সংগোপনে’ পর্ব-৬

0
2019

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৬
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

পরদিন সকালে ঠিক সময়মত অফিসে পৌঁছে কুহেলি নিজের ডেস্কের সামনে এসে অবাক হয়ে গেল, একগাদা ফাইলের স্তূপ। পিয়ন হরিশ কে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানাল প্রতিদিন কাজের শেষে রুহি এই ফাইল গুলো ওর টেবিলে রেখে যেত। চেয়ারে বসে ফাইলগুলো উল্টে পাল্টে দেখতেই বুঝতে পারল এগুলো ওর প্রজেক্টের ফাইল, কিন্তু ও তো সবটাই করে দিয়ে গিয়েছিল তাহলে এত ফাইল পেন্ডিং থাকে কীকরে? এরমধ্যেই রুহি এসে পড়ল, এসেই আগে কুহেলির কাছে এসে বলল,

থ্যাঙ্ক গড তুমি এসে গেছ, নাহলে কি যে করতাম কে জানে!

রুহির গলায় উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। কুহেলি বুঝতে পারল, নির্ঘাৎ কোনও সমস্যা হয়েছে। কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

কি হয়েছে? আর এত ফাইল কেন? আমি তো সবটা গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম।

সেসব আর কাজে লাগবে না।

কুহেলি প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল,

মানে?

মানে, সেদিন তুমি ফোন করলে আমি বললাম না, স্যার একটা মিটিং ডেকেছেন।

হ্যা, তো?

সেই মিটিংয়ে জানা গেল মিস্টার আগরওয়াল প্রায় গোটা প্রজেক্টটাই চেঞ্জ করে দিয়েছেন।

হোয়াট!! বাট এটা কীকরে পসিবল? সেদিন তো উনি নিজে সবটা ফাইনাল করে গেলেন। আর এভাবে হুট করে সব চেঞ্জ করা যায় নাকি?

অ্যাকচুয়ালি মিস্টার আগরওয়াল হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন, হার্ট অ্যাটাক। এখন উনি হসপিটালে আছেন, তাই এই প্রজেক্ট টা এখন ওনার ছেলে নিশীথ আগরওয়াল হ্যান্ডেল করছেন, আর উনিই এইসব চেঞ্জ গুলো করেছেন।

এইকদিনে এত কিছু হয়ে গেল? স্যার কি বললেন?

নাথিং, শুধু ইনস্ট্রাকশন দিলেন কিভাবে সবটা করতে হবে বাট দি, আমি সেভাবে কিছুই করতে পারছি না। তাই সব ফাইল তোমার ডেস্কে রেখেছি, যতটা আমি পেরেছি করে রেখেছি।

কুহেলির কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল, হঠাৎ করে সবটা নতুন করে করা মোটেও সহজ নয়। এরমধ্যে আলেখ অফিসে ঢুকল, সবাই উঠে দাড়াল, কুহেলিও নিজের চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাড়াল। আলেখ ওর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওকে দেখে দাড়িয়ে পড়ল, সোজা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

মিস বাসু, আপনি এসে গেছেন, দ্যাটস গুড, কাম টু মাই কেবিন।

কুহেলি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আলেখের পিছন পিছন ওর কেবিনে এল, আলেখ ওর চেয়ারে বসে অঙ্কিত কে বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে কুহেলিকে ইশারায় বসতে বলল। কুহেলি একটা চেয়ার টেনে বসল, আলেখের মুখে ওর সেই স্বাভাবিক হাসিটা এখনও লেগে আছে।

সো মিস বাসু, কেমন এনজয় করলেন?

কুহেলি একটা হালকা হাসি ঠোঁটে এনে বলল,

গুড স্যার।

ওকে, দেন এবার তাহলে কাজের কথায় আসা যাক।

ইয়েস স্যার, রুহির কাছে শুনলাম গোটা প্রজেক্টটা নাকি চেঞ্জ করা হয়েছে।

ঠিকই শুনেছেন। মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল এই প্রজেক্টটা টেক ওভার করার পর ওনার মনে হয়েছে প্রজেক্টের প্ল্যানিংয়ে অনেক কমতি রয়েছে তাই উনি প্রায় সবটাই আবার নতুন করে করতে বলেছেন।

কিন্তু স্যার মিস্টার আগরওয়াল, মানে নবীন আগরওয়াল তো নিজে সবটা দেখে তবে ডীল টা ফাইনাল করেছিলেন, তাহলে? আর এভাবে যখন তখন গোটা প্রজেক্টটা চেঞ্জ করে দেওয়া যায়?

