সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-৮

0
1112

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৮

দুদিন পর আজ এরেন ভার্সিটিতে এসেছে। এই দুদিন মূলত সে ইচ্ছে করেই ভার্সিটিতে আসেনি। সে চেয়েছিল নিজের মনকে শক্ত করতে। ঐ মেয়েটার সামনে আর পড়তে চায় না সে। সেজন্যই এই দুদিন ভার্সিটির আশেপাশেও পা রাখেনি। কিন্তু এভাবে তো আর চলা যায় না। ভার্সিটিতে তো আসতেই হবে। মনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আজ চলেই এসেছে। কিন্তু বেপরোয়া চোখ কি আর মনের কথা শোনে? সে তো মনের বিরুদ্ধে গিয়ে এদিক-ওদিক বিচরণ করে চলেছে সেই মুখটার খোঁজে। মন বলছে,‘তার সামনে যেন না পড়ি।’ আর চোখ বলছে,‘সে কোথায়?’ তার নিজের চোখই মনের কথা শুনছে না। আশ্চর্য! এরেনের ভাবনায় ছেদ পড়ল রনির ধাক্কায়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল এরেন। রেগেমেগে তাকাতেই দেখল রনি চোখেমুখে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরেন রাগত স্বরে বলল,“সমস্যা কী তোর? ধাক্কা মারলি কেন?”

রনি প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করল,“তোর মন কই?”

প্রশ্ন শুনে এরেন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। রনি আবার বলল,“আমি যে এত কথা বলছি তুই কিছু শুনছস?” সত্যি করে বল তো।”

এরেন গলা ঝেড়ে আমতা-আমতা করে বলল,“খেয়াল ছিল না।”

“সেটাই তো জানতে চাইছি। খেয়ালটা ছিল কোথায়? এই, প্রেমে পড়লি না-কি কারো?”

এরেন চোখমুখ কুঁচকে বলল,“হোয়াট! আর ইউ ম্যাড?”

“নো। প্রেমে পড়তেই পারিস। ফার্স্ট ইয়ারে কত সুন্দরী মেয়েরা ভর্তি হয়েছে সেজন্যই বললাম।”

“ওসব আমার কর্ম নয়।”

“জানি‌‌। তবু, সারাজীবন কি আর সিঙ্গেল থাকবি না-কি? এত সুন্দরী মেয়েদের কাউকেই কি চোখে পড়ে না তোর?”

“চোখে পড়বে না কেন? আমি কি অন্ধ? মূলত আমি সেভাবে কাউকে দেখতেই চাই না। সেজন্য কারো প্রেমেও পড়ি না।”

“দুদিন পর লেখাপড়া শেষ করে চাকরি-বাকরি করবি। এবার অন্তত চেঞ্জ কর নিজেকে। এরপর দেখবি খুব দ্রুতই বুড়ো হয়ে গেছিস।”

কথাটা বলেই রনি শব্দ করে হেসে উঠল। এরেন ধমক দিয়ে বলল,“চুপ কর। আর একটাও ফালতু কথা বলবি না। চল ওদিকটায় গিয়ে বসি।”

“আরে রেগে যাচ্ছিস কেন? সত্যি কথা বললেই রাগ উঠে যায় তাই না?”

রনির কথা কানে না নিয়ে এরেন সোজা হাঁটা শুরু করল। অগত্যা রনিও তার পেছন পেছন চলল।


ক্লাস থেকে বেরিয়ে ইলোরা সব বন্ধুদের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। অরিশা হঠাৎ বলল,“এই চল না একটু লাইব্রেরিতে যাই।”

অরিশার প্রস্তাবে কেউ রাজি হলো না। অরিশার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। ইলোরা হঠাৎ বলল,“আচ্ছা চল আমি যাচ্ছি।”

অরিশা খুশি হয়ে বলল,“যাবি? চল চল।”

তাহসিন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,“যাচ্ছিস যা। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।”

ইলোরা আর অরিশা সম্মতি জানিয়ে লাইব্রেরির দিকে চলে গেল। ওরা চলে যেতেই অন্তর গলা ঝেড়ে বলল,“নাদিয়া, শোক পালন ভালোভাবে শেষ হয়েছে?”

