সংগোপনে’ পর্ব-৪১

0
1262

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৪১
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————

রাত্রি।

নিশীথের উপস্থিতি রাত্রি এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, বোঝার মত অবস্থাতেও সে নেই। হঠাৎ নিশীথের কণ্ঠস্বর শুনে একটু যেন চমকে উঠল, কিন্তু তাও চোখ খুলল না। বলা ভালো খুলতে পারল না, সেই ভীতি টা যেন একটা অসহনীয় বোঝার মত জাকিয়ে বসেছে ওর সমগ্র সত্তা জুড়ে। নিশীথ খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে রাত্রি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক, এইরকম একটা ঘটনা কারো জীবনেই কাম্য নয়। রাত্রিকে দেখে নিশীথের খুব খারাপ লাগছে, দুর্ঘটনার ওপর কারোর হাত না থাকলেও পরোক্ষ ভাবে হলেও নিশীথের কিছুটা দায় থেকেই যায়। ওর প্রজেক্টের শ্যুটে এসেই এই বিপত্তি টা ঘটেছে, ড্রেস টাও ওর ফ্যাশন হাউসের তাই কেন যেন নিশীথের নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। আর রাত্রির এইভাবে ভেঙে পড়াটা যেন ওর খারাপ লাগা টাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। নিশীথ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর একটু ইতস্তত করে রাত্রির কিছুটা কাছে এগিয়ে এসে বসল। কিছুটা দ্বিধা নিয়েই একটা হাত আলতো করে রাত্রির কাধে রাখল, হঠাৎ এই স্পর্শে রাত্রি যেন শিউরে উঠল। নিশীথ খুব নরম সুরে বলতে শুরু করল,

রাত্রি, প্লিজ ওপেন ইয়োর আইজ। দেখো এভরিথিং ইজ ফাইন, কিছুই হয়নি সব ঠিক আছে। দ্যাট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট ব্যাস, এভরিথিং ইজ নরম্যাল।

কখন যে সম্বোধনের আপনি টা তুমিতে পরিণত হয়ে গেছে নিশীথ বুঝতে পারেনি, আবেগ জিনিস টাই বোধহয় এমনই। রাত্রির নিঃশব্দ কান্না তাও থামল না, বন্ধ চোখের পলক দুটোও যেন কিছুতেই বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে না। নিশীথের কথা গুলো আদৌ ওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে পেরেছে কিনা সেটাও বোঝা গেল না। কিন্তু নিশীথ হাল ছাড়ল না, আবার বলতে শুরু করল,

রাত্রি আই নো, যেটা হয়েছে সেটা খুবই আনফর্চুনেট, মুখে বললেও এই মুহূর্তে তোমার কষ্ট টা কারোর পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু রাত্রি ট্রাস্ট মি, এভরিথিং ইজ ফাইন, একটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটে গেছে ব্যাস, ওখানেই ওটা শেষও হয়ে গেছে। রাত্রি একবার চোখ টা খোলো প্লিজ, একবার ভালো করে আমার কথা টা শোনো।

রাত্রি কিছুটা হলেও যেন শান্ত হল, ধীরে ধীরে নিজের ভীতির সঙ্গে দ্বিধা দ্বন্দ্বের যুদ্ধ লড়ে অবশেষে চোখ মেলে তাকাল। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে নিশীথের বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল, অব্যক্ত একটা বেদনার ছায়া যেন চোখদুটোর সব প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। রাত্রি এতক্ষণের মৌনতা ভেঙে হঠাৎ বলে উঠল,

কেন মিথ্যে শান্ত্বনা দিচ্ছেন আমাকে? আমি জানি সব শেষ হয়ে গেছে, আমার সন্মান আমার কেরিয়ার সব। কালকেই সব অনলাইন ফোরামে মুখরোচক খবরের সঙ্গে এক্সক্লুসিভ ভিডিও বেরোবে। সবার দৃষ্টিতে আমি হয় উপহাসের নয়তো করুণার পাত্রে পরিণত হয়ে যাব।

বলতে বলতে রাত্রি কান্নায় ভেঙে পড়ল, নিঃশব্দ কান্নার স্রোত এবার যেন তীর ভাঙ্গা ঢেউয়ের হাহাকারে পরিণত হল। রাত্রির চোখের প্রতিটা অশ্রুবিন্দু যেন নিশীথের অন্তরে আঘাত হানতে লাগল। নিশীথ এবার কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই দুহাতে শক্ত করে রাত্রির দুটো কাধ চেপে ধরে বলল,

আগে থেকেই কেন এভাবে ভেঙে পড়ছ? কিছু হওয়ার আগেই তুমি কীকরে ভেবে নিচ্ছ এগুলোই হবে? আমি তো বলছি সব ঠিক আছে, তোমার সন্মান তোমার কেরিয়ার কোনোটাই শেষ হয়ে যায়নি। শেষ হয়ে যাওয়াটা কি এতটাই সহজ নাকি? একটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা সব কিছু শেষ করে দিতে পারে না।

নিশীথের কথা গুলোয় ঠিক কি ছিল রাত্রি জানে না, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল কথা গুলো। রাত্রিকে কিছুটা শান্ত হতে দেখে নিশীথ ওর হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল,

