সুখের_সন্ধানে পর্ব_৪৭

0
559
  1. #সুখের_সন্ধানে
    #পর্ব_৪৮

    নয় দিন পরে আমি আজ বাসায় ফিরেছি। এই ক’দিন কখন দিন আর কখন রাত পার করেছি সেটা টের পাওয়ার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। ভাবিনি আর বেঁচে ফিরব। আল্লাহর অশেষ দয়া যে এ যাত্রা ফিরতে পেরেছি। তবে এখনো প্রচুর শারীরিক দুর্বলতা রয়েছে । ডাক্তার বলেছে বেশ সময় লাগবে পুরোপুরি ইম্প্রুভ করতে। হসপিটাল থেকে ছাড়তে চায়নি। আরো দু’একদিন থেকে যেতে বলেছিল। কিন্তু আমিই জিদ করলাম বাসায় ফেরার জন্য । আর কতদিন ভালো লাগে ওই পরিবেশ? আইসিইউতে ছিলাম চারদিন। সেই ক’দিন কিছুর হুশ না থাকলেও কেবিনে শিফট হবার পর থেকে দেখেছি মিথিলা আর প্রিয় কতটা করেছে আমার জন্য। ওরা যেভাবে আমার খেয়াল রাখছিল আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি ওদের মা। মনে হয়েছিল ওরাই আমার বাবা মা এবং আমি ওদের ছোট বাচ্চা।

    বাসাতে এসে দেখলাম আমার চিন্তায় সেলিম আর আম্মার অবস্থাও খারাপ। এদের যে ঠিকঠাক গোসল খাওয়া কিছুই হয়নি সেটা দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছে। এদের মা ছেলে দু’জনকেই সবকিছু জোর করে করাতে হয়। আমি ছিলাম না কে করেছে এসব? সার্ভেন্টরা জোরাজুরি করলে যে ধমক দেয় দ্বিতীয়বার তারা আর সাহস পায় না কিছু বলতে। আমার সেন্স আসার পর থেকে আমার শুধু এ চিন্তাই হচ্ছিল তাই তো আরো তড়িঘড়ি করে চলে এলাম।

    কিন্তু ফেরার পর থেকেই বুঝতে পারছি আর দু’একদিন থাকাটা আসলেই দরকার ছিল। একা উঠে দাঁড়াতেই পারি না। মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছি। শুয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি।

    মিথিলা এসে আমাকে জানাল সে বিকেলে বাসায় ফিরে । মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব। মেয়েটা থাকলে মনে জোর মিলে। তাছাড়া মিথিলাও প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে এ ক’দিনে। একে তো ব্লাড দেবার পর কোনো বিশ্রাম পায়নি, অন্যদিকে এ ক’দিন আমার খেয়াল রাখতে যেয়ে নিজের খাওয়া ঘুম কোনোকিছুরই ঠিক ঠিকানা ছিল না। প্রিয়র নাকমুখও শুকিয়ে কাঠ। খুব অপরাধেবোধে ভুগছি আমি। ছেলেটা আসতে না আসতে কী একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসলাম। কোথায় ওর জন্য কিছু করব উলটা আমিই ওকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি। এক আমার জন্য পুরো বাসা এলোমেলো। হঠাৎ করে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়বো কল্পনাতেও ভাবি নি।

    দুপুরের খাবারের পর মিথিলা চলে যাবে বললে আমি মিথিলাকে বললাম , তোর শরীরের অবস্থাও তো ভালো না। এখানে কয়েকদিন থেকে যা। একটু খানাপিনা সময়মতো করলে ঠিক হয়ে যাবি দ্রুত। আমি বিছানায় থাকলেও তোর খেয়াল ঠিকঠাক রাখার মতো সুস্থ আছি। বাসায় ফিরলে তো নিজের দিকে খেয়াল করার সময় পাবি আর না তুই।

