#সুইটহার্ট
#Sohani_Simu
১১.
স্কুল থেকে বের হয়ে আমি আর হেমা রিক্সা নিয়ে পার্কে এসেছি।ড্রাইভার চাচা আমাকে নিতে এসেছিল কিন্তু আমি চাচাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।আজকে আমার মন ভাল নেই।হঠাৎ করেই মনের এক ভয়ানক অসুখ হয়েছে।কেন যেন আমার মনে হচ্ছে আমি একা,কেউ নেই আমার।স্কুল শেষে হেমাকে বললাম কিছু ভাল লাগছেনা তাই হেমা বলল পার্কে যেয়ে লুৎফর মামার স্পেশাল ফুচকা খেলে মন ভাল হয়ে যাবে।
এক প্লেট ঝাল ঝাল ফুচকা শেষ করে চোখ আর নাক দিয়ে পানি পরা শুরু হয়ে গেছে,কান দিয়েও মনে হচ্ছে গরম বাতাস বের হচ্ছে।ঝালের চোটে আমার মাথা কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে।হেমারও একই দশা।পানি খেয়েও কমছে না।তাই দৌঁড়ে একটা দোকানে যেয়ে আইসক্রিম নিয়ে খেলাম।এখন একটু সস্তি লাগছে।আরেকটা আইসক্রিম হাতে নিয়ে আমরা যেয়ে পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটের শেষ সিঁড়িটায় বসলাম।কেডস আর মোজা খুলে পানিতে পা ডুবিয়ে আইসক্রিম শেষ করলাম।তারপর আবার জুতো পরে পার্কের সরু রাস্তা দিয়ে দুজন দুজনার কাঁধে হাত রেখে হাঁটা দিলাম।কোথায় যাবো জানিনা শুধু জানি সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরবো।পুরো পার্ক চষে বেড়িয়ে আমরা রাস্তায় বের হলাম।ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে হেমা বলল,
“দোস্ত,তোকে আজ খুব শান্ত আর ভদ্র দেখাচ্ছে।কি হয়েছে তোর?”
আমি একটা ছোট দম ছেড়ে মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,”জানিনা,আমি মনে হয় আর বেশি দিন বাঁচবো না।মরার আগে ভদ্র হতে হবে নাহলে সবাই বলবে জাহিদ হাসানের অভদ্র মেয়েটা মারা গেছে।”
হেমা হাঁটা থামিয়ে ভীত কন্ঠে বলল,”কেন?কি হয়েছে?এক্সামের টেনশনে মরে যাচ্ছিস নাকি?”
আমিও হাঁটা থামিয়ে উদাস হয়ে বললাম,”এক্সাম তো অনেক দেরি মরার আগে এস.এস.সি. পাশের সার্টিফিকেটও পাবোনা,ফিলিং কষ্ট!
হেমা আমার হাত ধরে বিরক্ত হয়ে বলল,”কি তখন থেকে মরা মরা করছিস,কেন মরবি তুই?”
আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,”কেন মরবো না আমি?আমাকে কেউ ভালোবাসেনা।বাবা আর ভাইয়ার সাথে কথায় হয়না,সারাদিন রাত ওরা কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তোর তাও আম্মু আছে,শত ব্যস্ততার মধ্যেও তোকে সময় দেই আমার তো আম্মুও নেই।এই যে তুই এতক্ষণ বাসায় যাসনি তোর আম্মু নিশ্চয় টেনশন করছে আর আমার বাসায় কেউ টেনশন করছেনা।এসব ভেবে ভেবেই তো আমার বুক ব্যাথা করে,নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।এরকম হতে হতেই একদিন মরে যাবো।”
হেমা আমার একবাহু জড়িয়ে ধরে বলল,”সবাই তোকে অনেক বেশি ভালোবাসে।”
আমি মন খারাপ করে বললাম,”কাল রাতে ডিনার করিনি,সকালে ব্রেকফাস্ট না করেই স্কুলে এসেছি এখন বিকেল হয়ে গেছে তাও কারও কোন চিন্তা নেই।তুই বল,আমার কেউ আছে?”
