, ওর দাবী টা যে এত মিষ্টি ভাবে পূর্ণ হল সেটা জানতেই পারল না। কুহেলি একটু হেসে ওয়াশরুমে চলে গেল, যথারীতি সময় মত আলেখও উঠে ফ্রেশ হয়ে জগিংয়ে বেরিয়ে পড়ল। এই কয়েকদিনে জগিং ওয়ার্কআউট কিছুই করা হয়নি। কুহেলি এই সময় টায় ব্যস্ত থাকে সেটা আলেখ জানে তাই আপাতত কুহেলিকে না খুঁজে জগিং সেরে ফিরে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। ফ্রেশ হয়ে যখন একদম ফর্ম্যাল সাজে নিজেকে সজ্জিত করা হয়ে গেছে তখন কুহেলি ঘরে ঢুকল। কুহেলিও ফর্ম্যাল পোশাকে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে, কুহেলির হাতে একটা ফাইল দেখে আলেখ জিজ্ঞেস করল,

ওটা কিসের ফাইল?

কুহেলি ফাইল টা ব্যাগে গুছিয়ে নিতে নিতে বলল,

নতুন প্রজেক্টের ফাইল, আমরা যখন ছিলাম না তখন অঙ্কিত নাকি এটা দিয়ে গিয়েছিল, আমাকে এখন প্রভাত এটা দিল।

ওহ হ্যা, কালকে অঙ্কিত বলেছিল আমাকে।

আমাকে বলনি তো?

কীকরে বলব? আমি ব্যালকনি তে দাড়িয়ে একটু অঙ্কিতের সঙ্গে কথা বলছিলাম আর কখন যে তুমি ঘরে এসে দিব্যি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছ সে তো টেরই পেলাম না।

ওহ, আসলে খুব টায়ার্ড লাগছিল।

হুম, অত এদিক ওদিক করে বেড়ালে টায়ার্ড হবে না তো কি হবে?

কুহেলি একটু হেসে ওর ব্যাগটা নিতে নিতে বলল,

ওসব ছাড়ো এখন, তাড়াতাড়ি নীচে চল, ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোতে হবে, দেরী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

কথা টা বলে কুহেলি দরজার দিকে পা বাড়াল, কিন্তু সে দরজার কাছে পৌঁছানোর আগেই আলেখ ঝড়ের গতিতে পৌঁছে দরজাটা বন্ধ করে দিল। কুহেলি একটু অবাক হয়ে বলল,

এটা কি হল? দরজা বন্ধ করলে কেন?

আলেখ মুচকি হেসে এগিয়ে এসে বলল,

সব কিছু কি আর দরজা খোলা রেখে করা যায়! সেদিন দিঠি এসে পড়েছিল আজ হয়তো দেখা গেল প্রভাত এসে হাজির হল।

কুহেলি আলেখের ইঙ্গিত টা খুব স্পষ্ট করে বুঝতে পারল, ক্রমাগত এগিয়ে আসা আলেখের পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়েই কুহেলি পিছতে লাগল। গলায় একটু গাম্ভীর্য আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল,

কি হচ্ছে কি? চুপচাপ নীচে চল, দেরী হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু মুশকিল হল বেচারি কুহেলির স্বরে গাম্ভীর্য তো এলোই না বরং লজ্জা মিশ্রিত উত্তেজনার ভারে গলাটা একটু যেন কেঁপে গেল। আলেখ ওর ঠোঁটে একটা মৃদু দুষ্টু হাসির ছোয়া বজায় রেখেই এগোতে থাকল কুহেলির দিকে আর কুহেলি এদিকে পিছতে পিছতে একসময় আর পিছনোর জায়গা পেল না কারণ ইতিমধ্যেই ওর পিঠ টা দেওয়ালে স্পর্শ করে গেছে। আলেখ ধীরে ধীরে কুহেলির একদম কাছে এসে একটা হাত দেওয়ালে আর অন্য হাত দিয়ে কুহেলির কোমরটা পেঁচিয়ে ধরে প্রায় নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে বলল,

আমার দাবী পূরণ না করেই কোথায় পালাচ্ছিলে শুনি?

কুহেলির বুকের ওঠা নামা ইতিমধ্যেই দ্রুত হয়ে গেছে, আলেখের শরীরের সেই কড়া অথচ মিষ্টি মাতাল করা ঘ্রাণ টা যেন ওর সারা শরীরে তীব্র শিহরণের সঞ্চার করছে। কোনরকমে কম্পিত সুরে বলল,

কিসের দাবী?