    – না , মা! আমার স্কুল এমনিতেই এক সপ্তাহ বন্ধ গিয়েছে। আর দেয়াটা ঠিক হবে না। তুমি চিন্তা করো না। আমি ম্যানেজ করে নিবো। দু’ একদিনেই ঠিক হয়ে যাবে।

    – স্কুলে গেলে আর কী ঠিক হবে সে তো বুঝতেই পারছি।

    আমাদের কথার মাঝে প্রিয় এসে উপস্থিত হয়। সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল।

    – আম্মু যখন বলেছে থেকে গেলেই পারো। আম্মু কিন্তু আসলে তোমার জন্য নয়, নিজের জন্যই তোমাকে থাকতে বলছে। তুমি থাকলে তার গল্প করার একজন মানুষ পেয়ে যায়, বুঝতে পারছ না।

    – কিন্তু ভাইয়া! আমার স্কুল অফ রাখার ব্যাপারটা অলরেডি ম্যানেজমেন্টের চোখে লেগেছে। তাছাড়া নেক্সট মান্থে এক্সাম শুরু হবে। বুঝতেই পারছ।

    – হুম, বুঝেছি । বুঝেছি। টেনশান করতে হবে না। আমি মাত্রই জিন্নাত স্যারের সাথে কথা বলেছি।

    – মিথিলা অবাক হয়ে বলল, মানে?

    – মানে সহজ! আমি তোমার জন্য পুরো একমাসের ছুটির ব্যবস্থা করেছি। উইদাউট পেমেন্টে ওয়ান মান্থ হলিডে। বিন্দাস টেনশান ফ্রী থাকতে পারবে। উনারা প্রক্সি টিচারের এরেঞ্জ করে নিবে। শুধু দু’একদিনের মাঝে যেয়ে এপ্লিকেশানটা জমা দিয়ে আসতে হবে তোমার। অথবা মেইল করে দিলেও চলবে। আর স্যার তোমাকে কথা বলতে বলেছে। কীসব জরুরী ব্যাপারে একটু জানার ছিল উনার তাই।

    – তুমি জিন্নাত স্যারকে চেনো? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মিথিলা।

    – চিনব না কেন? সেদিন গল্পে গল্পে বললে না উনি তোমাদের ম্যানেজমেন্টের হেড। তাই ওনার সাথেই মাত্র কথা বলে ব্যবস্থা করেছি। জিন্নাত স্যার আমার ডিরেক্ট টিচার ছিলেন ভার্সিটিতে। খুব আদর করতেন আমাকে। কত স্যারের বাসাতেও গিয়েছি। রিট্যায়ারমেন্টের পর এই স্কুলটা চালাচ্ছেন । এখানে উনিও বেশ অংকের একটা শেয়ার ওউন করেন। বহুদিন পর স্যারের সাথে কথা হলো। আমার পরিচয় দিতেই চিনতে পেরেছেন। এখনো সেই আগের মতই মনে রেখেছেন আমাকে। দেশে এসেছি শুনে ভীষণ খুশি । স্যারের কাছে তোমার ছুটি চাইতেই সব কিছু শুনে এলাউ করে দিলেন। আর তিনি তুমি আমার কাজিন এ কথা শুনে তো আরো অবাক! যাই হোক তোমার ছুটি ম্যানেজ হয়েছে এটাই বড় কথা। এখন পুরো একমাস বিন্দাস করো আম্মুর সাথে । কী আম্মু! খুশি তো?

    – আমি তো ভীষণ খুশি , বাবা। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি এনে দিলে। কত বছর পর মা মেয়ে একসাথে এতদিন থাকব। মিথিলা তো এমন লম্বা সময় এসে আমার সাথে থাকার এখন সুযোগই পায় না। খুব ভাল করেছ, বাবা!