হেমা কিছু বলল না।এক্সাম নিয়ে আলোচনা করতে করতে দুজন হেঁটে হেঁটে অনেকটা রাস্তা চলে আসলাম।এখন আমাদের রাস্তা আলাদা হবে।আমি একটা রিক্সা নিলাম হেমা একটা রিক্সা নিল তারপর দুজন দুদিকে চলে গেলাম।রিক্সায় খুব বিরক্ত লাগছিল তাই কিছুদূর যেতেই রিক্সা থেকে নেমে হাঁটতে থাকলাম।পড়ন্ত বিকেলে লোকজনের ভীরের মধ্যে হাঁটতে ভাল লাগছে।হাঁটতে হাঁটতে ইভানা আপুর সাথে দেখা।আপু আমাকে দেখেই বলল,
“কি ব্যাপার জুঁই?তুমি এখন এখানে কেন?আমি তোমার জন্য ওয়েট করে ফিরে আসলাম।”
আমি কৌতুহুলি হয়ে আপুকে বললাম,”বাসায় সবাই কি করছে?আমাকে নিয়ে খুব টেনশন করছে?ওরা খুঁজছে আমাকে?”
আপু আমার গাল টেনে বলল,”নারে বুড়ি, খুঁজবে কেন?তুমি তো বলেছো ফ্রেন্ডের সাথে পার্কে গিয়েছো।আচ্ছা তাড়াতাড়ি বাসায় যাও একটু পরই সন্ধ্যা হয়ে যাবে,আমাকেও হলে ফিরতে হবে।”
আপু আমাকে বাসায় যেতে বলে হেঁটে চলে গেল।আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এক দৌঁড়ে আপুর কাছে যেয়ে বললাম,”এই ইভানা আপু?আমিও যাবো তোমার সাথে প্লিজ।আজকে আমি তোমার সাথে হলে থাকবো।”
আপু কিছুতেই রাজী হলোনা।হাজারটা অযুহাত দেখাতে লাগলো।আমিও নাছোড় বান্দা হয়ে আপুর সাথে লেগে থাকলাম।অবশেষে আপুর সাথে ভার্সিটির হলে চলে আসলাম।এখানে এসে দেখি অনেক মেয়ে।এক রুমে দুজন,দুটো সিঙ্গেল বেড।আমি কোথায় ঘুমাবো ভেবেই চিন্তায় পরে গেলাম।আপু আমাকে নাস্তায় নুডুলস খেতে দিয়ে বলল আমি আপুর বেডে থাকবো আর আপু তার রুমমেটের বেডে থাকবে আর রুমমেট অন্যকারও রুমে গিয়ে থাকবে।চিন্তার কোন কারন নেই।সন্ধ্যার একটু পর আপু আমাকে বলল,
“এই জুঁই সন্ধ্যা হয়ে গেল তুমি বাসায় ফোন করে জানালে নাতো?সবাই টেনশন করবে।ধর আমার ফোন থেকে ভাবিকে জানিয়ে দাও।”
আমি বেডে শুয়ে আমার ফোনে গেইমস খেলতে খেলতে বললাম,”জানাতে হবে না।কেউ টেনশন করবেনা শুধু শুধু তোমার ফোনের পয়সা কাঁটবে।”
আপু ভ্রু কুচকে বলল,”তাহলে আমি জানিয়ে দিই।”
আমি লাফ দিয়ে উঠে বসে বললাম,”এই না, কাউকে বলবা না।আচ্ছা শোন আমি এখন থেকে এখানেই থাকবো,তোমার সাথে।”
আপু কিছুক্ষণ আমার সাথে হাসি ঠাট্টা করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।তারপর দুজনার খাবার নিয়ে আসলো।আমরা একসাথে অনেক মজা করে খেলাম।খাবারটা খেতে আমার খুব ভাল লাগলেও আপু রোজ রোজ একই খাবার খেয়ে বিরক্ত।খাওয়া শেষে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সাড়ে সাতটা বাজে।আপু আমাকে নিয়ে পড়তে বসলো।আমি পড়া বাদ দিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করে আপুর মাথা খারাপ করে দিলাম।আপু এমনিতেই কম কথা বলে আজ আমার সাথে এত কথা বলে আপু মনে হয় ক্লান্ত হয়ে গেছে।আমি একটু চুপ থাকলাম তখনই আপুর ফোনে কল আসলো।আপু রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল,”আপনি এসেছেন?গেইটে ওয়েট করুন আমি জুঁইকে নিয়ে আসছি।”
