সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১৪) লেখনীতে—ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১৪)
লেখনীতে—ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

২০.
অভ্র হোটেল রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে যে এত সুন্দর দৃশ্য দেখা যাবে সে কখনোই ভাবেনি। এই কনকনে শীতেও তার এই তীব্র বেগে ছুটে চলা বাতাসটি উপভোগ করতে বেশ লাগছে। প্রকৃতিতে মত্ত্ব হয়ে থাকা অভ্রর হুশ এলো পকেটের মধ্যে টিংটং শব্দ হওয়া। বোঝা গেল কল এসেছে ফোনটা পকেট থেকে বের করে হাতে নিতেই দেখে স্ক্রিনে সুন্দর করে “মা” নামটি ভেসে উঠছে। মুঁচকি হেসে কলটা রিসিভ করে কানে ঠিকিয়ে সুন্দর করে সালাম দিল সে।
“আসসালামু আলাইকুম মা! কেমন আছো?”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম, আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি বাবা। তুই কোথায় আছিস? কোনো খোঁজ খবর নেই যে! তুই ভালো আছিস তো!”

অভ্র মৃদু হাসে, মায়ের চিন্তা করার স্বভাবটা হয়তো আর কখনও যাবে না। না যাক! মা ছাড়া আর কে আছে যে আমাদের জন্য চিন্তা করে? সবার চিন্তা আর মায়ের চিন্তা এক নয়। আকাশ পাতাল তফাৎ!
-“আমিও আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই আছি। আসলে আমি আর নির্ঝর মিলে কক্সবাজার এসেছি। যেহেতু হাতে ছুটি আছে তাই একটু ছুটিটা ভালো ভাবে কাটাতে চাইছি।”

-“কখন গেলি? এহসানের বিয়ে তো কালকে ছিল। আজকে কক্সবাজারে তুই মানে! ওর বিয়েতে যাস নি?”

-“গিয়েছি তো! আমরা সকালেই কক্সবাজারের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছিলাম। আর বাকিরা সব ঢাকাতে। এহসানের রিসিপশন সেখানে হবে তো তাই।”

-“তোরা দুইটা যাবি না রিসিপশনে?”

-“আমরা না গেলে হবে নাকি? যাব তো! আমরা এখানে দুইদিন থেকেই তারপর ঢাকা ফিরছি। রিসিপশন মে বি শুক্রবারে রেখেছে।”

-“ও আচ্ছা। তা বউ কেমন? সুন্দর তো!”

অভ্র মায়ের এই প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। উত্তরটা দিতে কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে সে নিদ্রার সৌন্দর্য পরখ করতে গিয়ে নিদ্রার অনুভূতির অসম্মান করে ফেলবে আর এহসানের প্রতি অন্যায়। এমন হওয়ার মানে কী? মানে তো একটাই! নিদ্রার মনে যে তার জন্য অনুভূতি তৈরি হয়েছিল তাই। তবুও এই প্রথম অভ্র একটু নিদ্রার সৌন্দর্য পরিমাপ করে। সরাসরি কখনোই সে নিদ্রাকে তেমন একটা আগ্রহ ভরে দেখেনি। শুধু নিদ্রা নয় কোনো নারীকেই দেখেনি। তবে এখন তার নিদ্রার সেই সুন্দর মুখমন্ডলটি কল্পনায় থোরা থোরা মনে পড়ছে। হঠাৎ করেই তার মনে হলো নিদ্রা অসম্ভব সুন্দরী! অনেক! ছেলের উত্তরের দেরি হওয়াতে মুক্তা বেগম পুনারয় জিজ্ঞেস করল,
-“কীরে! বলছিস না কেন? সুন্দর না তাহলে!”

অভ্র তীব্র প্রতিবাদ করে বলে উঠল,
-“নিদ্রা সাধারণের মধ্যে অসাধারণ মা। খুব সুন্দর, খুব! তুমি যে ছোট বেলায় রাজকুমারের সুন্দর রাজকুমারীর কথা বলতে তেমন সুন্দর।”

-“বলিস কী! এত সুন্দর রাজকুমারী আমার রাজকুমারটার বউ হলেই তো হতো!”

অভ্রর বুক ধক করে উঠে। মা এসব কী বলছে? মা কী বুঝতে পারছেনা এইসব কথা অভ্রকে কতটা অপ্রস্তুত করে দিচ্ছে? অভ্র তাড়া দেখিয়ে বলল,
-“মা? রাতের খাবার তো এখনও খাওয়া হয়নি। নির্ঝর ডাকছে আমি গিয়ে খেয়ে আসি। তোমাকে পরে কল দেই?”

