সিন্ধু ইগল – (১১)

সিন্ধু ইগল – (১১)
ইসরাত জাহান দ্যুতি

২৮
শত চেষ্টা করেও জায়িন জাদু আর মাধুকে চোখে চোখে রাখতে পারছে না। এদিকে রেজাও ব্যস্ত। তাই অতি দ্রুত হাতের কাজ অন্যদের বুঝে দিয়ে জায়িন জাদু আর মাধুকে সারা বাগান আর বাড়িতে খুঁজতে খুঁজতে রেজাকে কল করল। তারপর রেজাকে ডেকে পাঠাল বাগানে। সেখানে আসার পরই আচমকা দু’বোনের এক বোনকে চোখে পড়ল জায়িনের। খু্ব দূর থেকে চিহ্নিত করা মুশকিল, ওটা জাদু না মাধু। এর মাঝেই রেজা এসে জায়িনের পাশে উপস্থিত হলো। তখন রেজারও চোখে পড়ল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জাদু অথবা মাধুকে। একটা পরিবারের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে সে। রেজাও জায়িনের মতো জহুরি চোখে চেয়ে চেনার চেষ্টা করছে তাকে। কিন্তু রীতিমতো তার মাথা গুলিয়ে গেল। অধৈর্য হয়ে বিরক্তি কণ্ঠে বলল, ‘ধুরঃ! এই দু’জনকে দূর থেকে চেনার উপায়টা কী বলুন তো স্যার? আমার রাগ হয় ভীষণ ওদের চিনতে না পেরে।’

