#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৫
আমি ড্রয়িং রুমে বসে আছি বেশ কিছুক্ষণ ধরে। অথচ আমার শাশুড়ি সেই যে চা দিয়ে গেল তো গেল। আর খবর নেই তার । হয়তো উনি আমাকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করেন না। বসে থাকতে খুব বিরক্ত হচ্ছি তাই সেখান থেকে উঠতে চাচ্ছিলাম। জীবনে এত এত অপমান সত্যি এখন অসহনীয় মনে হয়। কাজের মেয়েটাকে দিয়ে খবর পাঠালাম উনি নিচে নামবেন কিনা!
মেয়েটি এসে জানাল, আমার শাশুড়ি কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন।
বুঝতে পারলাম আমাকে যে উনি এখানে বসিয়ে রেখে গেছেন সে কথা হয়তো বেমালুম ভুলেই বসে আছেন। অথবা না ভুললেও আমাকে এখানে বসিয়ে রাখাটা তার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছে না।
আমি আর ওনার আসার অপেক্ষা না করেই সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
গাড়িতে বসেই ফোন দিলাম আমাদের এনজিওর মমতাজ আপাকে। উনি আমাকে বেশ কিছুদিন ধরে মাঠ পর্যায়ে কিছু কাজ করার জন্য অনুরোধ করছিলেন। বস্তিতে বস্তিতে যেয়ে হেঁটে হেঁটে নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া নারী আর বাচ্চাদের নিয়ে একটা কাজ করছেন তিনি। নতুন একটা এনজিও খুলেছেন । তাই খুব পরিচিত মানুষ ছাড়া অন্য কারও হাতে দিতে ভরসা পাচ্ছেন না। কয়েকটা বিদেশি সংস্থা থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে যদি প্রতিবেদন ঠিকঠাক জমা দেওয়া যায়। নতুন এনজিও দেখে অনেকেই কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করছে তার সাথে।
মমতাজ আপা আমার ইউনিভার্সিটি লাইফের বড় আপা। আমাকে ছোট বোনের মতই স্নেহ করেন। মহিলা এই মানবসেবা করতে গিয়ে জীবনে বিয়েশাদিই করলেন না। প্রথম প্রথম উনাকে নিয়ে খুব আফসোস হলেও এখন মনে হচ্ছে উনি ঠিকই করেছেন। এইসব বিয়ে-শাদির বিড়ম্বনায় না পরাটাই বুঝি ভালো।
মমতাজ আপার সাথে চলে এলাম রামপুরা বস্তিতে। সেখানে বেশ সস্তা মানের একটা হোটেলে ঢুকে ডাল পরোটা দিয়ে নাস্তা সারলাম। নাস্তাটা খেতে অমৃত লাগল। ফাইভ স্টার হোটেলের ব্রেকফাস্টের থেকে এখানে নাস্তাটাই বুঝি বেস্ট মনে হল। মমতাজ আপা মগবাজারে তার বাবার আস্ত একটা বাড়ি ভাগে পেয়েছে। মাস গেলে বহু টাকা ভাড়া উঠে আসে সেই বাড়ি থেকে। অথচ চালচলন দেখে মনে হবে পকেটে দুই পয়সাও আছে কিনা সন্দেহ। মমতাজ আপার সাথে যে কদিনই বাইরে বেরিয়েছি এমন সব ছাপড়া হোটেল আর টং দোকানের চা খেয়েই নাস্তা সেরেছি ।
প্রথম প্রথম কিছুটা নাক উঁচু ভাব দেখালেও এখন আমার কাছে ব্যাপারটা একদম স্বাভাবিক। খুব সাদাসিধে মানুষ মমতাজ আপা।
একটা গলির মাঝে গাড়ি রেখে আমরা পায়ে হেঁটে রওনা হলাম বস্তুির ভেতরে। চিকন সরু গলি ধরে যতই সামনের দিকে এগুচ্ছি ততই আমার গা ঘিনঘিন করে উঠছে। কিন্তু মমতাজ আপার মধ্যে তেমন কিছুই লক্ষণীয় মনে হলো না। তিনি খুব সাবলীলভাবে অন্ধকার, সরু, স্যাঁতস্যাঁতে রাস্তাটা দিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছেন। আমিও কোন উপায়ান্তর না পেয়ে তাকে অনুসরণ করে যাচ্ছি।
চারপাশে ছোট ছোট বাচ্চাদের চিৎকার কান্নাকাটির শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার মতো অবস্থা। বাচ্চাগুলোর চেহারার দিকে তাকিয়েও বেশ বিরক্তিভাব নিয়ে আমি মমতাজ আপাকে অনুসরণ করে চলছি।