বলেই কল কেটে দিল।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,”জুঁই চলো আপু,ভাইয়া তোমাকে নিতে এসেছে। ”
আমার মন খারাপ হয়ে গেল।আপু তারমানে বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে।আমি উঠে ব্যাগের মধ্যে বই গুলো গুছিয়ে নিয়ে আপুর ড্রেস খুলে আমার স্কুল ড্রেস পড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম।আপুও আমার সাথে আসতে আসতে বলল অন্য একদিন আমাকে এখানে নিয়ে আসবে আমি যেন মন খারাপ না করি।আমি আপুর সাথে কোন কথায় বললাম না মুখ ফুলিয়ে তিনতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেইটের কাছে আসলাম।গার্ড গেইট খুলে দিতেই শ্রাবণ ভাইয়াকে দেখে আমার ভেতরে ধক করে উঠলো। সব পুরোনো অভিমান গুলো আবার নতুন করে জেগে উঠলো।আমি উনার সাথে কথা না বলেই উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে লাগলাম।ইভানা আপু গেইটের ভেতর থেকেই বলল,”এই জুঁই,রাগ করো না আমি কাল তোমাকে নিয়ে আসবো।”
আমি আর পেছনে তাকালাম না।গট গট করে হেঁটে অনেকটা দূরে চলে আসলাম।হঠাৎ হাতে কারও শীতল ছোঁয়া পেতেই হাঁটা থামিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি শ্রাবণ ভাইয়া।শান্ত,নীরব চাহনি তে আমার দিকে চেয়ে আছেন।আজ পাঁচদিন পর উনার সাথে আমার দেখা হল।এই পাঁচদিনে উনি কেমন যেন ভয়ানক সুন্দর হয়েছেন।নেভি ব্লু কালার টি শার্ট,অ্যাশ কালার থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে আছেন উনি।উনার চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে।চোখের নিচে বেশ গর্ত বুঝা যাচ্ছে।চোখ মুখ রক্তশূন্য রোগীর মতো ফ্যাটফেটে লাগছে।হাতের রগ গুলো জেগে উঠে আছে। আমি ভ্রু কুচকে উনার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
“আপনি এখানে?ভাইয়া কোথায়?আপনি কেন এসেছেন?।”
উনি দুই হাত আমার কাঁধে রেখে আমার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে চোখবন্ধ করে চুপ থাকলেন।উনার গরম নিঃশ্বাস আমার মুখের উপর আছড়ে পড়ছে।একটু পর উনি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
“কি করছেন ছাড়ুন।”
উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,”কাউকে না জানিয়ে এখানে এসেছিস কেন?”
আমিও রেগে বললাম,”কাকে জানিয়ে আসতে হবে?কে আছে আমার?”