এর মধ্যেই ভুলে গেলে? কালকেই তো সবে বললাম।

কুহেলি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে আলেখ কিসের কথা বলছে কিন্তু কোনো উত্তর দেওয়ার মত শক্তি টুকুও যেন সঞ্চয় করে উঠতে পারছে না। আলেখের উষ্ণ নিশ্বাসের স্পর্শ আর ওই ঈষৎ সবুজ চোখের নেশায় যেন ওর গোটা শরীর অবশ হয়ে আসছে। কুহেলি ওর চোখ দুটো বন্ধ করে এলোমেলো অনুভূতি গুলোকে একরকম জোর করেই নিয়ন্ত্রণ করল। তারপর একটা মৃদু ধাক্কায় আলেখকে নিজের থেকে একটু সরিয়ে দিয়ে বলল,

আমি এত সহজে কোনও কিছু ভুলিনা। তোমার দাবী আমি সকালেই পূরণ করে দিয়েছি।

আলেখ আবার কুহেলির কাছে এসে বলল,

কোথায়? আমি তো জানিনা।

জানবে কীকরে! তুমি তো তখনও ঘুমের কোন অতলে ডুবে ছিলে নিজেও জানো না।

তাহলে তো ওটা এমনিতেই ইনভ্যালিড, যেটা আমি জানলামই না সেটা কাউন্ট হবে না।

কুহেলি ওর বড় বড় চোখ দুটো আরও একটু বড় করে বলল,

মানে টা কি?

আলেখ এবার দুহাত দিয়ে কুহেলির কোমর জড়িয়ে নিজের কাছে এনে বলল,

মানে তুমি যেটা ভাবছ সেটাই। আমার পাওনা টা আমাকে এক্ষুনি দিতে হবে তাও আবার দুটো।

দুটো! আবার দুটো কোন দুঃখে?

কেন? কাল রাতের গুডনাইট কিস টা কোথায় যাবে? দিব্যি তো আগে ভাগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে।

কুহেলি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

এই দেখ, বেশি দুষ্টুমি করো না তো। কোথায় কাল রাতের…. ছাড় তো দেরী হয়ে যাচ্ছে।

পাওনা টা মিটিয়ে দিলেই তো হয়, আর আমার দুষ্টুমি তো তুমি ভালো করেই জানো। এটা যে কিছুই নয় সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, দেখাব নাকি একটু দুষ্টুমির নমুনা?

তুমি না বড্ড অসভ্য হয়ে যাচ্ছ।

যাহ বাবা, নিজের বউয়ের সাথে রোমান্স করলে কেউ অসভ্য হয় নাকি!

আলেখ ছাড়ো না প্লিজ।

কেন টাইম ওয়েস্ট করছ বলো তো? আমার পাওনা টা চট পট মিটিয়ে দিলেই তো পারো।

কুহেলির ফর্সা গাল দুটো ইতিমধ্যেই রং পরিবর্তন করে লাজুকতার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। এখন আর অন্য কোনও উপায় নেই বুঝে কুহেলি প্রায় ঝড়ের গতিতে আলেখের দুই গালে ওর ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে একটা বেশ বড়সর ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে পালিয়ে গেল। আলেখ ঠিক মত বুঝতেই পারল না কি হল, কোনরকমে ধাক্কার টাল সামাল দিয়ে কুহেলির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

