সংগোপনে’ পর্ব-৫

0
1862

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৫
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

কুহেলিদের কোলকাতা পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল, শ্যামবাজারের বিরাট তিনতলা বাড়িটা আলো আর ফুলের সাজে ঝলমল করছে। কুহেলির দাদু স্বরূপ রঞ্জন বাবুর শরীরটা ভালো নয় তাই ওনাকে এতোটা দূরে বিয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়নি, বধূবরণ পর্ব সারা হলে নবদম্পতি আগে ওনার আশীর্বাদ নিল। সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এসেছে, কালরাত্রি শুরু হয়ে যাবে, তাই বর বধূকে আলাদা আলাদা ঘরে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সারাদিনের জার্নি আর গতরাতের ধকলে সবাই ক্লান্ত, এমনিতেও আজ আর কোনও নিয়ম পালন করার নেই, তাই সবাই যার যার ঘরে ফ্রেশ হতে চলে গেল। কুহেলির দাদু এই বাড়িটা কিনেছিলেন কোনও এক জমিদারের উত্তরসূরীর কাছ থেকে, এত বড় বাড়ি কেনায় নাকি ওর দীদার আপত্তি ছিল, কিন্তু স্বরূপ বাবু শেষমেশ বাড়িটা কিনেই ছেড়েছিলেন, আর বাড়ির নাম রেখেছিলেন কুহেলির দীদার নামে, মঞ্জরী। ছোট থেকেই কুহেলির এই বাড়িটা খুব প্রিয়, এখানে ওর একটা নিজস্ব ঘরও আছে, যখনই আসে ওই ঘরটাতেই থাকে। আজকেও নিজের ঘরে এসে পোশাক টা পাল্টে স্নান সেরে সটান বিছানায় গা এলিয়ে দিল, কালকেও ঘুম হয়নি বলা চলে, আর আজকে এতটা জার্নি করে এসে শরীরটা সত্যিই ক্লান্ত লাগছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টের পায়নি, চৈতালী দেবী এসে রাতে খাওয়ার জন্য ডাকলে তবে ঘুম ভাঙলো।

এই, কত ঘুমাবি? আর এখন ঘুমাচ্ছিস রাতে ঘুম আসবে আর?

আসবে, আসবে। তুমি ডাকলে কেন?

দশটা বাজে, খাবি না?

ও, আসছি।

তাড়াতাড়ি আয়, আমি দেবাঞ্জলিকে ওর ঘরে খাবারটা দিয়ে আসি।

হুম।

চৈতালী দেবী চলে যাওয়ার পর কুহেলি উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে একটু জলের ছিটে দিয়ে নিচে নেমে এল। বাড়ি ভর্তি লোকজন, যারা বিয়েতে যাননি, তারাও এসে পড়েছেন, এত লোক একসাথে টেবিলে তো জায়গা হবে না, তাই মেঝেতে ঢালাও পাত পেড়ে শুরু হল খাওয়া, গল্প গুজবের মধ্যে দিয়ে খাওয়ার পাট চুকিয়ে যে যার ঘরে চলে গেল, কাল সকাল থেকেই আবার বৌভাতের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যাবে, তাছাড়া কনেযাত্রী সকাল সকালই এসে পড়বে, তাদেরও আপ্যায়ন করতে হবে, চৈতালী দেবী আর চৈতী দেবীই সবটা সামলাচ্ছেন। কুহেলি কিছুক্ষণ দেবাঞ্জলির সঙ্গে গল্প করে তবে ঘরে গেল, একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে তাই সহজে ঘুম আসবে না। বিছানায় শুয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে লগ ইন করল, একগাদা নিউজফিড জমে রয়েছে, সবকটা দেখতে ইচ্ছে করল না। দিঠি কালকের কতগুলো ছবি পোস্ট করেছে, ওকে ট্যাগও করেছে। সবকটা ছবিই খুব সুন্দর, চিরন্তন আর দেবাঞ্জলির ছবিগুলো তো ভিষন ভালোলাগছে। কুহেলির সাথে কয়েকটা সেলফি তুলেছিল, সেগুলোও পোস্ট করেছে। ছবিগুলোয় লাভ রিয়্যাক্ট দিয়ে একটা সুন্দর কমেন্ট করে মেসেঞ্জার টা ওপেন করল, দেবার্ঘ্যর নামের পাশের সবুজ বিন্দুটা চোখে পড়তেই ওর কান্নাভেজা চোখদুটো কুহেলির চোখের সামনে ভেসে উঠল। মেসেজ করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতে শেষমেশ মেসেজটা করেই ফেলল।

