#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৫৬
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
ভারতীয় সময় অনুযায়ী এখন মধ্য রাত হলেও লন্ডনের সময় অনুযায়ী এখন সবে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। হিথরো এয়ারপোর্টে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন আলেখের মনের ব্যাকুলতা শতগুণ বেড়ে গেল। করণজিত বাবু হ্যারো তে থাকেন, এখানকার ধনী ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে তিনিও একজন। দেশ ছেড়েছেন প্রায় তিরিশ বছর আগে, এখানকারই বাসিন্দা ভায়োলেট অ্যান্সলে কে বিয়ে করে পাকাপাকি এখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। উনি আলেখ আর কুহেলি কে নিজের বাড়িতেই থাকতে বলেছিলেন কিন্তু ওরা রাজি হয়নি। যতই তিনি নভতেজ বাবুর বন্ধু হোন, এভাবে তার বাড়িতে গিয়ে উঠতে ওদের ভালোলাগছিল না। আর তাছাড়াও ওদের ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া হত না কারণ নিশীথ ওদের হাজার নিষেধ উপেক্ষা করে ওদের নিয়ে চলেছে ওর এখানকার নিবাসস্থল ড্রীম নেস্টে। কুহেলি বারবার বলেছে ওদের হোটেল বুক করা আছে কিন্তু নিশীথের কান পর্যন্ত সে কথা পৌঁছায়নি। নিশীথের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছিল আগে থেকেই, এখন ওরা তিনজন সেই গাড়িতে বসে আছে। গাড়িটা সন্ধ্যের ব্যস্ত রাস্তার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলেছে নিজের গন্তব্যের দিকে। আলেখ গাড়িতে বসেই লন্ডনে পরিচিত প্রায় সবার সঙ্গেই যোগাযোগ করে ফেলল, কিছুটা পড়াশোনা করার সময় আর কিছুটা ব্যবসায়িক পরিচিতি মিলিয়ে সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়। গতকালের আলেখ আর আজকের আলেখের মধ্যে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য। ঠান্ডা মাথায় সবটা করছে, দেখলে কেউ বলতে পারবে না এই আলেখই কাল ঐভাবে ভেঙে পড়েছিল। তবে আর কেউ জানুক আর নাই জানুক কুহেলি জানে এটা শুধুই আলেখের বাহ্যিক একটা আবরণ মাত্র, তার অন্তরটা এখনও তেমনই রয়েছে। আগরওয়াল অ্যান্ড সন্স নামটা বর্তমানে লন্ডনে বেশ সুপরিচিত, আর তার সবটাই নিশীথের সুবাদেই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিশীথ ওদের পারিবারিক ব্যবসা টাকে একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। সেই সুবাদে এখানে নিশীথের প্রতিপত্তি কিছু কম নয়, গাড়িতে বসেই কাউকে একজনকে সব খোজ নেওয়ার নির্দেশ দিল। কুহেলি নিজেও একবার করণজিত বাবুকে ফোন করে কথা বলে নিল। নিশীথের ড্রীমনেস্ট ডাউন টাউন লন্ডনে, হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় আধ ঘণ্টার পথ। তবে আধ ঘণ্টার একটু আগেই পৌঁছাল ওরা, গাড়ি থেকে নেমে কুহেলির মনে হল ড্রীমনেস্ট নামটা সত্যিই সার্থক। অন্যসময় হলে হয়তো কুহেলি আরও ভালো করে বাড়িটার সৌন্দর্য্য উপভোগ করত কিন্তু এখন তার সেই মানসিক পরিস্থিতি নেই। ঠান্ডা টা বেশ ভালই পড়েছে, ফ্লাইট ল্যান্ড করার সময় ঘোষণায় শুনেছিল কুহেলি আজকে তাপমাত্রা সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস। নিশীথ ওদের গেস্ট রুমে পৌছে দিয়ে বলল,
