সুখের_সন্ধানে পর্ব_৩১

0
448

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩১

ভেজা চোখে ফোনটা রিসিভ করল মিথিলা। আবার সাজিদ ফোন দিয়েছে। মন না চাইলেও সৌজন্যতা দেখিয়ে হলেও ফোনটা রিসিভ করা উচিত বলে ভাবল সে।

– হ্যালো! আমি কি তোমাকে খুব ডিস্টার্ব করলাম? ডিস্টার্ব হলে তবে পরে কথা বলি। অপরাধীর কণ্ঠে বলল, সাজিদ।

তার কথার ধরণ শুনে মিথিলার খুব মায়া হলো।

– কৃত্রিম হাসি দিয়ে মিথিলা বলল-না না ডিস্টার্ব করবেন কেনো! ডিস্টার্ব হবে এমন কেন মনে হল আপনার কাছে?

– না মানে…তখন কল কেটে দিলে তাই ভাবলাম ডিস্টার্ব ফিল করলে কিনা! বাসায় ঠিকঠাক পৌঁছেছ কিনা তাই ফোন দিয়েছিলাম।

– ভাইয়া সামনে ছিল তাই কেটে দিয়েছিলাম। মাফ করবেন। জি, পৌঁছেছি ঠিকঠাকই। খোঁজখবর নেয়ার জন্য ধন্যবাদ। তবে রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল তাই একটু দেরি হয়েছিল পৌঁছাতে। এছাড়া কোনো সমস্যা হয়নি।

– তা কেমন লাগলো আমাদের বাসা তোমার?

– হুম ভালোই। আপনার আম্মা আর আপনার ছোটবোনতো অমায়িক মানুষ। খুব ভালো লেগেছে ওনাদেরকে আমার। আর আপনার বাগানটাতো অনেক বেশি ভালো লেগেছে। আপনার বাগান থেকে আমার আসতেই মন চাচ্ছিল না। চারপাশ থেকে ভুরভুর করে হাসনাহেনা গন্ধরাজ আর কামিনীর গন্ধ আসছিল। আমি যেন অন্য জগতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম।

– সত্যি? এত ভালো লাগছে তোমার?

– মিথ্যে বলব কেন?

– যাক, আমার বাগান তবে সার্থক হলো। তোমার মত এত সুন্দর করে কেউ প্রশংসা করেনি আমার বাগানের। আম্মা তো সারাক্ষণই আমাকে বকতে থাকে এই বাগানের পিছনে সময় নষ্ট করি বলে ।

– হা হা হা। মায়ের এমনই। তারা চায় তাদের সন্তান দুধে-ভাতে থাকুক। মায়েরা সন্তানের গা থেকে ঘাম ঝরা সহ্য করতে পারে না।

– এটা ঠিক বলেছ আম্মা সারাক্ষণই বাচ্চাদের মত আমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হই।

– ছি ছি! বিরক্ত হবেন কেন? মায়ের ভালোবাসা সবার ভাগ্যে জোটে না। আপনি কত বড় ভাগ্যবান আপনি জানেন! আপনার মা এখনও আপনার চোখের সামনে আছেন, আপনাকে এভাবে আদর করেন, আগলে রাখেন। কত বড় নেয়ামত এটা আল্লাহ পাকের।

– ঠিকই বলেছ। মায়ের প্রসঙ্গ তুলে তোমাকে হয়তো কষ্ট দিয়ে ফেললাম।

– কি যে বলেন! না, কষ্ট পাবো কেন? এটা তো বিধির বিধান। আম্মু নেই কষ্ট তো পাচ্ছিই তার অভাবে। তবে সেই অভাবটা আমি অনেকটাই টের পাই না। রুম্পা মায়ের মতো খালামণি থাকলে কষ্ট পেতে হবে কেন, বলুন! আমাদের দুই ভাই-বোনকে রূম্পা মা আগলে রাখছেন মায়ের পরম মমতায়।

– আল্লাহর রহমত! শুনে ভালো লাগছে। আচ্ছা, এত রাতে তোমাকে ফোন দিয়ে এত কথা বলছি বিরক্ত হচ্ছো না তো?

