#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৪৪
আইমান একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছে। ক্যারিয়ার নিয়ে খুবই সচেতন সে। হয়ত এ কারণেই এতদিনেও বিয়ে শাদীর কথা মাথায় আনেনি। সেদিন একটা ফ্যামিলি প্রোগ্রামে মিথিলার সাথে দেখা। একসময় কত কত পাগলামি করেছে মিথিলার সাথে। সে সব কথা বলাবলি করে খুব মজা করেছে মিথিলা আর সে।
কথাপ্রসঙ্গে তার পাগলামির কারণে বিয়ের দিনই যে মিথিলার আর সাজিদের সম্পর্কে প্রায় চিড় ধরে গেছিল এ কথা জেনে মিথিলার কাছে খুব দুঃখ প্রকাশ করে আইমান। সে রাগের বশে ওসব কথা বলে ফেলেছে। মিথিলার দাম্পত্য জীবনে অশান্তি করা তার ইচ্ছা ছিল না মোটেই। তাই নিজের এমন কর্মকাণ্ডের জন্য খুব লজ্জিত হয় আইমান।
মিথিলা তখন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকে সবকিছু ভুলে যেতে অনুরোধ করে।
বহুদিন পর মিথিলার খুব ভালো একটা সময় কাটে আজ। কত কত আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা হলো আজকের অনুষ্ঠানে । সবাই সবার জীবনে কত ব্যস্ত, কত হাসিখুশি। কিন্তু তার জীবনটা যেন থেমে আছে ছয় বছর আগে। তার সমবয়সী চাচাত , ফুফাত বোনেরা তাদের স্বামী সন্তান নিয়ে এসেছে। ওদের দেখেই মনটা জুড়িয়ে যায়। কত সুন্দর সাজানো গোছানো পরিপাটি জীবন ওদের। খুব লোভ হয় ওদের দেখলে মিথিলার। সারাদিন কর্মব্যস্ত দিন শেষ করে শূণ্য বাসায় এসে বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে তার। কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে না, বাসায় দেরী করে আসলে কেউ বকা দেয় না, কেউ দুশ্চিন্তা করে না। মাঝেমাঝে খুব বেশি খারাপ লাগলে সাত তলাতে মামা মামীর ফ্লাটে যেয়ে খানিক সময় কাটিয়ে আসে। মামাতো বোন দুটির বিয়ে হয়ে গেছে। ওখানে যেয়েও খুব বেশি সময় থাকা হয় না তার। ওনাদের সাথে আন্তরিকতা আগে থেকেই কম। তাই মনকে কিছুটা শান্ত করার জন্য গেলেও বেশি সময় থাকা হয় না আর।
আজ অবশ্য মেহরাব আছে ওর বউ নিয়ে। দু’দিন থাকবে। ফুফুর মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে এসেছে ওরা। মেহরাবের পোস্টিং এখন চট্টগ্রামে। আগামীকাল বউভাতের প্রোগ্রাম শেষ করে ফিরবে । এরপর আবার সেই একাকিত্বের জীবন।
মেহরাবের বউ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন সায়েন্সে পড়ে। মেয়েটা বেশ লক্ষী । মেহরাবের সাথে রিলেশানের বিয়ে হলেও মিথিলার অপছন্দ হয়নি । মেহরাবকে খুব ভালোবাসে এটাই বড় কথা।
পরদিন সকালে মিথিলা রুমে বসে কীসব টুকটাক কাজ করছিল এরমধ্যে মেহরাব আর ওর বউ আসে রুমে। মিথিলা ওদের দেখে হাসিমুখে বসতে বলে।
– কী ব্যাপার ! সকাল সকাল মানিক জোড় একসাথে? রাতে ঘুমাতে প্রবলেম হয়নি তো , আশা! এবার তো অনেকদিন পরে এলে।
– না, না আপা। একদমই না। আমি তো ভেবেই অবাক হচ্ছি একা এখানে এতবড় বাসায় থাকেন কী করে? আমি হলে তো মরেই যেতাম। বলল, মেহরাবের বউ আশা।
– হা হা! ‘ঠেলার নাম বাবাজী ‘ কথাটি শোননি? ঠেলায় পড়লে সবই করতে হয় বাধ্য হয়ে। একা না থেকে উপায় কী বলো!