    – কিন্তু, রূম্পা মা! আমার বাসায় যাওয়া তো জরুরী! আমার কাপড় চোপড় কিছুই তো সাথে নেই। তাছাড়া কতদিন বাসাতে নেই। যদিও আশা এসে থেকে গেছে দু’দিন। তবুও একটু যাওয়া দরকার। সব দেখেশুনে আসি। আজ না হয় যাই।

    – মিথিলা বাসায় যাওয়ার জন্য জিদ ধরেছে দেখে আমি বললাম, যাবিই। আচ্ছা, তবে যা। কিন্তু শর্ত হলো আজই ব্যাক করবি। কিছুতেই তোর শরীরের এই অবস্থায় একা থাকতে পারবি না। ঠিকঠাক রান্নাবান্না করিস না। আমি শিওর তুই এখান থেকে যেয়েই কোনোরকম বিছানায় পড়েই খেয়ে না খেয়ে ঘুমাতে থাকবি। তাই ওসব বাদ। সোজা চলে আসবি বাসাতে । প্রিয় , এক কাজ করো তো , বাবা। তুমি ওর সাথে যাও। ওকে আবার সাথে করে নিয়ে আসবে। ও যাই বলুক একদমই রেখে আসবে না।

    প্রিয় যেন এমন কিছু শোনার অপেক্ষাতেই ছিল। সে চট করে রাজী হয়ে গেল।

    প্রিয় ড্রাইভার আনেনি সাথে। তার মায়ের গাড়ীটা নিয়ে বেরিয়েছে। ড্রাইভার আসতে চেয়েছিল। সে ইচ্ছে করেই আনেনি। মিথিলার সাথে একান্ত কিছু সময় কাটানোর এমন মুহূর্ত সে আর কই পাবে? মিথিলা বাসায় চলে আসবে এ কথা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনে খুব মন খারাপ হচ্ছিল তার। মিথিলাকে ছাড়া এ বাসাতে থাকা খুব পানসে মনে হবে তার কাছে। তাই হঠাৎ করে মনে হলো মিথিলা সেদিন বলেছিল জিন্নাত স্যারের কথা। সে যে জিন্নাত স্যারকে চিনে আর যোগাযোগ আছে এটা আর জানায়নি তখন তাকে। তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ফেলল মুহূর্তেই। ফোন দিয়ে মিথিলার হেল্থ কন্ডিশান আর তার মায়ের মিথিলাকে কতটা প্রয়োজন এতা বুঝিয়ে বলতেই প্রিয় ছাত্রের আবদার ফেলতে পারেননি জিন্নাত স্যার। সে আসলে মায়ের দোহাই দিয়ে নিজের জন্যই আটকেছে মিথিলাকে। তাছাড়া আরো ভয় পাচ্ছে আইমানকে। মিথিলা বাসাতে গেলেই যে আবার আইমানের সাথে যোগাযোগ বেড়ে যাবে এটা সে নিশ্চিত। দেখা যাবে মিথিলার উইকনেসের দোহাই দিয়ে টেইক কেয়ারের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে, এটাও সে সুনিশ্চিত । তাই এসব কিছু ভেবে আপাতত এক মাসের জন্য তো আটকানো গেল মিথিলাকে। পরেরটা পরে দেখা যাবে, আবার কোনো নতুন ফন্দী বানানো যাবে। খুব বেশি স্বার্থপরের মতো আচরণ করে ফেলল সে জানে কিন্তু এছাড়া আর উপায় নেই।

    মিথিলা একদম চুপচাপ। প্রচুর রাগ হচ্ছে প্রিয়র উপর তার।

    বহুদিন পর বাংলাদেশের রোডে ড্রাইভিং করছে। একটু ধীরেধীরে আর সাবধানে চালাতে হচ্ছে প্রিয়র। তার উপর নেমেছে ঝুম বৃষ্টি। মিথিলা পাশের সীটে বসা। কোনো কথাই বলছে না। প্রিয় নিজের ফোনের ব্লুটুথ ওপেন করে গাড়ির সাথে কানেক্ট করে শ্রীকান্তের “ আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলেম… “। গানটা বেশ ভালোই ভলিউম দিয়ে প্লে করল। এই গানটা মিথিলার সবচে’ প্রিয় গান এটা প্রিয়র অজানা নয়। ইতালিতে বসে গানটা যতবার শুনত ঠিক ততবার মিথিলা কথা মনে করত ।