– না, না। বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। আপনি কি আমাকে আর কিছু বলবেন?

– না, মানে বলতে চাচ্ছিলাম আমি যদি তোমাকে মাঝে মাঝে ফোন দেই তুমি কি খুব খারাপ ভাববে আমাকে ?

– মিথিলা কিছুটা থেমে তারপরে বলল, একদমই না। আপনি ফোন দিলে বরং আমার ভালোই লাগবে। মন খুলে গল্প বলার মত একজন মানুষ দরকার। আজকে ছাদে আপনার সাথে গল্প করে মনে হলো আপনার সাথে মন খুলে কথা বলা যায়।

– তাই নাকি! আমি এত ভালো গল্পকার জানা ছিল না।
আচ্ছা, আমি যে তোমাকে ফোন দিয়েছি এনিয়ে প্রিয় কি কিছু বলেছে?

– হুম, বলেছে।

– কি বলেছে একটু উৎকণ্ঠার সাথেই জিজ্ঞেস করল সাজিদ।

– মিথিলা কোন রাখঢাক না করেই সরাসরি মুখের উপর বলে ফেলল বলেছে, আপনি নাকি আমাকে পছন্দ করেন। আপনি নাকি আমার জন্য লাট্টু হয়ে আছেন। অবশ্য ব্যাপারটা আমার বিশ্বাস হয়নি। তাই আপনার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে ফোনের ওপরে নীরবতা বিরাজ করছে। সাজিদ কি বলবে মুখ থেকে কোন কথাই বেরোচ্ছে না।

নিজের এমন বেহায়াপনায় নিজেই কিছুটা অবাক হল মিথিলা। এমন অকপটে কথাগুলো বলে ফেলতে পারবে সে কখনোই ভাবেনি। আজকে সে নিজেও জানে না তার উপরে কি ভর করেছে। মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে। কোন রাখঢাক ছাড়াই সে সাজিদের সাথে এভাবে কথা বলতে পারবে এটা সে কল্পনায়ও ভাবেনি। তার মাথায় শুধু দাদির বলা কথাগুলো ঘুরছে। তাকে আগামী পনেরো দিনের মধ্যে এই বাড়ি ছাড়তে হবে। একথা রুম্পা মায়ের কানে গেলে কি যে হবে সেটাই সে ভেবে কূল পাচ্ছে না। তাকে নিয়ে না তার রুম্পা মায়ের সংসারে আবার নতুন কোনো অশান্তির সৃষ্টি হয়। যে করেই হোক এখান থেকে তার বের হতে হবে। কোথাও যদি যাওয়ার জায়গা না হয় তবে সে তার বাবার কাছে ফিরে যাবে। কিন্তু তাতে হয়ত অশান্তি কমবে না। বরং বাড়বে। ওখানে রুম্পা মা কিছুতেই তাদেরকে যেতে দিবে না। তাই মিথিলা মনে মনে পরিকল্পনা করল এমন কিছু করতে হবে যাতে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব আর রুম্পা মায়ের সংসারেও কোন অশান্তির আঁচ না আসে।

– কি ব্যাপার কথা বলছেন না যে! ভাইয়া কি সত্যি বলেছে নাকি বানিয়ে বানিয়ে আমাকে মিথ্যে বলেছে?

– মনে করো প্রিয় যদি সত্যি বলে থাকে তবে তোমার কোন আপত্তি থাকবে না তো!

– আপত্তি বিপত্তির কথা আসছে কোথা থেকে? এখনো পর্যন্ত আমিতো কিছুই জানিই না। ভাইয়ার মুখে জাস্ট শুনেছি। কেউ যদি সাহস তার মনের কথা না বলে তাহলে আমি জানবই বা কি করে আর আপত্তিই বা করব কখন?

