সংগোপনে’ পর্ব-৫২

0
1171

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৫২
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

রাত প্রায় নটা হবে, আলেখ আর কুহেলি বসে আছে ওদের সুন্দর সাজানো ছাদে। না, আজ চেয়ারে নয়, দুজনেই আজ বসেছে খোলা ছাদের আঙিনায়। দুজনেই বসেছে বটে কিন্তু বসে আছে শুধু কুহেলি আর আলেখ কুহেলির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কুহেলি আনমনে আলেখের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আলেখ চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে আছে। দুজনের ঠোঁটেই লেগে আছে এক চিলতে হাসি, সামান্য সেই হাসির রেখা টুকুই যেন যথেষ্ট এটা বোঝানোর জন্য যে ওদের মনে এখন শুধুই পরম প্রাপ্তির আবেশ বিরাজ করছে। কুহেলির আঙ্গুল গুলো আনমনেই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে আলেখের চুলের আনাচে কানাচে আর কুহেলি চেয়ে আছে আকাশের দিকে। আজ অবশ্য পূর্ণিমা নয়, চাঁদ টা এখনও তার অর্ধাকৃতি তেও পৌঁছায় নি। তবে তাতে জোৎস্নার আলোয় খুব একটা ঘাটতি হয়নি। চারপাশটা একটা নরম হলদে আলোয় ভরে আছে, সাজানো বাগানের ফুলের সুবাসে বাতাসের প্রতিটা কণা যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জানুয়ারী মাসের ঠান্ডা একেবারে ফেলনা নয়, তবে এখন আর আগের মত জাকিয়ে শীত পড়ে না কিন্তু তবু্ও একেবারে তাচ্ছিল্য করার মত কিন্তু একদমই নয়। আলেখ বারণ করেছিল কিন্তু কুহেলির ভারী শখ হয়েছে এখন একটু দুজনে মিলে ছাদে বসে জোৎস্না বিলাস করবে। আলেখ কি আর কুহেলির কোনও ইচ্ছে অপূর্ণ রাখতে পারে! তাই দুজনেই গায়ে বেশ মোটা সোটা গরম পোশাক চাপিয়ে আর একটা ব্ল্যানকেট নিয়ে হাজির হয়েছিল ছাদে। ব্ল্যানকেট টা দিয়ে নিজেদের আবৃত করে বেশ জমিয়ে বসেছিল দুজনে আর তার কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য আলেখ কুহেলির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিল। বাইরের শীতল হাওয়ার স্পর্শের সাথে ভালোবাসার মানুষের উষ্ণ ছোয়া মিলেমিশে যেন অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। বেশ লাগছিল ওদের একে অপরের এই নিস্তব্ধ সঙ্গ, অনেকক্ষণ তারা এইভাবেই উপভোগ করছিল এই মনোরম মুহূর্তটা। একসময় আলেখ বলল,

কুহেলি।

কুহেলি আকাশের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল,

হুম।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

এবার কুহেলি আকাশের নক্ষত্র খচিত দৃশ্যপট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,

হঠাৎ পারমিশন নিচ্ছ কেন? আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য বুঝি তোমাকে পারমিশন নিতে হয়?

সেটা না, তাও ভাবলাম জিজ্ঞেস করার আগে একবার পারমিশন নিতে ক্ষতি কি।

আচ্ছা বেশ, এখন বলো কি বলবে?

তুমি খুব কষ্ট পেয়েছিলে তাই না?

তুমি আবার ওই কথা নিয়ে পড়লে? আমি বললাম তো, যা হওয়ার সেটা তো হয়ে গেছে আবার সেটা নিয়ে কেন কথা বলছ?

বলো না, আমার কথা গুলোয় খুব কষ্ট পেয়েছিলে তাই না?

কুহেলি একটু চুপ করে থেকে বলল,

হুম, খারাপ লেগেছিল, কষ্টও হয়েছিল খুব। আসলে তুমি যে কখনও এমন কিছু বলতে পারো সেটা আমার ধারনাতেই ছিল না। কিন্তু আমি জানি তুমি একটা কথাও মন থেকে বলোনি। আমাকে যে এত বেশি ভালোবাসো, সেই ভালোবাসা থেকে জন্ম নেওয়া ঈর্ষার বশেই বলেছিলে।

আলেখ হঠাৎ পাশ ফিরে কুহেলির কোমর জড়িয়ে ধরে ওর পেটে মুখ ডুবিয়ে দিল। কুহেলি একটু চমকে উঠলেও কিছু বলল না, কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। কুহেলি বুঝল আলেখ এখনও অনুতপ্ত, ওর অনিচ্ছাকৃত ব্যবহারের জন্য যতটা কষ্ট কুহেলি পেয়েছে তার থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছে আলেখ। কিছুক্ষণ ঐভাবেই থাকার পর আলেখ বলল,

এতোটা বোঝো তুমি আমাকে? এতটা জানো?

কেন? শুধু তুমিই বুঝি আমাকে আমার থেকেও বেশি বোঝো? আমি কি তোমার মনটা বুঝি না?

তাহলে অত রাগ করলে কেন?

আচ্ছা? আমার রাগ করাটা কি স্বাভাবিক ছিল না? তুমি নিজেই বল তো?