“মন খারাপ?”

দেবার্ঘ্যর মনটা সারাদিন সত্যিই খারাপ ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে কোলকাতা গামী কনেযাত্রীর বাসে বসে আর খারাপ লাগছে না। রাত পেরোলেই আবার নিজের দিদিকে দেখতে পাবে ভেবেই মনটা ভাল হয়ে গেছে, কুহেলির মেসেজটা দেখে মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। ছোট্ট করে রিপ্লাই দিল।

“ছিল”

“তারমানে এখন আর নেই, তাই তো?”

“হুম, দূরত্ব টা যত কমছে তত মনটা আরও ভালো হয়ে যাচ্ছে।“

“আপনারা রওনা হয়ে গেছেন?”

“হুম, এগারোটায় বাস ছেড়েছে।“

“গুড”

“তুমি এখনও ঘুমাওনি?”

“না, আসলে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এখন ঘুম আসতে একটু দেরি হবে।“

দেবার্ঘ্যর হঠাৎ কালকের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল, কুহেলিকে সরি বলা হয়নি এখনও। কিপ্যাডে আঙ্গুল চালিয়ে সরি টাইপ করে পাঠাতে গিয়েও থেমে গেল, ভাবল,

না, এভাবে মেসেজে সরি বলাটা ঠিক হবে না, বরং কালকে মুখোমুখি সরি বলে সবটা বুঝিয়ে বলব।

বেশ কিছুক্ষণ ওদিক থেকে কোনও সাড়া শব্দ না পেয়ে কুহেলি একটা গুডনাইট মেসেজ সেন্ড করে দিল। একটু পরেই একটা গুডনাইট স্টিকার স্ক্রীনে ফুটে উঠল, কুহেলি হালকা হেসে একটা মেসেজ সেন্ড করে ফোনটা অফ করে রেখে দিল। হালকা ঘুম আসছে, এখন না ঘুমালে ঘুমটা কেটে যাবে, পাশ ফিরে নরম কোলবালিশটা জড়িয়ে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। দেবার্ঘ্য বাসের নরম সিটটায় হেলান দিয়ে হেডফোনে গান শুনছিল, পাশে ওর পিসতুতো ভাই অনীক ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। কুহেলিকে গুডনাইট উইশ করে ফোনটা পকেটে রেখে দিয়েছিল, ফোনটা ভাইব্রেট করায় আবার সেটা হাতে নিয়ে অন করে দেখল কুহেলির ছবিসহ চ্যাটহেড টা স্ক্রীনের একটা কোনায় ভেসে উঠেছে। আজ প্রায় একমাস হল কুহেলির সাথে আলাপ হয়েছে, এরমধ্যে একদিনও গুডনাইট উইশ করার পর আর মেসেজ করেনি, চট করে চ্যাটবক্স টা ওপেন করে দেখল একলাইনের একটা মেসেজ।