মিথিলার কথার মধ্যে সাজিদ একটা পজেটিভ উত্তর খুঁজে নিলো। সে সাহস করে মিথিলাকে বলল, আগামীকাল তুমি একটু সময় দিতে পারবে আমাকে? তুমি যদি একটু সময় ম্যানেজ করতে পারো! কালকে তো শুক্রবার আছে। আমরা একটু টিএসসিতে বসতে পারি।

– আমার বাসার কাছাকাছি কোথাও বসা যায় না? আমি তবে শিওর কিছু বলতে পারছি না। কারণ টেকনিক করে সময়টা ম্যানেজ করতে হবে। যেহেতু কালকে হলিডে তাই চাইলেই বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না। রুম্পা মা পারমিশন দিলে তবে আমি বের হতে পারব।

– কিছু একটা বলে বের হও। আমি কল দিব কাছাকাছি এসে।

– ওকে! কথা দিচ্ছি না , তবে ট্রাই করব।

সাজিদ ফোন রাখার পর মিথিলা নিজেকে প্রস্তুত করল এই পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে। এত অপমানের জীবন আর না। এ বাড়িতে থাকলে সে দিনদিন প্রিয়র প্রতি আরো দুর্বল হয়ে যাবে। যেটা কারোরই কাম্য নয়। এমনকি সে নিজেও চায় না। তাছাড়া প্রিয় যদি ব্যাপারটা বুঝে যায় তাহলে তাকে নিয়ে না জানি সে কি ভাববে! কত খারাপ ভাববে। প্রিয়কে মন থেকে মুছে ফেলাই এখন সবচেয়ে বড় সমাধান। এই মুহূর্তে নিজেদের বাসায় ফিরে যাবে তাতেও রূম্পা মা অনেক কষ্ট পাবে। যদিও সে জানে ও বাসাতে তার সৎ মায়ের দুই ছেলের মাঝে ওখানে এত বছর পরে সে আর তার ভাই একেবারেই অনাহুত ।

ভাবতে ভাবতে চোখজোড়া ভিজে উঠল তার। সে ভাবছে আসলে তারা কোথায় তবে অনাহুত নয় ? তাদের নিজের বাসাতেই তারা আজ বাইরের মানুষ। যেখানে তাদের জন্ম , বেড়ে ওঠা সেখানেই আজ বড় অচেনা।

এখানে কোনোকিছুরই কমতি নেই । আরাম আয়েশের জীবন । না চাইতেই সবকিছু নিয়ে হাজির হয় রূম্পা মা। তারপরেও এখানে তারা আশ্রিত এটা বারবার মনে করিয়ে দেয় চারপাশ। মাঝেমাঝে মনে হয় এর শেষ কোথায়? কিন্তু উত্তর মিলে না। দম বন্ধ হয়ে আসে আজকাল। এখান থেকে মুক্তি চাই তার। মুক্তি চাই! যে করেই হোক!

সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই সেলিমের মুখ ভার। ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। কাল রাত থেকেই কেমন থমথমে ভাব নিয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে হলো না। আজকাল ত্যাড়াত্যাড়া উত্তর দেওয়া ছাড়া কথাই বলতে পারে না। আমি গোসল শেষ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। সেলিম এরমধ্যে বলল,

– আচ্ছা, মিথিলা এবার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল দিচ্ছে , তাই না?

– হুম। কিন্তু হঠাৎ করে মিথিলার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে?

– ওর এখন যা বয়স তাতে বিয়ের জন্য একদম পার্ফেক্ট। আমার কাছে একটা ভালো ছেলে আছে।

– তাই নাকি! বিয়ে তো দিতেই হবে। তবে আরেকটু সময় নিতে চাচ্ছি। বুদ্ধিজ্ঞান আরেকটু পাকুক। কিন্তু তোমার মিথিলার বিয়ে নিয়ে এত চিন্তার হেতু বুঝলাম না।

– ভালো পাত্র পেলাম তাই। আর ওর বয়স এমন কিছু কম না যে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার উপযুক্ত হয়নি। কুড়ি ছাড়িয়েছে তাইলে আবার কিসের অপেক্ষা ?

– খুব দেখছি তাড়া ওকে বিদায় করার জন্য। মেজাজ গরম করে বললাম, তা শুনি পাত্রটা কে?