-“এখনো খাস নাই? জলদি যা! আর আজ কল দেওয়া লাগবেনা। মন খুলে ঘুরা ফেরা কর। এখনই তো একটু সময় পেলি। কাজ শুরু করলে ঐসব ইমার্জেন্সী ফেন্সীতে আর শ্বাসটাও নিতে পারিস না।”

অভ্র তার মা’কে সালাম দিয়ে কল কেটে দিল। এসব আলোচনা তাকে পুরো উলোট পালোট করে দিচ্ছে। সে রুমে ঢুকে দেখে নির্ঝর নেই। হয়তো তাকে ফেলেই চলে গেছে রেস্টরন্টে। সেও রুম লক করে বেরিয়ে পড়ে। বর্তমানে খুব ক্ষুদার্থ সে!

২১.
নিদ্রার অসহ্য লাগছে সবকিছু। সাংসারিক প্যারাময় জীবনটা তার একটুও ভালো লাগে না। আর এদের কাউকেই তার ভালো লাগছেনা। সবাইকে বিরক্ত লাগছে। সবচেয়ে বেশি অসহ্য লাগে এহসানকে আর এহসানের মা’কে। নিদ্রা ঠিক করেছে সে আর এখানে থাকবেনা। যেহেতু ভার্সিটি খুলে গেছে তাই তার অতিদ্রুত রাজশাহী ফিরে যেতে হবে। পারে না এখনিই চলে যায়! এহসান রুমে এসে নিদ্রাকে বলল,
-“এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কী ভাবছ?”

-“আপনার কোনো সমস্যা আছে আমি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে? আর আমি কী ভাবছি না ভাবছি তার কৈফিয়ত আপনাকে দিব কেন?”

এহসান মৃদু হেসে বলল,
-“আমাকেই তো দিতে হবে। আমিই তো এখন থেকে তোমার সব।”

-“মোটেও না! আমি আপনাকে কিছুই মনে করিনা।”

-“তুমি না করলেও আমি তো করি! তাতেই হবে।”

-“হবে না! কিচ্ছু হবে না। আমি অতি দ্রুত রাজশাহী ফিরে যাচ্ছি। আপনাকে আমার অসহ্য লাগে। আর তাও মাত্রাতিরিক্ত।”

-“তা তো আমি প্রথম থেকেই জানি। তবুও কিছুই করার নেই। আর তোমার পড়াশোনার ব্যাপারে আমি কোনো বাধা দিব না। তুমি মন দিয়ে পড়বে আমি সেটাই চাই। তো কবে যাচ্ছো? আমাকে আগে আগে জানিয়ে রাখবে কিন্তু। গাড়ির ব্যবস্থা করে দিব।”

-“আমার নিজের কি সামর্থ নেই নাকি? আমিই পারব নিজের ব্যবস্থা করে নিতে।”

-“তবে স্বামী হিসেবে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে তোমার প্রতি।”

নিদ্রা কিছু বলতে নিবে তার আগেই এহসান শক্ত গলায় বলল,
-“উহু! কোনো কিছু শুনতে চাইছিনা আর। আমি যখন বলেছি আমি ব্যবস্থা করে দিব তখন আমিই করব। তুমি শুধু এই শুক্রবার পর্যন্ত আমাকে সহ্য করে নাও। তারপর থেকে তুমি স্বাধীন থাকবে আই প্রমিজ!”

এহসানের এই শান্ত অথচ দৃঢ় কথাটা নিদ্রার কেন যেন হজম হলো না। তীব্র অধিকারবোধ থেকে লোকটা যা বলেছে তা নিদ্রাকে নাড়িয়ে দেয় ভেতর থেকে। কিন্তু বাহিরে সে অনুভূতি শূন্য হয়ে আছে। এহসান ঈগলের দৃষ্টিতে নিদ্রাকে একবার দেখেই হনহন করে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। নিদ্রা সেদিকেই তাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। এহসানের কথাটা তার কাজের সাথে বেমানান মনে হলো তার কাছে। তবে নিদ্রা তো এখনও এহসানের ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হয়নি। যদি হতো তবে বুঝে যেত এহসান এক কথার মানুষ। আর স্পষ্টভাষী! তাই তার কথার খেলাপ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

——————————–
নিহারীকা আর মৃত্যুঞ্জয় পাহাড়ের ওপাড়ের দৃশ্য দেখে নিয়েছে। এবং গোপন ক্যামেরা সেট করে এসেছে। মৃত্যুঞ্জয়ের ধারণা এইখানে অসাধু কিছু মানুষ আনাগোনা করে। তারাই জানে যে কোথায় আছে জমিদারের গুপ্তধন। মৃত্যুঞ্জয়ের রাগ হয়! তারা জমিদার বংশের হয়ে কেউই জানেনা যে কোথায় গুপ্তধন আছে কিন্তু এই চোর চামার গুলো সব জানে। আশ্চর্য! ভাগ্যিস এটা শুধু জানাতেই সীমাবদ্ধ আছে। যত মানুষই গুপ্তধনের হদিস পেয়েছে কেউই গুপ্তধনের ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি। কারণ একটাই! চাবি আর মূল ম্যাপ তো মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে। আর সবচেয়ে বড় কথা গোপন পথের যেই সুরক্ষা গুলো আছে সেগুলোর ব্যাপারে কারো কোনো আইডিয়া নেই। ম্যাপের মাঝখানে একটা অংশের কালি ভাজ পড়ে থাকার কারণে উঠে গেছে। তাই তো এখন এতদূর এসে তাকে বারবার পেছাতে হচ্ছে। পথে পথে একজন একজনের দরকার পড়ছে।