ফিল ফ্রী কুহেলি, কোনরকম প্রবলেম হলে উইদাউট এনি হেজিটেশন আমাকে বলবেন। অ্যান্ড মিস্টার শর্মা, আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড, আপনার মনের অবস্থা এখন ঠিক কিরকম বাট ডোন্ট ওয়ারি এভরিথিং উইল বি ফাইন।
আলেখ সামান্য একটু হেসে বলল,
সব ঠিক হবে কিনা জানা নেই তবে চেষ্টা তো করতেই হবে। থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার আগরওয়াল, আপনি আমাদের জন্য অনেক কিছু করছেন।
থ্যাঙ্ক ইউ শোনার ইচ্ছে আমার নেই, আমি কোনোকিছু থ্যাঙ্কস ওয়ার্ড টা শোনার জন্য করি না। প্রয়োজনের সময় যদি পাশে নাই দাড়াতে পারলাম তাহলে আর শুধু শুধু ফ্রেন্ডশিপ করার তো কোনও মানে হয় না, তাই না? এনিওয়েজ, অনেকটা জার্নি হয়েছে, ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিন।
নিশীথ চলে যাওয়ার পর কুহেলি আর আলেখ ফ্রেশ হয়ে আবার নিজেদের কাজে লেগে পড়ল। আলেখ ওর পরিচিত এক প্রফেসর কে ফোন করার চেষ্টা করছিল, এমবিএ করার সময় আলেখ ওনার প্রিয় ছাত্র ছিল। কিন্তু লাইনটা কিছুতেই কানেক্ট হচ্ছিল না, আর কুহেলি আবার রাত্রিকে কল করার চেষ্টা করল। এবার কলটা কানেক্ট হল কিন্তু প্রথম দুবার ফুল রিং হওয়ার পরেও রাত্রি কলটা রিসিভ করল না। তৃতীয় বারের বার কুহেলি রি ডায়াল করার আগেই রাত্রির নামটা স্ক্রীনে ভেসে উঠল। কুহেলি কলটা রিসিভ করে কিছু বলার আগেই রাত্রি বলে উঠল,
সরি কুহেলি, আসলে শাওয়ার নিচ্ছিলাম তো তাই রিসিভ করতে পারিনি। সো, মিস করছিলে বুঝি আমাকে?
রাত্রি, উই নিড ইওর হেল্প।
কুহেলির কথায় বেদনার সুর শুনে রাত্রি ব্যস্ত হয়ে পড়ল,
হোয়াট হ্যপেন্ড কুহেলি? এভরিথিং ইজ ফাইন রাইট?
নাথিং ইজ ফাইন রাত্রি।
কুহেলি রাত্রিকে সবটা বলার পর রাত্রি বলল,
আমি ভাবতেই পারছি না আঙ্কেল…. নো ওয়ে, আঙ্কেলের এটা করা উচিৎ হয়নি। তুমি চিন্তা করো না কুহেলি, সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি দেখছি আমি কি করতে পারি। ইশ, ড্যাড মম দুজনেই আজকেই ভেগাস চলে গেল একটা বিজনেস ডিল করতে। আচ্ছা কুহেলি, আলেখ কেমন আছে? ও যা ছেলে, ওর তো… ও ঠিক আছে তো?
আমার চেয়ে অনেক বেশি সময় থেকে তুমি চেন ওকে, তোমাকে আলাদা করে বলার আর কিছু নেই, বুঝতেই পারছ, কেমন থাকতে পারে।
হুম, আই নো, আন্টির ডেথের পর ছেলেটা একদম ভেঙে পড়েছিল। আর এখন আবার….. ওর সাথেই এটা হওয়ার ছিল?
যে প্রশ্নের উত্তর হয় না, সেগুলো না করাই বোধহয় ভালো।
হুম, বাই দ্য ওয়ে তোমরা কোন হোটেলে আছ? আমি এক্ষুনি আসছি।
নো রাত্রি, আজকে আর তোমাকে আসতে হবে না, ইটস লেট অলরেডি।
কুহেলি এখন মাত্র এইট ফিফটি হয়েছে, লন্ডনে এখন সবে সন্ধ্যে। ডোন্ট ওয়ারি, আমার কোনও প্রবলেম হবে না তুমি শুধু তোমাদের হোটেলের অ্যাড্রেস টা দাও আর লাগেজ প্যাক করে রেডি থাক।
লাগেজ প্যাক করব কেন?