হুম, কিন্তু কথা কেন বলছিলে না? তুমি জানো তুমি যখন আমার সঙ্গে কথা বলছিলে না আমার কতটা কষ্ট হচ্ছিল? মনে হচ্ছিল আমার বুকের মধ্যে থেকে কেউ যেন আমার হার্ট টা ছিড়ে নিয়েছে।

কি করব? আমি সত্যিই খুব রাগ করেছিলাম, কিন্তু তুমিও তো তেমনই আমি বললাম কথা বলতে না আর অমনি তুমিও বাধ্য ছেলের মত চলে গেলে।

সত্যি আমার জন্য আজকে তুমি খুব কষ্ট পেয়েছ, সরি কুহেলি আমি……

আলেখের কথা সম্পূর্ণ হল না, কুহেলি তার আগেই বলে উঠল,

আমি জানি আলেখ তুমি আমাকে জেনে বুঝে ইচ্ছে করে কখনোই কষ্ট দিতে পারো না। এতবার সরি বলো না, আমার ভালোলাগে না, আমি তো বললাম আমার খারাপ লেগেছিল, কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু এখন তো তার কিছুই নেই, সবটাই অতীত, আমি ওই কথা গুলো মনেও করতে চাই না। আমি এখন খুশি হতে চাই, খুব খুশি হতে চাই কারণ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি আমায় দিয়েছ।

কথা গুলো বলতে বলতে কুহেলির মুখে একটা অনাবিল আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। আলেখ আলতো করে কুহেলির পেটে একটা ভালোবাসার পরশ ছুঁইয়ে বলল,

একটু ভুল বললে, উপহার টা আমি তোমায় দিইনি তুমি আমায় দিয়েছ। আর উপহারটা সেইদিন সম্পূর্ণ হবে যেদিন আমি আমার প্রিন্সেস কে নিজের হাতে নিয়ে আদর করব।

কুহেলি আলেখের চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল,

আচ্ছা, সেই তখন থেকে দেখছি তুমি প্রিন্সেস প্রিন্সেস করে যাচ্ছ, প্রিন্সও তো হতে পারে।

উহু, প্রিন্সেসই আসবে।

তুমি কিভাবে এত শিওর হয়ে বলছ বলতো?

জানিনা, কিন্তু তুমি দেখো তোমার কোল আলো করে আমাদের লিটল প্রিন্সেস আসবে একদম তোমার মত।

কুহেলির গালের লালচে আভাটা এবার আর আলেখের দৃষ্টিগোচর হল না, কারণ সে তো তখনও কুহেলির পেটে মুখ ডুবিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করছে তার ছোট্ট প্রিন্সেস কে। আরও কিছুক্ষণ এভাবেই কাটানোর পর কুহেলি বলল,

আলেখ একটা কথা খেয়াল করেছ?

আলেখ তেমনই কুহেলির কোমর জড়িয়ে রেখেই বলল,

কি?

আমাদের লাইফ প্ল্যান টা, মানে যেটা আমরা সেই শুরু থেকে প্ল্যান করে রেখেছিলাম কিভাবে আমূল বদলে গেল।

আলেখ এবার উঠে বসল, একটা হাতে কুহেলিকে নিজের বুকের মাঝে টেনে নিয়ে বলল,

হুম, এখন ভাবলেও খুব অদ্ভুত লাগে। জাস্ট ইম্যাজিন, কোথায় আমরা একটা সিলি শর্তের বেসিসে এই সম্পর্কটায় আবদ্ধ হয়েছিলাম আর এখন দেখো।

হুম, সেটাই তো বলছি। দুজনেরই আলাদা আলাদা রিজন ছিল নিজেদের লাইফে ভালোবাসার আগমনে বাধা দেওয়ার। বাট আমরা ভুলে গিয়েছিলাম জানো তো, যে লাইফ টা আমাদের মত করে চলে না আমরা লাইফের মত করে চলি। কখন কিভাবে তোমাকে এতোটা ভালোবেসে ফেললাম নিজেও বুঝতে পারিনি, আর আজ আমার ভালোবাসা সম্পূর্ণ হওয়ার দিকে আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়েছে। যার কল্পনা আমি কোনদিনও স্বপ্নেও করতে পারতাম না, আজ সেটাই ঘটছে আর সবথেকে অদ্ভুত আমি তাতে ভিষন খুশি।

শুধু তুমিই খুশি? আমিও ভিষন খুশি, সিরিয়াসলি যখন বিয়ে করি তখনও ভাবিনি লাইফটা এইভাবে চেঞ্জ হয়ে যাবে। সব হিসেব সব প্ল্যানিং এইভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে আর আমি তাতে এতোটা বেশি হ্যাপি হব। রিয়েলি কুহু দিস ইজ অ্যামেজিং, সবাই ঠিকই বলে লাইফ ইজ সো আনপ্রেডিক্টেবল।

কুহেলি এরপরেও আরও কিছুক্ষণ ছাদে কাটাতে চাইছিল কিন্তু আলেখ আর রাজি হলো না। কুহেলি একটু অনুনয়ের সুরে বলার চেষ্টা করল,

আরেকটু বসি না, প্লিজ।

একদম না, আমি তো আসতেই চাইছিলাম না তুমি এত করে বললে তাই এলাম। অনেকক্ষণ থেকেছ আর না, রাত বাড়ছে তার সঙ্গে ঠান্ডাও বাড়ছে। কাম অন গেট আপ কুহেলি, নীচে চলো।

কুহেলি আর কিছু না বলে উঠে পড়ল, আলেখ ব্ল্যানকেট টা গুছিয়ে নিতে গেলে কুহেলি বলল,

আরে দাও ওটা আমাকে আমি করছি।

না, আমি আছি তো আমি করব, তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না।