আমি জানি তোমার জন্য এটা মোটেও সহজ নয় কিন্তু তুমি যা ভাবছ তেমন কিছুই হবে না। আমি জানি একজন সেলিব্রিটির ইমেজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর তার থেকেও বড় কথা একটা মেয়ের সন্মান কতটা অমূল্য। এই ধরনের ভিডিও লিক হতে যতটুকু সময় লাগে তার থেকেও অনেক কম সময়ে সেটা ভাইরাল হয়ে যায়। আমি সবটাই জানি, কিন্তু তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পার, আজকের ঘটনা এখানে উপস্থিত স্টাফরা ছাড়া অন্য কেউ জানতে পারবে না।

রাত্রি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নিশীথের দিকে, ঠিক কি বলতে চাইছে যেন সেটা বোঝার চেষ্টা করছে। নিশীথ রাত্রির মনের ভাবটা বুঝতে পেরেই বলল,

আমি আজকের সমস্ত ভিডিও রেকর্ডিং, ফটোগ্রাফ ইভেন সি সি টিভি ফুটেজ পর্যন্ত সবটাই ডিলিট করে দিয়েছি। সবার সেলফোনও চেক করা হয়েছে, সব ঠিক আছে রাত্রি, চিন্তার কোনও কারণ নেই, ট্রাস্ট মি।

রাত্রি বুঝতে পারল না, সে ঠিক শুনছে না ভুল শুনছে! নিশীথ ওর জন্য আজকের গোটা দিনের পুরো রেকর্ডিং টা ডিলিট করে দিয়েছে! একজন বিজনেস ম্যানের জন্য এটা অনেক বড় একটা লস, শুধুমাত্র ওর সন্মান রক্ষার জন্য নিশীথ…. ভাবনা গুলো সম্পূর্ণ হলো না, তার আগেই নিশীথ বলল,

আই নো তোমার কিছুটা টাইম লাগবে, কিন্তু এভাবে দুর্বল হয়ো না, ভেঙে পড়া তোমাকে মানায় না।

রাত্রির চোখের অবিরাম বর্ষণ কিছুক্ষণ হল বন্ধ হয়েছে, নিশীথের কথা গুলো যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস টা কে আবার একটু একটু করে গড়ে তুলছে। নিশীথ একটু থেমে বলল,

এবার চেঞ্জ করে নাও, আমি অ্যামিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

নিশীথ উঠে বাইরে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেল দরজার দিকে, রাত্রি বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সেদিকে। খুব ইচ্ছে করছে একবার নিশীথ কে ডাকতে, মনের মধ্যে অনেক গুলো কথার স্রোত উথাল পাথাল করছে কিন্তু কিছুতেই যেন তাদের শব্দের রূপ দিতে পারল না। নিশীথ দরজাটা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই অ্যামি ঘরে এল। রাত্রিকে কিছুটা স্বাভাবিক দেখে যেন অ্যামিও একটু স্বস্তি পেল। ওর কাছে এসে বলল,

ম্যাম, ডোন্ট ওয়ারি এভরিথিং ইজ ওকে নাও। মিস্টার আগরওয়াল সবটা হ্যান্ডেল করে নিয়েছেন, আর এখানে সবাই সত্যিই খুব ভালো, সবাই খুব সাপোর্টিভ।

রাত্রি কিছু বলল না, এখনও ওর চোখ দুটো দরজার দিকেই নিবদ্ধ। অ্যামির কথায় এবার উঠে চেঞ্জ করে নিল, মেকাপ তুলে ফ্রেশ হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য বেরোতে গিয়েও পা টা যেন কিছুতেই এগোতে পারল না। একটা চাপা অস্বস্তি রয়েই গেছে, মনে হচ্ছে এখন বাইরে বেরোলেই সবার নজর শুধু ওর দিকেই থাকবে। রাত্রি চোখ দুটো বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিল, নিজের মনটাকে একটু শক্ত করে রুমের বাইরে পা রাখল। চাপা অস্বস্তি টা এখনও রয়েছে, থাকাটাই স্বাভাবিক, এত বড় একটা ঘটনার প্রভাব কি বললেই ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায়! কিন্তু রাত্রি যেমনটা ভেবেছিল তেমন কিছুই হল না। অন্যদিনের সঙ্গে আজকের কোনও তফাৎ নেই, রুম থেকে বেরিয়ে পার্কিং অবধি যাওয়া পর্যন্ত যার সঙ্গেই দেখা হল সবাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওকে দেখে অন্যদিনের মতই হাসল। কারোর চোখেই নিজের জন্য করুণা বা উপহাস কোনোটাই দেখতে পেল না, রাত্রির খুব ভালো লাগলো, অস্বস্তি টাও ধীরে ধীরে কমতে লাগল। রাত্রি প্রায় পার্কিংয়ে পৌঁছে গেছে এমন সময় একজন স্টাফ মেম্বার এসে বলল নিশীথ ওকে একটু ডাকছে। রাত্রিরও মনে হল নিশীথের সঙ্গে দেখা না করেই চলে যাওয়া টা ঠিক নয়, আজ নিশীথ ওর জন্য যা করেছে তার ঋণ হয়তো সারা জীবনেও শোধ করতে পারবে না। রাত্রি অ্যামিকে অপেক্ষা করতে বলে মেয়েটির সঙ্গে এগিয়ে গেল, নিশীথের রুমের সামনে এসে মেয়েটি চলে গেল। রাত্রি একটু থেমে নক করল, নিশীথ রাত্রির জন্যই অপেক্ষা করছিল ওকে দেখে উঠে দাড়িয়ে বলল,