হেই, দিস ইজ চিটিং।

কিন্তু সেকথা শোনার জন্য কুহেলি আর সেখানে নেই। আলেখও একটু মৃদু হেসে ওর আর কুহেলির ব্যাগ টা নিয়ে নীচে চলে গেল। বেচারি এমন ভাবে পালিয়েছে যে ব্যাগ টার কথাও মনে ছিল না। যাই হোক, ওরা তো নাহয় এমন টুক টাক মিষ্টি রোমান্সের পর ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। এদিকে রাত্রি শরীর চর্চায় ব্যস্ত, এমনিতে খুব একটা স্বাস্থ্য সচেতন নয়, মানে ওই মন থেকে করে না আর কি। কিন্তু, ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের টপ মডেল বলে কথা, হেলথ মেনটেন না করলে চলবে কেন! তাই ইচ্ছে না থাকলেও প্রয়োজনের খাতিরেই শরীর চর্চায় কিঞ্চিৎ ধ্যান দিতে হয়। এমনিতেই এই কটা দিন সব ডায়েট প্ল্যান একেবারে শিকেয় তুলে দিয়েছিল। যা সামনে পেয়েছে একেবারে মনের সুখে উদরস্থ করেছে, এখন সেই ক্যালরি গুলো বার্ন না করেও তো উপায় নেই। রাত্রি ভোর বেলায় উঠেই ওর ডেইলি রুটিং শুরু করে দিয়েছে, নিয়ম মত ওয়ার্কআউট সেরে রাত্রি তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ল শ্যুটিং লোকেশনের উদ্দেশ্যে। আজ থেকেই শুরু হচ্ছে ওর নতুন প্রোজেক্ট। রাত্রি ব্যক্তিগত জীবনে যতই ছটফটে হোক না কেন ওর কাজের ক্ষেত্রে কোনও গাফিলতি হয় না, যথেষ্ট সিরিয়াস সে। আজ অবধি কাউকে সে কোনও অভিযোগ করার সুযোগ দেয়নি, শুধু ওই একবারই একটু শ্যুটের ডেট পিছিয়ে দিয়েছিল। বেচারীকে পুরো দোষ দিয়েও অবশ্য লাভ নেই, মাঝে মধ্যে একটু ব্রেক নিতে কার না ইচ্ছে করে! তাই অমন একটু করে ফেলেছিল আর কি। কিন্তু ওই একবারই, নাহলে ওর কাজের প্রতি ডেডিকেশন কিন্তু মোটেই উপেক্ষা করার মত নয়। আর ঠিক এই কারণেই আজ ও এই জায়গা টা অর্জন করে নিতে পেরেছে। এমনিতে রাত্রি ওর কাজ টা খুব ভালোবাসে আর বেশ উপভোগ করে। হ্যা, মাঝে মাঝে অতিরিক্ত কাজের চাপে একটু হাসফাস করে বটে কিন্তু তা বলে কাজের প্রতি ওর ভালোবাসার অভাব নেই। কিন্তু আজ রাত্রির মুড টা ভালো নেই, কারণ টা আর কিছুই নয়, নিশীথ। নিশীথের জন্যই বেচারির মুড টা ভালো নেই। কেমন যেন আদায় কাচকলায় সম্পর্ক ওদের, কেউই যেন কাউকে ঠিক সহ্য করতে পারে না। তবে রাত্রি সেদিনের ঘটনাটার জন্য সত্যিই নিশীথের প্রতি কৃতজ্ঞ, কিন্তু ওই পর্যন্তই। কি জানি, এরা আবার মুখোমুখি হলে কি হবে! রাত্রি তো মনে প্রাণে চাইছে যেন নিশীথের সঙ্গে দেখাই না হয় কিন্তু চাইলেই যদি সব মনের মত হয়ে যেত তাহলে তো আর কোনও সমস্যাই থাকত না। যাই হোক, যেহেতু এবার বেশ কিছুদিন এখানেই থাকতে হবে তাই রাত্রি সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করে এসেছে। ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যামিও ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে, একটা বেশ পছন্দমত কারও নিয়ে নিয়েছে রাত্রি। আপাতত সেই গাড়ির নরম সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে রাত্রি আর গাড়িটা ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। লোকেশন টা একটু দূরেই, প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে গেল পৌঁছাতে, রাত্রি গাড়ি থেকে নামতেই অ্যামি হাসি মুখে এগিয়ে এল ওর দিকে। রাত্রি খুব ভালোবাসে অ্যামিকে, ভারী মিষ্টি মেয়ে, অ্যামিও রাত্রিকে নিজের দিদির মতই মনে করে। অ্যামি রাত্রিকে সঙ্গে করে এগিয়ে গেল ভিতরের দিকে, আজ সাউথ ইন্ডিয়ান ব্রাইডের সাজে শ্যুট হবে। সেটের এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও নিশীথ কে না দেখে যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রাত্রি, মনে মনে ভাবল, যত কম সাক্ষাৎ হয় ততই মঙ্গল। যথা সময়ে শ্যুট শুরু হল, আর প্রত্যাশিত ভাবেই সবটা খুব ভালো ভাবেই সম্পন্ন হল। রাত্রিও খুশি মনে সারাদিনের শ্যুট সেরে চেঞ্জ করে বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছে অমনি আবার বিপত্তি, কিন্তু এবারের বিপত্তিটা একটু অন্যরকম। রাত্রি এমনিতেই হাই হিল পরতে ভালোবাসে, বেশিরভাগ সময়ে তাই ওর পায়ে হাই হিলসই স্থান পায়। আজকেও তেমনই একটা সুন্দর হাই হিল পরেছিল, সব কিছু দিব্যি ঠিক ছিল কিন্তু হঠাৎ যে কি হল! ফট করে বা পাটা মচকে গেল, আর তারপর যা হওয়ার তাই হল। হাই হিল পরা অবস্থায় যদি পা মচকে যায় তাহলে ঠিক যা হতে পারে। এক্ষেত্রেও তাই হল, যদিও কপাল জোরে পা টা তেমন ভাবে মচকে যায় নি, ফলে ব্যথা না পেলেও রাত্রি মুহুর্তের মধ্যে বেসামাল হয়ে ভূপতিত হতে যাচ্ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর হল না। রাত্রি তো ভয়ের চোটে চোখ দুটো বুজেই নিয়েছিল কিন্তু কিছুক্ষন পরই যখন বুঝতে পারল যে সে এখনও পড়েনি তখন ধীরে ধীরে চোখ খুলে সামনে নিশীথ কে দেখতে পেল। মুখে একরাশ বিরক্তির ভাব ফুটে রয়েছে, আর রাত্রি কিনা তার হাতের মাঝে এক কথায় শূন্যে ঝুলে রয়েছে। রাত্রি ওর বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে ওঠার আগেই নিশীথ এক ঝটকায় ওকে সোজা ভাবে দাড় করিয়ে দিয়ে বলল,

