সুখের_সন্ধানে পর্ব_৪৮

0
784

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৪৯

মিথিলা ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল প্রিয় সোফায় বসে টি টেবিলের উপর পা তুলে টিভি দেখছে আবার মোবাইল ঘাটাঘাটি করছে। শুধুমাত্র একটা শর্ট প্যান্ট পরা, গায়ে কোনো জামা বা গেঞ্জি কিছুই নেই প্রিয়র। তার ধবধবে সাদা শরীরের দিকে চোখ পড়তেই মিথিলা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। এভাবে সে কখনো প্রিয়কে দেখেনি আগে। প্রিয় মিথিলাকে দেখে একটু নড়েচড়ে বসল। সে মিথিলার চোখ দেখে বুঝতে পারল ব্যাপারটা। একটু এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা তোয়ালে পেয়ে সেটিকে শরীরে ওপর প্যাঁচাল ।

মিথিলা ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে প্রিয়কে ডাক দিতেই প্রিয় বলল, আমি বলেছি তো তোমার ওই আইমানের আনা কোনো খাবার আমি খাব না। তবে আবার ডাকছ কেন?

– আরে আসোই না! কী এক ঝামেলা! খাবারে কি কারো নাম লেখা থাকে? আসো তো!

– বললাম তো খাব না। বেশি জোরাজুরি করলে তোমাকেও খেতে দিব না কিন্তু।

– তবে কি না খেয়ে থাকবে? আচ্ছা, এক কাজ করি। বাসায় পাস্তা আছে। বেক করে দেই । তুমি তো আবার বেশি করে চীজ দিয়ে বেকড পাস্তা পছন্দ করো। অবশ্য কোনো ভেজিটেবলস নেই। অনলি চিকেন! চলবে?

– তুমি নিজের হাতে করে দিলে মন্দ হয় না। আমিও হেল্প করতে পারি।

– তাই নাকি! তুমি আবার কিচেনের কাজ শিখলে কবে?

– আরো কত কিছু শিখেছি । ধীরে ধীরে সবই দেখবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ। বলেই প্রিয় সোফা থেকে উঠে মিথিলার পাশে এসে দাঁড়াল ।

প্রিয়র অর্ধ উলঙ্গ গেট আপে এমনিতেই মিথিলা বেশ অস্বস্তিতে ভুগছে তার উপর আবার কিচেনে ওর পিছু পিছু ঘুরছে এটা সেটা করার বাহানায়। টেবিলের উপর এত এত খাবার থাকার পরেও তাকে অন্য কিছু খেতে হবে। ওই খাবারগুলোতে কী দোষ সেটাই মাথায় আসছে না মিথিলার।

প্রিয় বেশ সুন্দর করে চিকেন স্লাইস করে দিচ্ছে মিথিলাকে। মিথিলা পাস্তা সেদ্ধ বসিয়ে টুকটাক কাজ দেখছে । আর প্রিয়ও সাথে সাথে পেয়াজ, মরিচ কেটে কুটে দিচ্ছে। প্রিয়র এত সুন্দর করে কাজ করতে দেখে মিথিলা বেশ অবাক। বিয়ের পরে যে মানুষ এতটা বদলে যায় তার জানা ছিল না।

প্রিয় টুকটাক করে কাজগুলি করছে আর গুনগুণ করে গান ধরেছে। মিথিলার রাগটা ধীরে ধীরে গায়েব হয়ে যেতে শুরু করেছে। তার বরং এখন ভালোই লাগছে। প্রিয় আইমানদের বাসার খাবার খেতে রাজী হলে বরং তার এই রূপটা দেখা মিস হয়ে যেত মিথিলার ! বাইরে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি আর সাথে টুকটাক গল্পের তালে সময়টুকু মন্দ কাটছে না তাদের ।

মিথিলাও আর আইমানদের বাসার কোনো খাবারে হাত দিলো না। পুরোটাই ধরে ফ্রীজে রেখে দিলো। প্রিয় যেহেতু খাবে না তাই তার খাওয়াটাও দেখতে খারাপ লাগবে। দু’জন মিলে বেশ মজা করে তাই শুধু পাস্তাই খেলো । আইমানদের বাসার খাবার না খাওয়ায় প্রিয় মনে মনে ভীষণ খুশি।

খাওয়া শেষে প্রিয় যেয়ে আবার সোফায় হেলান দিয়ে বসল।

– কী ব্যাপার , আবার বসলে যে! রাত কত হলো হিসেব আছে? চলো, ঘুমাতে যাবে।

– বাহ! একদম ঘরের কর্ত্রীর মতো একটা ডায়ালগ দিলে!