এই মুহূর্তে জায়িন ওর থেকে দূরে বলেই সেও বলতে পারছে মেয়েটি জাদু না কি মাধু? তবে তার মুখের হাসিটা ধরে রেখে রেজাকে বলল, ‘চলো এটা আমাদের কাছে একটা ধাঁধা। তুমি গেস করে বলবে ও জাদু নাকি মাধু। যদি তোমার গেস সঠিক হয়, তাহলে তুমি তোমার একটা ইচ্ছা প্রকাশ করবে আমার কাছে। আমি সেটা পূরণ করব।’
রেজা যেন দারুণ মজা পেল তার স্যারের বাচ্চাসুলভ কথাগুলোতে। অতি উৎসাহের সাথে সে দেখতে থাকল দূরের মেয়েটিকে। হঠাৎ তার মুখ চিন্তিত হয়ে উঠল। আশেপাশে নজর বুলিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলল, ‘স্যার, লক্ষ করেছেন? ওদের দু’বোনের মধ্যে একজন কিন্তু অনুপস্থিত।’
জায়িনও খেয়াল করল ব্যাপারটা, ‘হুঁ, এদের দু’জনকে এক সঙ্গে ধরা বা পাওয়া খুব মুশকিল।’
-‘আচ্ছা আপাতত এই ধাঁধাট সমাধান করি। আমার মন বলছে ওটা মাধু।’
-‘যুক্তিসমেত কারণ বর্ণনা করো।’
রেজা হেসে ফেলল জায়িনের কথার ভঙ্গিমাতে। যেন ক্লাস টিচার জায়িন। আর সে টিচারের কাছে পরীক্ষা দিচ্ছে। তারপর উত্তর দিলো, ‘যেহেতু দু’জনই একইরকম দেখতে, তো সেই মতে একজন থাকবে সব সময় সিক্রেট হিসেবে। ওদের প্ল্যানটা এরকম, সবার সামনে ফেস করবে একজন। আর ভেতরে থাকবে আরেকজন। যাতে বিপদ মুহূর্তে সেই ভেতরের ব্যক্তিটি আরেকজনকে যথা সময়ে সেফ করতে পারে। ওদের দু’জনের পার্সোনালিটি বিচার করলে জাদুকেই আমার সেই সিক্রেট পার্সোন লাগে। একটু সাদাসিধা গোছের কিংবা এমন তার এই রূপটি মানুষ দেখানো। আর মাধুকে লাগে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন গম্ভীর মানুষ।’
জায়িন মিটিমিটি হাসল। তারপর বলল, ‘তাহলে তোমার মতে মাধুই আমার সেই প্রিয় মানুষ?’
রেজা আড়চোখে জায়িনকে একবার দেখল প্রশ্নটা শোনার পর। এই ব্যক্তিটির চেহারা পড়ার ক্ষমতা ওর নেই। তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে, সে ভুল বলেনি। কিছুক্ষণ দু’জনেই নীরবে তাদের ধারণামতে মাধুকে লক্ষ করল। হঠাৎ রেজা হেসে উঠতেই জায়িন মাধুর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকাল রেজার দিকে, ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল হাসার কারণ কী? রেজা হাসতে হাসতেই বলল, ‘এই প্রথম ঘরের কোণে ক্রিমিনাল পেয়ে আপনাকে চুপচাপ বসে থাকতে হচ্ছে৷ ব্যাপারটা আমাদের স্যার জানলে কী হবে বুঝতে পারছেন?’
জায়িনও হাসল, ‘ওরা প্রথমে আমার ব্যক্তিগত শিকার।তারপর না হয় ক্রিমিনাল। স্যারের স্যার চাইলেও জানতে পারবে না, যদি আমি না জানাই। কেননা স্যারের কাছে আমি ভীষণ বিশ্বস্ত। ওরা এত নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারছে এখনো, কী জন্য জানো? কারণ, ওদের সমস্ত ইনফরমেশন আমার কাছে। আমি চাইলে ওদের বাঁচাতে পারি, আবার এখনই ওদের মেরে দিতে পারি।’
-‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কী জানেন স্যার? এই মেয়েদু’টো ভেতরে ভেতরে বড়োসড়ো কোনো প্ল্যান ভেবে রেখেছে। নাহলে আপনার পরিচয় সম্পূর্ণ জানার পরও আপনার কাছেই থাকছে, আপনার সঙ্গে চলাফেরা করছে এত সহজভাবে। মানে মরণ পাশে নিয়ে ঘুমাচ্ছে ওরা প্রতিদিন।’
