সুইটহার্ট-পর্ব:৬

0
1275

#সুইটহার্ট
#Sohani_Simu
৬.

সকালের ব্রেকফাস্ট করে নিচে লিভিং রুমের সোফায় বসে সবাই হৈ চৈ করছিলাম তখনই শ্রাবণ ভাইয়া উপর থেকে আমার উপর বালিশ ছুড়ে রাগী কন্ঠে বললেন,

“হোয়াট দ্যা… এত সাউন্ড করছিস কেন তোরা? ডিজগাস্টিং…..আর তুই কম কথা বলতে পারিস না,এত বেশি কথা বলিস কেন?আর একবার কিলকিল খিলখিল আওয়াজ পেলে তোর মুখ আমি সেলাই করে দিবো।আমার বালিশ নিয়ে আয় ফাস্ট।”

আমিও তেঁতে উঠে বললাম,”আমি বেশি কথা বলি?তুমিই বেশি কথা বলো।সারারাত কি চুরি করতে গিয়েছিলা তারজন্য সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমাতে হবে?”

উনি উপর থেকেই আমাকে চোখ দিয়ে শাসিয়ে ধপ ধপ করে হেটে নিজের রুমে চলে গেলেন।ঘুমের মধ্যে আছেন তাই হয়তো কিছু বললেন না। নেয়াজ ভাইয়া বলল,”এই জুঁই ধীরে কথা বল শ্রাবণ ভাইয়া রেগে গেছে।”

নিতু আপু তো হা করে শ্রাবণ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল।কি দেখছিল আপুই ভাল জানে।শ্রাবণ ভাইয়াকে তো উসকো খুশকো অ্যাংরি বার্ড মি. রেডের মতো রাগী দেখাচ্ছিল।নিতু আপু মনে হয়ে উনার জিম করা সাদা বডি দেখছিল।এই শ্রাবণ ভাইয়ারও না একটুও লজ্জা নেই আমাদের সামনেই শুধু একটা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে চলে আসলো।আমি নিতু আপুর দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলাম তখনই তৌসি বলল,”তুই আগে ভাইয়াকে বালিশ দিয়ে আয় যা তারপর আমরা বাগানে যেয়ে আড্ডা দিবো।নাহলে আবার সাউন্ড হলে ভাইয়া রেগে যাবে।”

আমি বালিশ দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই নিতু আপু আমার থেকে বালিশ নিয়ে বলল,

“তোরা যা আমি শ্রাবণকে বালিশ দিয়ে তৌসির রুম থেকে আমার ফোন নিয়ে আসছি।”

নিতু আপুর কথা শুনে আমি,তৌসি আর নেয়াজ ভাইয়া বাগানে চলে এলাম।ফুপ্পিদের বাসা অনেক বেশি জায়গা নিয়ে।বিশাল দোতলা বাসার চারদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।এখানে বাগান আছে, ছোট একটা সুইমিং পুল আছে এছাড়াও বিভিন্ন ফলের গাছ আছে।ফুপ্পি খুবই শৌখিন মানুষ তাই এই বাসার প্রত্যেকটা কোনায় কোনায় শখের জিনিসে ভরপুর।ফুপ্পা আবার এদিক দিয়ে নিরামিষ।নিজের বিজনেস নিয়ে এতই ব্যস্ত যে কোনো দিকে তাকানোর টাইম নেই।মাসের বেশির ভাগ সময়ই ফুপ্পা দেশের বাহিরেই থাকে।আজও বাসায় নেই,ইন্ডিয়াতে আছে।

সারাদিন হৈ চৈ আর লাফালাফি করে সন্ধ্যায় আমি বাসায় যাওয়ার জেদ তুলেছি।কাল আমার স্কুল আছে তাই আজই আমাকে বাসায় যেতে হবে কিন্তু কেউ আমাকে বাসায় যেতে দিবেনা।আমিও কিছুতেই এখানে থাকবোনা।চিৎকার চেঁচামেচি করে বাসা মাথায় তুলেছি।শ্রাবণ ভাইয়া এখন বাসায় নেই তাই ফুপ্পি আমাকে একা ড্রাইভারের সাথে পাঠাচ্ছেনা।আমি ফুপ্পির ফোন থেকে ভাইয়াকে ফোন করে আমাকে নিয়ে যেতে বললাম।ভাইয়া অফিস থেকে যাওয়ার সময় আমাকে বাসায় নিয়ে চলে গেল।বাসায় এসেই আমি ঘুমিয়ে গেলাম কারন আগের রাতে তৌসি আর নিতু আপু আমাকে ঠিক করে ঘুমোতে দেয়নি।ওদের গায়ে একটু হাত পা লাগলেই ওরা আমার হাত পা তুলে আছাড় দিচ্ছিল আর সারাদিন লাফালাফি করে আমার পা ব্যাথা হয়ে গেছে তাই রাত ন’টায় ঘুমিয়ে গেলাম।