– তুমি ওকে চেন।

– কে ? না বললে বুঝব কেমন করে?

– আজিজ। আমাদের চীফ একাউন্ট্যান্ট।

– আর ইউ ক্রেজি? ওই বুড়ো খাটাশের সাথে মিথিলা?

– বুড়ো কোথায় ? সংসারের চাপে পড়ে বিয়ে থা করতে একটু দেরি করে ফেলেছে । আর ছেলেদের বয়স নিয়ে কে মাথা ঘামায়? আজিজ বেশ পয়সা কড়ির মালিক। আমাদের এখানে জব করার পাশাপাশি শেয়ার মার্কেটেও বেশ ইনভেস্টমেন্ট আছে। তাছাড়া মোহাম্মদপুরের মতো জায়গায় নিজেদের বাড়ি আছে। যদিও টিনশেড তাতে কি ? সামনে যেয়ে এপার্টমেন্ট করবে।

– আজিজ চল্লিশ ছুঁইছুঁই আর তুমি বলছ বয়স না! আর এত বছর পর্যন্ত বিয়ে করেনি সংসারের চাপে নাকি কী কারণে সেটাও কি আমি জানি না?

– কি জানো তুমি? তোমার বোনের মেয়ের সাত জন্মের ভাগ্য যদি আজিজ ওকে বিয়ে করে। পরের বাড়িতে থেকে মানুষ হচ্ছে। কোনো ভালো পরিবার এমন একটা মেয়েকে কোনোদিনই একসেপ্ট করবে না। আজিজকে আমি বললে হয়ত না করবে না।

– আজিজের তো বউ পালার মতো সামর্থ্যই নেই। এ কথা তোমার কী করে অজানা আমি জানি না। সারা অফিস জানে । এ নিয়ে কানাঘুষা করে ওনার অগোচরে। আচ্ছা , সেসব কথা বাদ! এবার আরেকটা কথা বলি ! আমার বোনের মেয়েকে কে বিয়ে করবে না করবে তাতে তোমার এত মাথা ব্যথা কিসের? ওর ভাগ্যে যেখানে আছে সেখানে বিয়ে হবে। আর মিথিলা সবদিক থেকে চৌকস । আমার তো এত চিন্তা নেই । তুমিও অযথা চিন্তা করে নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলার কষ্ট করো না। আর ও মোটেই কারো বাড়ির আশ্রিতা নয়। বারবার এ কথা আর ভালো লাগে না। ওর বাবা এখনো বেঁচে আছেন। ওদের তোমার মতো এতবড় আলিশান বাড়ি না থাকলেও মাথা গোঁজার একটা ঠাই আছে এ শহরে। আমিই জোর করে ওদেরকে নিয়ে এসেছি। কথাগুলি বলতে বলতে রাগে যেন ফেটে পড়ছি আমি।
আর হ্যা, কষ্ট করে মিথিলার জন্য তোমার পাত্র খুঁজতে হবে না। মিথিলাকে কোথায় কার সাথে বিয়ে দিতে হবে সে নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা আছে।

– সেলিম রুম্পার শেষের কথায় ঘাবড়ে গেল। রূম্পা তবে মিথিলাকে প্রিয়র সাথে ……। নাহ!
বাপের এত জমিদারী আছে তবে আমারটা খেয়ে পরে ধ্বংস করছে কেন? নবাবের বেটি আর তার ভাইকে বাপের জমিদারীতেই পাঠিয়ে দিলে পারো!