প্লিজ কাম ইন রাত্রি।

রাত্রি একটু ইতস্তত করে ঘরে ঢুকল, নিশীথ ওকে বসতে বলে নিজেও বসল। রাত্রি সোফার একটা পাশে বসার পর নিশীথ বলল,

দেখ রাত্রি আমি জানি এখন এভাবে তোমাকে ডেকে পাঠানো টা হয়তো ঠিক হয়নি বাট…

নিশীথের কথা শেষ হওয়ার আগেই রাত্রি বলে উঠল,

নো প্রবলেম, আপনি বলুন।

নিশীথ একটু থেমে বলল,

রাত্রি আমি বলছিলাম যে তুমি কয়েকটা দিন রেস্ট নাও, আফটার ফিউ ডেয়জ আমরা আবার আজকের শ্যুট টা কমপ্লিট করে নেব। অ্যান্ড সরি ফর টুডে, আমার ফ্যাশন হাউসের ড্রেসের ফলটের জন্য তোমাকে এরকম একটা এম্ব্যারেসিং সিচ্যুয়েশনে পড়তে হল।

রাত্রির যেন নিজের চোখ বা কান কোনটাকেই বিশ্বাস হল না, ওর সামনে বসা মানুষটা কি সেই নিশীথ আগরওয়াল! সেই রুড অ্যারোগেন্ট নিশীথ! আজ যেন নিশীথের সম্পূর্ণ অন্য একটা রূপ দেখতে পেল রাত্রি। নিশীথ সরি বলছে! এই অচেনা নতুন রূপ টা রাত্রিকে যেন ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করছে। রাত্রি ওর বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে বলল,

একটা দুর্ঘটনার জন্য কেউ দায়ী হয় না, হঠাৎ করে অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঘটে বলেই তো তাকে দুর্ঘটনা বলে। নিজেকে শুধু শুধু দোষ দেবেন না, ওটা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে, কারোর কিছু করার ছিল না, আপনারও না আমারও না। আর…

রাত্রি ধন্যবাদ জানাতে চেয়েও কেন যেন পারল না। নিশীথ একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলল,

আর?