উনি আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলেন।আমি উনার চোখে চোখ রেখে বললাম,”আমি আর ওই বাসায় থাকবো না।এখন থেকে আমি ইভানা আপুর সাথে হলে থাকবো।”
উনি চোখমুখ শক্ত করে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে গাড়িতে তুললেন।উনিও গাড়িতে উঠে রাগী মুখ করে ড্রাইভ করতে লাগলেন।অর্ধেক রাস্তা এসে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না।উনার দিকে ঘুরে বসে বললাম,
“আপনি এখনও আমার উপর রেগে আছেন?আপনি এত রাগী কেন?আমি একটু আপনার বালিশ আর প্যান্ট ভিজিয়ে দিলাম জন্য আপনি আমার সাথে আর কথায় বললেন না।”
উনি সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন,”রেগে নেই।”
আমি বিস্ময় চোখে বললাম,”তাহলে কথা বলেননি কেন?আচ্ছা লন্ডন যাবেন কবে?যাওয়ার আগে আমার সিম কার্ডটা দিয়ে যাবেন।আমার তো এনআইডি নেই তাই নতুন সিম কিনতে পারছিনা আর কেউ কিনেও দিচ্ছে না।”
উনি রাগ ভেঙ্গে হালকা হাসলেন তারপর আবার সিরিয়াস হয়ে বললেন,”আমি গেলে তুই খুব খুশি হবি?”
আমি বললাম,”আমি শুধু সিম পেলেই খুশি হবো।আপনার যেখানে খুশি যান আমার সিমটা দিয়ে যান।”
উনি আবারও হালকা রেগে বললেন,”কোথাও যাবোনা আমি আর সিম?আগে বড় হ তারপর পাবি।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,”আমি বড় হইনি?আমার বয়স কত জানো?আই আম সিক্সটিন।স্কুলে ক্লাস সেভেনের রিমুর কাছেও সিম আছে আর আমি এত বড় হয়ে গেছি তাও আমার ফোনে সিম নেই,সবাই শুনলে হাসবে।”
উনি গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন।আমিও গাড়ি থেকে নেমে নয়তলায় আমাদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকালাম।শ্রাবণ ভাইয়া আমার পাশে এসে আমাকে নিয়ে বাসায় গেলেন।বাসায় ঢুকতেই সবার চিন্তিত মুখ দেখতে পেলাম।সবাইকে খুব টেনশনে ফেলে দিয়েছিলাম বুঝতেই পারছি।বাবা আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে বকতে শুরু করলো।ভাবি আমাকে একপাশ থেকে থেকে জড়িয়ে ধরে রুমে নিয়ে যেতে লাগলো।দাদিও সোফায় বসে আমাকে বকতে লাগলো।বুড়িটার হাঁটু ব্যাথা না থাকতে নিশ্চয় উঠে এসে আমার চুল ছিড়তো।ভাগ্যিস ভাইয়া বাসায় নেই নাহলে ভাইয়াও রেগে যেত।ভাবির সাথে রুমে এসে বেডের উপর ব্যাগ ফেলে দিয়ে বললাম,
“যাও এখান থেকে আমার ঘুম পাচ্ছে।”
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শ্রাবণ ভাইয়া রাগী কন্ঠে বললেন,
“পাঁচমিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বই নিয়ে বসবি, আ’ম ওয়েটিং।”
বলেই উনি চলে গেলেন।ভাবিও চলে গেল।আমি মুখ ফুলিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।পাঁচমিনিটের আগেই বের হয়ে একটা ঘুমের মেডিসিন খেয়ে টেবিলে বই নিয়ে বসলাম।আজকে আমি পড়তে চাইনা তাই তাড়াতাড়ি ঘুৃম ধরার জন্য মেডিসিন খেলাম।শ্রাবণ ভাইয়া রুমে এসে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে আমার পাশে চেয়ার টেনে বসে মুখ গম্ভীর করে বললেন,
“এটা তোর ডেইলি প্রোগ্রাম।এখন থেকে এটা ফলো করবি আর হ্যা এর বাহিরে কিছু করলে আমাকে তো চিনিস,থাপ্পড় দিয়ে তোর সব দাঁত ফালায় দিব।”
আমি চোখ বড় বড় করে প্রোগ্রামের দিকে তাকালাম।রাত বারোটা পর্যন্ত আমি জীবনেও পড়তে পারবোনা।দশটা পর্যন্ত পড়তেই ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায় আর আমি নাকি বারোটা পর্যন্ত পড়বো!পুরো প্রোগ্রাম দেখে আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমি এটা ফলো করতে পারবোনা।আমি এসব খাইনা,বিকেলে না ঘুমালে রাতে পড়তে পারবোনাতো আর আমার দুইবারই গোসল করতে হবে।”
উনি কিছু বললেন না।উনার চোখে মুখে রাগ দেখতে পাচ্ছি।উনি আমার ম্যাথ বই খুলে খাতা কলম নিয়ে আমাকে ম্যাথ বুঝিয়ে দিতে লাগলেন।একটু পর আমি খাতার দিকে তাকিয়ে ঝিমুচ্ছিলাম তখনই উনি বললেন,”ড্রেসের বাটন খুলে রেখে আমাকে দেখাচ্ছিস তুই বড় হয়ে গিয়েছিস?এখন সিম পাবিনা তুই,অসভ্য কোথাকার!”