জায়িনের চোখের সামনে দিয়েই মাধু বাসার ভেতর চলে গেল। তখন জায়িন একটা চেয়ার টেনে বসে রেজাকেও ইশারা করল বসতে। জায়িন বলতে শুরু করল, ‘ওরা যদি এই বাংলোতে আসার আগে জানত যে শিকারির কাছেই ওরা বসবাস করছে তাহলে কি এখানে এসে ঘাপটি মারত? আজকে মনে হচ্ছে আমার এই ছদ্মবেশে দিনযাপন করা সার্থক। প্রতিটা দিন এই ছদ্মরূপ নিতে কতটা মেহনতি আর খিজালত পোহাতে হয় আমার, তা যদি একটু টের পেতে রেজা! আমার সম্পর্কে যাতে কেউ কোনোভাবে সঠিক ইনফরমেশন না পায়, তার জন্য বাড়ির বাইরে অধিকাংশ সময় কাটাতে হয়েছে। তবে খুব শীঘ্রই এই ছদ্মবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে চলেছি। আমার আব্বা আম্মাও ভাগ্যিস আমার অনুরোধটা রেখে কাউকে জানাননি আমার পরিচয়। কিন্তু আম্মা জাদুর ব্যবহারে কী করে যে গলে গেলেন, সেটাই ভেবে পাই না আমি। যে আমার নিষেধ সত্ত্বেও আমার পরিচয় জানিয়ে দিয়েছেন ওকে। মানতে হবে, মেয়ের এলেম আছে। আর এই যে এখন ওরা আমার বিষয়ে কোনো খোঁজ না নিয়ে নিশ্চয়ই বসে নেই? তারপরও দেখো আমার পিছু ঘুরছে৷ একজন তো আমাকে নেশা ভেবে নিয়েছে। যেন কলিজার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে পারলে বেশি খুশি হতো। আর আরেকজন অতি বুদ্ধির সাথে সব সময় দূরে দূরে থাকছে আমার থেকে। এমন মুহূর্তে ওরা আমার পরিচয় জেনেছে, যখন আর চাইলেও এখান থেকে নড়তে পারছে না। পুলিশের সামনে যত ভয় পেয়ে চলবে, তত বেশি ফেঁসে যাবার আশঙ্কা। তাই ওরা এত সহজভাবে আমার সঙ্গে মিশছে। যাতে আমি ওদের ওপর কোনো সন্দেহ না করি। তবে এটা তুমি ঠিকই বলেছ। কোনো প্ল্যান না ভেবে তো আর এমন নিশ্চিন্তে আমার পাশে বসবাস করছে না। মজার বিষয় এটাই। আমিও যেমন না বোঝার ভান করে ওদের সঙ্গে চলছি, ওরাও ঠিক সেভাবেই চলছে আমার সঙ্গে। কিন্তু জাদুরানি যে অলমোস্ট ফেঁসে গেছে। তার আর পালানোর উপায় নেই। শুধু হার মেনেছি এক জায়গায়৷ এই বাংলোটা যে কিনেছে, তাকে যদি নাগালে পেতাম! কোন দেশে গিয়ে পড়ে আছে কে জানে। ওকে পেলে তোমাকে আর কষ্ট করে লন্ডন গিয়ে খোঁজ নিতে হতো না।’
-‘সেই মানুষটিও কিন্তু একজন মেয়েই। এই মেয়েদের মাথা এমন ডেঞ্জারাস হয় কীভাবে?’
জায়িন নিশ্চুপ। রেজাই বলতে থাকল, ‘আমার প্রশ্ন অন্যখানে স্যার। এই দু’বোনের টিম যে আপনার বাড়ির আশেপাশেই অবস্থান করছে তা তো নিশ্চিত। কিন্তু সেদিন আপনাকে অ্যাটাক করার পর জাদু…না না মাধু! ধুরঃ! যে-ই হোক, আপনাকে সে হেল্প করল কেন? মানে আপনাকে মারাই তো ওদের মেইন উদ্দেশ্য।’
-‘সেদিন ওর জন্য আমার চোখে যা ছিল। ঠিক আমার জন্যও ওর চোখে আমি তা-ই দেখতে পেয়েছি।’
-‘ভালোবাসা?’
-‘হয়তো। কিংবা গভীর টান। সেদিনের পর থেকে আমাকে কতটা সাবধানে থাকতে হচ্ছে, তা তো দেখতেই পাচ্ছ। আব্বা, ভাইয়া, সবার সাথে চব্বিশ ঘণ্টা বডিগার্ড রাখতে হচ্ছে। এই চক্রটা আমাকে প্রচুর ভোগান্তি দিচ্ছে। আমার পরিবারের ওপর দিয়ে ঝড় গেলে এই দু’বোনের অবস্থা আমি কাহিল করে ছাড়ব।’
-‘এই ভোগান্তি তো আপনি নিজেই পোহাচ্ছেন। হাতের কাছে সর্বক্ষণ পেয়েও ছেড়ে রাখছেন।’
তাচ্ছল্য প্রকাশে সামান্য হেসে বলল জায়িন, ‘আমার হাতে আসার পর ওরা কি আর মুক্ত জীবন পাবে রেজা? হয় মরতে হবে, নয় সারাজীবন বন্দি থাকতে হবে। একটু উপভোগ করুক ততদিনে, এই সুন্দর মায়া ভরা পৃথিবীটাকে।’
কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়াল সে, ‘যাই। সুন্দরীর থেকে একটু আদর নিয়ে আসি। তুমি থাকো। আর চোখ কান খোলা রেখো সব সময়।’