রাত্রি হাজার কথার ভিড়ের মধ্যে থেকে শুধুমাত্র থ্যাঙ্কস টাই বলতে পারল। বলতে চাইছে অনেক কিছু কিন্তু পারছে না, কেন পারছে না সেটার কারণ অবশ্য তার জানা নেই। নিশীথের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাত্রি বেরিয়ে এল, এখন সত্যিই একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। নিশীথ নিজের ঘরে বসে আজকের গোটা ঘটনা টার কথা ভাবছিল, যতবার রাত্রির অসহায় করুন কান্না ভেজা মুখটা মনে পড়ছে ততবারই একটা অদ্ভুত খারাপ লাগায় মনটা ভরে যাচ্ছে। শুধুই কি আজকের ঘটনাটার জন্য নিজেকে পরোক্ষ রূপে দোষী মনে করছে বলেই খারাপ লাগছে নাকি অন্য কোনও কারণ আছে? আজ জীবনে প্রথম বার উত্তর নিশীথেরও অজানা। রাত্রি সোজা নিজের বাংলোয় ফিরে ফ্রেশ হয়েই শুয়ে পড়ল, এমন সন্ধ্যে বেলায় সে শোয় না কিন্তু আজ আর ভালোলাগছে না। শুয়ে শুয়ে আজকের কথা ভাবছিল রাত্রি, ওয়ার্ডরোব ম্যালফাংশনের কথা অনেক শুনেছে। এমনকি একবার একটা ফ্যাশন শো তে চাক্ষুষও করেছিল কিন্তু কোনও দিনও স্বপ্নেও ভাবেনি নিজেকেও একদিন এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। মুহূর্তটা মনে পড়লেই যেন চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে, আজ সত্যি যদি নিশীথ না থাকত তাহলে….. নাহ বাকিটা ভাবার সাহস হল না রাত্রির। নিশীথের কথা মনে হতেই আবার যেন হারিয়ে যেতে লাগল ভাবনার জগতে। সেই চরম মুহূর্তে ওর সন্মান রক্ষা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই যেন ওর চোখের সামনে ভাসতে লাগল। নিশীথের এমন একটা রূপও থাকতে পারে এটা যেন রাত্রি কল্পনাও করতে পারে না, এতোটা সংবেদনশীল একটা মন লুকিয়ে আছে ওই খিটখিটে লোকটার মধ্যে! হঠাৎ করেই রাত্রির মনে কুহেলির কথা গুলো আবার ফিরে ফিরে আসতে লাগল। কানেকশন! কুহেলি সেদিন মজার ছলে বলেছিল কথাটা কিন্তু আজ রাত্রির মনে হচ্ছে কথাটা যেন সত্যি। একটা অদৃশ্য কানেকশন যেন সত্যিই আছে, না হলে আজও ঠিক সময়ে সেই নিশীথই…..রাত্রি নিজেও বুঝতে পারেনি ও কখন কোন ভাবনার সাগরে ডুব দিয়েছে। কি ভাবছে, কেন ভাবছে এসব প্রশ্ন যেন অবান্তর, এখন শুধু ওর সমস্ত মন জুড়ে শুধুই নিশীথের আনাগোনা। রাত্রির মনের কোনও একটা কোণায় নিশীথের প্রতি একটা অফুরন্ত সম্ভ্রমের সৃষ্টি হল। শুধুই সম্ভ্রম! না, সম্ভ্রমের পাশাপাশি নিশীথের প্রতি রাত্রির মনে কৃতজ্ঞতারও অভাব নেই। কিন্তু শুধু সম্ভ্রম আর কৃতজ্ঞতার গণ্ডিতেই কি সীমাবদ্ধ ওর মনের অনুভূতি গুলো? উত্তর টা এখনও অজানা। রাত্রির মত আজ নিশীথও ডুবে আছে ভাবনার অতল গভীরে, হয়তো জীবনে প্রথম বার। বারবার শুধু মনে হচ্ছে মেয়েটা ঠিক আছে তো? এত বড় একটা ধাক্কা একা সামলে নিতে পারবে তো? যদিও দেখে মনে হচ্ছিল নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে কিন্তু একাকী সময় গুলোতে এই ঋণাত্মক চিন্তা ভাবনা গুলো মন মস্তিষ্ক জুড়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। নিশীথের মনটা বড্ড অশান্ত লাগছে, খুব ইচ্ছে করছে একবার ফোন করে রাত্রির সাথে কথা বলতে। হঠাৎ এমন ইচ্ছের কারণ নিশীথ নিজেও জানে না, আজ পর্যন্ত কারোর জন্য নিশীথ এভাবে ব্যস্ত হয়নি। তাহলে হঠাৎ আজ রাত্রির জন্য এমনটা কেন হচ্ছে? প্রশ্নটা বারবার নিশীথের মনে উকি দিচ্ছিল। নিশীথ আগরওয়াল আজ হঠাৎ একজন স্বল্প পরিচিতা মেয়ের জন্য এত কেন ভাবছে? তাও আবার রাত্রির জন্য! যাকে কিনা সে বলতে গেলে পছন্দই করে না তার জন্য এত কেন সে ভাবছে? শুধু কি আজকের দুর্ঘটনার জন্য কিছুটা হলেও নিজেকে দায়ী মনে করে তাই? নাকি অন্য কোনও সুপ্ত কারণ আছে যেটা সে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু কিছুটা জোর করেই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল রাত্রির জন্য এটা শুধুই তার একজন মানুষের অন্য মানুষের প্রতি চিন্তা আর কিছুই না। নিশীথ নিজেকে এটা জোর পূর্বক বোঝালেও সত্যিই কি শুধু তাই? এর উত্তর জানা নেই, সময় যখন উত্তর নিয়ে আসবে তখনই না হয় জানা যাবে, ততদিন না হয় প্রশ্ন গুলো এভাবেই উত্তরের অপেক্ষায় থাক। নিশীথ নিজের মনকে নিজের ইচ্ছে মত একটা কারণ বোঝাতে সক্ষম হলেও চিন্তা টা কিছুতেই দুর করতে পারল না। রাত্রির একটা খোজ না পাওয়া পর্যন্ত যে ওর মনটা শান্ত হবে না সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। ফোনটা হাতে নিয়ে রাত্রির নম্বরটা বের করেও কল টা করতে পারল না। আজ পর্যন্ত কর্মসূত্রেও কোনদিনও রাত্রিকে ফোন করার প্রয়োজন হয়নি, সেজন্যেই হয়তো আজ হঠাৎ ফোন করতে একটু দ্বিধা হচ্ছে। আর তাছাড়া ফোন করে বলবেটাই বা কি? সে নিশীথ আগরওয়াল কোনও যেমন তেমন ব্যক্তি নয়, হঠাৎ ফোন করে কেমন আছ বলাটা আর যাকেই মানাক তাকে মানায় না। কিন্তু একটা খবর না পেলেও যে এই অস্বস্তি টা কমবে না সেটাও জানে। একটা উপায় হঠাৎ করেই যেন সামনে এসে পড়ল, এতক্ষণ যে কেন মনে আসেনি সেটা ভেবেই নিশীথের অবাক লাগছে। হাতে থাকা ফোনটা থেকে একটা নম্বর সিলেক্ট করে ডায়াল করল নিশীথ। বেশিক্ষণ লাগল না কলটা রিসিভ হতে, একটু পরেই মুঠোফোনটার ওপাশ থেকে ভেসে এল একটা অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর।

বলুন মিস্টার আগরওয়াল, আজ হঠাৎ কি মনে করে?

