সুখের সন্ধানে পর্ব ৪

0
568

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৪
কোথাও ঘুরতে গেলে আগে থেকেই কোনদিন কী পরব কী না পরবো রেডি করে নিয়ে আসি । সেই হিসেবে আজ বেরুবার আগে আমার সালোয়ার কামিজ পরার কথা। কিন্তু সালোয়ার কামিজ পরতে যেয়েও আবার কী মনে করে লাল জামদানী শাড়িটা পরলাম। তার সাথে ম্যাচিং করে হালকা গহনা আর মানানসই সাজগোজ। আয়নার দিকে তাকাতেই নিজেকে দেখে নিজেই অভিভূত। অনেকক্ষণ ধরে আয়নাতে নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কতদিন নিজেকে এভাবে দেখা হয় না।

মনে হলো আমি তো এখনো সেই আগের মতই আছি । খুব বেশি কী বুড়ি হয়েছি? নাহ! এই রূপের জাদুতে পাগল হয়েই আমাকে মন সঁপেছিল বিশিষ্ট শিল্পপতির ছেলে সেলিম মালিক। আমাকে একটি মুহূর্ত দেখবার জন্য ছটপট করত। শাড়ি পরতে বলাটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আমাকে তো বলেই দিয়েছিল, “বিয়ের পর তুমি এই সালোয়ার কামিজ টামিজ পরতে পারবে না। আমি তোমাকে শাড়ি পরাই দেখতে চাই সব সময়। “ অথচ এখন কবে শাড়ি পরলাম আর কবে সালোয়ার কামিজ পরলাম দেখার মত সময় হয় না তার। এখন আর বলেও না “চলো কোথাও লং ড্রাইভে যাই। খোলা চুলে তুমি পাশে বসবে আর আমি তোমার কালো চুলের মায়ায় হারিয়ে যাবো দূর প্রান্তরে।”

এখন আর সেই লং ড্রাইভের সহযাত্রী করার আবদার করার সময় হয় না সেলিমের। সম্পর্কও বুঝিও মানুষের বয়সের মতো বুড়িয়ে যায়। আশা প্রত্যাশা সবই একসময় হারিয়ে যায় কোন অজানায়। সেলিমের জন্য মনটা পুড়ে উঠল খুব। এক বুক অভিমান নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করতে যেয়েও রেখে দিলাম। ফোনটা রাখতেই হঠাৎ করে টুং করে শব্দ হলো। দেখি সিদ্ধার্থের মেসেজ। “ আমরা নিচে অপেক্ষা করছি” ।

আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। সেই পুরানো দিনের কথা মনে করতে যেয়ে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিলাম যেন। কিন্তু না । এই জাদুর শহরে আর যতক্ষণ আছি এক মুহূর্তের জন্যও আর ভাবতে চাই না সেই সোনালী অতীত যে অতীত আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে প্রতিনিয়ত পিষ্ট করে মারছে।