যেটা ক্যারি করতে পারেন না, সেটা না পরলেই পারেন।

কথাটা বলে রাত্রির প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা না করেই নিশীথ হেঁটে এগিয়ে গেল। রাত্রি কিছুক্ষণ হতভম্বের মত সেখানেই দাড়িয়ে থাকল। একটু পরে যখন বুঝতে পারল নিশীথ ঠিক কি বলে গেল তখন যেন সর্বাঙ্গে আগুন ধরে গেল। রাত্রি অহুজা কিনা হাই হিল ক্যারি করতে পারে না! যে রাত্রি অহুজা অনায়াস দক্ষতার সঙ্গে সাবলীল ভঙ্গিমায় রাম্প ওয়াক করে সে কিনা হাই হিল ক্যারি করতে পারে না! এটা শুনলে রাত্রির রাগ হবে না কেন? রাত্রির ইচ্ছে করল এই মুহূর্তে নিশীথ কে বেশ আচ্ছা করে দুটো কথা শুনিয়ে দেয় কিন্তু নিশীথ ততক্ষণে সেখানে আর নেই। আসলে নিশীথ সারা দিনে সেটে আসেনি, এখন সব কাজ সেরে ফটোগ্রাফারের সাথে একটু জরুরী কথা বলতে এসেছিল, আর এসেই এই বিপত্তি। রাত্রি আর কি করে, রাগে গজ গজ করতে করতে গাড়ির দিকে এগোতে লাগল। অ্যামি আগেই গাড়ির কাছে অপেক্ষা করছিল, রাত্রি কে অমন রেগে মেগে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল,

কি হল ম্যাম? এনিথিং রং?

রাত্রি প্রচন্ড রেগে উত্তর দিল,

এভরি থিং ইজ রং।

রাত্রি কথাটা বলেই গাড়িতে উঠে বসল, অ্যামি জানে এখন আর কথা বলে লাভ নেই তাই চুপচাপ সেও গাড়িতে উঠে বসল। রাত্রি সারা রাস্তায় আর একটাও কথা বলল না, অ্যামিকে ওর হোটেলে নামিয়ে দিয়ে সোজা ওঙ্কার ভিলায় চলে গেল। ঘড়ির কাটা বলছে এখন সন্ধ্যে সাতটা পেরিয়েছে সবে, কুহেলি কিছুক্ষণ হল ফিরেছে তবে আলেখ এখনও ফেরেনি। একটা মিটিং অ্যাটেন্ড করে তবে ফিরবে, কুহেলিও থাকতে চেয়েছিল কিন্তু আলেখ একরকম জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছে। কুহেলি নিজের ঘরে বসে এলোমেলো কবার্ড টা একটু গুছিয়ে নিচ্ছিল তখনই হঠাৎ রাত্রি প্রায় ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। রাত্রির এই হঠাৎ আগমনে কুহেলি একটু থমকে গেল, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাত্রি কোনও কারণে প্রচন্ড রেগে আছে। কুহেলি হাতের জামা কাপড় গুলো রেখে রাত্রির পাশে বসে বলল,

কি হল রাত্রি? কোনও প্রবলেম হয়েছে নাকি?

ইয়েস, প্রবলেম তো হয়েছেই। আর কার জন্য হয়েছে জানো? না না, কার জন্য বলছি কেন, উনি তো নিজেই একটা আস্ত প্রবলেম।

রাত্রির কথার এক বর্ণও কুহেলির বোধগম্য হল না, কি বলছে কিছুই বুঝতে পারল না।

কি বলছ তুমি? কে প্রবলেম?

রাত্রি রাগে গজগজ করতে করতে উত্তর দিল,

কে আবার? তোমার বন্ধু মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল। কুহেলি আই রিয়েলি ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট ওই খিটখিটে লোকটা তোমার ফ্রেন্ড হল কীকরে? হাউ?

কুহেলি এবার হাসল, নিশীথের সঙ্গে রাত্রির ঝামেলা হবে এটা কোনও নতুন কথা নয়। ওদের মধ্যে যে কারণে অকারণে এমন ঝগড়া লেগেই থাকে সেটা এতদিনে কুহেলিও বুঝে গেছে। তাই বেশ হালকা ভাবেই জিজ্ঞেস করল,

উনি আবার কি করলেন?

কি করলেন জিজ্ঞেস না করে এটা জিজ্ঞেস করো কি করেননি? আমার বলতে সুবিধা হবে।

কুহেলি বুঝল রাত্রি ভয়ানক চটে রয়েছে, একটু ঠাণ্ডা করার জন্য এক গ্লাস জল দিয়ে বলল,

এত রাগ করো না, এই নাও জল টা খাও। এবার বলো তো ঠিক কি হয়েছে।

রাত্রি জল টা খেয়ে সবটা কুহেলিকে খুলে বলল। কুহেলি তো প্রথম টায় ভেবেই পেল না, যে হাসবে না কাদবে। না মানে, আসল ঘটনা টা তো তেমন কিছু নয়। কিন্তু কুহেলি জানে এখন রাত্রির সামনে একদম হাসা যাবে না। তাই যথা সম্ভব হাসিটা চেপে রেখে বলল,

হুম, তোমার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। না মানে, ওনার এভাবে বলাটা একদম উচিৎ হয়নি।