নাদিয়া গম্ভীর মুখে বলল,“মজা নিচ্ছিস?”

“আরে আজব! মজা নিলাম কখন? আমি তো জাস্ট জিজ্ঞেস করলাম।”

“না, তুই যে মজা নিচ্ছিস সেটা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। তুইও তো টুম্পার পেছনে দুই বছর ধরে পড়ে আছিস। আমি কি এটা নিয়ে কখনও মজা করেছি?”

টুম্পা বলে উঠল,“স্ট্রেন্জ! এর মধ্যে আবার আমাকে টানছিস কেন?”

অন্তর হালকা হেসে বলল,“নাদিয়া, দুবছর ধরে টুম্পার পেছনে ঘুরেও আমি কিন্তু বারবার ওকে প্রপোজ করিনি। তুই মাত্র একবছরে তাহসিনকে যতবার প্রপোজ করেছিস আমি তার অর্ধেকও করিনি। আমি ওকে আমার মনের কথা জানিয়ে দিয়েছি আর ওর উত্তরও শুনেছি। রিজেক্ট হয়েও আমি ওকে বলেছি যে আমি ওর পজিটিভ রেসপন্সের জন্য অপেক্ষা করব।”

টুম্পা মুখ গম্ভীর করে বলল,“দয়া করে এসব আলোচনা বন্ধ কর প্লিজ। এসব শুনতে চাই না আমি।”

মুনা হঠাৎ মুচকি হেসে বলে উঠল,“তাহসিন, আমি কিন্তু নতুন কাহিনির জন্য অপেক্ষা করছি।”

তাহসিন বুঝতে না পেরে বলল,“মানে? কিসের কাহিনি?”

“গতকাল তো ক্লাসে আমি কিছু একটা দেখেছিলাম, তার কথাই বলছি।”

তাহসিন বুঝে গেল মুনা কী বলতে চাইছে। ডালিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,“কাহিনির কী দেখলি?”

তাহসিন তড়িঘড়ি করে বলল,“আরে ধুর! এই মুলার কথায় কান দিস না তো ডালিয়া। ফালতু বকবক ছাড়া আর কোনো কাজ নাই ওর।”

মুনা চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,“সত্য কথা তো ফালতুই মনে হয়।”

অন্তর বলে উঠল,“ওরে আমাদের সত্যবাদী মুলা রে। তুই থাম বইন।”

মুনা অন্তরের বাঁ হাতের বাহুতে থাপ্পড় মেরে বলল,“আমি দুইটা কথা বললেই থাম। আর ওরা যে এতক্ষণ কত কথা বলল তার বেলায়?”

অন্তর নিজের ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের বাহু ঘষতে ঘষতে মুখ ফুলিয়ে বলল,“দজ্জাল মাইয়া! কথায় কথায় এত হাত চলে কেন তোর? তা-ও আবার শুধু আমার বেলায়। অন্য কারো দিকে তো হাত যায় না। ঘুরেফিরে আমার দিকেই আসে।”

ডালিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,“থাম না তোরা।”

নাদিয়া ডালিয়ার হাত ধরে টেনে অন্যদিকে হাঁটা দিয়ে বলল,“এরা জীবনেও থামবে না। এদের এই ক্যাঁচক্যাঁচ আজীবন চলবে। চল এখান থেকে।”


লাইব্রেরির সামনে যেতেই ইলোরা আর অরিশা পড়ে গেল ফ্যাসাদে। অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল একদল ছেলেমেয়ে। তাদের দেখেই একটা ছেলে ডেকে উঠল,“এই পিচ্চি, এদিকে এসো।”

ইলোরা আর অরিশা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ডাক শুনে বুঝতে পারল তাদের মধ্যে একজনকে ডাকছে। কিন্তু কাকে ডাকছে তা তারা দুজনের কেউই বুঝতে পারল না। দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ইলোরা চাপা স্বরে বলল,“এই অরি, এরা আবার কারা? কাকে ডাকছে?”