“কালকে দেখা হচ্ছে।“

এই অতি সামান্য একলাইনের মেসেজটা পড়ে দেবার্ঘ্যর মনটা এক অদ্ভুত খুশিতে ভরে গেল। খুশির কারনটা যদিও অজানা, তবে সেটা জানার খুব একটা আগ্রহও বোধ করল না, ভালোলাগার আমেজ নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন সকাল থেকেই কুহেলির মামাবাড়ীতে একেবারে হৈ হৈ পড়ে গেল, সবাই ভিষন ব্যস্ত, বাড়িটাকে আরও সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে। স্বরূপ রঞ্জন বাবু নিজে সবটা তদারকি করছেন, পেশায় একসময় জাঁদরেল উকিল ছিলেন, মেজাজটাও তেমনই। কোথাও একটু ভুল দেখলেই রে রে করে পড়ছেন, কুহেলি ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে নিচে নামতে নামতে শুনতে পেল স্বরূপ বাবু কাউকে ভিষন বকছেন, একতলায় নেমে দেখল একটি অল্পবয়সি ছেলে মাথা হেট করে দাড়িয়ে আছে আর ওর দাদু প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে ওকে বকছেন। কুহেলি এগিয়ে গিয়ে বলল,

দাদান, কি ব্যাপার? তোমাকে না ডক্টর জোরে কথা বলতে বারন করেছে। আর তুমি এত ঘোরাঘুরিই বা করছ কেন? যাও ঘরে গিয়ে রেস্ট কর।

আরে দেখ না কুহু, মেয়ের বাড়ির লোকেরা আসার আগে সবটা শেষ হতে হবে তো নাকি? ওরা তো বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাবে, এখন অলরেডি নটা বাজে। কোনোটাই এখনও পুরো হয়নি, ছাদের কাজটাও বাকি রয়েছে।

সব হয়ে যাবে দাদান, তুমি এত চিন্তা করো না তো। যাও নিজের ঘরে যাও, আমি বাকিটা দেখে নিচ্ছি।

একপ্রকার ঠেলেঠুলে ওনাকে ঘরে পাঠিয়ে কুহেলি নিজে এবার ময়দানে নামল, সত্যিই এখনও অনেক কাজ বাকি। এবাড়ির হল ঘরটা একদম পুরনো আমলের বৈঠকখানার ধাঁচের, আসলে বাড়িটা যেমন কিনেছিলেন তেমনই রেখে দিয়েছেন স্বরূপ বাবু, কাঠামো বদলাননি, শুধু সংস্কার করিয়েছেন। এই বিরাট হলঘরের সাবেকি আমলের ঝাড়বাতির তলায় বউয়ের বসার ব্যবস্থা হয়েছে, প্রায় হয়ে এসেছে। সামনে মেসোকে দেখে এদিকের দায়িত্বটা ওনাকে দিয়ে কুহেলি সটান ছাদে চলে এল, আহারাদির ব্যবস্থা এই ছাদেই, এই ছাদে ওঠার জন্য যেমন ভিতর থেকে সিড়ি আছে তেমনি বাইরে থেকেও একটা সেকেলে ধাঁচের ঘোরানো লোহার সিড়ি আছে, তবে সাধারণত যত সরু দেখা যায় এই সিড়ি টা তার প্রায় দ্বিগুণ চওড়া। বিরাট খোলামেলা ছাদে শামিয়ানা স্টাইলে প্যান্ডেল হয়েছে, সিড়ি টাও তার সাথে মানানসই ভাবে সাজানো হয়েছে। লাল সাদা কম্বিনেশন টা এত সুন্দর ফুটেছে, দেখেই মনটা ভরে গেল কুহেলির। এখনও ফুল আর লাইট লাগানো বাকি, বুফের কাউন্টার রেডি হয়ে গেছে, অন্যদিকে এখনও টেবিল চেয়ার পাতা চলছে। কুহেলি সবটা দেখে ওদের একটু তাড়াতাড়ি করার নির্দেশ দিয়ে আবার নিচে নেমে এল। এদিকে চৈতালী দেবী আর চৈতী দেবী দুজনেই চরম ব্যস্ত, সকালের জলখাবার হল কিনা, দুপুরে কি হবে, কনে যাত্রী এসে কে কোথায় থাকবে, ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান টা কখন করলে সুবিধে হবে এইসব দেখার মাঝে তারা দম ফেলারও সুযোগ পাচ্ছেন না। কুহেলি এসে দেখল, চৈতালী দেবী হন্ত দন্ত হয়ে সারা বাড়ি ময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কুহেলিকে দেখেই ওর কাছে এসে বললেন,