কুহেলির সমর্থনে যেন রাত্রি খুব খুশি হল, উত্তেজিত হয়ে বলল,

তাহলেই বল, আমার তো ইচ্ছে করছিল ভালো করে দুটো শুনিয়ে দিই।

কুহেলি অতি কষ্টে ওর হাসিটা সংবরণ করল, হঠাৎ করেই মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। অল্প একটু হেসে কুহেলি বলল,

আচ্ছা রাত্রি আমার মনে হয় তোমার আর মিস্টার আগরওয়ালের মধ্যে কিন্তু কোনও না কোনও একটা কানেকশন আছে জানো তো।

রাত্রির ভাসা ভাসা চোখদুটো বিস্ময়ে গোল গোল হয়ে গেল, অবাক হয়ে বলল,

কি বলছ কি তুমি! ওনার সাথে আমার আবার কিসের কানেকশন? কাজের বাইরে আমি ওই লোকটাকে এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য করতে পারি না আর তুমি বলছ ওনার সাথে আমার কানেকশন আছে? এইসব উল্টোপাল্টা ভাবনা তোমার মাথায় এল কীকরে?

দেখো আমি এমনি এমনি বলছি না কিন্তু। তুমি নিজেই ভেবে দেখো না, তুমি লাইফে ফার্স্ট টাইম কোনও শ্যুট ডিলে করলে তাও নাকি ওনার প্রজেক্ট। তারপর এখানে এসে পার্টির অত লোকের মাঝখানে কিনা ঠিক ওনার সঙ্গেই তোমার ধাক্কা লাগল। আবার এই রিসেন্ট দুর্গাপূজার ঘটনার কথা ধর, অত গুলো লোক তো ছিল ওখানে কিন্তু সেই মিস্টার আগরওয়ালই তোমার হয়ে কথা বললেন। আর তারপর এই আজকের ঘটনা, তুমিই তো বললে সারা দিনে উনি সেটে যাননি কিন্তু দেখো ঠিক সময়মত একদম মোক্ষম সময়ে হাজির হয়ে গেলেন। আর তাছাড়াও তোমাদের দুজনের নামটা খেয়াল করেছ! নিশীথ অ্যান্ড রাত্রি… দুজনের নামের অর্থই কিন্তু সেম। বাহ্, এক সাথে শুনতে বেশ ভালো লাগল কিন্তু নাম দুটো.. নিশীথ রাত্রি।

রাত্রি অবাক হয়ে হা করে কুহেলির কথা গুলো শুনছিল, ওর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না কুহেলি এগুলো বলছে। একটু রেগে গিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,

কুহেলি, তুমি আর কিছু বলার খুঁজে পেলে না? ওই লোকটার সঙ্গে তুমি আমার মিল খুঁজে বেড়াচ্ছ? ওই খিটখিটে লোকটার সঙ্গে আমার কোনরকম মিল থাকতেই পারে না। ইমপসিবল, এগুলো জাস্ট কো ইনসিডেন্ট আর এমন কো ইনসিডেন্ট যেগুলো না হলেই ভালো ছিল।

কুহেলি হেসে বলল,

আচ্ছা বেশ, অত রাগ করো না। বাদ দাও ওনার কথা, এখন বলো তো তুমি কি খাবে? আমি নিজে বানিয়ে খাওয়াব তোমাকে।

খেতে রাত্রি খুবই ভালোবাসে, কিন্তু নাহ, এখন আর ইচ্ছে হলেই খাওয়া চলবে না। একদম রুটিন মাফিক পরিমিত আহার করতে হবে, তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

খেতে তো অনেক কিছুই ইচ্ছে করছিল বাট এখন কিছুই খাওয়া যাবে না।

হুম, তোমার ডায়েট প্ল্যান তাই তো?

হুম।

আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে যেদিন তুমি মনে করবে সেদিন কিন্তু আমাকে বলতে হবে আমি নিজে রান্না করে তোমাকে খাওয়াব। মনে থাকবে তো?

এতক্ষণে রাত্রির মুখে একটু হাসি দেখা গেল। অল্প একটু হেসে বলল,

নিশ্চয়ই, তোমার হাতের রান্না একবার খেয়েই খুব ভালোলেগেছে, সুযোগ পেলে ছাড়ব না, সে বিষয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পার।

রাত্রি ধীরে ধীরে গল্প করতে করতে আবার সেই হাসি খুশিতে মেতে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর রাত্রি ফিরে এল নিজের বাংলোতে। চেঞ্জ করে একটা নাইট স্যুট পরে একটু ত্বক পরিচর্যায় মন দিল। এটাও ওর দৈনন্দিন কাজেরই একটা অঙ্গ, হালকা হাতে কোমল মুখখানা ম্যাসাজ করতে করতে হঠাৎ করেই কুহেলির কথা গুলো মাথায় ঘুরতে লাগল। কথা গুলো কুহেলিও যে মজার ছলেই বলেছে সেটা রাত্রির বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় নি। কিন্তু কথাগুলো একটাও অযৌক্তিক নয়, ঠিকই তো বলেছে। বেছে বেছে বারবার নিশীথের মুখোমুখিই কেন হয়! আরও তো কত মানুষ আছে, তাদের বাদ দিয়ে শুধু নিশীথই কেন? ভাবতে ভাবতে কখন যে হাত দুটোও স্থির হয়ে গিয়েছিল টের পায়নি রাত্রি। হঠাৎ যেন ঘোর কাটিয়ে নিজেকেই একটা ধমক লাগাল।