    – চুপচাপ কেন? দেখেছ গানটা পরিবেশের সাথে একদম খাপে খাপ মিলে গেল। হোয়াট আ কো ইন্সিডেন্স, তাই না! এখন তো আসলেই শ্রাবণের সন্ধ্যা । প্রিয় এমনভাবে এসাইট্মেন্ট দেখাচ্ছে গানটা নিয়ে যেন আসলেই সে কিছু না জেনেবুঝে এই গান সিলেক্ট করেছে। মনে মনে নিজের অভিনয়ের প্রশংসা না করে পারছে না। সেদিন অল্পের জন্য মিথিলার কাছে ধরা পড়েনি। মিথিলাকে তো প্রায় বুকের সাথে চেপেই ধরেছিল সে। ভাগ্যিস মিথিলা টের পাবার আগেই সে মিথিলার ঘাড়ের নিচ থেকে হাত সরিয়ে ফেলেছিল। সেদিনের জন্যও খুব বিজয়ী ভাবতে মন চাচ্ছে নিজের।

    মিথিলাকে চুপচাপ দেখে সে আবার বলল, কী হলো ! বোবাবনে গেলে নাকি? কথবার্তা নেই সেই বেরোনোর পর থেকেই। নাকি মৌনব্রত রেখেছ?

    এমনিতে প্রিয় তার ছুটির এরেঞ্জ কেন করল এজন্য খুব মেজাজ গরম হচ্ছে তার উপর। তাছাড়া এমন নন স্টপ পটর পটর। মন চাইছে মুখটা দু’হাতে চেপে ধরে। গাড়ি চালাতে চালাতে আবার ওই বেসুরো গলায় শ্রীকান্তের বিখ্যাত গানটার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে। এত মিষ্টি সুরটা প্রিয়র ওই হুমড়া মার্কা ভয়েসের তলায় হারিয়েই গেছে প্রায় ।

    আসলে প্রিয় এটা ইচ্ছে করেই করছে যাতে মিথিলা তার উপর ক্ষেপে। সে গান গাইলে মিথিলা অলওয়েজ ক্ষেপে যেত। প্রিয়র গানের গলা এত বাজে যে আশেপাশে শিয়াল কুকুর থাকলেও ভয়ে পালাত! এ কথা যে কতবার বলত মিথিলা তাকে। আজ আর কিছুই বলছে না সে দেখে প্রিয় ইচ্ছে করেই আরো জোরে জোরে শ্রীকান্তের নকল করতে যেয়ে গানের চৌদ্দটা পনেরোটা বাজিয়ে সারছে।

    – ভাইয়া, এখনো সেই বাচ্চাই রয়ে গেলে। যখন যা খুশি তাই করো। তোমার খামখেয়ালিপনা আর গেল না। নিজে এতবড় এক বাচ্চার বাপ। তাও আক্কেল হলো না আর। অন্ততপক্ষে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারতে!

    মিথিলার যে মুখ খুলেছে তাতেই সে মহাখুশি। সে বলল , কেন কী করেছি? কী জিজ্ঞেস করব?

    – এই যে ছুটি নিলা? বাচ্চাদের কতবড় ক্ষতি হলো জানো?