সিদ্ধার্থ মেসেজিং করাতে বুঝতে পারছি গতকাল রাতের ব্যাপার নিয়ে নীরা আমার উপর রাগ করেছে তাই আমাকে সে না ডেকেই নিচে চলে গেছে। ও রাগ করেই থাকুক । সিদ্ধার্থের কাছে সবকিছু জানার পর ওর প্রতি ঘৃণা ধরে গেছে একদম। ভাবতেই বিরক্ত হচ্ছি ওর সাথে আরো দু’টো দিন পাশাপাশি থাকতে হবে বলে।
পরক্ষণেই আমি নিজের আচরণের কথা ভেবে অবাক হচ্ছি। আমি নীরার উপর রাগ করছি ভালো কথা। সেই সমান অপরাধে তো সিদ্ধার্থও দোষী। তবে সিদ্ধার্থকে কেন আমি ঘৃণা করতে পারছি না? আয়নায় শেষ বারের মত আমি নিজেকে আরেকবার দেখে পরিপাটি করে নিলাম। আয়না নিজেকে দেখছি আর ভাবছি আমার অবচেতন মন শুধুমাত্র সিদ্ধার্থ পছন্দ করে বলেই বুঝি শাড়ি পরতে আমাকে তাড়া দিয়েছে। নিজের পছন্দকে তোয়াক্কা না করেই আমি সিদ্ধার্থকে খুশি করতেই হয়তো শাড়ি পরলাম। এই ঠোঁটজোড়া লিপস্টিকের ছোঁয়ায় শেষবারের মতো রাঙিয়ে নিলাম। কপালের টিপটা ঠিক মাঝখানে আছে কি না খুব ভালো করে পরখ করলাম। মনের অলিগলিতে আসলে ঠিক কী চলছে খানিকক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলাম আর মনের এমন পরিবর্তনের কারণ খুঁজছিলাম । আমিও কি তবে নীরার পথেই হাঁটছি ? সিদ্ধার্থের মনোরঞ্জনের জন্য এত সুন্দর করে সাজলাম! কখনো কি এমন করে এখন আর সেলিমের জন্য আমি সাজি? সেলিম আমাকে এখন আর দেখে না এই অজুহাতে শেষ কবে শুধুমাত্র সেলিমের জন্য সেজেছি মনে পড়ছে না। আজ অন্য কারো ভালোলাগাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের পছন্দকে তোয়াক্কা করছি না। এই কি আমি? হ্যাঁ নিজের পছন্দকে তোয়াক্কা না করে একসময় সেলিমের চাওয়া-পাওয়া কে প্রাধান্য দিতাম। কিন্তু সেখানে আমি অন্য কাউকে আজ কী করে ভাবছি?

হঠাৎ কেন যেন মনে হলো আমিও বুঝি নীরার মত। চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই তো শুরু হয় পথ হারানোর সূচনা। সুখের নাগাল পেতে যেয়ে জীবনটাকে কোনো তিক্ত স্বাদ দিতে আমি রাজি নই। আমি আর নিজের ব্রেইনকে আর আগে-পিছে কোন কিছু চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে ঝটপট করে শাড়িটা খুলে ফেললাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছি খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। দেরী হোক তাও নিজের বিবেকের কাছে নিজে এভাবে হেরে যেতে পারব না। আগে থেকে সিলেক্ট করে রাখা সালোয়ার-কামিজটাই পরলাম। খোলা চুলগুলোকে খুব আঁটোসাঁটো করে বেঁধে নিলাম।
কপালের টিপ টা খুলে টিপের পাতায় রেখে দিয়ে খুব হালকা সাজগোজে তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে পড়লাম নীচে যাবার জন্য।

আমাকে দেখে নীরা খানিকটা গাল ফুলিয়ে বলল, এত দেরি করেছিস কেন? মনে হচ্ছে কোন বিয়ে বাড়ির বরযাত্রী যাচ্ছি আমরা। এভাবে যদি রুমে বসে থাকার জন্য আমরা এখানে এসেছি তাহলে টাকা খরচ করে ব্যাংককে আসার দরকার কি ছিল? বাসায় থাকলেই পারতাম।

আমি নীরার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু বললাম ,সরি। আসলেই খুব দেরী করে ফেললাম। তাকে নিয়ে আমার মনের ভেতর কী চলছে আমি একদমই বুঝতে দিলাম না।

আমার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধার্থ হয়তো কিছু বুঝতে পেরেছে। আমার কেন যেন খুব বুদ্ধিমান মনে হয় লোকটাকে। কিন্তু কেন এটা জানিনা। এমন একজন বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমান মানুষকে নীরার পাশে আমি ঠিক মানতে পারছি না।

তড়িঘড়ি করে ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমরা বের হই। নীরা এটা সেটা বললেও আমি শুধু হু হা করেই উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। নীরা আমার এই থমথমে ভাবটা বুঝতে না পারলেও সিদ্ধার্থ ঠিকই বুঝেছে। নীরা আমার থেকে বেশ সামনে। সিদ্ধার্থ ইচ্ছে করে নীরার থেকে কিছুটা দূরত্ব রাখার জন্য ধীরে ধীরে হাঁটছে।

– আপনি আমার উপর প্রচন্ড রেগে আছেন তাই না?