বিকজ তোমরা আমার সাথে আমার ফ্ল্যাটে থাকবে। আমি থাকতে তোমরা হোটেলে থাকবে এটা হতে পারে না। তুমি হোটেলের অ্যাড্রেস টা দাও তো।
রাত্রি, এত ব্যস্ত হতে হবে না আমরা হোটেলে নেই।
মানে! কোথায় আছ তাহলে?
মিস্টার আগরওয়ালের বাড়িতে।
নিশীথের বাড়িতে মানে?
কুহেলি এয়ারপোর্টে নিশীথের সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে সবটাই রাত্রিকে বলল। রাত্রি শুনে বলল,
বাহ্, এটা তো খুবই ভালো কথা। ওকে আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছি, বাকি কথা সামনা সামনি হবে।
রাত্রি তুমি সত্যি এত ব্যস্ত হয়ো না, এখন তোমার আসতে হবে না। তুমিও তো সারাদিনের কাজের পর টায়ার্ড তাই না, তুমি কালকে এসো।
কুহেলি, আমি এমন কিছু টায়ার্ড নই যে এরকম একটা খবর শুনেও আমি বাড়িতে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব। আর স্পেশ্যালি যখন তোমরা এতোটা কাছেই রয়েছ।
কাছে মানে?
মানে, নিশীথের বাড়ি থেকে আমার ফ্ল্যাট বড়োজোর দশ থেকে বারো মিনিটের রাস্তা।
ওহ, বাট স্টিল রাত্রি, আমি সত্যি বলছি তুমি কালকে এসো, নো প্রবলেম।
শিওর?
অফকোর্স।
ওকে ফাইন, আমি কালকে সকালে যাব আর আমি দেখছি কতটা কি করতে পারি?
হুম, গুড নাইট।
গুড নাইট অ্যান্ড বি স্ট্রং।
কুহেলি ফোন টা রেখে আলেখের দিকে তাকাল, এতক্ষণে বোধহয় সেই প্রফেসরের সাথে কনট্যাক্ট করতে পেরেছে, তার সঙ্গেই কথা বলছে হয়তো। রাত যত বাড়ছে ঠান্ডা টাও ততই বাড়ছে, ঘরের মধ্যে অবশ্য সেটা অনুভূত হচ্ছে না কারণ রুম হিটারের সুবাদে ঘর টা বেশ উষ্ণ হয়ে আছে। আলেখ কথা শেষ করে কুহেলির পাশে এসে বসল, কুহেলি একটা হাত দিয়ে আলেখের একটা হাত জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। এতগুলো মানুষের চেষ্টা কখনও বিফল হতে পারে না।
আলেখ কুহেলির হাত টা ছাড়িয়ে একহাতে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
তাই যেন হয় কুহেলি, আমি যাকে যাকে বলা সম্ভব সবাইকেই বলেছি সবাই চেষ্টা করছে। প্রফেসর গ্রিনের সাথেও কথা হল, ওনার এক নেফিউ মেডিকেল প্রফেশনের সঙ্গেই যুক্ত, আই হোপ আমরা খুব তাড়াতাড়ি ড্যাডের খোজ পাব।
নিশ্চয়ই পাব আলেখ।
রিতুর সাথে কথা হল?
হুম, এখনই আসতে চাইছিল। আমিই বারন করলাম, কালকে আসবে।
হুম। হঠাৎ করে এটা কি হল কুহেলি? এই ঝড় টা না এলে কি খুব ক্ষতি হত?
ভেঙে পড়লে চলবে না আলেখ, নিজেকে শক্ত কর।
ডিনারের সময় নিশীথ জানাল, সে ইতিমধ্যেই এখানকার একজন বড় ক্যান্সার স্পেশালিস্টের সঙ্গে কথা বলেছে। আলেখ এই ক্যান্সার শব্দ টাকে ভীষন ভয় পায়, এই রোগটা তার মাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল চিরতরে। আলেখ একটু কম্পিত গলায় বলল,
ক্যান্সার স্পেশালিস্ট কেন?