বাসার ভেতরে চলে এল জায়িন৷ চারপাশে নজর বুলিয়ে মাধুকে খুঁজল। অবশেষে চোখে পড়ল ওকে। তার সামনে দিয়েই ছোটো একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে করতে যাচ্ছিল। দু’জনের চোখাচোখিও হলো। কিন্তু মাধুকে দেখে যেন মনে হলো জায়িনকে এড়িয়ে চলতে চায়৷

ওপরে উঠছে মাধু, বাচ্চা মেয়েটিকে সঙ্গে করে। জায়িনও আর দাঁড়িয়ে থাকল না। মাধুর পিছু পিছু এসে নিজের ঘরের সামনে দাঁড়াল। মাধুর তা খেয়াল হলো না। চারপাশে একবার সাবধানী চোখে নজর বুলিয়ে নিলো জায়িন। মাধু তার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেই আচমকা ওর হাত টেনে নিয়ে এল ওকে ঘরের মাঝে। তবে বিস্ময়কর কাণ্ড ওখানেই শেষ নয়। মাধু নিজেকে সামলে ওঠার আগে ওই মুহূর্তেই জায়িন মাধুর ওষ্ঠে চুমু খেতে ঝুঁকে পড়ল। কিন্তু সেই সময় অবাক করা বিষয়ের মুখোমুখি হলো জায়িন। এত দ্রুত মাধু নিজের ঠোঁটের ওপর হাত মেলে দিলো যে, জায়িনের চুমু পড়ল ওর হাতের পিঠে। তারপর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘আমি জাদু নই।’
কথাটা শুনে জায়িন কয়েক সেকেণ্ড সরু চোখে ওর ঠোঁটের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ হেসে উঠল। সরে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হ্যাটস অফ! জবাব নেই তোমার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার।’
কাঠ হয়ে মাধু তাকিয়ে রইল তখন জায়িনের দিকে। জায়িন অবশ্য ওর শক্ত মুখের দিকে চেয়ে ফিচেল হাসতে থাকল। আর বলল, ‘আমার অ্যাটাকের যে কুইকনেস ছিল তাতে তোমার জায়গায় আমি হলেও এত চমৎকারভাবে বিপরীত ব্যক্তিটাকে আটকাতে পারতাম না।’
-‘আমি আশা করেছিলাম তুমি স্যরি বলবে।’
জায়িন তখন ওর কাছে এগিয়ে এসে কানেকানে বলল, ‘আর আমি আশা করেছিলাম তুমি ধরা দেবে।’
মাধু ঠিক কী বলবে তা ভেবে পেল না। তবে জায়িন থেমে রইল না, ‘আমি এও আশা করেছিলাম তুমি ঠিক বুঝবে।’
-‘কী বুঝব?’
জায়িন এবার কিছুটা গম্ভীরতা ধরে বলল, ‘কিছু না। এভাবে বারবার ভুল হতেই থাকবে। তার থেকে বরং তোমরা দু’বোন গলাতে লকেট ঝোলাও। যার যার নাম লকেটে লিখে রাখবে।’
হেসে ফেলল মাধু, কথাটা শুনে। কিন্তু জায়িনের গম্ভীর মুখটাতে আর হাসি দেখা গেল না। কেমন একটা রাগ চেহারায় চেয়ে রইল ওর দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বোন কই?’
-‘ওর ভালো লাগছে না। বাসায় চলে গেছে।’
-‘ছাদে যাবে?’
মাধু প্রশ্নচোখে তাকাল তখন ওর দিকে। জায়িন উত্তর দিলো, ‘একটু সময় কাটাতে মন চাইছে তোমার সাথে। যদি তোমার আপত্তি না থাকে।’
-‘আমি আসলে আন্টির রিকুয়েষ্টেই আছি এখনো। ওনাকে না বলে যেতেও পারছি না। এদিকে আন্টিকে খুঁজেও পাচ্ছি না৷ মানুষের সমাগম আমার ঠিক অতটা পছন্দ না।’
-‘এ জন্যই ছাদে যেতে চাইছি।’
মাধু আর কথা বাড়াল না। তবে জায়িনের কথাও মেনে নিলো না। উত্তরে ঠোঁটের একপেশে হাসিটা ওকে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর জায়িন থমথমে চেহারাটা ধরে চেয়ে রইল মাধুর যাবার পথে।

২৯
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। জাদুর মতোই মাধুও আজ-কাল হাসিখুশি থাকে সব সময়। তার মুখের সেই গম্ভীর ভাবখানা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জাদু তার বোনের এই পরিবর্তিত রূপ দেখে খুব আনন্দিত। জায়িনের পরিবারে এখন জাদুর থেকেও মাধুর আসা যাওয়াটা বেশি হয়। আর জাদু আগের মতোই দিনের অধিকাংশ সময়টা বাসায় পার করে ঘুমিয়ে। জায়িনেরও ওদের বাংলোতে আসা-যাওয়ার পরিমাণটা বেড়েছে। তবে তা রাতের বেলাতে। এই দু’বোনের মাঝে একজনের সঙ্গে তার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা দিনকে দিন যেমন বেড়েই চলেছে, তো অন্যদিকে আরেকজনের সঙ্গে দেখাটাও হয় না তার খুব একটা৷ রেজা এখনো মাঝেমাঝে বিভ্রান্তে পড়ে যায় এই ভেবে, জায়িনের সঙ্গে সম্পর্কটা এগোচ্ছে ঠিক কার সাথে? জাদু না মাধু? জায়িনও যেন তার কাছে দুই বোনকে এই চিনতে পারার ব্যাপারটা নিয়ে রহস্য করে রেখেছে। শুধু এটুকু বুঝেছে সে, এই দু’বোনের দুর্দিন শুরু হতে খুব বেশি দেরি নেই। এক ভয়াবহ খেলায় এবার নেমেছে যে জায়িন। যা গত সাত বছরের মাঝেও রেজা দেখেনি তার স্যারের মাঝে।