নিশীথ কোনরকম ভনিতা ছাড়াই সোজা বলল,

একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনাকে ফোন করেছি।

আই নো দ্যাট, আপনি ফোন করেছেন যখন, তখন দরকার তো কিছু একটা আছেই। বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে।

থ্যাঙ্ক ইউ কুহেলি, আপনি খুব সহজেই সবটা বুঝতে পারেন। রিয়েলি আই নিড ইয়োর হেল্প টুডে, অ্যান্ড ওনলি ইউ ক্যান হেল্প মি।

এইমুহুর্তে একমাত্র কুহেলি ছাড়া অন্য কারোর নাম নিশীথের মনে হয়নি। কারণ একমাত্র কুহেলির পক্ষেই এইমুহুর্তে রাত্রির কাছে যাওয়াটা সম্ভব। কুহেলি যেন নিশীথের গলার অস্থিরতা টা আন্দাজ করতে পারল, একটু অবাকই হল। সেটাই স্বাভাবিক, নিশীথের মত একজন ব্যাক্তিত্ব হঠাৎ এমন অস্থির হয়ে পড়বে এটা বিশ্বাস করা একটু কঠিন। খুব গুরুতর কিছু যে হয়েছে সেটা আন্দাজ করতে কুহেলির খুব একটা অসুবিধা হল না, ওর কণ্ঠস্বরেও এবার যেন একটু দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল।

কি হয়েছে মিস্টার আগরওয়াল? কোনও প্রবলেম?

নিশীথ অযথা সময় নষ্ট না করে কুহেলিকে সবটা খুলে বলল, আজ সেটে যা যা হয়েছে সবটাই। কুহেলির যেন প্রথমটায় নিজের কানকে বিশ্বাস হল না, যেটা শুনল সেটা কি আদৌ সত্যি! কিন্তু নিশীথ এমন একটা বিষয় নিয়ে যে মিথ্যে কথা বলবে না সেটা কুহেলি জানে। নিশীথ সবটা বলার পর বলল,

কুহেলি আই ডোন্ট নো রাত্রি এখন কেমন আছে, মানে লাস্ট যখন সেটে ওর সাথে কথা হয়েছিল তখন মনে হচ্ছিল অনেকটাই সামলে নিয়েছে নিজেকে কিন্তু বুঝতেই পারছেন এরকম একটা ইনসিডেন্ট সহজে তো ভুলে যাওয়া যায় না। আর সবথেকে বড় কথা রাত্রি এই মুহূর্তে একা আছে, যদি… ইউ নো.. মানে…

কুহেলি নিশীথের না বলা কথা গুলোও বুঝে নিল, নিশীথ আর কিছু বলার আগেই কুহেলি বলল,

আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড, ডোন্ট ওয়ারি মিস্টার আগরওয়াল, আমি এক্ষুনি রাত্রির কাছে যাচ্ছি। ওকে এইভাবে ভেঙে পড়তে দেব না, একটা দুর্ঘটনার জন্য লাইফ থেমে যেতে পারে না।

থ্যাঙ্ক ইউ কুহেলি, আমি জানি আপনি খুব ভালোভাবেই সামলে নিতে পারবেন রাত্রিকে। আমাকে শুধু একবার ইনফর্ম করে দেবেন রাত্রি ঠিক আছে কিনা।

নিশ্চয়ই, অ্যান্ড থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার আগরওয়াল। আপনি রাত্রির জন্য যা করেছেন তার সত্যিই কোনও তুলনা হয় না।

আমি সেটাই করেছি যেটা একজন প্রকৃত মানুষের করা উচিৎ, আর তাছাড়াও কিছুটা হলেও আজকের ঘটনাটার জন্য আমিও দায়ী। আমার স্টাফ দের গাফিলতির জন্যই এটা ঘটেছে, আর আমার স্টাফের ভুল মানে সেটা আমার ভুল। এরকম একটা ডিফেক্টড ড্রেস কীকরে চেকিংয়ে পাস করতে পারে? সো আমাকে থ্যাঙ্কস বলার কোনও কারণ নেই।

কুহেলি নিশীথ কে এমনিতেই খুব সন্মান করে, আর আজকের পরে যেন সেটা আরও বেড়ে গেল। কুহেলি বলল,

আপনি কেন নিজেকে দোষ দিচ্ছেন বলুন তো? ভুল মানুষ মাত্রেই হয়, আর সেটা নিজের অজান্তে অনিচ্ছাকৃত ভাবে হয়। এটাও তেমনই একটা ইনসিডেন্ট সো প্লিজ এভাবে নিজেকে দোষ দেওয়াটা বন্ধ করুন।

কিন্তু….

কোনও কিন্তু নয়, আচ্ছা মিস্টার আগরওয়াল আমি পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব, এখন আমার রাত্রির কাছে যাওয়া উচিৎ।

শিওর।

থ্যাঙ্ক ইউ আমাকে জানানোর জন্য, আমি আপনাকে ইনফর্ম করে দেব।

থ্যাঙ্কস কুহেলি।

কুহেলি কলটা ডিসকানেক্ট করেই ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছিল এমন সময় আলেখ ঘরে ঢুকল। আলেখ এতক্ষণ নীচে নভতেজ বাবুর সঙ্গে কথা বলছিল, ঘরে ঢুকেই কুহেলিকে ওরকম হন্তদন্ত হয়ে বেরোতে দেখে বলল,

কি হল? এত ব্যস্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছ?

