#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩
সিদ্ধার্থের সাথে নীরার এত ঢলাঢলি আমি কেন যেন মেনেই নিতে পারছিলাম না । যদিও ওদের হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সিদ্ধার্থের সাথে নীরার সম্পর্ক কোন পর্যায়ের হতে পারে। রাতে হোটেলে ফিরে এ ব্যাপারে আমি নীরার সাথে কথা বলার জন্য ওর রুমে গেলাম। আমি যে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নেইনি এটা নীরা বুঝতে পারার পরেও কোনো কিছুই মনে করছে না। সে তার মতোই চলছে। এটা দেখে আমার আরো রাগে গা জ্বলছে।
আমি রুমে যেতেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নীরা আমার মনের কথা বুঝতে পারল।
– আমি জানি তুই কী জিজ্ঞেস করতে এসেছিস? সিদ্ধার্থের ব্যাপারে কথা বলবি তো! তোকে শুধু এটুকুই বলব যে সিদ্ধার্থ আমার খুব ভালো বন্ধু!
– ভালো বন্ধু? এ কেমন ভালো বন্ধু?
তুই ম্যারিড। এত বড় বড় দুটো বাচ্চা আছে। তা স্বত্তেও এসব করছিস?
– এই যে আমাদের সমাজের নিয়ম! বড় বড় বাচ্চা আছে, ম্যারিড! তার মানে জীবনটাকে সারা জীবন এই ছকে বাঁধা নিয়মের মধ্যেই আমাকে চালাতে হবে তাই তো? সে জীবন ভালো লাগুক আর না লাগুক। জোর করে আমি কোন কিছু করতেই পছন্দ করি না। আমাদের সমাজ কী বলবে বা তোর মত ফ্রেন্ডরা কী বলবি আই ডোন্ট কেয়ার! ম্যারিড বলে কী জীবনে শখ আহ্লাদ নেই আমার?
জীবনটা ক্ষণিকের। ক’দিন বাদেই মরে যাব। তাই যতটুকু এঞ্জয় করা যায় ততটুকুই লাভ। বাচ্চা জন্ম দেয়া দরকার তাই দিয়েছি। তাই বলে কি আমি বুড়ি হয়ে গেছি? আমার চাওয়া-পাওয়ার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমি একজন স্বাধীন মানুষ। একজন অ্যাডাল্ট মানুষ। আমি বুঝি আমার জন্য কী ভালো, আর কী ভালো না।
– প্লিজ! এসব কী বলছিস? তুই নাহিদ ভাইকে ঠকাচ্ছিস! একবারও উনার কথা ভেবেছিস? আর আমাদের কী এখন সেই বয়স আছে? আমরা আজ বাদে কাল মা থেকে শাশুড়ি হব। এখন এসব আমাদের সাথে মানায় না।
– দেখ, তোকে সাথে এনেছি তোর একাকিত্বের কষ্ট দেখে। একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে। তুই তোর মত এঞ্জয় কর আমাকে আমার মত থাকতে দে। তোর মত মেন্টালিটি হলে আমাকেও এভাবেই কষ্ট পেতে হতো সারাজীবন। আমি লাইফটাকে ফুললি এঞ্জয় করতে চাই। আর প্লিজ, এসব কথা আবার দেশে যেয়ে জনে জনে বলে বেড়াস না। অবশ্য তাতে খুব
বেশি প্রবলেম হবে না আমার।
আর কোন কথা না থাকলে তুই এখন যেতে পারিস। সারাদিন আজকে অনেক জার্নি হয়েছে তার উপর ঘোরাঘুরি হয়েছে খুব। তোকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে ঘুমিয়ে পড় যেয়ে।
– আমাকে তাড়াতে চাচ্ছিস মনে হয়?