.
স্কুলের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি এখানে ওয়েট করবো নাকি রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে যাবো।অন্যদিন দুটোই স্কুল ছুটি হলেও আজ হঠাৎ এক ঘন্টা আগেই ছুটি হলো।দুদিন পর থেকে প্রতিদিন একটা করে মডেল টেস্ট এক্সাম হবে।আজ প্রোগ্রাম দিয়েছে তাই আগেই ছুটি হল।সকালে শ্রাবণ ভাইয়া আমাকে রেখে গিয়েছিলেন আর যাওয়ার সময়ও নিয়ে যাবেন বলেছেন কিন্তু আমি একা এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবোনা।আমার ফ্রেন্ডরা সবাই চলে গিয়েছে তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমিও রিক্সা নিয়ে চলে যাবো।আমি একটা রিক্সা নিয়ে উঠে বসলাম।রিক্সাতে খুব একটা উঠা হয়না তাই বসে থাকতে অসস্থি লাগছে।আমি বিরক্ত হয়ে চলন্ত রিক্সায় দাঁড়ালাম,ভাবলাম একটু সস্তি লাগবে কিন্তু সাথে সাথে ঝাকুনি লেগে তাল সামলাতে না পেরে আমি রাস্তার মাঝখানে পরে গেলাম।আমার পেছনের গাড়িটা সময় মত ব্রেক না কষলে আমাকে চাকার নিচে পিষে দিয়ে চলে যেত।আমি আতংকে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি।এক নিমিষেই কিছু অপরিচিত লোক আমাকে ঘিরে ধরলো।দুটো আপু আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে ধরে তুলল।আমি ঠিক করে দাঁড়াতে পারছিনা পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি দুই হাঁটুই ছিলে রক্তাক্ত হয়ে গেছে।হাঁটুর কাছে সাদা পায়জামাও ছিরে গিয়েছে আর বাম হাতের কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত ছিলে গিয়ে একদম বাজে অবস্থা।আমার আবার একটু রক্ত দেখলেই মাথা ঘুরে তাই এসব দেখেই চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসলো।একটা আপুর উপর ঢলে পরলাম।

হাত পায়ের ব্যথায় ঘুমের মধ্যেও আমি কাঁদছি।কেউ আমার গাল ধরে ঝাকাতেই আমি ধীরে ধীরে তাকিয়ে দেখি দুটো মেয়ে আর তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।আশেপাশে ভাল করে তাকিয়ে দেখি আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি।হাঁটু থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত পায়জামায় রক্ত লেগে শুকিয়ে গিয়েছে।দুই হাঁটুতে আর হাতে ব্যান্ডেজ করা আছে।পরিচিত কাউকে না দেখে আমি হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলাম।আপু দুটো আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

“ছোট আপু কেঁদনা কিছু হয়নি তোমার।হাতে পায়ে একটু ব্যাথা পেয়েছো।আমরা তো তোমাকে চিনিনা,তোমার সাথে পরিচিত কেউ ছিলও না।নাম কি তোমার?”

আমি হেঁচকি তুলতে তুলতে বললাম,”জুঁই আমার নাম,বাসায় যাবো আমি।”

একটা লম্বা আর শ্যামা দেখতে ছেলে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“জুঁই আপু, তোমার ফ্যামিলির কারও ফোন নাম্বার আছে?থাকলে বলো আমরা ফোন করে আসতে বলি।”

আমি উঠে বসে হেঁচকি তুলতে তুলতে বললাম,”ভাইয়ার নাম্বার জানি।”

আমি ছেলেটাকে ভাইয়ার ফোন নাম্বার দিলাম।ছেলেটা ভাইয়াকে ফোন দিল কিন্তু বার বার কল ওয়েটিং আসছে।আমি আপুটাকে জিজ্ঞেস করলাম কয়টা বাজে। আপু বলল সাড়ে তিনটে বাজে।আমি বুঝলাম এতক্ষণ বাসায় যাইনি জন্য সবাই হয়তো আমাকে খুঁজছে।পাঁচ মিনিট পর ভাইয়াকে ফোনে পাওয়া গেল।ছেলেটা একটু দূরে গিয়ে বলল,

“জ্বি আমি সবুজ বলছি।আপনি কি তালহা ভাইয়া?…….আপনার বোন জুঁই,,,,জ্বি জ্বি ওর একটা ছোট এক্সিডেন্ট হয়েছে।………চিন্তা করবেন না তেমন কিছু হয়নি।রিক্সা থেকে পরে গিয়ে একটু চোট পেয়েছে……এতক্ষণ সেন্সলেস ছিল তাই আমরা আপনাকে জানাতে পারিনি কিছুক্ষণ আগেই ওর সেন্স ফিরেছে।”

কথাগুলো বলতে বলতে সবুজ নামের ছেলেটা ফোন কানে ধরে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেল।বাকি দুটো ছেলেও মেয়ে দুটোকে আমার কাছে থাকতে বলে বেড়িয়ে গেল।আমি নাক টেনে ফর্সা,একটু মোটা,গোল ফ্রেমের চশমা পরা আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

“আপু,তোমরা কারা?”
আপুটা নম্রভাবে বলল,”আমি সিমা আর ও মিথিলা।আর আমাদের সাথে তিনটে ছেলেকে দেখলা ওরা আমাদের ফ্রেন্ড।আমরা ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলাম তখনই তো তুমি রিক্সা থেকে পরে গেলা।তোমার সাথে কেউ ছিল না তাই আমরাই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।তোমার কি কোথাও প্রবলেম হচ্ছে?”