    – আসছে মাদার তেরেসা! নিজের চেহারা দেখেছ? এই ক’দিনে পেঁচার মতো চেহারা হয়েছে। আগে নিজের সুস্থতা পরে বাকীসব! এখানে আমার যা ভালো মনে হয়েছে তাই করেছি। তাছাড়া আমি যা করেছি আম্মুর জন্য করেছি। তুমি থাকলে আম্মু তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে। তার কথা বলার একজন মানুষ দরকার। তুমি পাশে থাকলে সে খুব বেটার ফিল করে সেটা তুমি না বুঝলেও আমি এ ক’দিনে বেশ বুঝেছি।

    – ঘোড়ার ডিম বুঝেছ। তোমার গুণধর সুন্দরী বৌ যখন জানবে আমি তোমাদের বাসাতে থাকছি তোমাকে একদম পানি ছাড়াই গিলে ফেলবে। খুব বেশি বাড় যে বেড়েছ এটা ঠ্যাং একটা ভেঙ্গে তোমার বৌ হাতে ঝুলয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিবে। আমিও চাই রূম্পা মায়ের পাশে থাকতে। অমন ছন্নছাড়া একা জীবন আমারও ভালো লাগে না । কিন্তু ওই মহারাণী ভিক্টোরিয়ার কথা মনে পড়তেই তো কলিজা শুকিয়ে আসে।

    – ও তবে এই কথা! আমার যদি ভয় না থাকে তোমার এত ভয় কেন? নাকি আমার বউকে খুব হিংসে হয় তোমার?

    – আমার বয়েই গেছে হিংসে করতে! ওনার কাছে কী এমন আছে যাতে আমার হিংসে হবে?

    – আমি আছি যে!

    প্রিয়র এমন উত্তর মিথিলা মোটেই আশা করেনি। সে ভেবেছিল মজার ছলে কিছু বলবে। কিন্তু এ কথা শুনে সে একদম চুপ হয়ে গেল।

    – সরি! মজার মাত্রা মনে হয় বেশিই হয়ে গেল!

    মিথিলা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল, আজ যে জ্যাম! সন্ধ্যার দিকে ফেরা তো দূরে থাক আমরা পৌঁছাতেই তো রাত দুপুর হয়ে যাবে। বৃষ্টি হলেই রাস্তায় জ্যামের একটা হিড়িক পড়ে যায়। আর যে পরিমান বৃষ্টি পড়ছে রাস্তায় তো গলা পানি হবে মনে হচ্ছে। গাড়ি নিয়ে না এসে তখন নৌকা নিয়ে আসতে হবে। নৌকা চালাতে পারবে তো!

    – প্রিয় বুঝতে পারল মিথিলা প্রসঙ্গ বদলাতে চাইছে। তবে মিথিলা যা বলেছে তা তো সত্য। কী পরিমাণ যে বৃষ্টি হচ্ছে। আর জ্যামের কারণে গাড়ি এগুচ্ছেই না। সে মিথিলাকে বলল, তোমার জন্য নৌকা কেন রকেটও চালাতে পারব।

    – মিথিলার মন চাচ্ছে মাথা ফাটিয়ে দেয় প্রিয়র। কীসব আবোল তাবোল বলেই যাচ্ছে। এমন ভাবে আগে কখনো তো কথা বলেনি প্রিয়। বুড়ো বয়সে ভিমরতিতে পেল নাকি?

    – প্রিয় , মিথিলার দিকে আড়চোখে চেয়ে তার ওই মদন মার্কা গলায় গেয়ে উঠল , সব সখিরে পার করিতে নিবো আনা আনা! তোমার বেলায় নিবো সখী তোমার কানের সোনা …।

    – মিথিলার এবার সত্যি মনে হচ্ছে প্রিয়র মাথামুথা আউলাঝাউলা হয়ে গেছে। তাই আর কোনো কথা না বলে ডানদিকে তাকিয়ে মুখটিপে হাসছে সে।

