সুখের_সন্ধানে পর্ব_৩৪

0
336

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩৪
মিথিলার চোখজোড়া পুরো হলজুড়ে শুধু একজনকেই খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত। সে যদিও জানে প্রিয় কখনই আসবে না এখানে তারপরেও একটু আশা যদি আসে। মন চাচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে দু’চোখ যেদিকে সেদিকে ছুটে যায়। চারপাশে এত এত মানুষ এত এত আলোর ঝলমলানি কিছুই ভালো লাগছে না। ভারি পোশাক আর ভারি গয়নায় দম আটকে আসছে। ভাবনায় কত কথা চলছে তারপরেও কিছুই পারছে না সে। নিজের প্রতি নিজের ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করছে । এত ভীতু কেন সে? কেন সে মনের চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে পারছে না? ছোটবেলা থেকেই এই স্বভাবের জন্য বহুভাবে তাকে ঠকতে হয়েছে। এই স্বভাবের কারণেই সৎ মায়ের সংসারে নিজের অধিকার বজায় রেখে চলতে পারেনি। কেউ দশটা বকা দিলে মুখ বুজে সব হজম করা তার একটা রোগে পরিণত হয়েছে। নিজেই বোঝে এটা থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার কিন্তু মুক্তির পথ তার জানা নেই। কেউ কষ্ট পাবে এমন কথা বলার কথা সে চিন্তাও করতে পারে না । তাতে নিজের যত কষ্ট সহ্য করতে হোক না কেন! এই স্বভাবের জন্যই আজ সে নিজ হাতে গলা চেপে তার আর প্রিয়র ভালোবাসাকে ফুল হয়ে ফোটার আগেই খুন করছে। হয়ত সাজিদের সাথেও সে অন্যায় করছে। অন্তরে একজনকে রেখে আরেক জনের সাথে সংসার করা কতটা দুর্বিষহ সে যেন এখন থেকেই অনুভব করতে পারছে।
সাজিদ তার পাশেই বসা। মিথিলার বান্ধবীরা যেই আসছে ওর কানে কানে শুধু সাজিদের বলিষ্ঠ পৌরুষ্যের প্রশংসাই করছে। সত্যিই আজ সাজিদকে অপূর্ব লাগছে। তাকে নিজেকে কেমন লাগছে সে জানে না। পার্লারে সাজগোজ শেষ হবার পর কতবার মেয়েরা বলল, “ আয়নায় দেখুন কেমন লাগছে? আপনার কথামতোই ন্যাচারাল লুক দিয়েই সাজিয়েছি আপনাকে। “
মিথিলা ওদেরকে শুরুতেই বলেছিল , আপনারা যেভাবেই সাজান শুধু অনুরোধ মেক আপের আড়ালে আমার গায়ের শ্যাম বর্ণ লুকাতে যাবেন না, প্লিজ! আমি একটা ন্যাচারাল লুক চাই। দ্যাটস ইট!
নিপুণহাতে মিথিলাকে সাজিয়েছে অথচ ওর যেন একবারের জন্যও আয়নায় মুখ দেখতে মন চাইল না। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই নিজেকে টানতে টানতে সে এখানে নিয়ে এসেছে। সাজিদ আসার পর ওর কত প্রশংসা করল অথচ মিথিলা ওকে একটিবারের জন্যও বলল না, তোমাকেও চমৎকার লাগছে বরের বেশে। সাজিদ মিথিলার কাছে এতটুকু আশা করতেই পারে। মিথিলা শুকনো একটা হাসি দিয়ে ঐ থ্যাংকস পর্যন্তই আটকে ছিল।
যেই আসছে নতুন বউ আর বরের সাথে একের পর এক ছবি তুলেই যাচ্ছে । মিথিলা ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে একের পর পোজ দিয়েই যাচ্ছে । হলভর্তি এত মানুষের মধ্যে কেউই জানতে পারছে না তার বুকের ভেতর কী পরিমাণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