আমি চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকালাম।উনি আমাকে এসব বললেন!আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।উনি তো খাতার দিকে তাকিয়ে ম্যাথ করছেন।আমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার সাদা টপের উপরের দুটো টিপ বাটন খোলা।একটু হেলে থাকলে সব দেখা যাবে।অহ শীট!আমি তো খাতার দিকে হেলেই ছিলাম।আমি এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বাটন লাগিয়ে ওড়নাটা ঠিক করে গায়ে দিয়ে বললাম,
“আজকে আর পড়বোনা আজকে ছুটি,ঘুম পাচ্ছে আমার।”
উনি আমাকে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়ে বললেন,”বারোটার আগে ঘুমাতে পারবিনা।এখনও দশটায় বাজেনি,দশটায় ডিনার।তুই যেহেতু বড় হয়ে গিয়েছিস সেহেতু বড়দের মতো মধ্যরাত পর্যন্ত পড়বি।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,”আপনি বাসায় যাবেন কখন?”
উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,”আমি আমার ফ্ল্যাটে শিফট্ করেছি,এখন থেকে এখানেই আমার বাসা।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,”মানে?”
উনি আমার দিকে খাতা কলম এগিয়ে দিয়ে বললেন,”মানে শ্রাবণ এখন থেকে তার সুইটহার্টের কাছে থাকবে।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,”কে শ্রাবণের সুইটহার্ট?”
উনি মুচকি হেসে বললেন,”ড্রিম ওয়ার্ল্ডের প্রিন্সেস।”
আমি বললাম,”কে এখানকার প্রিন্সেস?”
উনি ঠোঁট চেপে হেসে বললেন,”তোর বড় ফুপ্পির একমাত্র ছেলের একমাত্র হৃদয়েশ্বরী হলো এখানকার প্রিন্সেস,বুঝেছিস মাথা মোটা?”
আমি কনফিউজড হয়ে বললাম,”বড় ফুপ্পির ছেলে মানে শ্রাবণ ভাইয়া?”
উনি বিরক্ত হয়ে বললেন,”শ্রাবণ ভাইয়া নয় শাহরিয়ার শ্রাবণ।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম, “হৃদয়েশ্বরী কি?এখানে কোনো প্রিন্সেস থাকেনা,পাশের স্বপ্নচুরা বিল্ডিং এ প্রিন্স ভাইয়া থাকে।”
উনি আমার কথা শুনে হতাশ হলেন,একটু পর রেগেও গেলেন তারপর আমাকে ম্যাথ করতে দিয়ে থম থমে মুখ করে বসে থাকলেন।এদিকে আমি ম্যাথ করতে করতে কখন যে টেবিলে মাথা লাগিয়ে ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানিনা।
.