মিস্টার শর্মা আই নো, আপনারা সঠিক জানেন না ওনার কি হয়েছে কিন্তু মারণ ব্যাধি বলতে সাধারণত ক্যান্সার কেই বোঝায়। আমি জাস্ট একটা চান্স নিয়েছি, যদি উনি সত্যিই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে কালকের মধ্যেই আমরা খবর পেয়ে যাব।
কুহেলি বুঝতে পারছে আলেখের কতটা কষ্ট হচ্ছে, আবারও সেই ক্যান্সার… আলেখের চোখ দুটো লাল হয়ে এসেছে, কুহেলি বুঝতে পারছে সে অনেক কষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছে। ডিনারের শেষে নিশীথ হঠাৎ বলল,
কুহেলি আপনি ঘরে যান আমার মিস্টার শর্মার সাথে কিছু কথা আছে।
কুহেলি কোনও আপত্তি করল না, সে চলে যাওয়ার পর নিশীথ আলেখকে নিয়ে নিজের ঘরে এলো। আলেখকে সোফায় বসিয়ে দুটো বিয়ারের বোতল এনে নিজেও বসল। একটা বোতল আলেখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
আই নো মিস্টার শর্মা ইউ ডোন্ট লাইক মি দ্যাট মাচ।
হঠাৎ এরকম একটা কথা আলেখ আশা করেনি, নিশীথের দিকে তাকিয়ে দেখল ইতিমধ্যেই বিয়ারের কিছুটা অংশ বোতল থেকে স্থানান্তরিত হয়ে নিশীথের পেটে পৌঁছে গেছে। নিশীথ আবার বলতে শুরু করল,
কি ভাবছেন? আমি হঠাৎ এটা কেন বলছি? তাও আবার এরকম একটা সিচুয়েশনে। মিস্টার শর্মা, আমি অপ্রাসঙ্গিক কোনও কথা বলি না, আর প্রয়োজনের বাইরে তো নয়ই। এটা বলারও কারণ আছে, নিশ্চয়ই আছে।
আলেখ ঠিক বুঝতে পারছে না নিশীথ কি বলতে চাইছে, তবে নিশীথ যখন বলেছে তখন কারণ তো অবশ্যই আছে সেটা সে নিজেও জানে। আর সেই কারণ টা যে কি সেটাও নিশীথ নিজেই বলবে, অযথা বেশি ভেবে লাভ নেই। আলেখ নিজের বোতল টায় একটা চুমুক দিল, বিজনেস পার্টি ছাড়া আলেখ ড্রিংক করে না কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। আসলে মনটাই তো সব, মন ভালো থাকলে সব ঠিক থাকে আর মনটাই যদি ঠিক না থাকে তাহলে বাকি সবকিছুও ওলোট পালোট হয়ে যায়। নিশীথ একটু হেসে বলল,
যেটা বলছিলাম, আই নো ইউ ডোন্ট লাইক মি, আর কারণটাও আমার অজানা নয়। অ্যান্ড ট্রাস্ট মি মিস্টার শর্মা, আপনার আমাকে পছন্দ না করাটা একদম অনুচিৎ নয়। আমি নিজেও মেনে নিতে পারতাম না হয়তো যে আমার ওয়াইফ কে অন্য কেউ এতোটা ভালোবাসবে। হোক সে ভালোবাসা একতরফা কিন্তু তবুও, মেনে নেওয়া এতটাও সহজ নয়। বাট কি জানেন তো, সব কিছুর উপরে একটা সম্পর্ক আছে যার সাথে অন্য কোনও সম্পর্কের কোনও তুলনা হয় না। ফ্রেন্ডশিপ, ইয়েস ফ্রেন্ডশিপ। এমন একটা সম্পর্ক যেখানে নিঃস্বার্থ ভাবে একজন একজনের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতে পারে। আপনিও সেটা জানেন আমি জানি, আপনার আর রাত্রির রিলেশন টাও তো ঠিক এইরকমই।
আলেখ চোখে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে নিশীথ বলল,
কি ভাবছেন? আমি এখন আপনাকে আমার আর কুহেলির ফ্রেন্ডশিপের কথা বলব? নো মিস্টার শর্মা, আমার আর কুহেলির সম্পর্কের স্বচ্ছতা আপনি নিজেও জানেন। আমি আপনার আর আমার কথা বলছি, আমাদের রিলেশনের কথা বলছি।
আলেখ সবে আরেকটা চুমুক দিতে যাচ্ছিল, নিশীথের কথায় বিস্মিত হয়ে সেটা আর হল না।
আমাদের রিলেশন মানে?