– মিথিলা খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল, তাই তো বলা উচিত। আমার ঘরে তো আমিই কর্ত্রী, তাই না!

– হুম! ঠিক বলেছ। আচ্ছা, বসো এখানে। আমার এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না । তাছাড়া হসপিটালে থেকে থেকে অভ্যাস আরো খারাপ হয়েছে। বসো , গল্প করি। বাইরে যে রোমান্টিক ওয়েদার , তাতে ঘুমিয়ে যাবার মতো আনরোমান্টিক মানুষ আমি না! অবশ্য তুমি হতে পারো!

– এমন বিধ্বংসী ওয়েদার তোমার কাছে রোমান্টিক লাগছে? বাহ! এই মুহূর্তে তোমার বউয়ের তোমার পাশে থাকা দরকার ছিল। তবেই জমত! দু’জনেই চরম রোমান্স করতে পারতে। আমি ভাই আনরোমান্টিক আছি সেই ভালো। আমার রোমান্টিকতা খরচের জায়গাও নেই , মনও নেই।

– জায়গা হতে কী আর সময় লাগে? সে তো মাত্র সময়ের অপেক্ষা!
আচ্ছা, একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলব। শোনার পরে রিয়্যাকশান দিবে। আগেই কিছু বলবে না।

-আচ্ছা, কী এমন কথা বলে ফেলো।!

– কথাটা আম্মু আব্বু কাউকে এখনই জানাতে চাচ্ছি না। আম্মু একটু স্টেবল হোক দেন জানাব। কিন্তু এভাবে চাপিয়ে রাখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাই মনে হচ্ছে আমার সবচাইতে কাছের বন্ধুর সাথে নিশ্চিন্তে শেয়ার করতে পারি আমি।

– মিথিলা খুব চিন্তিত হয়ে বলল, কী এমন হয়েছে ? কোনো অঘটন ঘটাওনি তো?

– প্রিয় খানিকটা থেমে এরপরে এক নিঃশ্বাসে বলল, এনার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে মাস ছয়েক আগে। নাউ আ’ম আ ফ্রী ম্যান।

কোনো ভূমিকা টুমিকা ছাড়াই হুট করে এমন একটা নিউজ শুনে মিথিলা নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সে ভাবছে সে হয়ত ভুলভাল কিছু শুনছে অথবা প্রিয় মজা করছে।

– এসব নিয়ে কেউ ফান করে, ভাইয়া?

– ইটস নট ফান । আ’ম সিরিয়াস! তুমি চাইলে আমি পেপার্সের ডিটেইলস দেখাতে পারি। ফোনে আছে সব।এতদিন ধরে বলব বলব করেও মাইন্ড সেট আপ করতে পারছিলাম না। তাছাড়া আম্মুর যে সিচুয়েশান তাতে এসব বলার প্রপার টাইমও পাইনি। কিন্তু তুমি বারবার ভাবী ভাবী করে আমার কান গরম করে দিচ্ছ তাই না বলে পারলাম না।

– মিথিলা যেন এমন একটা খবরে কিছুটা ধাক্কা খেলো। সে কোনোরকম করে আস্তে করে বলল, কবে ঘটিয়েছ এসব?

– বললাম তো , মাস ছয় তো পেরিয়েছে।

– এতদিনে আসোনি কেন তবে?

– আয়াতের জন্য। ওকে ছেড়ে আসতে মন সায় দেয়নি।

– এখন কী করে এলে?

– সে অনেক কাহিনী! পরে বলব। তবে নিজের মনকে অনেক কষ্টে বুঝিয়েছি। আয়াতকে ছেড়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। জানিনা কতদিন পারব এটা সহ্য করতে! তবুও জীবন তো থেমে থাকে না। একটা পালহীন নৌকার মতো চলেছি এতটা বছর। এখন একটু বাঁচতে চাই, নিজের মতো করে বাঁচতে চাই। অন্ততপক্ষে ওই জীবন থেকে দেরীতে হলেও মুক্তি যে পেয়েছি সেটাই আমার জন্য বড় পাওয়া।

মিথিলা আর কোনো কথা বলছে না। তার মাথায় আসছে না এই মুহূর্তে তার তাকে কী বলে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত। মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়ে গেল ।

– চুপচাপ হয়ে গেলে যে? কিছু বলছ না !