অরিশাও মিনমিনে গলায় উত্তর দিলো,“এরা মনে হয় ভার্সিটির সিনিয়র। কাকে ডাকছে তা তো আমিও বুঝতে পারছি না।”

ওদের ফিসফিস করতে দেখে আরেকটা ছেলে বলে উঠল,“কী হলো? ডাক শুনতে পাওনি?”

অরিশা সাহস জুগিয়ে বলল,“শুনতে পেয়েছি ভাইয়া। কিন্তু কাকে ডাকছেন তা বুঝতে পারছি না।”

“তোমার পাশের মেয়েটাকে ডাকছি। ওকে এদিকে আসতে বলো।”

ইলোরা চমকে উঠল। দুহাত দিয়ে অরিশার এক হাত চেপে ধরে বলল,“তুইও চল আমার সাথে।”

ইলোরার সাথে অরিশাও পা বাড়াতেই একটা মেয়ে অরিশাকে ধমক দিয়ে বলল,“এই মেয়ে, তোমাকে কে ডেকেছে? চুপচাপ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকো।”

অরিশা দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখ ফুলিয়ে ইলোরাকে বলল,“যা।”

ইলোরা ভয়ে ভয়ে এক’পা দু’পা ফেলে এগিয়ে গেল। জড়োসড়ো হয়ে সামনে দাঁড়াতেই একটা ছেলে বলল,“পিচ্চি, নাম কী তোমার?”

ইলোরা কিছুটা অবাক হলো। তাকে দেখে কি পিচ্চি মনে হয় না-কি? এদের চোখে সমস্যা আছে হয়তো। সে ছোটো করে জবাব দিলো,“ইলোরা জাহান।”

ছেলেটা আবার বলল,“বেশ ভালো নাম। তো আমাদের চেনো?”

ইলোরা ডানে বায়ে মাথা দোলালো। ছেলেটা হেসে বলল,“আমরা তোমাদের সিনিয়র। সিনিয়রদের রেসপেক্ট করতে হয় জানো তো? তাদের সব কথাও শুনতে হয়।”

ইলোরা কোনো উত্তর দিলো না। সে খেয়াল করল একটা মেয়ে কাগজে কিছু একটা লিখছে। লেখা শেষ করে মেয়েটা সামনের ছেলেটার হাতে কাগজটা এগিয়ে ধরল। কাগজটা হাতে নিয়ে ছেলেটা তাতে চোখ বুলিয়ে বাঁকা হাসল। ইলোরা তাদের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারল না। ছেলেটা সেই কাগজটা কয়েকটা ভাঁজ দিয়ে ইলোরার দিকে এগিয়ে ধরল। ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা বুঝতে পেরে হাসিমুখে বলল,“এটা নাও।”

ইলোরা হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল। কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখে নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,“এটা দিয়ে কী করব ভাইয়া?”

অপরপাশ থেকে অন্য একটা মেয়ে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে বলল,“ঐ যে দেখছো দুজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে? ওদের কাছে গিয়ে স্কাই-ব্লু কালার শার্ট পড়া ছেলেটাকে এই কাগজটা দিবে।”

ইলোরা মেয়েটার আঙুলের ইশারা অনুসরণ করে সেদিকে তাকিয়ে দেখল কিছুটা দূরে দুজন ছেলে বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুহুর্তেই ইলোরা বেশ ভালো করে বুঝতে পারল সে র্যাগিং এর শিকার হয়েছে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। একটা ঢোক গিলে বলল,“কিন্তু আপু, আমি কেন দিব? আপনাদের দরকার হলে আপনারাই তো দিতে পারেন।”

সামনের ছেলেটা ধমকে উঠে বলল,“সিনিয়রদের মুখে মুখে কথা বলো। সাহস তো কম না তোমার। পিচ্চি পিচ্চির মতো থাকো। চুপচাপ যা বলছি তা করো। কথা বাড়াবে তো তোমারই বিপদে পড়তে হবে।”

ইলোরা চমকে উঠল। আর কথা না বাড়িয়ে এরা যা বলছে তা করাটাই সমীচিন মনে করল। অরিশার দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ থেকে আরেকটা ছেলে কড়া গলায় বলল,“কী হলো? এখনও দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও।”