মানে এই যে, আমাদের মধ্যে শুধুই বিজনেসের রিলেশন। কিন্তু সেটার বাইরেও তো একটা সম্পর্ক হতে পারে, আপনার ওয়াইফ আমার ফ্রেন্ড সেখানে আমরাও তো ফ্রেন্ড হতেই পারি।
আলেখ সত্যিই কখনও ভাবেনি নিশীথ কখনও ওকে বন্ধুত্বের কথা বলবে। নিশীথ ওর বিয়ার টা শেষ করে বলল,
অবাক হচ্ছেন তাই না? আমিও হচ্ছি। ইউ নো, আমি সোজাসুজি কথা বলতে ভালোবাসি, ইন্ডায়েরকটলি কথা বলা আমার ঠিক পছন্দ নয়। আমি জানি আপনার তেমন কোনও ফ্রেন্ডস কোনোদিনই ছিল না আজও নেই। একমাত্র রাত্রি ছাড়া অন্য কোনও ফ্রেন্ড আপনার এত ক্লোজ নয়, যাকে নিজের মনের কথা গুলো খুলে বলতে পারেন কারণটাও আমি জানি। শুধু শুধু এখন সেসব বলে আপনাকে আর কষ্ট দিতে চাই না। শুধু বলব লাইফে অন্য সম্পর্ক গুলোর যেমন প্রয়োজন আছে তেমনই বন্ধুরও প্রয়োজন আছে কারণ এমন কিছু কথা থাকে এমন কিছু পরিস্থিতি থাকে যেখানে শুধুমাত্র একজন বন্ধুকেই সবটা বলা যায়। রাত্রি আপনার লাইফে সেই বন্ধুর কাজ টা অনায়াসে করতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে আপনার এমন একজন বন্ধুর খুব প্রয়োজন, আর আমি সেই বন্ধুটাই হতে চাইছি। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন, মনে জমিয়ে রাখা কষ্ট গুলোকে মুক্ত করে দিতে পারেন আমার কাছে যেগুলো আপনি চাইলেও কুহেলির সামনে করতে পারবেন না। বেশিক্ষণ মনের মধ্যে কোনোকিছু কে আটকে রাখতে নেই, তাতে একটা গুমোট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেটা শুধুই কষ্টটা বাড়ায়।
আলেখ অবাক হয়ে শুনছিল নিশীথের কথা, প্রত্যেকটা কথায় এত গভীরতা ছিল যাকে উপেক্ষা করা যায় না। সত্যিই তো, আলেখের মনের বর্তমান পরিস্থিতি তো ঠিক এইরকমই। সত্যিই এমন কিছু পরিস্থিতি থাকে যেখানে দাড়িয়ে শুধু একজন বন্ধুকেই সবটা বলা যায়, নিজেকে মেলে ধরা যায়। আলেখের জীবনে এইরকম বন্ধু বলতে শুধুই রাত্রি, আর এইমুহুর্তে তাকে পাওয়া সম্ভব নয়। আর এটাও সত্যি যে আলেখের এখন এই মুহূর্তে একজন বন্ধুর সত্যিই খুব প্রয়োজন। ভিতরে ভিতরে সে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে। আলেখ এক চুমুকে বাকি বিয়ার টুকু শেষ করে বলল,
আপনি এত ভালো করে সবকিছু কীকরে বোঝেন বলুন তো? কীকরে? ঠিক বলেছেন আপনি, আমি পারছি না আর জানেন তো, আর পারছি না। কালকে কুহেলির সামনেও ভেঙে পড়েছিলাম, কুহেলি সামলে নিয়েছিল আমাকে। আমাকে বুঝতে দেয়নি ও নিজে কতটা কষ্টে আছে, কিন্তু আমি জানি ওর কতটা কষ্ট হচ্ছে। ড্যাড কে ও কতটা ভালোবাসে সেটা আমি জানি, যতটা কষ্ট আমার হচ্ছে ঠিক ততটাই কষ্ট ওরও হচ্ছে। কিন্তু শুধুমাত্র আমি যাতে ভেঙে না পড়ি তাই নিজের কষ্টটাকে আড়াল করে রাখছে। সব জেনেও কীকরে ওর সামনে দুর্বল হয়ে পড়ি বলুন তো, কাল না হয় পারিনি নিজেকে সামলে রাখতে কিন্তু আর নয়। আমাকে কষ্ট পেতে দেখলে ওর কষ্টটা আরও বাড়বে, কিন্তু কাউকে বুঝতে দেবে না। তাই ওর সামনে নিজেকে শক্ত করে রেখেছি। জানি মনে মনে হয়তো কুহেলিও জানে আমি ভিতরে কতটা দুর্বল হয়ে আছি কিন্তু তাও অন্তত চেষ্টা তো করছি। ও যদি আমার কষ্টের কথা ভেবে নিজের কষ্ট গুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে তাহলে আমি ওর জন্য সেটা কেন পারব না?