– আবার নতুন করে জীবনটা সাজিয়ে নিলেই পারিস! তবেইতো উপায় হয়ে যায়।
সুযোগ পেয়ে বলে উঠল , মেহরাব!
– খুব বড় হয়ে গেছিস , তাই না! বিয়ে করেছিস বলে ভাবিস না যে আমি দু ‘একটা চর থাপ্পড় দিতে পারব না। বউয়ের সামনেই কী পানিশমেন্ট পেতে চাচ্ছিস নাকি?
– দিতে চাইলে দে! কোনো সমস্যা নেই । কিন্তু এবার একটা দফারফা করেই আমি ফিরব। তুই এখানে একা একা থাকিস আমার কিছুই ভালো লাগে না। জানিস কত চিন্তায় থাকি। কাজেও ঠিকঠাক মন দিতে পারি না। কতবার বললাম, আমার কাছে চলে আয়। চাকরি বাকরি করার দরকার নেই। আর দরকার হলেও ওখানে কিছু কর, কিন্তু তা তো যাবি না।
– আমার এখানে থাকায় তোর কী সমস্যা? আমি তো ভালো আছি।
– কত ভালো আছিস সে তো দেখছিই। এভাবে একা একা কতকাল? এখন শরীরে, মনে জোর আছে তাই তোর হয়ত খুব বেশি খারাপ লাগছে না। একটা বয়স পরে দেখবি এই জীবন আর ভালো লাগবে না। তখন কী করবি ভেবেছিস কখনো? এক কথা আর কতবার বলবো তোকে?
– এক কথা আমারও শুনতে ভালো লাগে না.। এত ভাবতে থাকলে জীবন চলে না। ভবিষ্যতে কি হবে তখনের টা তখন দেখা যাবে। তাছাড়া তোরা তো আছিসই। এসব কথা শুনার বয়স বা ধৈর্য কোনোটাই এখন আমার আর নেই।
– এটা কোনো কথা হলো না। তোর বয়সী মেয়েরা এখনো অনেকে আছে যারা বিয়েই করেনি। তাই এমন কিছু বয়স হয়নি যে তুই বিয়ে করতে পারবি না।
– তুই দেখছি খুব বড় বড় কথা বলছিস আজকাল। এত বেশি বুঝিস না। ভুলে যাস না আমি তোর বড় বোন।
– আপা, মেহরাব ভুল কী বলেছে? আমি আপনাকে খুব ভয় পাই। তাই কথা বলতে সাহস পাচ্ছি না। এজন্য চুপচাপ ছিলাম। কিন্তু না বলে আর পারছি না। আপনি কেন বোঝেন না! আপনার জন্য আমরা টেনশানে থাকি। বলল, আশা।
– এত টেনশান কেন করো? আমি কি বলেছি করতে। আমি তো ভালোই আছি। কখনো তো বলিনি যে আমার খারাপ লাগে এ জীবনে। সবার কাছে বারবার এই এক কথা শুনতে শুনতে আ’ম ফেড আপ। আজ প্রোগ্রামে যেয়েও একই প্রশ্ন সবার মুখে। আমার কথা হলো এত টেনশান কেন করো তোমরা ? একটা সিংগেল মেয়ে কী তার লাইফ লিড করার মতো যোগ্যতা রাখে না?
– অবশ্যই রাখে। রাখবে না কেন? আমিও একটা মেয়ে । আমি জানি মেয়েদের একা পথ চলা আমাদের সমাজে কতটা ভয়ানক। সমাজের কথা না হয় বাদই দিলাম ! আজ আপনি সুস্থ আছেন, ভালো আছেন তাই কিছু খারাপ লাগে না। কাল যদি অসুস্থ হয়ে একা ঘরে পড়ে থাকেন কে দেখবে বলেন তো! আমরা তো খবর পেয়ে আসতে আসতে আপনার আরো খারাপ অবস্থা হবে। আজ আব্বাও আপনার কথা বলতে বলতে কান্না করে দিয়েছে।
– বাবা?