– কিছুক্ষণ বাদেই সিদ্ধার্থ আসছে। আজ এখানেই থাকবে। আজই কেন যে ক’দিন আছি সিদ্ধার্থ আমার সাথেই থাকবে। এটা নতুন নয়। সিদ্ধার্থকে আমি সেই ছোট থেকেই পছন্দ করি। ও আমার দুই ক্লাস জুনিয়র ছিল। তাই তখন সাহস করে আসলে আগে ওকে কিছু বলা হয়ে ওঠেনি। সেই ভালোলাগা থেকেই মূলত ওর সাথে আমার রিলেশনটা শুরু।
নীরার কথা শুনে আমার গায়ের মধ্যে ঘিনঘিন করে উঠল। ও নির্লজ্জ জানতাম কিন্তু এতটা জানতাম না। ওর সাথে আসাটাই বুঝি ভুল হয়ে গেছে।
– নীরা, তুই কি মানুষ? নাহিদ ভাই কী কোনো অংশে এই সিদ্ধার্থের থেকে কম কিছু?
– দেখতে শুনতে ভালো হলেই সে ভালো হয় না। তোর নাহিদ ভাই তো একটা নপুংসক। বউয়ের চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা উনার যে কোনোকালেই হবে না সে আমি ফার্স্ট নাইটেই টের পেয়েছি। আচ্ছা, বাদ দে! এসব লেকচার দেয়া বন্ধ কর আর নিজের জীবনটাকে এঞ্জয় করতে শেখ৷ এই সতীসাধ্বী থেকে কোনো লাভ নেই। সারাজীবন আনলিমিটেড পেইন সহ্য করার কোনো মানে হয় না। মুক্ত বিহঙ্গের মত ডানা মেলে একটু নীল আকাশে বেরিয়েই দেখ তখন বুঝবি জীবনের আসল মানে! এভাবে ধুকে ধুকে আর কতো বাঁচবি?
– আমরা বাচ্চা নই, নীরা। তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস। তোর এসব কুকীর্তির কথা কারো কাছে আমি বলতে যাব না । আমাকে উল্টাপাল্টা জ্ঞান না দিয়ে নিজের শোধরানোর চেষ্টা কর। আমি আবারো বলছি, তুই নাহিদ ভাইয়ের মত এমন একজন ভালো মানুষকে এভাবে ঠকাস না। সে তোকে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। তোকে ভালোবাসা বলেই হয়তো যেখানে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয়। আর তুই এভাবে তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবি?
– এই যে তোদের মত সো কল্ড শাবানা টাইপের মেয়েদের জন্যই আজকাল মেয়েদের কপালে এত দুর্দশা! এসব বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ভালোবাসা এগুলো হচ্ছে ঠুনকো কাচের মতো। এগুলি নিয়ে আই ডোন্ট হ্যাভ এনি হেডেক।
– ঠিকই বলেছিস। এগুলো কাঁচের মতই। যত্ন করে ব্যবহার করলে সারাজীবন পার হয়ে যাবে আরেকটু অযত্ন হলেই ভেঙে খানখান হতে হতে মুহূর্ত সময় লাগবে না । নাহিদ ভাই যখন এগুলো জানবে তখন তুই বুঝবি জীবন কাকে বলে।
– নাহিদ সবই জানে। আমাদের সম্পর্কটা শুধুমাত্র কাগজে-কলমে টিকে আছে। এর কারণ আমাদের ছেলে মেয়ে দুটো। আজকাল অহরহ ছেলেরা বিয়ের পরে এমন এক্সট্রা রিলেশনে জড়িয়ে থাকে। সেগুলো যদি ঘরের বউয়েরা বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে, সংসারের দিকে তাকিয়ে মেনে নিতে পারে তাহলে হাজবেন্ডরা কেন ঘরের সুখ শান্তি বজায় রাখার জন্য ওয়াইফেরটা মানতে পারবে না? নাহিদের কথা বললি না যে ভালো! হ্যাঁ আমি অস্বীকার করবো না। সে মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো। ও আসলেই ভালো। এসব কিছু নিয়ে প্রথমে অনেক ঝামেলা করলেও এখন একদম বুঝে গিয়েছে। এখন সে বোঝে এগুলো নিয়ে ঝামেলা করলে সংসারে শুধু অশান্তিই বাড়বে কোনো সমাধান আর হবে না। আচ্ছা বাদ দে, তুই আমাকে এসব জ্ঞান দেয়া বন্ধ করে নিজের জীবন নিয়ে ভাব। প্লিজ, তোর রুমে যা।