বেশিরভাগ ছোট বাচ্চাদেরই গায়ে ঠিকঠাক কাপড় নেই। অনেকের তো পরনের প্যান্টটা পর্যন্ত নেই। নাক দিয়ে সর্দি গড়িয়ে পড়ছে। গায়ে গতরে ধুলোয় মাখামাখি। চেহারা দেখলে মনে হয় না যে গত এক মাসের মধ্যে এগুলোকে গোসল করানো হয়েছে।
মমতাজ আপাকে দেখলাম ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে কথা বলছেন। খেয়াল করে দেখলাম সে কয়েকজনের নাম পর্যন্তও জানে।
খুব বেশি অবাক হলাম না কারণ আমি বুঝতে পারলাম মমতাজ আপা এখানের নিয়মিত অতিথি। আপা ব্যাগ থেকে কিছু চকলেট বের করে বাচ্চাগুলো হাতে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকেন।
মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরে জীর্ণশীর্ণ একটা খুপরি ঘরের মধ্যে ঢুকলেন মমতাজ আপা। আমাদের আসার কথা হয়ত উনি আগেই জানতেন।
বিছানার উপরে বেশ চকচকে একটা চাদর বিছানো। বোঝাই যাচ্ছে খানিক সময় আগে হয়তো এটা বিছানো হয়েছে। আমরা এসেছি ষাটোর্ধ কুলসুম বিবির কাছে। ওনাকে বয়সের থেকে অবশ্য আরো বেশি বৃদ্ধা মনে হচ্ছে। তবে কথাবার্তায় বেশ পটু। পুরো বস্তির খোঁজখবর, হালনাগাদ তার নখদর্পণে। কুলসুম বিবিকে দেখতে এমন লাগলেও উনি যে বেশ দাপুটে মহিলা সেটা কিছুক্ষণ কথা বলেই বোঝা গেল। উনিই এই বস্তির ম্যানেজার। বস্তির সব ঘর থেকে ভাড়া তোলার এবং ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব ওনার।
মমতাজ আপা একটা খাতা বের করে উনার কাছ থেকে নানান ধরনের তথ্য নিচ্ছেন আর সেটা খাতায় টুকে নিচ্ছেন। এত এত নাম আপা কী করে মুখস্ত রাখেন সেটা ভেবেই অবাক হলাম। বেশ কিছু ইনফরমেশন সংগ্রহের পরে তিনি কয়েকজনকে ডেকে ডেকে তাদের সাথে কথা বলেন। আবার আমাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে কয়েক জনের ঘর পর্যন্ত যান।
আমারতো ঘরের ভিতরে ঢুকতেই ভিতরের পরিবেশ দেখে গা ঘিনঘিন করছে। খুব সংকীর্ণ একটা রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে কয়েকজন থাকছে। ঘরের ভিতরের পরিবেশ দেখে আমার আর সেখানে বসার রুচিতে কুলালো না। মমতাজ আপা ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। খেয়াল করে দেখলাম তিনি অকপটে অন্যদের সাথে মিশে যাচ্ছে। বসার জায়গা না পেলে নিজেই ঝেড়ে মুছে খাটের কোনায় একটু জায়গা করে বসে যায়। আমাকেও সেখানে তার পাশে বসার অনুরোধ করে। মমতাজ আপার অনুরোধ ফেলতে পারিনা। কোন রকম করে নাক চোখ বুজে তার অনুরোধ রক্ষা করছি।
মমতাজ আপাকে আমি ইশারায় বোঝালাম আমার পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব না। উঠে যাওয়ার জন্য উদ্যত হচ্ছি ঠিক সে সময় মমতাজ আপা আমার হাতটা চেপে ধরল। চোখের ইশারায় আমাকে সেখানে বসতে অনুরোধ করল।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে বস্তিতে আমরা নানান ধরনের তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ করে বাইরে বের হই।
মমতাজ আপা গাড়ি নিয়ে না আসলেও আমার সাথে গাড়ি ছিল। দুজনে গাড়িতে বসলাম। গন্তব্য মমতাজ আপার অফিস । সেখানে যেয়ে তথ্যগুলোকে সে আবার তার ল্যাপটপে নথিভূক্ত করবে। তার সাথে থেকে আমাকেও সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করল।
– আপা, তুমি আমাকে যে কাজ দাও করব। অফিশিয়াল কাজ দাও সেগুলো আমি করছি। বাট এখানে আমাকে আর প্লিজ নিয়ে এসো না।