আমাদের এখানে কিছু করার নেই মিস বাসু, কন্ট্রাক্ট এ স্পষ্ট লেখা আছে যদি কখনও দুই পক্ষের একজনেরও মনে হয় যে প্রজেক্টটা ঠিক মত হচ্ছে না, তাহলে সে সেটা চেঞ্জ করতে পারে এবং অন্য পক্ষ সেটা মানতে বাধ্য, তবে অবশ্যই সেই চেঞ্জের জন্য ভ্যালিড কারণ থাকতে হবে। আর এক্ষেত্রে মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল যে কটা পয়েনটস মেনশন করেছেন তার একটাও উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়।

কথাটা শুনে কুহেলির মনটা খারাপ হয়ে গেল, এই প্রোজেক্ট টার জন্য ও অনেক কষ্ট করেছে, আর এখন দেখা যাচ্ছে ওর পুরো পরিশ্রমটাই বৃথা। আলেখ ওর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারল, খুব সহজ ভাবে বলল,

মিস বাসু, এইটুকুতেই এত আপসেট হলে চলবে না। আপনি প্রজেক্টটা যেভাবে প্ল্যান করেছিলেন সেটা যথেষ্ট ভালো ছিল, মিস্টার আগরওয়াল নিজে আপনার প্রশংসা করে গেছেন। ফ্যাক্ট শুধু এইটুকুই যে মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল যে প্ল্যানটার কথা বলছেন সেটা আরও অনেক বেশি ভালো। আর এতে আপনার নিজেকে অযোগ্য মনে করার কিন্তু কোনও কারণ নেই, নিশীথ আগরওয়াল আমাদের ইন্ডাস্ট্রির এই মুহুর্তের নাম্বার ওয়ান বিজনেস ম্যান, স্বাভাবিক ভাবেই তার আইডিয়া আমার আপনার থেকে অনেক বেটার হবে।

কুহেলি আলেখকে যত দেখছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে, গোটা প্রজেক্টটা কুহেলির দায়িত্বে ছিল, আলেখ ইচ্ছে করলেই সমস্ত দোষটা ওর কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে কুহেলিকে সমর্থন করছে! ওকে উৎসাহ দিচ্ছে! আলেখ আবার বলল,

মিস বাসু, মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল গতকাল একটা মিটিং রাখতে চেয়েছিলেন, আমি ওনাকে বলে মিটিংটা আগামীকাল রেখেছি। আমি চাইছিলাম আপনি এই মিটিংটায় থাকুন, এটা আপনি লিড করছেন তাই আপনার থাকাটা প্রয়োজন। মূলত আপনার প্ল্যান টাই আছে শুধু তার ধরনটা বদলানো হয়েছে, আপনি আজ ভালো করে পুরোটা স্টাডি করুন, কোথাও কোনও প্রবলেম হলে আমাকে যেকোনো সময় বলতে পারেন।

কুহেলির প্রথমে একটু খারাপ লাগলেও দমে যাওয়ার মেয়ে সে নয়, বিশেষ করে আলেখের ওর উপর এতটা বিশ্বাস তার মনোবল আরো বাড়িয়ে দিল। চেয়ার থেকে উঠে কুহেলি বলল,