– উহ, ছুটির দিন সকাল সকাল শুরু হয়ে গেল। শোনো, মিথিলা আর মেহরাব তোমার কিছুই খায় না। আমারটা খায়। আমিও যে সম্পত্তির অংশীদার ভুলে যেও না।

– বাহ! দারুণ বলেছ। বাপের বাড়ি থেকে নিশ্চয়ই নিয়ে আসোনি? আমার বাবা ভালো মানুষ বলে দয়া করে গেছেন। আমার বাবার সম্পত্তি নিয়ে আমার সাথেই বাহাদুরি ! চমৎকার, চমৎকার।

আর কোনো কথা না বলে রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম তখন হুংকার দিয়ে সেলিম বলে উঠল, অনেক হয়েছে। এখন দেখছি অর্থ সম্পদ নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শিখেছ। এই ভাইবোন দুটি আসার পর থেকে অশান্তি কমছেই না একদম।

– শান্তি আবার ছিল কবে? কখনো ছিল নাকি ? আমার তো মনে পড়ছে না। শুধুশুধু ওদের কেন দোষ দিচ্ছ বলো তো!

– এত ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আগামী মাস শেষ হবার আগেই তোমার বোনের মেয়েকে এ বাড়ি থেকে বিদায় করবে। দ্যাটস ফাইনাল। আর মনে মনে যদি অন্য কোনো পরিকল্পনা এঁটে থাকো তবে মনে রেখ বুড়ো বয়সে বড়সড় কেলেঙ্কারিতে পড়ে যাবে।

সেলিম ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমার আর পা চলছে না। এই লোকটা কি কোনোদিনই শোধরাবে না? যখনই ভাবি এই বুঝি মানুষটা বদলাচ্ছে ঠিক তখনই সে আমাকে আবার ভুল প্রমাণিত করে। ভালোই হতো সেই সময় ওকে ছেড়ে চলে গেলে। প্রিয় আর শ্বশুরের মুখের দিকে তাকিয়ে পারিনি। কিন্তু পারাটা উচিত ছিল। এত এত সম্পত্তি যে মানুষটার তার কতটুকুই আর ধবংস হচ্ছে এই বাচ্চা দুটির জন্য? সেলিম তো কখনই কৃপণ না তবে কিসের জন্য সে ওদের এখানে থাকাটা মেনে নিতে পারে না ? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এই লোকটার কাছে কিছু আশা করাই এখন ভুল। মন চায় দু’চোখ যেদিকে যায় সেখানে চলে যাই । কিন্তু পারি না। কী এক অজানা মায়ায় জড়িয়ে আছি। প্রিয়র জন্যই হয়ত পারছি না। নাড়িছেঁড়া ধনকে রেখে যাওয়া এত সহজ কথা তো নয়। জীবনের দুইকাল শেষ আর এককাল কোনোরকম করে কেটে গেলেই বাঁচি ।
চোখের পানি যেন আজ আর বাঁধ মানছে না একদমই।

দুপুরের খাবার আর খেলো না মিথিলা। কিছুই ভালো লাগছে না তার। লাঞ্চের পরে একটু বাইরে বেরুবার অনুমতি চাইতে সে সকালে রূম্পা মায়ের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে যেসব কথা শুনে এসেছে তাতে এ বাড়ির দানাপানি তার গলা দিয়ে নামবে বলে মনে হয় না। যে করে হোক এই জাহান্নাম থেকে সে মুক্তি চায়। মেহরাবকে এসব কিছুই বলেনি। মেহরাব মন খারাপ করবে তাই। একবার মন চেয়েছিল এগিয়ে যেয়ে রূম্পা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে । তার চোখের পানি নিজের হাতে মুছে দেয় কিন্তু সাহস হয়নি। রূম্পা মা এতে হয়ত আরো লজ্জা পেত। সে যে তাদের দুই জনের সব কথাই দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছে এটা সে আর তাকে জানাতে চায়নি।

এখান থেকে বেরুবার পর তার একটা আশ্রয় দরকার। মেহরাবকেও নিয়ে যেতে হবে। হলে চেষ্টা করে একটা সিট পেলেও মেহরাবের কী হবে? এই মুহূর্তে ওকে কোনো হোস্টেলে চাইলেই রাখা যায় কিন্তু তাতে ওর ভবিষ্যতটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই তার মা মারা যাবার পর বড় কষ্টে সোজা পথে আনতে হয়েছে। আবার একই পথে যে যাবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তাই মেহরাবকে একটা পারিবারিক পরিবেশে কাছে রেখেই আপাতত বড় করতে হবে। এখন বয়সটাই এমন। একটু ভুল হলেই পুরো উচ্ছন্নে যাবে।