– কী বলব বলো! তবে এটা মনে হয় ঠিক হলো না। অন্ততপক্ষে বাচ্চাটার কথা ভাবতে! একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চা কতটা মেন্টাল ট্রমার মধ্যে বড় হয় সেই ভাবনাটা একবার ভাবা উচিত ছিল। আমি আর মেহরাব জানি এই কষ্ট কতটা ভয়ানক। আর কেউ এমন কষ্ট পাক আমি এটা কখনই চাই না। খুব ভুল করলে মনে হয়।

– আমার জায়গা থাকলে এটা বলতে না। আমি অনেক ভেবেই এতবছর সংসার টিকিয়ে রেখেছি। কিন্তু একতরফা চেষ্টায় আর কতদিন চলে বলো! ডিভোর্সটা সেই আমাকে দিয়েছে। আমি কোনো জোরাজুরি করিনি। সে যেটা চেয়েছে সেটাই করেছি মাত্র। আয়াতের কথা অনেক ভেবেছি। কিন্তু আমার বাচ্চাটার ভাগ্যই খারাপ। চেষ্টা তো কম করিনি। তবে আমি আজীবন চেষ্টা করব আমার ছেলেটার সর্বোচ্চ সুরক্ষিত একটা জীবন নিশ্চিত করতে। কারণ ওর মাঝেই আমার জীবনের অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই। বলতে বলতে কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়ল , প্রিয়।

– মিথিলা প্রসঙ্গ ঘোরাতে বলল, চা খাবে? নইলে কফি? রাত যখন জাগবে তখন খেলে মনে হয় মন্দ হতো না কিন্তু।

– চা খেতে পারি। লাল চা দিও।

– পুদিনা পাতা দেই চায়ের মধ্যে?

– হুম দিতে পারো, আদাও দিও।

মিথিলা চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে তাতে খানিকটা আদা কুচি যোগ করে দিয়ে বারান্দায় গেল পুদিনা পাতা ছিঁড়তে । তার বারান্দায় প্রচুর পরিমাণ পুদিনা পাতা হয়েছে। বারান্দার দরজা খুলতেই দেখল পানিতে বারান্দা প্রায় তলিয়ে গেছে। প্রচণ্ড বাতাস হচ্ছে আর তার সাথে বজ্রপাতের শব্দ। দু’দিন ধরেই নিম্নচাপের প্রভাব চলছে। আজ অবশ্য খুব বেশিই বৃষ্টি হচ্ছে। সে পাতা ছিঁড়ে মাত্র ফিরবে ঠিক তখনই একটা দমকা বাতাস আসায় গ্রীলের সাথে ঝুলানো একটা মাটির টব এত জোরে এসে তার পায়ের কাছে পড়ল যে সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল। বারান্দাটা লিভিং রুমের কাছেই হওয়ায় প্রিয় শব্দ শুনে ছুটে এল। বাইরের ভয়ানক শব্দ আর আচমকা এমন ঘটনায় মিথিলা ভয়ে একদম কুঁকড়ে গেছে। প্রিয় ছুটে এসে সামনে দাঁড়াতেই সে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল প্রিয়কে। প্রিয়ও তার বাহুবন্ধনে আঁকড়ে ধরল ভীতসন্ত্রস্ত মিথিলাকে। সে তাকে অভয় দিতে লাগল। মিথিলা এত ভয়ে পেয়েছে যে কোনো হুঁশ নেই সে কোথায় আছে!