রাগে গজগজ করতে করতে ওর রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
সারারাত আর চোখে এক ফোঁটা ঘুম এলো না। নীরার কথা শুধু ভাবছি মানুষ এমনও হয়? অবশ্য হলে দোষেরই বা কী? এটা ওর জীবন। ওর জীবন নিয়ে ও যা খুশি তাই করতে পারবে। আমি সেখানে বলার কে? সেলিমের সাথে রাতে কথা হলো না। আমি শুধু ভাবছি ওর কি আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না? ওতো আমাকে একটা ফোন দিতে পারে। এখানে আসার পর যে কয়বার ওর সাথে কথা হয়েছে ফোন আমিই দিয়েছি একবারের জন্যও সেলিম মনে করে আমাকে ফোন দেয়নি। তাই রাগ করে আমিও আর ফোন দিলাম না তাকে।
এপাশ-ওপাশ করতে করতে গভীর রাতের দিকে কখন ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পেলাম না।
পরের দিন সকালে দরজায় বারবার নক করার শব্দে ঘুম ভাঙল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা তখন সাড়ে ন’টা। ভাবলাম নীরা হয়তো নক করছে। তড়িঘড়ি করে উঠে দরজা খুললাম।
দরজায় দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থ। তাকে দেখে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমি এখনও স্লিপিং গাউন পরা অবস্থায়ই আছি।
– কি ব্যাপার ভিতরে আসতে বলবেন না?
– না… মানে… মানে! ঠিক আছে, আসুন।
– ভয় পাচ্ছেন কি?
– না, না, তা কেন? আসুন না।
– এখনো ফ্রেশ হবার সুযোগ পাননি মনে হচ্ছে।
– নাহ। মানে কাল রাতে ঘুম আসছিল না। তাই উঠতে একটু লেট হয়ে গেল। আমি ভাবলাম নীরা এসেছে হয়তো। এভাবেই চলে এলাম।
– ঘুম আসছিল না কেন? ভাইয়ার কথা মনে পড়ছিল কি খুব?
– আরে না । তেমন কিছু না। অন্য একটা বিষয় ভাবছিলাম। কিছুটা চিন্তিত ছিলাম তাই ঘুম আসছিল না।
– ঘুম থেকে উঠার পর আপনাকে দারুণ লাগছে এই লুকে। ফ্রেশ ফ্রেশ লুক।
– থ্যাংক ইউ!
– ব্রেকফাস্টের জন্য নিচে যাব তাই আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম। নীরা ফ্রেশ হচ্ছে। ওর সময় লাগবে তাই একা বোর লাগছিল। আমি আবার ঘুম থেকে ওঠার ব্যাপারে টু মাচ পাংচুয়াল। ঘুম ভেঙে যায় খুব তাড়াতাড়ি। হা হা। ফ্রেশ হয়ে নীরাকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে আপনার খোঁজ নিতে আসলাম।
সিদ্ধার্থকে দেখার পর থেকে আমার মনের মধ্যে শুধুশুধু খচখচ করছিল। গতরাতের নীরার কথাগুলি বারবার মনে বাজছে। সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।
– আপনি কি গতরাতে এখানেই ছিলেন? আই মিন নীরার সাথে?
সিদ্ধার্থ কিছুটা যেন হোঁচট খেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না এই প্রশ্ন করাটা কতটা ঠিক হলো। করে যখন ফেলেইছি কিছুই করার নেই । উত্তরের অপেক্ষা করাই এখন যুক্তিযুক্ত।
খানিক্ষণ নিরব থেকে সে বলল, হুম।
– আপনি কি ওকে ভালোবাসেন?
– ইয়ে মানে!