সকালে এলার্মের সাউন্ডে ঘুম ভাঙ্গলে তাকিয়ে দেখি ০৫:৪৫ বাজে।চোখ মুখ কুচকে এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেলাম কিন্তু একটু পর আবার এলার্ম ঘড়িতে এলার্ম বেঁজে উঠলো।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ০৫:৫০ বাজে।আজব তো এত সকালে এলার্ম কে দিয়ে রেখেছ!আমি রেগে উঠে বসে ঘড়ির ব্যাটারি খুলে নিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেলাম।
মুখের উপর অনেক গুলো পানি পরাতে আমি ধরফরিয়ে উঠে বসলাম।হাত দিয়ে চোখ মুছে তাকিয়ে দেখি শ্রাবণ ভাইয়া গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।শীতের সকালে পানি নিয়ে ইয়ারকি আমি একদম পছন্দ করিনা।উনি আমাকে এমনি ডেকে তুলতে পারতেন এভাবে পানি দেওয়ার কি দরকার ছিল।উফ্ কি ঠান্ডা পানি!এক নিমিষেই রাজ্যের সব ঘুম ছুটে গেল।আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,
“পানি দিলেন কেন?মুখে কথা নেই?”
উনি গ্লাসটা টেবিলে রেখে রাগী কন্ঠে বললেন,”সকালে উঠিসনি কেন?রাত ন’টার সময় পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে গেলি আবার সকাল ন’টা বেঁজে গেল উঠার নাম গন্ধ নেই।সারাদিন ঘুমাবি তো পড়বি কখন?ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে আয়,স্কুলে লেইট হলে তোর গাল লাল করে দিবো।”
রুমের মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে কথা গুলো বলে উনি রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।আমি কালকের কথা ভাবতে লাগলাম।টেবিলে বসে পড়ছিলাম তারপর কি হল আর মনে নেই।
স্কুলে যাবার জন্য রেডি হয়ে বাহিরে আসলাম। ব্রেকফাস্ট করতে এসে আমি অবাক।ফুপ্পি, তৌসি আর দাদু আমাদের বাসায় কখন আসলো?আমাকে দেখেই ফুপ্পি আমার প্লেটে নাস্তা দিতে দিতে বলল,
“তাড়াতাড়ি আয় খাওয়া শেষ করে আমার অনেক কাজ,সব জিনিসপত্র গোছাতে হবে।”
আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম,”কি গোছাবে?কখন আসলে তোমরা?ফুপ্পা আসেনি?ভাইয়া কোথায়?”
তৌসি বলল,”কাল সকালে এসেছি,বাবা তো ইন্ডিয়া আর তালহা ভাইয়া একটু আগেই বেড়িয়ে গেল।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,”কাল এসেছিস?কই দেখলাম নাতো তোকে?কোথায় ছিলি?”
বাবা বলল,”এখন থেকে ওরা ৯০৪ নাম্বার ফ্ল্যাটে থাকবে।”
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,”ওদের বাসা ফেলে ওরা আমাদের বিল্ডিং এ কেন থাকবে?”
ভাবি টেবিলের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলল,”এই জুঁই,তোর ওসব ভাবতে হবেনা।এই বিল্ডিং এ ফুপ্পার ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার আছে তাই সব সময় আমাদের বিল্ডিং আমাদের বিল্ডিং করবিনা,তোর তো আবার মুখ ভাল না।”
আমি হা করে ভাবির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।ফুপ্পি আমার মুখে সেদ্ধ ডিম দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”কেন বলবেনা?এই পুরো বিল্ডিং টাই ওর।”
শ্রাবণ ভাইয়া খেতে খেতে বলল,”হ্যা সবই তো ওর।সবকিছু ওকে দাও তারপর ও কাউকে না জানিয়ে বাহিরে ঘুরতে যাবে।তখন তোমরা যদি বলো কাউকে না জানিয়ে কেন গিয়েছে, ও বলবে কাকে জানিয়ে আসতে হবে?কে আছে আমার?”
আমি তেঁতে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রাবণ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,”ঠিকই তো,কে আছে আমার? কেউ নেই।যার মা থাকেনা তার কেউ থাকেনা।”
বাবা আমাকে ধমক দিয়ে বলল,”মা নেই তো কি হয়েছে?সারাদিন মা মা করো কেন এত?আমি কি তোমার কোন কিছুর অভাব রেখেছি?”