তিনটার দিকে কল এল সাজিদের । মিথিলা কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল।
বাসা থেকে মিনিট বিশেক দুরত্বের একটা খোলা জায়গায় বসল দু’জন। মিথিলা তেমন কোনো সাজগোজই করেনি। একদম যেভাবে ছিল সেভাবেই শুধু ড্রেস চেঞ্জ করেই চলে এসেছে। আশেপাশে অনেক কাপল বসে আছে । সবাই খুব পরিপাটি আর সাজগোজ করা এটা দেখে মিথিলার খানিকটা লজ্জা হচ্ছে নিজের হাল দেখে।

সাজিদ মিথিলার সাথে এ কথা সে কথা বলার ফাঁকে খুব বেশি না ঘুরিয়ে বেশ সহজ করেই বলে ফেলল সে মিথিলাকে পছন্দ করে এবং বিয়ে করতে চায়। মিথিলা মোটেও অবাক হলো না সাজিদের এমন প্রস্তাবে। কারণ সে জানতোই যে এমন কিছু বলতেই সাজিদ তাকে ডেকেছে। সে সাজিদের দিকে তাকিয়ে একটা ঊষ্ণ হাসি দিয়ে বলল, আমার সম্পর্কে সবকিছু জেনে তারপরে সিদ্ধান্ত নিলে হতো না?

– তোমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। তারপরেও কিছু জানাতে চাইলে আপত্তি নেই। তবে উত্তর পরিবর্তিত হবে না এটা জেনে রেখ। আর সবচেয়ে বড় কথা আম্মা তোমাকে পছন্দ করেছে। আমি তার কাছে আমার পছন্দের কথা জানাতেই সেও হ্যা বলেছে তোমার ব্যাপারে।

– তারা কি জানে আমার সবকিছু সম্পর্কে?

– জানে। তবুও কিছু বাদ থাকলে তুমি জানিয়ে দিও। তাদের তোমার কিছুতেই আপত্তি হবে না আশা করি। তবে আমার মনে হচ্ছে তোমার নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানার আছে আমার ব্যাপারে?

– একটা দীর্ঘশ্বাস গোপণ করে মিথিলা বলল, একদমই না। আমি আপনাকে যতটুকু জানি ততটুকুই যথেষ্ঠ।

– উহু। আমার সবকিছু জেনে নেওয়া উচিত তোমার। এত অল্প পরিচয়ে কাউকে মন দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। তার উপর যেখানে বিয়ের কথা উঠছে। আমাকে জেনে নাও তারপর না হয় তোমার সম্পর্কে জেনে নিব। সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।

প্রিয়র কাছে শুনেছ হয়তো স্টুডেন্ট লাইফে আমি কিছুটা অন্যরকম ছিলাম। এখন আমাকে যতটা শান্ত দেখতে মনে হচ্ছে ঠিক তার বিপরীত ছিলাম। জীবনে অনেক মেয়ের পেছনে ঘুরেছি আবার অনেক মেয়েও আমার পেছনে ঘুরেছে। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা সেই সুবাদে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেছি। টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। বাবার কাছে চাইলেই পেতাম। তাই নো চিন্তা ডু ফুর্তি স্টাইলে চলাফেরা করতাম। স্টুডেন্ট হিসেবেও বেশ ভালো ছিলাম। দেখতে-শুনতেও মন্দ ছিলাম না। তাই মেয়েরা কাছে আসার চান্স খুঁজত আর আমিও ব্যাপারটা খুব এনজয় করতাম এবং তাদেরকে চান্স দিতাম। আমার স্বভাবের কারণে বন্ধুরা একসময় নাম দিয়ে দিল প্লে বয়। এমন খেতাব পেয়েও বিন্দাস চলছিল আমার মেয়েদের সাথে মেলামেশা।