– না, না । তা কেনো হবে? আপনার ওপর আমি কেন রাগ করব?

– আপনি না বললেও আমি বুঝি। আসলে আমার সম্পর্কে যেসব কথা আপনাকে আমি বলেছি এগুলি জানার পর থেকে আপনি যে আমাকে প্রচন্ড ঘৃণা করবেন এটা আমি জানি । আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলেও তাই করত।
আমি আসলেই ভালো মানুষ না। ভালো মানুষ না বলেই হয়তো সংসারটা টিকল না। একটা ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে দিন পার করছি।

সিদ্ধার্থের কথা আমি কোন জবাব দিচ্ছি না দেখে সে নিজে থেকে আবার বলল,
আজ শাড়ি পরলেন না যে! তবে সালোয়ার কামিজেও কিন্তু আপনাকে দারুন মানায়।

– ধন্যবাদ । প্রতিদিন শাড়ি পড়তে ভালো লাগে না। তাই মাঝে মাঝে ভিন্নতা প্রয়োজন।

– হুম ,এটা ঠিক বলেছেন। মাঝে মাঝে বৈচিত্রেরও প্রয়োজন আছে জীবনটায়। একঘেয়েমি না হলে মাথায় উঠে বসে। কোনোভাবেই নামানো যায় না।

– হুম! তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে একঘেয়েমিই ভালো। সব জায়গা বিচিত্রতা খুঁজতে গেলে জীবনটাকে রঙিন করতে যেয়ে বরং দোজখে পরিণত করা হয়।

– ঠিকই বলেছেন। সব ক্ষেত্রে ভিন্নতা আসলেই অশান্তি ডেকে আনে। আপনাদের তো কাল রাতে ফ্লাইট তাই না?

– জি।

– ক্ষণিকের দেখা এই বন্ধুটির কথা মনে থাকবে নিশ্চয়ই?

– অবশ্যই । আমি আবার সহজে কিছু ভুলি না। অবশ্যই মনে থাকবে আপনার কথা।

– কৃতজ্ঞ হলাম। আমিও ভীষণ মিস করব। সরি, মানে আপনাদেরকে।

– ধন্যবাদ।

ব্যাংককে আমার মনই টিকছে না একদম। জানিনা বাকিটুকু সময় কীভাবে কাটবে? ছেলেটার সাথে কথা বলেছি । ও আসছে আগামী সপ্তাহে। এখনি মন ছুটে যাচ্ছে দেশের জন্য। সেলিমের উপর এক বুক অভিমান জমে আছে। অভিমান জমে জমে পাহাড় হয়ে আছে। এই অভিমানের পাহাড় জানিনা কোনদিন আর কবে বরফের মত গলে গলে সমতল ভূমিতে রূপ নিবে? নাকি আদৌ নিবে না। মানুষটার একবারের জন্যও কি মন চায় না আমার খোঁজখবর নিতে! মেসেঞ্জারে একবার দিনে হাই হ্যালো পর্যন্তই কি আমাদের সম্পর্ক? আমি কেন জানি না সিদ্ধার্থকে দেখলেই কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ছি। যদিও যতটুকু সময় আর আছি তাকে এভয়েড করারই চেষ্টা করছি। মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। আমি বুঝতে পারছি আমার মন প্রচণ্ড খরার পরে এক ফোঁটা শিশির বিন্দুকেও তার খুব আপন ভাবতে চাইছে। মন তো বড় বেয়াড়া । শাসন বারণ সে একদমই মানতে চায় না। কিন্তু তবুও আমাকে মানাতে হবে। আমি এটুকু বুঝতে পারছি সিদ্ধার্থও হয়তো আমার খুব কাছাকাছি আসতে চাইছে। আমি ইশারা দেবার সাথেই সে আরেক ধাপ এগিয়ে আসবে। কিন্তু সেই সুযোগ তাকে একদমই দেয়া যাবে না। নিজের ব্যক্তিস্বত্তাকে বিকিয়ে দেবার কোনো মানে নেই। আমার ভাগ্যই এমন। এই ভাগ্যকেই আমার মেনে নিতে হবে। সুখের সন্ধানে ক্লান্ত হয়ে পথ খুঁজতে খুঁজতে পথহারা হওয়া যাবার মত মেয়ে আমি না। সুখের ঠিকানা কোথাও না কোথাও ঠিকই আছে। আমি হয়তো সঠিক পথটা খুঁজে পাচ্ছি না। আমাকে খুঁজতেই হবে।