উফ্, আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি! কুহেলি জাস্ট আমার লেগ পুল করছিল, ও জানে আমি ওই লোকটার নাম শুনলেই রেগে যাই তাই একটু রাগাচ্ছিল, দ্যাটস ইট। আর আমি কিনা শুধু শুধু এই সব ফালতু কথা নিয়ে ভেবে নিজের টাইম ওয়েস্ট করছি! ওহ, সব ওই নিশীথ আগরওয়ালের জন্য, ধুর এই প্রজেক্ট টা শেষ হলে আমি আর ভুলেও ওনার কোনও প্রজেক্টের জন্য রাজি হব না।

রাত্রি মোটামুটি নিজেকে একচোট বকা ঝকা করে আবার নিজের ত্বকের পরিচর্যায় মনোনিবেশ করল। সব মিলিয়ে দিনগুলো বেশ ভালই কাটছিল, দেখতে দেখতে প্রায় একটা মাস পেরিয়ে গেছে। আলেখ আর কুহেলি নিজের কাজে আগের থেকেও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, কারণ নিশীথ আর আলেখের নতুন জয়েন্ট ভেঞ্চার টা ইতিমধ্যেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু তাই বলে কিন্তু ওদের দাম্পত্য জীবনে কোনও প্রভাব পড়েনি, টুক টাক প্রেমে পরিপূর্ণ খুনসুটি রোজই চলে, বরং কুহেলির ভাষায় বলতে গেলে আলেখ তো আগের থেকেও আরও বেশি দুষ্টু হয়ে গেছে। এদিকে নভতেজ বাবুও লন্ডনে নিজের বন্ধুর বাড়িতে লম্বা একটা ছুটি কাটিয়ে ফিরে এসেছেন। আবার রাত্রি আর নিশীথও সেই একই থেকে গেছে। না পারতে একে অন্যের সামনে আসে না আবার যদি ভুল বশত দেখা হল, তাহলে কোনও না কোনও বিপত্তি হবেই। মোট কথা, সব মিলিয়ে যেন একটা পরিপূর্ণ নির্ভুল জীবন চিত্র। কিন্তু মসৃণ ভাবে চলতে থাকা জীবনেও হঠাৎ করেই কখনও কখনও ঘনিয়ে আসে আশঙ্কার কালো মেঘের ছায়া। হয়তো বা হঠাৎ করে নয়, ধীরে ধীরেই হয়তো সবার অলক্ষ্যে ঈশান কোণে একটু একটু করে জমতে থাকে দুঃসময়ের আশঙ্কার করাল কালো ছায়াপুঞ্জ। ওদের জীবনেও কি ঘনিয়ে আসছে তেমনই কোনও ছায়া? এমন সুখ শান্তি ময় জীবনের জলছবি দেখলেই কেন যেন মনে একটা অদ্ভুত আশঙ্কা জন্ম নেয়। সব এমনই থাকবে তো? হঠাৎ কোনও ঝঞ্ঝাবর্তের কবলে পড়ে তছনছ হয়ে যাবে না তো সব? ভবিষ্যতের কথা কেই বা বলতে পারে? সময়ের গর্ভেই ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে সব প্রশ্নের উত্তর। আমরাও নাহয় প্রতীক্ষা করলাম সেই সময়টার। আজ রাত্রির শ্যুটিং এর শেষ দিন, আজকেই ফাইনাল শ্যুট হয়ে যাবে আর রাত্রির কথা মত ও এই নিশীথ আগরওয়ালের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। রাত্রি যথা সময়ে লোকেশনে পৌঁছে রেডি হয়ে একদম সময় মতই শ্যুট শুরু করে দিয়েছে। আজ রাত্রির পরনে একদম সাবেকি লেহেঙ্গা, লাল আর গোল্ডেনের কাজ করা ভারী লেহেঙ্গা টায় রাত্রিকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। আজ শেষ দিন বলে নিশীথ সকাল থেকেই সেটে উপস্থিত, সবটাই দেখছে বসে বসে। নিশীথ ব্যক্তিগত ভাবে রাত্রিকে খুব একটা পছন্দ না করলেও এটা অস্বীকার করতে পারে না যে এই মুহূর্তে দাড়িয়ে রাত্রির সমকক্ষ মডেল পাওয়া আর ব্রহ্মাণ্ডে অন্য গ্রহে প্রাণের সন্ধান পাওয়া একই ব্যাপার। রাত্রির অঙ্গে উঠেই যেন লেহেঙ্গা টার শোভা লক্ষ্য গুন বেড়ে গেছে আর ওর অনায়াস দক্ষতার ভঙ্গিমায় প্রতিটা ছবি যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। নিশীথ মনে মনে রাত্রির প্রশংসা না করে থাকতে পারল না, ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসিও ফুটে উঠল কি! কি জানি, এই ছেলের কোনও ভরসা নেই কখন যে কি হয় আর কি করে সে একমাত্র নিশীথ ব্যতীত অন্য কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যাই হোক সব কিছু বেশ ঠিক ঠাকই চলছিল, লাঞ্চ ব্রেকের আগেই মোটামুটি সত্তর শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেল। এখন লাঞ্চের পর অন্য একটা লেহেঙ্গা পরে বাকি শ্যুট টা হবে, স্বাভাবিক ভাবেই একটা ড্রেস চেঞ্জ মানে তার