এরমধ্যে আইরিন নামের একটা মেয়ের সাথে পরিচিত হলাম অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে বসে। আমরা দু’জনই একাউন্টিং ডিপার্টমেন্ট এর ছিলাম। অনেক মেয়ের সাথেই পরিচিত হলাম। আইরিনও তার মাঝে একজন।
কিন্তু কাউকে খুব বেশি সময় ভাল না লাগলেও আইরিনকে কেনো যেনো মন থেকে সরাতে পারলাম না। অন্য সবার থেকে একদমই আলাদা ছিল মেয়েটা। খুবই সাধারণ ঘরের মেয়ে। চলাফেরাও সাধারণ। কিন্তু আমার কাছে মনে হতো ওর সবই অসাধারণ। ওর চলন-বলন, হাসি, কান্না সবই আমার ভালো লাগত।

একসময় বুঝতে পারলাম আইরিনকে পাবার পরে আমার বদঅভ্যাস, চঞ্চলতা সবই কমছে ধীরে ধীরে ।
নিজেকে শুধরানোর এটা একটা সুযোগ মনে করলাম। তাই আইরিনের মাঝেই আমি স্বপ্ন খুঁজতে শুরু করলাম। একসময় আইরিনকে রাজিও করিয়ে ফেললাম। শুরুর দিকে আমাকে এভয়েড করলেও এক সময় ও আমাকে পছন্দ করতে শুরু করে। আমি সব বাদ দিয়ে একদম অন্য মানুষ হয়ে গেলাম। পরিচিত বন্ধুমহলে আমার এই পরিবর্তন নিয়ে শুরু হয়ে গেল নানান মুখরোচক গল্প।

সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছিল ভালোই। মাস ছয়েক যাওয়ার পরেই হঠাৎ আইরিনের ভার্সিটিতে আসা বন্ধ হয়ে গেল। খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম! ও ফুফুর বাসাতে থাকত। সেখানে যেয়ে খোঁজ নিলাম। জানতে পারলাম আইরিনকে ওর বাবার বাসা খুলনাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইরিন প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছে গত সপ্তাহ থেকে।

ও কখনও ফোন ব্যবহার করত না তাই ওর সাথে যোগাযোগের কোন মাধ্যম ছিল না। আমি কয়েকবার ফোন গিফট করতে চাইলেও সে নেয়নি। ও ছিল অন্য সব মেয়েদের থেকে আলাদা। মোবাইল, ফেসবুক কিছুই ইউজ করত না। ওর বাসার ঠিকানা আর ওর বাবার নাম্বার নিয়ে হণ্য হয়ে খুলনাতে ছুটলাম। যেয়ে দেখি মাত্র ক’দিনেই কংকালসার চেহারা ওর। ওকে আমি চিনতেই পারছিলাম না। আমি ওর বন্ধু পরিচয় দিলেও ওর বাড়ির সবাই জানত আমাদের ব্যাপারে। ওর বাবা ছোটখাট একটা জব করত খালিশপুরে। আমি তিনদিন ছিলাম ওদের বাড়িতে।
আমার বাসায় বলে গিয়েছি বন্ধুর বোনের বিয়েতে খুলনা যাচ্ছি।

– কি হয়েছিল ওনার? উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল মিথিলা।

– একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাজিদ বলল, ক্যান্সার। ওদের ব্যাপারটা জানতে বুঝতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। আমার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পর থেকেই খেয়াল করতাম মাঝে মাঝেই বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ত আইরিন। কখনো জ্বর, কখনো মাথা ব্যথা, কখনো প্রেসার আপ-ডাউন । ফার্মেসি থেকে টুকটাক ওষুধ খেত, ভালো হয়ে যেত। সে যে ভেতরে ভেতরে এত বড় একটা রোগ বাঁধিয়ে বসেছে সেটা কেউই বুঝতে পারিনি।