এই সেলিমকে পাবার জন্যই একসময় মরিয়া ছিলাম। আমার সব বন্ধু বান্ধবীরা বলত সেলিমের বউ হওয়া আমার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। আমি হার মানিনি । সকলের দেয়া এই ভয়টুকুকে জয় করবার জন্য সেলিমকে ভালোবাসা দিয়ে এতটাই ঘিরে রেখেছিলাম যে সেই আমাকে বাকিপথটুকুতে আলো দেখিয়েছে। আমাকে কিছুই করতে হয়নি। সেই দুঃসময়ের মতো দিনগুলিকে যদি আমি জয় করতে পেরেছি তবে এবার আবার আমাকে সেই সেলিমকে জয় করতে হবে। হয়তো পারব ,না হয় পারব না। তাই বলে পথভ্রষ্ট হওয়া যাবে না একদম। নিজেকে , নিজের মনকে যে করেই হোক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এই সার্কেল থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই নীরাদের মত মেয়েদের সাথে থাকলে পা পিছলাতে খুব বেশি সময় লাগবে না হয়তো। নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগেই নিজেকে এদের থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে। না জানি নীরার মত পর্দার আড়ালে একেক জনের আরো কত রূপ আছে। আমি সেই রূপ আর দেখতে চাই না একদম। আমিই এখান থেকে নিরবে সরে আসতে চাই।

প্লেনে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি বেশ কিছুক্ষণ ধরে। মনটা খুব বিষণ্ণ। চোখজোড়া ভেজা। ব্যাংককে এসেছিলাম একটু সুখের তালাশে। কিন্তু ফিরে যাচ্ছি বিষণ্ণমনে। এয়ারপোর্টে রেখে আসা ওই ক্ষণিকের পরিচিত মুখখানা খুব মনে পড়ছিল। সিদ্ধার্থের মায়া ভরা চাহনিটুকু আমি অনেক কষ্টে এভয়েড করতে পেরেছি। সিদ্ধার্থের সামনে তাকে এভয়েড করার বাহানা করলেও আমি জানি কতটা কষ্ট লেগেছিল তাকে শেষবারের মত বিদায় জানাতে। সিদ্ধার্থের ভেতরেও যে কেমন লাগছিল সেও হয়তো আমি খানিকটা টের পেয়েছি। মেয়েদের এই অদ্ভুত ক্ষমতাটুকু সৃষ্টিকর্তা একদম ঠিকঠাক দিয়ে দিতে ভুল করেননি। কে তাকে পছন্দ করে আর কে তাকে এভয়েড করে এতটুকু বোঝার ক্ষমতা তাদের খুব ভালোভাবেই থাকে। সিদ্ধার্থের চোখের ভাষা আমি টের পেয়েছিলাম। তবে তার মাঝে নোংরামি খুঁজে পাইনি একদমই।