কেন? দাও না, আমি করে নিচ্ছি তো।

এটা কত হেভি দেখেছ, তুমি এখন একদম এই হেভি কোনও কিছুতে হাত দেবে না।

আলেখ তুমি এমন করছ যেন আমি অসুস্থ।

তার থেকেও বেশি, তুমি এখন একা নও আমাদের সুইট প্রিন্সেস আছে তোমার সাথে। সো, আমি যেটা বলছি সেটা কর, আপাতত এই সব কাজ কর্ম সব ভুলে যাও।

আলেখ ডোন্ট বি সিলি, ডক্টর কিন্তু আমাকে কাজ করতে পুরোপুরি বারন করেননি।

তাতে কি হলো? সাবধানে তো থাকতে বলেছেন নাকি। সো, এখন থেকে তোমার কোনও কাজ করতে হবে না।

কথা বলতে বলতে ওরা ইতিমধ্যেই ওদের ঘরে চলে এসেছে। কুহেলি এবার খাটে বসে একটু ব্যস্ত হয়ে বলল,

আলেখ, বাই এনি চান্স তুমি কি আমাকে এখন অফিসে যেতেও নিষেধ করবে?

অফকোর্স।

একদম না, আমি এতদিন অফিসে না গিয়ে থাকতে পারব না। এভাবে একটা মানুষ কাজ ছাড়া থাকতে পারে নাকি!

কাজ ছাড়া থাকতে তো বলিনি, তুমি তোমার সব কাজ গুলোই করবে কিন্তু বাড়িতে থেকে। অফিসে এখন তুমি যাবে না, বাড়িতে বসেই তোমার যা কাজ করে নিতে পারবে তুমি।

মোটেই না, বাড়িতে বসেই কাজ হলে কেউ আর অফিসে যেত না। আমি এখন অফিসে যাব, আরও কিছুদিন যাক তারপর না হয়…..

কুহেলির বাকি কথাটুকু কুহেলির মুখেই রয়ে গেল কারণ আলেখ তার আগেই বলে উঠেছে,

কুহেলি, এত কথা বলো না, কোনও লাভ নেই। আমি আমার ডিসিশন চেঞ্জ করব না, তুমি অফিসে যাবে না দ্যাটস ফাইনাল।

আলেখের গলার সুরে এমন কিছু ছিল যার ওপরে কুহেলি আর কিছু বলতে পারল না। সে জানে সবটাই আলেখ ওর আর ওদের বেবির কথা ভেবেই করছে কিন্তু তাও…. অমন কাজ পাগল মেয়েকে যদি এখন বলতে গেলে প্রায় কর্মহীন করে দেয় তাহলে একটু খারাপ লাগার কথা বটে। তবে আর কিছু করার নেই, আলেখ একবার যখন হুকুম জারি করে দিয়েছে তখন আর তার নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। কুহেলি ফোনটা হাতে নিয়ে রাত্রিকে ফোন করল, মেয়েটা সন্ধ্যে বেলায় একবার ফোন করেছিল কিন্তু কুহেলিরা তখনও বাইরে ছিল তাই ঠিকমত কথাও হয়নি। আর তারপরে বাড়ি ফিরে যে ফোন করবে সে সুযোগ আর হল কোথায়! মান অভিমানের পালা চুকিয়ে একটু প্রেমময় মুহূর্ত কাটিয়ে আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি। এখন একবার তাই ফোন করা, বেশিক্ষণ লাগল না দু তিনবার রিং হতেই রাত্রির উৎসাহিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

এতক্ষণে সময় হলো তোমার? আমি সেই কখন থেকে ওয়েট করছি।

সরি রাত্রি, আসলে ডক্টরের কাছ থেকে ফিরতেও একটু লেট হলো আর তারপর….

এতটুকু বলে কুহেলি থেমে গেল, চোখ দুটো আপনা থেকেই সোফায় বসা আলেখের দিকে চলে গেল। ধীরে ধীরে কুহেলির উজ্জ্বল মুখ খানায় লালের আভা ছড়াচ্ছে, আলেখও শুনেছে কথাটা সেও চোখ তুলে একবার তাকিয়ে একটু হেসে আবার নিজের কাজে মন দিল। ওদিকে রাত্রি তো কুহেলির এই হঠাৎ থেমে যাওয়ায় যা বোঝার বুঝে নিয়েছে, একটু হেসে টোন কাটার সুরে বলল,

তারপরে তোমার সুইট হাবি তোমার মান ভাঙাতে অ্যাটলিস্ট সাকসেসফুল হয়েছে অ্যান্ড আফটার দ্যাট তোমরা দুজনে মিলে রোম্যান্টিক মোমেন্টস স্পেন্ড করতে এতটাই বিজি হয়ে পড়েছিলে যে এই বেচারির কথা এক্কেবারে ভুলেই গিয়েছিলে। কি ঠিক বললাম তো?

কুহেলি যেমন লজ্জা পেল তেমন অবাক হল। কৌতূহল টা আটকে না রেখে কুহেলি বলেই ফেলল,

তুমি কীকরে জানলে?

আমাকে দেখে কি তোমার বোকা মনে হয়? আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম কিছু তো একটা হয়েছে বাট কি হয়েছে সেটা পরে আলুর কাছে শুনলাম।

কখন?