জাদু আজ দিনের সারা বেলা ঘুমিয়েও তার মনে হচ্ছে ঘুম পুরোপুরি হয়নি। সন্ধ্যা হওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে সে ঘুম থেকে জেগে ফ্রেশ হয়েছিল। কিন্তু তাতে এক ফোঁটাও লাভ হয়নি। ঝিমুনি ভাব একেবারেই কাটেনি তার। এদিকে ক্ষুদাও পেয়েছে ভীষণ। মাধু খুব সকালেই সকালের নাশতা আর দুপুরের খাবার একবারে তৈরি করে ভার্সিটি চলে যায়। ফ্রিজ খুলে সে দেখল, তার জন্য বরাদ্দকৃত দুপুরের খাবারটা পড়ে আছে৷ তা বের করে গরম করারও প্রয়োজনবোধ করল না৷ টেবিলে বসে ঠান্ডা খাবারটাই কোনোরকমে খেয়ে আবার গিয়ে শুয়ে পড়ল। সেই ঘুম তার ভাঙল রাত আটটায়। কর্টইয়ার্ডে এসে দাঁড়িয়ে দু’হাত টানটান করে আলস্য ছেড়ে বাংলোর চারপাশে চোখ বুলাল। বুবনকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আবার মাধুও এখন অবধি ফেরেনি। হয়তো জ্যামে আটকা পড়েছে৷ হেঁটে হেঁটে লনের দিকটাই এগোতে থাকল৷ কিছু সময় ওখানে হাঁটাহাঁটি করবে বলে। কিন্তু যত এগোতে থাকল, তত জাদুর কানের বাজতে থাকল কোনো পুরুষ কণ্ঠ। কারও সঙ্গে মজার ছলে কথা বলছে সেই পুরুষ কণ্ঠটি। কাছে এই মুহূর্তে তার আত্মরক্ষা করার জন্য কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু তবুও সে এমন অবস্থাতেই কোনো শত্রুকে ঘায়েল করতে পারবে। এমন একটা আত্মবিশ্বাস আছে তার মাঝে।

খুব সাবধানে এগিয়ে এসে থমকে গেল তার পা। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সামনে বসে থাকা বুবনের দিকে। যে এই মুহূর্তে জায়িনের সঙ্গে বসে খেলা করছে। প্যান্টের পকেটে দু’হাত পুরে দাঁড়াল এবার জাদু। ঠোঁটের কিনারে তার কিঞ্চিৎ মৃদু হাসি। আর চোখের দৃষ্টিতে কেমন তাচ্ছল্য প্রকাশ৷ জায়িন তখনো টের পায়নি তার আগমন। ওর উদ্দেশ্যে জাদু জিজ্ঞেস করল, ‘কখন এসেছ?’ ঘুম থেকে কিছু সময় পূর্বে জেগেছে বলে জাদুর কণ্ঠ শোনাল ভাঙা আর মোটা স্বরের মতো।

বুবনকে নিয়ে ঘাসের ওপরই বসে ছিল জায়িন। জাদুর কণ্ঠে পিছু ফিরে কয়েক মুহূর্ত নিরবে তাকিয়ে থেকে আবার বুবনের দিকে তাকাল, বলল, ‘তা জেনে আর তোমার কী আসে যায়?’