কুহেলি আলেখকে সবটা খুলে বলল, আলেখ শুনে প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল,

হোয়াট! কি বলছ কি তুমি? রিতু কোথায় এখন?

বাংলোতেই আছে, আমি ওর কাছেই যাচ্ছি।

আমিও যাব, চল।

আলেখ ব্যস্ত হয়ে বেরোনোর জন্য পা বাড়ালেই কুহেলি ওর একটা হাত টেনে ওকে বাঁধা দিয়ে বলল,

নো আলেখ, তুমি এখন যেও না।

আলেখ অবাক হয়ে বলল,

মানে? কুহেলি শি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড, ওর সাথে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল আর তুমি আমাকে যেতে বারণ করছ?

হ্যা করছি। আলেখ আমি তোমার দিকটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি কিন্তু তোমাকেও তো রাত্রির দিকটা একটু বুঝতে হবে, তাই না।

মানে?

আলেখ, এরকম একটা ঘটনার পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই রাত্রির মন ভালো থাকবে না। আর ওকে যতটা আমি চিনেছি, তাতে এই মুহূর্তে কারোর সহানুভূতি বা করুণার ওর প্রয়োজন নেই। তাছাড়াও একটা মেয়ে হিসেবে আমি বলতে পারি এই মুহূর্তে ওর শুধু একটা সাপোর্ট দরকার। তুমি নিঃসন্দেহে ওর সাপোর্ট হতে পার কিন্তু রাত্রি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তোমার মনে ওর জন্য সমবেদনা সৃষ্টি হবেই। আর তাছাড়াও যতই হোক না কেন, এরকম একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে ও নিশ্চয়ই তোমার সামনে কম্ফর্টেবল ফিল করবে না, তাই বলছি তুমি এখন যেও না।

আলেখ কিছুটা শান্ত হয়ে বলল,

হুম, ঠিকই বলেছ। আসলে খবরটা শুনে আর মাথা ঠিক ছিল না, এতোটা ভেবে দেখিনি। তুমি যাও, আর কোনও প্রয়োজন হলে বলবে।

হুম, আচ্ছা শোনো আমি আজকের রাতটা রাত্রির কাছেই থাকব।

হ্যা, এটাই ভালো হবে।

দুজনে নীচে নামতে নামতে কুহেলি বলল,

আমি তাহলে ড্যাড কে বলে যাচ্ছি।

ড্যাড কে আমি বলে দেব, তুমি আগে রিতুর কাছে যাও।

ওকে।

কুহেলির রাত্রির বাংলোতে পৌঁছতে ঠিক দুমিনিট সময় লাগল। ডোরবেল প্রেস করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলোর সর্বক্ষণের দেখাশোনার লোক মুরু দরজা খুলে দিল। মুরু কুহেলিকে চেনে তাই ওকে দেখেই একগাল হেসে ওকে ভিতরে আসতে বলল। কুহেলি ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

মুরু জী, রাত্রি কোথায়?

ছোটি ম্যাডাম তো নিজের ঘরেই আছেন।

আচ্ছা, আমি তাহলে রাত্রির রুমে যাচ্ছি।

জী মেমসাব।

কুহেলি সোজা সিড়ি বেয়ে দোতলায় রাত্রির ঘরের সামনে গিয়ে দাড়াল। দরজাটা বন্ধ, কুহেলি আলতো করে দুবার টোকা দিতেই ভিতর থেকে রাত্রির আওয়াজ শোনা গেল,

মুরু আন্না আমি এখন কিছু খাব না, তুমি একেবারে ডিনার রেডি করে আমাকে দিয়ে যেও।

রাত্রি আমি কুহেলি।

রাত্রি নিজের নরম বিছানায় আলগোছে শুয়ে ছিল, এখন হঠাৎ কুহেলি আসবে এটা ভাবতেই পারেনি। সোজা উঠে গিয়ে দরজা খুলে একটু অবাক হয়ে বলল,

কুহেলি তুমি!

হুম, কেন আসতে পারি না বুঝি?

রাত্রি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

আমি কি তাই বললাম নাকি, এস এস ভিতরে এসো।

কুহেলির হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে নিজেও বসল। কুহেলি একভাবে কিছুক্ষণ রাত্রির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, একদিনেই মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। ওর স্বভাবসিদ্ধ সেই সতেজতার ছিটে ফোটাও নেই, উচ্ছল খরস্রোতা নদীর মত মেয়েটা কেমন যেন শান্ত দীঘির মত হয়ে গেছে। ঠোঁটে একটা হাসি লেগে আছে বটে কিন্তু তাতে যে কোনও প্রাণ নেই সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। কুহেলি একটু অভিমানী সুরেই বলল,

আমাকে এতোটা পর মনে কর তুমি?

হঠাৎ এমন একটা কথা শোনার জন্য রাত্রি মোটেই প্রস্তুত ছিল না। একটু অবাক হয়ে বলল,

মানে? তুমি কি বলছ কুহেলি? আমি তোমাকে পর কেন মনে করব?