যখন তুমি আলুর সাথে কথা বলছিলে না তখন, বেচারা আমার কাছে এসেছিল।

হুম, বুঝলাম।

আরে ছাড়ো তো ওসব, এখন বলো ডক্টর কি বলল?

কুহেলি আর রাত্রি গল্পে এমন মশগুল হয়ে গেল যে সময়ের খেয়াল টুকুও রইল না। আলেখ অনেকক্ষণ থেকেই ভাবছে এই বুঝি এদের কথা শেষ হবে কিন্তু নাহ, এদের গল্প শেষ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই দেখে এবার বাধ্য হয়ে তাকে হস্তক্ষেপ করতেই হলো। উঠে গিয়ে কুহেলির হাত থেকে ফোন টা নিয়ে বলল,

এই রিতু, তুই কিরে! কখন থেকে বকবক করেই যাচ্ছিস, একবার ঘড়িটার দিকেও একটু তাকিয়ে দেখ।

তুই এত হিংসুটে কেন রে? না হয় তোর ওয়াইফের সাথে একটু কথা বলছি তাই বলে এইরকম করছিস? কুহেলি তো আমারও ফ্রেন্ড নাকি!

সেই, এখন তো বোঝাই যায় না বেস্ট ফ্রেন্ড টা কার কুহেলির না আমার?

জেলাস হুম?

এই ফালতু বকা বন্ধ কর, আমি রাখলাম। এখন না খেলে এরপর ডিনার টাইম পেরিয়ে যাবে।

ওকে, ফাইন বাট ফোনটা আরেকবার একটু কুহেলিকে দে।

কেন?

ওহ গড, ইয়ার তুই দিবি নাকি আমি এক্ষুনি তোদের রুমে গিয়ে হাজির হবো?

নে ধর, স্টুপিড গার্ল।

আলেখ কুহেলিকে ফোনটা ফিরিয়ে দিল, কুহেলি ফোনটা নিয়ে হেসে বলল,

বলো রাত্রি।

দেখলে তো, এখন তোমার সাথে বেশি কথা বলা যাবে না। তোমার হাবি টা একটা মোস্ট ইরিটেটিং পারসন।

তাই বুঝি?

অ্যাকচুয়ালি নো, হি ইজ এ ভেরি গুড পারসন। এমনিতেই তোমাকে এত ভালবাসে এত খেয়াল রাখে তোমার। আর এখন তো দেখবে তোমাকে কতটা প্যাম্পার করবে, একদম মাথায় করে রাখবে দেখো তুমি।

আই নো দ্যাট, অলরেডি শুরু হয়ে গেছে।

রিয়েলি? আই নিউ ইট। ওকে ফাইন, এখন রাখি বুঝলে না হলে তোমার হাবি এবার আমার রুমে এসে আমাকে পিটিয়ে যাবে। কালকে যাব তোমার কাছে, বাই গুডনাইট অ্যান্ড মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি টেক কেয়ার, ওকে?

ওকে বাবা।

গুড নাইট।

গুড নাইট।

ফোনটা রেখে কুহেলি আলেখের দিকে তাকাতেই আলেখ বলল,

অনেক কথা বলেছ এখন আর কোনও কথা নয় চুপ করে এখানে বসো আমি তোমার ডিনার টা নিয়ে আসছি।

কুহেলি প্রবল আপত্তি করে বলল,

একদম না, এটা কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে এবার।

কি বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে?

এই যে তুমি এখন আমার ডিনার টা পর্যন্ত রুমে নিয়ে আসতে চাইছ।

সো হোয়াট? ডক্টর তোমাকে কিন্তু সাবধানে থাকতে বলেছেন।

ওহ গড আলেখ, সাবধানে থাকার মানে এই নয় যে আমাকে এখন ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার সব এই রুমের মধ্যে বসেই করতে হবে।

তোমার এখন বেশি উপর নিচ করাটা ঠিক হবে না।

আলেখ প্লিজ, তুমি বলেছ এখন থেকে অফিসে যেতে না আমি মেনে নিয়েছি বাট এটা কিন্তু সত্যিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমি মারাত্মক অসুস্থ, আর আমার বেড থেকে নামাই বারন। তুমি দেখছি একদম সেই হিন্দী টি ভি শো গুলোর টিপিক্যাল হাসবেন্ড দের মত বিহেভ করছ।

বাট কুহেলি…

আলেখ আমার মাও একজন গাইনোকলোজিস্ট, আমি মায়ের কাছেই শুনেছি এই সময়টায় যেমন সাবধানে থাকতে হয় ঠিক তেমনি স্বাভাবিক কাজকর্ম গুলোও করতে হয়। মানে দৈনন্দিন দিনচর্যার যে কাজ গুলো সেগুলো করা উচিৎ না হলে এইভাবে পুরো শুয়ে বসে থাকলে সেটাও কিন্তু বেবীর পক্ষে ঠিক নয়।

আলেখ আর কিছু বলল না, সে নিজেও তো আসলে এই ব্যাপার গুলো প্রথম বার অনুভব করছে। শুধু একবার বলল,

বাট ডক্টর রাও যে তোমাকে সাবধানে থাকতে বললেন।

আলেখ, তোমাকে বললাম না, সাবধানে থাকা মানে কিন্তু এটা নয়। তোমার যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয় তাহলে এই নাও আমি মাকে কল করছি তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করে নাও।

কুহেলি নিজের ফোনটা তুলে চৈতালী দেবীর নাম্বার টা ডায়াল করতে যাবে তার আগেই আলেখ ফোনটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিল।

আরে কি করছ কি? আমি কি বললাম নাকি যে আমি অবিশ্বাস করছি?