কাজি এসে পড়েছে। কাজিকে দেখামাত্রই মিথিলার হুশ উড়ে গেল যেন। একবার মন চাচ্ছে এখান থেকে একছুট দিয়ে পালিয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে নিজের হাতে জীবনটাকে কী এক অজানার পথে সঁপে দিচ্ছে সে জানে না। তার চোখজোড়া চারদিকে শুধু প্রিয়কেই খুঁজে যাচ্ছে। নাহ, কোথাও নেই। এই পাগলটা যে আসবে না এটা মিথিলা জানে তারপরেও তার কেন যেন মনে হচ্ছে হয়ত কোনো মিরাকল হবে। প্রিয়র প্রতি খুব অভিমান হচ্ছে । তার শুধু মনে হচ্ছে “ আমি না হয় কিছু বলতে পারছি না কারণ আমি আজন্ম ভীতু। আমি রূম্পা মায়ের সংসারে অশান্তির বীজবপণ করতে চাই না। তাই বলেও তুমিও কি পারো না আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে তোমার জীবনে টেনে নিতে? তুমি না খুব সাহসী? তুমি না বলেছ , তুমি কাউকে পরোয়া করো না। তবে কী হলো সেই বড় বড় কথার? নাকি সবই শুধু ওই কথা পর্যন্তই? “ দু’চোখ ফেটে নোনাজল উপচে পড়ছে তার। হার্টবিট বেড়েই চলছে। আশেপাশে সবাই কী ভাবছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সাজিদ মিথিলার একটা হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে সেদিকেও কোনো খেয়াল নেই তার। প্রিয়র প্রতি রাগ বেড়েই চলছে তার?
কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে পড়ল , কেন প্রিয় আসবে তাকে নিতে? কেন মিরাকল হবে? সে তো প্রিয়র মুখের উপর বলে এসেছে, সে তাকে ভালোবাসে না। সে তাকে শুধু বড় ভাইয়ের চোখেই দেখে। তাহলে কীসের অধিকারে তাকে এখান থেকে উদ্ধার করতে আসবে প্রিয়?
চোখের নোনাজলে চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছুই আর ভাবতে পারছে না।
নাহ, কোনো মিরাকল এল না তার জীবনে। কাজির কথায় বিনা বাক্যে “কবুল” শব্দটি বলতেও একফোঁটা দ্বিধা হলো না তার। পাশ থেকে তাকে যা করতে বলা হচ্ছে সেও রোবটের মত সেই ডিরেকশান অনুসরণ করেই যাচ্ছে। গল্প সিনেমার নায়িকাদের মতো কবুল বলার আগ মুহূর্তে তার নায়ক তাকে এসে বাঁধা দিলো না একদমই।