ওকে স্যার, আমি আজকের মধ্যেই সবটা স্টাডি করে নিচ্ছি।

আলেখ একটু হেসে বলল,

ওকে দেন, গো ব্যাক টু ইওর ওয়ার্ক।

কুহেলি ‘ইয়েস স্যার’ বলে নিজের ডেস্কে ফিরে এল। ফাইল গুলো দেখতে দেখতে কুহেলি একটা জিনিষ খুব ভালো করে বুঝতে পারল এই মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল নামক ব্যক্তিটির ব্যবসায়িক জ্ঞান অনেক বেশি। কুহেলির তৈরি করা প্ল্যানটা নিঃসন্দেহে যথেষ্ট ভালো ছিল, কিন্তু যে পয়েন্টস গুলো এখানে পরিবর্তিত করা হয়েছে, তাতে সত্যিই প্রজেক্টটা আগের থেকে অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। কুহেলি ঠিক করল যেভাবেই হোক কালকের মিটিংটা ও নতুন প্রজেক্ট তৈরী করেই অ্যাটেন্ড করবে, এই নিশীথ আগরওয়ালকে আর কোনও সুযোগ সে দিতে চায় না। ফাইল গুলো নিয়ে বসে গেল নিজের কাজে, ঘড়ির কাটা আপন মনে ঘুরতে ঘুরতে দুটোর ঘরে পৌঁছে গেল, রুহি ওকে লাঞ্চের জন্য ডেকে গেলেও কুহেলির সেদিকে এখন কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। লাঞ্চ টাইম পেরিয়ে ঘড়ির কাটা এখন সাড়ে সাতটায় দাড়িয়ে, এতক্ষণ একভাবে কাজ করে ঘাড় টা একটু যন্ত্রণা করছে, চোখদুটো ল্যাপটপ থেকে সরিয়ে ঘাড় টা এদিক ওদিক একটু ঘুরিয়ে নিল, অফিস একেবারেই ফাঁকা শুধু পিয়ন হরিশ সব টেবিল গুলো গুছিয়ে রাখছে। কুহেলি ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য উঠে দেখল আলেখের কেবিনে তখনও আলো জ্বলছে, কুহেলি ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসার সময় দেখল কেবিনে আর আলো জ্বলছে না। আলেখ চলে গেছে মনে করে নিজের ডেস্কের দিকে আসতে গিয়েই চমকে দাড়িয়ে পড়ল, আলেখ ওর সিটের কাছে দাড়িয়ে আছে। কুহেলি এগিয়ে আসতেই আলেখ বলল,

মিস বাসু, কতদূর এগোলেন?

অনেকটাই করে ফেলেছি স্যার, আজকের মধ্যেই হয়ে যাবে।

হুম, লাঞ্চ করেননি কেন?

কুহেলি একটু অবাক হয়ে বলল,

ম..ম্ম..মানে?

আলেখ ওর সেই স্বভাব সিদ্ধ হাসিটা হেসে বলল,

মিস বাসু, আমি আগেও বলেছি এটা আমার অফিস, এখানে কে কি করছে না করছে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।

কুহেলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল,

না, মানে ওই.. আসলে..

ইটস ওকে মিস বাসু, তাড়াতাড়ি আপনার ব্যাগটা গুছিয়ে নিন, উই আর রানিং লেট।

কুহেলি আরেক দফা অবাক হল, লেট! কিসের জন্য? কোথাও যাওয়ার কথা ছিল বলে তো মনে পড়ছে না, তাহলে? ওর মনের ভাবটা বুঝতে পেরেই হয়তো আলেখ বলল,

এত ভাবনা চিন্তা না করে চটপট নিজের ব্যাগ টা গুছিয়ে নিন।

কুহেলি আর কথা না বাড়িয়ে ওর ব্যাগটা গুছিয়ে নিল, যদিও ওর এখনও আরও কিছুক্ষণ কাজ করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু বসের অর্ডার উপেক্ষা করা যায় না। ব্যাগ গুছানো হয়ে গেলে আলেখ ওকে নিয়ে নীচে নেমে এল, তারপর ওকে ওয়েট করতে বলে গাড়ি আনতে চলে গেল। আলেখ ওর গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করতে ভালোবাসে, তাই ওর ড্রাইভার নেই। কুহেলি দাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল আলেখ ঠিক কি করতে চাইছে, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারল না। এরমধ্যেই আলেখ গাড়ি নিয়ে চলে এল, ওর সামনে গাড়িটা দাড় করিয়ে ওকে উঠে বসতে বলল, কুহেলি একটু ইতস্তত করছে দেখে আলেখ বলল,