প্রিয় তাকে আরো শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরেছে। তার মনে হচ্ছে এভাবেই কেটে যাক আদি অনাদিকাল। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর বারান্দার নিকষ কালো অন্ধকারে বাহুবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে একজোড়া তৃষ্ণার্ত হৃদয়।
এভাবে কতসময় কেটে গেল কারো হুঁশ নেই। মিথিলাকে আস্তে করে বলল, এই সাহস নিয়ে একা থাকছেন, ম্যাডাম! আমি না থাকলে তো আজ এখানেই পড়ে থাকতেন। ওটা মাটির টব ছিল। কোনো বাঘ ভালুক না। চেয়ে দেখেন একবার! ভাগ্য ভালো যে পায়ের ওপর পড়েনি। তবে তো খবর ছিল।

মিথিলার হুঁশ ফিরল। সে তড়িঘড়ি করে নিজেকে প্রিয়র বাহু থেকে মুক্ত করল। লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল সে। প্রিয় যেন এখনো সেই আবেশ থেকে বের হতে পারছে না, তার শুধু মনে হচ্ছে কী এমন হতো যদি আরেকটু বেশিই কিছু হয়ে যেত! মিথিলাকে বুকের সাথে আগলে রাখার এই সুখের মুহূর্তটুকু তাকে খুব বেশি স্বার্থপর আর লোভী করে দিলো যেন। সে যেকোনো মূল্যে মিথিলাকে চায় তার জীবনে। আজই সে কথা বলবে। ভাগ্য তাদেরকে আরেকবার সুযোগ দিয়েছে । এটা এবার সে আগের মতো কোনোমতেই হেলায় হারাতে চায় না।

মিথিলা রান্নাঘরে যেয়ে চা বানানো শেষ করার পরেও লজ্জায় আর প্রিয়র সামনে যেতে পারছে না । ইস, কী একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো! কী করে সে সামনে যেয়ে দাঁড়াবে প্রিয়র? এমনটা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয় মিথিলার মনের খবর টের পেয়ে নিজেই এগিয়ে এলো। সে গুটিগুটি পায়ে কিচেনে এসে চায়ের ট্রেটা এক হাতে আর অন্যহাতে মিথিলার হাত ধরে টেনে সোফায় নিয়ে বসাল।

মিথিলা এবার যেন লজ্জায় মিশে যাচ্ছে। প্রিয়র দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না একদমই। প্রিয় হাটুগেড়ে মিথিলার সামনে মেঝেতে বসে পড়ল। সে মিথিলার মুখখানা এক হাতে তুলে ধরে বলল,

– জীবন আমাদের আরেকবার সুযোগ দিয়েছে। আবার আমি তোমাকে হারাতে চাই না , মিথিলা। আই লাভ ইউ! লাভ ইউ সো মাচ! আমি আমার এই ভবঘুরে জীবনটাকে তোমার হাতে সঁপে নিশ্চিন্ত হতে চাই । আমাকে একটু ঠাই দিবে কি ? বলতে বলতে প্রায় কেঁদেই ফেলল , প্রিয়।

মিথিলা তো পুরাই হতভম্ব! এসব কী বলছে? মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে যায়নি তো! হুট করে এসব কী কথা বলছে নিজেই কী বুঝতে পারছে?

– ভাইয়া, ঠিক আছো, তুমি? আমার মনে হয় তোমার একটু রেস্ট দরকার! আমি উঠছি । এটা বলে মিথিলা উঠতে যাচ্ছে অমনি খপ করে প্রিয় তাকে তার বাহুর শক্তিতে আগলে ধরে। মিথিলা ভয়ে কেঁপে ওঠে। সে ভয়ার্ত চোখে প্রিয়র চোখের দিকে তাকিয়ে আরো ভয় পেয়ে যায়। প্রিয়র চোখদু’টি টকটোকে লাল। এমন রক্তবর্ণ চক্ষু সে আগে কখনো দেখেনি। চোখের মাঝে হাজার প্রশ্ন আর চাওয়া পাওয়া যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। মিথিলা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। ঘরে সে আর প্রিয় ছাড়া এই মুহূর্তে কেউ নেই। প্রিয় একটা ছেলে মানুষ । তার উপর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় কী থেকে কী করে বসবে ঠিক ঠিকানা নেই। সে প্রিয়কে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে আসতে আসতে যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়? তাই অযথা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে শরীরের সব শক্তি খরচ করে বন্ধনমুক্ত হবার চেষ্টা চালাতে লাগল। প্রিয়র চোখের ভাষায় সে যেন ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। নিজেই বুঝতে পারছে না হুট করে কী এমন হলো যে প্রিয়র রূপ এভাবে বদলে গেল। আগেও কত সে আর প্রিয় একসাথে এক ছাদের নিচে রাত কাটিয়েছে কিন্তু এতটা ভয় সে কোনোদিনই পায়নি তাকে! আজ যেন সে অন্য প্রিয়কে দেখছে। সে বুঝতে পারল প্রিয়র মনের মাঝে এখনো পর্যন্ত তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। তখন বারান্দায় ওভাবে জাপটে ধরাটাই আসলে কাল হয়েছে। প্রিয়র এতদিনের অতৃপ্ত কামনার আগুন ওকে ঝলসে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সে হয়ত না চাইতেই এসব করে ফেলছে। কেন যেন প্রিয়কে অপরাধী ভাবতে মন সায় দিচ্ছে না মিথিলার। তবে কী সেও দুর্বল এখনো প্রিয়র ওপর? কিন্তু যাই হোক না কেন এভাবে এসবের মানে কী? প্রিয়র চাহনি , ছোঁয়া কোনোটাই স্বাভাবিক লাগছে না মিথিলার কাছে। হুট করে এমন সাত পাঁচ ভাবনার মাঝেই মিথিলা অনুভব করল প্রিয়র গরম নিঃশ্বাসে তার মুখমণ্ডল যেন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সে কিছু বুঝে ওঠবার আগেই বুঝতে পারল তার ঠোঁটজোড়া বেদখল হয়ে গেছে ততক্ষণে।