আমি কিছুটা দূরে বসে আছি মিথিলার থেকে। ওর পাশে যাবার সাহস হচ্ছে না। মিথিলা আমার থেকে যেন ওই তিনটি শব্দ বলার সাথে সাথেই অনেক দূরে চলে গেল। সকালের ক্লান্তি এখন অনেকটা কাটিয়ে উঠেছি আমি। কিন্তু বুকের ভেতর কান্নার ঢেউ এসে বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছে সবকিছু। গেস্টদের দিকেও ঠিকঠাক খেয়াল করতে পারছি না। মিথিলার থেকে দূরে দূরে থাকছি। কাছে গেলেই দু’জনেই এই হলভর্তি মানুষের মধ্যেই সকালের মতো গলা ধরে কান্না শুরু করব নিশ্চিত। দূর থেকেই একজোড়া ঝাপসা চোখে আরেক জোড়া ঝাপসা চোখকে অনুভব করছি। ওই ঝাপসা চোখজোড়ায় বেদনার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। নিজের সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল যেন। আমিও এমন স্টেজে দাঁড়িয়ে ঝাপসা চোখে আমার মা আর ছোট বোন টুম্পার ঝাপসা চোখগুলিকে ছুঁয়ে দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। বাবা কঠিন মানুষ ছিলেন । সহজে কারো সামনে চোখ দিয়ে পানি পড়ত না। কিন্তু সেদিন বিদায় বেলায় সেও পারেনি তার সেই কাঠিন্যকে ধারণ করে থাকতে। স্মৃতির পাতা যেন আজ চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।
সেদিনের বউবেশে দাঁড়িয়ে থাকা রুম্পার মাঝে আর এই মেয়েটার মাঝে আমি কোনো তফাৎই খুঁজে পাচ্ছি না। মিথিলাও হয়ত আমাদেরকে ছেড়ে যাবার কষ্ট মেনে নিতে পারছে না কোনোভাবেই। কিন্তু বিধির বিধান খণ্ডায় কে?
আমার পাঁজর ভেঙ্গে কান্না আসছে। কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। সাগরের ঢেউয়ের মত গর্জন করে নোনাবাণ শুধু জানান দিয়ে যাচ্ছে এখনই হয়ত তীর ছুঁয়ে উছলে পড়বে অবাধ্য ঢেউয়ের মতো।
আমার এমন একটা কষ্টের মুহূর্তে আমার আপন মানুষেরা আমার সাথে নেই। সেলিম কোনোরকম একবার ঢু মারলেও প্রিয়র তো নামগন্ধই নেই। এতবার কল দিচ্ছি রিংও হচ্ছে কিন্তু সে ফোন তুলছে না। আমাকে অবশ্য একবার মেসেজ করে জানিয়েছে , সে এখানে আসবে না। গতরাতে হলুদের প্রোগ্রামের পর সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল । ভীড়বাট্টা তার পছন্দ না। এটাই তার অজুহাত।
এসব সামাজিকতা, এত মানুষের ভীড় তুই পছন্দ করিস না আমি জানি। তাই বলে নিজের বোনের বিয়েতেও থাকবি না। ছেলেটাকে মাঝে মাঝে বুঝি না। ওকি শেষ পর্যন্ত বাপের ছায়াই অনুসরণ করছে কি না কে জানে! ওর বাবাও অনেকটা এ রকম । শুধুমাত্র বিজনেস রিলেটেড প্রোগ্রাম ছাড়া কোথাও যেতে তার বড্ড এলার্জী। ওর বাবাকে আমি আর রাগ করে কলই দেইনি। তোমার মেয়ে না হোক এত এত আত্মীয় স্বজনের সামনে অন্তত সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেও তো তার এখানে থাকা উচিত ছিল। অথচ আমাকে কিছু না বলেই সে হাওয়া। কতজনকে আমি মিথ্যে বলব? জরুরী প্রয়োজনে হলিডেতেও তার বিজনেস মিটিং এটেন্ড করতে হয়েছে এই একই অজুহাত বলতে বলতেও ক্লান্ত আমি। অথচ এই বিয়ে অনুষ্ঠানের তিনের দুই গেস্টই তার সাইডের। সেই পরোয়াটুকুও করল না একবার। আমার শাশুড়িও তার এমন আচরণে মর্মাহত। তাকেও তো কম জনকে সামলাতে হচ্ছে না।