তাহলে একই কথা বারবার কেন বলছ?

কুহেলি বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেছে কথা গুলো, আলেখ মুখটা একটু কালো করে বলল,

কুহেলি আমি তোমাদের নিয়ে কোনও রিস্ক নিতে চাইনা তাই আর কি….

কুহেলি আলেখের চুল গুলো একটু ঘেঁটে দিয়ে বলল,

তুমি না, মাঝে মাঝে খুব কিউট হয়ে যাও।

তাই? শুধু মাঝে মাঝে? সবসময় নয়?

হুম, মাঝে মাঝেই। সবসময় কিউট হলে ভাললাগত না।

আলেখ কুহেলির কোমরে হাত দিয়ে নিজের কাছে এনে বলল,

আচ্ছা? তাহলে যখন আমি কিউট থাকি না তখন কেমন থাকি?

উম, এক এক সময় এক এক রকম।

যেমন?

যেমন, এই একটু আগেই কত কিউট লাগছিল আর এখন….

কুহেলি কথাটা শেষ না করে চুপ করে গেল, গাল দুটো আবার লালচে হয়ে উঠেছে। আলেখ কুহেলির কানের কাছে মুখ এনে খুব নিচু স্বরে বলল,

আর এখন কি? বলো, কথাটা কমপ্লিট কর।

আমার খিদে পেয়েছে।

একটু পরে খাবে, আগে বলো।

এক্ষুনি তো রাত্রিকে বকে ঝকে ফোনটা রেখে দিলে, আমার ডিনারের টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে বলে। আর এখন দেরী হচ্ছে না বুঝি?

আলেখ কুহেলির মুখের ওপর এসে পড়া চুল গুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল,

তোমার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা আমার কাজ না।

কুহেলি হেসে নিজেকে আলেখের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। যেতে যেতে বলল,

আমার কিন্তু সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে, আমি নীচে গেলাম তুমি আসবে কি?

কুহেলি চলে গেলে আলেখও একটু হেসে এগিয়ে গেল নীচের দিকে। ডিনার পর্ব সেরে যখন ওরা আবার রুমে ফিরে এলো তখন দেখল কুহেলির ফোনটা যান্ত্রিক শব্দ করে বেজেই চলেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল চৈতালী দেবীর নাম টা ভেসে উঠেছে স্ক্রীনে। কুহেলি ফোন টা রিসিভ করে বেশ গুছিয়ে বসল সোফায়, আলেখ বুঝল এই কথোপকথন টাও সহজে শেষ হওয়ার নয়। তাই কি আর করে বেচারা, অগত্যা সেও কুহেলির পাশেই বসে পড়ল। তবে আলেখের ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে চৈতালী দেবী খুব সংক্ষেপে কুহেলির খবর নিয়ে ফোনালাপ শেষ করলেন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে আবার আলেখের সঙ্গেও একটু কথা বলেছেন। কথোপকথন শেষ হলে কুহেলি উঠে ওর শুতে যাওয়ার আগের দৈনন্দিন কিছু কাজ সারতে লাগল আর আলেখ ততক্ষণে সোফায় শোয়ার তোড়জোড় করতে লাগল। কুহেলি তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে লোশন লাগাচ্ছিল, আয়নায় হঠাৎ আলেখের কার্য কলাপ দেখে কুহেলি অবাক হয়ে উঠে এসে বলল,

একি! এসব কি করছ?

কুহেলি, আমি ভাবছিলাম আজকে থেকে আমি সোফায় শোব।

মানে? কেন?

না, মানে তুমি একা একটু রিল্যাক্স করে শুতে পারবে।

হোয়াট ননসেন্স আলেখ? কি বলতে চাইছ একটু ক্লিয়ার করে বলবে?

আলেখ একটু আমতা আমতা করে বলল,

আসলে, যদি ঘুমের মধ্যে তোমার লেগে যায়। মানে দেখ, হয়তো অজান্তেই একটু লেগে গেল তখন কি হবে? তাই আমি ভাবছিলাম…..

কুহেলি এবার সত্যিই রেগে গেল, একটু জোরেই বলল,

তুমি এই অদ্ভুত আইডিয়া গুলো কোথায় পাচ্ছ বলতো? আমি তখন ঠিকই বলেছিলাম, তুমি একদম ওই হিন্দী ডেইলি সোপ গুলোর টিপিক্যাল হাসবেন্ড গুলোর মত বিহেভ করছ। প্লিজ আলেখ এই সব উল্টোপাল্টা চিন্তা গুলো মাথা থেকে বের করো তো। এগুলো ওই ইডিওটিক শো গুলোতেই ভালো লাগে, রিয়েল লাইফে নয়।

আলেখ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু কুহেলি বলতে দিলে তবে তো। আলেখ মুখ খোলার আগেই কুহেলি বলে উঠল,