পর মনে না করলে এত বড় একটা কথা তুমি আমাকে না জানিয়ে কীকরে পারলে?

রাত্রি এতক্ষণে বুঝতে পারল কুহেলি কেন একথা বলছে, ঠোঁটের বলপূর্বক ধরে রাখা হাসিটা আপনা থেকেই মিলিয়ে এল। ধীর গলায় বলল,

তুমি কীকরে জানলে?

সেটা গুরুত্বপুর্ন নয়, তুমি আমাকে বা আলেখকে কাউকেই একবার জানালে না রাত্রি?

কুহেলি আমি শুধু শুধু তোমাদের টেনশন দিতে চাইছিলাম না।

টেনশন? আচ্ছা আজ যদি তোমার জায়গায় আমার বা আলেখের কিছু হত, কোনও সমস্যা হত আর আমরা তোমাকে না জানাতাম তাহলেও কি তুমি একই কথা বলতে?

কুহেলি….

প্লিজ রাত্রি, আমি ভাবতে পারিনি তুমি আমাকে এতোটা পর ভাবো।

কুহেলি তুমি ভুল বুঝছ, আমি তোমাদের নিজের ফ্যামিলি মেম্বার হিসাবেই ট্রিট করি। আর তুমিও এটা খুব ভালো করেই জানো, এখানে তোমরা ছাড়া আমার কে আছে বলতো?

তাহলে কেন জানাওনি?

কুহেলি অ্যাম সরি, আমি সত্যিই ভাবছিলাম তোমরা অকারণে চিন্তা করবে তাই…. আমি মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ, রাগ করো না।

কুহেলি একটু হেসে বলল,

বেশ, করব না রাগ। কিন্তু তার জন্য তোমাকে আগে হাসতে হবে, এরকম দুঃখের অভিব্যক্তি তোমাকে মানায় না। নিজের কি চেহারা করেছ একবার দেখেছ?

রাত্রি একটু ম্লান হেসে বলল,

সবই তো জানো নিশ্চয়ই, তুমিই বলো, এত সহজে কি স্বাভাবিক হওয়া যায়?

যায়, নিশ্চয়ই যায়। অন্য কেউ না পারলেও তুমি পারবে, পারতেই হবে, এইভাবেই ভেঙে পড়া তোমাকে মানায় না রাত্রি। এইরকম মন খারাপ করে বসে থাকার জন্য তুমি নও, সেই উচ্ছ্বল ঝর্নার মত আনন্দে মেতে থাকার জন্যই তুমি। তোমার চোখে আনন্দের উজ্জ্বলতা ভালো লাগে, দুঃখের মলিন ছায়া না।

রাত্রি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটু হেসে বলল,

তুমি এসেই আমার সাথে ইচ্ছে করে ওভাবে কথা বললে তাই না?

হঠাৎ এমন একটা কথায় কুহেলি চমকে গেল,

মানে!

মানে, তুমি ভালো করেই জানো আমি তোমাকে বা আলুকে পর মনে করা দুর, সেটা ভাবতেই পারি না। কিন্তু তাও তুমি ইচ্ছে করেই কথা গুলো বলেছ তাই না?

কুহেলি এবার একটু হাসল, সত্যিই সে ইচ্ছে করেই ওভাবে কথা গুলো বলেছিল। রাত্রি যে ওদের কতটা আপন মনে করে সেটা আলাদা করে ভাষায় প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়ে না। সে ইচ্ছে করেই অমনটা করেছিল যাতে রাত্রির মনটা অন্যদিকে আকৃষ্ট হয়, রাত্রি যে সেটা এত তাড়াতাড়ি বুঝে যাবে সেটা হয়তো আন্দাজ করতে পারেনি।

তুমি এত তাড়াতাড়ি বুঝে ফেললে?

রাত্রি ধীরে ধীরে ওর পুরনো ছন্দে ফিরছে, কুহেলির পদ্ধতি কিছুটা হলেও কার্যকর হয়েছে। মিষ্টি একটা হাসি ঠোঁটের কোনায় এনে রাত্রি বলল,

আমাকে কি এতটাই অবুঝ মনে হয় নাকি! আমি জানি তুমি আমার মনটা অন্যদিকে ডাইভার্ট করার জন্যই ওরকম করে বলেছ। কারোর সহানুভূতি বা করুণার আমার কোনও প্রয়োজন নেই সেটাও তুমি খুব ভালো করেই জানতে তাই এই অভিনব পদ্ধতিতে আমার মনটা ভালো করার চেষ্টা করছিলে, কি তাই তো?

একদম তাই, আর আমার প্রচেষ্টা যে একেবারে বিফলে যায়নি, সেটা তোমার এই মিষ্টি হাসিটা দেখেই বুঝতে পারছি।

দুজনেই এক সঙ্গে হেসে উঠল, ওই ঘটনার পর থেকে রাত্রি এই প্রথম একটু প্রাণ খুলে হাসল। কুহেলি কিছুক্ষণ পর একটু থেমে বলল,

তবে রাত্রি সিরিয়াসলি, তুমি কিন্তু প্লিজ একদম মন খারাপ করবে না এটা নিয়ে। একটা দুর্ঘটনা ঘটার ছিল ঘটে গেছে ব্যাস, ভুলে যাও। যত বেশি ভাববে, তত বেশি কষ্ট পাবে, আর তাছাড়াও মিস্টার আগরওয়াল তো সবটা সামলে নিয়েছেন। তাই চিন্তার তো কোনও কারণই নেই, তাই না?