সঙ্গে পুরো মেকাপ জুয়েলারী সব চেঞ্জ হবে। আর এটা যে বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার সেটাও সবারই জানা, প্রায় দুঘন্টা লেগে গেল রাত্রির নতুন ড্রেসে তৈরী হতে। এবারের লেহেঙ্গা টা সম্পূর্ণ সাবেকি নয়, মানে আভিজাত্যের সাথে সাথে আধুনিকতার ছোয়াও বিদ্যমান। ব্যাক লেস গোল্ডেন চোলি আর গাঢ় মেরুন রঙের লেহেঙ্গা সঙ্গে গোল্ডেনের উপর মেরুন পাড় বসানো সূক্ষ্ম কারুকার্য করা ওরনা। অনেকটা রিসেপশন ম্যাটেরিয়াল লেহেঙ্গা আর কি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই রাত্রিকে এই লেহেঙ্গা টা তেও খুব সুন্দর লাগছে। রাত্রি যথারীতি আবার কাজ শুরু করল, স্বাভাবিক ছন্দেই এগোতে লাগল সব কিছু। নিশীথ এই লাঞ্চ ব্রেক আর প্রস্তুতির অতিরিক্ত দুঘন্টা সময়ের সদ্ব্যবহার করার জন্য একটু অন্য ঘরে গিয়েছিল একটা ভিডিও কনফারেন্স সেরে নেওয়ার জন্য। মিটিং টা শেষ করে আবার নিজের জায়গায় এসে বসে শ্যুট দেখতে লাগল। সব কিছু একদম ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু ওই যে, কখন যে কি হয় কেউ বলতে পারে না। হঠাৎ করেই রাত্রির চোলির নিজ স্থানে অনড় থাকার একমাত্র সম্বল দুটো রশির মধ্যে গলার কাছের রশিটা আলগা হতে শুরু করল। কোমরের কাছের পিঠের ওপরে বন্ধনাবদ্ধ রশি দুটো নিজ স্থানে ঠিক থাকলেও গলার পাশ থেকে ঠিক ঘাড়ের কাছে থাকা রশি দুটো কেন যেন হঠাৎ করেই নিজদের স্থান থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করল। রাত্রি এতটাই মগ্ন ছিল যে প্রথম দিকটায় খেয়ালই করেনি, কিন্তু রশি দুটো ধীর গতিতে নিজেদের স্থানচ্যুতি বজায় রাখল। আসলে যদি বাঁধন টা শিথিল হত তাহলে হয়তো রাত্রি খেয়াল করতে পারত কিন্তু এখানে বাঁধন টা ঠিকই আছে। সমস্যা টা হলো অন্য জায়গায়, একটা রশি চোলির সঙ্গে সংযোগ স্থল থেকেই ছিড়তে শুরু করল। ফলে রাত্রি শুরুতে কিছু বুঝতে পারল না, অন্য কারোর নজরেও পড়েনি যে সতর্ক করে দেবে। রাত্রি স্বাভাবিক ভাবেই নিজের কাজ করে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করেই এল সেই অনাকাঙ্ক্ষিত অবশ্যম্ভাবী মুহূর্ত যখন রশির সঙ্গে চোলির শেষ সংযোগ টুকুও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, আর…… বাকিটা বলার মনে হয় না প্রয়োজন আছে, ওয়ার্ডরোব ম্যালফাংশন শব্দটার সঙ্গে কম বেশি সবাই পরিচিত। কি হল সেটা রাত্রি বুঝে ওঠার আগেই যা হওয়ার হয়ে গেছে। রাত্রির তখন লজ্জায় দুঃখে চোখ দুটো বন্ধ করে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। রাত্রির মনে হল যেন ওর গোটা দুনিয়াটাই হঠাৎ করে পাল্টে গেল। দুটো হাত দিয়ে নিজের সম্ভ্রম রক্ষার চেষ্টা করতে যাওয়ার আগেই মনে হল কেউ যেন ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। চোখ দুটো খোলার মত সাহস ওর নেই, মনে হচ্ছে এখন চোখ খুললেই সবার নজরে নিজের জন্য উপহাস দেখতে পাবে। হঠাৎ কে ওকে জড়িয়ে ধরলো সেটুকুও যেন জানার ইচ্ছে হল না, এই মুহূর্তে ওর মস্তিষ্ক যেন কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ কানে এল গম্ভীর ভরাট পরিচিত পুরুষালি কণ্ঠস্বর। অতি পরিচিত সেই কণ্ঠস্বর রাত্রির কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র আপনা থেকেই অজান্তে ওর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হল একটা নাম… নিশীথ। হ্যা, রাত্রিকে সঠিক সময়ে নিশীথই জড়িয়ে ধরেছিল, আসলে সেই মুহূর্তে অন্য কোনো আবরণ খোজার থেকে বা নিজের কোট টা খুলে দেওয়ার থেকেও এটাই দ্রুততর উপায় মনে হয়েছিল নিশীথের কাছে। ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত সবাই যেন কেমন স্থানুবত্ হয়ে পড়েছিল, নিশীথের কথায় যেন সবার ঘোর কাটল।

