সুইটহার্ট-পর্ব:১৫

0
1100

#সুইটহার্ট
#Sohani_Simu
১৫.

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা আগত প্রায়।রুমের জানালার কাঁচ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি দূরে একটা টাওয়ারে লাল বাতি জ্বলছে।সারাদিন শরীরের উপর দিয়ে চাপ গেছে ভীষণ।এখন কেমন ক্লান্ত লাগছে নিজেকে।পড়ার টেবিলে চেয়ার টেনে বসে হাত-পাগুলি টান টান করে ক্লান্তি ভাঙার চেষ্টা করছি।শ্রাবণ ভাইয়ার কথা মনে পরতেই আমি উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে পার্সটা বের করলাম।গুনে গুনে দুইহাজার দুইশত টাকা নিয়ে পার্সটা যথা স্থানে রেখে আমি ফুপ্পিদের ফ্ল্যাটে যেতে লাগলাম।

ফুপ্পিদের ফ্ল্যাটের কলিং বেল চাপতেই কাজের মেয়েটা এসে দরজা খুলে দিল।ফুপ্পি কিচেনে আছে শুনে আমি গটগট করে হেঁটে কিচেনে গেলাম।কিচেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি শ্রাবণ ভাইয়া আর ফুপ্পি কথা বলছে।ফুপ্পি সিংকে কিছু ধুচ্ছে আর শ্রাবণ ভাইয়া পাশে দাঁড়িয়ে বলছে,
“কিসের পাপ?আমি কোন পাপ করছিনা।আমি ওকে ভালোবাসি,আল্লাহর কাছে আমি ওকেই চাই।এতে পাপ কোথায়?”

ফুপ্পি কাজের মধ্যে আছে তাই ব্যস্ত কন্ঠে বলল,”আমি অতকিছু বুঝিনা,তুই ওর থেকে দূরে থাকবি।যখন বিয়ের বয়স হবে তখন আমি নিজে বিয়ে দিবো।”

ওদের কথার মাঝখানেই আমি ফুপ্পিকে ডাকলাম।আমাকে দেখেই শ্রাবণ ভাইয়া কফির মগ হাতে নিয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন।আমি ফুপ্পির সাথে একটু কথা বলেই শ্রাবণ ভাইয়ার রুমের সামনে আসলাম।দরজা খোলায় আছে কিন্তু পর্দাটা টেনে দেওয়া আছে জন্য রুমের ভেতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না।আমি দুই হাতে পর্দা টেনে ভেতরে উকি দিতেই দেখলাম শ্রাবণ ভাইয়া একদম আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।হয়তো উনি রুম থেকে বাইরে আসতে চাইছিলেন।আমি উনাকে এত কাছে দেখে চমকে গিয়েছি কিন্তু উনি আমাকে দেখে একটুও চমকালেন না বরং ভ্রু কুচকে বললেন,
“কি চাই?”

আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা কিছুটা নিচু করে বললাম,”আমার কাছে তো নব্বই হাজার টাকা নেই তাই আপনাকে নতুন ফোন কিনে দিতে পারছিনা।বাবাকে বললাম বাবা বলল……”

উনি আমাকে পুরোটা বলতে না দিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,”বাবাকে বলে দিয়েছিস?গুড,ভেরি গুড।”

আমি উনার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে বললাম,”না না আমি বাবার কাছে টাকা চাইনি।বাবাকে বলেছি আমি আপনার ফোন নষ্ট করেছি তখন বাবা বলল সমস্যা নেই আপনি নাকি ফোন রিপেয়ার করে নিবেন।তাই আমি ভাবলাম আমার জন্য যখন আপনার ফোন নষ্ট হলো তখন আমিই রিপেয়ার করে দিই।স্কুল থেকে ফেরার সময় ফোন সার্ভিসিং এর দোকান থেকে শুনলাম দুহাজার দুশো টাকা হলেই আপনার ফোন ঠিক হয়ে যাবে।”

বলেই আমি হাতের মুঠো থেকে টাকাটা নিয়ে উনার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললাম,”এই নিন,এগুলো আমার জমানো টাকা।আরও লাগলে বলবেন,আছে আমার কাছে।”

উনি হাতে থাকা কফির মগে চুমুক দিলেন।আমার দিকে দুকদম এগিয়ে এসে বাম হাতটা দরজার হাতলে রেখে বললেন,
“তুই ফোন নষ্ট করেছিস ইটস্ ওকে,আই ডোন্ট মাইন্ড।এবার তুমি যাও ভাগো।”

বলেই উনি আমার মুখের উপর সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।আমি ভ্রু কুচকে দরজার দিকে তাকিয়ে বির বির করে বললাম,”এটা কি হল!!আমার ডাইলোগ আমাকেই ফিরিয়ে দিলেন!!

