সুইটহার্ট-পর্ব:২

0
1565

#সুইটহার্ট
#Sohani_Simu
২.

ডাইনিং টেবিলে বসে সবাই খাচ্ছি।টেবিলের প্রস্থের দিকে বসে আছেন শ্রাবণ ভাইয়া আর আমি দৈঘ্যের দিকে তালহা ভাইয়ার কাছে বসেছি।আমার অন্যপাশে তৌসি বসে আছে।আমাদের সামনে বাবা ফুপ্পা আর আমার দাদি বসেছে।আর টেবিলের অন্য প্রস্থে শ্রাবণ ভাইয়ার দাদু বসেছে।ফুপ্পি আর শিরিন ভাবি খাবার সার্ভ করছে।আমি এখন খাওয়া বাদ দিয়ে আমার প্লেটের খাবার ভাইয়ার প্লেটে ট্রান্সফার করছি।ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল,”হয়েছে বাকি গুলো তুই খেয়ে নে।”

“না বাকি গুলো টয় খাবে।টয়….,টয়…..এই টয়..?আমার টয় কোথায় গেল?”

বলেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠেছি আর শ্রাবণ ভাইয়া রাগী কন্ঠে বললেন,”এই বস ওখানে।সবগুলো খাবার না খেয়ে উঠবিনা।আম্মু ওকে সবজি দাও বেশি করে।”

আমি ঠোঁট উল্টে বসে গেলাম কারণ না বসলে হয়তো উঠে এসে থাপ্পড় বসিয়ে দিবে।শ্রাবণ ভাইয়াকে তো কেউ কিছু বলল না উল্টো বাবা আর ভাইয়া আরও বেশি করে মারতে বলল আমাকে।আমি খাচ্ছি আর বাঁকা চোখে শ্রাবণ ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছি।শ্রাবণ ভাইয়া মুখ গোমরা করে গাপুস গুপুস খেয়েই যাচ্ছে।আমাকে দেখে সবাই মিটিমিটি হাসছে।আমি যে শ্রাবণ ভাইয়াকে ভয় পাচ্ছি এটা সবাই বুঝেই গেছে।আমি থমথমে মুখে দাদির দিকে তাকিয়ে শ্রাবণ ভাইয়ার দিকে ইশারা করে বললাম,

“এই বুড়ি শোনো?ওই ছেলেটা তোমার কে হয়?”

দাদি হাসতে হাসতে বলল,”তোর যা হয় আমারো তাই হয়।বল ছেমরি কি হইছে?”

“অহ তাহলে তো খুবই ভাল কথা। ওই ছেলে আমার কেউ হয়না তারমানে তোমারও কেউ হয়না কিন্তু তুমি শুধু আমার দাদি ওই ছেলে তোমাকে নানু বললে তুমি কথা বলবানা,ওকে?আর ফুপ্পি?তুমিও কথা বলবানা।তোমরা কেউ কথা বলবানা ওই বদের হাড্ডির সাথে।”

শ্রাবণ ভাইয়া আমার দিকে রাগী চোখে তাকালেন আমি মুখ ভেংচি দিয়ে শ্রাবণ ভাইয়ার দাদুকে বললাম,”ওই বুড়ো কি এত খাও?চলো তো দাবা খেলবো।”

ভাইয়া আমাকে ধমক দিয়ে বলল,”জুঁই?ঠিক করে কথা বল।বেয়াদবের মতো করছিস কেন?”

“ঠিক আছে ঠিক আছে।দাদু চলো আমরা দাবা খেলবো।”

“ওটা আমার দাদু,তোর সাথে খেলবেনা।”প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললেন শ্রাবণ ভাইয়া।

“ওইটা তোমার কেউ না।এখানে তোমার কেউ নেই,যাও ভাগো তুমি এখান থেকে।”,ভাব নিয়ে বললাম আমি।তখনই মনে হলো আমি ভুল করে তুমি বলে ফেলেছি তাই আবার বললাম,”সরি আপনি।আপনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানে চলে যান,এখানে আপনার কেউ নেই।”