আমি সেটাই বলছি, কুহেলির সামনে আপনার দুর্বল হলে চলবে না কিন্তু কারোর একজনের সামনে তো কষ্ট গুলোকে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন তাই না? বিশ্বাস করুন কুহেলিও হয়তো ঠিক এই কাজটাই করছেন এখন, এমন কাউকে নিজের মনের কথা গুলো খুলে বলছেন যার সামনে তিনি অনায়াসে দুর্বল হতে পারেন। কথাটা নিশীথ খুব ভুল বলেনি, কুহেলি নিজেকে শক্ত করতে করতে যেন হাপিয়ে উঠেছিল, সেও তো মানুষ তারও তো কষ্ট হয়। আলেখের সামনে দুর্বল সে হতে চায় না, কিন্তু তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কষ্ট গুলোও তো ওকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে। আলেখের অনুপস্থিতির সুযোগে তাই আবার সে আশ্রয় নিয়েছে শৈলজা দেবীর কাছে, ওই একটা মানুষের কাছেই সে প্রাণ খুলে সব কিছু উজাড় করে দিতে পারে। যেন জমিয়ে রাখা কষ্ট গুলোর বিনিময়ে সঞ্চয় করে নেয় অফুরান মনঃশক্তি। কুহেলির জীবনে তো শৈলজা দেবী আছেন যিনি প্রয়োজনে কুহেলির বন্ধু হয়েও সামলে নেন তার কুহু কে। কিন্তু আলেখের জীবনে যে তেমন কেউ নেই…একটু ভুল হল, কথাটা নেই না, ছিল না হবে। আলেখের জীবনে তেমন কেউ ছিল না কিন্তু আজ আছে, এমন একজন আছে যার সামনে সে নির্দ্বিধায় উজাড় করে দিতে পারে সব কষ্ট সব দুঃখ গুলো। নিশীথের বাড়ানো বন্ধুত্বের হাত টার যেন এই মুহূর্তে সত্যিই খুব প্রয়োজন ছিল আলেখের। কথায় কথায় উঠে আসা নতুন পুরনো অনেক স্মৃতির মধ্যে যেন হারিয়ে যাচ্ছিল আলেখ। নিশীথ শুধু শুনছিল, কখন যে আলেখের চোখ দুটো ভিজে উঠেছে আলেখ বুঝতে পারেনি। নিশীথ লক্ষ্য করেছিল কিন্তু বাধা দেয়নি, সামনে হয়তো আরও দ্বিগুণ কষ্ট অপেক্ষা করছে আলেখের জন্য, মনটা একটু হালকা হওয়াটা প্রয়োজন। আলেখ যেন সত্যিই কিছুটা ভার মুক্ত অনুভব করছে এখন নিজেকে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, ঘড়ির কাটায় এখন পৌনে বারোটা। আলেখ ওর চোখ দুটো মুছে উঠে দাড়ালে, নিশীথও উঠে দাড়াল। আলেখ বলল,
থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার আগরওয়াল। আপনি….