এদিকে প্রিয়কে এতবার কল দিচ্ছি অন্ততপক্ষে একবার রিসিভ করে কথা তো বলবি। শুনবি তো আমি কী বলতে চাই। আমার এমন মুহূর্তে তোর পাশে থাকাটা কি নৈতিকবোধের মধ্যেও পড়ে না? বাপের মতো ভালো লাগে না তাই করব না বলেই খালাস। আরে ভালো তো আমারও কতকিছু লাগে না। তাও কি আমি আমার দায়িত্ব কর্তব্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখি? এটাই হচ্ছে ওদের আর আমার মাঝে পার্থক্য।
বেশিরভাগ মেহমানই এতক্ষণে চলে গেছে। মিথিলা এমনিতেও শান্ত আর আজ তো যেন শান্ত নদীর মতো হয়ে গেছে। আমি কাছে গেলেই যে এই শান্ত নদীতেই একটা বড়সড় বাণ ডাকবে সে আমি ভালোভাবেই টের পাচ্ছি। সেই ভয়ে একদমই যাচ্ছি না। আমার শাশুড়ি অবশ্য ওর পাশেই বসে আছে। আমার শাশুড়িও মিথিলা চলে যাবে সেই কষ্টে ব্যাথিত। ওনার এত এত সেবা মেয়েটা করেছে! কি করে ভুলবেন ওর এই শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসার কথা! আমি এতবছরেও যতটুকু স্থান ওনার কাছে করতে পারিনি সেটুকু মিথিলা পেরেছে। এটুকুই আমার প্রশান্তি।
প্রিয়র বন্ধু অনিকেত এসে হঠাৎ পেছন থেকে ডাক দিলো। বেশ কিছুদিন পরে ওর সাথে দেখা হয়ে গেল বলে প্রথমে আমি চিনতে না পারলেও পরিচয় দিতেই চিনে ফেললাম। অবাক হলাম প্রিয়র আক্কেলের কথা ভেবে। বন্ধুদের দাওয়াত দিয়েছে অথচ নিজের খোঁজ নেই।
– আন্টি , আপনি এখানে?
– ও মা! আমার মেয়ের বিয়ে আমি থাকব না?
– প্রিয়র বোন আছে জানা ছিল না তো!
– মিথিলা আসলে আমার বোনের মেয়ে । আমার কাছেই আছে ওর মা মারা যাবার পর থেকে। তোমাকে ইনভাইট প্রিয় করেনি? তাহলে তো জানার কথা।
– অনিকেত একটু কি যেন ভবে বলল, আমাকে সাজিদ কার্ড পাঠিয়েছিল । তবে ও যে প্রিয়র কাজিনকে বিয়ে করেছে এটা বলেনি। আচ্ছা, প্রিয়কে দেখছি না?
– কই যে গেছে আমিও জানি না। ছেলেটা এত একগুঁয়ে ! আমাকে একটা মেসেজ দিয়ে বলে দিয়েছে, সে আসবে না। ব্যাস শেষ। ভিড় নাকি তার পছন্দ না। এতবার ফোন দিলাম । আমাকে বোঝানোরও সুযোগ দিলো না। নিজের বোনের বিয়েতেও থাকবি না! কেমন মানুষ বলো তো! কম করে হলেও পঞ্চাশবার কল দিয়েছি। মেসেজ দিয়েছি কিন্তু কোনো রিপ্লাই নেই। আচ্ছা, বাবা! তুমি খাওয়া দাওয়া শেষ করেছ তো? কোনো অসুবিধা হয়নি তো? তুমি এসেছ আমি তো জানিই না।
– জি আন্টি। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি খেয়েছি। সব ঠিক ঠাক আছে। আমাদের আরো কয়েকজন ফ্রেন্ড এসেছিল । একসাথে খেয়েছি। ওরা প্রিয়রও ফ্রেন্ড। ওরা চলে গেছে সবাই সাজিদের সাথে দেখা করে। ওরা তো জানেই না সাজিদ প্রিয়র কাজিনকে বিয়ে করছে। প্রিয় থাকলে অবশ্য মজা হতো ।
– যাও ,সাজিদের সাথে দেখা করে আসো তবে। আমি একটু এদিকটা দেখছি। বাসায় এসো বাবা। তোমরা তো বাসায় আসোই না এখন আর। সবাই বড় হয়ে গিয়েছ তাই আন্টিকে ভুলে গেছ।
– না , না । আন্টি। তেমনটা না। ব্যস্ততা বাড়ছে বোঝেনই তো । আসব একদিন।
আমি অনিকেতকে রেখে অনেকটা দূরে চলে এসেছি আবার কী মনে করে পেছনে ফিরে দেখলাম অনিকেত আমার দিকে তাকিয়ে এখনো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে। আমি ওর দিকে ফিরতেই দ্রুতপায়ে আমার কাছে এসে বলল, আন্টি ব্যস্ত বুঝতে পারছি কিন্তু আমাকে মিনিট দুয়েক সময় দিবেন? একটু কথা বলতাম!
– হ্যা , বলো বাবা। কিছু কী ভুলে গিয়েছিলে বলতে?
– এখানে না। একটু বাইরে আসেন।