    – প্রিয় বেশ রোমান্টিক একটা মুডে আছে। ভাবছে মিথিলাকে আজ মনের কথা বলেই ফেলবে । এমন সাহস সবসময় তার হয় না। আজ পরিবেশই এই সাহসের জন্য দায়ী। তার কাছে সবকিছু খুব রোমান্টিক লাগছে। এক্সাইট্মেন্টের কারণে সে মিথিলাকে আসল কথা বলতে ভুলেই গেছে। এনার সাথে যে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই এটা সে আজ জানাতে চেয়েছিল । বাসা থেকেই এটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানাবে। তার আম্মুকে অবশ্য এই মুহূর্তে জানাতে চাইছে না। একটু হেলথ কন্ডিশান স্টাবল হলেই জানাবে। এমন একটা নিউজ এখন তাকে দিতে চাইছে না। তবে মিথিলাকে জানানোটা বিশেষভাবে দরকার। প্রথমে বলতে যেয়েও বলেনি মিথিলাকে একটু জেলাস ফিল করানোর জন্য। এরপর আবার কীসব কথায় টপিকস আর পরিবেশটাই বদলে গেল।
    তারপরেও মেন্টালি একটা প্রিপারেশান নিলো বলবে সেই মুহূর্তে মিথিলার ফোনটা বেজে উঠল। আইমান কল দিয়েছে। সে জানে মিথিলা আজ বাসায় ফিরবে। তাই সে বাসা থেকে মিথিলার জন্য কীসব খাবার দাবার রান্না করে নিয়ে এসে বসে আছে তার মামার বাসাতে। এত দেরী হচ্ছে কেন জানতে কল দিয়েছে।

    – কী ব্যাপার? কত দূর? আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। বাইরে যে পরিমাণ ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে!

    – সেটাই তো! কী করব বলোতো! গাড়ি দুই মিনিট চললে বিশ মিনিট বসে থাকে। এই দুই ঘণ্টা বসে মাত্র বিশ মিনিটের পথ এসেছি। এত জ্যাম তার উপর রাস্তা পানিতে একদম তলিয়ে গেছে।

    – কী বলো! তবে তো ফিরতে বেশ সময় লাগবে। আমি কী করি বলোতো! আমারও তো এখান থেকে ফিরতে বহুসময় লেগে যাবে তাহলে। আম্মু স্যুপ ট্যুপ কীসব রান্নাবান্না করে পাঠিয়েছে তোমার জন্য। সেসব নিয়ে বসে আছি।

    – কষ্ট করতে গেলে কেন বলোতো! শুধু শুধু এসবের দরকার ছিল না।

    – তুমি বললেই হলো! আম্মু সেদিন হসপিটালে তোমার চেহারার হালত দেখে খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। তাই সে নিজে থেকেই এগুলি করে আমাকে দিয়ে পাঠাল। বেশি করেই করেছে। ফ্রীজে রেখে বেশ ক’দিন খেতে পারবে। তোমার পছন্দের আরো বেশকিছু আইটেম দিয়েছে দেখলাম।

    – আন্টি না! বেশি বেশি। আমার তো মনে হচ্ছে তুমিই করিয়েছ এসব। বেচারিকে এত কষ্ট দেবার কোনো মানে ছিল না। এসব তোমার খাওয়া দরকার। তুমি যে ভিতুর ডিম। যে কাহিনী করেছ ব্লাড ডোনেটের সময়ে। আন্টিকে বলো তোমাকেই বরং বেশি বেশি খাওয়াতে। নয়ত কখন না মাথা ঘুরে পড়ে যাও। বলে মিথিলা কিছুক্ষণ হাসল ।

    এভাবে টুকটাক কথাবার্তা চলছেই আবার মাঝেমাঝে কথার ফাঁকেফাঁকে খিলখিল করে হাসছে মিথিলা।