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই নিশীথ বাধা দিয়ে বলল,
আমি কিন্তু এটাও থ্যাঙ্ক ইউ শোনার জন্য করিনি। আর বন্ধু বলে যদি সত্যি মনে করে থাকেন তাহলে আমি মিস্টার আগরওয়ালের থেকে নিশীথ টা বেশি প্রেফার করব।
আলেখ কিছুটা হাসল, চোখে ফুটে উঠেছে সন্মান আর কৃতজ্ঞতা। মানুষের কঠিন সময়ে যে এগিয়ে আসে, বাড়িয়ে দেয় বন্ধুত্বের হাত নিঃস্বার্থ ভাবে, সেই তো প্রকৃত বন্ধু, আর নিশীথ আজ ঠিক সেই কাজটাই করেছে। আলেখ একটু হেসে বলল,
অল রাইট, বাট তাহলে নিয়ম টা আপনার ক্ষেত্রেও একই হওয়া উচিৎ।
অফকোর্স… আলেখ।
আলেখ এবার সত্যিই হাসল, মন রাখা সৌজন্য মূলক হাসি নয়, মন থেকে।
গুড নাইট নিশীথ।
দুঃসময়ের মধ্যেও একটু ভালো কিছু হলে মনের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়। আজ নিশীথের সাথে বন্ধুত্বের সূচনা টা যেন সত্যিই আলেখের কষ্ট অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। পরের দিন বেশ সকালেই রাত্রি চলে এলো, নিশীথের বাড়িতে এর আগে কোনদিনও রাত্রি আসেনি তাই ওকে কোনও গার্ড চেনে না। অনুমতি ছাড়া কারোর এখানে প্রবেশের অধিকার নেই, তাই রাত্রিকেও তারা প্রবেশ করতে দিল না। একজন গার্ড নিশীথ কে ফোন করে রাত্রির কথা বলাতে নিশীথ একটু অবাক হল। অবাক হওয়ার কারণ হল গার্ড রাত্রির নাম বলেনি শুধু বলেছে একজন মেয়ে এসেছে। এত সকালে তার বাড়িতে কে এসেছে এটা জানার বেশ কৌতূহল হল নিশীথের। ব্যালকনিতে এসে গেটের কাছে রাত্রিকে দেখে একটু হাসল, নিজের মনেই ভাবল,
রাইট, ইটস রাত্রি, আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। আলেখ আর কুহেলি এখানে রয়েছে, এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে সেখানে রাত্রি তো আসবেই।
নিশীথ ঘরে এসে গার্ড কে জানিয়ে দিল রাত্রিকে যাতে আসতে দেয়। সে নিজেও নীচে নেমে এল, রাত্রি ভিতরে এসে নিশীথ কে দেখে অন্য কোনো কথা না বলে সোজা প্রশ্ন করল,
আলেখ আর কুহেলি কোথায়?
নিশীথ একটুও অবাক হয়নি, রাত্রি যে আলেখ আর কুহেলিকে কতটা নিজের মনে করে সেটা নিশীথ ভালো করেই জানে।
গেস্ট রুমে আছে, চলুন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
নিশীথ রাত্রিকে গেস্টরুমে নিয়ে এলো, আলেখ আর কুহেলি উঠেছে অনেকক্ষণ। রাত্রিকে দেখে দুজনেই খুশি হল, রাত্রি গিয়ে আগে আলেখকে জড়িয়ে ধরল।
ঠিক আছিস তুই?
হুম, যতটা ঠিক থাকা সম্ভব ততটাই ঠিক আছি।
রাত্রি আলেখকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
বেশি চিন্তা করিস না, দেখিস খুব তাড়াতাড়ি আমরা আঙ্কেলের খোজ পাব।
রাত্রির এই কথাটা বলারই বোধহয় অপেক্ষা ছিল। নিশীথের ফোনটা হঠাৎ শব্দ করে বেজে উঠল, নিশীথ কথা বলার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাত্রি আরও কিছু কথা বলছিল ওদের সঙ্গে এরমধ্যেই হঠাৎ নিশীথ ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকল।
উই হ্যাভ টু গো, রাইট নাও।
ক্রমশ___________
© স্বত্ব সংরক্ষিত
কেমন লাগল আজকের পর্ব টা জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। জানেনই তো অপেক্ষায় থাকি। আপনাদের মতামতের মধ্যে দিয়ে যে অফুরান ভালোবাসার সম্ভার উজাড় করে দেন সেটার আশাতেই তো বসে থাকি। আজ তবে আসি দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।