আমি খানিকটা অবাক হয়ে ওর পিছুপিছু কিছুটা নিরিবিলি জায়গা যেয়ে দাঁড়ালাম ।

– আন্টি, আমি প্রিয়র ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
– হ্যা, বলো বাবা।
– কিছুটা ইতস্তভাবে অনিকেত বলল, আসলে কিভাবে বলি!
– বলো বাবা। এত হেজিটেশানের দরকার নেই।
– আসলে এই মুহূর্তে কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা জানি না। তবুও প্রিয়র জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে তাই না বলে পারলাম না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে প্রিয় কোনো প্রবলেম করেছে । না হলে এখানে ঠিকই আসত । ওকে তো চিনি আমি। আর একজন সাইকাট্রিস্ট হিসেবে একটু মনে হয় বেশিই চিনি ওকে। ও যে পাগল! খুব বেশি আবেগী জানেনই তো!
– আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম , মানে! কী হয়েছে? খুলে বলো তো ! কী হয়েছে প্রিয়র? অনিকেতের কথা শুনে বুকটা কেঁপে উঠল আমার।
– আপনি কিছুই জানেন না?
– কী জানব? আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছে । কীসব বলছ তুমি? তাড়াতাড়ি বলো। কী হয়েছে আমার ছেলের?
– আপনি সত্যিই জানেনা না। প্রিয় তাহলে আপনার সাথে শেয়ারই করেনি? মাই গড! ছেলেটাও পারেও।
– মানে? কী শেয়ার করবে? এত ধাঁধা রেখে সোজাভাবে বলো। রেগে গিয়ে বললাম আমি।
– আন্টি । প্রিয় তো মিথিলাকে পছন্দ করে। মাত্র ক’দিন আগেই আমার কাছে কত কথা শেয়ার করল। ও মিথিলাকে সাজিদের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলো কী করে? আর আমার তো মনে হয় মিথিলাও পছন্দ করে প্রিয়কে। ওর চোখেও আমি বিষণ্ণতা দেখে এলাম। একজন নববধূর চোখে এত বিষণ্ণতা থাকার কথা না ।
– হোয়াট? তোমার মাথা ঠিক আছে? কী বলছ?
– ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে বলছি , আন্টি। এরমধ্যে এক বর্ণ মিথ্যে নেই। উফ, ছেলেটা এত বেশি পাগল। এত বড় ব্যবসায় সামলায় অথচ নিজের জীবনের সাথে এমন ?

আমার এবার গলা শুকিয়ে এল। আমি সবকিছু মেলাতে লাগলাম । অনিকেত তো মিথ্যে বলবে না। সত্যিই কী তবে ওরা? না, না। এটা কী শুনছি আমি?