– হ্যা, কালকে প্রোগ্রামে অনেক সময় কথা হয়েছে । আপনিতো অন্যদিকে তখন ব্যস্ত ছিলেন। আব্বা বাসাতে আসার পরেও কল দিয়েছিল। অনেক সময় নিয়ে কথা বলেছে। উনি শুধু আপনাকে নিয়েই ভাবে। আপনাকে কিছু বলতে সাহস পায় না। কারণ সে কোনমুখে বলবে? আপনাদের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারেনি তাই কত আফসোস করে! আর এখন এ অবস্থায় থাকেন বলে খুব কষ্ট পায়। উনি আমার কাছে আবদার করেছে মৃত্যুর আগে তার একটাই আশা আপনাকে সংসারী দেখে যাওয়া। আমি আব্বাকে কথা দিয়েছি। মেহরাবের কথা আপনি শোনেন আর নাই শোনেন আমি আপনার কোনো কথাই শুনব না। এবার আপনাকে যদি রাজী করাতে না পারি তবে আমি আর চট্টগ্রামই যাব না। সামনের মাসে আমার সেমিস্টার ফাইনাল। সব গোল্লায় যাক! আমি মেহরাবকেও বলে দিয়েছি, আপা যদি বিয়েতে রাজী না হয় আমি তবে এখন থেকে এখানেই থাকব।
– মিথিলা মুচকি হেসে বলল, তবে তো ভালোই হয়। দুই বোন জমিয়ে আড্ডা হবে।
– আমি কিন্তু ফান করছি না , আপা। সিরিয়াসলি!
– আমিও সিরিয়াস বলছি।
– মেহরাব একটু ক্ষেপে যেয়ে বলল, এত খামখেয়ালি করিস না তো , আপা। এবার তোর কোনো কথা শুনব না।
– মিথিলা হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা, আমাকে যে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস ! তা এই বুড়ির পাত্র পাবি কই তাই বল!
– তুই একবার রাজী হয়েই দেখ!
– আচ্ছা, ধর আমি রাজী! এবার বল কোন আংকেলের গলায় আমাকে ঝুলাবি?
– পাত্র আমি পেয়েছি। তুই শুধু বল বিয়েতে রাজী! বাকিসব আমার দায়িত্ব!
– তলে তলে অনেকদূর এগিয়েছিস মনে হচ্ছে। বিয়ের কার্ডও ছাপিয়ে ফেলেছিস নাকি?
– হেয়ালি করিস না একদম। আমি সিরিয়াস!
– আমিও সিরিয়াস! বললাম তো আংকেলের সাথে দেখা করিয়ে দে। আগে দেখি পাত্র পছন্দ হয় কি না! তারপরে না হয় ভাবব।
– ভাবাভাবির কিছু নেই। পাত্র আমাদের সবার পছন্দ। বাবাও পছন্দ করেছে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা তার তোকে খুব পছন্দ।
– তাই নাকি! কে সে ভদ্রলোক?
– আইমান ভাইয়া!
– হোয়াট! মিথিলা চমকে উঠল।
– ইয়েস। আইমান ভাই নিজে আমার সাথে কথা বলেছে। কোনো মিডিয়ার থ্রুতে কথা বলতে আসেনি । সে নিজেই বাবার সাথে আর আমার সাথে কথা বলেছে আজ অনুষ্ঠান শেষে। অনেকদিন ধরেই সে তোকে পছন্দ করে এটা আমরা সবাই জানি। আইমান ভাই এখন আর সেই আগের মতো বাউন্ডুলে নেই। একদম অন্যরকম মানুষ এখন সে। সে নিজে থেকে তোর ব্যাপারে প্রস্তাব দিয়েছে। তাছাড়া তার পরিবারেরও তার উপর কথা বলার কোনো সাহস নেই। আইমান ভাই যাকে পছন্দ করবে তাকেই তারা মেনে নিবে। বিশ্বাস কর , আপা! আমি আইমান ভাইয়ের চোখে তোর জন্য ভালোবাসা দেখেছি। উনি তোকে খুব সুখী রাখবে। তাছাড়া তোরা দু’জনই যথেষ্ঠ ম্যাচিউর! ভুল হবার কোনো চান্সই নেই।
– পাগলের মতো কথা বলিস না তো! আমি বিয়েশাদী কিছুই করছি না।
– আমিও তবে এবার তোকে বলে রাখলাম , তুই যদি বিয়েতে রাজী না হোস তবে কোনোদিন আমি আর এ মুখো হব না।
– তোর বউ বলে সারাজীবনের জন্য এখানে থেকে যাবে আর তুই বলিস আসবি না । তাইলে কেমন হলো! সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেল না।
– আশা কী বলেছে না বলেছে জানি না। তবে আমার কথা যে গাছে পাতায় বলিনা ভালো করেই জানিস! আমি এই মুহূর্তে তোর সামনে থেকে চলে যাব আর কোনোদিন আর আসব না। আমাদের কোনো কথার মূল্য তোর কাছে নেই । আমাদের ইমোশানের দাম নেই! সেখানে এসে মায়া বাড়িয়ে আর লাভ নেই। বিয়ে শাদী যা খেয়েছি সেই অনেক। বউভাতে আর যাচ্ছি না। আশা প্যাক করো! কুইক।
রাগ করে সেখান থেকে উঠে গেল ,মেহরাব!