– আমি বুঝতে পারছি তোর খুব খারাপ লাগছে। আসলে ওখানকার পরিবেশটাই এমন। তোর বা আমার স্ট্যাটাসের কেউই সহজে এখানে এসে মানিয়ে নিতে পারবে না। আসলে আমরা উঁচুতলায় থাকতে থাকতে ওদেরকে মানুষের কাতারেই গণ্য করি না। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুই পারবি। প্রথম প্রথম আমারও কিছুটা খারাপ লাগত। কিছু দিন আমার সাথে থেকে দেখ এরপরেও যদি এডজাস্ট করতে না পারিস তাহলে আর আসতে হবে না। দেখ, বুঝতেই তো পারছিস নতুন এনজিও। আমার সাথে এখন পাশে এমন কাউকে দরকার যে তার শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করতে পারবে। আমিতো সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী মানুষ তাই দিনের চব্বিশটা ঘন্টা এ নিয়ে পড়ে থাকলেও আমার কোনো সমস্যা হবে না। আমার মনে হয় আমার মত তুইও সেটা পারবি। সংসার নিয়ে তোর কোন ক্যাচাল নেই। নিজেকে ব্যস্ত রাখার মত কাজ পাচ্ছিস না। উল্টাপাল্টা মানুষের সাথে মিশে বেড়াচ্ছিস। আমি আজকাল খবর কিন্তু সবই পাচ্ছি। এসব ক্লাবে ফ্লাবে না যেয়ে কিছুদিন মানুষের সেবায় কাজ করে দেখ খুব ভালো লাগবে।
এদের সাথে মিশে যা দেখবি এরা মানুষ খারাপ না।
– আপা, তোমার কথা ঠিক আছে কিন্তু ……
– কোন কিন্তু না। একটা ব্যাপার বোঝ। ছোট হোক বড় হোক যে কোনো সংগঠন দাঁড় করাতে শুরুর দিকে প্রচুর আন্তরিক ইফোর্ট দিতে হয়। কোন রকম ফাঁকিবাজি করা বা ঘাপলা করা হলে সংগঠন দাঁড় করানো খুবই কঠিন হয়ে যায়। এই কাজগুলো আমি একজন মানুষ রেখেও করতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা চাই না। হ্যাঁ, মানুষ আমি রাখব কিন্তু তার আগে এদের সম্পর্কে সবকিছু আমাকে নিজের নখদর্পণে নিতে হবে। আশা করছি আমার কথা তুই বুঝতে পেরেছিস। তারপরেও আমি তোকে জোর করব না। এখানে আসা না আসা তোর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুই বাসায় যেয়ে আরো সময় নিয়ে ভাব।
– ঠিক আছে, আপা।
ডিনারে আমি তেমন কিছু খাই না সাধারণত । হালকা-পাতলা কিছু খেয়ে রুমে এলাম। সারাদিন মমতাজ আপার সাথে ঘুরতে ঘুরতে অনেক ক্লান্ত। একবারের জন্যও কথা হয়নি সেলিমের সাথে। ফোনটা হাতে নিয়ে বারবার কল দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু সেলিমের কোন খোঁজ খবর নাই। সেলিমের সাথে কে কে সিলেটে আছে বা নেই সেই খবরও আমার জানা নেই। আন্দাজে কাকে ফোন দিব বুঝতে পারছি না। আমি না হয় সারা দিন ফোন দেইনি সেলিমেরও কি দায়িত্ব ছিল না আমাকে একবার ফোন দিবার? যাই হোক নিজের দায়িত্ব পালন করার জন্য সেলিমকে খুঁজে পাওয়ার জন্য কাকে ফোন দিব ভাবছি।
অনেকটা অন্ধকারে ঢিল মারার মত আলিম চাচাকে ফোন দিলাম। উনি সেলিমের সব কাজকর্মের স্কেজুল করে থাকেন। ভাবলাম উনিও হয়তো সিলেটে থাকতে পারেন।
– আসসালামু আলাইকুম, চাচা। অসময়ে মনে বিরক্ত করলাম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। না, না, মা।
এমন কেন বলছেন? কী খবর বলেন।
– সেলিমকে ফোনে পাচ্ছি না। তাই আপনাকে নক করলাম। একটু জানাতে পারবেন ও সিলেটে আর কতদিন থাকবে? আর সাথে কে আছে যার সাথে কন্ট্যাক্ট করলে ওর খবর পাওয়া যাবে?
– জি মা। জানেনই তো স্যারের জমির ব্যাপারে একটু দেরি হচ্ছে। এক্স্যাক্ট কয়দিন লাগবে জানিনা। তবে আরো এক সপ্তাহের আগে মনে হয় না আসতে পারবে।
– সো স্যাড! আচ্ছা, ওর সাথে আর কে কে আছে? আপনি কি এখন সিলেটে নাকি ঢাকাতে?