    মিথিলার হাসি যেয়ে বুকে তীরের মতো বিঁধছে প্রিয়র। খুব বিরক্ত লাগছে তার। তার মনে হলো সে যে পাশে আছে যেন একদম ভুলেই গেছে মিথিলা। অযথাই বিশ মিনিটের বেশি হলো কীসব খেজুরে আলাপ শুরু করেছে ওই আইমান না ফাইমানের সাথে। মাথায় রক্ত ওঠার জোগাড় তার। এমনিতেই জ্যামে এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে ধৈর্যশক্তি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আর তার উপর ওই আইমানের সাথে কুটুর কুটুর আলাপ। সে কিছুতেই নিতে পারছে না। বারবার দরকার ছাড়াই হর্ণ বাজাচ্ছে। মিথিলা বুঝতে পেরে বলল,

    – আচ্ছা , এক কাজ করো। তুমি মামীর কাছে সব দিয়ে বাসাতে চলে যাও। রাস্তার যে অবস্থা কখন না কখন ফিরি। তোমার আবার বাসায় ফিরতে খুব কষ্ট হবে। এখনই বেরিয়ে যাও নইলে সামনে আরো ঝমেলায় পড়বে। রাতে কথা হবে। রাখছি তবে। সাবধানে যেও।

    – আল্লাহ হাফেজ!

    – আল্লাহ হাফেজ!

    মিথিলা ফোন ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল, পাগল! কথা শুরু করলে আর থামাথামির হুশ থাকে না, সরি ভাইয়া।

    “আবার ঢং করে পা…গো…ল! এত সময় বিরক্ত করে এখন আবার সরি! আমি মনে হয় ওনার ড্রাইভার! “ মনেমনে এসব কথা বলছে আর আইমানের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছে প্রিয়।

    – এত কীসের কথা? একা থেকে থেকে যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছ। ধমকের সাথে বলল , প্রিয়।

    – এমন করছ কেন? ও আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। ওর সাথে গল্প করলে সমস্যা কোথায়? আমি খেয়াল করছি তুমি আইমানকে কেন যেন সহ্যই করতে পারছ না। এটা শুধু আমিই না আইমানও টের পেয়েছে। সেদিন ব্লাড দিয়ে যাবার সময় সামান্য একটা ধন্যবাদও দিলে না ওকে। যেখানে অন্য ডোনারদের নিজের গাড়ি দিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়েছ সেখানে ওকে নূন্যতম থ্যাকংস দিতেও এত কার্পণ্য !

    – কেন… সে কী নালিশ করেছে ?

    – না , তা করেনি। আমার কাছেই খারাপ লেগেছে। বেচারা একটা থ্যাংকস আমাদের থেকে এক্সপেক্ট করতেই পারে।

    – তুমি তো দিয়েছ আমি আবার কী করতে ? ঝারি মেরে বলল, প্রিয়। এত এত আদর যত্ন করলে ব্লাড দেবার সময় তাতে তার হয়নি? আচ্ছা, আচ্ছা । ফের কথা হলে তাকে বলে দিও আমি থ্যাংকস দিয়েছি।
    প্রিয় রাগে ফেটে যাচ্ছে । কী আর বলবে মিথিলাকে?

    সারাপথ আর তেমন কথা হলো না দু’জনের সাথে। মিথিলারও মেজাজ গরম প্রিয়র এমন ব্যবহারে। মিথিলা আগ বাড়িয়ে তেল দিচ্ছে না দেখে প্রিয়ও চুপ করে বসে আছে। মনে মনে কীসব প্লান করে বেরিয়েছে অথচ এই হারামজাদা আইমানের যন্ত্রণায় সব বৃষ্টির পানির মতো পানি পানি হয়ে গেল।

    পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত এগারোটা। যেখানে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ দেড় কি দুই ঘন্টা লাগে অন্যদিন, সেখানে আজ লেগেছে টানা সাড়ে চারঘণ্টা। রাস্তায় যে জ্যাম তাতে আবার যদি বাসাতে ব্যাক করতে চায় তবে আজ বাসায় ফিরতে ভোর রাত হয়ে যাবে। তাছাড়া যে মুষলধারে ঝড় বৃষ্টি চলছে তাতে গাড়িই ডুবে যাবে কিনা সন্দেহ।