মেহরাবের চোখ রক্তবর্ণ! ওর এমন চেহারা কখন হয় এটা মিথিলা জানে। খুব জেদী ছোটবেলা থেকে । ও যদি সত্যিই এখান থেকে একবার রাগ করে যায় তবে এই রাগ ভাঙ্গাতে কত কী যে করতে হবে আল্লাহ মালুম! সত্যিই যদি তার ভাইটি আর তার সাথে যোগাযোগ না রাখে। প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে ওর সাথে কথা না বললে মিথিলার ঘুম আসে না। অথচ পাগলটা কী বলছে এসব?
সে দ্রুত ওর পিছু পিছু যেয়ে বলল, আচ্ছা, একটু সময় দে। ভেবে জানাই।
– ভাবাভাবির সুযোগ নেই। এই কথা বলে এত বছর কাটিয়েছিস। এবার আর আমার তোকে বিশ্বাস নেই। বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন । মানলাম তোর সেটা আছে কিন্তু একজন সঙ্গীরও যে প্রয়োজন সেটা কেন বুঝিস না। একসময় দেখবি ক্লান্ত হয়ে গেছিস। আর পারছিস না। তখন আর পেছনে ঘুরে দাঁড়াবার সময়ও থাকবে না। আজ যে সুযোগ এসেছে তাকে হেলায় হারাস না। আইমান ভাই সম্পর্কে অনেক খোঁজখবর আগে থেকেই জানি। প্রয়োজনে আবার নিবো। তুই আর না করিস না , আপা। তুই শুধু একবার হ্যা বলে দেখ! আইমান ভাই তোকে পাগলের মতো চায়! গতকাল আমার আর বাবার সামনে তোকে পাবার জন্য বাচ্চাদের মতো করে হাতজোড় করেছে। তোকে বলার সাহস ওনার নেই। তাই আমাদের কাছে আসতে বাধ্য হয়েছে।
– মিথিলা নিশ্চুপ!
– ঠিক আছে ! তুই সময় চেয়েছিস , ওকে! আজ সারাদিন ভাব। আগামীকালও ভাব। আমি প্রয়োজনে মেইল করে আরো দু’দিন এমার্জেন্সী ছুটি বাড়িয়ে নিবো। তাও এবার আমি আর খালি হাতে ফিরতে চাই না। গতবার এসেও এক ডাক্তার ছেলে ঠিক করলাম তুই রাজীই হলি না। এবার আর না করিস না আপা। এবার তুই না করলে সত্যিই তোর সাথে আর কোনো যোগাযোগই আমি রাখব না। আম্মি মারা যাবার পর তুইই আমার সব। তোকে কতটা ভালোবাসি তুই জানিস। আর তোর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা আমার জন্য কতটা কষ্টের সেটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস। আমার কষ্ট যে তুই সত্য করতে পারিস না সে আমি জানি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেহরাব বলল, বাকিটা তোর ইচ্ছা!
মিথিলা দু ‘ হাতে মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে আছে । আশা কয়েকবার এসে নাস্তা খাবার জন্য তাড়া দিলেও সে সাড়া দেয় না। বলে, পরে খাবে।
মেহরাবকে যেয়ে খানিক সময় বকাঝকা করল আশা।
-আপার সাথে এমনভাবে কথা বললে? দেখো, আপা কী অস্থিরতায় ভুগছে!