– দেখুন সিদ্ধার্থ সাহেব! আমাদের বয়সটা এমন একটা পর্যায়ে আছে এখানে ভুল করার কোনো গুঞ্জায়েস নেই। আমরা যা কিছু করছি ভেবে চিন্তেই করছি। নীরা আমার খুব ছোটবেলার ফ্রেণ্ড। ও কেমন সেটা আপনিও হয়তো জানেন আমিও জানি। নীরার দু দুটো বাচ্চা আছে। ওর হাজবেন্ড আছে। উনি খুবই ভালো মানুষ। আমাদের বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই । তাই এ বয়সে হয়তো এ ধরণের আচরণ আমাদের শোভা পায় না। আপনি আনম্যারিড হলেও একটা সংসারের ভ্যালু নিশ্চয়ই বুঝবেন। আপনাদের দু’জনের মাঝে আমার কথা বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত জানিনা। নীরার সাথে তো এসব নিয়ে কথাই বলা যায় না। তাই আপনাকে বলছি । প্লিজ , অন্যভাবে নিবেন না। আপনাকে খুব ভালো লেগেছে। বন্ধুর মনে করে কথগুলি বলছি।
কিছুটা পুরো ভাবে কথাগুলো বললাম আমি।
সিদ্ধার্থ যেন আমার কথায় কিছুটা ধাতস্ত হলো। এ ধরণের পরিস্থিতিতে পড়বে সে ভাবতেই পারেনি। চোরের মত মিনমিনে গলায় বলল,
– দেখুন, এই বয়সে যে সম্পর্কে আমরা জড়াই এটা একদম বুঝেশুনেই জড়াই। একদম ঠিক বলেছেন। আপনার কথাগুলি খুব ভালো লাগছে। আপনি যে আপনার বান্ধবীর মত একদমই না সেটা আমি প্রথমবার আপনাকে দেখেই খানিকটা টের পেয়েছি। অসম্ভব বিচক্ষণ আপনি। বন্ধুই যখন ভাবলেন আপনাকে সত্যি বলতে আমার বাঁধা নেই। নীরার স্বভাবতো জানেনই। ও কোনোদিনই ভালোবাসা পাবার মত মেয়ে নয়। আমি অনেক আগে থেকেই ওকে চিনি। সে কোনোদিনই কারো প্রতি লয়্যাল না। হাজবেন্ডের সাথে কী করে হবে বলুন! ওর মতো মেয়ের কপালে কী করে নাহিদ সাহেবের মতো এমন একজন ভালো মানুষ জুটেছে জানিনা। যে তার হাজবেন্ডের সাথে এমন করতে পারে সে অন্য কারো কী করে হবে বলুন।
– তবে আপনি তার সাথে সম্পর্ক কেন রাখছেন?
– তাহলে ঘটনা খুলেই বলি। নীরাকে আমি পছন্দ করতাম বহু আগে। আপনি জানলে অবাক হবেন নীরার সাথে আমার ফিজিক্যাল রিলেশান হয়েছে ও যখন ইন্টারে পড়ে তখনই। আমি তখন মাত্র এসএসসি দিয়েছি। কিশোর বয়স হয়তো তখনো পার করিনি বা পার করছি করছি মাত্র। আমি মামার বাসাতে গিয়েছিলাম কিছুদিন থাকার জন্য। মামা ভাড়া থাকতেন ওদের বাড়ির তিন তলায়। তখন দূর্গা পূজার ছুটি চলছিল আমাদের। ও আমার সাথে প্রায়ই খামারবাড়ি পূজামণ্ডপে যেত। এছাড়া সারাদিনই মামার বাসায় এসে আড্ডা দিত। আমিও যেতাম মাঝেমাঝে ওদের বাসায়। এভাবেই আমাদের মাঝে একটা রিলেশান গড়ে ওঠে। মনে মনে নীরাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করি। একদিন মামা, মামি , কাজিনরা সবাই পূজামণ্ডপে গিয়েছে । আমি বাসায় একা। নীরা আসল তখন। সেদিনই প্রথম ওর সাথে আমার রিলেশান হয়। এরপর থেকে আমার পুরো পৃথিবী জুড়ে নীরা আর নীরা। নীরার কাছাকাছি থাকার জন্য অনেক কায়দা করে বাবা মায়ের সাথে জিদ করে বাংলাদেশে এসে ভর্তি