এই তো কুহু, যা তো, শিগগিরি গিয়ে দেবাঞ্জলিকে নিয়ে আয়, ও এতক্ষণে তৈরি হয়ে গেছে, আমি দিঠিকে চিরুকে ডাকতে পাঠিয়েছি। ঝটপট ভাতকাপড়ের অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলতে হবে, নাহলে এরপর কনেযাত্রী এসে গেলে মুশকিল হয়ে যাবে।

কুহেলি দেবাঞ্জলিকে ডাকতে এসে দেখল সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছে, নতুন হলুদ লাল শাড়িতে খুব মিষ্টি লাগছে। কুহেলি দুষ্টু হাসি হেসে দেবাঞ্জলির কাছে গিয়ে বলল,

কি ব্যাপার মামী!! আমার মামাকে কি রোজ রোজ নতুন নতুন রূপে ঘায়েল করার প্ল্যান করছ নাকি?? দারুন লাগছে কিন্তু।

দেবাঞ্জলির গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে গেল, কুহেলির হাতে একটা চিমটি কেটে বলল,

বড্ড পেকেছো দেখছি, দাড়াও বড়দিকে বলে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করছি।

আমার বিয়ে!! আপাতত ওসবের টাইম নেই। তাই ফালতু এনার্জি নষ্ট করো না, এখন চল, আমার মামা তোমার ভাতকাপড়ের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। যদিও তোমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নেওয়ার প্রয়োজন নেই, তাও নিয়ম বলে কথা।

দুজনে হাসতে হাসতে নিচে চলে এল, চিরন্তনও এসে গেছে। শুরু হল ভাতকাপড় পর্ব, সে তো আরেক মজার ব্যাপার, চিরন্তন লজ্জায় কিছুতেই জোরে জোরে কথাগুলো বলতে পারছে না, আর বাকিরাও ছাড়ছে না। অবশেষে অতিকষ্টে ঝড়ের বেগে একবার বলে তবে বেচারা রেহাই পেল, সবাই তো হেসেই অস্থির, দেবাঞ্জলিও মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে, চিরন্তন কোনরকমে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচল। এরপর বাকিদের সকালের খাওয়াদাওয়া হলে যে যার কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল। প্রায় বারোটা নাগাদ দেবার্ঘ্যরা এসে পৌঁছল, ওদের সবার থাকার ব্যবস্থা এইবাড়িতেই করা হয়েছে, স্বরূপ বাবুর বক্তব্য এত বড় বাড়ি থাকতে হোটেলে কেন থাকবে? প্রথমে দেবাঞ্জলির বাবা শিরীষ বাবু রাজি হচ্ছিলেন না, ওনার কথায় এইভাবে বৌভাতের দিন সদলবলে মেয়ের শশুরবাড়িতে ওঠা নাকি বড্ড অশোভনীয়, আর তাছাড়া মেয়ের বাড়ির অন্নজল গ্রহণ করা পাপ। কুহেলির বড্ড অদ্ভুত লাগে এইসব উল্টোপাল্টা নিয়ম গুলো, এই যুগে দাড়িয়েও মানুষ সেই আদ্দিকালের নিয়মগুলো আকড়ে ধরে রেখেছে। কিন্তু স্বরূপ বাবু কোনও কথাই শোনেননি, স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন,

শুনুন শিরীষ বাবু, এইসব আমি মানি না, আমার এত বড় বাড়ি থাকতে আপনারা হোটেলে উঠবেন, এ হবে না, আর বিয়ের পর এটা আপনার মেয়ের বাড়ি হবে, নিজের মেয়ের বাড়িতে আসবেন, থাকবেন, এতে অসুবিধে টা কোথায়? আর ওই অন্নজলের থিওরিটা মাথা থেকে বাদ দিন।