জাদু একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হাসতে থাকল নিঃশব্দে। জায়িন আবার তার দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এসে বসতে পারো। না কি দাঁড়িয়েই থাকার ইচ্ছা?’
-‘আমার ঘুমটা একটু বেশিই। সেটা খুব সহজে ভাঙে না। আর যদিওবা ভাঙে, তা পেটের দায়ে।’
-‘তাহলে কি এখন তোমার ঘুম ভেঙেছে ক্ষুদায়?’
-‘হুঁ, সন্ধ্যায় হালকা পাতলা খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম আবার। কিন্তু কাজ হয়নি তাতে। তাই ঘুম ভেঙে গেছে।’
জায়িন এবার উঠে এল বুবনকে ছেড়ে। মুখটা গম্ভীর করে এসে দাঁড়াল জাদুর মুখোমুখি। কিছুক্ষণ জাদুর মৃদুহাস্য চেহারাটার দিকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘শরীরের ক্ষতগুলোর কী অবস্থা? একদম শুকিয়ে গেছে না এই ক’দিনে?’
টানটান একটা হাসি দিয়ে জাদু বলল, ‘কোনো ক্ষত নেই আমার শরীরে।’
জায়িন গম্ভীর হয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘দাগগুলো তো রয়ে গিয়েছে।’
জাদুও আগের মতোই হেসে জবাব দিলো, ‘তুমি কি চিন্তিত আমার শরীরের দাগগুলো নিয়ে?’
চকিতেই জবাব দিলো জায়িন, ‘উহুঁ, তোমাকে নিয়ে।’
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে জাদু মুখের ওপর হাতটা নেড়ে বলল, ‘আমার জন্য চিন্তা করা তোমাকে মানায় না। তোমাকে মানায় দেশকে নিয়ে ভাবা।’
-‘দেশকে নিয়ে যারা ভাবে, তাদের কি বউ নেই? না কি তাদের বিয়ে হবার সম্ভাবনা নেই? যে শুধু দেশ নিয়েই ভেবে যাবে?’
-‘আমিও এটাই বলছি। দেশ, বউ আর বউ, দেশ, এদের নিয়ে চিন্তা জায়িন মাহতাবের জন্য। জাদুকে নিয়ে চিন্তা জায়িন মাহতাবের জন্য নয়।’
জায়িন এ কথার জবাবের বদলে জাদুর ডান হাতটা হঠাৎ দু’হাতের মাঝে তুলে নিলো। বেশ বিস্ময়কর একটি কাণ্ড ঘটাল সে এরপর। জাদুর হাতের তালুতে অসংখ্য চুমু খেয়ে হাতটা বুকের মাঝে ধরে বলল, ‘নিজেকে লোহা ভেবো না। স্বয়ংসম্পূর্ণও ভেবো না নিজেকে। ভুলে যেয়ো না, তোমাদের জন্মই হয়েছে পুরুষ জাতির অর্ধাঙ্গীনি হওয়ার জন্য। আমি ছাড়া তুমি সম্পূর্ণ নও।’

জাদু কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু জায়িনের কার্যকলাপ দেখছিল। ওর কথাগুলো শুনে হঠাৎ মিটিমিটি হেসে বলল, ‘ইনডিরেক্টলি প্রপোজ করে বসলে?’
জায়িনও এবার মুচকি হেসে বলল, ‘আমি তোমাকে প্রপোজই করিনি৷ শুধু আমার অধিকারবোধ থেকে বললাম। তোমাকে প্রপোজ করার মতো কিছু নেই। কারণ, তোমার প্রতি অধিকার আমার আজকের নয়।’
-‘খুব বেশিদিনেরও নয়। মাসখানিক হয়েছে, তাই না?’
উত্তর দিলো না জায়িন৷ হাসতে হাসতে বলল, ‘রান্না তো জানো না। বোন আসবে, তারপর এসে কখন রান্না করবে, ততক্ষণ অভুক্ত হয়ে বসে হয় বই পড়বে চশমা চোখে নিয়ে, নয় ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে থাকবে। তো তোমাকে অভুক্ত থেকে মুক্তি দানের জন্য এই মুহূর্ত থেকে আমি তোমার ব্যক্তিগত শেফ হয়ে গেলাম। চলো, যা খেতে চাইবে তাই-ই রেঁধে খাওয়াব।’
কথাগুলো বলেই জাদুর গাল টেনে এগিয়ে গেল সে ঘরের দিকে।

মাধু বাসায় চলে এলো রাত সাড়ে আটটার কিছু সময় পর। আসার পরই শুনতে পেল রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ। জাদু এক কফি করা ছাড়া রান্নাঘরে কখনোই পা রাখে না। কিন্তু শব্দ শুনে মনে হলো না তার, কফি করার জন্য ঢুকেছে জাদু। জাদু করছে রান্নাবান্না, এ দৃশ্য দেখলেও যে মাধুর বিশ্বাস হবে না। তবে বুঝতে পারল, ক্ষুদার যন্ত্রণায় তার বোনটা আজ রান্নাঘরে ঢুকেছে। হাসিও পেল তার। ঘরে ঢুকে দ্রুত ফ্রেশ হয়েই চলে এল সে রান্নাঘরে। চমকে গিয়ে সে মৃদু চিৎকারে ডেকে উঠল, ‘জায়িন!’