হলাম। এর মাঝে কতবার যে ওর সাথে আমার রিলেশান হয়েছিল ইয়াত্তা নেই। নীরা আমার থেকে বড় হওয়াতে কেউ তেমন কিছু সন্দেহ করত না। এভাবে বছর দুই চলছিল । এর মাঝে নীরা একবার কন্সিভও করে ফেলে। আমাদের ভয়ে তো হাত পা কাপাকাপি অবস্থা। বয়স কম। অতশত বুঝি না। এক বড় ভাইয়ের বুদ্ধিতে ওর এবোরশান করালাম। উনি নীরাদের বাসার চিলেকোঠাতে থাকতেন। ঢাকা ভার্সিটিতে উনি মাস্টার্সে পড়তেন তখন। এবরশনের সময় নীরার কষ্ট দেখে মনে মনে আমি দৃঢ় সংকল্প করে ফেললাম নীরাকেই আমি বিয়ে করব। শুরুর দিকেই টের পেয়ে গিয়েছিলাম বলে এই ব্যাপারটা কেউ আর কিছু বুঝতে পারেনি। বাসায় এটা সেটা বলে নীরা বেঁচে গিয়েছিল । এর কিছুদিন পরে খেয়াল করলাম নীরা আর আগের মত আমার কাছে আসে না। এভয়েড করে চলে। এরপর আমি একদিন হাতেনাতে নীরাকে ধরে ফেললাম সেই বড় ভাইয়ের সাথে উনার চিলেকোঠার রুমে। নীরা অবশ্য আমাকে দেখেনি। কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল সেদিন।
নীরাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলাম না। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বাংলাদেশে আর নয়। এমন মেয়ের জন্য নিজের জীবন বরবাদের কোনো মানে হয় না। দুই মাসের মাঝে আমি সব গুছিয়ে মা বাবার কাছে চলে আসি। ওকে বলে আসি মা বাবাই জোর করছে যাবার জন্য। ওর মধ্যে তেমন দুঃখবোধ হলো মনে হলো না। কারণ ততদিনে বেশ দূরে সরে গেছি আমরা দু’জন। এরপর আর দেখা হয়নি বহু বছর। ও মাঝমাঝে যোগাযোগ করার চেষ্টা করত আমি দায়সারা উত্তর দিতাম। ও আজ অবধি ও জানে না কেন আমাদের মাঝে এমন দুরত্ব হলো। ও মনে করে আমি কিছুই জানি না। আমিও আর বলতে যাইনি। এরপরে বহুবছর কেটে গেল। আমি বিয়ে করেছিলাম । কোনো এক কারণে আমার সংসার টিকল না। বন্ধু যখন ভাবলেন সেই দুঃখের ঘটনা না হয় আরেক দিন বলব।
ফেসবুকের কারসাজিতে যোগাযোগ হলো আবার নীরার সাথে। ততদিনে সে দুই বাচ্চার মা। ভেবেছিলাম ও হয়তো মানুষ হয়েছে এতদিনে। কিন্তু কোথায় কী! মানুষের আজন্ম স্বভাব সে কি আর বদলায়? হাই হ্যালো কথাবার্তা চলছে এমন সময় সে একবার ওর হাজবেন্ড বাচ্চাসহ ঘুরতে এল ইন্ডিয়াতে। ওর হাজবেন্ডের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলো ছোট ভাই বলে।
সেবার আমাদের আরেক বন্ধুর সাথে দেখা করার নাম করে একাই আমার সাথে একদিন বেরুল । আমি দেখলাম ও এখনো সেই আগের মতই আছে। কোনো চেঞ্জ নাই। আমাকে নানান ভাবে কাছে পাবার বাহানা খুঁজছে শুধু। আমি কিছুটা এভয়েড করার চেষ্টা করি প্রথমে। কিন্তু পুরুষ মানুষ তো! তাছাড়া সেই পুরানো কথা বারবার তোলায় আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। ও ওর হাজবেন্ড বাচ্চাকে হোটেলে রেখে আমার সাথে অন্য হোটেলে সময় কাটায়। এই তো ! এভাবেই গেল দু’বছর। সে মাঝেমাঝে ইন্ডিয়াতে যেত ঘোরার নাম করে। আমাদের দেখা হতো। সে আমাকে বারবার বাংলাদেশ যাবার অনুরোধ করলেও আমি যাইনি।