– না, মা। আমি যেতে পারিনি। স্যারের সাথে আছে তো অনেকেই। পনেরো জনের একটা টিম গিয়েছে। তবে স্যারের খোঁজ খবর জানার জন্য হেলেনই বেটার। স্যারের সাথে তার পার্সোনাল সেক্রেটারি হেলেন আছে। আপনি ওকে ফোন দিলে হয়ত পাবেন।
– হেলেন? হেলেন আবার কে?
– আপনি হেলেনের কথা জানেন না?
– নাহ!
– মাস তিনেক আগে উনি জয়েন করেছেন আমাদের অফিসে। কাজকর্মে খুব পটু এবং স্মার্ট হওয়াতে স্যারের সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
– ওহ! আগে তো আশিক নামের একটা ছেলে সেক্রেটারি ছিল, তাই না। এজন্যই আশিককে আমি বার বার কল দিয়েও পাচ্ছি না।
– আশিক নিজেই জব ছেড়ে চলে গেছে। অন্য জায়গায় ওর একটা আরো ভালো চাকরি হয়েছে।
– ও আই সি! বাট, এ কথা আমাকে জানায়নি সেলিম। আচ্ছা এক কাজ করেন আমাকে হেলেনের নাম্বারটা একটু পাঠিয়ে দিন।
আলিম চাচা নাম্বার পাঠানোর সাথে সাথে আমি হেলেনের নাম্বারটা মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্টে এড করলাম। কন্টাক্ট লিস্টে এড করার সাথে সাথে হেলেনের ইমো আইডি থেকে একটা নোটিফিকেশন পেলাম । আমি ওর ইমো আইডির প্রোফাইল পিকচারটা খুব ভালো করে দেখলাম খানিকক্ষণ। মেয়েটা দেখতে আসলেই বেশ স্মার্ট এবং সুন্দরী। বয়সটাও আন্দাজ করে নিলাম। মনে হচ্ছে সদ্য পাশ করে বেরিয়েছে। এই বয়সের মেয়েরাই নিজেদের ক্যারিয়ারকে গুছিয়ে তোলার জন্য অনেক বেশি কর্মোদ্যমী হয়ে থাকে। হেলেনও নিশ্চয়ই তার বিকল্প নয়। এজন্যই হয়তো সেলিমের ওকে পছন্দ হয়েছে।
মনে মনে খানিকটা অবাক হলাম এবার একজন মেয়ে সেক্রেটারি রাখার জন্য। এর আগে অবশ্য একজন ছিল তবে উনি কিছুটা বয়স্ক। সেলিম আমাকে হেলেনের কথা জানাল না কেন এটা ভেবে খানিকটা অবাক হচ্ছি। অবশ্য অবাকও ঠিক হচ্ছি না। কারণ সেলিম আমাকে কোন কথাটাই বা জানাই?
সাত পাঁচ ভাবা বাদ দিয়ে হেলেনের নাম্বারে ডায়াল করলাম। যদিও রাত অনেক। তারপরেও সেলিমের খোঁজখবর নেয়াটা এই মুহূর্তে বেশি জরুরি।
কয়েকবার রিং বাজতেই ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো! খুব মিষ্টি একটা কন্ঠে হ্যালো বলার সাথে সাথে আরেকটা পুরুষ কন্ঠের আওয়াজ টের পেয়ে আমি থেমে গেলাম।
– এসময় কে ফোন দিয়েছে?
– জানিনা স্যার। একটা আননোন নাম্বার!
– কেটে দাও! এসময় আমার থেকে গুরুত্বপূর্ণ তোমার আর কোন কিছু হতে পারে না! এখন আমরা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছি। এর মধ্যে কোন ফোন কল অ্যালাউ করো না, প্লিজ।
– ওকে স্যার।
আমি হ্যালো বলার আগেই সাথে সাথেই ফোনটা কেটে গেল। মেয়েটার কন্ঠ অপরিচিত হলেও বুঝতে পারলাম এটা হেলেনের কণ্ঠ। কিন্তু পাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠটি আমার কাছে একদমই অপরিচিত না। এই কন্ঠ ভুল হবে অন্ততপক্ষে এতটা বোকা তো আমি না।
বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে আসছে। চোখ দুটো মুহূর্তেই নোনা জলে ভরে গেল। আমি স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবিনি সেলিম আমার সাথে এমন করবে। সেলিমের সাথে আমার দূরত্ব বেড়েছে এটা ঠিক কিন্তু তাই বলে এতটা বেড়েছে এটা আমার মাথায়ই আসে নি কখনো।
সেলিম তো এমন কখনোই ছিল না। তবে কি আমার ভাগ্যটাই খারাপ?
কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। হঠাৎ করে অ্যাজমার সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে মনে হলো। দৌড়ে গিয়ে খুঁজে খুঁজে ইনহেলারটা বের করলাম।
কতক্ষণ কেঁদেছি হিসেব নেই। এই মুহূর্তে কোন আপন জনের সাথে কথা বলতে পারলে হয়তো কষ্টটা কিছুটা কমতো।
কিন্তু আমার তো কোন আপনজন নেই। ছোট বোনের সাথে কথা বলতে পারলে খুব ভালো লাগত কিন্তু ওর সাথে তো যোগাযোগ নেই বহুদিন।
সারারাত আর ঘুম হল না। সকালবেলা ফোনটা হাতে নিয়েই মমতাজ আপাকে ফোন দিলাম। তাকে জানিয়ে দিলাম আমি তার সাথে কাজ করতে আগ্রহী।
এর পরের দুটো দিন বিষন্ন মনে মমতাজ আপার সাথে এ বস্তি সে বস্তির অলিতে-গলিতে চষে বেড়ালাম। মমতাজ আপা মন খারাপের কারণ বারবার জানতে চাইলেও আমি এ কথা সে কথা বলে কাটিয়ে দিলাম।
বস্তির এই নিরীহ মানুষগুলোকে দেখে প্রথম প্রথম গা ঘিনঘিন করে উঠত কিন্তু এখন আর তেমন মনে হয় না। উল্টো এদেরকে কেমন যেন ভালোবেসে ফেলেছি মনে হচ্ছে। মানুষগুলি খুবই নিরীহ এবং সরল মনের। এদের অভাব আছে কিন্তু অভিযোগ নেই। পেটভরা ক্ষুধা আছে কিন্তু মুখে হাসির অভাব নেই।
হঠাৎ কি যেন মাথায় এলো নিজেও জানিনা। মমতাজ আপাকে জানিয়ে দিলাম আমি কিছুদিনের জন্য ঐ বস্তিতে থাকতে চাই। এদের সাথে মিশে যেতে চাই। এরা যেভাবে চলে সে ভাবে চলতে চাই। এরা যা খায় আমিও তাই খেতে চাই । আরাম আয়েশের জীবন তো অনেক হলো। কিছুদিনের জন্য না হয় সেটাকে বিসর্জন দিয়ে দেখা যাক। আমার জন্য একটা রুম ব্যবস্থা করে দিতে বললাম আপাকে।
আপাতো আমার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল।
প্রথমে ভেবেছিলো আমি হয়তো মজা করছি। কিন্তু আমার দৃঢ়তা দেখে কিছুসময়ের মধ্যেই সে বুঝতে পারে আমি কোন মজা করছি না।
আপা আমাকে নানান ভাবে বুঝাল এখানে থাকলে আমার কি কি অসুবিধা হবে। কিন্তু আমি তার কোন কথাই শুনলাম না। আপাকে জানিয়ে দিলাম আগামীকালের মধ্যেই আমি রুম চাই। আপা আমার খামখেয়ালীপনা দেখে কিছুটা বিরক্ত হলেন। তার পরেও আমার জন্য ঠিকই একটা রুম ম্যানেজ করে ফেললেন।
গতকাল বিকেলের দিকে সেলিম একবার কল করেছিল। আমি ইচ্ছে করেই রিসিভ করিনি। ওর সাথে একদম কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমার। কথা বলতে গেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। তাছাড়া কি জিজ্ঞেস করবো সবই তো নিজের কানেও শুনলাম। আগামীকাল ব্যাগপত্র নিয়ে এখানে এসে থাকার পরিকল্পনা করে ফেললাম। অন্ততপক্ষে আমার ছেলে প্রিয় আসার আগ পর্যন্ত।
চলবে….
প্রিয় পাঠক,
বেশ বিরতির পরে আপনাদের সাথে আবার দেখা। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া, বাড়ি থেকে আসা, আসার পরে নানান ধরনের কাজকর্ম গোছাতে গোছাতে লেখায় হাতই দেওয়া হয়নি। এবার বেশ বড়সড় রকমের অন্যায় করে ফেলেছি আপনাদের সাথে। এতটা অপেক্ষায় থাকা সত্যিই বড় কষ্টের।
আজ এতটুকুই দিলাম। ইন শা আল্লাহ, আগামীকাল আবার পর্ব পাবেন।
পর্ব-৪
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/328256402290369/