.
সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য গাড়িতে বসে দেখি পেছনে শ্রাবণ ভাইয়াও বসে আছেন।আমি একবার উনার দিকে তাকিয়েই গাড়ি থেকে নেমে এলাম।কি ভেবেছন উনি?আমি সব অপমান ভুলে গিয়েছি?জুঁই কিছু ভুলে না।সেদিন উনার সামনে আমি রিক্সায় জ্যামে বসে ছিলাম সেটা কি উনি দেখেন নি।আর পড়ার টেবিলে বলছিলেন সারাদিন আমাকে নিয়ে পড়ে থাকলে উনার পড়াগুলো আমার বাপ করে দিবে কিনা।আমি এক প্রকার রাগ দেখিয়েই গাড়ি থেকে নেমে এলাম।ড্রাইভার চাচা বলল,”কি হল নামলা কেন?”

আমি কিছু না বলে গেইটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রিক্সার জন্য ওয়েট করতে লাগলাম।ঢাকা শহর রিক্সার শহর হলেও দরকারের সময় একটা রিক্সাও পাওয়া যায়না।রিক্সার জন্য ওয়েট করছিলাম তখনই শ্রাবণ ভাইয়া আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।আমি দেখেও না দেখার ভান করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম।উনি আবার আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন।আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
“কি?”

উনি মুচকি হেসে বললেন,”কিছুনা।”
আমি রাগী কন্ঠে বললাম,”তাহলে এমন করছেন কেন?”

উনি আমার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন,”কেমন করছি?”

আমি কিছু বললাম না।চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম।উনিও আমার সাথে আসতে আসতে বললেন,”রাগ করেছো?আ’ম সরি।”

আমি হাঁটা থামিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বললাম,”রাগ করব কেন?”

উনি ভ্রু কুচকে বললেন,”কেন আবার,আমি তোমাকে বকেছি,স্কুলে নিয়ে যায়নি সেজন্য।”

আমি বললাম,”আপনি আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবেন কেন?আপনি কি আমার ড্রাইভার?শুনুন আপনার কাছে আর পড়বোনা।আপনার সাথে স্কুলেও যাবোনা।আপনি চলে যান।”

উনি আমার একহাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,”তুই যেই লেভেলের বোকা, তোকে রাস্তা ঘাটে একা ছাড়ায় যাবেনা।কালকে স্কুল ছুটি হয়েছে দুটোই তুই বাসায় ফিরেছিস দুই ঘন্টা পর।স্কুল ছুটি হলে সবাই ছুটে বাসায় যায় আর তুই ঘুরতে যাস।পার্কের সামনে ওই ছেলেটার সাথে ঝগড়া করছিলি কেন?”

আমি হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম,”আপনি জানলেন কি করে?

উনি আমাকে গাড়ির মধ্যে ঢুকে দিয়ে নিজে আমার পাশে বসে সামনে তাকিয়ে বললেন,”সব জানি আমি।”

আমি একটু চেঁচিয়ে বললাম,”কচু জানেন আপনি।সব সময় দুই লাইন বেশি বুঝেন।কন্টেস্টে আমার নাম দিয়েছেন কেন?আপনি জানেন আমার সেদিন আটটা ক্লাসটেস্ট আছে?আটটা!!!দিয়েছেন জীবনেও একদিনে আটটা টেস্ট?কিভাবে আর দিবেন, আপনি যা একটা কচুর ছাত্র তার নাম আবার পাত্র।আপনার মতো ফেলু ভাই আমি জীবনেও দেখিনি।”

উনি মুচকি হেসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুই তো অলরাউন্ডার,সারাদিন এক্সাম দিবি আর রাতে কন্টেস্ট করবি।”

আমি রেগে বললাম,”করবোনা আপনার ইচ্ছে হলে আপনি করুন।”
সামনে থেকে ড্রাইভার চাচা বলল,”কেন করবা না?গতবার তো প্রথম হয়েছিলা।আমাকে কতগুলো চকলেট দিলা।”

আমি জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁটুতে কনুই রেখে দুই হাতে মাথা ধরে বললাম,”তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাও ভাললাগছেনা এখানে আমার।”

শ্রাবণ ভাইয়া বললেন,”কেন?”
আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে বললাম,”আপনি কথা বলবেন না আমার সাথে আর আমার সামনেও আসবেন না।আপনাক দেখলে আমার রাগ হচ্ছে।”

উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার একহাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন,”ভয় হচ্ছেনা?এই যে তুই আমাকে এত গুলো কথা শুনালি,আমি যদি তোকে এখন এই জানালা দিয়ে ফেলে দিই তাহলে কেমন হবে?”

আমি ভীত চোখে উনার দিকে তাকালাম।এই কথা আগে মাথায় আসেনি,উনি ইচ্ছে করলে এখনই আমাকে জানালা দিয়ে ফেলে দিতে পারেন।আমি ভীত চোখে উনার দ্দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে উনার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে নিলাম।উনি মুচকি হেসে সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকলেন।আমি আড় চোখে উনাকে দেখতে লাগলাম আর মনে মনে ভাবলাম এত সুন্দর ছেলে এত খারাপ কেন?ফুপ্পি-ফুপ্পা তো অনেক ভাল কিন্তু তৌসি ভাল নয়। উনি তাহলে তৌসির মতো উড়নচন্ডি হয়েছেন নাকি উনার মতো তৌসি হয়েছে?কি জানি বাবা!!ওরা দুই ভাই-বোন যে কার মতো হয়েছে!!আমি তো আম্মুর মতো ভাল হয়েছি।

সন্ধ্যায় বিছানায় শুয়ে থেকে পড়ছি তখনই শ্রাবণ ভাইয়া আর তৌসি আমার রুমে আসলো।আমি বই রেখে ঝট করে উঠে বসে তৌসিকে বললাম,

“কাইফা হালুকা ইয়া হাবিবী?”