দোতলা তিনতলা মিলিয়ে মোট আটটা ঘরে ওদের সবার থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেবাঞ্জলি ওর বাবা মা কে দেখে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল, দেবার্ঘ্যও ওর দিদিকে দেখে খুব খুশি। চৈতালী দেবী সবাইকে অ্যাপায়ন করে ভিতরে এনে বসালেন, তারপর কুহেলি আর দিঠিকে ডেকে সবাইকে যার যার ঘরে পৌঁছে দিতে বললেন। কুহেলিকে এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি দেবার্ঘ্য কে, এবার সামনে এসে দাড়াতেই ওর দিকে তাকিয়ে হাসি মিনিময় করল। কুহেলি আর দিঠি একে একে সবাইকে ঘর দেখিয়ে দিল, দেবার্ঘ্য আর ওর ভাই অনীকের একঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, তিনতলায়। কুহেলি ওদের ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে বলল,

এটা আপনাদের রুম, কোনো অসুবিধা হলে বলবেন, ওই কোনার ঘরটা আমার।

এত যত্ন আত্তির পরেও অসুবিধা হবে বলছ?

বলা তো যায় না, আচ্ছা আপনারা রেস্ট করুন, আমি খাওয়ার সময় ডেকে নিয়ে যাব।

কুহেলি নিচে চলে গেল, দেবার্ঘ্য সেদিকে একটু তাকিয়ে হেসে ঘরে ঢুকে গেল। সময় যেন এরপর দৌড়াতে লাগল, দুপুরের খাওয়া দাওয়া মিটলে, শুরু হয়ে গেল সন্ধ্যের প্রস্তুতি। একটু পরেই পার্লার থেকে দেবাঞ্জলিকে সাজাতে চলে এল, কিছুক্ষণ সেখানে থেকে কুহেলিও নিজের ঘরে এসে রেডি হতে লাগল। আজকেও শাড়ি পরেছে, একটা কালো লাল ঢাকাই জামদানি, সঙ্গে মানানসই জুয়েলারী আর মেকাপ, আজকে চুলটা সুন্দর করে খোঁপা করেছে, মানে করিয়েছে, ওর মাসী করে দিয়েছে। অসম্ভব মোহময়ী লাগছে কুহেলিকে, ওদিকে দেবাঞ্জলিকেও দারুন লাগছে, আটপৌড়ে করে পড়া কমলা ঘিয়ে বেনারসিটায় ওকে একদম দেবী প্রতিমার মত লাগছে। সন্ধ্যের আগেই ওকে তৈরি করে হলঘরে বিরাট সিংহাসন টায় বসিয়ে দেওয়া হল, পাশে দিঠি। কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হয়ে গেল অতিথিদের আনাগোনা, স্বরূপ বাবু নিজে সবাইকে আপ্যায়ন করছেন, কারো বারন শোনেননি। কুহেলিও ব্যস্ত, খাওয়ার জায়গার দায়িত্বটা মোটামুটি ওর কাঁধেই বর্তেছে। বারবার ছাদে গিয়ে দেখে আসছে সব ঠিক আছে কিনা, ও অবশ্য বাড়ির ভিতরের সিড়ি দিয়েই যাচ্ছিল, ওটা ফাঁকা, তাই সুবিধা। একবার তাড়াহুড়ো করে ছাদ থেকে নামতে গিয়ে শাড়িতে পা বেধে হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই দুটো হাত ওকে ধরে ফেলল। কুহেলি চোখ মেলে দেখল, দেবার্ঘ্য ওকে ধরে দাড়িয়ে আছে, নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাড়িয়ে হেসে বলল,

থ্যাঙ্কস, আপনি এই নিয়ে দুবার আমায় বাঁচালেন।

দেবার্ঘ্যও একটু হেসে বলল,

ওয়েলকাম, তবে একটু দেখে চলবে তো, আমি না এলে কি হত?