ব্রিং সামথিং ফাস্ট।

নিশীথের আদেশে তৎক্ষণাৎ একজন দৌড়ে গিয়ে একটা ভারী চাদর এনে দিতেই নিশীথ ইশারায় সেটা ওকে সহই রাত্রির গায়ে জড়িয়ে দিতে বলল। মেয়েটি নিশীথের কথামতই ওদের দুজনকেই চাদর দিয়ে জড়িয়ে দিল আর তারপরে নিশীথ সাবধানে গোটা চাদরটা রাত্রির গায়ে জড়িয়ে দিল। রাত্রি এখনও চোখ দুটো বন্ধ করেই রেখেছে, কিন্তু বন্ধ চোখের আগল ওর নোনা জল গুলোকে আটকে রাখতে পারেনি, উষ্ণ স্রোতের মত অঝোর ধারায় তারা বয়ে চলেছে। নিশীথ অ্যামিকে ডেকে রাত্রিকে ওর রুমে নিয়ে যেতে বলল, অ্যামিও এতক্ষণ যেন স্তব্ধ হয়ে ছিল এখন নিশীথের কথা শুনে রাত্রিকে নিয়ে ওদের নির্দিষ্ট ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রাত্রির যেন কোনও হুশই নেই, যেন যন্ত্রচালিত পুতুলের মত অ্যামির সঙ্গে এগিয়ে যেতে লাগল। নিশীথ কিছুক্ষণ রাত্রির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল, ওর খুব খারাপ লাগছে। আজ যা হল সেটা যে কোনও মেয়ের পক্ষেই মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। নিশীথ কিছুক্ষণ সেইভাবেই তাকিয়ে থেকে ফটোগ্রাফারকে ডেকে নিজের রুমে নিয়ে গেল। এদিকে রাত্রি রুমে এসেও একভাবে অশ্রুবর্ষণ করেই চলেছে, চোখ দুটো এখনও তেমনই বন্ধই রয়েছে। শুধু নিঃশব্দে বন্ধ চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তপ্ত জলের ধারা। অ্যামি অনেক বুঝিয়েও শান্ত করতে পারেনি রাত্রিকে, অনেক বলার পরেও রাত্রি কিছুতেই চোখ খোলেনি। কেন যেন ওর মনের মধ্যে একটা ভীতি জন্মে গেছে, মনে হচ্ছে চোখ খুললেই দেখতে পাবে কারোর চোখে উপহাসের হাসি, তো কারোর চোখে করুণার দৃষ্টি। দুটোর কোনোটাই সে সহ্য করতে পারবে না, কিছুতেই না। অ্যামি বারবার বলেও ওর পোশাক টা পর্যন্ত বদলাতে পারেনি, সেই থেকে গায়ে জড়ানো চাদরটা দুহাত দিয়ে শক্ত করে আকড়ে ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর নিশীথ এল ওর রুমে, রাত্রিকে এখনও সেইভাবেই দেখে খারাপ লাগাটা আবার যেন মোচড় দিয়ে উঠল। অ্যামি নিশীথ কে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, ওর চোখে ফুটে ওঠা অসহায় ভাবটা লক্ষ্য করেই নিশীথ ইশারায় ওকে ঘর থেকে চলে যেতে বলল। অ্যামি বিনা বাক্যব্যয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে নিশীথ দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে ঠিক রাত্রির সামনে টায় বসল। এখনও রাত্রির বন্ধ চোখের আগল ভেঙে নিঃশব্দ কান্নারা ঝরে চলেছে। নিশীথের মনটাও হঠাৎ করেই বড্ড ভারী হয়ে এল, একটু ইতস্তত করে খুব নরম সুরে ডাকল,

রাত্রি।

ক্রমশ___________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগল আজকের পর্ব টা? আশা করি আপনাদের ভালো লেগেছে। রাত্রি আর নিশীথকে কেমন লাগছে? এরপর কি হতে পারে বলে মনে হয়? এই আকস্মিক দুর্ঘটনার কি ফল হবে? আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। অপেক্ষায় থাকব। আজ তবে এই টুকুই। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here