শ্রাবণ ভাইয়া আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন।ভয়ে তো আমি শেষ।এক হাত দিয়ে ভাইয়ার হাত জড়িয়ে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করে বললাম,”মারবেন না আর বলবো না।এখানে সবাই আপনার আমার কেউ নেই।আমি চলে যাবো।আর থাপ্পড় মারবেন না…এ্যা এ্যা এ্যা।”

সবার হাসির শব্দ শুনে আমি ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখি শ্রাবণ ভাইয়া বেসিনে হাত ধুচ্ছেন।আমি ঠোঁট উল্টে সত্যি সত্যি কান্না শুরু করে দিলাম।

.
রাতে তৌসি পড়ছে আর আমি ওর বই উল্টে পাল্টে দেখছি।টয়কে কোলে নিয়ে ওর লোমে হাত বুলিয়ে ওকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছি।টয় আমার পোষা বিড়াল। খুব কিউট দেখতে আর ফর্সাও অনেক।বাংলা বই বের করে বিড়াল গল্প পড়ছিলাম তখনই তৌসি বলল,
“এই পাতলু,কাল আমার সাথে কলেজ যাবি?কাল আমাদের দুটো ক্লাস হবে না।”

আমি লাফ দিয়ে উঠে তৌসির কাছে দাঁড়িয়ে বললাম,”যাবো যাবো।সিজান আসবে কাল?তোর ফ্রেন্ডের কাছে ফোন দিয়ে শোন তো আসবে কিনা। সিজান আসলে আমিও যাবো।”

তৌসি চেয়ার ঠেলে উঠে আমার মুখ চেপে ধরে বলল,”আস্তে বল,ভাইয়া শুনতে পেলে তোকে আর আস্ত রাখবেনা।”

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম।কাল সিজানের সাথে দেখা হবে তাই এক্সাইটমেন্টের ঠেলায় সারা রাত ভাল ঘুম হলো না।আসলে সিজান আমার ক্রাশ।তৌসিদের কলেজে অনার্সে পড়ে।আমি ওকে ভালোবাসি হি হি।

.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি তৌসি কলেজ ড্রেস পরে রেডি।আমার তো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।আমি তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে আমার ড্রেস বের করতে করতে বললাম,”মোটি হারামি আমাকে ডাকিস নি কেন?কত্ত দেরি হয়ে গেল।”

তৌসি কলেজ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গোল ফ্রেমের চশমাটা চোখে পরে শান্ত কন্ঠে বলল,”তাড়াতাড়ি নিচে আয় আমি ব্রেকফাস্ট করছি।আর তুই তোর স্কুল ড্রেস পরে আয় আর ব্যাগও নে নাহলে আম্মু তোকে আমার সাথে যেতে দিবেনা।”

“স্কুল ড্রেস পরবো?কত দিন পর সিজানের সাথে দেখা হবে আর আমি স্কুল ড্রেস পরে যাবো?না না আমি শুধু ব্যাগ নিবো আর এই সাদা ড্রেসটা পরে যাবো।”

তৌসিকে কিছু বলতে না দিয়েই আমি তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম।সাদা কালার সুন্দর ডিজাইন করা লং কুর্তি আর নীল কালারের মতো জিন্স পরলাম।মাথার ডানপাশে দুটো সুন্দর ক্লিপ লাগিয়ে কোঁকড়া চুল গুলো কিছু সামনে আর কিছু পেছনে ছেড়ে দিয়ে রাখলাম।হাতে কালো ফিতার ঘড়ি আর জুতো পরে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম।নিচে এসে শুনলাম তৌসি গাড়িতে ওয়েট করছে।আমি ব্রেকফাস্ট না করে এক দৌঁড়ে গাড়িতে যেয়ে ড্রাইভারের পাশে বসে বললাম,

“চলো চলো তাড়াতাড়ি চলো।উফ্ অনেক লেট হয়ে গেল।সব হয়েছে এই মোটিটার জন্য।আমি লিপস্টিক টাও দিতে পারলাম না।”

ব্যাগ থেকে লিপস্টিক নিয়ে লুকিং গ্লাস নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে লালটুকে লিপস্টিক লাগিয়ে বললাম,”উম্মাহ কত কিউট লাগছে আমাকে!আজকে সিজানের সাথে ওর গার্লফ্রেন্ডের ব্রেকআপ করিয়েই ছাড়বো।এই তৌসি,সিজানের গার্লফ্রেন্ড আসবে আজ?”