আসার আগমুহূর্তে সিদ্ধার্থের বলা কথাগুলি আমার মনে খুব বাজছে।

নীরার অগোচরে বলা তার সেই কথাগুলি আমি ভুলতেই পারছি না একদম।
বিদায় জানানোর মুহূর্তে সিদ্ধার্থকে আমি আবারও বিয়ে করে সংসারী হতে বললে সে আমার খুব কাছাকাছি এসে আস্তে করে বলল, “ প্রথম দেখাতে মানুষের প্রেম হয় সেটা জানতে খুব দেরি করে ফেললাম। সিনেমার এই ডায়লগে শুনতে শুনতে এই বস্তাপচা ডায়লগটা একদমই সস্তা মনে হতো। ভাবতাম প্রেম আবার প্রথম দেখাতে হয় নাকি? দেখতে দেখতে ভালোলাগার অনুভূতি আসবে। তারপরেই না সেই ভালোলাগা থেকে হবে প্রেম, ভালোবাসা। কিন্তু ভাবনাগুলি ভুল প্রমাণ হলো। বুঝতে পারলাম প্রেম আসার যেমন কোনো নির্দিষ্ট সময় , স্থান, কাল আর বয়সের সীমারেখা নেই ঠিক তেমনি কার সাথে প্রেম হবে এটাও একটা অলৌকিক বিষয়। নিজের মনের অজান্তেই ভালোবাসা হয়ে যায়। “

সিদ্ধার্থ আরো কিছু বলতে যাবে তখনই তাকে থামিয়ে দিয়ে আমি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। কথাগুলিকে আর এগুতে দিলাম না আমি। কেন যেন নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিলাম। সেই বিশ্বাসটুকু যাতে একদমই হাত ছাড়া হয়ে না যায় তাই আর সিদ্ধার্থকে একদমই পাত্তা দিলাম না।

চোখের কোণে জমে থাকা নোনাবিন্দুটুকু টিস্যু দিয়ে মুছে ফেললাম। খেয়াল করলাম নীরা একটা ইংলিশ ম্যাগাজিন পড়ায় খুব মনোযোগী। আমি ব্যাগ থেকে আমার ফোনটা বের করে সিদ্ধার্থের নাম্বারটা ব্লকলিস্টে রাখলাম। তখনও নেটওয়ার্ক কাজ করছিল। আমি ফেসবুক , মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপেও তাকে ব্লক করলাম। কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে নীরাকেও সবখান থেকে ব্লক করে দিলাম। আমি চাই না নীরার সাথে আর কোনো ধরণের যোগাযোগ হোক। আর নীরার সাথে যোগাযোগ করলেই সিদ্ধার্থ সম্পর্কে আবার জানার আগ্রহ বেড়ে যাবে।

বাসায় ফিরেছি কিছুক্ষণ আগে। ফিরেই জানতে পারলাম সেলিম সিলেট গেছে কী একটা কাজে। খুব কষ্ট লাগল। কষ্টটাকে চেপে রেখে ফোন দিলাম । সেলিম জানাল তাদের নতুন ফ্যাক্টরির জন্য জমি দেখতে সিলেট গেছে । ফিরবে কখন ঠিক বলতে পারছে না। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। বারবার সিদ্ধার্থের কথা মনে আসছিল । মনটাকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করতে ছেলের সাথে কথা বলতে ওর হোস্টেলে কল দিলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই প্রিয়কে পেলাম। প্রিয়কে জানালাম আমি ব্যাংককে গিয়েছিলাম। তাকে না জানানোর জন্য প্রথমে রাগ করলেও পরে সরি বলতেই সে হেসে দিয়ে আমাকে ক্ষমা করে দিল এমন একটা ভাব নিয়ে বলল, “ আচ্ছা, বুঝেছি, বুঝেছি। এবার বলো আমার জন্য কী কী আনলে? ছেলের জন্য নিয়ে আসা গিফটের লিস্টের কথা শুনে সে ভীষণ খুশি হলো। কথা শেষে প্রিয় জানাল আগামী সপ্তাহের ছুটিটা তাদের বাতিল হয়ে গেছে। পরীক্ষা শেষ হবার আগে কোনো ছুটি নেই । মনটা আবারো খুব খারাপ হয়ে গেল ।
কতকিছু নিয়ে এসেছি কিন্তু প্রিয় এই মুহূর্তে আসবে না। সারা বাড়িতে একা একা ছটফট করছে মন। রাতে সেলিমকে কল দিলাম। কয়েকবার বাজার পর রিসিভ করে খুব বিরক্তির সাথে বলল, “ এত কল দিচ্ছো কেনো? ফ্রী হলে আমিই তো দিতাম । এখানে ফ্যাক্টরির জন্য হিউজ এমাউন্টের জমি নিতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা যে জমিগুলি নিতে চাচ্ছি ফার্মারদের মধ্যে অনেকে সেগুলি নিয়ে বেশ ঝামেলা করছে। এজন্য কিছুটা দেরী হবে ফিরতে । উনাদের সবাইকে রাজি করিয়ে মোটামুটি একটা সেটলমেন্টে এসেই আমি ঢাকায় ব্যাক করব। প্রতিদিন তো আর আসা সম্ভব না সব কাজকর্ম ফেলে। “
সেলিমের এমন ব্যবহার নতুন না তাই খুব বেশি আর কষ্ট পেলাম না।