ইলোরা মাথা দুলিয়ে উল্টো দিকে পা বাড়াল। ভয়ে তার হাত পা মৃদু কাঁপছে। বুকের মধ্যে ধকধক করছে। অসহায় মুখে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ছেলে দুটোর ঠিক পেছনে দাঁড়াল। শুনতে পেল তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এই কাগজটা দিতে হলে তো তাদেরকে আগে ডাকতে হবে। কিন্তু তার তো সাহসই হচ্ছে না। ভয়ে ভয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল সিনিয়র গুলো অধীর আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তাকাতেই সামনের ছেলেটা ইশারায় বলল কাগজটা তাড়াতাড়ি দিতে। তবু সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল এই আশায় যে যদি ছেলে দুটো পেছন ফিরে তাকায় আর তাকে দেখে। কিন্তু তা আর হলো না। ছেলে দুটো নিজেদের মধ্যে কথা বলেই চলেছে। কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকার পর আর কোনো উপায় না পেয়ে সে গলা ঝেড়ে মৃদু কন্ঠে ডাকল,“এক্সকিউজ মি ভাইয়া?”

তার ডাক শুনে ছেলে দুটো পেছন ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে ইলোরা থমকে গেল। সামনে দাঁড়ানো স্কাই-ব্লু কালার শার্ট পড়া ছেলেটারও তার মতো অবস্থা হলো। দুজনেই ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কারো মুখ দিয়েই কোনো কথা বেরোচ্ছে না। দুজনের মন একই কথা বলছে,‘এত চাইলাম আর যেন সামনে না পড়ে। লাভ কী হলো? সেই তো আবার সামনে পড়েই গেল।’ দুজনের ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে পাশ থেকে রনি বলে উঠল,“আরে ইলোরা। কেমন আছো?”

ইলোরা মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল,“ভালো আছি ভাইয়া। তুমি কেমন আছো?”

রনি জবাব দিলো,“ভালো আছি। কী ব্যাপার? সাকিবকে খুঁজছো না-কি?”

ইলোরা বলল,“না ভাইয়া।”

রনি আবার প্রশ্ন করল,“তাহলে?”

ইলোরা কী বলবে? এরেন প্রশ্নভরা চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কাগজটা তো এরেনকেই দেয়ার কথা। কিন্তু সে কীভাবে দেবে? সে তো এই ছেলের সামনেই পড়তে চায়নি। এখন যদি এই কাগজটা দেয় কী হবে আল্লাহ্ জানে। আচ্ছা এই কাগজটায় যদি উল্টাপাল্টা কিছু লেখা থাকে তাহলে? তাহলে তো এরেন আর রনির সামনে লজ্জায় তার মাথা কাটা যাবে। আর যদি ভাই জানতে পারে তখন কী হবে? সিনিয়ররা যখন লিখেছে তখন তো অবশ্যই উল্টাপাল্টা কিছুই লিখেছে। র্যাগ বলে কথা। ধুর তাকেই কেন র্যাগিং এর শিকার হতে হলো। পাশে তো অরিশাও ছিল। এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে জানলে তো সে আজ ভার্সিটিতেই আসতো না। সে এখন কী করবে? কথা ঘুরিয়ে কাগজটা কি ফেলে দিবে? কিন্তু ওই সিনিয়ররা যদি সত্যি সত্যিই তাকে বিপদে ফেলে দেয় তাহলে? এসব ছেলেদের দিয়ে বিশ্বাস নেই। কখন কী বিপদে ফেলে দেয় তা কে বলতে পারে? জেনেবুঝে এমন ভুল করা যাবে না। যা হবার হবে, তা পরে দেখা যাবে। আপাতত অনিশ্চিত বিপদ থেকে তো রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু এরেনকে এই কাগজটা দিবে কীভাবে সে? ইলোরার চোখ দুটো এবার ছলছল করে উঠল। মনে মনে আল্লাহ্কে ডাকতে শুরু করল। সে ঘনঘন শুকনো ঢোক গিলে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগল। তার এমন অবস্থা দেখে রনি আর এরেন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এতক্ষণে এরেন মুখ খুলে বলল,“কোনো সমস্যা হয়েছে? তোমার মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। কী হয়েছে বলো আমাদের।”

রনি বলল,“হ্যাঁ ইলোরা। কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে আমাদের বলো। সাকিব নেই তো কী হয়েছে? আমাকে কি ভাই মনে হয় না?”