কুহেলিও পাল্টা হেসে বলল,

কি আবার হতো, পড়ে যেতাম।

দেবার্ঘ্য হেসে একটু ইতস্তত করে বলল,

কুহেলি, আই অ্যাম সরি।

কুহেলি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে, দেবার্ঘ্য কেন ওকে সরি বলছে সেটা বুঝতে ওর কোনও অসুবিধা হল না, তাই পরিস্থিতিটা যাতে বিব্রতকর না হয় তাই কোনও রকম ভনিতা ছাড়াই বলল,

ছাড়ুন, ওসব মনে রাখার কোনও মানে হয় না। ওরকম সিচুয়েশন মাঝেমধ্যে তৈরি হয়ে যায়, ওতে কারো হাত থাকে না। কারও ভুলও থাকে না, তাই আমার মনে হয় এইসব ব্যাপার গুলো নিয়ে বেশি ভেবে সময় নষ্ট না করাটাই বেটার।

কুহেলির কথা শুনে দেবার্ঘ্য স্তম্ভিত হয়ে গেল, কত সহজে ব্যাপারটা বলে দিল, সত্যিই এতে তো কারোর কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু কুহেলি যে এত সহজ ভাবে ব্যাপারটা নেবে এটা সে ভাবেনি। চারিদিকের ঝলমলে আলোর মাঝখানে দাড়ানো কুহেলিকে দেখে দেবার্ঘ্যর মনটা আবার কেমন উথাল পাথাল হতে লাগল। অন্যদিকে রয়্যাল ব্লু স্যুটে সুসজ্জিত দেবার্ঘ্যর ওই ঘুম জড়ানো চোখ দুটো যে কুহেলির মনেও নাড়া দিয়ে গেছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বৌভাত টা বেশ ভালোভাবেই মিটে গেল, রাতে দুই পক্ষ মিলে অনেকক্ষণ হাসি ঠাট্টার পর দেবাঞ্জলি আর চিরন্তনকে ওদের ঘরে পাঠিয়ে বাকিরাও যে যার ঘরে চলে গেল। এত হৈ হুল্লোড়ে সবাই ক্লান্ত, তাই কারোর চোখেই ঘুম আসতে দেরী হলো না। পরদিন সকালে যথারীতি আবার ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল, সবার জলখাবারের ব্যবস্থা করতেই নটা ছাড়িয়ে গেল, কনেযাত্রীরাও সবাই একটু পরেই বেরোবে, এদিকে আবার কুহেলিও বেরোবে, তাই ব্যস্ততার শেষ নেই। বেলা সাড়ে দশটার মধ্যেই সবার খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটে গেল, শিরীষ বাবুরাও ফেরার জন্য তৈরি হলেন, চৈতালী দেবীরা অনেক করে বলেছিলেন দুপুরে খেয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে বলে ওনারা এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে গেলেন। ওনারা চলে গেলে কুহেলি আর দেবার্ঘ্যও লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে কুহেলিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। চৈতালী দেবী অবশ্য বলেছিলেন এখান থেকেই দুপুরে খাওয়াটা সেরে যেতে কিন্তু কুহেলির কথাটাও যুক্তি সঙ্গত, এত গ্যাঞ্জামের মধ্যে ওদের ঠিক রেস্ট হবে না, তাই আর বাধা দেননি। কুহেলি আর দেবার্ঘ্য যখন ওদের বাড়িতে পৌঁছাল তখন বারোটা বাজে। হাতে কিছুটা সময় আছে, কুহেলি খাবার অর্ডার করে দিয়েছে, দেবার্ঘ্যকে গেস্ট রুমটা দেখিয়ে রেস্ট করতে বলে নিজেও ওর ঘরে গিয়ে পোশাক টা বদলে একটু চুপচাপ বসল। দেবার্ঘ্যরও এই কটাদিন খুব ধকল গেছে, ওয়াশরুম থেকে একটু ফ্রেশ হয়ে এসে খাটে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল করেনি। লাঞ্চ এসে গেলে কুহেলি গেস্টরুমে গিয়ে দেখে দেবার্ঘ্য ঘুমিয়ে পড়েছে, ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে বেশ লাগছে, একটা নিষ্পাপ শিশুর মত ঘুমাচ্ছে। কুহেলি খাটের পাশে বসে একভাবে ওকে দেখছিল, কখন যে ওর হাতটা অজান্তেই দেবার্ঘ্যর গাল স্পর্শ করেছে সেটা বুঝতে পারেনি, হঠাৎ খেয়াল হতেই হাতটা সরিয়ে নিল। দেবার্ঘ্যর প্রতি এই অদ্ভুত আকর্ষণটা যে কেন অনুভব করে সেটা এখনও ওর কাছে স্পষ্ট নয়। কুহেলি দেবার্ঘ্যকে এখনও কিছু বলে সম্বোধন করে না, আর এমনিতেও এই সম্পর্ক গুলো ঠিক ও বুঝে উঠতে পারে না, তাই ঠিক কি বলে যে ডাকবে বুঝে পেল না। কিছু বুঝে না পেয়ে দেবার্ঘ্যর হাতে একটু নাড়া দিল, দেবার্ঘ্যর ঘুম খুব পাতলা তাই একবারেই ঘুমটা ভেঙে গেল। কুহেলি ওকে খেতে ডাকল, দেবার্ঘ্য উঠে কুহেলির সঙ্গে ডাইনিং রুমে গেল, কুহেলি ওকে বসতে বলে দুটো প্লেট এনে খাবার বেড়ে দিল। দুজনে টুকটাক কথা বলতে বলতে খেয়ে নিল, তারপর সময় মত রেডি হয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ফ্লাইট বোর্ড করার পর দেখা গেল দুজনের সিট দুদিকে, সেটা দেখে কুহেলি হেসে বলল,