প্রিয় তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে তার দু’বাহুতে। এমন বলিষ্ঠ একজন পুরুষের পুরুষালী শক্তির কাছে সে পারবে কেন? হঠাৎ তার মনে হলো তার মন আর শরীরও যেন তার সাথে বেঈমানী শুরু করেছে। প্রিয়র ভারী নিঃশ্বাসের তালের সাথে তাল মেলাতে চাইছে তার অক্সিজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইডের আসা আর যাওয়া। এত দিনের তপ্ত মরুর বুকে যেন এক পশলা ঢেউ খেলা করছে। সে নিজেকে প্রায় হারিয়ে ফেলছে প্রিয় নামের সেই অতি কাঙ্ক্ষিত মানুষটির ছোঁয়ায় । প্রিয়র পৌরুষ্যের কাছে পুরোপুরি হারিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে তার ব্রেইন তাকে সিগন্যাল দিলো, কী করছিস তুই? এই পাপের বোঝা কাঁধে নিয়ে এক পাও সামনে এগুতে পারবি তুই? এই তোর এথিকস?

মিথিলার হঠাৎ কোথা থেকে এত শক্তি এলো সে নিজেও জানে না। মানসিক আর শারীরিক দুই শক্তিকে এক করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে। স্বর্গসুখে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়কে টেনে তোলার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে কিন্তু পেরে উঠছে কই। বেদখল হয়ে যাওয়া মনটাকে টেনে বের করতে পারলেও ঠোঁটজোড়ার দখল এখনো প্রিয়র কাছে। পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করার আগ মুহূর্তে কী হলো সে নিজেও জানে না। নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডান হাতটা এগিয়ে প্রিয়র বুকে বেশ জোরে খামচি মারল যাতে ওর হাত থেকে মুক্তি পায়। প্রিয় ব্যাথায় কুঁকড়ে যেয়ে একটু সরে দাঁড়ালেই মিথিলা অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ওর ডান গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।

প্রিয় তো অবাক! সে যেন ঘোরের মধ্যে আছে। কী করছে আর কী হচ্ছে নিজে এতক্ষণে টের পেল।

মিথিলার চোখ থেকে ঘৃণা যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। মিথিলা কোনোরকম অস্ফুটস্বরে বলল, ছিঃ! দ্রুত সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হতেই প্রিয় আবার খপ করে মিথিলার ডান হাতটা চেপে ধরল।

– আ’ম সো সরি! আ’ম সো সরি! আমি আসলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। কী যে হলো! প্লিজ, আমার কথা শোনো।

– আর কী শোনাবে , ভাইয়া। তুমি মনে হচ্ছে কোনো অন্য জগতের মধ্যে আছ। প্লিজ! হাত ছাড়ো। তেজের সাথে বলল সে!

কিছুতেই যখন সে মিথিলাকে শান্ত করতে পারছিল না তখন বলল, কী করেছি আমি? ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেতে চেয়েছি। এটা কী অন্যায় করে ফেলেছি?