ঢাকার ডাক্তাররা তাদের উত্তর দিয়ে দিয়েছিলেন। তাছাড়া ওদের এত টাকাপয়সাও ছিল না যে উন্নত চিকিৎসার জন্য কোথাও নিয়ে যাবে। তিনদিন ওকে নিয়ে খুব ঘুরলাম ওদের এলাকার আশেপাশে।
ওকে ছেড়ে আসতে একদমই মন চাচ্ছিল না কিন্তু ফিরতে তো হবেই। বাসা থেকে তিনদিনের জন্যই অনুমতি পেয়েছিলাম। খুলনাতেই আইরিনের চিকিৎসা চলছিল তখন। ঢাকায় রেখে চিকিৎসা করার মতো অবস্থায় ছিল না। আইরিনকে কথা দিয়ে আসলাম পরের মাসে আবার ওর সাথে দেখা করতে যাব যে করে হোক। প্রতিদিনই ওর বাবার ফোনে ফোন দিয়ে ওর সাথে কথা বলতাম। মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম এতটা ভেঙ্গে পড়েছিলাম যে আমার বাসা থেকে বুঝতে পারে যে আমার সাথে কিছু একটা চলছে। আম্মার কাছে সবকিছু খুলে বলি। মন কিছুটা হলেও হালকা হয়।

আম্মা নিজেই পরের মাসে আমাকে অনুমতি দিলেন ওকে দেখতে যাবার জন্য। যেদিন যাব তার আগের দিন রাতে ওর সাথে আমার কথা হয়েছিল। আমি আসছি এটা জানিয়েছিলাম। প্রচন্ড জ্বর ছিল সেদিন ওর।

পরের দিন আমি পৌঁছাতে পৌঁছাতেই সব শেষ। তবে আমি আমার কথা রেখেছিলাম আমি ওকে বলেছিলাম ওকে ঠিক এক মাস পরে আমি আবার দেখতে যাব। আমি ঠিকই গিয়েছিলাম। তবে শেষবারের মতো তাকে দেখে এলাম।

আইরিনকে হারানোর পরে এক নতুন সাজিদের জন্ম হলো। সেই শূন্য স্থানে নতুন করে আর কারো ঠাঁই হলো না। এরপরে বহু বছর কেটে গেছে।

হঠাৎ করে প্রিয়দের বাসায় তোমাকে দেখার পরে কেন যেন আবার আইরিনের কথা মনে পড়ে গেল। আইরিনও দেখতে ঠিক তোমার মত মায়াবতী ছিল। আইরিনের চেহারার সাথে তোমার মিল নেই কিন্তু কেন যেন আমি তোমার মাঝে আইরিনকে খুঁজে পেতে শুরু করি। সত্যি বলতে আইরিনকে খুঁজতে যেয়ে আমি তোমাকে পেয়েছি। মনের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি। জীবনে কোনোদিন আবার কারো প্রেমে পড়ব কখনো ভাবিনি! কিন্তু সেই ভাবনায় ছেদ পড়ল তোমাকে দেখার পরে। এবার তুমি বলো সবকিছু জানার পরে তুমি কি পারবে আমাকে তোমার জীবনে আপন করে নিতে?

সাজিদের জীবনের এমন ট্রাজেডির কথা শুনে মিথিলার চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

– মিথিলা নিজের অজান্তেই মাথা নাড়িয়ে বলল, আপনি ভালোবাসায় পুড়ে খাঁটি সোনা হয়েছেন। ভালোবাসা যে কত অমূল্য সে কথা আপনার থেকে ভালো কে জানবে! তাই এমন খাঁটি সোনাকে ফিরিয়ে দেবার মতো দুঃসাধ্য আমার কই?

মিথিলার কথা বলার ধরণ দেখে সাজিদ কিছুটা অবাক হলো। সে যতদূর প্রিয়র কাছ থেকে শুনেছে তাতে মিথিলার জীবনে প্রেম-ভালোবাসা এসেছে বলে তার জানা নেই।

– তুমি কি কাউকে ভালবাসো বা বেসেছ?

মিথিলা খানিকটা সময় নিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া ভাবটা লুকিয়ে রেখে বলল, সেই সুযোগ নিয়তি আমাকে দেয়নি। সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই বাসব।

চলবে…..

পর্ব-৩০

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/370879168028092/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here