– অস্থিরতায় ভুগছে তুমি শিওর?
– হুম! তাই তো দেখছি।
– তবে নিশ্চিত থাকো! পজিটিভ রেজাল্টই আসবে। তুমি পারলে বাড়িয়ে বাড়িয়ে আরো কিছু বলে অস্থিরতা বাড়িয়ে দাও। বলো আমি সত্যিই আর যোগাযোগ রাখব না এমনটাই বলছি। বিলিভ মি! আপাকে তো আমি চিনি। আমাকে হারানোর কথা সে ভাবতেই পারবে না। আমার জন্য আপাকে এবার রাজী হতেই হবে। আইমান ভাইয়ের সাথে বিয়ে হলে আমি একদম নিশ্চিত থাকব। জানাশোনার মাঝে থাকবে আপা।
তুমি একটু আগুনে ঘি ঢালো ,যাও। এবার একটা এসপার ওস্পার করেই ছাড়ব।
– তুমি না!
– আমি কিছুই না! আমি শুধু একজন অপারগ ছোট ভাই। সারাজীবন ওর থেকে নিয়েই গেছি । ওকে কিছু দিতে পারিনি। গাধাটা সারাজীবন শুধু সবার জন্য করেই গেল। কারো প্রতি কোনো অভিমান , রাগ কোনোকিছু হতে দেখিনি ওকে। একদম সিনেমার নায়িকা, শাবানা। বাস্তবে এমন মিলে না। তাই, আমি নিজের কাছে এবার প্রমিজ করেছি আমার দুঃখী বোনটাকে আমি এবার যেভাবেই হোক একটু সুখের আলো দেখাতে চাই।
– মন থেকে চাইছ! আল্লাহ নিশ্চয়ই সহায় হবেন! দেখি , একা একা আপা কী করে! খুব মানসিক প্রেসারে আছে মনে হলো।
– থাকতে দাও। সিদ্ধান্ত আমাদের ফেভারেই আসবে , ইন শা আল্লাহ!
– ইন শা আল্লাহ! তাই যেনো হয়!
সামনা সামনি দু’টি চেয়ারে বসে আছে প্রিয় আর এনা। প্রিয় এতকরে বলেছে আসার সময় আয়াতকে নিয়ে আসতে। কিন্তু এনা আনেনি। এনা চায় না আয়াতের সাথে প্রিয়র এটাচমেন্ট বাড়তে থাক। এমনিতে ছেলেটা বাবার জন্য খুব ঝামেলা করে। এ ক’মাসে কিছুটা কন্ট্রোলে এনেছে। প্রিয়র সাথে এতবার দেখা হলে আবার সেই আগের মতো হয়ে যাবে।
– কী বলবে দ্রুত বলো! আমার আবার পার্লারে এপয়েন্টমেন্ট আছে।
– এটা করেই তো দিন পার করো! আল্লাহ তো অনেক সুন্দর চেহারা দিয়েই তোমাকে পাঠিয়েছে । এত পার্লারে যেয়ে সময় নষ্ট করে কী লাভ! ছেলেটাকে একটু সময় দিলেই তো পারো।
– সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে! আমার সৌন্দর্য দেখার চোখ তো দেখছি ভালোই হয়েছে । আগে তো কখনো হদীস পাইনি । আচ্ছা, সেসব কথা রাখো ডেকেছ কেন তাই বলো।
– ডেকেছি কারণ প্রথমত আয়াতকে দেখতে চেয়েছিলাম।
– সেটা সম্ভব না। আয়াত ঘুমাচ্ছিল।
– মিথ্যা বলার অভ্যাস আর গেল না।
– আচ্ছা, দ্বিতীয়ত কী সেটা বলো।
– আমি বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছি। আয়াতকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। আয়াত তোমার কাছে আমার আমানত। তবে ছয়মাস অন্তর আসব ওকে দেখতে। আর ওর সাথে প্রতিদিন যেন কথা বলতে পারি সেটা মেক শিওর করার দায়িত্ব তোমার। আর এটা যদি তুমি করতে অপারগতা প্রকাশ করো তবে আমি আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবো। আদালতের কথাগুলো নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে।
– ওহ! তবে বাংলাদেশে ফিরবে? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, এনা।
– এখানে করব কী তবে? কিছু তো করে খেতে হবে।
– বিজনেস থেকে না বেরোলেই পারতে।
– একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে প্রিয় বলল, তাই তোমার বাবার বিজনেস!