– বাবা, এসব কী বলছ? আমি তো ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পেলাম না। ও তো বিন্দু না কাকে যেন পছন্দ করত! কিছুই তো বলেনি ওরা আমাকে? ওহ আল্লাহ!
– আন্টি , প্রিয় নিজের মুখে স্বীকার করেছে। আর বিন্দুর ব্যাপারটা বোধ হয় এখন ক্লোজ হয়ে গেছে । মেয়েটা ফ্রড। জানি না ও মিথিলাকে পছন্দ করে এ ব্যাপারে ওকেও কিছু বলেছে কি না!
– কিন্তু মিথিলা যে বলল, সে সাজিদকে পছন্দ করে। এজন্যই তো তড়িঘড়ি করে বিয়েটা হচ্ছে।
– আমি আন্টি জানিনা আসলে কী হয়েছে?
– এজন্যই কী তবে প্রিয় এ ক’দিন ধরে এত আপসেট? ওহ মাই গড! ও আমাকে কিছুই তো বলেনি। আমি তো এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি। ও আমাকে একবার বলত!
আমি যে করে হোক মিথিলা রাজী না থাকলেও রাজী করাতাম । মিথিলা আমাকে না করতে পারত না আমার বিশ্বাস। এটা কী হয়ে গেল আমার বাচ্চাটার সাথে? আল্লাহ, রক্ষা করো।
আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি ধপাস করে বসে পড়লাম। আমার ছেলেটার ভেতরে এসব চলছে অথচ আমি একবারের জন্যও টের পেলাম না। এজন্যই কি ও মিথিলাকে পার্লারে রেখেই ওভাবে চলে এসেছিল? আগের রাতে নেশা করে পড়েছিল চিলেকোঠায়? আর মিথিলা ? ও যে সকালে কান্না করে বলেছিল , “ ভেবেছিলাম সারাজীবন তোমার কাছে থেকে যাব” । মিথিলা কি আমাকে কোনো মেসেজ দিতে চেয়েছিল? আমার অগোচরে কী ওদের মাঝে কিছু চলছিল? মিথিলা আর সাজিদের ব্যাপারটা বোঝায় কি আমি ভুল করে ফেলেছিলাম? আর মিথিলাই বা কেন বিয়ের জন্য এত তড়িঘড়ি করেছিল? কী ঘটেছিল আসলে? আমি এতটা উদাসীন কী করে হলাম ? আমি এতটা ব্যর্থ মা ?
আমার ছেলে কতটা কষ্ট পাচ্ছে ? সে কোথায় ? কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসেনি তো?
প্রশ্নের পর প্রশ্ন আমার কলিজায় এসে তীরের মতো বিঁধছিল । আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। চারপাশে এত মানুষ কিন্তু আমি কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছি না। হতাশায় ঘিরে রেখেছে চারপাশ আমার।
অনিকেত আমার হাত ধরে টেনে তুলল।
– আন্টি , আমি বুঝতে পারছি আপনার মাঝে কী ঘটছে। আমাকে ক্ষমা করবেন । এমনটা হতে পারে ভেবেই আমি প্রথমে বলতে চাইনি। আসলে এখন তো করারও কিছু নেই। বলে লাভও নেই। কিন্তু প্রিয়র কথা ভেবে না বলে থাকতে পারলাম না। আপনার স্ট্রং হতে হবে। আশেপাশে সবাই দেখছে। কী ভাববে সবাই? আপনার কোনো ভুল স্টেপ মিথিলার নতুন জীবনকে হ্যাম্পার করবে। প্লিজ, এখন প্রিয়র কথা ভাবতে হবে। ও কোথায় থাকতে পারে আন্দাজ আছে কিছু?

– আমি কিছু জানি না , বাবা। কাঁপা গলায় বললাম আমি।
– বাসায় একটু কল করে দেখবেন কি?