বলেই আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি তৌসি ভীত চোখে ওর পাশে বসা শ্রাবণ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।আমার পেছনের সিটে শ্রাবণ ভাইয়াকে দেখেই আমি অপ্রস্তুত হেসে আটকা আটকা গলায় বললাম,”শ্রাবণ ভাভাইয়া ভাভাল আছো?ননা মমানে ভাল আছেন?”

শ্রাবণ ভাইয়া কিছু বললেন না।সিটে আরাম করে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।আমিও ভয়ে ভয়ে আর কিছু না বলে সামনে তাকিয়ে থাকলাম কিন্তু একটু পর আমার মন বলল পেছনে সিজানের থেকে সুন্দর কাউকে দেখলাম মনে হলো।আমি আবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই শ্রাবণ ভাইয়ার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।আমি মনে মনে অবাক হয়ে বললাম, “অহ মাই গড শ্রাবণ ভাইয়া তো সিজানের থেকে বেশি সুন্দর!কত্ত ফর্সা, হ্যান্ডসাম আর চুলগুলোও কি সিল্কি।এই কালো শার্ট টা পরে শ্রাবণ ভাইয়াকে হলিউডের হিরোদের মতো লাগছে আর সিজান যদি এই কালো শার্ট পরে নিশ্চয় ওকে বান্দরের মতো লাগবে।”

আমি তৌসির দিকে তাকিয়ে বললাম,”সিজান ক্যান্সেল, আজ তোর কলেজে যাবোনা।”তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললাম,” ড্রাইভার ভাইয়া তুমি আগে আমাকে স্কুলে নিয়ে চলো,আজকেও যদি স্কুল মিস দিই ওই শাঁকচুন্নি মিস আবার ভাইয়ার কাছে রিপোর্ট পাঠাবে।”

পেছন থেকে তৌসি বলল,”স্কুলে তো যাবি কিন্তু তোর স্কুল ড্রেস কোথায় চান্দু?স্কুল ড্রেস ছাড়া তোকে ঢুকতে দিবে?”

“একি!তাই তো।এই ড্রাইভার তাড়াতাড়ি বাসায় চলো।গাড়ি ঘুড়াও।”,ব্যস্ত হয়ে বললাম আমি।

তৌসিও ব্যস্ত হয়ে বলল,”না না আমি আগে কলেজ যাবো।রফিক ভাইয়া আপনি আগে আমাকে কলেজে নিয়ে চলুন।আমার লেট হয়ে যাচ্ছে আর তাছাড়াও সামনেই আমার কলেজ।”

আমি সিটের উপরে পা তুলে বসে ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি চালাতে বলছি।এমন ভাব করছি যেন আমাকে চালাতে দিলে আমি আকাশ দিয়ে উড়ে যাবো।তাও শ্রাবণ ভাইয়ার জন্য ভয়ে বেশি কিছু করতে পারছিনা।আমি তেজি মেজাজ নিয়ে ড্রাইভারকে বললাম,”এই ছাতার মাথার ড্রাইভার তাড়াতাড়ি ড্রাইভ করো।তুমি তো দেখছি পারই না ড্রাইভ করতে।কি দেখছো ওই গাড়িকে ওভার টেক করো।ইচ্ছে করছে তোমাকে এক লাথি মেরে জানালা দিয়ে ফেলে নিজে ড্রাইভ করি।যদিও আমি ড্রাইভ করতে পারিনা তাও আমি তোমার মতো কচুর ড্রাইভারের থেকে ভাল পারবো হু!”

ড্রাইভারটা গাড়ি থামিয়ে মুচকি হেসে বলল,”আমরা চলে এসেছি আপুমনি।”

তৌসি আর শ্রাবণ ভাইয়া গাড়ি থেকে নামলো।হঠাৎই আমার মনে হলো কলেজ পর্যন্ত যখন এসেই গেছি সিজানকে একবার শেষ দেখা দেখে যায়।তাই গাড়ি থেকে নেমে তৌসির হাত ধরে বললাম,”আমিও যাবো তোর সাথে।”

তৌসি আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,” আমি তোকে নিয়ে যাবো না।তুই বাসায় যা।ভাইয়া আমি আসছি।”