খুব মনে পড়ছে সিদ্ধার্থের কথা। ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। ওকে জানানোই হয়নি যে আমি সেফলি এসে পৌছেছি। ও হয়তো আমাকে ট্রাই করেছে। কিন্তু আমি ওকে ব্লক করে রেখেছি তাই ও শত চেষ্টা করলেও আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পারবে না। একবার মন চাইল ওর ব্লক ক্যান্সেল করি। কিন্তু বিবেকের কাছে হেরে গেলাম আমি।

সারারাত ধরে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি সোশ্যাল ওয়ার্কে আবার একটিভ হব। এসব বন্ধুমহল , ক্লাব , পার্টি আসলে আমার জন্য নয়। ব্যাংকক থেকে শ্বশুর , শাশুড়ির জন্য গিফট এনেছি। ভাবলাম কাল সকালেই যাবো তাদের কাছে। এ সুযোগে ওনাদের সাথে দেখা করাও হয়ে যাবে। মনটা হয়তো তাতে কিছুটা ভাল লাগতে পারে।

ভাবনা মতই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় তেমন জ্যাম না থাকার কারণে আমি খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম। নিজ হাতে শ্বশুরের হাতে গিফট দেবার জন্য সকাল সকাল চলে এলেও তাকে পেলাম না। শাশুড়ি মা আমাকে দেখে খানিকটা অবাক হলেন। এত সকালবেলা আসিনি কখনো।
আমি একাই ব্যাংককে গিয়েছিলাম শুনে বেশ অবাক হলেন। কিন্তু আমার সামনে সেটা প্রকাশ করতে না চাইলেও আমি বুঝতে পেরেছি।

সব কুশলাদি বিনিময়ের পরে তার হাতে বাবার জন্য এবং তার জন্য আনা গিফট দেওয়ার পরে ভেবেছিলাম হয় তো খুব খুশি হবেন এবং অন্তত পক্ষে একটা থ্যাঙ্কস আমি পাব । কিন্তু তেমন কোন ভাব লক্ষন দেখছি না। আমি বারবার প্যাকেট খুলে দেখার অনুরোধ করলেও পড়ে দেখবেন বলে রেখে দিলেন।মেইডকে সেগুলো উপরে রেখে আসতে বললেন। আমার সাথে দু’চারটা কথা বলতে বলতে আরেকজন মেইড কফি আর কিছু হালকা নাশতা নিয়ে এলো। আমাকে সেগুলো খাবার অনুরোধ করে উনি কিছুক্ষণ বসেই কী একটা অজুহাতে উপর চলে গেলেন। আমি একা একা বসে আছি। আশেপাশে আর কাউকে দেখছি না। আমার ননদ আর দেবরের বউ হয়তো এখনো ঘুমাচ্ছে। মনে মনে ভেবেছিলাম আজকে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে নাস্তা করব তাই বাসা থেকে নাস্তা করে আসিনি। অথচ আমার শাশুড়ি একবারের জন্য নাস্তা নাস্তা করার কথা জিজ্ঞেস করলেন না।

নিজেকে নিজের খুব ঘৃনা হচ্ছে আমার।

চলবে…..

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/326121785837164/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here