আমি দ্রুত বাসায় কল দিলাম টিএন্ডটি নাম্বারে। একটা কাজের মেয়ে ফোন ধরলে ওকে জিজ্ঞেস করলে জানাল, প্রিয় বাসায় যায়নি। ভালো করে ছাদে আর ওর রুমে খোঁজ নিয়ে দেখতে বললাম। কিন্তু উত্তর একই। প্রিয় কথাও নেই। পরিচিত যেসব জায়গা থাকতে পারে সেসব জায়গায় খোঁজ করলাম , অফিসে কল দিলাম কিন্তু নাহ, প্রিয় নেই।
হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আমার। কোথায় আছে ছেলেটা? এতবার রিংয়ের পর রিং হয়ে যাচ্ছে ফোনই ধরছে না। অনিকেতও বারবার ট্রাই করছে কিন্তু কোনো খোঁজ নেই।
– আন্টি, আংকেলকে কল দিন। আর মনে হয় অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আর আমাদের এখান থেকে এখনই বের হতে হবে। আপনি যেভাবে হোক ম্যানেজ করে তাড়াতাড়ি বের হন। ওর কল যেহেতু বাজছে ওকে ট্রেস করা যাবে। আমার পরিচিত সোর্স আছে। কুইক করেন। আর স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন। না হলে আরো ঝামেলা শুরু হবে।
আমি আর কিছু না ভেবে আমার শাশুড়ি আর মিথিলার কাছে বলার জন্য স্টেজের দিকে পা বাড়ালাম। স্টেজ এখন কিছুটা ফাঁকা । সাজিদের মাকেও কিছু একটা এমার্জেন্সীর কথা বলে বেরুতে হবে নইলে ওনারা আবার অন্যভাবে নিবে।

আইমানকে স্টেজের দিকে আসতে দেখে মিথিলার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। বেয়াদবটা ওকে অনেকক্ষণ ধরেই এটাসেটা বলে জ্বালাচ্ছিল। এখন আবার কেন আসছে কে জানে! ছোট চাচার আত্মীয় হিসেবে দাওয়াত পেয়েছে। খুব রাগ লাগছে ওকে আসতে দেখে।

– আমাকে দেখে বিরক্ত হচ্ছো বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। কিউরিয়াস মাইন্ড অনেকক্ষণ ধরে একটা ব্যাপারে জানতে চাইছে। তাই বাধ্য হয়ে আসা। নইলে আসতাম না।
– কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো।
– সারাবছর প্রেম করলে কাজিনের সাথে আর এখন মালা পড়ালে অন্যজনকে। মানেটা কী? নাকি কাজিন একদম ছ্যাবড়া ছ্যাবড়া করে ছুঁড়ে ফেলেছে? তাই এখন এই মদনের গলায় ঝুলে পড়লে? এটা অবশ্য আমি শুরুতেই বুঝেছিলাম। আমাকে বলতে পারতে। আমি কিন্তু সব জেনেশুনেও আপত্তি করতাম না। ব্যাড লাক ! আমার ভাগ্যে নেই। সেই ছোটবেলা থেকে পিছে পিছে ঘুরলাম অথচ দুধের সর কারা কারা খেয়ে গেল। আমি কাঙ্গাল কাঙ্গালই রয়ে গেলাম।

শ্লেষ টেনে কথাগুলি বলতে বলতেই সাজিদকে দেখে মিথিলার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই স্টেজ ছেড়ে নেমে গেল । মিথিলা কিছু বলতে যাবে তাকিয়ে দেখে পাশেই সাজিদ দাঁড়ানো । সাজিদ বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে মিথিলার দিকে। তার চোখে বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন স্পষ্ট। পেছন থেকে এসে সাজিদ যে সবকিছু শুনে ফেলেছে এটা মিথিলা নিশ্চিত ।

সাজিদ কিছু বলার আগেই মিথিলা বলল,
– প্লিজ, ওই বেয়াদবটার কথায় কান দিও না। এমন আজেবাজে কথা বলাই ওর স্বভাব। প্লিজ!
– রূম্পা আন্টি আসছে । মুখ বন্ধ করো। পরে কথা বলছি। আমি এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না, প্লিজ। তাছাড়া এখানে আমার অনেক রিলেটিভস আছে ।

কথাগুলি চাপাস্বরে বললেও সাজিদের ভয়েস টোন শুনে মিথিলার মনে হচ্ছে এখন সত্যি সত্যি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। এত লোড নেওয়া আর তার পক্ষে সম্ভব না। কী হচ্ছে তার সাথে এসব? সে তো কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি, কারো ক্ষতি করেনি। তবে তার সাথে এতসব খারাপ হচ্ছে কি অপরাধে?

চলবে……

পর্ব- ৩৩

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/374711180978224/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here