কাম অন মিস বাসু, আমরা অলরেডি অনেকটা লেট হয়ে গেছি।

কুহেলি আলেখের পাশের সিটটায় উঠে বসতেই আলেখ গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে গেল, সারা রাস্তা একটাও কথা হল না। কুহেলির ভিষন ইচ্ছে করছে জানতে ওরা কোথায় যাচ্ছে কিন্তু জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না মনে করে চুপ করেই বসে থাকল। মিনিট কুড়ি ড্রাইভ করার পর একটা অপেক্ষা কৃত ফাঁকা জায়গায় আলেখ গাড়িটা থামাল, কুহেলি আশেপাশে তাকিয়ে দেখল এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুএকটা ছোট খাটো দোকান আর একটা ছোট রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছে। আলেখ গাড়িটা রেস্টুরেন্টের সামনেই দাড় করিয়েছে, হঠাৎ এরকম একটা জায়গায় আসার কি দরকার পড়ল সেটা কুহেলির ঠিক বোধগম্য হল না। আলেখ কুহেলিকে গাড়ি থেকে নামতে বলে নিজেও নামল, কুহেলিও নেমে এল। আলেখ চুপচাপ রেস্টুরেন্ট টার দিকে এগিয়ে গেল, কুহেলিও কিছু না বলে তাকে অনুসরণ করল। যখন ওরা দুজন রেস্টুরেন্টে ঢুকল, তখন প্রায় আটটা বাজে, একটা লোকও নেই সেখানে, একটা রেস্টুরেন্টে আটটার সময় লোক থাকবে না, এ যেন অবিশ্বাস্য। আলেখ কুহেলিকে নিয়ে একটা টেবিলে বসল, সব টেবিলই ফাঁকা, যেকোনো একটায় বসলেই হত কিন্তু আলেখ একটু পিছন দিকের একটা টেবিলে এসে বসল, কারনটা ঠিক কুহেলি বুঝতে পারল না। কিন্তু এখানে যে হঠাৎ করে কেন এল ওরা সেটা জানার কৌতুহল টা আর দমিয়ে রাখতে পারল না, শেষমেশ জিজ্ঞেস করেই ফেলল,

উম, স্যার.. আমরা এখানে কেন এসেছি?

আলেখ একটু হেসে বলল,

রেস্টুরেন্টে মানুষ কেন আসে মিস বাসু?

কুহেলি আবার অবাক হল, মনে মনে ভাবল,

মানে টা কি? এত তাড়াহুড়ো করে ওকে নিয়ে মিস্টার আলেখ শর্মা এই রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে এসেছেন! তা কীকরে হয়!! একজন সামান্য এমপ্লয়ীকে হঠাৎ করে উনি ডিনার ট্রিট দেবেনই বা কেন?

কুহেলির অবাক হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে আলেখ আবার হাসল।

রিল্যাক্স মিস বাসু, ব্রেনে এত প্রেসার দেবেন না। সকাল থেকে তো কাজই করছেন, বাড়ি ফিরেই তো আবার কাজ নিয়ে বসে পড়বেন, এই টাইম টুকু একটু রিল্যাক্স করুন। আর হ্যা, আগেও বলেছি, আবার বলছি নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রেখে চলবেন, সে যতই কাজের চাপ থাক। শরীরটাই যদি বিগড়ে যায় তাহলে কাজ করবেন কীকরে?

এই মুহূর্তে ঠিক কি উত্তর দেওয়া উচিত সেটা কুহেলি ভেবে পেল না, তাই চুপ করেই বসে থাকল। একটি মাঝবয়সি লোক এসে দুটো প্লেট গরম গরম ইডলি আর সম্বার দিয়ে গেল। আলেখ নিজের প্লেট টা টেনে নিয়ে বলল,

নিন, শুরু করুন। আমি খুব ভালো করেই জানি আপনি বাড়ি ফিরেই প্রজেক্টের কাজ নিয়ে বসে যাবেন, কালকে মিটিংয়ের আগে প্রজেক্টটা কমপ্লিট করতে গিয়ে খাওয়ার কথা মনেও আনবেন না। তাই এখানে নিয়ে এলাম, আমি চাই না কালকের মিটিংএ আপনি অ্যাবসেন্ট থাকুন।

কুহেলি এবার সত্যি ভিষন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, সঙ্গে বিস্মিতও হল। কুহেলির খুব ভালো মত মনে আছে ও যে কালকের মিটিংয়ের আগেই প্রজেক্টটা রেডি করে ফেলতে চায় সেটা ও আলেখ কেন, কাউকেই বলেনি, তাহলে আলেখ সেটা বুঝল কীকরে?