স্টপ ইট, একটাও কথা বলবে না তুমি। চুপচাপ চলো তো, এতদিন যেমন ছিল এখনও তেমনই থাকবে।

বলে কুহেলি সোফা থেকে বালিশ আর ব্ল্যানকেট টা নিয়ে সোজা খাটের দিকে চলে গেল। আলেখও আর কিছু না বলে চুপচাপ খাটে উঠে পড়ল। কুহেলি আর কথা না বলে শুয়ে পড়ল, সে যে রেগে আছে এটা আলাদা করে বলে দেওয়ার আর প্রয়োজন পড়ে না। আলেখের দিকে পিঠ করে শুয়েছিল কুহেলি, সে ভেবেই পাচ্ছে না হঠাৎ আলেখ এই অদ্ভুত ছেলেমানুষী গুলো করছে কেন। আলেখ নিজেও এবার শুয়ে পড়ল, কুহেলির একটা কাধে হাত রেখে ডাকল,

কুহেলি।

কুহেলি কোনও সাড়া দিল না, আলেখ আবার বলল,

কুহেলি সরি, কুহেলি।

কুহেলি তাও কোনও কথা বলছে না দেখে আলেখ এবার বলল,

কুহু, তুমি আবার আমার সঙ্গে কথা বলছ না? তুমি জানো তুমি কথা না বললে…..

আলেখের কথাটা কুহেলি সম্পূর্ণ করল, আস্তে করে আলেখের দিকে ফিরতে ফিরতে বলল,

তুমি কষ্ট পাও। জানি আমি, কিন্তু তুমি এত অদ্ভুত কথা বললে আমিও বা কি করব বলো তো? তুমি ভাবলে কীকরে বলো তো তোমার জন্য আমার বা আমাদের বেবীর কোনও ক্ষতি হতে পারে?

জ্ঞানত যে সেটা পসিবল না সেটা আমিও জানি আর তুমিও জানো কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার পর আমার অজান্তেই যদি…..

এবারও আলেখের কথা শেষ হওয়ার আগেই কুহেলি বলে উঠল,

তোমার অজান্তেও যে এটা কখনই সম্ভব না আমি জানি।

আলেখ যেন নতুন করে আবার কুহেলির প্রেমে পড়ছে, কুহেলি তাকে ভালোবাসে তার সবটুকু বোঝে এগুলো সেও জানে কিন্তু আজ কুহেলির বিশ্বাস দেখে ওর খুব অবাক লাগছে। ওর নিজের উপরে যতটা না বিশ্বাস আছে তার থেকেও আরও অনেক বেশি বিশ্বাস কুহেলির আছে তার উপর। আলেখ একটু মৃদু হেসে কুহেলির কপালে নিজের ভালোবাসার চিহ্ন একে দিয়ে বলল,

আই লাভ ইউ কুহু।

কুহেলি একটু অবাক হয়ে বলল,

হঠাৎ?

এমনি, আমার ওয়াইফ কে আমি যখন ইচ্ছে তখন আই লাভ ইউ বলতে পারি, তোমার কি প্রবলেম?

কুহেলি হেসে বলল,

কোনও প্রবলেম নেই।

আলেখ কুহেলিকে বুকের মাঝে টেনে নিল, অবশ্যই সাবধানে। আর এই সাবধানতা দেখে কুহেলি মনে মনে খুশি হল, আলতো হাসি ছুয়ে গেল ওর ঠোঁট জুড়ে। দুজনে কিছুক্ষন সেইভাবেই রইল, একে অপরের উষ্ণ ভালোবাসার চাদর গায়ে জড়িয়ে। একসময় আলেখ কুহেলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

আচ্ছা কুহেলি, তুমি আজকে দু বার বললে যে আমি স্টুপিডের মত বিহেভ করেছি। একদম ওই হিন্দী শো গুলোর টিপিক্যাল হাসবেন্ড গুলোর মত।

হুম বলেছি তো, আর একদম ঠিক বলেছি। ওগুলো ঐসব শোগুলোতেই মানায়।

হুম, বুঝলাম। কিন্তু আমার মনে না একটা প্রশ্ন জাগছে।

কুহেলি আলেখের বুকে মাথা রেখে পরম আবেশে চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে ছিল। আলেখের কথা শুনে মুখটা একটু তুলে বলল,

কি?

তেমন কিছু না, এই যে তুমি হিন্দী শো গুলোর ব্যাপারে এত কিছু জান কীকরে? না মানে, আমি তো অন্তত তোমাকে কখনও কাজের বাইরে অন্য কিছু করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তাহলে এগুলো জানলে কীকরে?

ভেরি সিম্পল, আমার ফ্রেন্ড সার্কেল আর আমাদের মান্তু দি। ওদের দৌলতেই টিভি না দেখেই আমার মোটামুটি সব জানা হয়ে গেছে।

কিরকম?

আরে, সেই স্কুল থেকে শুরু, কলেজ লাইফটাও বাদ যায়নি। মেয়ে গুলো সুযোগ পেলেই শুধু সিরিয়ালের গল্প। কোন হিরো কত হ্যান্ডসাম, কোন হিরো টা পারফেক্ট হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল… উফ্, কান ঝালাপালা হয়ে যেত।

তাই বলো, আমিও তাই ভাবি তুমি আর টিভি শো… ঠিক ম্যাচ করছিল না। তোমার সাথে ওয়ার্ক টাই ম্যাচ করে, একদম পারফেক্ট।

ওহ হ্যালো, আমি শুধু কাজই করি না, আরও অনেক কিছু করি।

আমি তো দেখিনি।

আরে এখানে আর সেভাবে দেখবে কীকরে? ফ্রেন্ড সার্কেল টাই তো, ভেঙে গেল। সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিকে ওদিক চলে গেছে, এখন তো ঐ হোয়াটসঅ্যাপেই যা যোগাযোগ আছে। বাট যখন স্কুল বা কলেজে ছিলাম না, পড়াশোনার পাশাপাশি এনজয় টাও কম করিনি। এভরি উইকেন্ডে আমাদের কোনও না কোনও প্ল্যান থাকতই।

বাহ্, এটা তো জানা ছিল না।

এখন জেনেছ তো? প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে গেছ। এখন চুপচাপ ঘুমিয়ে পড় তো, আমার ভীষন ঘুম পাচ্ছে, আর বেবিরও।

আরে দাড়াও, এত ব্যস্ত কেন? তোমার মনে হচ্ছে না তুমি কিছু একটা ভুলে যাচ্ছ?