আমি কান্না মুখ করে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,”তুমি কোন কথায় বলবা না।তোমরা কেউ কোন কথা বলবানা।এখানে সবার মা আছে শুধু আমার নেই।তোমার মা আছে শ্রাবণ ভাইয়ারও মা আছে,মা না থাকলে কি হয় তোমরা কি বুঝবে?তোমার জ্বর হলে এই বুড়ি সারারাত তোমার পাশে বসে তোমার মাথায় পানি ঢালে আর আমার জ্বর হলে এক গাদা মেডিসিন খেয়ে ভং ধরে শুয়ে থাকতে হয়।এই তো কিছুদিন আগে শ্রাবণ ভাইয়া রাতে খাবে না বলল, ফুপ্পি তাও জোড় করে মুখে তুলে খাওয়ালো আর দুদিন আগে আমি সারাদিন খাইনি তুলে খাওয়ানো তো দূরের কথা আমাকে কেউ জিজ্ঞেস ও করেনি খেয়েছি কিনা।তারপরও তোমরা বলো আমার সবাই আছে?আমি কিছুতেই থাকবোনা তোমাদের সাথে।”
বলেই এক দৌঁড়ে বাহিরে চলে আসলাম।লিফটের জন্য ওয়েট না করে সিঁড়ি দিয়ে আসতে লাগলাম।পাঁচতলায় এসে লিফট পেলাম।একদম গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে দেখি রকি বাইক নিয়ে কলেজে যাচ্ছে।আমি ওকে বললাম আমাকে স্কুলে ড্রপ করে দিতে।রকি আমাকে স্কুলে রেখে নিজের কলেজে চলে গেল।গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে রাস্তায় শ্রাবণ ভাইয়াকে দেখলাম গাড়ির ভেতরে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেলাম।পুরো স্কুল আওয়ার আমি ভাবলাম,আমার হারিয়ে যাওয়া উচিত।আমার মন সব সময় চায় কোথাও হারিয়ে যাই।হাজার হাজার লোকের ভীরে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটলে আমি খুব শান্তি পাই।তাই আমি ঠিক করলাম আমি আর কখনও বাসায় যাবোনা।আজকে আমি হারিয়ে যাবো।অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো।
স্কুল ছুটি হতেই আমি ভীরের মধ্যে দিয়ে যেখানে রিক্সা দাঁড়ায় সেখানে গেলাম যাতে আমাদের ড্রাইভার আমাকে দেখতে না পায়।আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,
“এই মামা বাসস্ট্যান্ড যাবা?”
রিক্সা মামা বলল যাবেনা।আমি আবার বললাম,”তাহলে রেলওয়ে স্টেশন চলো।”
রিক্সা মামা বলল,”মুই মিরপুর ছাড়া কোথাও যাইতাম না।”
আমি রেগে বললাম,”তুমি আমাকে স্টেশন নিয়ে চলো,পাঁচশো টাকা দি…..”
আর কিছু বলার আগেই কেউ উল্টো দিকে ঘুড়িয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল।আমি গালে হাত দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি শ্রাবণ ভাইয়া চোখ মুখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই উনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,”যাওয়াচ্ছি তোকে স্টেশন,বাসায় চল শুধু একবার।”
আমি পেছনে রিক্সা মামার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললাম,”কুত্তা তোর জন্য আমার মাইর খাওয়া লাগলো।কাল ওখানেই থাকবি তোকে আর তোর রিক্সাকে আমি বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিবো!”
চলবে…………
(লম্বা পার্ট দিয়েছি।আপনারা নেক্সট বলবেন না প্লিজ।নেক্সট না বলে গল্প নিয়ে কিছু বলবেন তাহলে আমি বুঝতে পারবো গল্পটা আপনাদের কাছে কেমন লাগে।)