আলেখ পরম তৃপ্তিতে একটুকরো ইডলি মুখে দিয়ে চামচে করে একটু সম্বর মুখে দিতে দিতে বলল,

অত ভাবতে হবে না, এই একবছরে আপনার সম্পর্কে যতটা জেনেছি তাতে এটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। আর আপনি যে কালকের মধ্যে প্রজেক্টটা রেডি করে ফেলবেন তাতে আমার কোনও ডাউট নেই, আর সেইজন্যই ইচ্ছে করেই এখানে আনলাম। খাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি, তাই এটা নেগলেক্ট করবেন না।

বলে আলেখ আবার খাওয়ায় মন দিল, কুহেলির যেন আজ অবাক হওয়ারই দিন। ওর যোগ্যতার ওপর আলেখের আস্থা যেন ওর থেকেও বেশি, এটা দেখে কুহেলি মনে মনে খুশিই হল। আলেখ আবার খাওয়ার জন্য তাড়া দিল, কিন্তু কুহেলি খাবে কি, এমনিই ওর সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার ভালো লাগে না, তারমধ্যে এই ইডলি টা মোটেই ভালো লাগে না, সম্বর টা তাও খায় কিন্তু ইডলি… এখন কি করবে সেটা ভাবতে লাগল। অর্ডারও তো নিতে আসেনি, তখন না হয় বারন করতে পারত, কিন্তু এতো একেবারে সোজা অর্ডার ছাড়াই ডিশ হাজির হয়েছে। কুহেলি সম্বারের চামচটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল, ওকে না খেয়ে বসে থাকতে দেখে আলেখ খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,

ইজ এনিথিং রং মিস বাসু?

কুহেলি চমকে বলল,

না, না, এভরিথিং ইজ ফাইন।

কিন্তু আলেখ বুঝতে পারল হয়তো কুহেলি এগুলো খেতে ভালোবাসে না, সে বলে উঠল,

আপনি ইডলি সম্বর পছন্দ করেন না তাই না?

কুহেলি একটু আমতা আমতা করে বলল,

ন..নন..না মানে.. ওই..

সরি মিস বাসু, আমারই দোষ। আপনি কি খান না খান সেটা জেনে নেওয়া উচিত ছিল, ওটা মাথায় আসেনি, আসলে এখানে এসে আমাকে অর্ডার করতে হয় না, সেই ছোট বেলা থেকে এখানে আসি। এখানকার ইডলি সম্বর আমার খুব প্রিয়, আক্রম মিঞা তখন নিজে বানাতেন, খুব ভিড় হত সেসময়। এখন অন্যরা বানায়, ওনার বয়স হয়েছে এখানে নিয়মিত আসতে পারেন না। তবে এখানকার সবাই আমাকে চেনে, মাঝে মধ্যেই আসি তো, ঠিক এই টেবিলটাতেই বসি সেই শুরু থেকে। আমি কি খাই সেটাও এখানে সবাই জানে, তাই আজকেও অভ্যাস মতই ওরা ইডলি আর সম্বর নিয়ে এসেছে, আমারও খেয়াল ছিল না। সরি মিস বাসু, আপনি কি খাবেন বলুন আমি অর্ডার করছি।

এতক্ষণ কথা গুলো বলার সময় আলেখের চোখদুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, সেটা কুহেলির নজর এড়ায়নি, হয়তো পুরনো অনেক স্মৃতি ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে। কুহেলিকে বারবার সরি বলায় ওর কেমন যেন খারাপ লাগছিল, একেতে ওকে ডিনারে নিয়ে এসেছেন তার উপর সামান্য একটা কারণে ওকে সরি বলছেন। শেষে অন্য খাবার অর্ডার করার কথা বললেই কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