বলেই তৌসি ভেতরে যেতে লাগলো।আমিও ওর পেছন পেছন যাবো তখনই শ্রাবণ ভাইয়া আমার ব্যাগ টেনে ধরলেন।আমি ভ্রু কুচকে শ্রাবণ ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি আমাকে টেনে গাড়ির পেছনের সিটে ঢুকিয়ে দিয়ে আমার পাশে বসলেন।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,”রফিক লেডিস পার্লারে চলো।”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,”লেডিস পার্লার? ওখানে যেয়ে কি করবেন?আপনি মনে হয় জেন্টস পার্লারে যাবেন।আচ্ছা আপনি কি ডেইলি পার্লারে যান?তাই তো বলি এত গ্লো করে কেন।আপনি কোন ফেসিয়াল করেন?”

শ্রাবণ ভাইয়া কোন কথা বললেন না আমার হাতে খাবারের বক্স দিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকালেন।আমি বক্স খুলে স্যান্ডউইচ খেলাম।খাওয়া শেষে আবার একা একা বক বক শুরু করলাম।কেউ কথা বলছেনা দেখে ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম।ধূর এভাবে চুপ থাকা যায় নাকি!নাকে একটা সুন্দর ঘ্রাণ আসতেই আমি শ্রাবণ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,”শ্রাবণ ভাইয়া তুমি কি পারফিউম দিয়েছো?অছাম এর মতো সেন্ট পাচ্ছি কিন্তু এটা অছাম নয় তাহলে এটা কি ফগ?”

শ্রাবণ ভাইয়া গম্ভীর মুখ করে আমার দিকে তাকাতেই আমি দুই গালে হাত দিয়ে জানালার সাথে লেগে বসলাম।আর কোন কথা বললাম না।লেডিস পার্লারে এসে শ্রাবণ ভাইয়া একটা মেয়েকে ডেকে নম্র ভাবে বললেন,”ওর চুলগুলো স্ট্রেইট করে দিন আর এই ব্রাউন কালার গুলো তুলে দিয়ে ন্যাচারাল ব্ল্যাক কালার করে দিন।”

মেয়েটি বিনয়ী হয়ে বলল,”সিউর স্যার।”

“না আমি চুলে কিছু করবো না।”,ভ্রু কুচকে বললাম।শ্রাবণ ভাইয়ার ইশারায় মেয়েটি আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল।আমি ততক্ষণাৎ চেয়ার থেকে উঠে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম,”এগুলো আমার চুল।কেউ হাত দিবানা আমার চুলে।”

শ্রাবণ ভাইয়া রাগী চোখে আমার দিকে তাকাতেই আমি দুই গালে হাত রেখে বললাম,
“মারবেন না আমি তো স্ট্রেইট করবো।আমার চুল তো ন্যাচারালি স্ট্রেইট কিন্তু যাদের স্ট্রেইট চুল হয় তাদের লাইফও নাকি স্ট্রেইট হয় আর যাদের কার্লি তাদের লাইফও কার্লি।আমার চুল স্ট্রেইট হলেও লাইফ তো কার্লি তাই ইকুয়েশন ঠিক রাখার জন্য চুলও কার্লি করে নিয়েছি।এগুলো এভাবেই থাক ভভভাইয়া?”

শ্রাবণ ভাইয়া আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন,”এসব ননসেন্স কথা কে বলেছে তোকে?”

আমি মাথা নিচু করে বললাম,”আই নো।”

শ্রাবণ ভাইয়া আমার গাল থেকে হাত সরিয়ে আমার গালে হাত দিয়ে নরম কন্ঠে বললেন,”আজ থেকে তোর চুলও স্ট্রেইট হবে আর লাইফও।”

চুল একদম আগের মতো কালো আর স্ট্রেইট করে নিয়ে এসে সেই যে তৌসির রুমে ঢুকলাম আর বের হলাম না।দুপুরের খাবার খেতেও নিচে যাইনি,ফুপ্পি রুমে এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে।আমার কারও সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না চুলের জন্য মন খারাপ লাগছে।আর ওই বুড়ো দাদুটা আমাকে দেখে শুধু হাসছে।তাই আমি তৌসির রুমে গাল ফুলিয়ে শুয়ে থাকলাম।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here