    কিছুটা ফ্রেশ হবার পরে মিথিলা বলল, এখন আর তবে ফেরার দরকার নেই। কাল সকালে একসাথে স্কুলের কাজটা শেষ করে তবে ফিরি। রূম্পা মাকে আমি জানিয়ে দিয়েছি। সে বলেছে সমস্যা নেই। সেও কালই যেতে বলছে।

    প্রিয় কোনো কথা বলছে না দেখে আবার বলল, চলো ! মামার বাসাতে থাকবে তুমি।
    রাতের খাওয়ারও তো দরকার আছে। আমি এতদিন বাসায় ছিলাম না। বাজার সদাইও নেই কিছু ঘরে। দেখি আইমান কী রেখে গেছে। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে যাও সকালে দেখা হবে।

    – তোমার ওই ন্যাকা আইমানের প্রসাদ তুমি খাও। আমি খাচ্ছি না।

    – আচ্ছা , না খাও না খেলে। চলো মামী কী করেছে দেখি। সেটাই খেও। মিথিলাও মেজাজ দেখিয়ে বলল।

    – নেভার! ও বাসাতে আমি যাব না। ইভেন তাদের কাছে আমার কথা তুমি বলবেও না।

    – তবে? থাকবে কই খাবে কী? না খেয়ে থাকবে?

    – একবেলা না খেলে মানুষ মরে যায় না। আর থাকব কই মানে? এ বাসাতে তোমার বেডরুম ছাড়া আর রুম নেই?

    মিথিলা ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলল, না … মানে! আমি এখানে পুরো পাসাতে একা থাকছি সেখানে তোমার থাকাটা কী তোমার জন্য ঠিক হবে? পরে তোমার বউ জানলে যদি কোনো অশান্তি হয় তোমার সংসারে?

    – আমার বউয়ের কথা ভেবেই বললে নাকি তোমার ভয় হচ্ছে আমাকে? সোজা করে সেটা বললেই তো পারো! এতো ন্যাকামির কী দরকার! আমি খেয়ে ফেলব না তোমাকে । ভয় নেই। বাঁকা স্বরে কথাগুলি বলল, প্রিয়।

    – উফ! এত ত্যাড়া করে কথা বলতে পারো তুমি! আচ্ছা , আচ্ছা! এখানেই থেকো। আমি রুম রেডি করে দিচ্ছি। তোমার ভালোর জন্যই বলেছিলাম। আমার কী! আমি রুম রেডি করে ওপরে যাচ্ছি। খাবার নিয়ে আসি।

    – ও বাসাতে ঢোল পিটানোর দরকার নেই যে আমি এসেছি। তাহলে এখন আবার এই রাত দুপুরে আপ্যায়নের হিড়িক পড়ে যাবে যেটা আমার একদমই পছন্দ না।

    – আচ্ছা, আচ্ছা । বলবো না। আচ্ছা, একটা কথা বলোতো তুমি মামা মামীকে সহ্য করতে পারো না কেন ! তোমার তো কপাল ভালো । কত কদর তোমার। অথচ আমরা চাইলেও কোনোদিন পাইনি।

    – এ জন্যই আমার ওনাদের পছন্দ না। তেলা মাথায় তেল দেয় যারা আই হেট দেম। যখন তোমার আর মেহরাবের পাশে তাদের থাকার দরকার ছিল তখন বুক পেতে না দিয়ে তোমাদের পিছন দেখিয়েছে। তেমন মামা মামীর সাথে রিলেশান রাখার ইচ্ছে বা রুচি কোনোটাই আমার নেই। হাই হ্যালো রিলাশান পর্যন্তই এনাফ ফর মি।

    – বুঝেছি। আচ্ছা বলব না তবে। তুমি আবার শুয়ে পড়ো না । আমি যাব আর আসব।

    – ওকে!

    চলবে…

    পর্ব-৪৭

    https://www.facebook.com/111576077291737/posts/400975231685152/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here