রাত্রি নিশীথের নাম শুনেই চমকে উঠল,

তোমাকে মিস্টার আগরওয়াল জানিয়েছেন?

হুম, উনি আমাকে ফোন করে সবটা বললেন। জানো তো রাত্রি, ওনার গলায় তোমার জন্য স্পষ্ট উদ্বেগ ছিল। খুব চিন্তা করছিলেন তোমাকে নিয়ে, আর তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য পরোক্ষ ভাবে নিজেকে দায়ী মনে করে আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছেন।

রাত্রি কিছু বলল না, নিশীথ ওর জন্য এতটা চিন্তা করছে! এটা কি সত্যি নাকি….

ভাবনাটা আবারও অসম্পূর্ণই থেকে গেল, কুহেলি আবার বলতে শুরু করেছে,

জানো রাত্রি, আমি মিস্টার আগরওয়ালকে যতটা চিনি তাতে করে আমার মনে হয় না উনি আজ পর্যন্ত কারোর জন্য এতোটা কনসার্ন দেখিয়েছেন। উনি অকারনেই গিলটি ফিল করছেন, আমি বলেছি ওনাকে শুধু শুধু নিজেকে দোষ না দিতে। আমার মনে হয় রাত্রি তুমিও কালকে একবার ওনার সাথে কথা বলে নিও।

রাত্রি কিছু না বলে শুধু ছোট্ট করে মাথা নাড়ল, ওর মনে এখন অনেক প্রশ্নের আনাগোনা চলছে। যাদের উত্তর কিছুটা জানা কিছুটা অজানা, আর এই জানা অজানার ভিড়ে যেন সব কিছু কেমন ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে। কুহেলি রাত্রির একটা কাধে হাত দিয়ে বলল,

কি হল? আবার কি ভাবছ?

রাত্রি ওর ভাবনা গুলোকে একটু দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে বলল,

কিছু না।

হুম, আচ্ছা শোনো আমি কিন্তু আজকে তোমাকে জ্বালাতে এসেছি।

মানে?

মানে তোমার এই সুন্দর বিছানায় ভাগ বসাবো, আজ এখানেই তোমার সাথে থাকব।

রাত্রি ব্যস্ত হয়ে বলল,

কুহেলি, আমি জানি তুমি কেন এটা করছ। ট্রাস্ট মি কুহেলি, আমি একদম ঠিক আছি, তোমার এখানে থাকার কোনও প্রয়োজন নেই।

তাড়িয়ে দিচ্ছ?

আমি তাই বললাম?

তাই তো বলছ।

কুহেলি…..

ঠিক আছে তুমি না চাইলে থাকব না, আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।

কুহেলি একটু কপট রাগ দেখিয়ে ঠোঁট টা ফুলিয়ে উঠে চলে যাচ্ছিল। রাত্রি ওর হাত টা ধরে আবার বসিয়ে দিয়ে বলল,

থাক, অনেক ড্রামা হয়েছে, থাকো আজকে আমার সঙ্গে আই ডোন্ট হ্যাভ এনি প্রবলেম। বাট তোমার হাবি না ওদিকে বিরহে কাতর হয়ে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করেন। যেভাবে তোমাকে চোখে হারায়, দেখা গেল মাঝরাতে এসে হামলা করল।

কুহেলি রাত্রিকে আবার আগের মত দেখে খুব খুশি হল, কিন্তু ওর কথা গুলো শুনে একটু যেন লজ্জাও পেল। আর সেটা লক্ষ্য করে রাত্রি একটু মুচকি হেসে বলল,

উফ্, কি লজ্জা! দেখো আমি কিন্তু এখনও বলছি পরে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবে না।

কুহেলি রাত্রিকে আলতো করে একটা চাটি মেরে বলল,

সে তুমি যতই চেষ্টা করো আজকে আমি এখন থেকে নড়ছি না।

বেশ, অ্যাস ইউ উইশ।

দুজনেই বেশ হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠল, রাত্রির মন থেকে একসময় ধীরে ধীরে মন খারাপের শেষ কনাটুকুও মিলিয়ে এল। একবার রাত্রি একটু উঠে নীচে গেল ডিনারে কি হবে সেটা বলতে আর সেই ফাঁকে কুহেলি আলেখ আর নিশীথ দুজনকেই একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠিয়ে দিল।

“শি ইজ ফাইন নাও।“

এই ছোট্ট একটা মেসেজ যেন নিশীথের অশান্ত মন টাকে নিমেষে শান্ত করে দিল। কারণ…. সেটা তো অজানা।

ক্রমশ_________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগল আজকের পর্বটা জানাতে ভুলে যাবেন না কিন্তু। অপেক্ষা করে থাকব। আজ তবে আসি দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here