কুহেলি ভালই বুঝতে পারছে আলেখ কি বলছে, কিন্তু না বোঝার ভান করে বলল,

কই? না তো।

তাই তো? কিছু ভুলছ না?

উহু, এবার ঘুমাও।

আলেখ একটা হাত কুহেলির পেটের ওপর রেখে হালকা করে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

দেখেছ প্রিন্সেস, তোমার মাম্মা এখন থেকেই আমাকে ইগনোর করছে। এরপর যখন তুমি আসবে তখন তো আর আমাকে পাত্তাই দেবে না।

কুহেলি আলেখের নাকটা একটু টিপে দিয়ে হেসে বলল,

বেশ করেছি, এখন থেকেই হিংসে করছ?

উহু, এটা হিংসা নয়, আমার সবকিছুই তো আমার প্রিন্সেসের জন্য, বাট একটা জিনিষ বাদে।

কি?

আলেখ কিছু না বলে কুহেলির ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের ভাজে মিশিয়ে নিল। স্বল্পক্ষণ পর কুহেলির ঠোঁট দুটো মুক্ত করে বলল,

এটা… এটা শুধুই আমার। আর আমার পাওনা আমাকে না দিলে আমি নিজে আদায় করে নিতে জানি। সো মিসেস কুহেলি আলেখ শর্মা, আমি আগেই বলছি আমার এই ডেইলি রুটিন টা কিন্তু কোনোমতেই চেঞ্জ হবে না।

কুহেলি কিছু না বলে মুখ লুকালো ওর সব থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে। কখন যে ভালোবাসার চাদরে ঘুমের পরশ ছুয়ে গেছে সেটা ওরাও হয়তো জানে না। পরদিন সকালে কুহেলি ঠিক নির্দিষ্ট সময়েই উঠে পড়ল, আসলে এতদিনের অভ্যাস বলে কথা না চাইতেও ঘুমটা এমনিই ভেঙে যায়। চোখ মেলে একবার জানালার বাইরের খোলা আকাশের দিকে তাকাল কুহেলি, কি সুন্দর ঝলমলে পরিষ্কার আকাশ। মনটা এমনিই ভালো হয়ে যায়, একটু আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই খেয়াল হল পাশে আলেখ নেই। একটু অবাক হল কুহেলি, একদম প্রথম প্রথম আলেখ কুহেলির আগেই ঘুম থেকে উঠত কিন্তু সেটা পরিবর্তিত হয়েছে বেশ অনেক দিন হয়ে গেছে। এখন কুহেলিই আগে ওঠে, আজ ব্যতিক্রম দেখে একটু বিস্ময়ের ভাব আসা টা স্বাভাবিক। কুহেলি উঠে ফ্রেশ হয়ে একবার ছাদে আলেখের মিনি জিম টা ঘুরে এলো সেখানে নেই, এদিকে সব কটা জগিং স্যুট তাদের নিজস্ব স্থানেই আছে, তাহলে গেল কোথায়? কুহেলি কি ভেবে নীচে এলো, আশেপাশে কেউ নেই। হঠাৎ কিচেনের দিক থেকে কারোর কথা শুনতে পেয়ে সেদিকেই এগোল। আর গিয়ে যা দেখল সেটা দেখার কথা কুহেলি স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। আলেখ ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে! আর বৃন্দা সহ আরো কয়েকজন পরিচারিকা একটু পিছনে দাড়িয়ে আছে। বৃন্দা বারবার বলছে, কিছু করতে হবে না সব সে করে নেবে কিন্তু আলেখ সে কথা যেন শুনেও শুনছে না। হাসি মুখে এখন সে অমলেট বানানোয় ব্যস্ত, কুহেলি ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বলল,

একি! তুমি কিচেনে কেন?

আলেখ ব্রেকফাস্ট বানানোয় এতটাই মগ্ন ছিল যে কুহেলিকে লক্ষ্যই করেনি। এখন চোখ তুলে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

এসে গেছ? গুড মর্নিং, তুমি টেবিলে ওয়েট করো ব্রেকফাস্ট এক্ষুনি রেডি হয়ে যাবে।

তুমি কেন ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছ?

এমনি, ইচ্ছে হলো তাই।

কিন্তু….

এখন আমাকে ডিস্টার্ব না করে যাও তো, গিয়ে ওয়েট কর। কুহেলি কি বলবে খুঁজে না পেয়ে শেষে ডাইনিং টেবিলে এসে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারটায় বসে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই আলেখ নিজে একটা ট্রে তে ওদের দুজনের ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে নিয়ে এলো। যত্ন করে কুহেলির সামনে প্লেট টা রেখে নিজেও ওর পাশে বসে বলল,

নাও, শুরু কর।

কুহেলি তো এখনও অবাক হয়ে তাকিয়েই আছে, খাবে আর কি! আলেখ রান্না করেছে এটা ভাবতেই কেমন লাগছে। আলেখ যে রান্না করতে জানে এটাই তো জানা ছিল না। প্লেট টা কি সুন্দর করে সাজানো, এটা যে মোটেই কাচা হাতের কাজ নয় সেটা বলাই বাহুল্য। কুহেলি এখনও খাওয়া শুরু করেনি দেখে আলেখ বলল,

কি হল? খাচ্ছ না কেন? পছন্দ হয়নি?