ইলোরা আমতা-আমতা করে বলল,“এসব কী বলছো ভাইয়া? তুমি তো জানো আমি তোমাকে ভাইয়ের মতোই মনে করি।”

“তাহলে বলো কী হয়েছে।”

এরেন ইলোরাকে নিরীক্ষণ করে বলল,“আমার মনে হয় তুমি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছ। ভয় পেও না। আমরা তো আছি। বলো আমাদের কাছে।”

ইলোরা এবার কিছুটা সাহস পেল। হাতের কাগজটা এরেনের দিকে এগিয়ে ধরতেই এরেন কিছুটা অবাক হলো। আরো অবাক হলো ইলোরার হাতের কম্পন দেখে। রনিও অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। এরেন বিস্ময় নিয়েই হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল। ইলোরা হাত নামিয়ে দুহাত কচলাতে শুরু করল। উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। কী লেখা আছে কাগজটায় এই প্রশ্নই মাথায় ঘুরছে। ইলোরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবার এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগল। এরেন একবার কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখেই দ্রুত হাতে ভাঁজ খুলে ফেলল। কাগজটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরতেই সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কাগজটার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরক্ষণেই কাগজের থেকে দৃষ্টি সরে তা ইলোরার বিচলিত মুখে নিবদ্ধ হলো। এরেনের চাহনি দেখে ইলোরার আত্মা কেঁপে উঠল। উত্তেজনা তো আরো একধাপ বেড়ে গেল। রনি এরেনকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করল,“টাস্কি খাইলি কেন? কী লেখা আছে?”

এরেন ইলোরার মুখে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলে উঠল,“আই লাভ ইউ।”

রনি আর ইলোরা দুজন একসাথে চমকে উঠে চোখ ছানাবড়া করে তাকাল এরেনের দিকে। এরেন ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ইলোরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রনি ছোঁ মেরে এরেনের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে তাতে চোখ বোলালো। ইলোরার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“এসব কী ইলোরা?”

ইলোরা রনির হাত থেকে কাগজটা নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল। মুহুর্তে তার দু’চোখ ছলছল করে জলে ভরে গেল। গলা দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারল না। এরেন আর রনি এখনও অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মুখেও আর কোনো কথা নেই। চেষ্টা করেও ইলোরা চোখের জল আটকাতে পারল না। দু’চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই এরেন হঠাৎ বলে উঠল,“কে বলেছে এটা দিতে?”

ইলোরা চুপ হয়ে গেল। এরেন আবার শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল,“বলো। কে বলেছে?”

ইলোরা উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে তার প্রচন্ড ভয় লাগছে। ঐ ছেলেগুলোর কথা বললে যদি তারা ওর কোনো ক্ষতি করে দেয়। এরেনকেও তো মিথ্যে বলতে পারবে না। সে পড়ে গেল দোটানায়। এরেন এবার কিছুটা জোরে বলল,“চুপ করে থেকো না। এটা তোমাকে কে দিতে বলেছে বলো। আমি জানি তুমি র্যাগিং এর শিকার হয়েছো। এসব কমন ব্যাপার। তাই নির্ভয়ে বলতে পারো। কান্না বন্ধ করে বলে ফেলো।”

রনি বলল,“বলো ইলোরা। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আরে আমরাও তো সিনিয়র। কোনো সমস্যা নেই। কেঁদো না প্লিজ।”

ইলোরা এবার মুখ খুলল। চোখের পানি মুছে পেছন ফিরে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে বলল,“ওই যে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, ওনারাই বলেছে। ওই আপুটা এটা লিখেছে। আর ওই সামনের ভাইয়াটা আমাকে ডেকে এটা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। আমাকে ধমক দিয়ে ভয়ও দেখিয়েছে।”