হাতে খুন্তি নিয়ে জায়িন ফিরে তাকিয়ে ঘর্মাক্ত চেহারায় মলিন হাসি দিলো মাধুকে। তারপর অভিযোগের সুরে বলল, ‘তোমার বোন এতটা সেলফিশ কেন মাধু? তার জন্য রান্না করতে এলাম। ভাবলাম ওর সাথে গল্প করতে করতে রান্নাটা করে দেবো। কিন্তু ও কী করল জানো? কিছুক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো করে দু’তিনবার হামি ছেড়ে বলল, “আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না বুঝলে? ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। তুমি রান্নাটা শেষ করে বরং আমাকে ডেকে দিয়ো। ততক্ষণে মাধুও চলে আসবে। তারপর আমরা এক সঙ্গে বসে ডিনার করব।” আমি গরমে অস্থির হয়ে গিয়েছি মাধু। প্লিজ, একটু বাতাস করো।’
জায়িনের কথা শুনে আর তার বলার ধরন দেখে মাধু হাসতে হাসতে ক্যাবিনেটের সঙ্গে হেলে দাঁড়াল। হাসি থামলে বলল, ‘তুমি আমার ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। আমি রান্না শেষে ডেকে দেবো তোমাদের দুজনকে।’
জায়িন লাফিয়ে উঠে বলল, ‘নেভার। রান্নার সম্পূর্ণ ক্রেডিটটাই আমার থাকবে। তোমাকে যেটা বললাম সেটা করো প্লিজ।’
-‘ওকে, একটু অপেক্ষা করো।’

রাতের রান্নাটা ওরা দু’জন এক সঙ্গেই তৈরি করল। রান্না শেষে মাধু জায়িনকে তার ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হতে বলে জাদুকে ডাকার জন্য যেতে চাইলে জায়িন তাকে বলল, ‘তুমি আসার পর তো শাওয়ার নিতে পারোনি নিশ্চয়ই। তুমি বরং গিয়ে শাওয়ারটা নিয়ে নাও। আমি জাদুর রুমে যাচ্ছি। আমিই ডেকে তুলছি ওকে।’

মাধুর খুব একটা ভালো লাগল না জায়িনের কথাগুলো। না চাইতেও চলে যেতে হলো তাকে নিজের ঘরে। জায়িনের একটা জিনিস সে লক্ষ করেছে, জাদুর প্রতি সে খুবই যত্নশীল। জাদুর সামান্য বিষয়েও ওকে অস্থির দেখায়। খুব আগলে রাখতে চায় সে জাদুকে। মনেই হয় না, জাদুকে সে কিছুদিন হলো চেনে।

ঘরে এসেই জায়িন দরজাটা আটকে দিয়ে জাদুর কাছে এল। বিছানার একেবারে এক কোণে এসে হাত একটা বিছানার নিচে নামিয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে জাদু। বাইরের এক ছটা আলো জানালা দিয়ে ঘরে এলেও ঘরটা এক প্রকার অন্ধকারই। জায়িন ঘরের আলো না জ্বেলে ল্যাম্পশেডটা জ্বালিয়ে দিলো। তারপর নিচে হাঁটুতে ভর ফেলে জাদুর মুখের সামনে বসে স্বগোতক্তি করে উঠল, ‘তোমার অত্যাধিক সৌন্দর্য এই ঘুমের মাঝেই জাদু। তোমাকে এখন অবধি আমার দুইভাবে দেখতে ভালো লাগে। তোমার হাসি হাসি মুখটা, আর তোমার নিদ্রারত মুখটা। ভাবছি, তোমার পাওনা শাস্তিটা তাহলে তোমার ঘুমন্ত অবস্থাতেই দেবো। তবে ঘুম ভাঙার পর কিন্তু অবশ্যই হাসতে হবে। যন্ত্রণায় কান্না করলে কিন্তু রেগে যাব ভীষণ।’

________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here