কুহেলি হেসে বলল,

তুমি বানিয়েছ আর আমার পছন্দ হবে না?

তাহলে খাচ্ছ না কেন?

ভাবছিলাম তোমার এই গুন টা তো জানা ছিল না।

আরে প্রশংসা তো তখন করবে যখন তুমি এটা খাবে, আগে খেয়ে তো দেখ।

আমি না খেয়েই বলতে পারি এটা দারুন টেস্টি।

কীকরে?

জাস্ট লুক অ্যাট দিস, এত সুন্দর লাগছে দেখতে তাহলে সেটা খেতে তো ভালো হবেই। আর তাছাড়াও তুমি বানিয়েছ বলে কথা, ভালো তো হতেই হবে।

এবার একটু খাও, তারপরে না হয় তারিফ করো।

কুহেলি খাওয়া শুরু করল, প্রথম বার মুখে দিয়েই বুঝল সে ভুল কিছু বলেনি। এটা সত্যিই দারুন সুস্বাদু হয়েছে, আলেখের এই নতুন গুন টা বেশ ভালোলাগল কুহেলির। খুব তৃপ্তি করে পুরোটা খেয়ে বলল,

দারুন, তুমি এত ভালো কুক জানা ছিল না কিন্তু। কোথায় শিখলে এত ভালো রান্না?

যখন লন্ডনে ছিলাম তখন শিখেছিলাম, আমার এক ফ্রেন্ড ছিল জেসন, ওর হবি ছিল কুকিং। একটু সুযোগ পেলেই এটা সেটা এনে নানা রকম ডিশ বানানোর ট্রাই করত আর ওর সঙ্গে সঙ্গে আমিও। সেই থেকেই শেখা আর কি, নাথিং স্পেশ্যাল।

এতদিন বলোনি কেন?

আমার নিজেরই খেয়াল ছিল না, এত কাজ আর অন্যান্য সব কিছুতেই ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে ইচ্ছে হল আমার এই সুইট ওয়াইফ আর আমার লিটল প্রিন্সেসের জন্য ব্রেকফাস্ট বানানোর। ব্যাস আর কি, লেগে পড়লাম কাজে আর তারপরের ঘটনা তো জানোই।

কুহেলি চুপ করে শুনছিল সবটা, আলেখের প্রতিটা কথায় প্রতিটা শব্দে খুশির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আর সেই খুশির আভা যেন কুহেলির মন জুড়েও ছড়িয়ে পড়ছে, আপনমনেই যেন একবার বলে উঠল,

আমার জন্য এত সুখ রাখা ছিল! এত পরিপূর্ণ জীবনের কল্পনা যে আমি কোনদিনও করিনি। না চাইতেই এতোটা খুশি আমার ভাগ্যে লেখা ছিল!

আলেখ ব্রেকফাস্টের পর কুহেলিকে সাবধানে থাকার কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়ে আর নিজের পাওনা টা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অফিসের উদ্দেশ্যে। কুহেলিকে কিছু কাজ অবশ্য সে দিয়ে গিয়েছিল কিন্তু সে কাজ নিতান্তই নাম মাত্র। কুহেলির খুব বেশি সময় লাগল না সেগুলো শেষ করতে। কাজ গুলো সম্পূর্ণ করে আলেখকে মেল করে দিয়ে এবার আর কোনও কাজই রইল না। মাত্র সাড়ে দশটা বাজছে, কাজ পাগল মানুষ কতক্ষন আর চুপচাপ বসে থাকতে পারে, একবার নিজের মনেই ভাবল, রাত্রির আসার কথা ছিল এখনও এলো না তো। কিন্তু আবার ভাবল, হয়তো কোনও কাজ করছে আসবে কিছুক্ষণ পরে। কিন্তু এই এখন কি করবে! বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারল না কুহেলি, এই অভ্যেস টা ওর একেবারেই নেই। কি করবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল নভতেজ বাবুর স্টাডি রুম টার কথা। সেই যে একদিন নভতেজ বাবু নিজে নিয়ে গিয়েছিলেন তারপর আর যায়নি। এখন সেখানে যাওয়াটাই স্থির করল কুহেলি কারণ সেখানে ঠাসা আছে একগাদা বই। বই পড়তে কুহেলি ভালইবাসে, সময়ের অভাবে আর পড়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু এখন তো সময়ই সময় ওর কাছে, তাই সময়ের সদ্ব্যবহার করাটা একান্ত প্রয়োজনীয় মনে করেই কুহেলি এগিয়ে গেল স্টাডিরুমের দিকে। তখনও কুহেলি জানে না, কোন অজানা অশনির দিকে এগিয়ে চলেছে তার পদরেখা।

ক্রমশ_______________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না যেন… আমি প্রতিবারের মতো এবারও অপেক্ষা করে থাকব। কিসের দিকে এগোল কুহেলি? কি মনে হয় আপনাদের? জানাবেন কিন্তু… আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম। আজ তবে আসি দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here