নিহারীকা সকাল আটটায় হোটেলে ফিরেছিল। রাতে খুব ঝুকিপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে এসেছিল। এখন প্রচন্ড টায়ার্ড! ফ্রেশ হয়েই সে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। দুই ঘন্টা পরই ইন্টারকম থেকে কল আসে নিহারীকা রিসিভ করতেই মৃত্যুঞ্জয়ের গলা শুনতে পায়। মৃত্যুঞ্জয় বলল,

-“নিহারীকা জলদি নিচে আসুন। আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট করব।”

নিহারীকা ঘড়ি দেখে নিল ১০:৫৭ বাজে। ১১ বেজে এসেছে অলরেডী এখন নাকি করবে ব্রেকফাস্ট! সে মৃত্যুঞ্জয়কে বলল,
-“একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দিবেন না? একেবারে লাঞ্চ করে নিব। আর আপনি আমার ফোনে কল না দিয়ে রুম সার্ভিসে কেন কল দিলেন?”

-“আপনার ফোন বন্ধ বলছিল তাই। আমি অপেক্ষা করছি। আপনি জলদি আসুন। একসাথে ব্রেকফাস্ট করব বলেছি যখন তখন করবই।”

নিহারীকার রাগ উঠে প্রচুর। তবে ঘুমের রেশ কেটে যাওয়ায় ক্ষুদার অস্তিত্ব জানান দেয় তার পেট। তাই মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলল,
-“আচ্ছা আসছি।”
জবাবে মৃত্যুঞ্জয় মুঁচকি হাসে।

২২.
অভ্র আর নির্ঝর খাওয়া শেষ করে উঠে যাবে এমন মুহূর্তে সেখানে নিহারীকা আর মৃত্যুঞ্জয় উপস্থিত হয়। অভ্রর চোখে তারা না পড়লেও নির্ঝরের চোখে ঠিকই পড়ে যায়। সে অভ্রর হাতে টোকা দিয়ে বলল,
-“ওটা নিহারীকা না? পাশে ছেলেটা কে!”

নির্ঝরের কথায় অভ্রও পেছনে ফিরে দেখে। নিহারীকা আর মৃত্যুঞ্জয় তাদের পেছনের একটি টেবিলেই বসেছে। তাদের দেখে অভ্ররও ভ্রুঁ কুঁচকে আসে। নির্ঝরের দিকে ফিরে বলল,
-“নিহারীকা যে সেটা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সাথের ছেলেটাকে আমি চিনবো কেমন করে? আশ্চর্য!”

নির্ঝর চেহারার ভাবমূর্তি পাল্টে বলল,
-“নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড হবে। এই ছেলের সাথেই তাহলে পালিয়েছে! আর যার মূল্য স্বরূপ আমার নিদ্রাকে এহসানের বউ হতে হলো! মেয়েটার প্রতি আমার কেন যেন খুব রাগ হচ্ছে আর ঘৃণাও! বিয়ে যখন করবেই না তখন আগেই বলে দিত। সকলের মান-সম্মান, অনুভূতি নিয়ে খেলার কোনো মানেই হয়না।”
শেষের কথাগুলোতে নির্ঝরের মনের একরাশ ক্ষোভ আর কষ্ট খুব করে প্রকাশ পায়। অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিহারীকাদের দিকে একবার তাঁকিয়ে আবারও চোখ সরিয়ে নেয়। আদেশের সুরে নির্ঝরকে বলল,
-“আমার নিদ্রা কথাটা আর কখনও বলবিনা। সে কখনোই তোর ছিল না আর এখনো নেই। সে এহসানের স্ত্রী। কষ্টকর হলেও সত্যি এটাই।”
নির্ঝরের বুকটা আবারও ভার হয়ে আসে। সে আর একদন্ড বসে থাকেনা সেখানে। দ্রুত কদম ফেলে চলে যায়। আর তখনিই নিহারীকার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে সেই একরাশ হতাশা আর কষ্ট বুকে জমিয়ে রাখা সুন্দর পুরুষটির দিকে। হঠাৎ করেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে।

#চলবে!
(আজকে বলতেই হবে কেমন লাগছে!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here