ইলোরার বলতে দেরি হলো কিন্তু এরেনের তেড়ে যেতে দেরি হলো না। চোখের পলকে এরেন তেড়ে গিয়ে সামনের ছেলেটার শার্টের কলার চেপে ধরল। ছেলেটা যেন এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল। সেও দুহাতে এরেনের শার্টের কলার চেপে ধরেছে। রনি আর ইলোরা এটা দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। ততক্ষণে অরিশাও দৌড়ে এগিয়ে এসে ইলোরার পাশে দাঁড়াল। ঘটনা সম্পূর্ণ না জানলেও সে কিছুটা আঁচ করতে পারল। এরেন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“মানসিকতা এত খারাপ কেন তোর? তুই ভালো করেই জানতি ও সাকিবের বোন। আর তাই ওকে নিয়ে মজা করছিস। যেচে আমার সাথে ঝামেলা বাঁধাতে চাইছিস? ইচ্ছে তো করছে তোকে……….।”

রনি দৌড়ে গিয়ে ওই ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে এরেনকে টেনে দূরে সরিয়ে আনলো‌। এরেন রাগে ফুঁসছে। ওই ছেলেটা আবার তেড়ে আসতেই রনি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে দুহাত দিয়ে টেনে ধরে চাপা স্বরে বলল,“দেখ, তোরা ইচ্ছে করে আগ বাড়িয়ে আমাদের সাথে লাগতে এসেছিস। এই মুহূর্তে আমরা কোনো ঝামেলা চাইছি না। সাকিবের সাথে তোর ঝামেলা হয়েছে বলে এর মধ্যে ওর বোনকে কেন টানছিস? মেয়েটা এসব কিছু জানে না। তাই বলছি ভালোয় ভালোয় সরে যা। সাকিব জানতে পারলে পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে যাবে। এরেন তোদের সাথে ঝামেলায় জড়াতে চায় না। ওকেই বা ইচ্ছে করে কেন রাগিয়ে দিচ্ছিস? মিনিমাম সেন্সটুকু নেই তোদের?”

ছেলেটা রনির কলার চেপে ধরে রাগত কন্ঠে কিছু বলল। ইলোরা ওদের কারোর কথাই শুনতে পেল না। শুধু দেখল ছেলেটা রনিকে কিছু বলে তারপর দলবল নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। ওরা চলে যেতেই রনি এগিয়ে এসে এরেনের কাঁধে হাত রেখে বলল,“ইটস ওকে। আর রেগে থাকিস না। ওরা তো এমনিতেই মূর্খ।”

এরেন মাথা দুলিয়ে ইলোরার দিকে ফিরে তাকাল। ইলোরা আর অরিশা ভীত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এরেন জোরে শ্বাস নিয়ে শান্ত স্বরে বলল,“ভয় নেই। ওরা ফালতু ছেলে-মেয়ে। যেচে ঝামেলা বাঁধানোই ওদের কাজ। নেক্সট টাইম ওরা কিছু বললে একদম ভয় পাবে না। সোজা আমাদের জানাবে। ওকে?”

অরিশা দ্রুত বলে উঠল,“ওকে ভাইয়া।”

এরেন আবার বলল,“ক্লাসে যাও।”

ইলোরা কোমল দৃষ্টিতে সরাসরি এরেনের চোখের দিকে তাকাতেই তার সাথে চোখাচোখি হলো। এরেন সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াল। অরিশা ইলোরার হাত ধরে সামনের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,“চল।”

ইলোরা অরিশার সাথে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েও কী মনে করে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। এরেন এখনও অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারল এরেন আর তার দিকে তাকাতে চাইছে না। হয়তো অস্বস্তি বোধ করছে। ইলোরা একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে অরিশার সাথে পা মিলিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল। এরেনের হাতের মুঠোয় এখনও ইলোরার দেয়া কাগজটা ধরা আছে।‌ এরেন কাগজটা আরেকবার চোখের সামনে মেলে ধরে আনমনে ভাবল,‘লেখাটা সত্যি হলে মন্দ হতো না।’ পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে কাগজটা হাতে মুড়িয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

চলবে……………………..🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here