বলেছিলাম না, সিট নির্ঘাৎ আলাদা হবে, এবার? খুব তো বলেছিলেন আড়াই ঘণ্টার জার্নিটা বেশ কাটবে।

এখনও তো জার্নিটা শুরুই হল না, দাড়াও, দেখ আমি কি করি।

কুহেলি নিজের নির্দিষ্ট সিটে বসে আবার হাসতে লাগল, দেবার্ঘ্য নিজের সিটে চলে গেল। ফ্লাইট টেক অফ্ করার আগেই একটা মেয়ে এসে হঠাৎ কুহেলিকে বলল,

আপনি কুহেলি?

কুহেলি একটু অবাক হয়ে বলল,

হ্যা।

আপনার ফ্রেন্ড আমাকে রিকোয়েস্ট করলেন আপনার সাথে সিট টা চেঞ্জ করতে।

এ কি! আপনি কেন শুধু শুধু কষ্ট করছেন? আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

আমারও কোনো প্রবলেম নেই, আপনি সিট এক্সচেঞ্জ করতে পারেন, এতে লজ্জার কিছু নেই।

কুহেলি আরও অবাক হয়ে বলল,

কিসের লজ্জা?

আপনি ফ্লাইট টেক অফ্ করার সময় ভয় পান, তাই পাশে চেনা পরিচিত কেউ থাকলে আপনার সুবিধা হয়।

কুহেলির মুখটা হা হয়ে গেল, কিছুই বলতে পারল না। মেয়েটা আবার বলল,

নিন তাড়াতাড়ি করুন, এক্ষুনি ফ্লাইট টেক অফ্ করবে।

কুহেলি আর কথা না বাড়িয়ে সিট টা বদলে নিল, চুপচাপ দেবার্ঘ্যর পাশে এসে মুখটা ভার করে বসে রইল। আর কুহেলিকে ঐভাবে দেখে দেবার্ঘ্যর ভিষন হাসি পেল, মুখ টিপে হাসতে লাগল। ওকে হাসতে দেখে কুহেলির আরও রাগ হল, দেবার্ঘ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

আবার হাসছেন? এইরকম একটা মিথ্যে কথা বলার পরেও হাসছেন?