তার কোনও দরকার নেই, মিথ্যে কথা বলব না, আমি ইডলি ভালো খাই না, ইনফ্যাক্ট আমি সাউথ ইন্ডিয়ান কোনও ফুডই তেমন ভালো খাই না, তাই বলে একদম খেতেই পারব না এমন নয়।

বলেই একটুকরো ইডলি কেটে মুখে পুরলো কুহেলি, খাবার নষ্ট করা ওর একেবারেই পছন্দ নয়, তাই কষ্ট হলেও পুরোটা শেষ করল। আলেখ অবশ্য আরও কয়েকবার বলেছিল অন্য কিছু অর্ডার করার কথা কিন্তু কুহেলি শোনেনি। খাওয়া শেষ হলে আলেখ বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল, কুহেলিকে আবার গাড়িতে উঠতে বলে নিজে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। কুহেলি উঠে বসলে গাড়ি রওনা হল কুহেলির আপ্যার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে। আলেখ এখন আর কথা বলছে না, কুহেলি মনে করল ড্রাইভ করার সময় কথা বলা হয়তো সে পছন্দ করে না, কিন্তু ওকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আলেখ বলে উঠল,

আমার জন্য আপনার ডিনার টা আজকে ভাল হল না, খুব কষ্ট হয়ে গেল আপনার। সরি এগেইন।

প্লিজ স্যার, আপনি সরি বলবেন না, আর কষ্টের কি আছে? আপনি এখানে না নিয়ে এলে হয়তো খাওয়াটাই হত না আজকে, ভুলেই যেতাম।

বলে কুহেলি হাসতে লাগল, ওকে হাসতে দেখে আলেখও হাসল। কুহেলি এবার প্রশ্ন করল,

আচ্ছা স্যার, রেস্টুরেন্ট টায় একটাও কাস্টমার ছিল না কেন?

এখন আর আগের মত ভিড় হয় না, তাও যা হয় দিনের বেলায়, সন্ধ্যের দিকটায় এদিকে কেউ আসেনা তেমন, ওরাও তাই সাড়ে আটটার মধ্যে বন্ধ করে দেয়।

ও।

কুহেলি আর কিছু বলল না, চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল, এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখল দেবার্ঘ্য ফোন করছে, নামটা দেখে মনটা একটা অদ্ভুত খুশিতে ভরে গেল, কিন্তু এখন আলেখের সামনে কথা বলাটা উচিত হবে না মনে করে ফোনটা কেটে সাইলেন্ট করে আবার ব্যাগে রেখে দিল। আলেখ সেটা দেখে বলল,

আপনি কথা বলতে পারেন, কোনও প্রবলেম নেই।

ইটস ওকে স্যার, তেমন দরকারি নয়, বাড়ি গিয়ে কথা বলে নেব।

আধঘন্টা পর আলেখের গাড়িটা এসে কুহেলির আপ্যার্টমেন্টের সামনে দাড়াল, কুহেলি গাড়ি থেকে নেমে দাড়াল। আজ আর আলেখ নামল না, গাড়িতে বসেই বলল,