– হ্যা, তো!
– আচ্ছা ওসব কথা বাদ দাও। ওসব এ যেতে চাই না। আর আয়াত আর একটু বড় হলে ওকে আমি আমার কাছে নিয়ে রাখব কিছুদিনের জন্য। ওর নিজের দেশ, দাদা-দাদি এদেকেও দেখা দরকার ওর। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বছর দুয়েক পরে ওকে কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশে নিয়ে যাব আমার সাথে। আশা করছি তখন কোন ধরনের সিনক্রিয়েট করবে না।
– দুই বছর পরে ছেলের জন্য এই ভালোবাসা তোমার থাকে কিনা সেটা দেখো না!
– নিজের মত সবাইকে কেন ভাবো!!
– আচ্ছা তোমার কথা শেষ হয়েছে? আমি উঠব।
– হুম। আপাতত শেষ। ভালো থেকো। আর আগামী সপ্তাহে আমি টিকিট করেছি। যাবার আগে একবার ছেলেটার সাথে দেখা করে যেতে চাই। আগামী পরশু তো ওর স্কুল ছুটি। ঐদিন সারাদিন আমি ওর সাথে থাকতে চাই। ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিবে। আমি অপেক্ষা করব।
– বেশতো! বাসায় চলে এসো।
– সরি। আমার বাসাতে নিয়ে আসব। আপত্তি করার মতো কোনো কারণ দেখছি না।
– আচ্ছা।
– উঠি তবে।
– তবে এখানেই কি আমাদের শেষ দেখা?
– আর কী প্রয়োজন আছে?
– নাহ! সময় কত নিষ্ঠুর তাই না!
– সময় নিষ্ঠুর না। নিষ্ঠুর আমরা বানিয়েছি। সময় সময়ের গতিতে চলে। সেখানে কারো হাত নেই।
– অল দ্যা বেস্ট।
প্রিয়র চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো এনা। চোখের কোণ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল অজান্তে। মানব মন কত বিচিত্র। সে অবাক হয়ে ভাবছে, “প্রিয় চলে যাবে শুনে এত খারাপ লাগছে কেনো আমার? একসময় মানুষটাকে কত কষ্ট দিয়েছি!
সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্স পর্যন্ত দিয়েছি। তারপরও কিসের টান কাজ করছে?
প্রিয় দেশে ফিরে কি করবে? ওর মা-বাবা নিশ্চয়ই ওকে আবার বিয়ে দিবে! সে কি আর ইতালিতে ফিরবে? আর কি আমার সাথে ওর দেখা হবে? ”
মানুষ সত্যিই হয়ত দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। এত বছরেও যে অনুভূতি কাজ করেনি হঠাৎ করে সেই অনুভূতি মোচড় দিয়ে উঠলো এনার বুকের মধ্যে।
আইমান অনেকক্ষণ ধরে ওয়েটিং রুমে বসে আছে । অনেক কষ্টে মিথিলাকে ডিনারের জন্য রাজি করানো গেছে। মিথিলার পাঁচটার দিকে ছুটি হবে। ছুটি হলেই দু’জনে মিলে কিছুটা সময় পার্কে হাঁটবে। ডিনার পর্যন্ত কাটাবে সেখানে। মিথিলার খোলা হাওয়া খুব পছন্দ এটা জানে আইমান। বিশেষ করে সন্ধ্যার হাওয়া। আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছে । তার কাছে এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। মেহরাব যখন বলেছিল, মিথিলা তার সাথে ডিনারে যাওয়ার জন্য রাজি! শুনে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না কিছু সময়ের জন্য আইমান। তার সারা জীবনের অধরা স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। মিথিলাকে সে তার মনের রাণী বানিয়ে রাখবে সে সারাজীবন। নিজের কাছেই নিজেই প্রতিজ্ঞা করল।
চলবে……
পর্ব-৪৩
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/395114465604562/