এরপরে আমি চলে এলাম ব্যাংককে। এখানেও সে আসে মাঝেমাঝে। এই তো! বাকি সব তো দেখছেনই।এখন বলুন, আপনার ফ্রেন্ডের ন্যাচার কত খারাপ। এত বছরে কী সে শুধু আমার সাথেই রিলেশান রেখেছে নাকি অন্য কারো সাথেও সে এমন সম্পর্ক রেখেছে? আমাকে না পেলে সে অন্য কারো সাথে থাকবে। এটা আমি নিশ্চিত।
এটা কি ভালোবাসা নাকি অন্যকিছু আপনিই বলেন।
নির্দ্বিধায় আপনাকে অনেক কথা বলে ফেললাম । মাফ করবেন। কেন যেন আপনাকে অন্য সবার থেকে আলাদা মনে হলো তাই অনেক কথা বলে ফেললাম। জানি খুব খারাপ মানুষ ভাবছেন আমাকে। আমি আসলেই খারাপ , খুব খারাপ। সারাজীবন শুধু খারাপ মানুষদের সাথেই ডিল করেছি। ভালো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো। জীবনের শুরুটাই হয়েছে ভুল মানুষের সাথে।
সিদ্ধার্থের কথা শুনে আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। নীরাকে খারাপ ভাবতাম কিন্তু আমি এতটা খারাপ ভাবিনি কখনই। ও যে সেই আগে থেকেই এত খারাপ সিদ্ধার্থ না বললে এটা আমি জানতেই পারতাম না। এ জন্যই হয়তো আম্মু আমাকে সবসময় ওর থেকে দূরে থাকতে বলত। সে হয়তো বুঝতে পারত ওর স্বভাব চরিত্রের ব্যাপারে। এমন একটা মানুষের সাথে আমি এখনো বন্ধুত্ব রেখেছি ভেবেইও লজ্জা পাচ্ছি। সিদ্ধার্থ যতটা অকপটে স্বীকার করল ও নিশ্চয়ই করবে না কোনোদিন। ওর সাথে এতদূর চলে এসেছি ভাবতেই লজ্জা লাগছে। এতটা নীচ চরিত্রের মানুষ হয়!
আমি কোনো কথা বলছি না দেখে সিদ্ধার্থ বলল, আপনাকে একটা অনুরোধ করব রাখবেন?
– জি বলুন। চেষ্টা করব।
– নীরার মত ফ্রেন্ডের থেকে দূরে থাকবেন , প্লিজ। আপনি বেশ ভালো মানুষ। হয়তো ওর সাথে চলতে চলতে কখন পথভ্রষ্ট হবেন নিজেও টের পাবেন না। আমাকে অনেক খারাপ ভাবছেন । ভাবাটাই স্বাভাবিক। তবে আপনার সাথে মাত্র এই দু’দিনের পরিচয়ে আমি বুঝতে পেরেছি আপনি নীরার অন্য ফ্রেন্ডদের মতো নয়। আমার যদি আপনার মতো একজন বন্ধু থাকত যে সৎ পরামর্শ দিবে তবে জীবনটা হয়তো অন্য রকম হতো। অনেক কথাই বলে ফেললাম। ক্ষমা করবেন, প্লিজ। আমি ব্রেকফাস্টের জন্য নিচে যাচ্ছি । এতক্ষণে নীরাও হয়তো রেডি হয়ে গেছে। আপনার অনেক সময় নিয়ে ফেললাম । ভেরি সরি।
সিদ্ধার্থ চলে যাবার পর কেন যেন সিদ্ধার্থের জন্য খুব মায়া হচ্ছিল। কেন জানি না। বারবারই মনে হচ্ছে ওর চাহনিতে কী এক মায়া জড়িয়ে। আবার নিজেকেই নিজে বকা দিচ্ছি ,” সিদ্ধার্থের জন্য মায়া লাগছে কেন? সেও তো সমান অপরাধী নীরার মত। “
কিন্তু তারপরেও কেন জানিনা সিদ্ধার্থকে আমার মন অপরাধী ভাবতেই চাইছে না। এই ক্ষণিকের পরিচয়ে পরিচিত হওয়া মানুষটিকে খুব আপন মনে হচ্ছে, বন্ধু মনে হচ্ছে।
চলবে….
পর্ব-২
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/324805105968832/