তৌসিও আমার মুখোমুখি বসে আনন্দিত হয়ে বলল,

“ত্বাইয়্যিব জিদ্দান আশকুরুকা,হাল আনতা বিখাইরি?”

আমি হাসতে হাসতে বললাম,”নায়াম আনা বিখাইরি।”

শ্রাবণ ভাইয়া আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুচকে বললেন,”কিসের ভিখারি?

তৌসি উনার দিকে তাকিয়ে বলল,”উফ্ ভাইয়া,ভিখারি নয় বিখাইরি।আমরা আরবিতে কথা বললাম।”

উনি ভ্রু ঠিক করে বললেন,”আরবি আবার কোথায় শিখলি?কি কথা বললি?”

তৌসি বলল,”তোমার জুঁই, স্কুলে ইসলাম টিচারের থেকে শিখে এসেছে।কাইফা হালুকা ইয়া হাবিবী মানে কেমন আছো বন্ধু।ত্বাইয়্যিব জিদ্দান আশকুরুকা,হাল আনতা বিখাইরি মানে আমি ভাল আছি,তুমি কেমন আছো আর নায়াম আনা বিখাইরি মানে আমিও ভাল আছি।তাইনা জুঁই?”

আমি মাথা উপর নিচ নাড়ালাম এর অর্থ একদমই তাই।শ্রাবণ ভাইয়া যেয়ে চেয়ারে বসে বললেন,”হুহ্, সারাদিন মুখ দিয়ে গালি বের হয় সে আবার আরবিতে কথা বলছে!”

আমি তেজি কন্ঠে বললাম,”তাতে আপনার কি?আপনি নিজের চরকায় তেল দিন।”
উনিও রাগী কন্ঠে বললেন,”দুই সেকেন্ডের মধ্যে এখানে আসবি,তৌসি তুই এখন যা।”

“না যাবে না,আপনি যান।আমি আপনার মতো ছাতার মাথা ফেলু স্টুডেন্টের কাছে আর পড়বো না।আমি একা পড়লেও গোল্ডেন পাবো।হুদায় আপনার কাছে পড়ার কোন মানেই হয় না,রেজাল্টের পর দেখা যাবে অল ক্রডিট গোস টু শাহরিয়ার শ্রাবণ,আমি যে কষ্ট করে পড়লাম তার কোন ক্রেডিট পাবো না।” – উনার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।

তৌসি অবাক হয়ে বলল,”ভাইয়া ফেলু স্টুডেন্ট?ইম্পেরিয়াল কলেজে পড়েছে ভাইয়া,পুরো ওয়ার্ল্ডে অষ্টম স্থানে আছে ওই কলেজ।ওইরকম একটা প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে নেই।ভাইয়া তো ওখানকার টিচার হবে,তাইনা ভাইয়া?”

শ্রাবণ ভাইয়া বললেন,”হুম কিন্তু আগে এই গাধাকে পিটিয়ে মানুষ করতে হবে।”

আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে উনার কাছে যেতে যেতে বললাম,”আমি গাধা?আপনি গাধা, আমার ম্যাথ খাতায় ওসব কি লিখেছেন?সাগরে লবণ অনেক কবরে ভূত অনেক টেংরা লম্বা ভূত!!!!

উনি মুচকি হেসে বললেন,”সাগর মানে সাইন,লবণ মানে লম্ব অনেক মানে অতিভুজ তাহলে সাইন=লম্ব বাই অতিভুজ।একইভাবে কবর মানে কস ভূত মানে ভূমি অনেক মানে অতিভুজ তাহলে কস =ভূমি বাই অতিভুজ আর টেংরা মানে ট্যান লম্বা মানে লম্ব আর ভূত মানে ভূমি তাহলে ট্যান= লম্ব বাই ভূমি।আর কখনও উল্টা পালটা করবা?”

আমি হা করে উনার দিকে তাকালাম।হোয়াট আ টেকনিক!তৌসি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”ভাইয়া ওকে তাড়াতাড়ি পড়িয়ে ছেড়ে দাও,অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের প্রাকটিস করতে হবে।আমি নিচে গেলাম।”

বলেই তৌসি চলে গেল।আমিও গিয়ে পড়তে বসলাম।মনে মনে ভাবলাম এদের ভাই-বোনের খালি গল্প,শ্রাবণ ভাইয়া জীবনেও ভাল স্টুডেন্ট নয়।

চলবে……………!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here