আমি আবার কান্না শুরু করে বললাম,”পা ব্যাথা করছে আর হাতও।”

মিথিলা আপু তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আমাকে একটু পানি খাইয়ে দিল।ওরা বাহিরে থেকে খাবার কিনে এনেছিল সেখান থেকে আমাকে খাওয়ালো।খাওয়া শেষে আমি চোখ বন্ধ করে বেডে হেলান দিয়ে থাকলাম কারন ড্রেসে রক্ত লেগে থাকায় ওদিকে তাকালে আমার মাথা ঘুরছে।প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর আমার একটু আলস্য ভাব হতেই কেউ আমার পিঠে আর ঘাড়ে হাত দিয়ে আমাকে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।আমি হকচকিয়ে তাকালাম।লোকটার কাঁধে আমার থুতনি থাকাই আমি লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছি লোকটা শ্রাবণ ভাইয়া ছাড়া আর কেউ নয়।এতক্ষণে আমি যেন আমার আসল ফর্মে ফিরে এলাম।সব সময় অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো আমার একটা গুণ।আমি উনার কাঁধে থুতনি রেখেই কান্না করতে করতে বললাম,

“শ্রাবণ ভাইয়া…..ওই রিক্সা ড্রাইভারটা আমাকে রিক্সা থেকে ফেলে দিয়েছে..এ্যা এ্যা এ্যা।”

উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার দুগালে হাত রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে আমার চোখ মুছে দিলেন।আমার কপালে কিস করে উনার বুকে আমার মাথা চেপে ধরে বললেন,
“ব্যাথা করছে তোমার?কোথায় কষ্ট হচ্ছে?ডোন্ট ক্রাই। তুমি একটু ওয়েট করলা না কেন?আমি দেড়টার মধ্যেই তোমার স্কুলে চলে গিয়েছিলাম।কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না,কত টেনশন হচ্ছিল আমার জানো?”

আমি মাথা তুলে উনার দিকে তাকালাম।উনাকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।যদিও এখন নভেম্বর মাস,গরম নেই বললেই চলে তাও উনার অ্যাশ কালার টিশার্ট জায়গা জায়গা ঘেমে ভিজে গিয়েছে।মাথাও ঘেমে গেছে তাই চিপ বেয়ে ঘাম ঝরে পরছে।চুল গুলো এলোমেলো হয়ে কপালে পরে আছে। ভাইয়ার কন্ঠ পেয়েই উনি বেড থেকে উঠে দাঁড়ালেন।ভাইয়া এসে আমার পাশে বসতেই আমি ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে রিক্সা ড্রাইভারের নামে হাজারও অভিযোগ জানালাম।শ্রাবণ ভাইয়া গিয়ে ওই ছেলে মেয়ে গুলোর সাথে কথা বলতে লাগলেন।ছেলে-মেয়ে গুলো খুবই ভাল আর হেল্প ফুল নাহলে আজকালকার দিনে কেউ কারও জন্য এতটা করে না।হসপিটালের বিল মিটিয়ে ভাইয়া আর শ্রাবণ ভাইয়া আমাকে নিয়ে বাসায় চলে আসলো।বাসায় এসে বুঝলাম সবাই কতটা টেনশনে ছিল।সবাই ভেবেছিল আমাকে কেউ কিডন্যাপ করেছে।আমি সবাইকে বললাম আমার রিক্সাতে বিরক্ত লাগছিল তাই একটু দাঁড়িয়েছি আর ড্রাইভারটা আমাকে ফেলে দিয়েছে।আমার কথা শুনে সবাই আমারই দোষ দিল আর শ্রাবণ ভাইয়াতো আমার উপর অনেক রেগে গেল।ভাইয়া আমাকে আমার ফোন ফেরত দিয়ে বলল এটা যেন আমি সব সময় কাছেই রাখি।আমার কাছে ফোন থাকলে আজকের দূর্ঘটনাটা ঘটতো না।ফোন ফেরত পেয়ে আমি খুবই খুশি হলাম।আগে জানলে ফোন ফেরত নেওয়ার জন্য এরকম ছোট খাটো এক্সিডেন্ট আরও আগে ঘটাতাম।

চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here