– এই তোমার ভালোবাসার নমুনা? ছিঃ ! হাত ছাড়ো নইলে খারাপ হয়ে যাবে!

– অন্য কোনভাবের জন্য অপেক্ষা করতাম আমি? আগেরবার যেমন সাজিদের হাত ধরে আমার সামনে থেকে চলে গিয়েছিলে ঠিক তেমনি এবারও আইমানের ঘরের ঘরনি হয়ে যাবার পর পর্যন্ত। আমার মন যেটা করতে বলেছে আমি সেটাই করেছি। বিকজ আই লাভ ইউ! এটা কবে থেকে সেটাও আমিও যেমন জানি তেমনি তুমিও। তোমার জন্য একটা দিন একটা রাত আমি স্বাভাবিকভাবে সংসার করতে পারিনি এনার সাথে। আমার মনজুড়ে একজনকে রেখে অন্য জনের সাথে সংসার হয় না। আমি পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। আজ আমি তাই কিছুতেই তোমাকে পেয়েও আর হারাতে চাই না। লিগ্যাল ওয়েতে হোক আর ইলিগ্যাল! আমি তোমাকে চাইই চাই। এখানে আর কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। চিৎকার করে বলে উঠল, প্রিয়।

– আমি আইমানকে বিয়ে করছি তোমাকে কে বলল? তেজের সাথেই বলল, মিথিলা।

– আমি বললাম। আমি কি কিছু বুঝি না? আমি সবই বুঝি। আবার আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে এটা আমি একদমই এক্সেপ্ট করব না। নেভার এভার। ইউ আর মাইন, এন্ড অনলি মাইন।

প্রিয়র কথাবার্তা কেমন অপ্রকৃতস্থ লাগছে। সে স্বাভাবিক যে নেই এটা মিথিলা শিওর। এই প্রিয়কে সে চেনে না। খুব ঘাবড়ে গেল এই পরিস্থিতি থেকে বের না হতে পারার জন্য ।

– ওহ! এজন্যই তুমি তোমার ডিভোর্সের মনগড়া কাহিণী বানিয়েছ তবে? আমার সাথে এসব করতে , ছিহ! আমি ভাবতে পারছি না। বিদেশে থেকে থেকে এত অধঃপতন তোমার?

এক ঝটকা দিয়ে সে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি আমার রুমে যাচ্ছি। সকালবেলা উঠে তোমার মুখ দেখতে চাই না।

প্রিয়কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে ছুটতে ছুটতে রুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো। প্রিয় কী করবে বুঝতে পারছে না। কীসব করে বসল সে ঝোঁকের বশে? এমন পাগলামীর মানে হয়? মিথিলাকে কাছে পেতে যেয়ে দূরে ঠেলে দিলো এভাবে? উহ!

সে দ্রুত মিথিলার দরজার সামনে যেয়ে দরজা নক করছে আর বলছে, আ’ম সো সরি! মিথিলা , তুমি যা ভাবছ এমন কিছুই না। প্লিজ, দরজা খোলো! শুধু একবার শোনো, আমি কোনো নাটক করিনি, এক বর্ণ মিথ্যেও বলিনি। আমার প্রতিটি কথা সত্যি। প্লিজ, একবার শোনো!
আমি গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না। আমার পাগলামী তো তুমি নতুন দেখছ না, আমি স্বীকার করছি , আমি ভুল করেছি। আমি অন্যায় করেছি তোমার সাথে। আমার মাঝের পশুত্বকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল নিজেই জানি না। প্লিজ, আমাকে ভুল বোঝ না। আমাকে যে শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নিবো। আমার কথা শোনো। প্লিইইজ!

– আমি তো বলেছি, এখানে আর বোঝাবুঝির কিছু নেই। আমার তোমার চেহারা দেখার বা তোমার সাথে কথা বলার রুচি নেই। তুমি প্লিজ, সকাল হতেই এখান থেকে চলে যাও। প্লিজ! আমাকে মুক্তি দাও। আর জ্বলতে চাই না আমি নতুন করে। সেই পুরানো ক্ষত শুকিয়ে গেছে। আর নতুন করে ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে তাজা করার শক্তি আমার নেই । প্লিইইইজ!

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মিথিলা।

চলবে…

পর্ব- ৪৮

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/402212771561398/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here