কি করব বল, তোমাকে দেখে সত্যিই হাসি পাচ্ছে।

কুহেলি আরও রেগে গিয়ে বলল,

আমি সেই কবে থেকে ফ্লাইটে একা যাতায়াত করি সেখানে আপনি বললেন আমি ফ্লাইট টেক অফ্ করলে ভয় পাই!! হ্যাঁ, প্রথমবার একটু অন্য রকম ফিলিংস হয়েছিল কিন্তু সে তো সবারই হয়।

সরি, বাট এমনি বললে তো আর সিটটা এক্সচেঞ্জ করত না, আর আমি একবার যখন বলেছি সেটা তো পুরো করতেই হত।

কুহেলি কিছু না বলে উল্টো দিকে তাকিয়ে থাকল, আর দেবার্ঘ্য মুখ টিপে হাসতেই থাকল। তবে কুহেলি বেশিক্ষণ রাগ করে থাকল না, একটু পরেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করতে লাগল, বিশেষ করে বিয়েবাড়ির গল্প। হঠাৎ কুহেলি বলল,

আচ্ছা, আপনার প্রোফাইলে ডিপিটায় আপনার ছবি?

হ্যা, কেন?

আপনি ছবি তুলতে পারেন?

হুম, ওই আর কি।

তাহলে বিয়েতে তুললেন না কেন?

বিয়েতে কত কাজ, ছবি তুলে বেড়ালে হবে?

হুম।

কেন বলত?

এমনিই, হঠাৎ মনে হল তাই বললাম।

কথার মধ্যে দিয়ে কোথা থেকে আড়াই ঘণ্টা কেটে গেল ওরা টের পেল না। ফ্লাইট ল্যান্ড করলে ওরা যখন এয়ারপোর্ট থেকে বেরোল তখন পৌনে আটটা বাজে। দেবার্ঘ্য বলল,

চল তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।

মানে টা কি? আপনার ফ্ল্যাট আর আমার ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ উল্টো দিকে।

তাতে কি হল?

কি হল মানে? উল্টো দিকে যাবেন কেন?

আরে ওটা কোনও ব্যাপার নয়।

অনেকটাই ব্যাপার, আপনি আপনার দিকে যান, আমি আমার দিকে।

বলে কুহেলি একটা ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে গেল, দেবার্ঘ্যও ওর পিছনে এল। কুহেলি ট্যাক্সিতে বসে বলল,

এবার আপনিও যান, কাল থেকে আবার তো ব্যাক টু ওয়ার্ক।

হুম, সাবধানে যেও। বাই।

বাই।

কুহেলির ট্যাক্সিটা কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের বাইরে চলে গেল সেদিকে তাকিয়ে এক চিলতে হাসি দেবার্ঘ্যর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল। একটা ট্যাক্সি ডেকে দেবার্ঘ্যও এগোল নিজের গন্তব্যের দিকে।

ক্রমশ_____________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

শেষ হল বিয়ে বাড়ি পালা, কুহেলি আর দেবার্ঘ্যর আলাপটা কেমন লাগল? কুহেলির সাজিয়ে রাখা ওর পারফেক্ট লাইফের যে ছবিটা ও একে রেখেছে, সেটা কি তাহলে এবার বদলাবে? নাকি কাজের মধ্যে ফিরে গিয়ে কুহেলি আবার ডুবে যাবে কাজের নেশায়? কি মনে হয় আপনাদের? কি হতে চলেছে আগামী দিনগুলোতে? আমাকে জানাবেন কিন্তু। আমি আপনাদের কমেন্টের অপেক্ষায় থাকি। আপনাদের প্রতিটা কমেন্ট আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে আগামী পর্বে। ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here