ওকে মিস বাসু, প্রজেক্টের কথা আর বললাম না, ওটা আপনি কমপ্লিট করে নেবেন আমি জানি।

কুহেলি উত্তরে শুধু একটু হাসল। আলেখ ওকে গুড নাইট জানিয়ে চলে গেলে কুহেলিও নিজের ফ্ল্যাটে চলে এল। খাওয়ার পর্বটা মিটে যাওয়ায় কুহেলির বেশ সুবিধাই হল, ঝটপট ফ্রেশ হয়ে এসিটা চালিয়ে সোজা ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেল। কাজ করতে করতে দেবার্ঘ্যকে ফোন করার কথা ভুলেই গেল, এমনকি সেই যে ফোনটা সাইলেন্ট করেছিল সেটাও নরমাল মোডে করতে ভুলে গেছে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ স্ক্রীনের ওপর আবার দেবার্ঘ্যর নাম ফুটে উঠল, কিন্তু ফোনটা আওয়াজ করে তার জানান দিতে পারল না, ফলে কুহেলির সেদিকে নজর গেল না। এদিকে দেবার্ঘ্য দুবার ফোন করার পরেও যখন কুহেলি রিসিভ করল না, তখন বুঝতে পারল নিশ্চয়ই আবার কোনও কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। কিন্তু ওর খুব খারাপ লাগতে লাগল, খুব ইচ্ছে করছিল কুহেলির সাথে একটু কথা বলার। যতদিন কুহেলির সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ ছিল না ততদিন বেশ ভালই ছিল কিন্তু তারপরেই সমস্যাটা শুরু হয়েছে। মাঝেমধ্যেই কুহেলির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে, অথচ এই কালকেই কিন্তু ওরা একসাথে ফিরেছে, কিন্তু দেবার্ঘ্য এর মধ্যেই কুহেলির সাথে কথা বলার জন্য আকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন যে কুহেলির সাথে কথা বলার আর কোনো উপায় নেই সেটা খুব ভালো করেই জানে, শেষে ফেসবুকে গিয়ে একটা মেসেজ সেন্ড করে ফোনটা রেখে শুয়ে পড়ল। কুহেলি যখন গোটা প্রজেক্টটা কমপ্লিট করল তখন দেড়টা বাজে, ফাইল আর ল্যাপটপ গুছিয়ে রেখে শোয়ার আগে ফোনটা হাতে নিতেই দেবার্ঘ্যর মিসডকল দুটো দেখতে পেল। হঠাৎ মনে পড়ল বাড়ি ফেরার সময়ও দেবার্ঘ্য ফোন করেছিল, ওকে ফোন করার কথাটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল, এখন অনেক রাত, কলব্যাক করার প্রশ্নই ওঠে না, কি মনে করে একবার ফেসবুকে লগ ইন করল, অনেকগুলো নোটিফিকেশনের মাঝে একটা চ্যাট হেড ভেসে উঠল। চ্যাট হেড টা ওপেন করতে একটা মেসেজ ফুটে উঠল স্ক্রীনে।

“এসেই বিজি হয়ে পড়েছ দেখছি, কাজের ফাঁকে যদি এই নগণ্য ব্যক্তিটিকে মনে রাখা যায় তাহলে একটু ভালোলাগবে। গুডনাইট।“

কুহেলির ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠল, চটপট কিপ্যাডে আঙ্গুল চালিয়ে একটা মেসেজ টাইপ করে সেন্ড করে দিল।

“কাজের চাপটা সত্যিই খুব বেশি, এইমাত্র কাজ শেষ করলাম। সরি আপনার কলটা তখন রিসিভ করতে পারিনি, আর পরে খেয়াল ছিল না। রাতেও টের পাইনি, ফোনটা সাইলেন্ট ছিল। কালকে রাতে কথা বলব, বাই, গুডনাইট।“

মেসেজ টা সেন্ড করে ফোনটা রেখে দিয়ে শুয়ে পড়ল কুহেলি। কালকে নিশীথ আগরওয়াল আসবেন, তার সামনে কোনও রকম ভুলভ্রান্তি হোক সেটা কুহেলি চায় না। বালিশে মাথা রাখার একটু পরেই ঘুম নেমে এল কুহেলির দুচোখ জুড়ে।

ক্রমশ____________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগছে এই গল্পটা? কুহেলি যথারীতি আবার নিজের কাজের মধ্যে ডুবে গেছে, দেবার্ঘ্য কি পারবে ওর জীবনে প্রেমের ছোয়া আনতে? নাকি কাজই কুহেলির প্রথম আর একমাত্র প্রেম হয়ে রয়ে যাবে? কি মনে হয় আপনাদের? কুহেলির জীবনে আলেখেরও বা কি প্রভাব পড়বে? প্রশ্ন অনেক গুলো, উত্তর আসবে ঠিক সময় মত। আপনাদের মতামত আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আপনাদের কমেন্টের অপেক্ষায় রইলাম। দেখা হবে আগামী পর্বে, ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here